মন

আনোয়ারা সৈয়দ হক

 

সামিনার কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল মাহিদুল, নাসিরও চলে গেছে!

কথা শুনে যেন একটু চমকে উঠল সামিনা। আজকাল প্রায় সে সামান্য ব্যাপারেই চমকে চমকে ওঠে। অস্ফুটে বলল, কবে, কখন, কীভাবে?

সাতক্ষীরা বর্ডার দিয়ে। আমাকেও বলেছিল যেতে।

কেউ কোথাও শোনার নেই, তবু কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে উঠল মাহিদুল।

তো তুমি তার সঙ্গে গেলে না? একটু যেন হতভম্ব হয়ে বলে উঠল সামিনা।

সামিনার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবে মাহিদুল বলল, না। তোমাকে এভাবে একা ফেলে –

কথা বলে আড়চোখে সামিনার শরীরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে।

সামিনা তার কথা বুঝে একটু যেন জড়োসড়ো হয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক।

মাহিদুল বলল, তাছাড়া কতদিন এরকম চলবে কেউ তো বলতে পারে না। যে-কোনো যুদ্ধ তো এক-দুই বছরে শেষ হয় না। কোনো কোনো যুদ্ধ তো যুগের পর যুগ চলছে। তার ওপর এটা হলো মুক্তিযুদ্ধ, কিন্তু মুক্তি কীভাবে আসবে কেউ তো সঠিক বলতে পারছে না। মাঝখান থেকে কিছু মানুষের প্রাণ নিধন হচ্ছে। এই তো গত সপ্তাহেই বিহারিরা রাজাবাজার থেকে তিনজন জোয়ান ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর তাদের আর খোঁজ পাওয়া গেল না।

তার কথা মন দিয়ে শুনল সামিনা। খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা। উত্তরে কিছু বলল না।

একটু চুপ করে থেকে আপনমনে বলল মাহিদুল, গত এপ্রিলে গেল টুলুভাই, তারপর গেল রিয়াজ, তারপর গেল মোসাদ্দেক, এখন এই জুন মাসে আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড নাসিরও চলে গেল আগরতলা সীমান্ত দিয়ে।

কীভাবে গেল?

সামিনার ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন শুনে একটু যেন থমকে গেল মাহিদুল। তারপর বলল, যেভাবে সকলে যায়। বলতে পারো মৃত্যু হাতের মুঠোয় ভরে নিয়ে। যে-কোনো মুহূর্তেই জীবন শেষ হতে পারে এ-কথা মনে মনে জেনে। নাসির অবশ্য বলেছিল সীমান্ত পেরোবার আগে সে একমুঠো মাটি তুলে নিয়ে যাবে দেশের। কোনোদিন যদি আর ফিরতে না পারে!

তার কথা শুনে দৃশ্যতই একটু কেঁপে উঠল সামিনা। স্ত্রীর আতঙ্ক দেখে মৃদুস্বরে মাহিদুল বলল, আমিও হয়তো যেতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো যেতে পারিনে। তুমি তো আছোই, তার ওপর আমাকে দেশে টাকা পাঠাতে হয়। সরকারি চাকরি। অনেক সরকারি চাকরিজীবী কিছুদিন থেকে আবার ফিরে এসে কাজে জয়েন করেছে। নইলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে কতদিন মানুষ নিজেকে ছেড়ে দিতে পারে?

কথা ঠিক। মাহিদুলের পরিবারে তার বাবা বুড়ো অথর্ব একজন মানুষ। তার মাকে সংসারের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে দেখতে হয়। মাহিদুলের বাবার এই বয়সে এত বৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত রোগে তার হাত-পাগুলো সরু হয়ে গেছে, যেজন্য তিনি বাইরে বেরোতে পারেন না। হাঁটতেও পারেন না। সেজন্যে মাহিদুলের মাকেই সংসারের হাল ধরে রাখতে হয়। সন্তানদের ভেতরে মাহিদুল সকলের বড়।

অবশ্য যেখানে তারা এই সেদিন পর্যন্ত ছিলেন, সেই শহরটাও এখন কোনো শান্তিতে নেই। প্রায়ই রাতের বেলা বাড়ির দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঘর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মাহিদুলের মা-বাবা তাদের অন্য তিনজন ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন গ্রামের দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও টাকা পাঠাতে হয়। নইলে কতদিন আত্মীয়ের আপ্যায়নে দিন কাটাবে?

তবু যেন সবকিছু ভুলে সামিনা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, তোমার যেতে ইচ্ছে করে না?

নাঃ। মাথা ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল মাহিদুল। তারপর কী ভেবে বলল, ওদের সিদ্ধান্ত ভুল কি না, আমি এখনো ঠাওর করতে পারছিনে। এতবড় একটা দেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধ করাটা কি ঠিক হচ্ছে? পাকিস্তানের সৈন্যবল তো কম নয়। কতদিন আর ভারত এদেশের মানুষকে সাহায্য করবে? এখনই তো শুনতে পাচ্ছি ভারতের সীমান্তের আশ্রয়শিবিরে ডায়রিয়া, অপুষ্টি আর জ্বরজারিতে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি হয়তো গেলাম, কিন্তু আর ফিরে আসতে পারলাম না। শেষমেশ আমও গেল ছালাও গেল!

 

কথা শেষ করে সামান্য হাসল মাহিদুল। মাহিদুলের একটা অভ্যাস আছে এই প্রবাদটা বলার। যে-কোনো কথার ভেতরে ফাঁক পেলে এই প্রবাদটা সে ঢুকিয়ে দেয়।

 

মাহিদুলের কথা শুনে ভাবতে বসল সামিনা। তার এক দূরসম্পর্কের চাচা আওয়ামী লীগ করতেন, গত এপ্রিলেই তাকে তার গ্রামের বাড়িতে হানা দিয়ে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছে।

এখন দেশজুড়ে সহিংসতা। এখন দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ। ছাবিবশে মার্চেই দেশ স্বাধীন। কিন্তু হানাদারমুক্ত হয়নি এখনো। কবে হবে কেউ বলতে পারে না। আদৌ হবে কিনা সে-বিষয়েও যথেষ্ট মতভেদ আছে বাঙালিদের ভেতরেই। এর ভেতরেই মানুষেরা কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে গ্রাম থেকে ফিরে এসে আবার চাকরি-বাকরি করছে। কেউ কেউ পাকিস্তানের দালাল সেজে বসেছে। এদেশে দুই যুগ ধরে বসবাস করা বিহারিরা হঠাৎ করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যেন জেহাদে নেমেছে। পাকিস্তানিদের চর হয়ে তারা বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকে তাদের অত্যাচার করছে। সেসব অত্যাচারের বর্ণনা শুনতে চায় না সামিনা। তার বুক ধড়ফড় করে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এই পাড়ায় কখন যে কে হানা দেবে, দালাল বাঙালি না বিশ্বাসঘাতক বিহারি, কে বলতে পারে?

একদিন মাহিদুলকে সে মুখ ফুটেই বলল, এখানে, এই পাড়ায় থাকতে আমার ভয় করে, মাহি।

কেন, কেন? উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠল মাহিদুল।

তুমি বরং আমাকে আমার খালার কাছে গ্রামে রেখে এসো। সেখানেই না হয় আমার বাচ্চাটা হোক। আমার খালা নিজেও মেয়েদের অনেক ডেলিভারি করিয়েছেন।

তাই কি হয় নাকি? হাজার হোক এটা আমাদের প্রথম বাচ্চা, সামি। মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর নিজের হাতে তোমার ডেলিভারি করাবেন।

কথাটা শুনে মনে মনে সামান্য স্বস্তি পেল সামিনা। কিন্তু তা অল্পক্ষণের জন্যে।

তার মনে পড়ল পঁচিশে মার্চের সেই রাতের কথা। সেই কালরাত যেদিন হাজার হাজার বাঙালি প্রাণ দিয়েছিল এই ঢাকা শহরেই।

তারা যখন সঙ্গমে লিপ্ত তখন ঢাকার রাস্তায় পাকিস্তানি মিলিটারির ট্যাঙ্ক ও মেশিনগানের গুলির শব্দ কানে ভেসে এসেছিল ওদের। প্রথমে সচকিত হয়েছিল সামিনা। স্বামীকে হঠাৎ ধাক্কা মেরে বলে উঠেছিল, শুনতে পাচ্ছ?

কী? মহাবিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিল মাহিদুল।

সেই চরম মুহূর্তে কোনো কিছু শুনতে মাহিদুল রাজি ছিল না। কিন্তু সামিনার স্বভাবের ভেতরে অতিসতর্ক ভাব বিয়ের পর থেকেই সে লক্ষ্য করেছে। বিয়ে তাদের বছর দুয়েকের মতো হয়েছে। আগে থেকে চেনাশোনার বিয়ে নয়। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধে হয়নি। মন থেকেই বাবা-মায়ের পছন্দ করা বিয়েকেই তারা মেনে নিয়েছে।

মাহিদুলের বিরক্তিজনক কী-র পরপরই তাদের পুরো এলাকাটা কে যেন ফ্ল্যাশবম্ব মেরে সাদা করে তুলেছিল। রক্তহীন সাদা একটি দিনের মতো আলো।

আরে ব্যাপারটা কী? বলে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমেছিল মাহিদুল। আর তার পরমুহূর্তে কানে ভেসে এসেছিল মানুষের মরণ আর্তনাদ।

অ্যাই শোনো, বাইরে বেরিয়ো না, বলে চিৎকার করে উঠেছিল সামিনা।

সেও তখন নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরের মেঝেয় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাহিদুল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, দাঁড়াও, আগে লাইটটা জ্বালাই।

না, না, না, বলে চাপাস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল সামিনা। রাস্তার সামনেই তখন ট্যাঙ্কের ঘড়ঘড় আওয়াজ কানে এসেছিল। এটা যে ট্যাঙ্ক, এটাও তারা তখন জানত না। ট্যাঙ্ক জীবনে তারা সচক্ষে কোনোদিন দেখেনি, এমনকি সিনেমাতেও নয়। কোনো প্রকারের যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা তখন ছিল না। তাদের কারো বংশে কেউ কোনোদিন সামরিক বাহিনীতে কাজ করেনি। সামরিক জীবনের সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না।

 

কিন্তু সেসব কয়েক মাস আগের কথা। এখন তাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন তারা দূর থেকেই বুঝতে পারে কোনটা বন্দুকের গুলি, কোনটা স্টেনগানের, কোনটা মর্টার আর কোনটা ট্যাঙ্ক। এখন তারা রাতের বেলা ফিসফিস ছাড়া কথা বলে না। ঘরে বাতি জ্বালায় কম। প্রায় সময় ঘরদোর অন্ধকারে রাখে। খুব লো ভলিউমে স্বাধীন বাংলা রেডিও শোনে। এসব হলো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।

মাহিদুল এসব ব্যাপারে খুব সাবধান। কারণ সমস্ত শহরে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, মানুষের হৃৎপিন্ড বুঝি এই পরিবেশে থাকতে থাকতে স্ফীত হয়ে উঠছে!

বুঝি এই অবস্থা থেকে কোনোদিন নিস্তার পাওয়া যাবে না। কিংবা আর কতদিনে নিস্তার পাওয়া যাবে?

 

একদিন কাজ থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাহিদুল বাড়ি ফিরল। বাড়িটা চারতলা একটা ভাড়াবাড়ি। মাহিদুলরা তিনতলায় থাকত। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে সামিনা বেশি নিচে নামত না। বাজারঘাট যা করার সব করত মাহিদুল।

দোতলার ভাড়াটেরা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গ্রামে চলে গিয়েছিল। শোনা গিয়েছিল তাদের বড় ছেলেটি নাকি আগরতলায় গিয়ে যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিচেছ। সেদিন কথাটা শুনে মনে মনে খুব উদ্দীপিত বোধ করেছিল সামিনা। স্বামী ফিরলে সে গর্বের হাসি হেসে বলেছিল, শুনছো, সেই ছোট্ট পিন্টু-খোকা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্যে আগরতলায় নাকি ট্রেনিং নিচ্ছে। এই সেদিন না সে অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে তিনতলায় উঠতে পারত না?

স্ত্রীর কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল মাহিদুল। বলেছিল, হ্যাঁ, পিন্টু হবে আবার মুক্তিযোদ্ধা, কী যে বলো! তোমার বাস্তব বুদ্ধি খুব কম বুঝলে?

সামিনা প্রতিবাদ করে বলেছিল, কেন হতে পারবে না? ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে তারা শুনেছি যুদ্ধক্ষেত্র রেকি করায়, ছালার ভেতরে গ্রেনেড ভরে তাদের হাতে দেয় ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যে।

আবার শুনি ছোট ছোট অনেক ছেলে নাকি আগরতলায় গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করবে বলে। তাদের বলে বিচ্ছু। স্বাধীন বাংলা রেডিওতে তো হরদম এসব কথা বলছে।

স্ত্রীর কথা শুনে মিষ্টি হেসে মাহিদুল বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষ, বুঝলে? যুদ্ধের সময়, তা যে কোনো যুদ্ধ হোক না কেন, ছোট বা বড়, একটা ওয়ার প্রোপাগান্ডা বলে কথা আছে। কেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েবলসের কাহিনি শোনোনি। সে বলত, একটা মিথ্যা কথা দশবার বলার পর তা শুনতে শুনতে সত্যি হয়ে যায়! আসলে যুদ্ধ যদি বলো, তাহলে সেটা করবে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী। এইসব বাঙালির নাম ধরে তারাই করবে আসল যুদ্ধ। বাঙালিরা যুদ্ধের কী জানে বলো তো?

মাহিদুলের কথা শুনে মনে মনে মুষড়ে গিয়েছিল সামিনা। মাহিদুলের কথা একেবারে ফ্যালনা যে নয়, এরও কিছু সত্যতা আছে, সেটা একেবারে অস্বীকার করবে, এরকম সাহস তার হয়নি সেদিন।

এর ভেতরে একদিন মাহিদুল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অফিস থেকে বাসায় ফিরল। বাসে করে রোজ সে অফিস যায় এবং ফেরে। অফিসে বিহারি পিয়নদের ঔদ্ধত্য এবং অসহযোগিতার কথা বলে। সেদিন ফিরে একেবারে হাত-পা অবশ হয়ে বসে পড়ল মাটিতে।

উদ্বিগ্ন হয়ে সামিনা স্বামীর কাছে মাটিতে বসে পড়ে বলে উঠল, তোমার কী হয়েছে বলো তো?

আমার, আমার, মানে আমাদের বাস মাঝপথে থামিয়ে চারজন বিহারি বাসের তিনজন বাঙালিকে নামিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমার ঠিক পাশের একজনকেই তুলে নিয়ে গেল তারা।

তারা কী যে করুণ মুখ করে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল, সামি! কথাটা বলে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাহিদুল। চোখ ভরে পানি চলে এলো তার।

স্বামীর কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে সামিনা বলল, থাক, কাল থেকে তোমার আর কাজে গিয়ে দরকার নেই। চলো, আমরা গ্রামে পালিয়ে যাই। তারপর সেখান থেকে বর্ডার পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। না খেয়ে থাকবো সেটাও ভালো, তবু আতঙ্কের ভেতরে এত দীর্ঘদিন থাকতে পারবো না।

তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, জানো, আজকাল তুমি অফিসে চলে গেলেই সারাটা দিন আমি অস্থির এক আতঙ্কে থাকি। মনে হয়, এই বুঝি কেউ তিনতলায় এসে দরজার বেল টিপল। হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আর দেখাও হলো না!

এত ভয় করে না সামি। নিজেকে সামলে নিয়ে মাহিদুল স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বলল।

সামিনা বলল, তবু আমার ভয় করে। তাছাড়া আমার কেমন যেন লাগে। দেশের এত মানুষ যুদ্ধে গেছে, আর আমরা নিশ্চুপ পড়ে আছি। একবার দেশে যেতে পারলে, বর্ডার তো বেশিদূরে নয়। যুদ্ধ হয়তো করলাম না, কিন্তু দুর্গত ভাইবোনদের সঙ্গে তো থাকতে পারি!

সামিনার কথা শুনে চকিতে একবার তার স্ফীত পেটের দিকে তাকিয়ে মাহিদুল গলায় একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ তুলে বলল, তুমি না সামি, ভারি রোমান্টিক সব কল্পনা করো। বাস্তবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আমি দেখি নে। আরে, দুর্গত বাঙালি, যাদের তুমি ভাইবোন বলছ, সে-পর্যন্ত পৌঁছতে তো হবে?

তা যদি না হয়, তাহলে অন্তত আমরা এখান থেকে সরে যেতে তো পারি? যেন নাছোড়বান্দা হয়ে বলে উঠল সামিনা।

তা হয় না, সামি। করুণ মুখ করে বলে উঠল এবার মাহিদুল। এভাবে হঠাৎ করে পালিয়ে গেলে আমাদের শহরে যে-বাড়ি আছে সেটা হয়তো পাক সেনারা আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে। আমার মা-ভাইবোনদের ধরে নিয়ে যাবে। তখন কী হবে? এখানে তো আমরা দুজনে মোটামুটি সেফ। আমার যাতায়াতের জন্যে সরকারি পাশ আছে, আইডেন্টিটি কার্ড আছে, মহল্লার শান্তি কমিটির সার্টিফিকেট আছে। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই, কোনোদিন ছিলাম না। আমি, সত্যি বলতে এখনো অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করি, মানে এই কিছুদিন আগেও করতাম, কিন্তু এখন আর করিনে। এখন কী যে বিশ্বাস করি, তাও ঠিক বুঝতে পারিনে। ধরো, তোমার কথা শুনে তোমার এই অবস্থায় পাড়ি দিলাম কুমিল্লা, তারপর মাঝপথে ধরে নিয়ে গেলে কী হবে? শুনি ওরা নাকি ঘাটে ঘাটে চেকআপ পয়েন্ট বসিয়েছে। প্রতিদিন কাউকে না কাউকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে চালান দিচ্ছে মিলিটারি ক্যাম্পে। বোরকাপরা মেয়েদের মুখ খুলে খুলে ওরা দেখে আজকাল।  গর্ভবতী মেয়েদেরও নিস্তার নেই। তখন তো আমও যাবে, ছালাও যাবে!

এবার বুদ্ধি করে সামিনা বলে, জানো মাহি, রেডিওতে সেই যে কতদিন আগে শুনলাম যে, বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদ গণমাধ্যমে আদেশ জারি করেছেন, এখন আমরা যদি কোনোরকমে গ্রামে পালিয়ে গিয়ে ওপারে মানে ভারতে যেতে পারি, তারপর তুমি যদি বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করো, তাহলে সেই অস্থায়ী সরকারের কোনো না কোনো কাজ তুমি করতে পারবে। তোমার মতো বিচক্ষণ কর্মকর্তার দরকার আছে তো এই নতুন সরকারের।

চুপ, চুপ, চুপ, ঝটিতি মাটি ছেড়ে উঠে বসে বলে উঠল মাহিদুল। ঘর বন্ধ, তবু সামিনার মুখের দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, রাস্তাঘাটের কী যে অবস্থা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, সামি। জায়গায় জায়গায় ওদের চেকপোস্ট বসিয়েছে। এইভাবে হঠকারী কাজ করতে গিয়ে কত বাঙালি যে পাকিস্তানি আর বিহারিদের হাতে পড়েছে, তার ঠিক নেই। বরং যে যেখানে আছি সেখানেই চুপচাপ থেকে যাওয়া ভালো। আমি কী ভাবছি, জানো?

কী? একটু যেন হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল সাবিনা।

আমি কাল থেকে দাড়ি রাখতে শুরু করবো! যত যা-ই বলো, আমরা যে সত্যিকারের মনে-প্রাণে মুসলিম, বাইরে থেকে কিন্তু ঠিক বোঝা যায় না। হলোই-বা বাংলা ভাষার জন্যে বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছে, তার মানে তো এই নয় যে, আমরা মুসলমান নই। বরং আমি তো মনে করি, পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে আমরা বাঙালিরা বেশি মুসলমান। তোমার কী মনে হয়?

সামিনা কী যে বলবে ঠিক যেন বুঝতে না পেরে মাহিদুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

 

সামিনা মনে মনে যা আশঙ্কা করেছিল, ঠিক তা-ই হলো। কিছুদিন থেকেই তার মনে হচ্ছিল যেন পেটের বাচ্চাটা আর আগের মতো নড়াচড়া করে না। কিন্তু কী করবে বা ডাক্তারের কাছে যাবে কিনা, ভাবতে ভাবতেই একদিন দুপুরবেলা তার পেটব্যথা শুরু হলো। অথচ গর্ভ তখন মাত্র ছ-মাসও পুরো হয়নি। আর যখন ব্যথা শুরু হলো তখন তার আশেপাশে কেউ নেই। দোতলার ভাড়াটেরা বাড়ি ফেলে রেখে গ্রামে চলে গেছে। সেখানে নতুন কোনো ভাড়াটে আর আসেনি। চারতলার বাসায় কোনো মহিলা থাকে না। সেখানে তিনজনই পুরুষ। তারা তাদের মহিলাদের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। নিজেরা শুধু রুজি-রোজগারের জন্যে ঢাকায়। একেবারে নিচের তলাটায় দুটো মনিহারি দোকান। কিন্তু ইদানীং দোকান দুটো প্রায় বন্ধই থাকে।

সামিনা এখন কী করে। তার পেটব্যথা বাড়তে লাগল শনৈঃশনৈঃ। বড় উচ্চকিত এক ব্যথা। এরকম ব্যথার সঙ্গে তার আগে কোনোদিন পরিচয় হয়নি। সে মায়ের নাম ধরে কাঁদতে শুরু করল। তার মা বহুদিন হলো মৃত। তার খালাকেই সে মায়ের মতো দেখে। কিন্তু খালা তাকে মার্চ মাসের পর থেকে বারবার ডেকে পাঠালেও মাহিদুলের সিদ্ধান্তে তার সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এখন গর্ভ পুরো হওয়ার আগেই এই ব্যথা শুরু হয়ে গেল। নিজের চেয়েও নিজের গর্ভজাতের জন্যে শঙ্কা হতে লাগল সামিনার ভেতরে। একসময় বাথরুমে যাওয়ার পথে পেট থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা রক্তাক্ত পিন্ড। ভয়ে এবং আশঙ্কায় ব্যাকুল হয়ে সামিনা তাকিয়ে দেখল পিন্ডটাকে। ছোট্ট একটি অপরিপক্ব শিশু। তখনো তার চোখ ভালো করে ফোটেনি। তাকিয়ে দেখে ফিট লাগল সাবিনা।

 

পুরো ন-মাস ধরে যুদ্ধ চলল বাংলাদেশে। হাটে-মাঠে খানাখন্দে হাওরে-বাঁওড়ে জলায়-ডাঙায় যুদ্ধ চলল অবিরাম। তারপর স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। লাল-সবুজের বন্যায় ছেয়ে গেল দেশ। বিবিসি রেডিওতে দুপুরের দিকে যখন ঘোষণা দিলো দেশ স্বাধীন, পাকিস্তানি সৈন্যরা নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে যৌথবাহিনীর কাছে, তখন বাড়ি থেকে ছুটে বেরোতে লাগল মানুষ। হাজার হাজার মানুষ। ক্রমশ তারা লাখো মানুষে পরিণত হলো, তারপর কোটি। পরে কোটির সংখ্যাও যেন ছাড়িয়ে গেল। বুড়ো অথর্ব মানুষেরা যারা বাইরে বেরোতে পারে না, তাদের পাঁজাকোলা করে ছাদে তোলা হলো, তারা ছাদে দাঁড়িয়ে বা বসে রাস্তার মানুষের আনন্দ হই-হল্লা তাকিয়ে দেখতে লাগল। যেন অবিশ্বাস্য হয়ে গেল সবকিছু, আবার সবকিছু বিশ্বাসও হতে লাগল। যেন অবাস্তবের ডানায় চড়ে মানুষেরা বাস্তবের সাম্পানে পাড়ি দিতে লাগল স্বপ্নের নদী। বা একে অপরের বিপরীত। বা সবকিছু মিলিয়ে সবকিছু। বা হয়তো কিছুই না। এতবড় দুঃখ-দুর্দশার পর মানুষেরা যেন হতভম্ব কেউ কেউ। হাসবে কি কাঁদবে কি আহাজারি করবে স্বজন হারানোর শোকে ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছে না।

কিছুক্ষণের ভেতরে মাথায় লাল রুমাল বা গামছা বা খালি মাথায়, খালি পায়ে পিলপিল করে রাস্তায় এসে হাজির হতে লাগল মুক্তিযোদ্ধারা। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিক থেকেই তারা যেন হাজির হতে লাগল। তাদের চেহারা দশাসই কিছু নয়। তারা কালো, বেঁটে, রোগা, মলিন লুঙি বা ছেঁড়াখোঁড়া প্যান্ট বা হাফপ্যান্ট পরা। তাদের অধিকাংশের খালি পা, পা ভর্তি ধুলো; তাদের বয়স কারো চৌদ্দ, কারো ষোলো, কারো একুশ, কারো তেইশ, কারো বা শুধু দশ। শুধুই দশ! তাদের কারো কারো মুখে দাড়ি-গোঁফেরও চিহ্ন নেই, যেহেতু তারা তখন পর্যন্ত মুখে ওঠার সময় পায়নি। তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতে মেশিনগান বা এলএমজি বা এসএমজি বা স্টেনগান, বা গ্রেনেড বা কিছু না কিছু। কারো কারো হাতে শুধু লাঠি বা দা। একজন খালি পা মুক্তিযোদ্ধার হাতে শুধু একগাছি দড়ি। ওই যে ইতিহাসের এক মহানায়ক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে, ঠিক যেন তাই। স্বপ্ন কি বাস্তব কি রহস্য কি, ঠিক যেন তাই। আনন্দ বা বিষাদ বা স্ফূর্তি, বা রাগ বা ঘৃণা, কিছুই আর কিছু না, যেহেতু বাঙালি জাতি আজ থেকে স্বাধীন।

 

দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মানুষের আনন্দ, কান্না,  চিৎকার-চেঁচামেচি, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা সুখের কান্না, সব তাকিয়ে দেখছিল সাবিনা। প্রায় চার মাস আগে তার একটি গর্ভপাত হয়ে গেছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, অতিরিক্ত অনিশ্চয়তায় ভোগার কারণে। হয়তো গ্রামে গেলে তার এরকম কান্ড ঘটত না। অথবা কে জানে হয়তো ঘটতও। কোনোকিছু সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রথম কদিন মনমরা হয়ে থাকার পর ক্রমাগত যখন দেশের আসন্ন মুক্তির খবর তার কানে আসতে লাগল, সে ভুলে গেল তার ব্যক্তিগত হারানোর কথা। সে ইদানীং গুনগুন করে গানও গাইতে শুরু করেছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করত মাঝে মাঝে। বিএ পাশ করা মেয়ে সে। স্বাধীন দেশে সে যে চুপ করে ঘরের ভেতরে বসে থাকবে না – এরকম কিছু স্বপ্নও তার মনে খেলা করত মাঝে মাঝে।

গত কয়েকদিন ধরে অফিসে যায়নি মাহিদুল। যাওয়ার মতো পরিবেশও ছিল না। আকাশে দিবারাত্রি যৌথবাহিনীর আক্রমণ। সকলে যে যার প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। তার ভেতরেই চাপা এক বিজয়োল্লাস। এ-আনন্দ চেপে রাখার মতো নয়। কিন্তু শত্রুর ভয়ে চেপে রাখতে হয়েছিল। আজ সবকিছু বাঁধনহারা হয়ে গেছে যেন। মাহিদুল ছুটে বেরিয়ে গেছে রাস্তায়। যাকেই সামনে পাচ্ছে তার সঙ্গেই সে কোলাকুলি করছে। তার আগে বাথরুমে গিয়ে গালের দাড়ি-গোঁফ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছে! তার কেন জানি মনে হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের দাড়ি-গোঁফের চেয়ে তার দাড়ি-গোঁফের চেহারা আলাদা!

এ সবই তার মনের বাঁকাচোরা ভাবনার কারবার। বাইরের কেউ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। মাহিদুলও এটা ভালো করেই জানে। কিন্তু আজ এই বিজয়ের দিনে তার স্ফূর্তি দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে সামিনা। সে ব্যালকনি থেকে সবকিছুই লক্ষ্য করছে।

একসময় এক পুরনো বন্ধুকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে তাকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে এলো মাহিদুল। বন্ধুর মাথায় লাল গামছা বাঁধা। হাতে রাইফেল। চিৎকার করে সিঁড়ি দিয়ে তেতলায় উঠে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সে ঘরে ঢুকল। সামিনার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো, দেখে রাখো আমার ছেলেবেলার বন্ধু এরফান। কতবড় মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরেছে সে আজ। কী রে, কোন সেক্টরে তুই যুদ্ধ করেছিলি দোস্ত? আমারও কত যে ইচ্ছে ছিল যুদ্ধে যাওয়ার, কিন্তু আমার কপাল খারাপ, তোর ভাবি ঠিক সেইসময় হয়ে গেল প্রেগন্যান্ট! আর আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার আশা মাঠে মারা গেল! কিন্তু এদিকে বাচ্চাটাও ঠিকমতো পয়দা হলো না। ছ-মাসে পা দিতে গর্ভপাত হয়ে গেল। আমার আমও গেল ছালাও গেল।

এরফানের শরীরে ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড়। চোখের ভুরুতে বালি। জামাকাপড়েও বালি লেগে আছে। নদীর পাড় ভেঙে এসেছে সে। তার বাসা মণিপুরিপাড়ায়। এখনো সেখানে পৌঁছতে পারেনি। পথে পথেই অনেকটা সময় কেটে গেছে। ভিড়-ভাড়াক্কায় মানুষের অভিনন্দন নিতে নিতে সে এখন পরিশ্রান্ত।

ছেলেবেলার বন্ধু মাহিদুলের কথায় প্রাণভরে হেসে উঠল এরফান। বলল, যুদ্ধে যাসনি বেঁচে গেছিস দোস্ত। উঃ, সে কী কান্ড। বাঙালির ছেলে কোনোদিন বন্দুক-হাতে পথে-ঘাটে যুদ্ধ করবে ভেবেছিল কেউ, হ্যাঁ? আমার চৌদ্দ পুরুষেও এসব ভাবেনি। তবে বুঝলি দোস্ত, ঘাড়ে জোয়াল পড়লে ঠিকই টেনে নিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর অর্ডার মানতে হবে না?

ঠিক, ঠিক বলেছিস, ভাই। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল মাহিদুল। তারপর বন্ধুর রাইফেলে সতৃষ্ণ একটা হাত রেখে বলল, ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাক করে একবার ছাড় তো একটা গুলি? অনেকেই সেই দুপুর থেকে ছাদে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে রাইফেল নিয়ে আকাশে গুলি ছুড়ে আনন্দ করছে!

যাঃ, তাই কি হয় নাকি? ওরা সব ছেলেমানুষ, আমিও কি তাই? আমি তো একজন কমান্ডার। বলে উঠল এরফান।

অনেক জোরাজুরি করলেও এরফান কিছুই মুখে দিলো না। বলল, বাড়ি গিয়ে সে তার মায়ের হাতে গরম ভাত খাবে। তার জন্যে চিন্তা করতে করতে মা তার প্রায় মরতে বসেছিল।

এরফান বাসা থেকে চলে গেলে মাহিদুল বলল, বুঝলে সামি, আমার বন্ধুরা একেকজন শের-কা-বাচ্চা। এখনো তো নাসির, টুলুভাই, রিয়াজ, মোসাদ্দেক ফিরে আসেনি। ওরা ফিরে এলে আরো অনেককিছু ওদের মুখে শোনা যাবে। বাববাঃ, একটা দেশ স্বাধীন করে ফেলা, এটা কি চাট্টিখানি কথা, হ্যাঁ? তুমি কী বলো সামি?

 

গভীর রাতে যখন দেশের মানুষেরা আনন্দ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে, মাহিদুলের প্রাণের ভেতরে ঠিক সে-সময় যেন আবেগের ঢেউ উঠল। সে অন্ধকারে সামিনাকে হাতড়াতে হাতড়াতে বলে উঠল, অ্যাই, ঘুমোচ্ছ নাকি? আজকের এই বিশেষ রাতটা কি আমরা ভেজিটেবিল হয়ে ঘুমোবো? এসো, আমরা দুজনে মিলে এখন রাতটা সেলিব্রেট করি। মনে আছে সেই পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা যখন –

সামিনা তার ধাক্কা খেয়ে জেগে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি এক ধাক্কা সে এবার দিলো মাহিদুলকে। অন্ধকারে মাহিদুল খাট থেকে মাটিতে পড়তে পড়তে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আরে, তোমার হলো কী! আজকের দিনটা একটা বিশেষ একটা –

চোপ্, কাপুরুষ! অন্ধকারে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে বলল সামিনা।

দেয়ালঘড়িতে তখন ঢংঢং করে দুটো বাজল।