মাজহারুল ইসলামের সামগ্রিকতা

রবিউল হুসাইন

একজন বহুমাত্রিক পথিকৃৎ স্থাপত্যশিল্পী
বাংলাদেশের যে-স্থপতি সর্বপ্রথম এদেশে আধুনিক স্থাপত্যের সূচনা করেন তাঁর প্রখর সৃষ্টিশীল মেধা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে, তিনি হলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তিনি এদেশের স্থাপত্য পেশাচর্চার পথিকৃৎ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম দিকে, বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগার এবং চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের এই দুটি ভবনই এদেশের আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের প্রথম উদাহরণ এবং এই দুটি বিশিষ্ট স্থাপত্যকর্মের স্থপতি হচ্ছেন মাজহারুল ইসলাম। তখন তিনি সরকারি চাকরি করতেন। সরকারের অধীনেই ১৯৫৪ সালে এই ভবন দুটি নির্মিত হয়। দরিদ্র এবং যে-দেশের জনগণের শিক্ষার হার মারাত্মকভাবে কম, এমন একটি দেশে সেই সময়ে নির্মিত এই ভবন দুটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে অবাকই হতে হয়। পরিসরের বিভাজন, উপযোগিতার সঙ্গে উপকরণের সমন্বয় সাধন এবং সর্বোপরি চারপাশে বিরাজমান নিসর্গের সঙ্গে মেলবন্ধে এই কাজ দুটি এদেশের স্থাপত্যজগতের দৃষ্টান্তমূলক মাইলফলক। হয়তো পৃথিবীর স্থপতিগুরু লে কর্বুসিয়ের বা আলভার আলটুর পরোক্ষ প্রভাব এ-কাজে দেখা যেতে পারে তথাপি, বর্তমান স্থাপত্যশিল্পের যে অবস্থা, সেদিক দিয়ে বিচার করলে ওগুলোর মান উন্নত তো বটেই বরং দেশের পরিপ্র্রেক্ষিতে তা একটি ধ্র“পদী উদাহরণ হিসেবে বিরাজ করছে।
স্থাপত্যশিল্পের বেশ কয়েকটি বিষয়ে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়ে থাকে, যেমন তিনি এদেশের প্রথম আধুনিক স্থপতি ও প্রথম স্থাপত্যপেশা চর্চার পথিকৃৎ তো বটেই, তিনি এদেশের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি এবং স্থাপত্য প্রতিযোগিতার বিচারক। তিনি স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি এদেশের স্থাপত্যশিক্ষা বিশেষ করে স্থাপত্যচর্চার জন্য নবীন স্থপতিদের সম্মুখে পৃথিবীবিখ্যাত স্থপতিদের কাজের দৃষ্টান্ত রাখার জন্য তাঁদের দ্বারা ভবন নির্মাণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিলেন। এই নীরব, আত্মপ্রচারবিমুখ, নিরঙ্কুশ স্থাপত্যশিল্পীর জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ১৯৪২ সালে বিএসসি পাস করে প্রথমে তিনি শিবপুরের রয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে পুরকৌশলে ১৯৪৬ সালে স্নাতক হন। এরপর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কন্সট্রাকশন, বিল্ডিং অ্যান্ড ইরিগেশন (সি বি অ্যান্ড আই) বিভাগের প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এই বিভাগে কর্মরত অবস্থায় স্থাপত্যপেশায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেন এবং ১৯৫৩ সালে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে জুনিয়র সহ-স্থপতি হিসেবে পুনরায় সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৭ সালে লন্ডনের এ অ্যান্ড এ স্কুলে ট্রপিক্যাল স্থাপত্যবিষয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ইতিমধ্যে এদেশে তাঁর সেই দুটি পৃথিকৃৎ ভবন নির্মিত হয়েছে।  সে-সময় যেহেতু দেশে কোনো উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত স্থপতি ছিলেন না, সেহেতু সরকার বিদেশি স্থপতিদের নিযুক্ত করেছিল বিভিন্ন সরকারি ভবনের নকশা করার জন্য। কিন্তু তাঁদের কাজ উচ্চমানসম্পন্ন হতো না এবং তাই তাতে আধুনিক স্থাপত্যের কোনো গুণাবলি থাকতো না। এই বৈরী পরিবেশে স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে একা সংগ্রাম করতে করতে এগোতে হয়েছে এবং ওই দুটি ভবন, যেখানে সেই সময়ের বিদেশি স্থাপত্যের প্রভাব পড়া খুব স্বাভাবিক কিন্তু পরবর্তীকালে অচিরেই তিনি এই প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব স্থাপত্যধারা প্রয়োগ করে বিশিষ্টতা লাভ করেন এবং এদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্য-ভাবধারাসংবলিত নান্দনিকতা, ব্যবহারিকতা ও উপকরণের সার্থক সমন্বয় করতে সফলকাম হন। তিনিই এদেশে ঐতিহ্যবাহী লাল পোড়া ইটকে লাইনবন্দি, সরাসরি, উন্মুক্ত পলেস্তরাহীন টালি বা টাইলের মতো করে পুরনো রীতিটি নবতররূপে উপস্থাপন করেন। এছাড়া স্থাপত্যে শিল্পকর্ম যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের দেয়ালে দেয়ালচিত্র সংযোজন করার প্রস্তাব এদেশে তিনিই প্রথম বাস্তবায়ন করতে পরামর্শ দেন, যার ফলে আমরা নভেরা আহমেদ এবং হামিদুর রহমানের দুটি কাজ সেখানে দেখতে পাই এবং এই শিল্পকর্ম স্থাপত্যশিল্পের সঙ্গে অন্যান্য শিল্পের সার্থক যোগাযোগের প্রয়াস বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সম্পন্ন করা সরকারের বহু স্থাপত্যকর্মের মধ্যে উপরোল্লিখিত দুটি প্রকল্প ছাড়া অন্য প্রকল্পগুলো সরকারি লাল ফিতার কারণে কোনোদিন বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য শুরু হয় এবং এ কারণে ১৯৫৭ সালে তিনি চাকরি থেকে ছাড়পত্র নিতে আবেদন করেন, কিন্তু সে-পত্র তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। অতঃপর স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার জন্যে সরকারি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং ১৯৬১ সালে ফিরে এসে আবার সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এই সময়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ড. কুদরত-ই-খুদার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৬২ সালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি (বিসিএসআইআর) প্রকল্প প্রণয়ন করেন। তদনীন্তন শাসকগোষ্ঠীর একতরফা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের কারণে এদেশে তখন তেমন উল্লেখযোগ্য নিমার্ণকার্য চলছিল না। এ অবস্থায় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম প্রায় এককভাবে সরকারি স্থাপত্য-নির্দেশনামা প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করেন কিন্তু সরকারিভাবে তা অনুমোদিত হয়নি। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আবার বিরোধ বাধে এবং ১৯৬৭ সালে তিনি সরকারি স্থপতির পদ থেকে সম্পূর্ণরূপে পদত্যাগ করেন। পরে এ সময়েই প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন, যিনি পরে তাঁদের সঙ্গে মিলে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে একটি স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গঠিত করে স্থাপত্যচর্চা শুরু করেন। ‘বাস্তুকলাবিদ’ – এই নামটি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি সিকান্দর আবু জাফরের দেওয়া, যিনি ফ্রিশম্যান নামে এক স্থপতির সঙ্গে মিলে এর আগে আরেকটি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বাস্তুকলাবিদই এদেশের প্রথম স্থপতি-পরিচালিত স্থাপত্যপেশাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। কিছুদিনের মধ্যে স্থপতি ইসলামের পরিচালনায় এ-প্রতিষ্ঠানটি তদানীন্তন সমগ্র পাকিস্তানে উন্নত স্থাপত্য-শিল্পকর্মচর্চার প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এদেশে স্থাপত্যচর্চা ও পেশাকে একটি সম্মানজনক শৈল্পিক পেশা হিসেবে তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্ব রুচি, দেশপ্রেম, কাজের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা, পরিপূর্ণ সততা, শৃঙ্খলা ও নান্দনিক বিন্যাস ইত্যাদি সহকারে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ইতোমধ্যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অনুষদে প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপত্যশিক্ষা শুরু হয় এবং স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত অনেক নবীন স্থপতি হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্য স্থপতি ইসলামের বাস্তুকলাবিদ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্বনামধন্য স্থপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। বাস্তুকলাবিদ প্রতিষ্ঠার পর অনুপম স্থাপত্য-গুণসংবলিত তিনি বহু ভবনের নকশা করেন। তখন ১৯৬৪-৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিভাগের উত্তরে নিপা ভবন, ১৯৫৫ সালে মতিঝিলে কৃষি ভবন, ১৯৬৫-৬৬ সালে জীবন বীমা ভবন (টাওয়ার বাদে), ১৯৬৬ সালে মিরপুরের রোড রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রকল্পের ভবনসমূহ এবং অসংখ্য বসবাসগৃহের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। স্থপতি ইসলাম ও তাঁর বন্ধু বিখ্যাত আমেরিকান স্থপতি টাইগারম্যানের যৌথ উদ্যোগে ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের পাঁচটি শহর যথা বরিশাল, পাবনা, রংপুর, সিলেট ও বগুড়ায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রকল্পের ভবনসমূহের নকশা করেন। তিনি ১৯৬৪-৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৬৭-৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প দুটির মহাপরিকল্পনা ও বিভিন্ন ভবনের নকশা প্রণয়ন করেন, যা তাঁর স্থাপত্য জীবনের অন্যতম প্রধান উল্লেখযোগ্য কীর্তি বলে বিবেচিত, যদিও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগরের কাজ থেকে তাঁকে অজ্ঞাত কারণে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়া জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্পের আবাসিক ভবনের নকশাও স্থাপতি ইসলাম প্রণয়ন করেন যা বাংলাদেশ আমলে বাস্তবায়ন হয়।

Dhaka University Charu o karukala Institute

এখন ভাবলে অবাক লাগে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যে স্থপতি এতো ব্যস্তভাবে কাজ করে গেছেন, এ-সময়ে তাঁর হাতে কোনো কাজ নেই। প্রশ্ন জাগে এর কারণ কী। তৃতীয় বিশ্বের সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে পেশাজীবীরা বাস্তব জীবনে একটু সফল হলে তাঁরা এই অভাগা দেশের অবহেলিত জনগণের মৌলিক চাহিদার দাবিতে খুব সংগত কারণেই বিবেকের তাড়নায় সোচ্চার হন, যা আবার শাসকগোষ্ঠীর পছন্দ নয় এবং এই শাসকগোষ্ঠী আবার জনগণের পছন্দ নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই জনগণ-সমর্থিত শিল্পী-স্থপতিরা সরকারের কাজ পান না এবং এভাবে তাঁরা নিজেদের পেশাচর্চার ক্ষতি করেন। অন্যান্য উন্নত দেশে এ-ধরনের স্থপতিদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। উপরন্তু তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে জাতীয় বুর্জোয়ারা, তাই তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় না। সরকারের পাশাপাশি আরো একটি বেসরকারি জনগণ সমর্থিত ধারা বয়ে যায় যার প্রচলন হওয়া সেই সময়ে অর্থাৎ ষাটের দশকের দেশে ও বিদেশে সর্বক্ষেত্রে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক সামগ্রিক সন্দীপন সত্ত্বেও আমাদের দেশে অচিন্তনীয় এবং অসম্ভব যেহেতু এরাও শাসক সমর্থক, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই মাজহারুল ইসলামের মতো স্থপিতরা কর্মহীন থাকেন যা আমাদের দেশ ও জাতির জন্যে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বর্তমানে।
স্থাপত্যকর্ম ছাড়াও স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের উপযুক্ত স্থাপত্যশিক্ষার সঠিক প্রসার ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত স্থাপত্যপরিবেশ নির্মাণে এবং স্থাপত্যপেশার সুষ্ঠু আন্দোলন গঠনে সচেষ্ট হন। স্থাপত্যশিক্ষাকে একটি স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়িত করার জন্য স্থপতি ইসলামের উদ্যোগে ১৯৫৯ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাহায্যক্রমে জাতীয় শিক্ষা কমিশন কর্তৃক আমন্ত্রণে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শক্তিশালী দল ঢাকায় উচ্চমানের স্থাপত্যশিক্ষার প্রচলনের সম্ভাবনা যাচাই করতে আসে। কিন্তু সে-চেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৬৬ থেকে ’৬৮ পর্যন্ত ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প উপদেষ্টা ছিলেন। তার প্রস্তাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন, একাডেমিক ভবন ও কিছু আবাসিক ভবন নকশা করার জন্য পৃথিবীবিখ্যাত আমেরিকান আধুনিক স্থপতি, তাঁর শিক্ষক এবং তৎকালীন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের প্রধান পল রুডলফকে মনোনীত করা হয় এবং তাঁর ডিজাইনকৃত ভবনগুলো আমাদের দেশের আধুনিক স্থাপত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সেইসঙ্গে আমেরিকান স্থপতি রিচার্ড নয়ট্রাও কিছু ভবনের নকশা করেছিলেন, যা কৃষি বিদ্যালয়ে দেখা যায়।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের নাথিয়াগলিতে গভর্নরস কনফারেন্সে গৃহীত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় রাজধানী নির্মাণের যে প্রস্তাব আনা হয় তার বাস্তবায়নে ১৯৬৪ সালে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় পূর্তমন্ত্রী ইসলামাবাদে নিয়ে গিয়ে স্থপতি ইসলামকে সরাসরি ওই দ্বিতীয় রাজধানীর পরিকল্পনা ও নকশা করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি নিজে না করে মন্ত্রীকে তিনি কোনো পৃথিবীখ্যাত স্থপতি দ্বারা বাস্তবায়ন করতে অনুরোধ জানান। সেই ধারাবাহিকতা ও পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমানের শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা। ফ্রান্সের লি কর্বুসিয়ের, ফিনল্যান্ডের আলভার আলটু ও আমেরিকার লুই কানের মধ্যে শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান স্থপতি লুই কান দ্বারা সম্পন্ন হয়, যা বিংশ শতাব্দীতে নির্মিত স্থাপত্য-গুণসংবলিত বিশটি শ্রেষ্ঠ ভবনের মধ্যে অন্যতম একটি বলে স্বীকৃত। প্রকৃতপক্ষে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের আধুনিক স্থাপত্যে বিদেশি শ্রেষ্ঠ স্থপতিকৃত সৃষ্টকর্ম  বাস্তবায়নে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন এই মনে করে যে, তরুণ স্থপতিদের সম্মুখে ভবিষ্যতে এই ভবনগুলোর উন্নত উদাহরণ এবং চিরকালের জন্য তাদের প্রেরণা ও সুস্থ স্থাপত্যের মূল উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর এই আত্মদান ও মহতী পরার্থ প্রচেষ্টার পরোক্ষ অবদান আমাদের নবীন স্থপতিদের মাঝে অপরিসীম। স্থাপত্য সংগঠক হিসেবেও তিনি তাঁর স্থাপত্য ধারণায় শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন তদানীন্তন পাকিস্তান স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি ছিলেন সে-সময়ে ১৯৬৮ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো দেশের সমস্ত স্থপতি কর্তৃক একটি সেমিনার খুব সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। দেশে প্রকৌশলী, পরিকল্পক ও স্থপতিদের সুস্থ ও সঠিক পেশাচর্চার দিকনির্দেশনা ও বিভিন্ন দিক নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো ভৌত পরিকল্পনা, স্থাপত্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা মিনিস্ট্রি অফ ফিজিক্যাল প্ল্যানিং নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের জন্যেও তিনি বহুদিন ধরে কাজ করেছিলেন এবং এই প্রস্তাবের গুরুত্ব স্থাপত্যজগতে আজও অপরিসীম বলে বিবেচিত। যদি কোনোদিন কালক্রমে এটির বাস্তবায়ন হয় তবে তা স্থপতি ইসলামের স্বপ্ন ও দূরদৃষ্টির সার্থকতা প্রকাশ করবে। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রণালয়টি বাস্তবায়নে ইতিবাচক অনুমোদন দিয়েছিলেন ও সে-অনুযায়ী সেটা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময়ে পরিবারসহ নির্মমভাবে তিনি কিছু সেনাসদস্য দ্বারা নিহত হলে তা থেমে যায়। বর্তমান সময়ে দেশের সার্বিক সুষ্ঠু নগর ও গ্রাম পরিকল্পনার ভবিষ্যৎমুখী বাস্তবায়নে এই মন্ত্রণালয় প্রচলিত হলে অনেক চলমান সমস্যার শুভ নিরসন হতো বলে বিশ্বাস। মনে পড়ে সেই সময়ে লুই কানের বিশ্বখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন সংসদ ভবনের কথা বললে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, হ্যাঁ ঠিক তবে খুব খুশি হতেন যদি এদেশের কোনো বাঙালি স্থপতির নকশা অনুযায়ী এটি নির্মিত হতো। এতে বোঝা যায় বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা। মাজহারুল ইসলাম সেই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
তিনি ছিলেন পুরোপুরি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। ঢাকা শহরকে পানির ওপরে নিয়ে ভেনিসের মতো পরিকল্পনা করতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি বাংলাদেশের গ্রাম পরিকল্পনাতেও নিয়োজিত হয়েছিলেন। ঢাকার কাছে রায়পুরা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষিভূমির আয়তন বৃদ্ধি করা, নদী, বিল-জলাভূমি সংরক্ষণ, বনাঞ্চল তৈরি, টিন বা কুঁড়েঘরের বদলে চারতলা আবাসিক ভবন, বিনোদন, মিলনায়তন, যাত্রাগান, মেলা, হাট, খেলাধুলার আনুপাতিক জমি নির্ধারণ এবং সমবায় ভিত্তিতে কারুশিল্প, পশু পালন, মুরগি পালন, মৎস্য পালন, ফল, ফুল ও শাক-সবজির চাষসহ যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজনীয় ভৌত উপাদান ও পদ্ধতি নিয়ে সার্বিক গ্রাম পরিকল্পনায় প্রায় সমাপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং এসব বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে বাস্তবায়িত হতে চলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়ে ওঠেনি, তা রয়ে গেল স্বপ্ন হিসেবে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি ছাড়াও তিনি একজন স্থাপত্য বিচারকও। দেশি-বিদেশি বহু আন্তর্জাতিক স্থাপত্য প্রতিযোগিতার তিনি অন্যতম বিচারক হিসেবেও তাঁর বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন। ১৯৮০-৮১ সালে সৌদি আরব সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান ভবন এবং আগা খান শীর্ষক স্থাপত্য প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রধান বিচারকের ভূমিকা পালন করেন। আমাদের দেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা-নির্বাচনেও তিনি মুখ্য ভূমিকা রাখেন। স্থপতি ইসলাম শুধু স্থপতি শিক্ষা, পেশা, সংগঠন এবং আন্দোলনে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি নবীন ও উৎসাহী স্থপতি ও ছাত্রদের নিয়ে সব শিল্পমাধ্যমের সৃষ্টিশীল শিল্পী, কবি, সাহিত্যক, প্রতœতাত্ত্বিক, ভূগোলবিদ, ইতহাসবিদ সমন্বয়ে ‘চেতনা’ নামে একটি পাঠচক্রও গঠন করার মূলে অবদান রেখেছেন। স্থাপত্যশিল্প ক্রমান্তরভাবে জটিল ও পরিবর্তনশীল। সাম্প্রতিক স্থাপত্যবিশ্বে কী পরিবর্তন, উন্নয়ন এবং পরিবর্ধন ঘটছে, বিষয়, দর্শন ও উপকরণ নিয়ে, নিজের দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য সম্বন্ধে জানা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভের উদ্দেশ্যেই এই পাঠচক্র। স্থপতি ইসলামের প্রেরণা, উৎসাহ ও নবীন স্থপতিদের অদম্য উদ্দীপনা, কার্যক্ষমতা দ্বারা ইতিমধ্যে সুধী মহলে চেতনার কার্যক্রম বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে এই সংস্থা থেকে পুণ্ড্রনগর টু শেরেবাংলা নগর শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী স্থাপত্যপুস্তক প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের এই পথিকৃৎ স্থপতিকে কর্মবিহীন অথবা বলা যায় সে-সময়ের অসুস্থ স্থাপত্য পেশা ও স্থপতি নির্বাচনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর অপারগতায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। দেশের বাইরে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের স্থাপত্য-চেতনা বিকাশে অপরিসীম অবদান রাখার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের পশ্চিমবঙ্গ শাখা কর্তৃক বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছেন। এইসঙ্গে মিশরের স্থপতি হাসান ফাতিহ ও ভারতীয় ব্রিটিশ স্থপতি লরি বেকারও। সম্মাননাপত্রে এমন উল্লেখ করা হয়েছিল যে, এই সম্মান তাঁকে দেওয়া হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যের মূলধারার সঙ্গে দেশজ বা আঞ্চলিক রীতির মেলবন্ধে, স্থাপত্যশিল্পে উপযোগিতা ও ব্যবহারিকতার সঙ্গে উপাদান, রীতি, উপকরণ ও কৌশলের সার্থক সমন্বয় সাধনে তাঁর নিরলস সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার অপূর্ব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। প্রথমবারের মতো অন্যান্য দেশের পৃথিবীখ্যাত স্থপতিদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো স্থপতি স্থাপত্যজগতের এরকম একটি দুর্লভ ও আন্তর্জাতিক সম্মানে বিভূষিত হলেন। এই সম্মান স্থপতির জন্যে তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মুখকেও সহস্রগুণ উজ্জ্বল করেছিল। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। একই বছরে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস (এআইএ) স্থাপত্যশিল্পে তাঁর জীবনব্যাপী অসামান্য অবদানের জন্য ফেলো সদস্য (এফএআইএ)  হিসেবে মনোনীত করে। পরে ভারতের জে. জে. সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্র্যান্ডমাস্টার পুরস্কারেও ভূষিত করে। এভাবে তিনি এদেশের স্থাপত্যশিল্পের মান বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করে তুলতে প্রভূত সাহায্য করেছেন।
বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ আদ্যপ্রান্ত বাঙালি, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, উদার মনোবৃত্তিসম্পন্ন, প্রখর ব্যক্তিত্ববান, মানবতাবাদী, রাজনীতি সচেতন ও প্রগতিশীল স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের স্থাপত্যজগতের ইতিহাসে তাঁর নীরব, দৃঢ়, নান্দনিক ও ঐতিহ্যময় অবদানের জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অন্যান্য শিল্পবিকাশে তাঁর উৎসাহ ও অবদান
স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলাম সম্পূর্ণরূপে একজন সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। স্থাপত্য শিল্পচর্চার পাশাপাশি তিনি এদেশের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শিল্পমাধ্যম Ñ সাহিত্য, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, দেয়ালচিত্র, রন্ধনশিল্প, সংগীতের বিকাশ, প্রচার এবং প্রসারে নিজেদের দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি অনুসরণ-অনুধাবন করার উদ্দেশ্যে এককভাবে সর্বদা আপ্রাণ সচেষ্ট ছিলেন। সাধারণ অথচ রুচিশীল বাঙালি মনন ও মানসে জীবনাচরণ, চলন-বলন ও দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে দেশ ও সমাজের স্বরূপ সন্ধানে প্রগতিশীল রাজনীতি অনুসরণ এবং উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করেছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের সামগ্রিক বিকাশে প্রাগুক্ত শিল্পমাধ্যমগুলোর সঙ্গে একত্রিত করে একটি যৌথ যাত্রাপথে অগ্রসর হওয়ার জন্যে সৃষ্টিশীল সচেতনতা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাই দেখা যায়, শিল্পী রশিদ চৌধুরী প্যারিস থেকে ফিরলে তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনী বাস্তুকলাবিদ অফিসে আয়োজিত হয়েছিল। পটুয়া কামরুল হাসান প্রায় বিকেলে তাঁর অফিসে ইজেলে হ্যান্ডমেড পেপারে ছবি এঁকে চলেছেন চারকোল দিয়ে। ব্রতচারী শরীরচর্চায় কামরুল হাসান লুঙ্গি পরে খালি গায়ে মালকোচা মেরে মাটিতে হাত দিয়ে চাপড় মেরে মুখে রে-রে শব্দ করে সবাইকে তা শিখিয়ে দিতেন। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ও মীর মোস্তাফাও তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ছায়ানট সংগীত ভবনের তখন জায়গা সমস্যা চলছিল। তাই তাঁর বাস্তুকলাবিদে বহুদিন ক্লাস চলেছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেনকে সেখানের সবুজ লনে গান পরিবেশন করতে দেখা গেছে। সেইসঙ্গে দেখা গেছে কবি সুভাষ মুখার্জিকেও। স্থপতিদের মধ্যে লুই কান, পল রুডলফ, টাইগারম্যান, চার্লস কোরিয়া, ভীম সেন যোশী, সোহা ও কান – এরকম সবাইকে দেখা গেছে, বিশেষ করে লুই কানের সংসদ ভবন নকশা করার সময় প্রায় প্রতি বিকেলে দেখা যেত দুজনে গভীর আলাপে মগ্ন। রাজনীতিতে তিনি নেপথ্যে সবসময় সক্রিয় ও সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ন্যাপ (মুজাফ্ফরে) দলের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, পরে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে। নিজের যাবতীয় স্বপ্নের বাস্তবায়ন রাজনৈতিক ও প্রকৃত জনগণভিত্তিক গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সম্ভবপর নয়, সে-কারণেই তাঁর এ-প্রচেষ্টা ছিল জীবনভর। সাহিত্য ও কবিতার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তাই দেখা গেছে তাঁর সঙ্গে কবি সিকান্দার আবু জাফর, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এরকম কবি-সাহিত্যিককে। এসবই তাঁর ছিল স্থাপত্যশিল্পের সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্যে, যেহেতু তিনি বিশ্বাসী ছিলেন সেই বিখ্যাত আপ্তবাক্যে – স্থাপত্যশিল্প হচ্ছে সবশিল্পের সূতিকাগার। তাই তিনি সম্পূর্ণ এক সম্পন্ন স্থাপত্যশিল্পী ও চিন্তক।

তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু প্রস্তাব
সেই অর্থে তাঁর আপিস বাস্তুকলাবিদ একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এরকম ক্ষণজন্মা পুরুষের স্মৃতি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসা সমাজ ও দেশের জন্যেই প্রয়োজন। মাজহারুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং চারবার এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাই তাঁর নামে ইনস্টিটিউট কর্তৃক আগারগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ইনস্টিটিউট ভবনটি  বা পাঠাগার হিসেবে করা যায়। তাঁর নামে স্থপতিদের মধ্যে সারাজীবন স্থাপত্যকর্ম বিবেচনায় একটি স্বর্ণপদক প্রচলিত হতে পারে। তাঁর যাবতীয় স্থাপত্য নিদর্শন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে, যেগুলো জাতীয় ঐতিহ্যের সম্পত্তি হিসেবে সরকার কর্তৃক ঘোষণা এবং তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে আসা, আর্ট ইনস্টিটিউটে তাঁর একটা ভাস্কর্য প্রতিমূর্তি স্থাপন করা, সামনের রাস্তার কিছু অংশ তাঁর নামে ঘোষণা করা বা তিন পরীবাগের সড়ক যেটা হাতিরপুলের পুবে উত্তর-দক্ষিণে আজিজ মার্কেটে মিশেছে, সেটিকে স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলাম সড়ক হিসেবে ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক ঘোষণা করা। আশা করা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগুলোর বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থাসহ এগিয়ে এসে তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাবে।

দুটি অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা
ক. আলাপচারিতার জন্যে সেই ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে চারুকলা শিক্ষার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বাসভবনে যাই। পরীবাগে তিন,  মানে ফারহাত মঞ্জিল, বাস্তুকলাবিদে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সবুজ বিস্তীর্ণ লন পেরিয়ে পুরনো আমলের একতলা ভবনের টানা বারান্দায় রাখা বেতের সোফায় বসলাম। উঁচু সিলিং থেকে ঝোলানো পাখা থেকে বাতাস বইছে। বাসায় একজন আপন মানুষের সদ্য রোগ ধরা পড়ায় সবাই ব্যথিত ও চিন্তিত। এই দুঃসময়ে কথা বলা ঠিক হবে কিনা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু ইসলাম সাহেবের আন্তরিকতায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। একজন ডাক্তার রোগী দেখে এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। ইসলাম সাহেবকে স্যার বলে সম্বোধন করি সাধারণত। ১৯৬৪ সালে আমি যখন তৃতীয় বর্ষে স্থাপত্যে পড়ি সেই ছাত্রাবস্থায় তাঁর সুবিখ্যাত আমার প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত আজমল হায়াত আহমেদের সৌজন্যে  বাস্তুকলাবিদ অফিস কাজ শুরু করি। পাশ করার পর ’৭১ সালের যুদ্ধ শুরু করার নয় মাস পর্যন্ত বাস্তুকলাবিদ সচল ছিল। তখন তিনি ওপার বাংলায়। আমি, ওয়ারেস, অপরেশ – এরা অফিসটিকে টিকিয়ে রেখেছিলাম এবং ভেতরে ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গোপন কাজে তৎপর হয়েছিলাম। এদেশে স্থাপত্যচর্চার শুদ্ধ এবং সুষ্ঠু অনুশীলন, পেশাজীবীর মধ্যে স্থাপত্য শিল্পমূল্যের বিকাশ, বিস্তার এবং প্রতিষ্ঠা সর্বপ্রথম মাজহারুল ইসলামের বাস্তুকলাবিদ থেকেই শুরু হয়। বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের গোড়াপত্তন তাঁর হাত থেকে উৎসারিত এবং সেটি হয় তদানীন্তন আর্ট কলেজ বর্তমানের চারুকলা ইনস্টিটিউট ভবন থেকে সেই ১৯৫৪ সালে যা আগে বলা হয়েছে। আর্ট কলেজ শুরু হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে। দীর্ঘ ৫০ বছর পার হলো। এই ঘটনা সামনে রেখে বাংলাদেশের চারুকলার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসব তখন পালিত হচ্ছিল। চারুকলার বিকাশে মাজহারুল ইসলামকৃত আর্ট কলেজ ভবনের অবদান অপরিসীম। শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে স্থানিক পরিবেশের মূল্যও অনেক। বিশেষ করে চারুকলার মতো নান্দনিক বিষয়ের ক্ষেত্রে এর পরিবেশ সৃষ্টির অবদান ভেতরে ভেতরে অনেক কাজ করে। শিক্ষার্থীরা যখন এই সুন্দর পরিবেশে শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করেন, অবচেতনে তাঁদের মনে একটি সুন্দর অভিধা সৃষ্টি হয় যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সবাইকে সুন্দরের প্রতি অধিক আগ্রহী করে তুলতে সাহায্য করে। পরিবেশের প্রভাব এইভাবে ব্যবহারকারীর মনে-দেহে চেতনে-অবচেতনে নতুন একটি কল্যাণকর সৃষ্টির উৎস হিসেবে ধরা দেয়। স্থাপত্য এবং পরিবেশের মূল্য তাই সব সময় একটি বিচার্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত, যার ওপর সামগ্রিকভাবে অনেক কিছু নির্ভর করে আসছে।
বাংলাদেশের চারুকলা বিকাশে তাই এ-ভবনটির অবদান কম নয় এবং এজন্যে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। চারুকলার ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে স্বভাবত অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে তাঁর কথা মনে আসে তাই জিজ্ঞেস করি –
প্রশ্ন : আপনি কখন শুরু করেন এ-ভবনের নকশা?
উত্তর : যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরি ১৯৫৩ সালে এবং কাজে যোগদান করি সেই বছরে। তখন পূর্ব পাকিস্তান, প্রধান স্থপতি ছিলেন ম্যাককনেল সাহেব। তিনি এ-কাজ করতে দেন আমাকে। ১৯৫৩ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর – এই সাত মাস কাজ করি।
প্রশ্ন : শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব বা সখ্য কেমন ছিল, তিনি কেমন সহযোগিতা করেছিলেন আপনার সঙ্গে, বিশেষ করে ভবনের নকশার ব্যাপারে?
উত্তর :  তাঁর সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি এবং কামরুল হাসান নকশার খুঁটিনাটি বিষয়ে যাবতীয় সহযোগিতা করতেন। আমার আফিসে এসে দিনের পর দিন কাজ দেখতেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন।
প্রশ্ন : বাজারে এমন একটা কথা প্রচলিত আছে যে, শিল্পাচার্যের সঙ্গে আপনার নাকি তেমন মতের মিল হতো না, তাহলে এ-কথাটা ভুল।
উত্তর : ভুল, সম্পূর্ণ ভুল, কারা যে এসব কথা রটায় বুঝি না। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, একটি ভালো ভবনের ভালো নকশার জন্যে যেমন ভালো স্থপতির অবদান থাকে, তেমনিভাবে একজন ভালো ক্লায়েন্টেরও অবদান অপরিসীম। জয়নুল আবেদিন তেমন ছিলেন।
প্রশ্ন : তদানীন্তন পাবলিক লাইব্রেরি আর আর্ট কলেজ ভবনের নকশা কি একই সময়ে শুরু করেছিলেন?
উত্তর : হ্যাঁ, তাই। আসলে লাইব্রেরি ভবন থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ জায়গায় পরপর স্থাপত্য স্কুল, সংগীত ভবন, নৃত্য ও নাট্যশালার জন্যে নকশা করেছিলাম, সব মিলে একটা আর্ট কমপ্লেক্স, সেরকমই তখন বলা হয়েছিল। পরে শুধু লাইব্রেরি আর আর্ট কলেজ তৈরি হয়।
প্রশ্ন : আর্ট কলেজ ভবন সৃষ্টির পেছনে কোন চিন্তাটা আপনার মূল হিসেবে পরিগণিত করবেন?
উত্তর : মনে রাখা দরকার যে, ভবনটির জন্যে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল ৩৫০ জন। দোতলার বেশি উঁচু হবে না। সামনে রেসকোর্সের ফাঁকা মাঠ, চারদিকে গাছপালার পরিবেশ। ভবনটি ব্যবহৃত হবে চারুকলার মতো একটি নান্দনিক বিষয়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিসর্গ এবং পরিবেশই মুখ্য। তাই স্বভাবত ভবন সৃষ্টির পেছনে মূল চিন্তা সেই পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে এমন একটি অবস্থার বিকাশ ঘটানো যাতে নিসর্গ ও ভবন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিরাজ করে। সেজন্যে চারদিকের নিসর্গকে ভবনের মধ্য দিয়ে অবাধে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিসর্গকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু ভবনটিকে আলাদা অস্তিত্বে স্থাপন করা হয়নি। ভবনটিও যাতে পরিবেশ ও নিসর্গের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাঁড়ায় সেদিকে জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন : ভবন এবং নিসর্গের সহাবস্থান দেখে মনে হয় ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যানিং খুব গুরুত্ব পেয়েছে।
উত্তর : হ্যাঁ, তবে ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যানিং আমাকে করতে দেওয়া হয়নি। প্ল্যান শুরু করার আগে সম্পূর্ণ সাইটের ডিটেইল সার্ভে করা হয়। প্রতিটি গাছের নাম, অবস্থান, দূরত্ব সবকিছু নিয়ে ড্রইং করা হয়। কোনো গাছ কাটতে দেওয়া হয়নি। বিল্ডিং বসাতে গিয়ে কিছুসংখ্যক গাছ কাটা পড়ে তা খুব সামান্য।
প্রশ্ন : মূল গাছগুলো যেমন ছিল সেইগুলোই পরে বড় হয়ে সম্পূর্ণ নিসর্গের আওতায় গিয়ে একটি সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
উত্তর : হ্যাঁ, তাই।
প্রশ্ন : পেছনের গোলাকার পুকুরটা কি আগে থেকেই অমন ছিল?
উত্তর : পুকুরটা আগে থেকেই অমন ছিল। তখন পানি থাকতো। রমনা লেকের সঙ্গে এর যোগাযোগ ছিল। পরে বন্ধ হয়ে যায় এবং আর কখনো পানি দেখা যায়নি, হাজার বৃষ্টি হলেও এখন পানি জমে না।
প্রশ্ন : শুনেছি পুকুরটি নিয়ে অনেক প্ল্যান করা হয়েছিল, সেটি কী রকম?
উত্তর : যেহেতু পুকুরটি গোলাকার এবং পানি জমে না, আর বেশ গভীর, তাই এটিকে নিয়ে একটি এম্ফিথয়েটার বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মাঝখানে মঞ্চ আর একদিকে স্টেডিয়ামের মতো ধাপে ধাপে বসার ব্যবস্থা, পেছনে বাগান, গাছপালা – এসব। পরে করা হয়নি, তবে এখনো করা যায়।
প্রশ্ন : এই ভবনের সম্প্রসারণের উপায় কী? এখন তো ছাত্রসংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু ভবনটি তেমনি আছে।
উত্তর : ভবনটি দোতলা। এর ওপরে আর বাড়ানো উচিত হবে না। তাহলে মূল পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাড়াতে গেলে গোলাকার পুকুরের অপর পাশ দিয়ে সুন্দর করে নতুন ভবন তৈরি করা যায় এবং তা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে করতে হবে। জায়গা অনেক আছে।
প্রশ্ন : ভবনটির কোনো ফরমাল প্রবেশদ্বার নেই, এটা কি ইচ্ছে করে করা হয়েছে এবং কী কারণে?
উত্তর : আসলে ইচ্ছে করেই, যাতে একটা ব্যাপ্তি আসে। সম্পূর্ণ নিচতলাটা ফাঁকা। এখানে ছেলেমেয়েরা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পান। প্রয়োজনমতো ছোটখাটো জনসমাগম হতে পারে, কোনো প্রদর্শনীর উদ্বোধনীর ফাংশন হতে পারে, আবার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি প্রবেশদ্বারও; খুব ইনফরমাল। বাইরে দিয়ে ভেতরের বাগান দেখা যায়। বাইরের সঙ্গে ভেতরের যোগসূত্রও এটি।
প্রশ্ন : শুনেছি আর্ট কলেজের মধ্যে একটি পুরনো কবর পাওয়া যায়। সেটিকে নিয়ে একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়, সে-সমস্যার সমাধান কীভাবে করেছিলেন?
উত্তর : জয়নুল আবেদিন এবং আমরা খুব সহজেই এটার সমাধান করি। আমরা কবরটিকে নষ্ট করিনি বা তা করার চেষ্টাও করিনি। এখনো সেটি আছে।
প্রশ্ন : এতে বোঝা যায় আপনারা সবাই এই ভবনটি তৈরির ব্যাপারে সহযোগিতা পেয়েছেন সবার কাছ থেকে এবং একটি সুন্দর বোঝাপড়া ছিল।
উত্তর : তা তো ঠিকই।
প্রশ্ন : শুনেছি জয়নুল আবেদিন এই ভবনের পারস্পেকটিভ এঁকেছিলেন নিজে, তাই কি?
উত্তর : তিনি আঁকেননি, আমরাই এঁকে দিয়েছিলাম মূল ছবিটি, পরে তিনি রং করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে উদ্বোধনের সময় সেই ছবিটি উদ্বোধক বেগম ভিকারুননেসা নূনকে উপহার দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন : ভাবতে একটু অবাক লাগে, ওই সময়ে যে লাল রঙের সিরামিক ইট ব্যবহার করেছিলেন যা এখনো নতুন মনে হয় ভবনে, ওগুলো কোথায় পেয়েছিলেন?
উত্তর : তখন হিজরি অ্যান্ড কোম্পানি এই ইট তৈরি করতো, মিরপুরে ফ্যাক্টরি ছিল, এখন উঠে গেছে। আমাদের জন্যে বিশেষ করে তৈরি করেছিল। তখন প্লাস্টারহীন দেয়ালের প্রচলন ছিল না। ১৯০৫-১১ সালের পর স্থাপত্যে আমরাই প্রথম এইরকম লাল ইটের দেয়াল দিয়ে ভবন তৈরি করি, যা আর্ট কলেজে দেখা যায়।
প্রশ্ন : আচ্ছা, একসময় আর্ট কলেজে ছোট একটা চিড়িয়াখানা ছিল, তাই না?
উত্তর : হ্যাঁ, ছাত্রদের ছবি আঁকার জন্যে করা হয়েছিল, এখন বোধ হয় নেই।
প্রশ্ন : সরকারি স্থপতি হিসেবে আর্ট কলেজের মতো আরো কোনো প্রজেক্ট সেই সময়ে করার সুযোগ হয়েছিল কি?
উত্তর : অনেক প্রজেক্টের ডিজাইন করেছিলাম, কিন্তু একটিও নির্মিত হয়নি। অবশ্য ’৬৩-৬৪ সালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি, পরে রাঙামাটি টাউন প্ল্যানিং, রাঙামাটি কোর্ট ভবন, আজিমপুরার একটি হাউজিং ইত্যাদি এইসব করি। পরে ১৯৬৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে বাস্তুকলাবিদ শুরু করি।
প্রশ্ন : আমরা শুনেছি যে, আর্ট কলেজ উদ্বোধনের সময় আপনাকে নাকি নিমন্ত্রণ করা হয়নি। সত্যি?
উত্তর : হ্যাঁ, আমাকে বলা হয়নি, সরকারি ব্যাপার ছিল বলেই হয়তো।
বর্তমানের চারুকলা ইনস্টিটিউটের চারুকলা চর্চার ৫০ বছর বয়স। চারুকলা শিক্ষাচর্চায় যেমন এই ভবন ইতিহাস হয়ে আছে, তেমনি বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের প্রথম নিদর্শন হিসেবেও ভবনটি ইতিহাসের অংশবিশেষ। এই দুই ইতিহাস নিয়েই চারুকলা ইনস্টিটিউট ভবনের অগ্রযাত্রা যা ভবনস্থিত অপূর্ব খোলামেলা – অনবদ্য সিঁড়িটির প্রতীকীতে সমাসীন। চারদিকের সবুজ উন্মুক্ত অঙ্গনের একই উচ্চতায় মেঝেহীন পরিসর সমগ্র পরিবেশকে একীভূত প্রতিবেশে প্রতিস্থাপিত করে। বাধাহীন সচল পরিবেশ বাইরের সঙ্গে ভেতরের যোগসূত্রকে একত্রিত করে তোলে। এই ধরনের পরিসরের শুরু ও শেষ নেই। সব মিলে সম্পূর্ণ ও স্বয়ম্ভু। চারুকলার মতো নান্দনিক বিষয়ের চর্চা উচ্চমান স্থাপত্যকলার পরিবেশে অর্জিত হলে তা সবদিক থেকেই আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। চারুকলাবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্যে এটি একটি উপরি পাওনা এবং অবশ্যই এসব জেনে তাঁরা গর্বিত বোধ করতে পারেন। আর এই গর্বের মূলে আছেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম যাঁর অনন্য সৃষ্টিক্ষমতায় অনবদ্য হয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট ভবন ফুলের মতো বিকশিত হয়ে আছে। ৫০ বছর এই স্মরণকালে তাঁর কথা তাই স্বভাবত চলে আসে। ফিরে যাওয়ার আগে তাঁকে শেষ প্রশ্ন করি –
প্রশ্ন : আপনি কি জানেন বাংলাদেশের চারুকলার ৫০ বছরপূর্তি উৎসব উদযাপিত হচ্ছে?
উত্তর : হ্যাঁ, শুনেছি।
প্রশ্ন : আপনাকে কি কোথাও স্মৃতিচারণ বা বক্তব্য বলার জন্যে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে?
উত্তর : এখনো জানি না। তবে আমি আশ্চর্য হই না, আমাদের দেশে সামাজিকভাবে স্থপতিদের চিরকালই অবহেলার চোখে দেখা হয়, সে একালই কী আর ওকালই কী। আমি কিছু মনে করি না। সবাই ভালো থাকুন এবং সবার মঙ্গল কামনা করি। এখন বেশ রাত ঘনিয়েছে। দু-একটা গাড়ি-রিকশা চলছে। রাস্তার ভিড় একটু একটু করে কমছে।


সম্প্রতি কলকাতার রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টস পশ্চিমবঙ্গ চ্যাপ্টারের উদ্যোগে সুদীর্ঘ ৪২ বছর পর প্রথমবারের মতো ষষ্ঠ জাতীয় কনভেনশন উপলক্ষে স্থপতি সমাগত, সেমিনার, সভা ও প্রদর্শনী উপলক্ষে সেখানে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তিনজন স্থপতিকে স্থাপত্য শিল্পে অসামান্য অবদান রাখার জন্যে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছিল। সম্মানিতদের মধ্যে রয়েছেন মিশরের অশীতিপর-প্রয়াত প্রবীণ স্থপতি হাসান ফাতিহ, বাংলাদেশের প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এবং ভারতের ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত কেরালার ত্রিবান্দ্রাম নিবাসী গান্ধীবাদী স্থপতি লরি বেকার।
বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্য শিল্প ও পেশার পথিকৃৎ হচ্ছেন সত্তর বছর বয়সী আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। দেশের প্রথম আধুনিক স্থপতি যেমন তিনি, তেমনই দেশের স্থাপত্যপেশাকে সম্মানজনক পর্যায়ে আনতেও তাঁর অবদান তুলনাহীন। আধুনিক স্থাপত্যের মূলধারার সঙ্গে দেশজ বা আঞ্চলিক রীতির মেলবন্ধে, স্থাপত্যশিল্পে উপযোগিতা ব্যবহারিকতার সঙ্গে উপাদান রীতি-উপকরণ কৌশলের সার্থক সমন্বয় সাধনে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। প্রগতিশীল রাজনীতি, বাঙালি সংস্কৃতি, স্থাপত্য পেশা আন্দোলন ও স্থাপত্য শিক্ষা প্রসারেও তাঁর প্রভূত অবদান স্বীকৃত। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের স্থাপত্য-চেতনা বিকাশে বিশেষ অবদান রাখার জন্য স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এই সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে একটি তাম্রফলক, একটি কাশ্মিরি উত্তরীয়, একটি সম্মাননাপত্র ও পিতলের একশনয়নমুখী একটি প্রদীপ স্তম্ভ উপহার দিয়ে এই বিশিষ্ট বাঙালি স্থপতিকে মাল্যভূষিত করা হয়।
এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একজন স্থপতি স্থাপত্য জগতের এরকম একটি দুর্লভ ও আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হলেন। এই সম্মান স্থপতির জন্য তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মুখকেও সহস্রগুণ উজ্জ্বল করেছে। আমার নেওয়া নিেম্নাক্ত এ-সাক্ষাৎকারটি প্রবাসী আনন্দবাজার পত্রিকায় (২৩ বৈশাখ ১৩৯৬ শনিবার, ৬ মে ১৯৮৯) প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : ভারতের এই যে স্থাপত্য সম্মাননায় আপনি সম্মানিত হলেন, এতে আপনার প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতি কী?
উত্তর : প্রথমে আমাকে যখন জানানো হলো, তখন অবশ্যই আমার খুব ভালো লেগেছিল এবং কলকাতায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত প্রায় ৮৫০ স্থপতির সম্মুখে আমাকে যখন মঞ্চে যাওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়, তখন আমি খুব সংগত কারণে সত্যি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম।
প্রশ্ন : আপনি ছাড়া আর কোন কোন দেশের স্থপতি কী কী অবদানের জন্য সম্মানিত হয়েছেন?
উত্তর : এই কনভেনশনে আমাকে নিয়ে মোট তিনজনকে সম্মানিত করা হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থাপত্য বিষয়ে বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডে সাফল্য, উৎকর্ষ সাধন এবং বিশেষ অবদানের জন্য, যেমন মিশরের হাসান ফাতিহকে সম্মান দেখানো হয় তাঁর দেশজ উপাদানে সাধারণ মানুষের বাসগৃহ নির্মাণ এবং সারাজীবন গ্রামীণ ও লোকজ স্থাপত্যে উৎসর্গীকৃত জীবনের জন্য। কেরালার ব্রিটিশ স্থপতি বর্তমানে ভারত-নিবাসী লরি বেকারকে সম্মান করা হয় দেশজ উপকরণের ব্যাপক ব্যবহার এবং কমমূল্যের আবাসগৃহ নির্মাণে সহায়তা করার জন্য। তিনি কেরালার আদিবাসীদের সঙ্গে বহুদিন কাটিয়েছেন, ভদ্রলোক গান্ধীভক্ত, তাদের স্বনির্ভর গৃহনির্মাণেও তিনি পথ দেখিয়েছেন।
প্রশ্ন : ভারতীয় আধুনিক স্থাপত্যধারার ক্রমোন্নতির সঙ্গে আমাদের দেশের আধুনিক ধারার কোনো সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় কি আপনার দৃষ্টিতে? হলে, বা না হলে, তার কারণ কী?
উত্তর : ভারতে সত্যিকার অর্থে সমকালীন উন্নতমানের স্থাপত্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে মূলত পশ্চিম ভারতে চণ্ডীগড়, দিল্লি, আহমেদাবাদ ইত্যাদি শহরকে ঘিরে। পূর্ব ভারত নানান কারণে একটু অবহেলিত হয়ে পড়েছে। এই কনভেনশনে বিভিন্ন সেমিনার থেকে এবং পশ্চিমবঙ্গের নবীন স্থপতিদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, তাঁরা এ-সম্বন্ধে শুধু সচেতন তাই নয়, এটার ক্রমোন্নতির বিরুদ্ধে সব বাধা দূর করার একটি প্রধানতম ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ বোধহয় এ-বিষয়ে কিছুটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কিছু কিছু স্থপতির কাজ কলকাতা এবং তার আশপাশে উঁচুমানের হচ্ছে বলে আমার ধারণা। পশ্চিম ভারতের স্থাপত্যকর্ম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। চার্লস কোরিয়া, যোশী আন্তর্জাতিক স্থাপত্য জগতে পরিচিত নাম। বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের কিছু স্থপতি সচেতনভাবেই কাজ করছেন এবং যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের পটভূমি এক এবং তাই আমাদের কাজের ভেতর অনেক উপাদানের প্রভাবে সাদৃশ্য দেখা যেতে পারে। এই সাদৃশ্য ভৌগোলিক, উপাদান ও কৃষ্টিগত এক পটভূমির কারণে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রয়োজন বিভিন্ন প্রকারের তাই এই দুই দেশের স্থপতিরা বিভিন্নভাবে স্থাপত্য শিল্পচর্চায় সাড়া দিতে বাধ্য এবং তার প্রতিফলন স্থাপত্যে প্রকাশ পাবেই। একদিক দিয়ে অভিন্নতার সংযোগ থাকবে; কিন্তু আরেক দিক থেকে ভিন্নতা প্রকাশ পাবে।
প্রশ্ন : তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও শিল্প উন্নয়নে বিশেষভাবে সজাগ হয়েছে এবং সেটিই বর্তমান বিশ্বস্থাপত্যের অন্যতম প্রধান ও আধুনিকতম ধারা বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ সম্বন্ধে মন্তব্য করুন।
উত্তর : স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যে কোনো দেশ প্রথমেই তাদের জাতীয় সত্তার বিভিন্ন উপকরণ সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন হয়ে ওঠে এবং নিজেদের সাংস্কৃতিক শেকড় খুঁজে পেতে এবং তার সঙ্গে বর্তমান কর্মকাণ্ডের সংযোগ স্থাপনে সজাগ হতে চেষ্টা করে। ভারতীয় উপমহাদেশের স্থাপত্য-ঐতিহ্য অতিপ্রাচীন এবং গৌরবময়। ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছর আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে একটি মূলমন্ত্র ছিল, তাহলো, ভারতকে ভারতীয়দের কাছে একটি নিঃস্ব দেশ হিসেবে পরিচিত করা অর্থাৎ আমাদের ইতিহাস বিকৃত করে এমন কিছু বোঝানো যে, আমরা ছিলাম যেন প্রায় এক অসভ্য জাতি। এই প্রকারের প্রচেষ্টা ইউরোপীয় জাতিগুলো তাদের প্রতিটি উপনিবেশে চালিয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আজ পর্যন্ত স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর সমাজে অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। স্বাধীনতার প্রথম দিকে শিক্ষিত সমাজের একটি বড় অংশ ঔপনিবেশিক শাসকদের চিন্তা-ভাবনায় চালিত হতো। স্বাধীন ও সুষ্ঠু চিন্তা-ভাবনা বিকাশের জন্য আমাদের দেশে বেশ কিছু সময় লেগেছে এবং এখনো লাগছে। তবুও এটুকু বলা যায় যে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্থপতিরা এখন তাঁদের দেশ, সমাজ, ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং জনগণ সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। তাঁরা নিজেদের দেশের মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে গৌরববোধ করে। যদিও বর্তমান জগতে তথাকথিত আন্তর্জাতিক স্থাপত্যের প্রাধান্য বিরাজমান, তবু স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের স্থপতিরা, বিশেষ করে গত দুই দশকের নতুন দেশজ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্থাপত্য শিল্পের অনুশীলন করছেন এবং তাঁরা দুনিয়াজোড়া পরিচিতি পাচ্ছেন। আমাদের কাছে দুনিয়া এখন ছোট এবং ভাবের আদান-প্রদান স্বাভাবিক এবং আরো কাম্য; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজ জাতির ঐতিহ্যের কথাও ছোট করে দেখা যায় না। নিজের দেশের মাটি, মানুষ আবহাওয়া সংস্কৃতি Ñ সবকিছুই স্থাপত্যে প্রতিফলিত হতে বাধ্য এবং তখনই তার সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা এবং তখনই দেশের প্রকৃত সত্তার প্রকাশ হয়।

চারুকলা ইনস্টিটিউট ভবনের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ১৯৫৪ সালে বিদেশে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এই চারুকলা ভবনের নকশা শুরু করেন। অনেক কারণে এ-ভবনটি আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ হয়ে আছে। চিরাচরিত বর্গ-আয়তের নিয়ম অনুসরণ না করে স্থপতি উন্মুক্ত-উদার ভঙ্গিতে সোচ্চার হয়েছেন। গোলাকার, ব্যাসার্ধ, জ্যামিতিক নকশায় ক্লাসরুম এবং আপিসগৃহ এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে একটি অপরটির পরিপূরক হয়। বাইরের পরিসর আর ভেতরের পরিসরকে পৃথক না করে তা একীভূত করেছেন। প্রাকৃতিক পরিসরকে বিঘিœত না করে বরং সেটিকে ভেতরের পরিসরের অনুষঙ্গী করে তুলেছেন এক অনবদ্য মুন্শিয়ানায়। গাছপালা ও প্রকৃতির মধ্যে ভবনটি প্রকৃতিরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেইমতো নির্মাণসামগ্রীও ব্যবহার করেছেন। আমাদের দেশের সাধারণ ব্যবহার্য ইটকে পরিশীলিত করে সিরামিক পর্যায়ে বাছাই করে তার সুন্দর লাল স্থায়ী রংকে প্রকৃতির সবুজের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। ক্লাসের একপাশে প্রবাহিত বারান্দা ভেতরের ঘাসে-ঢাকা আঙিনাকে ধরে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক অবস্থাকে ফ্রেমে-বাঁধা ছবির মতো বেঁধে দিয়েছেন। মাঝখানে অবস্থিত জলহীন গোলাকার পুকুরের একপাশে ক্লাসের সারি সারি অবস্থান দুটি পরিসরকে এক সুরে নিয়ে এসেছে। আঙিনায় গোলাকার জলাশয়, গাছের অবস্থান, সবুজ চত্বর লাল ইটের নগ্ন ব্যবহারে যেমন উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে, তেমনি তা হয়ে উঠেছে প্রতি বছরের সংস্কারহীন এক স্বাভাবিক-সাবলীল প্রক্রিয়া যেন প্রকৃতির মতো ভবনটিও প্রকৃতির অংশ। ভবনে ঢুকতেই যে কয়েকটি গোলাকার স্তম্ভবিশিষ্ট ফাঁকা পরিসর, কড়ি-বর্গা-বিমহীন সোজাসাপটা ছাদযুক্ত আয়োজন প্রথমেই একজন দর্শককে বিমোহিত করে, তার সামনেই একটি অপূর্ব সিঁড়ি এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গেছে, একা একা দাঁড়িয়ে, চারিদিকে ফাঁকা যা এখনো ধ্র“পদী বিন্যাসে অনন্য। আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগেকার নকশা করা এমন সিঁড়ি আমাদের এখানে দ্বিতীয়টি নেই। নিচের ফাঁকা পরিসরকে এই সিঁড়িটি ওপরের পরিসরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এমনভাবে যেন তা অবিভাজ্য এবং অবধারিত। গোলাকার প্রদর্শনীশালা একদিকে, আর একদিকে পরিসরকে ভাগ করার জন্যে একটি জালিযুক্ত ফাঁকা দেয়াল সম্পূর্ণ জায়গাটিকে বাইরে থেকে ভেতরের জন্যে পৃথক করেছে। এই ফাঁকা জায়গাটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আয়োজনের জন্য ব্যবহৃত হয় যেমন, তেমনি ছাত্রছাত্রীদের জন্যে অবসর সময়েও কাজে লাগে। এটিকে বলা যায় ভবনটির নিশ্বাস ফেলার জায়গা। সিঁড়িটি প্রাকৃতিকভাবে একটি ভাস্কর্যের নমুনা হিসেবে দাঁড়িয়ে, ফাঁকা, কোনোদিকে কোনো দেয়াল নেই, রেলিং ছাড়া। ছাত্রছাত্রীরা মাঝে মাঝে বসার জন্যেও ব্যবহার করেন। তার পেছনেই লম্বা করিডোর যা ক্লাসভবনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। আর একপাশে রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চের জায়গা, ক্লাসভবনের পেছনে। উন্মুক্ত মঞ্চটি একটি বিরাট বকুলগাছের গোড়ায় চারিদিকে বড় বড় গাছ, সবুজ পাতায় ছাওয়া এক বিশাল জায়গা। বর্তমানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত এটি একটি জনপ্রিয় স্থান। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আর্ট বা শিল্পকলার পীঠস্থান হবে মনে করে ভবনটিকে চিরাচরিত বর্গ বা আয়তাকারে না নিয়ে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এটিকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন জ্যামিতিক বিন্যাসে। প্রাকৃতিক সাবলীলতা স্থপতিকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিয়েছে। কোথাও অলংকার নেই, নিরাভরণ, যথোপযুক্ত, ‘কমই অনেক’ Ñ এই দর্শনে স্থপতি উজ্জীবিত হয়ে ভবনটির নকশা করেছেন। তাঁর নগ্ন ইটের ব্যবহারের সঙ্গে কাঠের পলিশ করা বড় বড় দণ্ডায়মান লুভারের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য। এগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন রৌদ্র থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে এবং নান্দনিক কারণে তো বটেই। মেঝেহীন প্রায় এই ভবন মাটির সমান্তরালে মাটিরই আশ্রয়ে নির্মিত হয়েছে। এই ভবনটির মধ্য দিয়ে স্থপতি ইউরোপীয় বা পশ্চিমা বা আধুনিক স্থাপত্যের সঙ্গে দেশীয় ভাবধারা, প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস এবং দেশীয় নির্মাণসামগ্রীর সংমিশ্রণে একটি রুচিশীল প্রকৃত আধুনিক দেশীয় স্থাপত্যের নিদর্শন রচনা করেছেন। মাত্র দোতলা উচ্চতার ভবনটির পরিমাপ বা অনুপাত প্রকৃতির যেমন অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি মানুষের পরিমাপে তা আপন এবং মানবিক গুণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
আধুনিক আন্তর্জাতিক মানের ও একই সঙ্গে দেশীয় স্থাপত্য নিদর্শন যার চরিত্র ও প্রক্রিয়া ধ্র“পদী এবং সেভাবেই তা সব সময় বিরাজ করবে।

কিছুদিন আগে, আমার গুরু
হঠাৎ একদিন তিনি টেলিফোনে ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গুলশানের বাসায় ছুটে গেলাম যাঁকে আমি আমার স্থাপত্যগুরু হিসেবে সবসময় শ্রদ্ধা করে আসছি এবং আজীবন তেমনি থাকবো। তখন একটু ডিমেলশিয়া ও স্মৃতিভ্রষ্টতা শুরু হয়েছে। বললেন, আপনার আপিসে যাবো। আমি তো মহাখুশি। নিয়ে এলাম গ্রিন রোডে। আমার কক্ষে ঢুকে চারদিকে তাকালেন, তারপর বললেন, চলেন যাই। আমার বা প্রায় সবার সঙ্গে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। স্যার, একটু বসবেন না। তিনি চলা শুরু করেছেন। পেছন থেকে বললাম, স্যার, শহীদুল্লাহ সাহেবের অফিস এখানে, যাবেন। চলেন। শহীদুল্লাহ সাহেব তাঁকে হঠাৎ দেখে অবাক, আবার খুশিও। বসতে বললে বসলেন না। তখনই আবার গুলশানের দিকে রওনা দিয়ে বাসায় দিয়ে এলাম। এরপরে ধানমণ্ডিতে স্থপতি নাহাস খলিলের বাসায় নিয়মিত চেতনার মঙ্গলসভায় তাঁকে শেষবারের মতো সম্মাননা দেওয়া উপলক্ষে নিয়ে গিয়েছিলাম। উত্তরীয়, পুষ্পসম্ভার দিয়ে নবীন স্থপতিরা তাঁকে সংবর্ধিত করেন। পরে শরীর খারাপ হলে তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এ্যাপোলো হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে। ওয়ারেস, রশিদসহ আমি তখন দেখতে যাই। চিনতে পারেন না। হাত ধরে কপালে হাত রাখি। বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকেন, ঠোঁট দুটি নড়ে ওঠে। আমার গুরু কথা বলতে পারেন না। আমার চোখ জলে ভরে ওঠে, সবার তখন খালাম্মা মানে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বেগম সুফিয়া কামালের গুরুকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা মনে পড়ে। শেষ কয়েকটি পঙ্ক্তি এরকম – ‘মৃত্তিকার মর্ম্মবাণী করিয়া সন্ধান/ সৃজনে করে যে কীর্তিমান/ মাতৃঅঙ্গসম শান্তনীড়/ রচিয়া প্রশান্তি দানে নিশ্চিন্ত নিবিড়/ সে শিল্পী সে স্রষ্টা, তার দান/ কালজয়ী, নাম তার রহিবে অম্লান।’ স্থাপত্যাচার্যের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা, অপার এবং প্রগাঢ় সম্মান।