মাটি-মানুষের তন্নিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিক

আমাদের কথাসাহিত্যের সামগ্রিক বিচারে মুষ্টিমেয় যে-কজন সৃজনশীল লেখক সৎ সাহিত্য-ভাবনাকে তন্নিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রকাশে উন্মুখ রয়েছেন, শওকত আলী তাঁদের একজন। শুধু একজন নন, নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে একজন। লেখকের দায়ভার নিয়ে আজো তাঁর সৃষ্টি-চিকীর্ষা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের এই দুঃখী দেশের গণমানুষের হাসিকান্না, শোকসমত্মাপ, কান্না ও বিলাপ, সুখ ও আনন্দ দিয়ে তিনি তাঁর সাহিত্য-চেতনায় যে ভূখ- গড়ে তুলেছেন, তাতেই বোঝা যায় সাহিত্যিকরূপে লেখকের ভূমিকা ও তৎপরতা। এ-উপমহাদেশের মানুষের সমাজবাসত্মবতা যে তাঁর অভিজ্ঞতায় আসত্মীর্ণ তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তিনি তাঁর আহরণ নিয়ে সময়কে তুচ্ছ করে বোধ করি আরো সুদূর অতীতের আবহমান বাংলাদেশকেই শনাক্ত করতে চান। ‘জীবনের গভীর থেকে গভীরতর ভেতরের দিকে যেতে’ পারার লক্ষক্ষ্য তিনি আজো নিষ্ঠাভরে নির্মাণ করে চলেছেন। বাংলা কথাসাহিত্যের বিবেচনায় লেখকের প্রাতিস্বিক অনুভবের ঈপ্সিত ফসল এই সাক্ষাৎকার।                          -বজলুল করিম বাহার

বজলুল করিম বাহার : বাংলাসাহিত্যের মূল স্রোতের ধারাবাহিকতায় আমাদের কথাসাহিত্যের স্থান কোথায়?

শওকত আলী : আমার ধারণা, বাংলাসাহিত্যের মূল স্রোত বলে কিছু নেই। আসলে মূল-অমূল যা-ই বলা যাক, স্রোত একটাই এবং একমাত্র, ১৯৪৭ পর্যন্ত। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের দেশটি ১৯৪৭ সালে দুভাগে ভাগ হয়ে গেলে বাংলাসাহিত্যের প্রবাহটিও দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তারপরে এখন পর্যন্ত, আমাদের সাহিত্যক্ষক্ষত্রে যা-কিছু অর্জন, এবং ওপার বাংলার সাহিত্যক্ষক্ষত্রেরও, ভালোমন্দ যা-ই হোক, সবই ১৯৪৭-পূর্ববর্তী বাংলাসাহিত্যেরই ধারাবাহিক অংশ। আমি মনে করি, আমাদের কথাসাহিত্যের স্থান এই পরিপ্রেক্ষিতেই নির্ধারিত হওয়া উচিত। অর্থাৎ ১৯৪৭-পরবর্তী দ্বিধাবিভক্ত বাংলাসাহিত্য এখন দুই ধারায় দুরকম জীবনবাসত্মবতার মধ্যে নির্মীয়মাণ। আমাদের দেশের বাসত্মবতার কথা এখানে উলেস্নখ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় উত্থান এবং উপর্যুপরি গণআন্দোলন চলে বাংলাদেশে পুরো ষাটের দশকজুড়ে এবং একটি রক্তাক্ত ও সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে। এই যুদ্ধের প্রভাব এখন পর্যন্ত আমাদের জীবনে রয়ে গেছে।

এখানে বলার কথা এই যে, ১৯৪৭ সালের পর গত চারটি দশকজুড়ে আমাদের অস্থির এবং খুব টানটান সময়ের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। জীবনের বাইরের দিকে যেমন, তেমনি ভেতরের দিকেও এত ভাঙচুর ও দ্রম্নত ভালোমন্দ পরিবর্তন ঘটেছে যে, তাতে লেখক ও পাঠকের দম ফেলার অবকাশ থাকছে না। অভিনিবিষ্ট কাজ, বড়মাপের কাজ, আবেগ ও বুদ্ধিকে সংহত করে ব্যবহার করার কাজ, করার মতো অবকাশ আমাদের কম। এককথায় বলতে হয়, আমাদের লেখকদের ওপর জীবনবাসত্মবতার চাপ খুব বেশি। এত বেশি যে, জীবনবাসত্মবতার শিল্পরূপটি আমরা সাফল্যের সঙ্গে বিন্যসত্ম করতে পারি না – আর গল্প বানানোও সম্ভব হয় না। তাই, আমার মনে হয়, শিল্পতার মান যা-ই হোক, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে জীবন বেশি, বানানো গল্প কম। সম্ভবত সে-কারণেই চমকদার ভাষায় জমজমাট ও বানানো গল্প পাঠে অভ্যসত্ম পাঠকরা মনে করেন যে, এদেশের লেখকরা ভালো গল্প লিখতে পারেন না।

শুধু লেখকের কথা নয়, প্রকাশনার কথাও এ-প্রসঙ্গে আসে। নিয়মিত কোনো সাহিত্য পত্রিকা নেই, এই দুঃখজনক বাসত্মবতা কি অস্বীকার করা যায়? আর বইয়ের প্রকাশনা? সবই নিদারুণভাবে নেতিবাচক অবস্থায় বিদ্যমান।

তাই আমাদের কথাসাহিত্যের স্থান খুঁজতে যাওয়ার প্রশ্নটাকে আমি অযৌক্তিক বলে মনে করি। তুলনাটা করব কার সঙ্গে কার? হ্যাঁ, আমরা জানি, বাংলাদেশে একটিই তেজি, সৃজনশীল এবং গভীরভাবে জীবনবোধসম্পন্ন লেখক ছিলেন এবং আছেন, তাতে কি কিছু প্রমাণিত হয়? একজন সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্ বা তাঁর মতো আরো দু-তিনজন লেখকের দু-একটি করে কাজ নিয়ে কি তুলনা করা যায় ১৯৪৭-পূর্ববর্তী ‘মূলধারার’ লেখকদের সঙ্গে? কিংবা সাম্প্রতিককালের বাংলা কথাসাহিত্যের দুই প্রবাহের মধ্যেই কি তুলনা করার মতো অবস্থা আছে? একজন-দুজন ভালো লেখক দিয়ে কি সমগ্র সাহিত্যের অবস্থা বোঝা যাবে?

এ-প্রসঙ্গে আমার একটি সবিনয় নিবেদন আছে, কী দরকার তুলনা করতে আর স্থান খুঁজতে যাওয়ার? একটি স্বাধীন জাতির জন্য সাহিত্য নির্মাণের প্রয়োজন আমাদের – আমাদের কি ওই কাজেই বেশি সময় ও মনোযোগ দেওয়া দরকার নয়? ষাটের দশকের কথা স্মরণ করুন – তখন তো তুলনায় যাওয়া হয়নি, সুযোগও অবশ্যি ছিল না। আমরা যে তখন নিজের মতো করে কাজ করে গিয়েছি, তাতে কি ক্ষতি হয়েছে আমাদের, না লাভ হয়েছে? আমি সাহিত্যকর্মীদের কথাটা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।

বাহার : কথাসাহিত্যের বাসত্মবতা প্রসঙ্গে আপনার অভিজ্ঞতা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে?

শওকত : কথাসাহিত্যের বাসত্মবতা কী, এই প্রশ্নটিই এখন আপেক্ষক্ষক হয়ে উঠেছে। আমি বাসত্মবতাকে যেভাবে দেখি, অন্য লেখক সেভাবে নাও দেখতে পারেন। এমনিতে তো জানি, মানুষের কাহিনি জীবনযাপনের বাসত্মবতার যত কাছাকাছি আসতে পারে, ততই তা উপন্যাস হয়ে ওঠে। সত্মাদাঁলের সময় থেকেই প্রক্রিয়াটি সুস্পষ্ট। তবু দেখা যায়, ফ্লবেয়ার আর জোলার বাসত্মবতায় দুসত্মর ফারাক। অবয়বিকতা যেমন বাসত্মব, প্রাণময়তাও তেমনই বাসত্মব। দিবালোকিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও বাসত্মব; আবার, ফ্রয়েড সাক্ষী, স্বপ্নের ঝাপসা অভিজ্ঞতাও বাসত্মব। উপরন্তু কার্ল য়ুঙের তত্ত্ব মানলে তো তন্ত্রমন্ত্র আর পরাবাসত্মবতার বিষয়গুলোও বাসত্মবতার সীমানার মধ্যে এসে যায়। আর সাম্প্রতিককালের তাজা তত্ত্ব ম্যাজিকাল রিয়ালিজম যদি বিবেচনায় আনি, তাহলে তো বাসত্মবতা আর অবাসত্মবতার সীমানা ঠাহর করা মুশকিল হয়ে যাবে। অথচ আমরা জানি সবই বাসত্মবতা। আসলে লেখক কী লিখবেন, সেটাই প্রধান কথা। এখানে লেখকের মনের প্রবণতাটাই আসল। প্রবণতাই লেখককে জগতের সঙ্গে যুক্ত করে – এবং সেই যুক্ত থাকার ফলেই লেখকের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বাড়ে, যে-সঞ্চয় লেখক ব্যবহার করতে পারেন তাঁর শিল্প নির্মাণের সময়। আমার অনুমান, এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই সব লেখককে যেতে হয়।

আমার অভিজ্ঞতায় শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত যা সঞ্চিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে, তা-ই আমি ব্যবহার করেছি এবং করছি আমার লেখায় – এই সোজাসাপ্টা জবাবটা দিতে পারলে সুখী হতাম। কিন্তু আসলে তা হয়নি, এবং বোধহয় হয়-ও না। কারণ এই যে, বাসত্মবতা তো শিল্প নয় – শিল্পের একটা আলাদা দাবি আছে। আমি বাসত্মবতা নিয়ে লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিলেই যে লিখতে পারব এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। জনগণের জীবন-সংগ্রাম নিয়ে অনেক লেখাই যে প-শ্রম হয়েছে, সে-উদাহরণ তো ভূরি ভূরি, আমাদের জীবৎকালেই আমরা দেখেছি।

বাসত্মব অভিজ্ঞতার সঞ্চয় এবং শিল্প নির্মাণের সময় তার ব্যবহার, এই প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় অবশ্যই হয় না। কিন্তু সব অভিজ্ঞতাই যে শিল্পের কাজে লাগানো যাবে, এমন কোনো কথা নেই। এখানে নিজের কথা বলতে পারি। ধরা যাক, ‘কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ’ নামক গল্পটির কথা। ওই গল্পের বৃদ্ধ কপিলদাস আর আসল কপিলদাস দেখতে আপাদমসত্মক হুবহু একই রকম। আচার-আচরণও একই রকম। কিন্তু পরিণতিতে যে-কা-টি সে ঘটায়, সেটি কিন্তু বাসত্মবে সে ঘটায়নি, ঘটিয়েছিল তার নাতি। এরকম অনেক এদিক-ওদিক হয় অভিজ্ঞতাকে শিল্পে রূপান্তর করার সময়। আবার যেমন ‘প্রদোষে’র কথা বলা যায়। ওই লেখাটি উপন্যাস হয়েছে কিনা জানি না – কিন্তু ওটির মধ্যে শুধু ইতিহাসের বাসত্মবতাই নয়, প্রত্যক্ষ বাসত্মবতাও আছে। ১৯৭১-এর শত্রম্ন-কবলিত ও আক্রান্ত বাংলাদেশই হলো ওই লেখাটির প্রেরণা এবং একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও বাসত্মব উপাদান। আমার মনে হয়, কেবলই অবয়বিকতা কিংবা কেবলই বিমূর্ততা বাসত্মবতা নয়। শুধুই অবয়বিকতা বস্ত্তর অবয়ব মাত্র, আর শুধুই বিমূর্ততা, পস্নাস্টিসিটি থাকলেও, আকারপ্রকারবিহীন প্রতিভাস মাত্র – পুরো বাসত্মবতা কখনোই নয়। কিন্তু উপন্যাস বা গল্পের প্রধান উপাদানই বাসত্মবতা। আমি মনে করি, জীবন্ত প্রাণময় বস্ত্তই হতে পারে সেই বাসত্মবতা, যার পক্ষে শিল্পের উপাদান হওয়া সম্ভব।

বাহার : লেখার ক্ষক্ষত্রে কোনো  বিশেষ অঞ্চলের পটভূমি, গণমানুষ বা পারিপার্শ্বিকতাকে কি আপনি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?

শওকত : হ্যাঁ, যে-অঞ্চলের মাটি ও মানুষ আমার ভালোভাবে জানা, মাটি ও মানুষসুদ্ধ সেই অঞ্চলটি আমার লেখায় বারবার নানান প্রসঙ্গে চলে আসে। তাছাড়া এমনিতে লেখক হিসেবে কোনো অঞ্চলের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব নেই।

বাহার : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বীরভূমের, মনোজ বসুকে সুন্দরবন এলাকার, হাসান আজিজুল হককে রাঢ়বঙ্গের লেখক বলা হয়। আপনাকে কি এভাবে উত্তরবঙ্গের লেখক অভিধায় চিহ্নিত করা বিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করেন?

শওকত : অবশ্যই বিবেচনাপ্রসূত হবে না। কেন হবে? আমি কি বরেন্দ্রের গল্প বলে কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছি? হ্যাঁ, দিনাজপুর-রংপুরের উত্তরাঞ্চলে আমার জন্ম, কিছুকাল সেদিকে বসবাস ছিল এবং সেই সুবাদে ওই এলাকার মানুষ এবং মাটির সঙ্গে আমার গভীরভাবে জানাশোনা। তাই ওই এলাকা এবং তার মানুষ আমার অনেক গল্পে এবং উপন্যাসে এসেছে। শুধু এই কারণে কেমন করে দাবি করব যে, আমি উত্তরবঙ্গের লেখক? দিনাজপুরের উত্তরাঞ্চলটিই কি পুরো উত্তরবঙ্গ?

কোনো বিশেষ অঞ্চলের লেখক হতে পারা গৌরবের ব্যাপার। টমাস হার্ডি, উইলিয়াম ফকনার, মিখাইল সোলোকভ – এঁদের বিশেষ অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানুষের লেখক বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং যদি আমি যথার্থই উত্তরবঙ্গের লেখক হয়ে উঠতে পারি অর্থাৎ পুরো উত্তরবঙ্গের মাটি ও মানুষ নিয়ে লিখে উঠতে পারি তাহলে অবশ্যই গর্ববোধ করব।

বাহার : আমাদের কথাসাহিত্যে মানবিক মূল্যবোধ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কতটুকু প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আপনার?

শওকত : যতদূর জানি, আদ্যন্ত মানুষ আর তার জীবনযাপনের যাবতীয় অনুষঙ্গই মানবিক মূল্যবোধের এলাকার জিনিস। মানুষকে শ্রেষ্ঠ ভাবা, মানবিক গুণগুলোকে জীবনাচরণের ক্ষক্ষত্রে প্রাধান্য দেওয়া এবং সকল মানব-প্রসঙ্গকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করাকেই আমি মানবিক মূল্যবোধের বিষয় বলে বিবেচনা করি। আর কথাসাহিত্যের প্রধান শিল্পরূপ উপন্যাস এবং ছোটগল্প, যার সূচনাতেই মানুষ এবং মানুষের যাবতীয় অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কথাসাহিত্যের মূল ভিত্তিটাই তৈরি হয়েছে মানব-প্রসঙ্গ দিয়ে। তাই মানবিক মূল্যবোধকে কথাসাহিত্যের ক্ষক্ষত্রে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করার আদৌ কোনো অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না।

বাহার : একুশের চেতনা আপনার সাহিত্যকর্মে কতটুকু স্থান পেয়েছে?

শওকত : এ-প্রশ্নের জবাব দেওয়া কি ঠিক হবে? পাঠক-সমালোচকরাই বরং ভালো বলতে পারবেন, একুশের চেতনা আমার সাহিত্যকর্মে কতটুকু স্থান পেয়েছে। এখানে একটি তথ্য আমি জানানো প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তা হলো এই যে, ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রম্নয়ারির দিন আমি শুধু ঢাকা নয়, তখনকার দিনের পূর্ববাংলাতেই অনুপস্থিত ছিলাম। তবে কয়েকদিন পরই আমি দিনাজপুর শহরে গিয়ে পৌঁছি এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি।

বাহার : এদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ কি তেমন কোনো সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব পেয়েছে বলে আপনার মনে হয়? আপনার নিজের ক্ষক্ষত্রে?

শওকত : মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব লাভ করেছে আমাদের কথাসাহিত্যে। গল্প-উপন্যাস, আলোচনা ইত্যাদি লেখাও হয়েছে প্রচুর। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেসব লেখা শিল্পের দিক থেকে কতখানি সার্থক হয়ে উঠতে পেরেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ যতখানি বড় ব্যাপার সে-মাপের সাহিত্য এখনো লেখা হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতে আমাদের লেখকরা সেই কাজটি করবেন। যদি না করতে পারেন, তাহলে সেই ব্যর্থতার দায় তাঁদেরই বহন করতে হবে। কিন্তু যতটুকু কাজ এক্ষক্ষত্রে হয়েছে তার সবটুকু কি আমরা পড়ে দেখেছি? আমি যতদূর জানি, মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে একাধিক ভালো গল্প এবং উপন্যাস ইতোমধ্যে লেখা হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় লেখক তো লিখেইছেন, তরুণতর লেখকরাও এ-বিষয়ের ওপর কাজ করেছেন।

আসলে প্রশ্নটা তো বাসত্মবতার, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বাসত্মবতা কি আগের চেয়ে অন্যরকম নয়? লেখকরা তো সেই পরিবর্তিত বাসত্মবতার মধ্যে বাস করেন, সুতরাং সেই পরিবর্তিত বাসত্মবতাই তো ধরা থাকবে সাহিত্যে। আমার ধারণা, লেখকরা পরিবর্তিত সেই জীবনবাসত্মবতার মধ্যেই লিখবেন আরো বহুকাল ধরে। এছাড়া কি অন্য পথ আছে তাঁদের? আমার মনে হয় না। একটা জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা কি হরহামেশাই ঘটে? আমার গল্প-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ বারবারই চলে আসে।

বাহার : এদেশের কথাসাহিত্যের বিকাশের ক্ষক্ষত্রে আপনার বিবেচনায় প্রধান অন্তরায়গুলো কী কী?

শওকত : সাহিত্যের পাঠ ও চর্চা যে জীবনের জন্য প্রয়োজন, এই উপলব্ধি যতদিন পর্যন্ত না সবার মনে জাগছে, ততদিন পর্যন্ত শুধু কথাসাহিত্য নয়, সবরকম সাহিত্যেরই সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি।

এখন সমস্যা, সাহিত্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করানোর কাজটা কে করবে, এবং কীভাবে করবে। আমার মনে হয়, এ-ব্যাপারে লেখকদের কিছু করণীয় আছে। এমনিতে সাহিত্যচর্চার সুযোগ খুব বেশি নেই। কিন্তু যতটুকু আছে তার ব্যবহার কি আমরা, লেখকেরা, করছি? আমরা এত কম লিখি কেন? একজন সৃজনশীল লেখক বছরে একখানা উপন্যাসও লিখবেন না, এটা কোনো কাজের কথা নয়। না-লেখার কারণে, সীমিতসংখ্যক পাঠকও যে সাহিত্যবিমুখ হয়ে যেতে পারেন – এ-কথাটা আমরা মনে রাখি না। আরো একটি কথা এই যে, আমরা অনেকেই ছোটদের জন্য লিখি না। এ-প্রসঙ্গে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে তিরিশের দশক এবং তারপরের লেখকেরাও ছোটদের জন্য নিয়মিত লিখেছেন। এবং তাঁদের লেখার মাধ্যমেই পাঠক তৈরি হয়েছে। সাহিত্যপাঠ তো অভ্যাসেরই ব্যাপার – আর বালক ও কিশোর পাঠকেরাই যে বয়সী পাঠক হয়ে ওঠে, এ-সত্য কি অস্বীকার করা যাবে?

এ-ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানেরও বড় রকমের দায়িত্ব আছে বলে মনে করি। সরকার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। সরকারি ব্যবস্থায় কি পাঠাভ্যাস বাড়ানোর কোনো সুযোগ আছে? আমার জানামতে বহু পৌরসভা আছে, যারা স্থানীয় লাইব্রেরিগুলোতে নামমাত্র অনুদান, অথবা আদৌ দেয় না। সরকার কি লাইব্রেরির সংখ্যা বাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? আমার মনে হয় না। জনসংখ্যার অনুপাতে হাসপাতালের বেডের হিসাব আমরা জানি, কিন্তু লাইব্রেরির হিসাব কি কখনো করা হয়েছে? স্রেফ মনোযোগ ও সচেতনতার অভাবে বহু প্রাচীন লাইব্রেরির এখন নাম-নিশানা পর্যন্ত নেই। সুতরাং কথাসাহিত্য বা সাধারণভাবেই সাহিত্য-বিকাশের প্রশ্নটা জাতীয় পর্যায়ে বিবেচিত হওয়া উচিত। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষক্ষত্রে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা কি বিষয়টা নিয়ে ভাবেন? আমার মনে হয় না। যদি ভাবতেন তাহলে তার খবর কাগজ মারফত আমাদের কাছে অবশ্যই পৌঁছত।

বাহার : কৃষিকেন্দ্রিক ও শিল্পকেন্দ্রিক আমাদের আর্থ-সমাজ ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতর যে ব্যবধান – এদেশের কথাসাহিত্যে তার কোনো উপস্থিতি না
থাকার কারণ কী?

শওকত : আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় শিল্পকেন্দ্রিক উৎপাদন এখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। তবু যতটুকু শিল্পক্ষক্ষত্র রয়েছে তার প্রতিফলন আমাদের কথাসাহিত্যে নিদারুণ রকম অনুপস্থিত – এ-কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। এর কারণ, শিল্প উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও
শিল্প-শ্রমিকদের জীবন যথেষ্ট প্রবলভাবে সমাজ-মানসে অনুভূত হয় না – আর দ্বিতীয় কারণ যাঁরা লেখালেখি করেন, সেই লেখকেরাও শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়া ও
শিল্প-শ্রমিকদের জীবনযাপনের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট হতে পারেননি। এরও অবশ্যি কারণ আছে। যে-শ্রেণি থেকে আমাদের কথাসাহিত্যিকরা এসেছেন, সেই শ্রেণিটির অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি। আমাদের শহরাঞ্চলগুলোর চারদিকে তো ক্ষিত, ফসল, গ্রাম আর গাছগাছালি। ফলে, সামান্য ঠাঁই বদল করলেই আমরা কৃষির যাবতীয় অনুষঙ্গের মধ্যে পড়ে যাই। শিল্প এলাকায় যদি আমরা যাই-ও তাহলে আমরা থাকি অতিথি দর্শকের মতো। যন্ত্রপাতি কিংবা উৎপাদন-প্রক্রিয়া চোখ মেলে দেখি শুধু। তাতে কখনো চমৎকৃত হই, কখনো হতাশ। ভেতরের দিকে যেতে পারি না।

আমার মনে হয়, লেখকদের অবস্থানগত ও মানসিক দূরত্বের কারণেই শিল্প ও কৃষিকেন্দ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যবধান-সংক্রান্ত বিষয়টি আমাদের কথাসাহিত্যে অনুপস্থিত।

বাহার : আমাদের কথাসাহিত্য কাহিনির অভাবে ক্রমেই যে বৈচিত্র্য হারাতে বসেছে, এ-ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

শওকত : কথাটা সবদিক থেকে ঠিক, আবার অন্যদিক থেকে ঠিক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কথাসাহিত্যিক কি আমোদ বিতরণকারী এন্টারটেইনার? যদি সেদিক থেকে বিচার করতে হয়, তাহলে কথাসাহিত্যিক নিটোল গোলগাল মজাদার গল্প বানাতে না পারলে সেটা তার ব্যর্থতা এবং এক্ষক্ষত্রে বুঝতে হবে মজাদার কাহিনির অভাবে কথাসাহিত্য বৈচিত্র্য হারিয়েছে। কিন্তু মূল প্রশণটা এখানে বিবেচনা করতে হবে যে, কথাসাহিত্য কি শুধুই গল্প বা কাহিনি? যদি হতো তাহলে রূপকথা বা কল্পকাহিনির বৈচিত্র্য দিয়েই তো কথাসাহিত্যের কাজ চলত। উপন্যাস বা আধুনিক ছোটগল্পের শিল্পরূপের দরকার হতো না। আসলে মানুষের জীবনই কথাসাহিত্যের বিবেচ্য বিষয়। তাতে পূর্ণাঙ্গ কাহিনি থাকতেও পারে, না-ও পারে। বিচার্য বিষয় হচ্ছে লেখক জীবনের কতটুকু দেখলেন ও দেখালেন এবং কীভাবে দেখালেন। লেখক জীবনের গভীর থেকে গভীরতর ভেতরের দিকে যদি যেতে পারেন, তাহলে তাঁর লেখায় যা উঠে আসবে তাতেই পাওয়া যাবে সাহিত্যের সেই অন্বিষ্টকে যা মানুষকে ভাবায় এবং আলোড়িত ও উদ্দীপ্ত করে।

বাহার : ভারতীয় ও এদেশি বেস্ট সেলার্স উপন্যাসগুলো আমাদের পাঠক সমাজে যেভাবে আদৃত হচ্ছে, তাতে এদেশের সিরিয়াস সাহিত্য কি ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে না? এ-প্রতিকূলতার সমাধান কী?

শওকত : ভারতীয় বা এদেশি বেস্ট সেলার্স মাত্রই কি হালকা সাহিত্য? বিষয়টা আমি ওভাবে দেখি না। বিদেশি বই অবাধে এলে তা দেশীয় প্রকাশনা-শিল্পকে অবশ্যই ক্ষতিগ্রসত্ম করবে; এ-বিষয়ে আমি একমত। কিন্তু সব বেস্ট সেলারই হালকা সাহিত্য হবে, এমন আমি মনে করি না। হেমিংওয়ের বই তো বেস্ট সেলার হয়েছিল, হেমিংওয়ের বই কি আপনার ভাষায় ‘সিরিয়াস’ নয়? আরো কথা এই যে, মানুষের সাহিত্য-রুচি উন্নততর হওয়ার জন্য সময় এবং চর্চার দরকার। আবার এও সত্য যে, সব দেশেই জনপ্রিয় সাহিত্য থাকে এবং তার পাশাপাশি প্রকৃত সৃজনশীল সাহিত্যও থাকে। সব দেশেই জনপ্রিয় সাহিত্যের কাটতি বেশি তাই বলে কি সৃজনশীল সাহিত্য কোণঠাসা হয়ে পড়ে? আইন করে কি ‘সিরিয়াস সাহিত্য’ বেশি পড়ানো যাবে? এক্ষক্ষত্রে যদি আদৌ সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাহলে সে-সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে সৃজনশীল সাহিত্যিকদেরই। আমি আগেই বলেছি, তাঁদের আরো বেশি এবং আরো ভালো লিখতে হবে। এমন ভালো যে, পাঠক যেন সেই লেখা পড়তে বাধ্য হন।

বাহার : আমাদের সাহিত্যের কোন ক্ষক্ষত্রটি পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে বলে আপনার মনে হয়?

শওকত : এই তুলনা আমি করতে পারব না, কারণ ও-বঙ্গের সাহিত্য বেশি পড়ার সুযোগ নেই। শুনতে পাই, আমাদের কবিতা ভালো এগিয়েছে। কিন্তু দেশ পত্রিকার কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কবিতা পড়ে মনে হয় না যে, আমাদের তরুণ কবিরা এগিয়েছেন। কেননা, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে ভাষা, উপমা, বিষয় ইত্যাদিতে দুই বাংলার কবিতা একই রকম। গল্প-উপন্যাস সম্প্রতি যা হাতের কাছে পেয়েছি তাতেও মনে হয়নি যে, ও-বাংলায় কথাসাহিত্য খুব একটা এগিয়েছে। আমাদের কথাসাহিত্য যে তুলনায় বেশি এগিয়েছে তাও বলার সময় এসেছে বলে মনে হয় না। এক্ষক্ষত্রে বলার কথা একটাই যে, বাংলাদেশের
কথাসাহিত্যে জীবনের স্পন্দন অনেক বেশি। আমাদের লেখকেরা সীমিত ক্ষমতা নিয়েও জীবনের অনেকখানি ভেতরের দিকে যেতে পেরেছেন। আমাদের কথাসাহিত্যিকদের লেখায় একটা তাজা ভাব ধরা পড়ে।

বাহার : এদেশের কথাসাহিত্যের বিকাশের ক্ষক্ষত্রে বর্তমানে যে প্রবল সংকট রয়েছে, এই প্রতিবন্ধকতার পেছনে কার ভূমিকা সবচেয়ে প্রধান – লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, পাঠক, সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি?

শওকত : এ-প্রশ্নের জবাব কিন্তু ইতোমধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে।

বাহার : আপনি কি মনে করেন ধর্মীয় কুসংস্কার আমাদের লেখার সুযোগকে সীমিত করছে?

শওকত : অনেকটা। ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে আমাদের লেখকরা লেখেন না। অনেকের আশঙ্কা, ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে লিখলে আমাদের দেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা ক্ষক্ষপে উঠবে।
কিন্তু কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্ যে-কাজ করেছেন তারপরে আমার মনে হয় না ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে লেখালেখি হলে তেমন বড় কোনো সমস্যা হবে। যতদূর মনে হয়, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এমন অসহিষ্ণু নয়।

এ-প্রসঙ্গে উর্দু সাহিত্য বা সাম্প্রতিক আরবি-সাহিত্যের উদাহরণ উলেস্নখ করা যায়। উর্দু কথাসাহিত্যের অনেকক্ষক্ষত্রে ধর্মীয় কুসংস্কারের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। আরবি বিশেষত মিশরীয় সাহিত্যে তো ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ পর্যন্ত করা হয়েছে – তাতে যে খুব অসুবিধায় পড়েছেন ওদেশের লেখকরা, এমন খবর আমার জানা নেই।