মাতেরার গুহাস্থাপত্য

ফারুক মঈনউদ্দীন

ইতালির বারি স্টেশনে নামার পর প্রাচীন গুহা দেখার জন্য মাতেরা যাবো শুনে কাদের সাহেব আমাদের সম্পূর্ণ পরিকল্পনার ওপর পানি ঢেলে দিলেন। তাঁর বক্তব্যও পানির মতো সহজ, দীর্ঘ দেড় যুগের ইতালিবাসের মধ্যে তিনি কষ্মিনকালেও শোনেননি মাতেরা নামের জায়গাটিতে দেখার মতো কিছু আছে, থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু সুদূর বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসে দেখতে যাওয়ার মতো কিছু নিশ্চয়ই নয়। আমি যতই বলি, আমি ওয়েবসাইটে সবকিছু দেখে তারপরই পরিকল্পনা করেছি, তিনি সেসবে কান দেন না। মাতেরায় হোটেল পর্যন্তু বুক করে ফেলেছি শুনে তিনি আমার যাবতীয় উচ্ছ্বাসকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলেন, টাকাগুলো অনর্থক জলে ফেলা হয়েছে। এসব কথোপকথনের মাঝে অবশ্য তিনি আমাদের মালপত্রগুলো তাঁর ছোট মাইক্রোবাসটিতে তুলে নেন। তারপর আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে স্টেশনের সামনের পর্যটন অফিসটিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে একটা ট্যুরিস্ট গাইডবই বের করে আমাকে কিছু লাইমস্টোন গুহার ছবি দেখিয়ে বলেন – এগুলোই হচ্ছে গ্রোত্তো (গুহা), মাতেরা না গিয়ে বরং থেকে যান বারিতে, আপনাকে এগুলো দেখাতে নিয়ে যাবো। আমি সবিনয়ে জানাই, সে-ধরনের গুহা আমি ভিয়েতনামের হালং বে-তে দেখে এসেছি। তিনি অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে জানান, মাতেরা যাওয়ার একমাত্র ট্রেনটি এ-স্টেশন দিয়ে আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যে পাস করে যাবে, এতো অল্প সময়ে ট্রেন ধরা যাবে না। তারপরও আমি নাছোড়বান্দার মতো ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হতে চাই শুনে তিনি তাঁর পরিচিত কাউকে ফোনে ধরলেন, যাতে তার গাড়িতে আমাদের মাতেরা পৌঁছে দেওয়া যায়। সে-লোক তখন লাঞ্চে। অগত্যা আমাদের দুপুরের হালকা খাবার খেয়ে নেওয়ার সময় দিয়ে তিনি গেলেন জোহরের নামাজ পড়তে, বলে গেলেন অন্য কোনো ব্যবস্থা না-হলে তিনি নিজেই আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবেন।

সেদিনের আগে কাদের সাহেবের সঙ্গে আমার কোনোই পরিচয় ছিল না। রোম থেকে বারি যাবো শুনে সেখানকার বাংলাদেশ বিমানের স্টেশন ম্যানেজার তাহের সাহেব সেখানকার একজনের ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, আপনাদের সীতাকুন্ডের লোক, খুব পরোপকারী। রোম থেকে ট্রেন ছাড়ার পর তাঁকে ফোনে পেয়ে যাই; তখন বলেছিলেন, বারি স্টেশনে পৌঁছে যাতে ফোন করি। স্টেশনে নেমে তাঁকে ফোন করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যান তিনি। প্যান্টের সঙ্গে টুপি-পাঞ্জাবি পরা শ্মশ্রুমন্ডিত লোকটিকে দূর থেকে দেখেই বাংলাদেশি বলে শনাক্ত করা যায়। কথায় কথায় জানালেন বিশ বছর ধরে ইতালির দক্ষিণ-পূর্বের বারি শহরের বাসিন্দা তিনি। গ্রামের বাড়ি সীতাকুন্ডের বাড়বকুন্ডে, জানালেন, কাপ্তান বাড়ি বললে এলাকার সবাই এক নামে চিনবে। বারিতে একাধিক দোকান ছিল; কিন্তু তাঁর উদারতা এবং ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো স্বভাবের কারণে সেগুলোর দুটি হাতছাড়া হয়ে গেছে, তাও নিকটাত্মীয়দের কাছে। আরেকটি বন্ধ করে রেখেছেন ব্যবসা পরিবর্তন করার জন্য। জানালেন, বারিতে একটা মসজিদ তৈরি করেছেন সেখানকার বাঙালিরা, সেই মসজিদের ইমামের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন এক ফাঁকে, বাড়ি চট্টগ্রামের মিরেরশ্বরাই। এমনকি বারিতে তৈরি করেছেন একটা শহীদ মিনারও। সেটি উদ্বোধন করে গেছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার।

আমাদের খাওয়া হতে হতে কাদের সাহেব নামাজ পড়ে ফিরে আসেন, তারপর বললেন, চলেন আমিই নামিয়ে দিয়ে আসব, যাকে আপনাদের নিয়ে যেতে বলেছিলাম ওর দেরি হবে। আমরা যতই বলি, আপনার কষ্ট করার দরকার নেই, আমাদের একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দিলেই চলবে, তিনি এই অপরিচিত শহরে এত দীর্ঘ যাত্রায় ট্যাক্সিওয়ালার হাতে আমাদের ছাড়তে চাইলেন না। তাঁর ঝরঝরে মাইক্রোবাসটাতেই আমাদের নিয়ে রওনা হলেন তিনি। গাড়িতে ওঠার আগে তিনি আমার স্ত্রী ও কন্যাকে দুটো সুগন্ধি উপহার দিতেও ভুললেন না। বারি থেকে মাতেরা প্রায় সত্তর কিলোমিটার রাস্তা, অতদূর রাস্তা উজিয়ে আমাদের নামিয়ে দিয়ে আবার একা গাড়ি চালিয়ে ফিরবেন তিনি – এ-ভাবনায় কাতর হয়ে যাত্রা শুরু করি আমরা।

বারি খুব বড় শহর নয়, তাই শহর ছাড়িয়ে যেতে খুব সময় লাগে না। শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে পথে এটা-ওটা দেখিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। খাঁ-খাঁ দুপুরের রোদে ইতালির গ্রামাঞ্চল কোথাও সবুজ, কোথাও ঊষর। কিছুদূর পর দেখা মিলছিল জলপাই বাগানের। ওখানকার জলপাই আমাদের দেশে জন্মানো জলপাইয়ের মতো অত বড় নয়, গাছও ফুট সাতেকের বেশি হয় না। সেসব জলপাই আজকাল টিন আর কাচের বয়ম ভর্তি হয়ে আমাদের দেশে রফতানি হয়ে আসে। বাগানগুলো কিছু ভারতীয়রা বন্দোবস্ত নিয়ে চালায়, আবার কোনোটিতে ভারতীয় শ্রমিকরা কাজ করেন।

মাতেরার কাছাকাছি এক জায়গায় রোড সাইন চোখে পড়ে – আলতামুরার দিকে যাওয়ার রাস্তার পথনির্দেশ। ইতালির জাতীয় সড়ক এসএস ৯৬ আলতামুরাকে হাতের ডানে ফেলে সোজা চলে গেছে মাতেরার দিকে। একটু ধন্ধে পড়ে যাই, জানতাম আলতামিরা গুহা হচ্ছে স্পেনে; কিন্তু ইতালিতে এটা দেখা যাচ্ছে আলতামুরা। নিজের জ্ঞানের ওপর খুব বেশি ভরসা আমার কখনোই ছিল না, তাই একটু আফসোস হচ্ছিল এত বিখ্যাত আলতামিরার কাছ থেকে ঘুরে যাচ্ছি। ওটা এখানে জানলে ভ্রমণসূচিটা অন্যরকম করে তৈরি করতাম। ১৮৭৯ সালে আবিষ্কৃত আলতামিরা গুহার ছাদে বাইসনের যে-ম্যুরাল অাঁকা আছে, ধারণা করা হয় সেটি খ্রিষ্টের জন্মের ১৬৫০০ থেকে ১৪০০০ বছর আগের। অবশ্য পরে হোটেলে গিয়ে আমার সে-ভুল ভাঙে। আসল আলতামিরা তার জায়গাতেই আছে, স্পেনে। ইতালির এই আলতামুরার লামালুঙ্গায় চুনাপাথর গুহার ভেতর পাওয়া গেছে চার লাখ বছর আগের বিবর্তিত প্রায়-মানব প্রজাতির চুনীভূত দেহাবশেষ। এটির নাম দেওয়া হয়েছে আলতামুরা মানব।

মাতেরা শহরে ঢোকার পর দুই জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কাদের সাহেব স্থানীয় পথচারীদের কাছ থেকে আমাদের হোটেলের ঠিকানা জেনে নেন, তবু তাঁর অপরিচিত এই শহরে তাঁকে বেশ কয়েকবার এদিক-ওদিক ঘুরতে হয়। শেষ পর্যন্ত পথচলা এক দম্পতিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি খুব কাছের একটা বিল্ডিংয়ের মাথায় প্যালেস হোটেলের লোগো সংবলিত সাইনবোর্ড দেখিয়ে দিলে বুঝতে পারি, আমরা এতক্ষণ এটির আশপাশ দিয়েই ঘোরাঘুরি করছিলাম। গাড়ি থেকে নামার পর পড়ি সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায়, এই দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে যাবে, তার প্রতিদান কীভাবে দেওয়া যায়? ট্যাক্সিওয়ালা হলে কোনো সমস্যা ছিল না। তবু বহু ইতস্তত করে তাঁকে তেলের খরচ দেওয়ার প্রস্তাব দিলে সবিনয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করে ফেরার পথে আবার যাতে যোগাযোগ করি, সে-অনুরোধ জানিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বারির দিকে ফিরে যান তিনি।

মাতেরার প্যালেস হোটেলটি চারতারা, অথচ ভাড়ার বিচারে ঢাকার নবাবপুর রোডের হোটেলগুলোর মতো রোমের দুই তারা ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট হোটেলের সমান। জায়গাটা যে ব্যস্ত ট্যুরিস্ট গন্তব্য নয়, সেটা হোটেলভাড়া থেকেই বোঝা যায়। সাধে কি আর মিরিয়াম মারফি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে মাতেরার ওপর লেখা একটা প্রবন্ধের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য টাউনস ইটালি ফরগট’? অর্থাৎ মাতেরার মতো শহর কেবল যে ট্যুরিস্টদের চোখের আড়ালে পড়ে আছে তা-ই নয়, খোদ ইতালিও ভুলতে বসেছে ঐতিহাসিক এ- নগরটিকে। কেবল হোটেলভাড়া থেকে নয়, মাতেরার সাসি ঘুরে দেখার সময়ও বুঝতে পারি, এটি এখনো খুব বেশি ট্যুরিস্টের চোখে পড়েনি। আমিও কি মাতেরার কথা জানতাম নাকি! বেশ কিছুদিন আগে কোথায় যেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাথর খোদাই করা গুহা-স্থাপত্যের অনেকগুলো ছবি দেখেছিলাম। হাজার বছর আগের সেসব অবিশ্বাস্য গুহা-স্থাপত্য এবং গুহা-ভাস্কর্যের মধ্যে ছিল আমাদের বাড়ির পাশের অজন্তা এবং ইলোরা, বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) পো উইন দং গুহা, চীনের ইয়াংআং গুহা, আবার মিশরের আবু সিম্বেল, জর্দানের পেত্রা, তুরস্কের কাপ্পাডোসিয়া গুহা, ইতালির মাতেরাসহ মোট পনেরোটি দেশের গুহাস্থাপত্যের ছবি। এগুলোর মধ্যে অজন্তা-ইলোরা দেখা, এমনকি ইলোরার একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ মুম্বাইয়ের কাহ্নেরি গুহাও দেখা। তাই এসব অবিশ্বাস্য গুহা স্থাপত্যের আরো কয়েকটা দেখার একটা অদম্য লোভ ছিল। ইউরোপ ভ্রমণের প্রথম কিস্তিতে রোমে ঢোকার আগে থেকেই মাতেরা যাওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। প্যালেস হোটেলের বুকিংও ইন্টারনেটে বাংলাদেশ থেকে দেওয়া। সে-সুবাদে এই হোটেলের আন্তোনেল্লা নামে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়। তার কারণেই হোটেলভাড়ার সঙ্গে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট যুক্ত হয়েছিল। চেক-ইন করার সময় ডিউটিতে ছিল মেয়েটি। বুকিং ভাউচার দেখার পর বিলক্ষণ চিনতে পারল আমাকে, কারণ বিনা পয়সায় সকালের নাস্তা এবং ওখানকার গুহা এলাকায় ঘুরে দেখার বিষয়ে ওর সঙ্গে আমার চালাচালি করা কয়েকটি মেইল। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে সে-হোটেলে নিশ্চয়ই গন্ডা গন্ডা ট্যুরিস্ট যান না। মেয়েটির ফ্যাকাশে চেহারা এবং গম্ভীর স্বভাবের কারণে ওকে এজাতীয় হোটেলের রিসেপশন ডেস্কের কর্মচারী হিসেবে মোটেই মানায় না, স্কুল-মাস্টারনি হলে বরং ওকে মানাত ভালো।

হোটেল রুমে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে নিচে নামলে আন্তোনেল্লা আমাদের হাতে মাতেরার একমাত্র দ্রষ্টব্য সাসি এলাকার একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিয়ে কলম দিয়ে দাগিয়ে ওখানে যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিয়ে বলে, দশ থেকে পনেরো মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ওখানে। তারপর জানায়, মেল গিবসনের প্যাসন অব দ্য ক্রাইস্টের শুটিং হয়েছিল মাতেরাতেই। অবশ্য পরে জেনেছি, ১৯৫৪ সালে বানানো পিয়ের পাওলো পাসিনির ক্লাসিক ছবি দ্য গসপেল অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথুর শুটিংও এখানে হয়েছিল। এছাড়াও ব্রুস বেরেসফোর্ডের কিং ডেভিড, এবং ক্যাথেরিন হার্ডউইকের দ্য নেটিভিটি স্টোরির শুটিংও এই মাতেরাতেই হয়েছিল। মেল গিবসন নাকি তাঁর ছবির লোকেশন হিসেবে বেছে নেওয়া সাসি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বাস্তবিকই প্রথম যখন জায়গাটা দেখি, পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি, কারণ এটি ছিল এত নিখুঁত।’ মাতেরার বৈশিষ্ট্য এমনই যে, খ্রিষ্টধর্মের আদি যুগের পটভূমিতে তৈরি ছবিগুলোর সেট হিসেবে এটিকেই সবাই বেছে নিয়েছিলেন।

আমরা রাস্তায় নেমে ম্যাপ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য হাশিখুশি চেহারার আধবুড়ো এক লোককে ম্যাপ দেখিয়ে রাস্তার হদিস জানতে চাইলে লোকটি ইতালীয় ভাষায় অনেক কসরত করে আমাদের যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দেয়। ম্যাপ দেখে ঠিক রাস্তায় গেলেও পথে আরো দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে এগোতে থাকলে পথে পড়ে এক শপিং এরিয়া। ঝকঝকে পরিষ্কার তবে প্রাচীন রাস্তার দুধারে আলো-ঝলমল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সব দোকানপাট দেখে ঠিকপথে এসেছি কিনা বুঝতে পারি না। কিছুদূর আগে ভিত্তোরিও ভেনেতোর সামনের বিশাল স্কোয়ার থেকে এক লোক আমাদের এদিকেই পাঠিয়েছে। এখানে দু-একজনকে ম্যাপ দেখিয়ে সাসি এলাকার সন্ধান জানতে চাইলে তাদের কেউ দুহাত নেড়ে অসহায়ত্বের ইঙ্গিত দেয়, কেউবা খুব চিন্তিত মুখে ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, স্যরি। এমনকি ধরাচুড়া পরা পুলিশের একটা দলকে জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর মেলে না। শেষ পর্যন্ত ইংরেজিভাষী এক শিখ যুবক আমাদের নির্ভুলভাবে সাসি যাওয়ার পথটা বাতলে দিতে পারে।

‘সাসি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পাথর, ইতালীয় ভাষায় বলা হয় ‘সাসি ডি মাতেরা’, অর্থাৎ মাতেরার পাথর। প্রায় নয় হাজার বছর আগের গুহামানবরা যেসব গুহায় বাস করতেন, সাসির সেসব গুহাগৃহে মাত্র সেদিন পর্যন্ত বাস করেছে তাদেরই উত্তরপুরুষরা। মাত্র সেদিন বলতে ভারতভাগেরও তিন বছর পর, ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইতালির দক্ষিণ প্রান্তের মাতেরা গুহাবাসী মানুষের ইতিহাসের এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন হওয়া সত্ত্বেও অবহেলিত এ-জনপদকে দেশ এবং বিশ্বের কাছে প্রথম পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী এক ইতালীয় ইহুদি কার্লো লেভি (১৯০২-৭৫)। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করা লেভি ছিলেন একাধারে চিত্রশিল্পী, লেখক ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে মুসোলিনি সরকার ১৯৩৫ সালে তাঁকে ইতালির দক্ষিণে লুসানিয়া নামের এক পান্ডববর্জিত অঞ্চলে নির্বাসিত করে। নির্বাসিত অবস্থায় তিনি সেখানকার আদিবাসী স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে যান, স্বাস্থ্যসেবায় অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেন তাদের চরম দুর্দশা। পরবর্তীকালে নির্বাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্যারিসে চলে গিয়েছিলেন তিনি। দেশে ফিরে আসার পর আবারো সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধ হন।

সে-সময়ে জেলে বসে তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত বই ক্রিস্তো সি অ্যা ফেরমাতো অ্যা এবোলি, যার বঙ্গানুবাদ খ্রিষ্ট থেমে যান এবোলিতে। যে-লুসানিয়ায় কার্লোকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, সেটি বাসিলিকাতা প্রদেশের অন্তর্গত। দারিদ্র্যপীড়িত এই প্রদেশ-অভিমুখী সড়ক এবং রেলপথ এবোলিতে এসে শাখাবিভক্ত হয়ে ভিন্নদিকে চলে গেছে, তাই লুসানিয়ার লোকজন তাদের দুর্দশার কারণকে এভাবেই প্রকাশ করত। ইতালির দক্ষিণের দারিদ্র্যপীড়িত, মৌলিক চাহিদাবঞ্চিত এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ মনে করত খ্রিষ্টধর্ম এবং তার নীতি ও ইতিহাস তাদের বঞ্চিত ও উপেক্ষা করে চলে গেছে। ফলে পরিপূর্ণ মানুষের অভিজ্ঞতা তারা লাভ করতে পারেনি। কার্লোর ভাষায়, ‘যিশুখ্রিষ্ট কখনোই এতদূর পর্যন্ত আসেননি, সময় আসেনি, আসেনি মানুষের আত্মা, আসেনি আশা, আসেনি কার্যকারণ সম্পর্ক, আসেনি ইতিহাস, কেবল শত্রু, বিজেতা অথবা উপলব্ধিহীন কিছু আগন্তুক ছাড়া আর কেউই আসেনি এ-জায়গায়।’ মাতেরা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের বঞ্চনাবোধ, তাদের চরম দারিদ্র্য ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা প্রণালী চিত্রায়িত করে লেখা কার্লোর এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হলে একটা চরম কেলেঙ্কারির মুখে পড়ে ইতালীয় সরকার। অবস্থা সামাল দিতে সরকার ১৯৫০ সালে এখানকার প্রায় ২০ হাজার আদিবাসীকে মাতেরার নতুন গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এমনকি এখান থেকে সরে যেতে অনিচ্ছুক বাসিন্দাদের বাধ্য করতে ১৯৬০ সালে ইতালি সরকারকে গুহাগৃহগুলোতে বাস করা অবৈধ ঘোষণা করতে হয়েছিল।

এই আইনি ব্যবস্থার কারণে সাসির গুহাবাসী আদিবাসীরা হারাতে বসে তাদের প্রজন্মান্তরের পূর্বপুরুষের ভিটে। কার্লো লেভির নেতৃত্বে সচেতন নাগরিকরা সেদিন এগিয়ে না এলে সাসি আজ আর ঐতিহাসিক গুহাস্থাপত্যের দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতো না। তাঁরা দাবি করেন, গুহাবাসী আদিবাসীদের জবরদস্তি করে সরিয়ে দিয়ে হাজার বছরের নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে পরিত্যক্ত মৃত শহরে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে এটিকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে। অবশ্য এ-ব্যবস্থার ফলে লাভবান হয়েছিল ধনী বাসিন্দারা। তারা সরকারের বরাদ্দ করা বাড়ি কিনে নিয়েও মাতেরার সাসিতে গুহাগৃহগুলোকে সংস্কার করে সেগুলোকে বাসোপযোগী করে তুলতে পেরেছিল। সরকারের এ-উদ্যোগের পুরোপুরি সুফল পেতে সময় লাগে প্রায় ত্রিশ বছর, কারণ বেশি গরিব যারা তাদের পক্ষে সরকারের নতুন বাড়িতে ওঠারও সামর্থ্য ছিল না, তাই ১৯৬০ সালের আইন করার আগে পর্যন্ত তারা তাদের আদি গুহাঘরেই থেকে গিয়েছিল। আশির দশকে ধনী বাসিন্দারা তাঁদের সংস্কার করা গুহাবাড়িগুলোতে ফিরে এসে থাকতে শুরু করে। অনেকগুলো এরকম বাড়ি কালক্রমে পরিণত হয় আবাসিক হোটেল-রেস্তোরাঁয়। ইতালীয় সরকার সাসির সংস্কার কাজের জন্য ১০ হাজার কোটি লিরা বরাদ্দ দিয়েছিল, যাতে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া লোকজন আবার এসে বসবাস করতে উৎসাহিত হয়। সরকারি বরাদ্দ পাওয়ার পর পৌর কর্তৃপক্ষ পরিবেশ এবং স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য বিনষ্ট না করে এখানে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করে।

সাসির বর্তমান জনসংখ্যা তিন হাজারের মতো। বাকি যেসব গুহাগৃহে সংস্কারের কাজ চলছে সেগুলোতে থাকতে পারবে আনুমানিক আরো হাজার সাতেক মানুষ। ১৯৯৩ সালে এটিকে ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দারিদ্র্যপীড়িত ঐতিহাসিক এ-অঞ্চলটি যে ইতালির অন্যতম প্রধান পর্যটনস্থান হতে পারে, সেটি বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল সরকার এবং নগরকর্তাদের। পর্যটকদের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে এ-কাজে হাত লাগায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইতালীয় সরকার এমনকি হলিউডও। এখন সাসি আর গরিব গুহাবাসী মানুষের অস্বাস্থ্যকর কোনো অঞ্চল নয়, নানান মানের হোটেল-রেস্তোঁরা গড়ে উঠেছে এদিক-সেদিক, এমনকি স্বাদে ভিন্নতা আনার জন্য গুহাকে প্রায় অবিকৃত রেখে রূপান্তরিত করা হয়েছে হোটেলে।

শিখ যুবকটির দেখানো পথে গিয়ে ঠিকঠিক দেখা মেলে তেরো শতাব্দীর গম্ভীর চেহারার মাতেরা ক্যাথেড্রালের। শপিং এরিয়া পেরিয়ে আসার পর এদিকটা প্রায় জনশূন্য। তার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে সেডিলে স্কোয়ারের এক মাথায় সেডিলে প্যালেস। ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি এক সময়কার প্রাচীন এই পৌর ভবনটিকে হাতের ডানে রেখে টানেলের মতো গেট দিয়ে প্রশস্ত সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সর্পিল সেই সিঁড়িপথ ধরে ক্রমাগত নামতেই থাকি, রাস্তায় জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই যে কাউকে জিজ্ঞেস করব। এদিক-ওদিক সব গেরস্তবাড়ি, বোঝা যায় বাড়ির উঠোনে জামা-কাপড় রোদে মেলা আছে বলে। গোলকধাঁধার মতো কিছু সিঁড়ি কিছু পায়ে-চলা পথ ধরে এগোতে থাকলে বোঝার কোনো উপায় নেই ঠিক কোন দিকে যাচ্ছি। এলোমেলোভাবে বাড়ির ওপর বাড়ি, অপরিকল্পিত গলিঘুঁজির অন্ধকার কোণে যেন থমকে আছে ইতিহাস।

এক সময় অাঁকাবাঁকা সিঁড়িপথ শেষ হলে একটা চওড়া রাস্তার দেখা মেলে, লোকজনও চোখে পড়ে দু-একজন। এখানে-ওখানে কয়েকটা খুব ঘরোয়া মতো আবাসিক হোটেল, সামনে টেবিল সাজানো ছোট রেস্তোরাঁ। মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়িও ধিরবেগে চলে যাচ্ছিল। ঈষৎ মেঘযুক্ত আশ্চর্য শান্ত পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে তাকালে চোখে পড়ে পাহাড়ের গায়ে সেঁটে থাকা নানান আকারের ঘর। সেগুলোর জানালা-দরজার কালো গহবরগুলো অন্তহীন বর্ণহীন পাথুরে কাঠামোর গায়ে ফুটিয়ে তুলেছে বিচিত্র জ্যামিতিক নকশা। পাথুরে পাহাড়ের শরীর থেকে কুদে বের করা কিছু ঘরের পেছনে আছে গুহার সত্যিকার গুহাঘর। এগুলোর ছাদের ওপর দিয়ে হয়তো চলে গেছে প্রশস্ত পথ।

জনহীন নিস্তব্ধ সেই পাথুরে রাস্তা ধরে যেতে যেতে পৌঁছে যাই সেন্ট পিয়েত্রো কেভোসো গির্জার সামনের প্রশস্ত চত্বরে। এই গির্জাটিও চোদ্দো শতাব্দীর শেষদিকে তৈরি। বিশাল চত্বরের একপাশে গুটিকয় গাড়ি পার্ক করে রাখা। একপাশে বুকসমান উঁচু দেয়াল, তার ওপারে নিচে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে। দেয়ালের পাশে দাঁড়ালে চোখে পড়ে গির্জার পেছনের গভীর গিরিখাত আর অন্যপাড়ের পাহাড়। গির্জার ডানপাশে উঁচু ধনুকাকৃতির গেট, তার নিচে এক বয়স্ক লোক একটা টেবিল নিয়ে বসা, টেবিলের ওপর কেনার মতো নয় এমন অল্প কিছু স্যুভেনির, মাতেরার ট্যুরিস্ট গাইড বই, ম্যাপ ইত্যাদি সাজানো। ভাবলাম এখান থেকে বুঝি আবার ভেতরে ঢোকার টিকিট কিনতে হবে। লোকটি সেরকম কিছুর আভাস দেয় না, বরং ভাঙা ইংরেজিতে তার সওদাগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতদূর হেঁটে আসার পর এই প্রথম একটা স্যুভেনিরওয়ালা দেখতে পেলাম, ট্যুরিজম যে এখানে এখনো জমে ওঠেনি, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে এখানে পা দেওয়ার পর থেকেই। নিরীহদর্শন বয়স্ক লোকটাকে দেখে বেশ মায়া হয়।

গেট দিয়ে ঢুকলে এক ঝলকে ছবিতে দেখা মাতেরার আকাশরেখা ফুটে ওঠে চোখের সামনে। সেন্ট পিয়েত্রো গির্জার পেছনদিক দিয়ে যে গভীর গিরিখাত নেমে গেছে সেটি এদিকে দিয়েই গিয়ে দূরে বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেছে দৃষ্টিসীমা থেকে।  সেটির ধারে রেলিংঘেরা চত্বর থেকে খাঁড়ির উল্টোদিকে তাকালে পাথুরে পাহাড়, মাঝে মাঝে কিছু রোদজ্বলা ঘাসের চাপড়া পাথরের গায়ে সৃষ্টি করেছে ধূসর কোলাজ, তারই মাঝে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুহা। তবে এগুলো একেবারেই বুনো আদিম, এপাড়ের গুহাঘরগুলোর মতো বড় নয়, সংস্কার এবং বাড়তি নির্মাণের ছোঁয়াবর্জিত। এগুলোকে গুহাঘর বলার কারণ, এ-পাড়ের প্রায় সব আদি গুহার সামনে পরবর্তীকালে দেয়াল তুলে বাড়তি কামরা নির্মাণ করা হয়েছে, সুতরাং সেগুলো কেবলই গুহা নয় আর।  বিশ্বাস হতে চায় না ওপাড়ের সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত গুহাগুলোতে একসময় মানুষজন থাকত। দূরের সেই গুহাময় পাহাড়ের ওপর কিছু লোকের নড়াচড়া দেখা যায়, এরা হয়তো হাইকিং করতে গেছে ওখানে, কারণ ওপাড়ের গুহাগুলো একেবারেই পরিত্যক্ত। হাইকাররা এত কষ্ট করে কী মজা পায় কে জানে।

পূর্বপাড়ের বিক্ষিপ্ত পরিত্যক্ত গুহাগুলোর তুলনায় এপাড়ের পাহাড়ের গায়ের গুহাস্থাপত্যগুলো সংস্কারের পর সৃষ্টি করেছে এক ছেদহীন বর্ণহীন ভিন্নরকম পাথুরে কোলাজ। আমরা গভীর গিরিখাতের ধারে দাঁড়িয়ে বহু নিচে বয়ে যাওয়া ক্ষীণস্রোতা জলধারার সবেগে বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে এই এলাকার আদিবাসী মানুষের জলকষ্টের কথা বিস্মৃত হই। অথচ একসময় এখানকার দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জলকষ্টের সীমা ছিল না। গ্রাম ও বসতিগুলো গড়ে উঠত গিরিসংকটের ধারে এবং পাহাড়ের ঢালে। সেই গিরিখাতের নিচে দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনীই ছিল তাদের ব্যবহার্য পানির মূল উৎস। প্রতি সকালে পরিবারের মেয়েরা পানি বয়ে আনত সেখান থেকে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল তাদের বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা। ঘরের বাইরের উঠোনের একপাশ থেকে পাথর খুঁড়ে পথ কেটে মিলিয়ে দেওয়া হতো ঘরের মেঝের নিচের গভীর চৌবাচ্চার সঙ্গে। বৃষ্টি হলে বাইরের সে-জল গড়িয়ে এসে জমা হতো পরে ব্যবহারের জন্য। আজকাল বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কথাটা বেশ শোনা যায় দেশে- বিদেশে, অথচ ঠিক এ-কাজটি বহু বছর আগে উদ্ভাবন করে ফেলেছিল গুহাবাসী এক জনগোষ্ঠী।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে কিছুদূর ওপরে উঠি, এদিক-সেদিক বহু গুহাগৃহ নির্জন, পরিত্যক্ত। সংস্কার করার পর যেগুলোতে লোকজন আছে সেগুলোর বাইরে ফুলের টব এবং অন্যান্য গৃহস্থালি উপকরণ, রোদে শুকোতে দেওয়া নানা বর্ণের কাপড়-চোপড় ধূসর পাথুরে পাহাড়ের গায়ে বর্ণিল অর্কিডের মতো ঝুলে থাকে যেন। নিচে কোনো বাড়ির ছাদে দেখা যায় উজ্জ্বল সাদা কাপড়ের ঢাকনা দেওয়া গোল ছোট টেবিল ঘিরে কয়েকখানা চেয়ার, বৈকালিক চা পানের খুব শান্ত ঘরোয়া পরিবেশ। পাহাড় কুদে বের করা এলোমেলো গুহাগুলোর অনেকগুলোই  পরিত্যক্ত, আবার কোনোটির গায়ে ডেভেলপার কোম্পানির মালিকানা নেটিশ সাঁটানো।

ওপর থেকে নেমে এলে একটা গুহাঘরের দরজার সামনে একদল ট্যুরিস্টের জটলা দেখে বুঝতে পারি, ভেতরে কিছু একটা চলছে। দরজার পাশে দাঁড়ানো এক তরুণীকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ভেতরে সাসির আদি বাসিন্দাদের বসতবাড়ির জীবন্ত নমুনা দেখা যাবে জনপ্রতি মাত্র চার ইউরোর বিনিময়ে। ‘স্তোরিকা কাসা গ্রোত্তা’ (যার অর্থ সম্ভবত – ঐতিহাসিক গুহাগৃহ) নামের এই অতিক্ষুদ্র জাদুঘরে একসঙ্গে জনাআষ্টেক লোক ঘুরেফিরে দেখতে পারে বলে আমাদের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটি নির্ভুল ইংরেজিতে বলে, আপনারা পাশের ঘরে বসে ডকুমেন্টারিটা দেখতে থাকেন, সময় হলে আমরা ডেকে নেব। সেখানে মাঝারি আকারের এক গুহাঘরে প্রজেক্টরে দেখানো হচ্ছিল সাসির আদি মানুষের ঘরবাড়ি এবং জীবনযাপন প্রণালীর প্রামাণ্যচিত্র। সেটি শেষ হতেই গেট-আগলানো তরুণীটি এসে আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। ব্রোশিওর পড়ে জানা গেল, মাতেরার কালচারাল থিয়েটার গ্রুপের সদস্যরাই জাদুঘরটির ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত, মেয়েগুলোর প্রাণবন্ত উচ্ছল তৎপরতা দেখে সেজন্যই ওদের স্বেচ্ছাসেবক বলে মনে হচ্ছিল।

La gestione è a cura dell’associazione culturale Gruppo Teatro Matera, che grazie alla passione e alla costanza dei suoi operatori, è divenuta nel corso degli anni meta obbligata per molti visitatori italiani ed esteri, riscuotendo numerosi consensi e riconoscimenti dalle principali testate giornalistiche ed emittenti televisive nazionali e internazionali. খুব ছোট সে-গুহাঘরটিতে ঢুকলে বোঝা যায় সেকালের গুহাবাসী মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল। আমরা ঢোকার পরই কোনো লুকানো লাউড স্পিকার থেকে ইংরেজি ধারাবর্ণনা শুরু হয়, তবে ইংরেজি না-জানা দর্শনার্থীদের জন্য ভিন্ন ভাষার ব্যবস্থাও আছে ভিন্ন সময়ে। ঘরটির সবদিকে সাজানো রয়েছে একজন কৃষকের ঘরে থাকা পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন গৃহস্থালি উপকরণ – বালতি, গামলা, বেতের ঝুড়ি, হারিকেন, মাটি এবং চিনামাটির তৈজস, ভান্ড, বিভিন্ন আকারের জার – এসবের কোনোটি দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখা, কোনোটি দেয়ালের গায়ে ঝোলানো। একটা কাটা দেয়ালের পেছনের গভীরতর অংশ ব্যবহার হতো ভাঁড়ার ঘর হিসেবে, সেখানে তেমন কিছু রাখা নেই, তবে এখন যে প্রমাণ সাইজের খচ্চরের মূর্তিটি রাখা আছে ওদিকে, একসময় এ-পাশেই হয়তো ছিল ওটার আস্তাবল। মূল দরজা দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁয়ে রান্নাঘর, সেখানে হাতা, খুন্তি, চামচ, হাঁড়ি, কড়াই, সসপ্যান, ফ্রাইপ্যান, বোতল এসব সাজানো। রান্নাঘরে ঢোকার আগে দেয়ালের গা-ঘেঁষে পাথরের মেঝে কেটে বের করা একটা ত্রিকোণাকার গর্ত, সেটার ভেতর উঁকি দিলে দেখা যায় নিচে বড়সড় একটা চৌবাচ্চা, দরজার বাইরে থেকে পাথর কেটে তৈরি একটা নালা এনে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে ওটাতে। এটাই সেই বহুল আলোচিত বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা। ঘরের এক মাথায় একটা তাঁত। বিছানাপাতা উঁচু খাটের নিচে ওরা মুরগিগুলো রাখত, তার পাশে একটা কালো রং করা কাঠের চেস্ট অব ড্রয়ার, দেখে মনে হয় না এটির ব্যবহারকারী সাসিবাসীটি ততটা প্রাচীন যুগের ছিলেন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তখন সাসিবাসী গুহামানবরা গৃহপালিত পশুপ্রাণীর সঙ্গে একঘরেই বাস করত। কার্লো লেভিও তাঁর খ্রিষ্ট থেমে যান এবোলিতে বইটিতে লিখেছেন, ‘এসব গুহা গভীর গিরিসংকটের শক্ত মাটি খুঁড়ে  তৈরি করা।… মাটির দেয়ালের এসব কৃষ্ণ-গহবরের ভেতর আমি দেখেছি বিছানাপত্র, দীনহীন সরঞ্জামাদি, ত্যানাকানি। মেঝেতে এলোমেলো শুয়ে থাকা কুকুর, ভেড়া, ছাগল, শূকর এসব। সাধারণত সব পরিবারের জন্য ছিল এরকম একটিই গুহাঘর, আর তারা সেখানে নারী-পুরুষ, বাচ্চাকাচ্চা এবং পোষা পশুগুলো নিয়ে ঘুমাত। এভাবেই বাস করত হাজার বিশেক মানুষ।’ লেভি অন্য জায়গায় লেখেন, ‘সাসির গুহাগুলোতে কৃষকের পুঁজি লুকানো, আর হৃদয় লুকানো রয়েছে তাদের প্রাচীন সভ্যতার মাঝে। এটির বিষণ্ণ সৌন্দর্য এত বাঙ্ময় এবং হৃদয়স্পর্শী বলে যে-ই মাতেরাকে দেখে সে, সম্ভ্রমোপহত না হয়ে পারে না।’ লেভির বর্ণনার বিষণ্ণ, গম্ভীর এবং বর্ণহীন সৌন্দর্য কেবল এটির পথে পথে হেঁটেই উপলব্ধি করা যায়।

সেখান থেকে যখন বেরিয়ে আসি, তখন বিকেল আরো গাঢ় হয়েছে। উঁচু ফটকের নিচে বসা স্যুভেনিরওয়ালা লোকটা তার সামনের টেবিলের জিনিসপত্র গোছগাছ করার এন্তেজাম করছিল, বোঝা গেল সন্ধ্যার পর আর বেচাবিক্রি হবে না। কেনার জন্য বাছাই করার মতো তেমন বিশেষ কিছু ছিল না। অগত্যা  সাসির ওপর একটা সচিত্র ট্যুরিস্ট গাইড বই নিলাম ছয় ইউরো দিয়ে। আমি আমাদের স্বভাবসুলভ কায়দায় একটু দরাদরি করতে উদ্যত হলে ঢ্যাঙা শীর্ণকায় লোকটা কিছুটা নিরুপায় হয়েই যেন একখানা পিকচার পোস্টকার্ড দিলো ফাউ হিসেবে। এরকম বিরান ট্যুরিস্ট এলাকা না হলে ওরা আমাকে থোড়াই পাত্তা দিত। ইউরোপীয় মন্দার শিকার বলেই হয়তো এমন বাড়তি খাতির। এটা নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও ভাষার ব্যবধানের জন্য সম্ভব হয় না। গির্জার চত্বরটাতে এসে আবার ফিরতি পথের সেই ভুলভুলাইয়া চড়াই ভাঙতে হবে ভেবে একটা ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করি, কিন্তু মেলে না। মাতেরাতে আদৌ ট্যাক্সি আছে কি-না কে জানে। এতদূর পথ হেঁটে এসে একখানা ট্যাক্সিও চোখে পড়েনি। অগত্যা আবার সেই গলিঘুঁজির গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে ফিরতি পথ ধরি। আসার সময় মহানন্দে নেমে এসেছিলাম, কিন্তু এবারে সিড়ির পর সিড়ি টপকাতে গিয়ে টের পাওয়া যাচ্ছে হাড়ে-হাড়ে। তার ওপর আছে ভুলপথে চলে যাওয়ার ভয়, এখানে ছিনতাইকারীর ভয় আছে কিনা জানি না। দিনের আলো মুছে যাচ্ছে ধীরে, সেই নির্জন গলিপথে  লোকজন নেই, কোনো কোনো বাড়িতে মনুষ্য বসবাসের চিহ্ন দেখা গেলেও জীবন্ত প্রাণীর দেখা মেলে না। কিছুদূর ওঠার পর দম নেওয়ার জন্য থামতে হচ্ছে, সেই ফাঁকে এদিক-সেদিক উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিতে হচ্ছিল আমরা এদিক দিয়েই নেমেছিলাম কিনা। সেই ভুতুড়ে নির্জন ইতিহাস-প্রাচীন পরিত্যক্তপ্রায় লোকালয়ে নিভে আসা দিনের আলোর ভেতর আমাদের বিদেশি পরিবারটাকে সে-মুহূর্তে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। এ-সময় নেমে যাওয়া সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে তলোয়ারের মতো তীক্ষ্ণ শরীরের এক তরুণীকে পেশাদার ফটোগ্রাফারের মতো একটা জুতসই অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে দেখে কিছুটা সাহস সঞ্চয় হলে আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করি।

শেষ পর্যন্ত সেই গোলকধাঁধার সিঁড়ি আরোহণ করে আমরা উঠে আসি সেডিলে স্কোয়ারে।  চোদ্দোশো শতাব্দীতে এ-স্কোয়ারের চারপাশে ছিল দোকানপাট, সরাইখানা ইত্যাদি। ১৫৫০ সাল নাগাদ এখানে উঠে আসে গভর্নরের অফিস, জেলখানা এবং নগর মিলনায়তন। সেডিলে স্কোয়ারের মাথায় যে পুরনো ভবনটির পাশ দিয়ে সাসিতে যাওয়ার সিঁড়ি নেমে গেছে, সেই পালাজ্জো ডেল সেডিলে তৈরি হয়েছিল ১৫৪০ সালে পৌর কর্তৃপক্ষের অফিস হিসেবে। ভবনটির সামনের বারান্দায় ইতালি আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটো পতাকা ক্রস করে লাগানো, এটি এখন ইতালির জাতীয় ইতিহাস সংরক্ষণবিষয়ক একটা প্রকল্পের অফিস। স্কোয়ারটিকে ঘিরে এখনো রয়েছে আবাসিক হোটেল, একটা ছোট আকারের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আমরা উঠে আসার পর সেডিলে স্কোয়ারের একটা ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁয় পেতে রাখা চেয়ারে কিছুক্ষণ ফাউ বসে বিশ্রাম নিই। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছিল দ্রুত। সেই অপরিসর আলোয় চারপাশের স্থাপনাগুলোর ছবি তুলতে তুলতে দিনের আলো আরো ম্লান হয়ে আসে। নিচের সাসি ঘুরে আসার পর ভূগোলের সামান্য জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি, প্রাচীন এই নগরীটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে আছে নতুন শহর, আর একপাশে আছে গভীর গিরিখাত, তার উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে পরিত্যক্ত গুহাগুলো এখনো উৎকীর্ণ হয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

সেডিলে স্কোয়ার থেকে বের হয়ে ফিরতি রাস্তায় পিয়াজ্জা ভিত্তোরিও ভেনেতোতে এসে বসি। পিয়াজ্জা মানে স্কোয়ার বা প্লাজা। চারপাশে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ভবনঘেরা এই বিশাল স্কোয়ারটি হচ্ছে মাতেরার প্রাণকেন্দ্র। মাতেরার লোকজন সন্ধেবেলাটায় সেডিলে প্লাজা থেকে ভেনেতো প্লাজায় এবং মাঝের দোকানগুলোয় ঘুরে কাটায়। এই অংশটাতে এখানে বাস করা বাসিন্দারাই কেবল গাড়ি চালাতে পারে, বহিরাগতদের গাড়ির প্রবেশ নিষেধ, তাই ইতস্তত দুয়েকটা গাড়ি ছাড়া আর সব পায়ে হাঁটা মানুষ বলে ঘুরে বেড়ানোটা হয় নির্ঝঞ্ঝাট।

লোকজন বাচ্চাকাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত, বয়স্ক লোকজন ভিত্তোরিও বেনেতো প্রাসাদ নামে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রাচীন মনাস্ট্রির সামনের বসার জায়গাটায় অলস বসে আছে, কেউ খবরের কাগজটা দিনের অলো মুছে যাওয়ার আগে পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রাচীন আশ্রমটির কপালে সচল ঘড়িটায় সন্ধে ৭টা বাজে, এদিক-ওদিক বাতিগুলো জ্বলে উঠতে থাকে। স্কোয়ারের অন্যপাশে স্যান ডোমিনিকো গির্জার সাদামাটা ভবন। বিশাল স্কোয়ারটিতে এত লোকজন, অথচ তেমন কোনো কোলাহল নেই, শুধু মাঝে মাঝে খেলায় রত বাচ্চাদের ছোটাছুটির শব্দ আর সহর্ষ উল্লাস। ভিত্তোরিও বেনেতো প্রাসাদের সামনে উল্টোদিকে বেলভিদেরি লুইগি গুয়েরিক্কিও, এখান থেকে একনজরে সাসির পুরনো শহর দেখা যায়। এটার রেলিংঘেরা পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে সাসো বারিসানোর প্রায় পুরোটাই চোখের সামনে ধরা দেয়। আমরা সেন্ট পিয়েত্রো কেভোসো গির্জার পাশের যে-অংশটা থেকে ঘুরে এলাম সেটা হচ্ছে সাসো কেভোসো। দূরে মাতেরা ক্যাথেড্রালের উঁচু মিনার দেখা যাচ্ছিল আকাশের পটভূমিতে। তারপাশে একটা দৈত্যাকার ক্রেন তর্জনী নির্দেশ করে রেখেছে দিগন্তের দিকে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে সাসির আকাশরেখায় এই দুটোর চাইতে উঁচু আর কিছু নেই। সাসিতে যে সংস্কারকাজের দক্ষযজ্ঞ চলছে, ক্রেনটার উপস্থিতি সে-কথাই জানান দেয়। সাসির বর্ণহীন ঘরগুলোতে একে একে বাতি জ্বলে উঠছে বলে বিকেলের মরা আলোর ধূসরতা দূর হয়ে, সেখানে কিছুটা বর্ণচ্ছটা দেখা দেয়। এই বেলভিদেরির নিচেও আছে বর্ষার জল সংরক্ষণের জন্য বড় বড় ভূগর্ভাধার, কিন্তু সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় সেগুলো আর দেখতে যাওয়া হয় না।

আমরা সেই পরিচিত রাস্তায় আবার হোটেলের পথ ধরি। মফস্বলের রাস্তায় যেমনটি দেখা যায়, খুব বেশি গাড়ি-ঘোড়া লোকজনের চলাচল নেই, একটা পারিবারিক সবজির দোকান আগলাচ্ছিল দুই তরুণী, দুই বোন হতে পারে। ওখান থেকে  একগাদা আঙুর কিনলাম শস্তা পেয়ে। মেয়েগুলোর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হয় না, একবর্ণ ইংরেজি জানে না কেউই। অথচ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা না বললে একটা জায়গা সম্পর্কে বাড়তি অজানা কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

আমাদের হোটেলটিতে রাতের খাবার খেয়ে নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মেন্যুতে যা দাম দেখলাম তাতে আক্কেল   গুড়ুম, রুম ভাড়া শস্তা হলে কি হবে, খাবারের দাম পাঁচ দু গুনে দশ তারা হোটেলকে হার মানায়। অগত্যা    আন্তোনেল্লার শরণাপন্ন হয়ে কাছেধারে কোনো রেস্তোঁরার হদিস চাই। ওর নির্দেশিত রাস্তায় হোটেলের কাছাকাছি আবাসিক এলাকার প্রায়ান্ধকার এক গলিপথে পাওয়া যায় উদ্দিষ্ট রেস্তোঁরাটি। সম্পূর্ণ খালি রেস্তোঁরাটিতে একটিমাত্র পরিবার বসা, আর একজন মাত্র বেয়ারা। ওকে চিকেন পিৎজার অর্ডার দিতে গিয়ে মহা বিপদে পড়া গেল। লোকটি পিৎজা বুঝলেও তাকে কিছুতেই চিকেন বোঝানো যায় না। অন্য টেবিলে শিশুপুত্রসহ অতি অল্পবয়সী যে দম্পতি বসা ছিল তাদের শরণাপন্ন হই, ‘‘এক্সকিউজ মি, এই লোক চিকেন বুঝতে পারছে না, একটু সাহায্য করবেন দয়া করে?’’ বিপদের ওপর বিপদ, এরাও বিদেশী, ফরাসী। আমরা নানা কসরৎ করে বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয় না। শেষপর্যন্ত কোনো রকমে মোরগের ডাক-টাক দিয়ে লোকটাকে আমাদের চাহিদা বোঝানো সম্ভব হলে আমরা সে রাতের সমূহ উপবাসের হাত থেকে রক্ষা পাই।

পরদিন সকাল দশটায় বারির ট্রেন ধরতে হোটেল থেকে পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হই মাতেরা সেন্ট্রাল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হোটেলের রিসেপশন থেকে বলেছিল পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। বাস্তবেও দেখলাম তাই, মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর বাস টার্মিনাসের মতো একটা বড়সড় খোলা জায়গায় পৌঁছালেও স্টেশনের দেখা মেলে না, অথচ এটাই স্টেশন হওয়ার কথা। এক লোককে জিজ্ঞেস করলে সে একটা ছোট ঘর দেখিয়ে দেয়। ওটাতে ঢুকে টিকিট ঘর পাওয়া গেল, কিন্তু রেল লাইন, প্লাটফরমের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। বারির টিকিট চাইলে দিলও লোকটা, জিজ্ঞেস করলাম, ট্রেনটা কোথায় পাওয়া যাবে। লোকটা কাউন্টার-উইন্ডোর বাইরের দেয়ালের গায়ে ঝোলানো একটা বাক্সের মতো যন্ত্র দেখিয়ে বললো, টিকেট ভ্যালিডেট করাতে হবে আগে। ওটার মধ্যে একেকটা টিকেট ঢোকালে পর ঘটাং শব্দ করে ছাপ্পা পড়ে আবার বেরিয়ে আসে। আমাদের রেলে কোনো কোনো ট্রেনের জন্য  কার্ডবোর্ডের ছোট যে টিকিট দেওয়া হয়, সেগুলো ইস্যু করার সময় স্টেশন মাস্টার একটা ছোট লোহার যন্ত্রের ভেতর ওটা ঢুকিয়ে চাপ দিলে ঘটাং করে একটা শব্দ হয়ে যে রকম তারিখ খোদাই হয়ে যায়, বুঝলাম এটাও ওরকম ক্যানসেল করার ব্যবস্থা।  এবারে লোকটার দিকে তাকালে উল্টোদিকে নেমে যাওয়া একটা সিড়ির দিকে  দেখিয়ে বলে, প্লাটফরম ওদিকে। এটাই তাহলে ব্যাপার ! সিড়ি দিয়ে মাটির নিচে নেমে গেলে দেখা যায় একটা অপরিসর, অন্ধকার এবং অপরিচ্ছন্ন প্লাটফরম, ওখানে বসে থাকার প্রশ্নই ওঠে না, তাই হাতে সময় আছে বলে ওপরে উঠে আসি।

সময়মত নিচে নেমে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথে ট্রেন ঢোকে প্লাটফরমে। বারি এবং মাতেরার মাঝে চলাচলকারী এই ট্রেনটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির।  দুটোমাত্র কামরার ছোট ট্রেনটি আমাদেরকে নিয়ে মাটির নিচ থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোকে বেরিয়ে আসে, দুপাশে বিস্তীর্ণ মাঠের ঊষর দৃশ্য দেখে মনে পড়ে আগের দিনের পড়ন্ত বিকেলে দেখা সাসির গুহাসারির ধূসর দেয়ালের জ্যামিতিক নকশাদার ক্যানভাসের কথা। সাসির বিষণ্ণ সৌন্দর্য্য সম্পর্কে বহু যুগ আগে ইতালির কবি জিওভান্নি পাসকোলি (১৮৫৫ – ১৯১২) বলেছিলেন, ‘‘আমি যতগুলো শহর ঘুরেছি, সেগুলোর মধ্যে মাতেরাই আমার কাছে ছিল হাস্যোজ্জ্বল, এটিকে আমি এখনও সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারি কবিতা এবং বিষাদের ভেতর দিয়ে।’’ বস্ত্তত প্রাচীন এ নগরীটি যেন এখনও এক নিভৃত, নির্বাক পৃথিবীর প্রান্তদেশ। সেদিন পড়ন্ত বিকেলের দীর্ঘ ছায়ার নিচে বর্ণহীন পাথরের ক্যানভাসকে মনে হচ্ছিল আরও নির্জন এবং বিষণ্ণ।