সৌমিত্র বসু
মেঘনাদ ভট্টাচার্য বললেন, খুব ভালো হয়েছে। খালেদদার মতো মাথা উঁচু করে থাকা একজন মানুষের এত কষ্ট – আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। – এটাই বোধহয় খালেদ চৌধুরী সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা, সারা জীবন মাথা উঁচু করে চলা একজন মানুষ।
জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯১৯, বাংলাদেশের শ্রীহট্ট বা সিলেটে। প্রথমে নাম রাখা হয়েছিল চিরকুমার। সে-নাম পালটে হলো চিররঞ্জন। ১৯৪৫ সালে চলে এলেন কলকাতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তখন, আগস্টে হিরোশিমায় পড়বে আণবিক বোমা। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে দেশে দেশে আন্দোলন শুরু হয়েছে, কোনো দেশের সমস্যা কেবল সেই দেশের সীমান্তেই আটকে নেই আর। স্বাধীনতার ঋণ এগিয়ে আসছে, রক্তে পিচ্ছিল, মাতৃভূমি ভাগে দীর্ণ এক হাহাকারের স্বাধীনতা। যোগ দিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। দাঙ্গার সময় আশ্রয় পান মুসলমান পরিবারে, সেখানেই নতুন নাম হলো, খালেদ। এই নাম আর সারা জীবনে পরিত্যাগ করেননি। শ্রীহট্টের চিররঞ্জন কলকাতায় নতুন জীবনে প্রবেশ করলেন মুসলমান এক নামে, অথচ এমন নয় যে, পালটাতে হলো নিজের ধর্ম। বস্ত্তত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের ধর্মেই বিশ্বাস রাখেননি মানুষটি, তাঁর ধর্ম সব অর্থেই তাঁর নিজের ধর্ম হয়েছিল মৃত্যু পর্যন্ত।
সেই অর্থে জনপ্রিয় কোনো মানুষ নন, যাঁদের নাম বলামাত্র আমজনতা চিনে ফেলতে পারে। কিন্তু যাঁরা শিল্পী বা শিল্পপ্রেমী, মানুষের গভীর প্রকাশের মাধ্যমগুলির এলাকায় যাঁদের যাতায়াত, সব থেকে বড় কথা, যাঁরা মানুষের চরিত্রবলকে শ্রদ্ধা করেন, খালেদ চৌধুরী তাঁদের অন্তর্মনের পূজা পেয়েছিলেন। সংগীত, বিশেষ করে লোকসংগীত বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান। হয়তো সে-জায়গা থেকেই তিনি গণনাট্য সংঘের মঞ্চে গাওয়া গান বিষয়ে খুশি ছিলেন না। বারবারই বলতেন, কলকাতা থেকে এসে আমরা গান গেয়ে যেতাম বটে, কিন্তু চলে যাওয়ার পরে গ্রামের মানুষ যথারীতি নিজেদের গানই গাইত, আমরা তাদের কিছুমাত্র পেনিট্রেট করতে পারিনি। খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন, অন্যান্য নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজানোতেও তাঁর ছিল অবিসংবাদিত দক্ষতা। উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল দারুণ। নাটকের প্রয়োজনে তো ঘড়ঘড়ি বলে একটা বাজনাই তৈরি করে ফেললেন। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে মোটর পার্টসের দোকানে ফেলে রাখা নানা লোহা-লক্কড় জোগাড় করে তার সঙ্গে বাঁশির সুর মিশিয়ে কেমন করে তৈরি করেছিলেন রক্তকরবীর ওভার্চার বা নাটক শুরুর আবহ, সে-গল্প শুনেছিলাম তাঁর নিজের মুখে।
অসামান্য ছবি অাঁকতে পারতেন। স্বাধীনতার পরে, বাংলা থিয়েটার যখন একটি নতুন বাঁক নিল, এই গুণগুলির ব্যাপক ব্যবহার করেছেন তিনি। অজস্র বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন এবং হয়তো প্রচ্ছদের একটিমাত্র ছবি দিয়ে সম্পূর্ণ বইটির নির্যাস তুলে আনার দক্ষতাই তাঁকে মঞ্চস্থপতি হিসেবে বরণীয় করে তুলেছে। বহুরূপীর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর মঞ্চভাবনা করেছিলেন খালেদ চৌধুরী, যাকে বাংলা মঞ্চ-পরিকল্পনার ইতিহাসে মাইলফলক বলে মনে করা হয়। এ-নাটকের পোশাক-পরিকল্পনাও তাঁর করা। সত্যি বলতে কী, রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের জটিল নাটককে দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ দেওয়া যায়, এই বিশ্বাস আমাদের মনে সঞ্চারিত করে দেন শম্ভু মিত্র। সে-কাজে তাঁর যোগ্য সহচর ছিলেন এ-মানুষটি। বহুরূপীর পুতুলখেলা, ডাকঘর থেকে নিন্দাপঙ্কে পর্যন্ত অজস্র নাটকে তাঁর কাজ ছাত্রদের কাছে চিরকালের শিক্ষণীয় হয়ে আছে। একটা সময় শম্ভু মিত্র, খালেদ চৌধুরী আর তাপস সেনের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতো নাট্যজনদের মুখে। আরো বহু দলের নাটকে মঞ্চ-পরিকল্পনার কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। একদিকে যেমন ছবি অাঁকার ক্ষমতায় মঞ্চের মধ্যে নানা কোণ, উচ্চাবচতার বিচিত্রসব ধরন তৈরি করতে পারতেন, অন্যদিকে আবার খুব সহজ কিছুকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে নাটকের গভীর অর্থকে বের করে আনায় তাঁর জুড়ি ছিল না। এ-কথাও বিশেষ করে মনে রাখতে বলব, বিভিন্ন দলের প্রযোজনায় একই নাটকের একাধিক মঞ্চ-পরিকল্পনা করেছেন তিনি, বহুরূপীর রক্তকরবী আর আরব্ধ নাট্যবিদ্যালয়ের রক্তকরবী, কিংবা সমকালে দাঁড়িয়ে বহুরূপীর পাগলা ঘোড়া আর অনামিকার হিন্দি পাগলা ঘোড়ার মঞ্চ এতটাই আলাদা যে, তাদের একই শিল্পীর কল্পনাজাত বলে ভাবা প্রায় অসম্ভব মনে হয়। বহুরূপীর বাইরেও কাজ করেছেন বহু নাটকে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.