মাহবুবের কুটিরশিল্প

মোস্তফা তারিকুল আহসান

ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েও মাহবুবের চাকরি হয়নি। তখন ওর আবার ছানাপোনাও হয়েছে একখানা, তো তিনখানা মুখের আহার সে জোগায় কী করে? এতদিন তবু আশা ছিল। এখন তো কিছুই নেই। প্রিয় একজন শিক্ষক বুদ্ধি দিলেন, তুমি বরং এমফিল বা পিএইচ-ডি কোর্সে ভর্তি হয়ে যাও। কিছু মাসোয়ারাও পাবে, আর পরেরবার চাকরি পাওয়ার জন্য তুমি স্ট্রং হয়ে উঠবে। মাহবুব স্যারের কথা বুঝেছিল ঠিকই কিন্তু সায় দিতে পারছিল না। ও বলেছিল, মাসোয়ারা মানে তো মাসে পনেরোশো টাকা। ও দিয়ে সিগারেটের খরচও হয় না আমার। শিক্ষক মাহবুবকে পছন্দ করতেন। ও সিগারেট খায়, তাও তিনি জানতেন। তবে এভাবে মুখের ওপর বলাতে তিনি একটু কষ্ট পান। মাহবুব স্যারের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে। ও সঙ্গে-সঙ্গে স্যরি বলে। আরো বলে, স্যার মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। স্যার বলেন, না, ঠিক আছে। তাছাড়া তোমরা তো বড় হচ্ছো। আর তোমার কথাও তো ঠিক, একটি ছেলে বা মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে আসবে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় দিচ্ছে মাসে পনেরোশো টাকা – এটা তো রীতিমতো ঠাট্টা। তবু দেখো ভেবে, কী করবে।
কী মনে করে মাহবুব গবেষণা কোর্সে ভর্তি হয়ে যায়। এক রুমের বাসা নেয় ভার্সিটির কাছাকাছি। দুটো টিউশনিও জুটে যায় বন্ধুদের সুবাদে। তবে সংসার করতে গিয়ে দেখতে পায় এখানে সে টিকতে পারবে না। গবেষণার কাজেও বেশ খরচ আছে। বাচ্চা বউয়ের খরচ জোগাতে তার ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। এখন সে বোঝে, বিয়েটা আর কয়েক বছর পরে করলে ভালো হতো। তবে মঞ্জুকে সে কীভাবে ফাঁকি দিত? এখন বিয়ে না করার অর্থই তো ফাঁকি দেওয়া। সে এও ভাবে, মঞ্জু তো একটা চাকরি করতে পারে। মঞ্জুকে সে একবার জিজ্ঞেসও করেছিল। সে বলেছিল, তোকে বিয়ে করেছি এই তো ঢের, আবার চাকরি কী রে? ভাগ্য ভালো, মেয়েটা এখনো কথা বুঝতে শিখেনি। না হলে সে হয়তো…। মাহবুব অবশ্য কিছু মনে করেনি। কারণ আমাদের মাহবুব খুব ভালো ছেলে। সে মঞ্জুকে ভালোবাসে, মঞ্জুও ওকে ভালোবাসে। ওরা তুই-তোকারি করে সেই প্রথম বর্ষ থেকে। আর বিয়ের পরও সেটা ছাড়তে পারেনি। তবে মঞ্জু সব সময় ওকে তুই বললেও বাবা-মা, বড়দের সামনে তুই বলে না। সমস্যা হয় মাহবুবের। ও দুরকমভাবে কথা বলতে পারে না। একদিন বাবার সামনে মঞ্জুকে সে তুই বলে ফেলেছিল। বাবা স্কুলমাস্টার, বেশ নিয়মতান্ত্রিক ও সেকেলে ধরনের মানুষ। তিনি মাহবুবের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন, এই শিক্ষা কোথা থেকে পেয়েছ মাহবুব? মাহবুব চুপ করে থাকে। জানে, তার উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। চুপ করে থাকাই বরং নিরাপদ।
তো একদিন কী মনে করে তল্পিতল্পা নিয়ে মাহবুব পাবনার দিকে রওনা দিতে শুরু করল। কাজলার গেট দিয়ে মর্নিংওয়াক সেরে রুমে ফেরার সময় দেখি ও মেয়ে কোলে করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, পাশে মঞ্জুও আছে। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমিও মাহবুবের সঙ্গে কোনো কাজ না পেয়ে গবেষণা করতে শুরু করেছিলাম। আর আমি কাউকে বিয়ে করার মতো বিপদে ছিলাম না। কাজেই আমার একলা চলতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। পাইলে খাই, না পাইলে এক গ্ল¬াস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ি। শহর থেকে কবিবন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাত নটা-দশটার দিকে ফিরে প্রায়ই ডাইনিংয়ে খাবার না পেয়ে বিনোদপুর বাজারে সোলেমান মিয়ার হোটেলে বাসি খিচুড়ি খাই দশ টাকা দিয়ে, টাকা না থাকলে বাকি। সোলেমান মিয়া মন খুব খারাপ করে না। সে হয়তো জানে যে, এরা গবেষক-ছাত্র মানুষ, টাকা না দিয়ে যাবে কোথায়? অবশ্য বহু গবেষক-ছাত্র যে টাকা না দিয়ে সটকে পড়ে, সে হিসাবও সোলেমান মিয়ার মাথায় আছে। আমি গবেষণা করি, মানে প্রথমত, ২০টা বিষয়ে কোর্সওয়ার্ক করি, পদ্য লিখি (কারণ কবিতা হয় না, বিশেষত বন্ধু-বান্ধব বিস্তর প্রশংসা করলেও সম্পাদক সাহেব আমার কবিতায় কোনো সার পদার্থ খুঁজে পান না। এক সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন, বেশি করে আধুনিক কবিতা পড়ুন, দরকার হয় কারো থেকে দু-একটি লাইন মেরে দিন এবং কিছু নিজে যোগ করুন।) সে-চেষ্টা অবশ্য করতে হয়নি। গবেষণার চাপে কবিতার ভূত মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিল অচিরেই। এখন তো বুঝি, আমি কোনো কালে কবি ছিলাম না; থাকলে কবিত্বশক্তি এত দ্রুত পালিয়ে যেত না। যা হোক, মাহবুবের কাছে যেতেই সে তার উঁচু বিশালাকৃতির দাঁত বের করে হাসতে শুরু করল। কোনো কথা বলে না, শুধু হাসে। আমরা অবশ্য মাহবুবকে সব সময় হাসতেই দেখি। বিভাগে চাকরিটা তো ওরই হওয়ার কথা। ওকে বাদ দিয়ে যখন থার্ড পজিশনের ছেলেকে চাকরি দিলেন ভিসি সাহেব, তখনো আমরা ওকে কাঁদতে দেখিনি। আমি বললাম, যাস কই?
ও বলল, পাবনা?
পাগলা গারদে?
না, তবে পাগলা গারদ সেখান থেকে খুব কাছে। ইচ্ছা করলে যখন-তখন যেতে পারব।
বেড়াতে?
না রে, একবারে। এখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
তো ওখানে গিয়ে কী করবি?
একটা কলেজে চাকরির কথা হয়েছে। দেখি কী হয়।

সেই যে মাহবুব গেল আর ফিরে আসেনি কোনোদিন। আমি নানা কসরত করে, জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়লাম। পাশ করার পরপর, বিশেষত বিভাগে দরখাস্ত করার পর, এবং প্রথমবার চাকরি না হওয়ার পর থেকে আমার নানা হাল হয়েছে। দুই প্রভাবশালী দলের নামে আমার কঠিন সম্পর্ক বলে প্রচার করা হয়েছে। তবে যে-দল ক্ষমতায় থাকে, সে-দল আমাকে টানে না। আমি তখন হয়ে যাই অন্য দলের। কীভাবে হই, কারা বানায়, আমি বলতে পারব না। রাজনীতি কী, না বুঝলেও আমাকে নিয়ে যে রাজনীতি হয় সেটা বুঝতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এক মেসে আমি শুয়ে থাকি। উঁইপোকায় দেয়াল, মেঝে, বইপুস্তক নষ্ট করে আর জীর্ণ দোদুল্যমান একটা খাটে চামড়ার মতো তেল-চিটচিটে একটি বালিশ আমাকে বেশ ঘুম দেয় এবং কাজের মেয়ের বিচিত্র স্বাদের রান্না আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমাকে টিকে থাকতে হবে। ভাবি এ-সময় কবিতা আমার সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। আমার মতো আরো কজন ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মেধাহীন যুবক যারা বাংলাদেশে আর কোনো চাকরি পাওয়ার ক্ষমতা রাখি না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায় অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, তারা অদ্ভুত এক প্রজাতি এতে কোনো সন্দেহ থাকে না।
হয় কী, আমি ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ থিওরির প্রয়োগ করতে পারি আমার জীবনে। মাহবুব পারে না। রবিন পারে না। তৌহিদ পারে না। আতিক পারে না। ওরা আমার চেয়ে খারাপ ছিল না বরং ভালো ছিল; কিন্তু আমি সেই ন্যালাভোলা কবি-কবি স্বভাবের তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিদাতা ভিসির কোটারি দলের সঙ্গে কীভাবে যেন মিশে যেতে পারি। তাদের যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারি। এখন আমার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে না। ভিসি সাহেবের গুপ্তচর বাহিনীও আমার নামে ভালো রিপোর্ট লেখে। আমাকে একজন ভিসিপন্থী শিক্ষকের কন্যার পাণিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয় (বন্ধুমহল একে বলবে অস্ত্র জমা দিয়ে চাকরি গ্রহণ)। একজন দূত আমার ভূতের গলির জীর্ণ মেসে একদিন রাতে এসে হানা দেয়। সব শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। তবে কে যেন আমাকে শক্তি জোগায়। ঈশ্বরকে তো সেভাবে কোনোদিন ডাকিনি, তিনি আমাকে সাহায্য করবেন কেন? হয়তো শয়তান আমাকে সাহায্য করেছিল। আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। ততদিনে আমার বাবা মারা গেছেন, মানে আমার মাথার ওপর তখন কোনো ছাদ নেই। বড় ভাবির অনুরোধে বড় ভাই তার সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক আগেই। কাজেই আমি বাস্তববাদীর মতো রাজি হয়ে গেলাম। একটি সাদা কাগজে তারা আমার দস্তখত নিল। একে গোপন দলিল বলা যায় কিংবা বলা যায় চাকরি কনফার্ম করার গোপন সফল বন্দোবস্ত এবং অদ্ভুত উপায়ে। আমার ইন্টারভিউ হলো। প্রথমবারের মতো আমার বুক কাঁপল না। দৃশ্যত কেউ আমাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন না। এ যেন জামাইবাবু প্রথম শ্বশুরবাড়ি গেছে। ভিসি মহাশয় আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ধরুন আপনার হয়ে গেল, আপনার অনুভূতি কেমন? আমি তো রীতিমতো অবাক হচ্ছি। এর আগে যখন ইন্টারভিউ দিই, তিনি শুধু আমাকে সাল-তারিখ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। জানতেন, পারব না। ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাব আর ঘোষণা করা হবে, কী চাকরি হবে! ব্যাটা তো কিচ্ছু জানে না। অথচ একজন এমএ পাশ, ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলেকে তিনি কেন সাল-তারিখ জিজ্ঞেস করেন? বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না কেন, সেটা ভাবার বিষয়। যা হোক, আমাকে তখন গাধা বানানো হয়েছিল কারণ আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, আমাকে নেওয়া হবে না। তাছাড়া শুধু ইন্টারভিউ নিয়ে একজন ছাত্রের মেধা কীভাবে বিচার করা সম্ভব? যাহোক এবার আমার চাকরি আগেই হলো। কোনো টেনশন করতে হলো না। আমি আমার সম্মান বিক্রি করে দিলাম, স্বাধীনতা-মর্যাদা নিয়ে বেঁচে আছি বলতে পারব না। তবে বেঁচে আছি, এই তো ঢের।
যে-মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা ছিল, তাকে একদিন আমার সামনে আনা হলো। আমি তখন জুবেরি ভবনে থাকি। প্রথম বেতন পেয়ে কিছু পোশাক-আশাক কিনে সভ্য হওয়ার চেষ্টা করছি এবং এটাও প্রাণপণে চেয়েছি, যেন বিয়েটা না হয়। তবে এবার শয়তানও আমার সাহায্য করেনি। বন্দোবস্তকারী শিক্ষক একদিন আমার রুমে এলেন, এবং বললেন – দেখো, তোমাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে; এখন তুমি বিয়েটা করে ফেলো। সবার তো আগেই বিয়ে পড়ানো হয়, পরে চাকরি দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে তোমাকে কিছুটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তুমি মেধাবী ছেলে, বুদ্ধিমান ছেলে। আশা করি আমার কথা মানবে। তিনি যেভাবে কথা বলছিলেন তাতে তাকে পাকা অভিনেতা বলে মনে হয়। তার উচ্চারণ, হাত-পা নাড়ানো কিংবা দেহভঙ্গিমা সবকিছু অভিনেতার মতো। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। সত্যিকার অর্থে বিয়ে বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া যাকে জীবনে কোনোদিন দেখিনি, বিন্দুমাত্র পরিচয় নেই, তাকে কীভাবে বিয়ে করব। আমি কিছুক্ষণ পর বললাম – আমার মা খুবই অসুস্থ, আমাকে কিছুদিন সময় দিন। তিনি হাসতে-হাসতে বললেন, সে তো আরো ভালো কথা, তাড়াতাড়ি বিয়ে করে মাকে নতুন বউ দেখাও, মা খুশি হবেন।
আমি বুঝতে পারলাম আমার উপায় নেই, হাঁড়িকাঠ প্রস্ত্তত, আমাকে বলি দেওয়া হবে। আমি স্বেচ্ছায় নাকি জোর করে বলি হচ্ছি তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে আমার বলি রদ হবে না জানি। বেশি কিছু বললে তিনি আমার স্বাক্ষর করা কাগজ বের করবেন। একটু পরে রিকশাযোগে মেয়েটা এলো। বসল চেয়ারে, আর সে আমার মুখের দিকে কোনোরকম সংকোচ না করেই চেয়ে থাকল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, এরকম অভিজ্ঞতা এর আগেও হয়েছে অনেকবার। আমিও উপায়ান্তর না পেয়ে তাকে দেখলাম। বুঝতে পারছি আমাকে গিলতে হবে এবং তাতে যত কষ্ট হোক। নিজেকে কী মনে হলো এখন ভেবে বলতে পারব না। তবে একজন যুবক মানুষের কোনো নারীকে দেখলে যে অবস্থা হয়, আমার তা হলো না। আমি তেমন কারো সঙ্গে মিশিনি কখনো। কারো সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও হয়নি। কাজেই অচেনা কাউকে আমাকে সঙ্গী হিসেবে নিতে হবে, সেটাই হয়তো ভবিতব্য। তবে কেন জানি আমি কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। বন্দোবস্তকারী কোনো রাখঢাক না রেখেই বলে ফেললেন, কেমন দেখলে? যদিও এখানে পছন্দ-অপছন্দের কিছু নেই, বরং সে আমাকে পছন্দ করবে কিনা সেটাই এখন প্রধান ব্যাপার। আমি কোনো উত্তর করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমি তখন সত্যি-সত্যি আমাকে নিয়ে ভেবেছি, যেমন কবিতা লেখার জন্য ভেবেছি – যখন ব্যর্থ কবি, কেন উত্তীর্ণ চরণ খুঁজে পেতাম না সহজে। সেদিনও ভেবেছি অচেনা মেয়েটিকে সামনে রেখে। জীবনে এর চেয়ে বড় কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা আমি করিনি। জানতাম, এরকম একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো, যেদিন চাকরির জন্য সাদা কাগজে দস্তখত করেছিলাম।
সবকিছু শেষ হলো, সেই মেয়ে সামসুন বেগম আমার বিবাহিত স্ত্রী। আমি কেমন আছি সেটা বলার মতো কোনো বিষয় নয়। সহ্যক্ষমতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছি। কিছুটা থিতু হয়েছি গত এক বছরে বলা যায়। বিভাগে যোগদান করে একটা পরিবেশ পেয়েছি, সেটাই কিছুটা স্বস্তি। সেটা কতদিন থাকবে জানি না। মাঝে মাঝে মাহবুবের ফোন পাই, আতিক ফোন করে। আতিক ফোন করে মাহবুব সম্পর্কে বলে। সে নাকি বদলে গেছে। আমি বিশ্বাস করি না। আমাদের মাহবুব, সেই ভালো ছেলে মাহবুব কীভাবে বদলে যায়। আতিক বলেছে, মাহবুব গবেষণা বাদ দিয়েছে। লেখাপড়া করে না। সে করে কুটিরশিল্প। আমি কুটিরশিল্প কী জিনিস বুঝতে পারি না। যা হোক, সিদ্ধান্ত হয়, আতিক আর আমি পাবনা যাব। কেন সে গবেষণা বাদ দিয়েছে, কেন সে বিভাগে দরখাস্ত করেনি আমরা জানি না। সে নিজে কিছু বলেনি। ফোন করলে বলে ভালো আছি।
একদিন বিকেলে আমি আর আতিক পাবনার উদ্দেশে রওনা দিই। ওকে কিছু বলি না। কেন বলি না, বলতে পারব না। প্রস্তাবটা ছিল আতিকের। আতিক আর আমি একসঙ্গে পৌঁছলাম ওর বাড়ির সামনে বিকেল ৫টার দিকে। আমরা কলিংবেল চাপতেই একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো। সে যে মঞ্জু নয়, সে তো আমরা ভালো করে জানি। যা হোক, ঘরে ঢুকে আমি মাহবুবের নাম ধরে ডাকতেই ও বারান্দায় চলে এলো। সেই মাহবুব, উঁচু দাঁতে হাসিমুখে আমাদের সহপাঠী মাহবুব খোন্দকার। বসার ঘরে ঢুকতেই দেখলাম চৌদ্দো-পনেরোজন মেয়ে চেয়ারে-বেঞ্চে বসে আছে। মাহবুব কিছুটা অপ্রস্ত্তত বোঝা যাচ্ছে। আমরা না জানিয়ে এসেছি, তার জন্য ও মন খারাপ করেনি বরং ওকে মেয়েদের দঙ্গল নিয়ে টিউশনি করতে দেখছি, সেজন্য কিছুটা অপ্রস্ত্তত। মেয়েরা আমাদের দেখে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। আতিক বলল, তোমরা বসো। ওরা বসল। মাহবুব বলল, আরেকটু পড়াতে পারলে ভালো হতো। যা হোক, তোমরা আজকে যাও। কাল এসো।
মেয়েরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। একজন আবার নাকিসুরে বলল – স্যার, কাল কখন আসব স্যার? আরেকজন বলল – স্যার, কাল কী পরীক্ষা হবে স্যার? মাহবুব ঠিক কী বলবে যেন বুঝতে পারে না। শুধু বলে, কাল এসো। ওরা বেরিয়ে গেলে আতিক বলল, কাল আসবে মানে। আমরা তো চার-পাঁচদিন থাকব। তোমার কুটিরশিল্প ধ্বংস করে তারপর যাব। মাহবুব কিছু বলে না। আমি বললাম, তুই মহিলা কলেজে চাকরি নিয়েছিস? মাহবুব ঘাড় নাড়ে। কথা বলে না। আতিক বলে, কথা বলো সোনামানিক। দুবছর পরে তোমার সঙ্গে দেখা আর তুমি ঘাড় নেড়ে জবাব দিচ্ছ – ব্যাপার কী? তোমার বউ কই? মঞ্জু – মঞ্জু বলে সে ডাক শুরু করে। মাহবুব বলে, ও বাসায় নেই, বাবার বাড়িতে গেছে। – সে কি! আতিক লাফিয়ে ওঠে যেন! ও তো কখনো বাপের বাড়ি যায় না। তোকে বিয়ে করার পর থেকে তো ও-পথ বন্ধ।
মাহবুব বলে, আগে যেত না, এখন যায়।
যায় মানে, কবে গেল, আসবে কবে? ঝেড়ে কাশ বাবা।
তুই, আমাকে জেরা করছিস কেন? এসেছিস, বস। বিশ্রাম কর। ধীরে ধীরে সব শুনিস।
আমি বলি, তোর মনে অনেক কিছু জমা আছে বলার জন্য। ও বলে – না, এমন আর কী।
আমরা বুঝতে পারি, যে-আগ্রহ নিয়ে আতিক বা আমি কথা বলছি, মাহবুব ততো আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে না। কারণ নিশ্চয় কিছু আছে। আমরা তো এসেছি ওকে দেখতে। ও কেমন আছে তা দেখার জন্য। কেন সে-বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করেনি। ও দরখাস্ত করলে ওর তো চাকরি হতে পারত। বিভাগের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র মাহবুব সারাজীবন বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করবে? এটা সে নিজে মেনে নিয়েছে? কেন?
আমরা পৈলানপুরের রাস্তা ধরে মানসিক হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করি। মাহবুব এখনো সপ্রতিভ নয়, কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। আতিকের গুঁতো খেয়েও সে চুপচাপ আছে। আতিক এও বলেছে, আমরা এসেছি বলে তুই কি রাগ করেছিস? মাহবুব বলে, কী বলিস যা-তা। কতদিন পর তোদের দেখলাম, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। তবে সব সময় তো মানুষ একইভাবে আনন্দ প্রকাশ করতে পারে না। হাঁটতে-হাঁটতে আমরা স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে আরেকটা খোলা মাঠে গিয়ে বসলাম। সেখানে মাটি উঁচু করে একটি পাহাড়ের মতো বানানো হয়েছে। সেখানে মাটি কেটে রং লাগিয়ে লেখা হলিউড। আতিক লেখাটা দেখো, হো-হো করে হাসে। বলে, এজন্য বাংলাদেশে অন্য কোথাও মানসিক হাসপাতাল না বানিয়ে বানানো হয়েছে পাবনায় আর সেজন্য অন্য কোথাও হলিউড নেই। আমি বললাম, তুই কি উলটাপালটা ব্যাখ্যা দিচ্ছিস না? এই প্রথম মাহবুব নিজে থেকে কথা বলল, বলতে দে না। বলুক না ওর মতো।
আমরা যদিও কখনো পাবনা মানসিক হাসপাতালে যাইনি। তবু আজ আমরা তা দেখতে গেলাম না। কারণ আমরা সত্যি মাহবুবকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। সে যদিও আমাদের দেখে আনন্দিত। তবু সে- আনন্দের প্রকাশ নেই। সে কেমন যেন চুপসে গেছে, মনমরা একটা ভাব। আমরা অন্য একটা রাস্তা ধরে হামিদ রোডে ফিরে এলাম। চা-বিস্কিট খেয়ে সন্ধ্যায় ওর বাড়ি ফিরলাম।
মাহবুবের পড়ার ঘরে শোকেসের মাথায় একটি বারবি ডল, পাখার বাতাসে পুতুলটি বেশ জোরে নাচছে। আসলে দুলছে, মনে হয় নাচছে। আমি মাহবুবকে জানি, ভালো করেই জানি; সে পুতুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বলে না। আতিক কি যেন একটা হিট হিন্দি সিনেমা দেখছে। এটাও ঠিক যে, মাহবুব আতিকের সঙ্গে অত খোলামেলা না। আমাকেই সব বের করতে হবে, ওর কী হয়েছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। বললাম, মঞ্জু কতদিন গেছে? ও বলল, প্রায় দুমাস। আমি বললাম, তুই আনতে যাসনি? ও বলে, যাব না কেন, অনেকবার গেছি, ও আসেনি। আর আমাকে ভয়ংকরভাবে অপমান করেছে। আমি বলি, সেই মঞ্জু তোর, এত কাছের মঞ্জু তোকে রেখে থাকতে পারে?
সে উত্তর দেয় না, পুতুলটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর চোখ লাল হয়ে গেছে। হয়তো কেঁদে ফেলবে। আমি আর কোনো কথা বললাম না।
আতিক চিৎকার করে ডাকতে থাকে আমাদের, আরে দেখে যা না রে, কী ছবি! আমরা দুজন কেউ জবাব না দিলে সে নিজেই চলে আসে। বলে, কী ব্যাপার – দুজনে কি বিরহযাপন হচ্ছে? এক কাজ কর মাহবুব, তুই মঞ্জুর একটা ছবি সামনে নিয়ে ফুল-চন্দন নিয়ে বসে যা। দেখ, তাতে কিছু হয় কিনা, শালা! আমি বলি, আতিক বাজে কথা বলিস না। তোর সিনেমা দেখায় তো আমরা বাধা দিচ্ছি না। সে বলে, ও তোর কী ধারণা, আমি এখানে সিনেমা দেখতে এসেছি। আমি বলি, না, তা বলি না, তবে কিছু যখন করতে পারবি না তাহলে চুপ থাকাই ভালো। ও কিছুটা মন খারাপ করল বুঝতে পারলাম। তবে এটাও জানি ও বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে পারবে না।
সবাই মিলে আবার ড্রয়িংরুমে বসলাম। মাহবুব হোটেলে খায় মঞ্জু যাওয়ার পর থেকে। আমরাও খানিক পর যাবো খেতে। আতিক ছবি দেখছে। ছবিতে নায়ক চরিত্রের সঙ্গে বহুদিন পর কাকতালীয়ভাবে নায়িকার দেখা হয়েছে। দুজন দুজনকে এখনো সমান ভালোবাসে, তবে তা বলতে পারে না। আতিক গল্পটা আমাদের বুঝিয়ে দেয়। আতিক বলে, মাহবুব, চল আমরা সবাই মিলে মঞ্জুকে নিয়ে আসি। বাড়িতে রান্নাবান্না না হলে হোটেলে বেশিদিন খেলে তুই মরে যাবি রে। মাহবুব জবাব দেয় না। সে কিছুটা অন্যমনস্ক। আতিক বলল, বাংলায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে মেয়েদের কারক-সমাস-বাগধারা-বাক্য কাহাকে বলে পড়াস, কেমন লাগে রে। নতুন নতুন ফুটফুটে মেয়ে তোকে স্যার, স্যার করে জিজ্ঞেস করে। স্যার বিভক্তি মানে কী, কেমন লাগে? ইহাই তোমার কুটিরশিল্প? কুটিরে বসে কুটিরশিল্প, শিল্পের কাঁচামাল কী স্যার? সে মশকরা করতেই থাকে। আমি থামিয়ে দিই। ও অবশ্য রাগ করে না। মাহবুব গম্ভীরভাবে তাকিয়ে থাকে।
রাতে আমাকে মাহবুব অনেক কথা বলে। আতিক অন্য ঘরে শুয়ে পড়লে সে ধীরে-ধীরে বলতে থাকে। একপর্যায়ে সে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আমি তাকে থামাই। বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে। সে শুধু বলে, মঞ্জু যদি ফিরে না আসে তাহলে আমি তো বাঁচব না। আমি মানছি আমার কিছু ভুল হয়েছে, তা বলে কি আমি ক্ষমা পাব না। মানুষ তো ভুল করতেই পারে। সে তো আমাকে চেনে, আমাকে সে ভালোবেসে ক্ষমা করতে পারে না? এত কষ্টে আছি যে বিভাগে দরখাস্ত করিনি, চেয়ারম্যান স্যার আমাকে ফোন করেছিলেন, অনেকবার, জানি না হতো কিনা চাকরিটা। তবে আবার গতবারের অভিজ্ঞতার কথাও মনে পড়ে, ভিসি স্যারের কী নাটক, কী দুর্ব্যবহার! সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রকে বাদ দিয়ে তিনি ভোটার সংগ্রহ করছেন। ওই ভোটার কী পড়াবে, রাজনীতি শেখাবে, সেটাও তো ভালো করে বলতে পারবে না। তবে এখন ভাবি দরখাস্ত করতে পারতাম। যদি হতো তা হলো এ-বস্তাপচা চাকরি তো আর করতে হতো না। আমি জানি ও যত সহজ বলছে ব্যাপারটা অত সহজ না। চাকরি পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে থেকে নানা ফন্দি-ফিকির করতে হতো, নেতাদের পেছনে-পেছনে ঘুরে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় করতে হতো। আমি ওকে আমার ব্যাপারটা বললাম না। কীভাবে চাকরি নিয়েছি, কীভাবে ভালোবাসাহীন জীবনযাপন করছি, ওকে বললাম না। বললে ও হয়তে আরো কষ্ট পেত। আর আমি কি সবটা বলতে পারতাম। ও ভালোবাসার কাঙাল, আর আমি জানি না ভালোবাসা কী জিনিস। জীবিকার জন্য নিজের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিলাম। কে বেশি দুঃখী? ও-না আমি? ওকে আমার কথা বেশি বলা যাবে না জানি। কোনোদিন যদি মনে হয় বলা জরুরি তখন বলব।
আমি বললাম, তোদের সমস্যা কী নিয়ে শুরু হয়েছিল? টিউশনিই কি একমাত্র সমস্যা, নাকি আরো অন্য কিছু? ও বলে, প্রথম থেকেই ওর টিউশনিতে আপত্তি ছিল। আমিও যে হাউস করে টিউশনি করেছি তা তো না। কলেজের বেতনে দশ দিন চলে না, তা আবার কোনো মাসে বেতন দেয় না। তিন মাস পরে দিলো একমাসের বেতন। ধারদেনা হয়ে যেত গলা পর্যন্ত। আমার একজন কলিগ একদিন বলল, মাহবুব সাহেব, আপনি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, আপনি কেন অর্থনৈতিক কষ্ট পাবেন? মূর্খরা দেখুন কত টাকা আয় করছে। বেশি না করুন সংসার চালানোর মতো কিছু ছাত্র পড়ান। আমি বললাম, তুই ভদ্রলোকের কথায় রাজি হয়ে গেলি? ও বলে, তখনো আমি ভাবতে পারি না যে, বাড়িতে ছাত্র পড়াতে হবে। আমার লেখাপড়া, গবেষণা সব চুলোয় যাবে তা আমি জানতাম। শেষ পর্যন্ত মঞ্জুকে রাজি করালাম। সংসারের অভাব ঘুচল; কিন্তু মনের রোগ শুরু হলো। সত্যি তোকে কি বলব, মেয়েদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশতে-মিশতে আমি যেন পালটে গেলাম। তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতে হয়। তারা নানা ছল-ছুতোয় অজস্র বিষয় নিয়ে কথা বলে। মঞ্জু আমাকে সন্দেহ করত না প্রথমদিকে। পরে সে দাঁড়িয়ে থাকত পর্দার ওপারে। আমরা পড়ার বাইরে কী সব আলাপ করি সে কান পেতে শুনত। তোকে কি বলব, মেয়েদের অপ্রয়োজনীয় কথা আমার বেশ ভালো লাগত। ওরা যেন ওইসব বিষয়ে কথা বলার জন্য সব সময় উৎসুক থাকত। আমি সে-রাজ্যে যেন ভেসে গেলাম। আমি ঘোরের মধ্যে থাকতে শুরু করলাম। রাতে-দিনে ঘুমে-নির্ঘুমে আমি মেয়েদের ছবি দেখতে থাকি। তাদের চাহনি, ভ্রুকুঞ্চন দেখতে পাই। কেমন যেন আলাদা একটা জগৎ। আমার আসলে মানসিক বিপর্যয় ঘটল বলতে পারিস।
আমি বললাম, বলিস কী? যে জানে তার বিপর্যয় ঘটছে, সে তো তা থেকে বাঁচতেও পারে।
পারে, কিন্তু আমি পারছিলাম না। আমার মানসিক শক্তি নষ্ট হয়ে গেল বলতে পারিস।
মাহবুব আরো বলে, মঞ্জুর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছিলাম না, ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। আমি জানতাম ও ভীষণ রেগে আছে; কিন্তু মুখে কিছু বলে না। আমি যে কী বলব ভেবে পেতাম না। নায়লা আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে মায়ের কাছে বসিয়ে দিত। ওইটুকু মেয়ে বুঝত, যে মা-বাবা আগের মতো নেই।
আমি বললাম, তার মানে কী? তুই কচি খোকা, আর কোনো পুরুষ মেয়েদের পড়ায় না, সবার মাথা খারাপ হয়?
মাহবুব বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। ও বলে, আমি সবার কথা বলতে পারব না। নিজের কথাও তোকে গুছিয়ে বলতে পারব না। তবে এটুকু তোকে বলতে পারি, আমি এখনো মঞ্জুকে খুব ভালোবাসি। ও আমাকে ভুল বুঝেছে, তা ঠিক নয়। তবে আমি কিছু বুঝে উঠতে পারি না যে, কী করব। মঞ্জু মনে হয় আমাকে কখনো ক্ষমা করবে না।
সে দুচোখ ঢেকে ফেলে হাত দিয়ে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। জানি এ-সমস্যার সমাধান এক্ষুনি করা যাবে না। মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলতে হবে। টিউশনি ছেড়ে দিয়ে অন্য আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তবু মুখে বললাম, বেশি চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সকালে আমরা ফিরে আসব। আমরা হাঁটতে-হাঁটতে প্যারাডাইস নামে একটা হোটেলে সবজি-লুচি খেলাম। মাহবুব আমাদের একটা বাসে তুলে দিলো। আতিক বলে, তোর রাজশাহী যেতে ইচ্ছে করে না? দুই ঘণ্টার তো পথ। চল এখন যাই। মাহবুব কিছু বলে না। আমি ওর মুখে সর্বনাশের এক লক্ষণ দেখতে পাই, মাহবুব কি বোবা হয়ে যাচ্ছে? আমি বলি, ভালো থাকিস মাহবুব। ও শুধু ঘাড় নাড়ল।
আমি বাড়িতে ফিরি। আবার সেই গন্ধহীন উত্তাপহীন ভালোবাসাহীন জীবন। আমার মাঝে-মাঝে দু-একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে ইদানীং। আবার পরক্ষণে মনে পড়ে ওটা কবিতার লাইন তো নয়। ওটা আসলে মাহবুবের বিষণ্ণ মুখের অভিব্যক্তি, ওর উস্কোখুস্কো মুখ, উঁচু দাত, পাতলা চুল, মুখে মুখে মায়া মায়া চাহনি। এসব কি কবিতার পঙ্ক্তি? না, কবিতা আমাকে ছেড়ে গেছে একেবারে। যে-জীবনে প্রাণ নেই, সে-জীবন প্রাণিত করবে কীভাবে অন্যকে? আমি ঘুমে-নির্ঘুমে মাহবুবের কথা ভাবি। যদিও মাহবুব সবটা আমাকে বলেছে, তবু আজ কেন যেন মনে হয় ও খানিকটা লুকিয়েছে আমার কাছে। পর্দার আড়ালে মঞ্জু রোজ দাঁড়িয়ে থাকত। মাহবুব পড়াত মেয়েদের। অনেকগুলো মেয়ে, সাদা-ফর্সা, ছোট-বড়, সুন্দরী-অসুন্দরী, চিকন-পাতলা আরো কত প্রকার। আমাদের মাহবুব ফেরেস্তা ছিল না। সে তাহলে কী করেছে কুটিরশিল্পের নামে। কোনোদিন কি একলা কোনো মেয়ে পড়তে এসেছিল? আর মঞ্জু ছিল না বাড়িতে। হয়তো সে বাজারে গিয়েছিল। ফিরে দেখে অস্বস্তিকর অবস্থা? মাহবুব বলেছে, তার একটা ভুল হয়েছিল। কী সেই ভুল। ও বলেছিল, অল্পবয়স্ক মেয়েরা খুব চঞ্চল, ওরা অনেক আবদার করত সবসময়, কথা বলত ইনিয়ে- বিনিয়ে। কতরকম জামা-কাপড় প্রসাধনী। আমি যেন খানিকটা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আর মঞ্জু তো আমাকে কোনোদিন কিছু বলেনি, সাবধান করেনি। করলে হয়তো এমনটা হতো না। আমি সত্যি দিন-দিন একটা রঙিন জগতে ডুবে যাচ্ছিলাম। সংসার চলত না, টিউশনি না করলে খাওয়া জুটত না, সেটাও ঠিক। তবে আমার কী হলো, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হারালাম, পিএইচ-ডির পড়াশোনা বন্ধ করলাম, আর মঞ্জুকে হারালাম।
আমি ভাবতে পারি না, মাহবুব ভালোবাসার অভাবে কাঁদছে আর আমি ভালোবাসাহীন জীবনে ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি। ছেয়েমেয়ে আমাকে ভালোবাসে, সেটাই আমার পুঁজি। এই নিয়ে হয়তো বেঁচে থাকতে পারব না, পারলে কী আর করা। আমি চেষ্টা করেছিলাম সামসুনকে ভালোবাসতে; কিন্তু সে দূর আকাশের তারা। বড়লোক বাবার আদরে যেভাবে বড় হয়েছে, সেখানে আমার মধ্যবিত্ত মন তাকে ধরতে পারে না। একসময় ক্ষান্ত দিয়েছি। আমার চেয়ে মাহবুবের অবস্থা খারাপ? মঞ্জু ফিরে এলে তো ও আবার সব পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। ওদের বন্ধন তো একটু আলগা হয়েছে মাত্র। আবার জোড়া লাগবে। আর আমার তো বন্ধনই তৈরি হয়নি। তাই ছেদও নেই, বিচ্ছেদও নেই।
আজ ঘুম থেকে উঠেই মাহবুবের মুখ মনে পড়ে। কী বিষণ্ণ ম্লান মুখ। সদাহাস্যময় মাহবুব কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। মঞ্জু কী ফিরে এসেছে? আদৌ কি সে ফিরে আসবে? না এলে মাহবুব বাঁচবে কী করে? মঞ্জু ছাড়া মাহবুবের তো বেঁচে থাকার কথা নয়? 

Published :


Comments

Leave a Reply