মূর্ত-বিমূর্ততায় শিল্পী রনজিতের শিল্পপ্রয়াস

Acrilicরবিউল হুসাইন
শিল্পী রনজিৎ দাসের দ্বাদশ একক চিত্রপ্রদর্শনী গুলশান-১-এর বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে গত ৭ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো। প্রদর্শনীটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিল্পী এখানে শুদ্ধ মূর্ত বাস্তবতায় বেশ বড়সড় চিত্রপটে মানুষের অবয়ব সৃষ্টি, মুখমণ্ডলের নানান ভঙ্গি, চোখের বিভিন্ন দৃষ্টিপাতের দ্রুত সঞ্চালন – এসব নিয়ে বড় মুনশিয়ানায় প্রকাশ করেছেন। মৃত্তিকার তামাটে বর্ণ দিয়ে ছবির মধ্যে মানুষের মুখচ্ছবি, সেসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ কাছে-দূরে দেখা নাক, দাঁত, চোখ, চোখের মণি, চোখের পাতা বা পল্লব, ভ্রু ইত্যাদির গতিশীল অস্থিরতা পরিবেশিত হয়েছে এক বলিষ্ঠ ও নিখুঁত সৃষ্টিশীলতায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ শিল্পী বিমূর্ততার শিল্পরসে নিমজ্জিত। ফলে শক্তিময় আঁকিয়ে-শিল্পী ধীরে ধীরে বিরল হয়ে পড়েছেন। এই আশঙ্কার ভেতর দিয়ে শিল্পী রনজিৎ সব প্রতিকূলতা, অমনোযোগিতা ও অসহযোগিতার মধ্য দিয়ে মূর্ত প্রতীকের নিয়মনিষ্ঠায় এগিয়ে চলেছেন তাঁর স্পষ্ট সাবলীল প্রয়াসে। তাই তিনি প্রদর্শনী সাজিয়েছেন অতিদ্রুত চোখ পরিচালনা বা সঞ্চালনা – এই শিরোনামে। ছবিতে ধূসর মাটি-রং দিয়ে মানুষের মুখমণ্ডলে অবস্থিত জিহ্বা, চোখের মণি, ঠোঁট – সব বাস্তবরীতিতে পরিস্ফুট এবং পরিবেশিত এমনভাবে যে, মূর্ততায় পরিচিহ্নিত সেটিকে অনায়াসে বিমূর্ত বলা যায় আর বিমূর্তকে মূর্ত। এই মূর্ততাকে বিমূর্ততায় পরিবেশনার ক্ষমতা সত্যিকারভাবে শিল্পীর গভীর অনুশীলন ও সৃষ্টিকুশলতার পরিচয় দেয়। প্রতিটি দৃশ্যপটে বুনুনির আকর্ষণীয় প্রতিস্থাপন, বিষয়কে কেন্দ্র করে মুখের কোনো অংশের কয়েকগুণ বড় সম্প্রসারিত রূপায়ণ, চোখের ভেতর দিয়ে দৃষ্টিপাতের ভঙ্গিসহ বিভিন্ন দিকে গতিময়তা ও প্রেক্ষাপণে মানুষের অস্থিরতা ভয়ার্ততা, বিস্ময়বোধ অসহায়ত্ব নিয়ে আত্মসমর্পণ ক্রিয়া ইত্যাদি ছবির মধ্যে এক করুণ নিঃস্বতা ও নিঃসঙ্গতা ফুটিয়ে তুলেছে। বারংবার একটি বিষয় থেকে বা একটি অবস্থান থেকে পরিবর্তন, মূল রূপ থেকে অন্য স্বরূপে প্রতিস্থাপন – যে-প্রক্রিয়াকে দার্শনিক বদ্রিলার্দের সাইমালাক্রাম বা প্রতি-পরিবর্তিত প্রতিসরিত অবস্থানকে নির্দেশিত করে। বিষয়টি মূল অনুভবের নকল নয়, বরং তা সত্য ও বিশুদ্ধ। শিল্পী মানুষের মনোজগৎ তার মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি এবং প্রকাশভঙ্গির মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন। বিষয়টির ভেতর বেশ অভিনবত্ব পাওয়া যায়। সেজন্যে অনায়াসে বলা যায় যে, মানুষের সার্বিক শরীর বা অবয়ব মূর্ত; কিন্তু সেই মূর্ততার অনুভব, অনুভূতি ও পরিবেশনা যখন ঘটে তা হয়ে যায় বিমূর্ততা বা নৈরূপ্যবাদে। এই যে তন্ময় আর মন্ময়ের একে অপরের ওপর পরিস্থিতির নির্ভরশীলতা ও প্রাকৃতিক পরিপূরক প্রক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া – সেই আখ্যান-সৃষ্টিই পরিশীলিত মাধুর্যে শিল্পী প্রকাশ করেছেন খুব স্পষ্টভাবে। শিল্পী রনজিতের এখানেই শিল্পিত সফলতা। এসব প্রকাশে তাঁকে বলিষ্ঠভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে বিষয়ের ওপর তাঁর পারদর্শিতা, আঁকিবুঁকির সাবলীল দক্ষতা, অনুভূতির প্রখরতা অনুযায়ী ছবির নির্মাণ-কুশলতা গঠনের ভারসাম্যতা, বর্ণের প্রকৃত রূপ-বিচ্ছুরণ ক্রিয়া এবং সর্বোপরি মূর্ততার সঙ্গে বিমূর্ত বোধের মন্ময় সৃষ্টির শিল্প-সুষমা পরিবেশনা। নিখুঁত অঙ্কনক্ষমতা, খুঁটিনাটি বিশদ বিস্তার করার স্বাভাবিক ঝোঁক, মানুষের বিশেষ অনুভব ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সময়ে যথাযথ মুখ ব্যাদান যা বিকৃত নয় বরং সুকৃতি হিসেবে পরিদৃশ্যমান করে তোলা হয়েছে। অনুভূতির বিভিন্ন স্তর ও মাত্রাভেদে মানুষের নানারকম শরীরী প্রকাশ ঘটে, যা বিস্ময়, ভয়, ভালোবাসা, ক্রোধ, বিরক্তি, চাটুকারিতা, অভয়বোধ – এসবে সংযোজিত হয়। শিল্পী সেগুলো খুব দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। ছবির শিরোনাম – অস্তিত্ব ও জীবন, ছন্দ ও ছন্দপতন, ঐকতান, সামান্য স্বপ্ন, ভাবনা ও ভাব – এসবের সাহায্যে ছবির মূল আর্তির পরিচয়, তার চেয়ে ছবির কুশলীনৈপুণ্য, বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ীসমূহ দর্শকদের সামনে পরিস্ফুট হয়। মানুষের অবয়বের সঙ্গে পাখি, বিশেষ করে কবুতরের দেখা পাওয়া যায়। অশান্তি, চিৎকৃত মানসিক যন্ত্রণা, বিরক্তি, হতাশা – এসবের বিপরীতে মধুর ও শান্তিময় বৈষম্যের প্রতীক এই দৃশ্যসুখী পাখির ব্যবহার ছবির একটি মাত্রা সৃষ্টিতে শিল্পীর শিল্পকৃতিত্ব প্রতিষ্ঠিত – এ-কথা বলা যায়। চোখের পরিস্ফুট রূপ, মুখের প্রকাশ, ঠোঁটের বা দাঁতের সাহায্যে অনায়াস অনুভূতির দৃশ্য – এগুলো অতি যতেœর সঙ্গে রূপ ও অরূপ সন্ধানে ছবিতে বিবেচিত হয়েছে। দৃশ্যমান রূপ মূর্ততার সঙ্গে অরূপতা অদৃশ্যমান, তা বিমূর্ততা শরীরী প্রকাশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিল্পী খুব সমাজসচেতন এবং বিপন্ন ও প্রান্তিক মানুষের জন্যে তাঁর অনুভূতি প্রখর। তাই দেখা যায়, এক নিঃসঙ্গ দুঃখী নারী এক শিশু-পশুকে কোলে করে ম্লান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দূরপানে নিমগ্ন। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে সে, সঙ্গে প্রাণের উত্তাপে অন্যের প্রতি ভালোবাসাও জানাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক টানাপড়েনে সাধারণের অভিজ্ঞতা, জীবনযাপন বেশ সংগ্রামশীল, কিন্তু এসব ছাপিয়ে মনের ভাব ও বোধের প্রকাশে তারাও সচেতন ও সক্রিয়। শিল্পীর প্রকাশ তাই সবাইকে নিয়ে। শিল্প যেমন কোনো সীমানা মানে না, তেমনি সামাজিক শ্রেণিবিভেদেও শিল্প নিরপেক্ষ ও সুস্থির। শিল্পীর কাজ সুন্দর ও অসুন্দরকে চিহ্নিত করা এবং সেগুলোকে প্রকাশ করা। মানুষের ইচ্ছা, আশা, ভরসা, দুঃখ, অসম্মান, অপমানের বর্ণচ্ছটা যেমন তাঁর চিত্রপটে ধরা পড়ে, তেমনি করে শিল্পী নিজেকে সেগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততায় খুঁজে পান সৌন্দর্য-সুষমাকে। সেটিই তাঁর আরাধ্য হোক, তা সুন্দর বা অসুন্দর। চরম বাস্তবতা যদি সত্যের অপর নাম হয়, তাহলে তা সৌন্দর্যকেও অপর পরিচয়ে পরিচিত করে তোলে। তাই বাস্তবতা, সত্যতা ও সৌন্দর্য – সব একই পথের পর্যটক। শিল্পী রণজিত বোধ করি সে আরাধ্য পথের পথিক। মূর্ত ছবির মধ্যে বিমূর্ত সৌন্দর্য ও সত্যকে খুঁজে ফিরছেন মানবিক অভিব্যক্তির সাহায্যে, যা বিমূর্ত বোধের অনুষঙ্গী কিন্তু বিমূর্ততা পরিদৃশ্যমান নয়। শিল্পীর এই সূক্ষ্ম শিল্পকৃতিত্ব খুব উপভোগ্য এবং শিল্পরসিক সবার কাছে বিষয়টি আদরণীয় ও সুনির্দিষ্ট প্রয়াসে গ্রহণযোগ্যতা পাবে, এই আশা করি।