রাজা দীন দয়াল ও নিমাই ঘোষ

মৃণাল ঘোষRaja din Doyal and nimay gosh

এক
ভারতবর্ষে আলোকচিত্রের ইতিহাস পাশ্চাত্যের প্রায় সমসাময়িক। খুব দীর্ঘ নয় অবশ্য এই ইতিহাস। এদেশে স্থিরচিত্র ধরে রাখার উপযোগী ক্যামেরা এসে পৌঁছায় ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। পাশ্চাত্যে ক্যামেরা আবিষ্কৃত হওয়ার মাত্র এক বছর পরে। চলমান বস্ত্ত বা দৃশ্যের ছবি তোলার উপযোগী ক্যামেরা মুম্বাইতে এসে পৌঁছেছিল ১৮৯৬ সালে। পাশ্চাত্যে সিনেমার জন্য চলমান চিত্রগ্রহণ পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাত্র মাস ছয়েক পরে। আমরা জানি সকলেই, লুই ও অগাস্ট লুমিয়ের-ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন এই উদ্ভাবনের পথিকৃৎ। ১৮৩৯-এর পর থেকে এদেশে যে আলোকচিত্র গ্রহণের কাজ শুরু হয় সেই ধারাবাহিকতা নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে আজো প্রবাহিত হয়ে চলেছে। শুরুতে আলোকচিত্র-চর্চার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি বাণিজ্যিক এবং প্রয়োজনভিত্তিক তথ্যপঞ্জীকরণ বা ডকুমেন্টেশনের জন্য। আর একটি শৌখিন বা বিনোদনমূলক। প্রথম ধারাটি ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছে সামাজিক ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দ্বিতীয় ধারাটি নান্দনিক তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয়েছে ক্রমশ। ঐতিহাসিক এবং নান্দনিক তাৎপর্য অবশ্য দুই ধারার আলোকচিত্রেই রয়েছে। এখন আলোকচিত্রের গুরুত্ব শুধু আর ডকুমেন্টেশন বা তথ্যপঞ্জীকরণে সীমাবদ্ধ নেই। আলোকচিত্র এখন ললিতকলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। চিত্রকলারই প্রায় সমান্তরাল।
এ-লেখায় আমরা কলকাতায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দুটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আলোচনা করব। দুটিই তথ্যের আকর হিসেবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চিত্রের নান্দনিকতার দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম প্রদর্শনীর শিল্পী রাজা দীন দয়াল (১৮৪৪-১৯০৫)। আলোকচিত্রচর্চার প্রথম যুগের একজন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত শিল্পী। দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি নিমাই ঘোষের (জন্ম : ১৯৩৪) আলোকচিত্র নিয়ে। তাঁর আলোকচিত্রের প্রধান বিষয় সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা। সত্যজিৎ ছাড়াও অন্যান্য চলচ্চিত্রকারের সিনেমার স্থিরচিত্রও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই প্রদর্শনীতে। সিনেমায় আমরা যে-দৃশ্য দেখি, তার একটি নেপথ্য ইতিহাস থাকে। তা থেকে সিনেমা তৈরির অন্তরালের বহু অজানা তথ্য ও রহস্য উঠে আসে। নিমাই ঘোষের প্রদর্শনীটি সেদিক থেকে খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

দুই
দীন দয়ালের প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ৬ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য আর্টস, নিউ দিল্লি ও ন্যাশনাল লাইব্রেরির যৌথ উদ্যোগে। ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার শিল্পকলার তথ্য ও ইতিহাসচর্চার একটি কেন্দ্র। দীন দয়াল-সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য ও তাঁর আলোকচিত্রের বড়মাপের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। এ-বিষয়ে বহু গবেষণাও হয়েছে এই কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাঁদেরই সংগ্রহের প্রায় একশ ছবি নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল এই প্রদর্শনী।
দীন দয়ালের জন্ম ১৮৪৪ সালে উত্তর প্রদেশের মিরাটের কাছে এক মধ্যবিত্ত জৈন পরিবারে। রুরকির থম্পসন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন করেছিলেন। পাশ করে ইন্দোরের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে চাকরিতে যোগ দেন। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর আলোকচিত্রের প্রতি আগ্রহ ছিল। এবং ভারী বেলো ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করেন। তাঁর কাজ ইন্দোরের মহারাজা টুকাজি রাওয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে এবং তিনি তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। এই সময় ইন্দোরে তিনি তাঁর প্রথম স্টুডিও খোলেন। স্যার লেপেল নামে একজন ইংরেজ স্থাপত্যবিশারদ এই সময় মধ্য ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যের আলোকচিত্রীয় তথ্যপঞ্জীকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দীন দয়াল এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। গোয়ালিয়র, খাজুরাহো, সাঁচি, ঝাঁসি, দীঘ, ইন্দোর, ওঙ্কারেশ্বর ইত্যাদি অঞ্চলের প্রাসাদ ও কেল্লার ছবি তোলেন তিনি এই সময়। এই কাজের মধ্য দিয়েই তিনি একজন আলোকচিত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আলোকচিত্রী হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।
১৮৮৭ সালে তিনি রানী ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে রাজকীয় আলোকচিত্রী হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পান। এর আগে ১৮৮৫-তে হায়দ্রাবাদের ষষ্ঠ নিজাম দীন দয়ালকে তাঁর পরিষদীয় আলোকচিত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁর সমস্ত কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই পৃষ্ঠপোষকতা তিনি পেয়ে এসেছেন ১৯০৫ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ১৮৮৬-তে তিনি সেকেন্দ্রাবাদে এবং ১৮৯২-তে হায়দ্রাবাদে স্টুডিও খোলেন। ১৮৯৪-তে হায়দ্রাবাদের নিজাম তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে সম্মানিত করেন।
রাজা দীন দয়াল ছিলেন ভারতের প্রথম যুগের আলোকচিত্রীদের মধ্যে প্রধান এক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে প্রথম রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী বললেও অত্যুক্তি হয় না। আলোকচিত্রে তাঁর অবদানের রয়েছে দুটি দিক : ঐতিহাসিক ও নান্দনিক। দেশজুড়ে নানা ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ছবি তিনি তুলেছেন। সেগুলি দেশে-বিদেশে মানুষের কাছে ইতিহাস-সম্পৃক্ত তথ্যের আকর হয়েছে। এছাড়া তিনি যে সাধারণ মানুষের ও জীবনের ছবি তুলেছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের অনেক বাস্তব তথ্য ধরা রয়েছে। মানুষের আচার-আচরণ, চালচলন, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সেই সময়টা পঞ্জীকৃত হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এটা একটা দিক। এটা তিনি করেছেন অত্যন্ত নন্দন-সমৃদ্ধভাবে। তখন ছিল সাদা-কালো আলোকচিত্রের যুগ। আলোছায়ার দ্বৈতকে নন্দনসমৃদ্ধভাবে পরিস্ফুট করা আলোকচিত্রের প্রধান একটি দায়। সেইসঙ্গে নির্দিষ্ট ফ্রেমের মধ্যে ধরা হচ্ছে যে বিষয়, তাকে সাজিয়ে তোলার মধ্যে যে শিল্পসৌকর্য – এটা চিত্রকলার কম্পোজিশন বা রচনাসৌকর্যের একটা দিক। আলোকচিত্র কম্পোজিশনের এই বিষয়টি চিত্রকলার কাছ থেকেই গ্রহণ করে। চিত্রকলায় শিল্পীর স্বাধীনতা থাকে চিত্রিত বিষয়কে নিজের পছন্দমতো সাজিয়ে নেওয়ার। আলোকচিত্রে সেই স্বাধীনতা থাকে না। এখানে শিল্পীকে অপেক্ষা করতে হয় বাস্তবকে নান্দনিকভাবে বিন্যস্ত হওয়ার জন্য। যে-মুহূর্তে শিল্পীর পছন্দমতো দৃশ্যটি বিন্যস্ত হলো, সেই মুহূর্তে শিল্পী ক্যামেরায় ‘শাটার’ টেপেন। এই মুহূর্তটিকে বলা হয় ‘ডিসিসিভ মোমেন্ট’ বা নির্ণায়ক মুহূর্ত। এই মুহূর্তটিকে যিনি যত সুচারুরূপে ব্যবহার করতে পারেন, তিনি তত বড় শিল্পী। দীন দয়াল এই মুহূর্তটিকে অত্যন্ত প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে ব্যবহার করেন।
তাঁর ছায়ার ব্যবহারে রয়েছে বিষাদমগ্ন স্নিগ্ধতা। দৃশ্যের অন্তস্তলকে তা বাইরের কোলাহলমুক্ত করে উপস্থাপিত করে। দৃশ্যের নৈঃশব্দ্যের মধ্যে একটি কোমল সুর সঞ্চারিত করে। এর মধ্য দিয়েই তাঁর ছবিগুলি শৈল্পিক গুণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
আমরা এই লেখার সঙ্গে দুটি ছবি উপস্থাপিত করছি, যাতে এই বৈশিষ্ট্যগুলো খুব সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
প্রথম ছবিটি দিল্লির জামা মসজিদের। অসামান্য এর স্থাপত্যগত জ্যামিতি। দেয়াল, স্তম্ভ, খিলান, গম্বুজ, শীর্ষদেশের গোলক-সম্পৃক্ত সরু দন্ড – এ সমস্ত নিয়ে সংকৃত রাজকীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। যখন আলোকচিত্র নেওয়া হয়েছে, সেই সময় সূর্য ছিল চিত্রক্ষেত্রের বাঁদিকে। ফলে বাঁদিকের দেয়ালগুলিতে আলো পড়েছে। সম্মুখবর্তী দেয়ালে বিস্তৃত হয়েছে ছায়া। সামনের যে শূন্য পরিসর, সেখানে রয়েছে স্তিমিত আলো। আলো-ছায়ার এই বিন্যাসের মধ্যে যে প্রশান্তি, তাই এই স্থাপত্যটিতে এক দরবারি মহিমা এনেছে। সেই সমৃদ্ধ সৌষ্ঠবকে শিল্পী ধরেছেন তাঁর আলোকচিত্রে।
দ্বিতীয় ছবিটি উঠে এসেছে সাধারণ জীবনপ্রবাহ থেকে। এর শিরোনাম : ‘স্মল বয় উইথ আমব্রেলা লিয়ার প্রাম’। এখানে ছায়ার থেকে আলোর মাত্রা বেশি। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে যে-বালকটি, ক্যামেরার চোখ তার দিকেই বেশিমাত্রায় সংবদ্ধ। যদিও তার অবস্থান চিত্রক্ষেত্রের ঠিক মধ্যভাগে নয়, একটু বাঁদিক ঘেঁষে। প্রায় মাঝামাঝি অংশে একটি পেরাম্বুলেটর-জাতীয় গাড়ির ওপর বসে আছে একটি শিশু। তার পেছনে সাদা পোশাকের একজন লোক। পোশাকের সাদা-কালো বিন্যাস দিয়ে শিল্পী এখানে আলো-ছায়াকে বিভাজিত করেছেন। সেই বিভাজন দিয়েই গড়ে তুলেছেন সুঠাম একটি রচনা। এই ছবিতেও একটা শান্ততার আবরণ ছড়িয়ে আছে চিত্রক্ষেত্রজুড়ে। আলো-ছায়ার বিন্যাসে এই প্রশান্তি গড়ে তুলতে পারাই এই শিল্পীর প্রধান কৃতিত্ব।

নানা বিষয়ের ছবি ছিল এই প্রদর্শনীতে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন শিকারি দুটি বাঘ মেরেছে। শায়িত মৃত সেই বাঘের ওপর সে বসে আছে দোনলা বন্দুকটি কোলের ওপর নিয়ে। পেছনে রয়েছে ভূপতিত একটি বড় বৃক্ষ। একটি আখ্যান রয়েছে এই ছবিতে, রয়েছে মানুষ, অরণ্য ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সম্পর্কের এক সময়বিধৃত ইতিবৃত্ত, যা সেই সময়কে বুঝতে সাহায্য করে আমাদের। আর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ত্রিশূল-হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় নগ্ন এক যুবক সন্ন্যাসী। কোমরে শুধু একটুখানি সরু কৌপিন রয়েছে তার। পেছনের নিসর্গ আলোয় আবৃত হয়ে গেছে। তাতে খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে ত্রিশূল-হাতে কৌপিন পরা এই মানুষটি। এর মধ্যেও ধরা রয়েছে সেই সময়েরই আলেখ্য।
এইভাবে একের পর এক ছবিতে দীন দয়াল সেই সময়ের জীবনের নানা দিককে ধরেছেন। আলোকচিত্রের প্রথম যুগের একজন শিল্পী ছিলেন তিনি। তখনকার ক্যামেরার প্রকরণগত ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। ফলে শিল্পীর নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। তাঁর ছবি দেখলে বোঝা যায় কত সুচারুভাবে সেই নিয়ন্ত্রণকে তিনি নিজের আয়ত্তে রেখেছেন। বাস্তবতাকে কোথাও এতটুকু ভাঙেননি। ভাঙার কোনো উপায়ও ছিল না তখন। তাঁর ক্যামেরা বাস্তবের সত্যকেই রূপবদ্ধ করেছে। সেই সত্যকেই যেভাবে তিনি অলৌকিকে উদ্ভাসিত করেছেন, তাতেই শিল্পী হিসেবে তাঁর মহত্ত্ব ও কৃতিত্ব।

তিন
দ্বিতীয় যে-প্রদর্শনীটির কথা আলোচনা করব আমরা, তার শিল্পী নিমাই ঘোষ (১৯৩৪)। রাজা দীন দয়ালের সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ৯০ বছরের। দীন দয়াল ছিলেন আলোকচিত্রের প্রথম যুগের একজন শিল্পী। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে তাঁর কাজ। আর নিমাই ঘোষ শুরু করেছেন ১৯৬৮ থেকে। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ তাঁর কাজের সময়। এই প্রায় শতকের ব্যবধানে জীবন অনেক পালটেছে। আলোকচিত্রের প্রকরণ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্রের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্ক ক্রমে ক্রমে উন্মীলিত হয়েছে। নিমাই ঘোষের কাজ এই ক্ষেত্রটিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছে কলকাতার হ্যাবিংটন স্ট্রিট আর্ট সেনটারে ২০১৩-র আগস্ট মাস জুড়ে। এর উদ্যোক্তা দিল্লি আর্ট গ্যালারি। নিমাই ঘোষের নিজের তোলা আলোকচিত্রের সংগ্রহ বিপুল, প্রায় লক্ষাধিক। নানা বিষয়ে তিনি ছবি তুলেছেন – সিনেমা, নাটক, নিসর্গ, মুখাবয়ব, আদিবাসী জীবন ইত্যাদি। এর ভেতর সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাবিষয়ক ছবিই তাঁর সংগ্রহকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। দিল্লি আর্ট গ্যালারির আশিস আনন্দ তাঁর কাছ থেকে এই ছবি নিজের গ্যালারির জন্য সংগ্রহ করেন। তাকে সুচারুভাবে পঞ্জীকৃত করে তার একটি নির্বাচিত অংশ নিয়ে দিল্লি ও কলকাতায় প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এই প্রদর্শনী উপলক্ষে একটি বড় গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। প্রদর্শনী ও এই গ্রন্থ উভয়েরই শিরোনাম : নিমাই ঘোষ : সত্যজিৎ রায় অ্যান্ড বিয়ন্ড। এই গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন কিশোর সিং এবং প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন প্রমোদ কুমার কে.জি.।

নিমাই ঘোষের জন্ম ১৯৩৪-এর ৮ মে। ১৯৫০-এর দশক থেকে তিনি বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন। উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপের বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৫৫-তে তাঁর প্রথম অভিনয় রবি ঘোষ-নির্দেশিত সার্ত্রের Nekrassov অবলম্বনে রচিত নাটক ঠগে। ১৯৫৯-এ উৎপল দত্তের অঙ্গার নাটকে অভিনয় করেন। তারপর ফেরারি ফৌজ, ওথেলো, নীচের মহল ইত্যাদি নাটকে। তাঁর ছবি তোলা শুরু ১৯৬৮ সালে। তাঁর এক বন্ধু একটি Canonet QL 17 ক্যামেরা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। সম্ভবত কোনো ট্যাক্সিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল সেটি। বন্ধুর কিছু ঋণ ছিল তাঁর কাছে। ঋণের বিনিময়ে ক্যামেরাটি তিনি সংগ্রহ করেন। সেই ক্যামেরা দিয়েই তাঁর প্রথম ছবি তোলা। ১৯৬৮ সালে বীরভূমের রামপুরহাটে সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার শুটিং চলছিল। কোনোভাবে সেই শুটিংয়ে গিয়ে পৌঁছেছিলেন নিমাই ঘোষ। একটি দৃশ্যে বাঘার ঢাকের ওপর গাছের পাতা থেকে বিন্দু বিন্দু জল পড়ে যাচ্ছিল। নিজেরই আগ্রহে সেই দৃশ্যের কিছু ছবি তোলেন তাঁর সেই ক্যামেরায়। সত্যজিৎ রায় সেই ছবিগুলি দেখে খুশি হন। ১৯৬৯-এ যখন তাঁর পরবর্তী সিনেমা অরণ্যের দিনরাত্রির শুটিং শুরু হয়, তখন সত্যজিৎ রায় নিমাই ঘোষকে এই শুটিংয়ের স্টিল ফটোগ্রাফার হিসেবে নিযুক্ত করেন। এর পর থেকে সত্যজিতের সব শুটিংয়েরই ছবি তোলার দায়িত্ব পান তিনি।
আমরা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে সাদা পর্দায় প্রক্ষেপিত প্রবহমান আলোকচিত্র-সংবলিত যে-দৃশ্যমালা দেখি, যাকে চলচ্চিত্র বা সিনেমা বলে, তার একটি জটিল অন্দরমহল আছে। সেই সিনেমা তৈরি করতে প্রচুর উদ্যোগ-আয়োজন প্রয়োজন হয়। সেই নেপথ্য কাহিনি দর্শকের জানার দরকার হয় না। তবু যদি দর্শক জানতে আগ্রহী হন সিনেমা তৈরির সেই নেপথ্য ইতিহাস, অন্তর্নিহিত বিভিন্ন মানবিক সম্পর্ক, তাহলে এক নতুন জগৎ উন্মীলিত হতে পারে তাঁর সামনে। ফরাসি চলচ্চিত্রকার ত্রুফো একবার একটি সিনেমা করেছিলেন এই সিনেমা তৈরির সিনেমা নিয়ে। সেই সিনেমার নাম ছিল ডে ফর নাইট। দিনের আলোকে কীভাবে ব্যবহার করা হয় রাত্রির দৃশ্য তুলতে, তারই ইঙ্গিত রয়েছে এই নামের মধ্যে। সিনেমার নেপথ্যের অনেক প্রয়োজনীয় ও কৌতুকদীপ্ত ইতিবৃত্ত পাওয়া গিয়েছিল সেখানে। এই নেপথ্য সাধারণত অজানাই থেকে যায়। সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, এই নেপথ্যের কথা লিখে রাখতে পারলে যাঁরা সিনেমা করেন এবং যাঁরা সিনেমা দেখেন উভয়ই উপকৃত হতে পারেন; কিন্তু সেটা লিপিবদ্ধ করা খুব দুরূহ।
নিমাই ঘোষের আলোকচিত্রের একটি বড় অংশ এই নেপথ্যকে নিয়ে। এছাড়া তিনি নানাভাবে সত্যজিৎ রায়ের সৃজনশীল মনটিকেও নানাভাবে ধরতে চেয়েছেন, যা আজ সিনেমার ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। এই ২০১৩ সাল ভারতবর্ষে সিনেমার ইতিহাসের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার বছর। এই বই ও প্রদর্শনী সেই শতবর্ষ উদ্যাপনেরও অঙ্গ হিসেবে অভিনন্দনযোগ্য। এটা গেল বাইরের দিক। তাছাড়া আলোকচিত্রের নান্দনিক উৎকর্ষের দিক থেকেও নিমাই ঘোষের ছবিগুলির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। সাদা-কালোতেই তিনি বেশিরভাগ ছবি তুলেছেন সাধারণ ক্যামেরায়, কখনো ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে। সাদা-কালোর কল্পনাদীপ্ত বিভাজন, ধূসরের নানা মাত্রার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও পরিবেশের ভেতর বাস্তবোত্তীর্ণ অনির্বচনীয় এক পরিমন্ডল গড়ে তোলার প্রয়াস, তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য। কোথাও তিনি দৃশ্যকে ভাঙেননি। স্বাভাবিকতাতেই সংস্থিত থেকেছেন। অথচ উপস্থাপনার গুণে সেই স্বাভাবিকই গভীরতর মাত্রায় ব্যঞ্জিত হয়েছে। আলোকচিত্রী হিসেবে এখানেই তাঁর সার্থকতা।

চার
আমরা প্রথমে দেখব ছবি তৈরির ছবিগুলো। এই পর্যায়ের ছবির মধ্যে একেবারে গোড়ার দিকের একটি গুপী গাইন বাঘা বাইনের। ১৯৬৮-তে তোলা। সুউচ্চ বড় বড় গাছের অরণ্য। এরকম দুটি গাছের মাঝখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে সত্যজিৎ রায়কে। স্ক্রিপ্ট হাতে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। পেছনে গুপী ও বাঘা-বেশী যথাক্রমে তপন চ্যাটার্জি ও রবি ঘোষ। বাঘার ঢাকটিও দেখা যাচ্ছে সামনে গাছের গোড়ায়।
এর পরেই আমরা চলে আসি অরণ্যের দিনরাত্রির শুটিংয়ে। ১৯৬৯-এ তৈরি হয়েছিল এই সিনেমা। ছবি তৈরির ছবি হিসেবে এর একটি আলোকচিত্র খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এটি একটি শারীরিক মিলনের দৃশ্য। এক সাঁওতাল যুবতী দুলীর সঙ্গে শহুরে যুবক হরি যৌনমিলনে তৎপর। দুলীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সিমি গারেওয়াল। আর হরির ভূমিকায় শমিত ভঞ্জ। মিলনের প্রস্ত্ততি চলছে। দুলী মাটিতে শায়িত। হরি খালি গায়ে তার ওপরে। পেছনের নিসর্গে ঝোপঝাড়, এবড়ো-খেবড়ো জমি। শায়িত দুজনের মাথার থেকে অল্প দূরে বসানো রয়েছে ক্যামেরা। মাটিতে বসে ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দেখছেন সত্যজিৎ। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে। পেছনে রয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার সৌমেন্দু রায় ও অন্য কলাকুশলীরা। সিনেমার পর্দায় দর্শক যে যে শরীরী মিলন দেখে, তা একান্তই গোপন, দুটি নারী-পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত এক ক্রিয়া। সেই ব্যক্তিগতকে তৈরি করতে যে প্রয়োজন হয় কত মানুষের চিন্তা ও কর্মপ্রয়াস, তারই একটি নিদর্শন ধরা আছে এখানে। স্বয়ং পরিচালক এবং অন্য অনেক মানুষের সমবেত প্রয়াস থেকে গড়ে উঠছে একটি দৃশ্যের গোপনীয়তা। এরকম দৃশ্যের পর দৃশ্যজুড়ে তৈরি হচ্ছে যে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রটি, তার পশ্চাৎপটের কর্মযজ্ঞের খানিকটা আভাস পাওয়া যায় এই ছবি থেকে। ছবিটিতে আলোর মধ্যে যে ছায়ার বিস্তার, আলো-ছায়ার যে বিনম্র আলাপচারিতা, তাতে আলোকচিত্রীর ব্যক্তিত্বকেও অনুভব করা যায়।
অরণ্যের দিনরাত্রির মেমোরি গেমের দৃশ্যের ছবিটিও খুব মনোরম। ছজন অভিনেতা-অভিনেত্রী, রবি ঘোষ, শর্মিলা ঠাকুর, শুভেনদু চ্যাটার্জি, কাবেরি বোস, সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও শমিত ভঞ্জ গোল হয়ে বসে খেলছে। মাঝখানে ট্রেতে ছটি গ্লাসে রয়েছে পানীয়। এ ছবিতে সবটাই আলো। বিনম্র আলো। তার মধ্যেই মিশে আছে খুব সংবৃত ছায়া। আলো-ছায়ার সংঘাত নেই কোনো। এখানে আমরা সিনেমার দৃশ্যটিই শুধু দেখছি। ছবি তৈরির ছবি দেখছি না। সেরকম আরেকটি সুন্দর ছবি ছিল পাশেই। একটি গাছের তলায় ছাতা মাথায় বসে আছেন সত্যজিৎ ও অন্য কয়েকজন কলাকুশলী। বৃষ্টি হচ্ছে। সামনের নিসর্গ ঝাপসা। সত্যজিৎ প্রকৃতির নিজস্ব রূপকেই ধরতে চাইতেন তাঁর সিনেমায়। আরোপিত রূপ চাইতেন না। প্রকৃত বৃষ্টি দিয়েই বৃষ্টিদৃশ্য তৈরি করতে চাইতেন। আরোপিত বৃষ্টি দিয়ে নয়। সেরকম সন্ধানের প্রয়াসের একটি মুহূর্ত ধরা রয়েছে এই ছবিতে।
নিমাই ঘোষ এরপর একের পর এক সিনেমার ছবি তুলে গেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), জনঅরণ্য (১৯৭৫) – এই তিনটি নিয়ে আধুনিক নাগরিক জীবনের ট্রিলজি। তারপর অশনি সংকেত (১৯৭৩)। সেখানে ধরা আছে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের বাস্তব। গুপী গাইন বাঘা বাইনের (১৯৬৮) পরবর্তী অধ্যায় হীরক রাজার দেশে তোলা হয়েছিল ১৯৮০ সালে। এরপর সত্যজিতের নিজেরই লেখা দুটি গোয়েন্দা-গল্প নিয়ে সিনেমা সোনার কেল্লা (১৯৭৪) ও জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮)। হিন্দি ভাষায় শতরঞ্জ কে খিলাড়ি তোলা হয়েছিল ১৯৭৭-এ। এরপর রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে (১৯৮৪)। দূরদর্শনের জন্য প্রেমচন্দের কাহিনি অবলম্বনে সদগতি তোলা হয়েছিল ১৯৮১-তে। আজকের জীবনে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে তিনটি সিনেমা করেছিলেন সত্যজিৎ গণশত্রু (১৯৮৯), শাখা-প্রশাখা (১৯৯০) ও আগন্তুক (১৯৯১)। সদগতির আগে আরো একটি ছোট ছবি করেছিলেন পিকু, ১৯৮০ সালে। একটি শিশুর দৃষ্টিতে সেখানে ধরা হয়েছিল তার মায়ের অবৈধ প্রেমের কাহিনি। এর পরে রয়েছে তিনটি তথ্যচিত্র : ১৯৭১-এ সিকিম, ১৯৭২-এ শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে করা দ্য ইনার আই আর ১৯৭৬-এ প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বালা সরস্বতীকে নিয়ে তোলা তথ্যচিত্র বালা। এই সবকটি চলচ্চিত্রেরই ছবি তুলেছিলেন নিমাই ঘোষ। এই প্রদর্শনীতে আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে এসব ছবি। শুধু আমরা পাই না প্রথম পর্বের সত্যজিৎকে। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার, দেবী, জলসাঘর, পরশপাথর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানগর – এসমস্ত অসামান্য সিনেমার সময় সত্যজিতের সান্নিধ্যে আসেননি নিমাই ঘোষ।

আমরা এত ছবির এত অজস্র দৃশ্যের ভেতর থেকে কয়েকটিকেই মাত্র একটু নিবিষ্ট দেখার চেষ্টা করব নিমাই ঘোষের শিল্পদৃষ্টিকে বুঝতে। প্রতিদ্বন্দ্বীর (১৯৭০) একটি দৃশ্য। কলকাতার টাটা সেন্টারের ওপরে তোলা সিদ্ধার্থ (ধৃতিমান চ্যাটার্জি) ও কেয়া (জয়শ্রী রায়) হেঁটে যাচ্ছেন। সূর্যালোক তাঁদের পেছন দিকে। তাই দুজনেই ছায়াময়। তাঁদের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে মেঝের ওপর, তার দুপাশে রয়েছে দুটি স্তম্ভের ছায়া। ছায়া দিয়ে শিল্পী তৈরি করেছেন বাস্তবের ভেতর বাস্তবাতীত মায়া।
অশনি সংকেতের (১৯৭৩) একটি দৃশ্য। ব্রাহ্মণ গঙ্গাচরণ (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরছেন ছোট-বড় বৃক্ষ ও গুল্মে ভরা জমির ওপর দিয়ে। ওপরে আকাশ আলোকিত শূন্যতা বিস্তার করে রয়েছে। এই গমন বা আগমনের ছবি তোলা হচ্ছে। ক্যামেরায় রয়েছেন কলাকুশলীরা। সত্যজিৎ আছেন কি? বোঝা যাচ্ছে না। এও একটি ছবি তোলার ছবি। ঘরে বাইরের (১৯৮৪) একটি দৃশ্য। মশাল হাতে ছুটে আসছে কিছু লোক। সমস্ত দৃশ্যপটে নিবিড় অন্ধকার। তার মধ্যে মশালের আলোয় আলোকিত চলন্ত মানুষেরা। নিবিড় কালোকে অসামান্য ব্যবহার করেছেন শিল্পী। ঘরে বাইরে সিনেমাটি রঙে তোলা। নিমাই ঘোষ দৃশ্যটি তুলেছেন সাদা-কালোয়। তাতে স্বতন্ত্র এক নান্দনিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে ছবিটি। শতরঞ্জ কে খিলাড়ির (১৯৭৭) একটি দৃশ্য। ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে প্রান্তরের মধ্য দিয়ে তিন অশ্বারোহী। চিত্রক্ষেত্র দুভাগে বিভাজিত। নিম্নভাগে নিপাট অন্ধকার, ঊর্ধ্বভাগে উদ্ভাসিত আলো। সেই আলোর প্রেক্ষাপট তিন অশ্বারোহীকে সিল্যুট বা ছায়াবৃত করেছে। আর ছবিটিতে এনেছে বাস্তবাতীত রহস্যময়তা। সাদা-কালোতে যতটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে নিমাই ঘোষের ছবি, রঙে এলে কি একটু স্তিমিত হয়ে যায় তা? দ্য ইনার আইয়ের (১৯৭২) একটি রঙিন ছবি দেখে সে-কথাই মনে হয়। বিনোদবিহারী ও সত্যজিৎ মুখোমুখি বসে রয়েছেন। বর্ণে বাস্তব আরো প্রত্যক্ষ। কিন্তু বাস্তবাতীতের মায়া সৃষ্টি হয়নি।
এই প্রদর্শনীতে সত্যজিৎ ছাড়া অন্য সিনেমাও ছিল। কিন্তু সেদিকে আমরা যাচ্ছি না। পরিসরের সীমাবদ্ধতার কারণে খানিকটা। তাছাড়া সত্যজিৎই এই প্রদর্শনীর প্রধান সুর। এই প্রদর্শনীর একটি বড় অংশ সিনেমা-নিরপেক্ষ সত্যজিৎকে নিয়ে। সত্যজিতের ব্যক্তিত্ব সেখানে উদ্ভাসিত হয়েছে মর্যাদাময়ভাবে। তারই কয়েকটি ছবির উল্লেখ করে শেষ করব এই আলোচনা। চিত্রপটে দেখা যাচ্ছে শুধুই ক্যামেরার সম্মুখভাগ। তার ওপর রাখা আছে সত্যজিতের বাঁ-হাতটি। পেছনে রয়েছেন তিনি। কিন্তু অদৃশ্য। একাত্ম হয়ে গেছে এখানে ক্যামেরা ও সত্যজিৎ। শতরঞ্জ কে খিলাড়ির (১৯৭৭) নির্দেশনার সময়ের ছবি এটি। আরেকটি ছবিতে সত্যজিতের মুখ আবৃত হয়ে গেছে অন্ধকারে। বসে আছেন তিনি। হাতদুটি কপালের কাছে তোলা। ডান হাতটি চোখের ওপর স্থাপিত। বাঁ-হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। প্রেক্ষাপটের দুপাশে পরিব্যাপ্ত অন্ধকার। মাঝখানে স্তিমিত আলোর বৃত্ত। একজন বড় শিল্পীর মগ্নতা ধরা পড়েছে এই ছবিতে। অশনি সংকেতের (১৯৭৩) চিত্র গ্রহণের সময় তোলা হয়েছিল এই ছবি। কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে বিশাল পথ চৌরঙ্গী রোড। একা হেঁটে আসছেন সত্যজিৎ। অসামান্যভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্ব। রাস্তায় যানবাহন বিশেষ নেই। সম্ভবত পরিকল্পিতভাবেই যানমুক্ত রাখা হয়েছে পথকে। সীমাবদ্ধ (১৯৭১) শুটিংয়ের পূর্বপ্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন পরিচালক। সেই সময় তোলা হয়েছে ছবিটি। উত্তর কলকাতার গড়পার রোডে সত্যজিতের পূর্বপুরুষের বাড়ি। এখন প্রায় পরিত্যক্ত। এই নির্জন বাড়িটিকে স্বমহিমায় উপস্থাপিত করেছেন শিল্পী। ধূসরের নানা প্রচ্ছায়ায় তাতে সঞ্চারিত হয়েছে স্বতন্ত্র এক প্রাণ। আমাদের আলোচনার শেষ ছবিটি বিশপ লেফ্রয় রোডে নিজের ঘরে কর্মরত সত্যজিতের, মগ্ন শিল্পীর এই ছবি পরিচিত প্রায় সকলেরই। সামনে রয়েছে ক্যামেরা। তাতে সত্যজিতের ছবি তুলছেন কেউ। ১৯৮৮-তে বিবিসি থেকে তোলা হয়েছিল তথ্যচিত্র দ্য সিনেমা অব সত্যজিৎ রে। তারই জন্য ছবি তোলার একটি মুহূর্ত ধরা পড়েছে এই ছবিতে।
সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে ক্যামেরায় নিমাই ঘোষের এই অভিযাত্রা আমাদের আলোকচিত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।