শহীদ কাদরী : নিজকীয় বৈশিষ্ট্যের এক অনন্য কবি

মঈন শেখ

শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬) লিখেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু লিখেছেন খুবই অল্প। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চার। এই চারটি গ্রন্থে কবিতা রয়েছে ১৫০টির মতো। আবার গ্রন্থ চারটির প্রকাশকাল দেখেও আমরা বিস্মিত হই। প্রথমটি অর্থাৎ উত্তরাধিকার প্রকাশিত হয় কবির ২৫ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে। দ্বিতীয়টি অর্থাৎ তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় কোথাও কোন ক্রন্দন নেই নামক গ্রন্থ। এর প্রায় ৩০ বছর পরে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হলো আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও গ্রন্থটি। তাঁর কবিতার সংখ্যা, গ্রন্থের সংখ্যা আর এক গ্রন্থ থেকে অন্য গ্রন্থের মধ্যে ব্যবধান আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় কবির প্রতি, সেইসঙ্গে আফসোসও হয়, কবি আরো কেন ভরিয়ে দিলেন না তাঁর সৃজনের উঠোন-বারান্দা। অবশ্য একজন কবির সৃষ্টি-সংখ্যা দিয়ে তাঁর
কৃতিত্ব বিচার্য নয়, তাঁর সৃষ্টিটাই আসল। পৃথিবীবিখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই অল্প। যেমন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ারের বইয়ের সংখ্যা একটাই (লে ফ্লর দ্যু মাল)। কবিতার সংখ্যা ১৮০টি। আর একজন বিখ্যাত কবি জঁ আর্তুর র্যাঁবো। তাঁর বই মাত্র দুটি। এই বিরলপ্রজ কবিদের ধারায় এক সংযোজন বলতে পারি শহীদ কাদরীকে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে সংখ্যার একটা প্রচলিত ব্যাপার থাকলেও শহীদ কাদরী তাতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন লেখকের প্রধান কথাগুলো বলে ফেলবার জন্যে ৫০-৬০টি গ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘সাধারণত দেখা যায় কি, লেখকেরা তাদের প্রধান লেখাগুলোর পর সব পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।’ একথা সত্য যে, শহীদ কাদরীর কবিতায় আমরা পুনরাবৃত্তি পাই না। এক গ্রন্থ থেকে আরেক গ্রন্থে থেকেছে চিমত্মার নতুনত্ব। প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটেছে বিশেষ বাঁকবদল।

যাহোক, এই অল্পকটি কবিতায় কবি আমাদের যা দিয়েছেন, তা অসামান্য আর অতুলনীয়। তিনি প্রথম গ্রন্থেই বড়সড় ঝাঁকুনি দিয়ে বসলেন আমাদের কবিতা-অঙ্গনে। তাঁকে আমরা উপাধি দিয়ে বসলাম অনেক। যেমন – ক্ষণজন্মা, বিরলপ্রজ, বিশ্বজনীন ইত্যাদি কবি হিসেবে। প্রকাশক মফিদুল হক তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন : বাংলা কবিতার অতিসাম্প্রতিক সৃষ্টিপ্রাচুর্যের ভিড়ে তাঁকে কেউ খুঁজে পাবেন না। অথচ সাতচলিস্নশ-উত্তর কবিতাধারায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সঞ্চারিত করে কবিতার রূপ বদলে যাঁরা ছিলেন কারিগর, শহীদ কাদরী তাঁদের অন্যতম প্রধান। তাঁর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ এক আলাদা জগতে, ঝলমলে বিশ্ব-নাগরিকতাবোধ ও গভীর স্বাদেশিকতার মিশেলে শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বে তিনি যেন বিদ্যুচ্চমকের মতো এক ঝলকে সত্য উদ্ভাসন করে পরমুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন দূর দিগমেত্মর নিভৃত নির্জনতার কোলে। মফিদুল হকের এই উক্তি যথার্থ। কারণ তাঁর রচনার অভিনবত্ব, বলবার ভঙ্গি, উপমার দৃঢ়তা আর সাহস আমাদের চমকিত করে। আমরা পাঠামেত্ম স্তম্ভিত হই কী ঘটে গেল বলে। সেক্ষেত্রে তাঁর বহুল পঠিত ও প্রশংসিত একটি কবিতা ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’র কথা বলা যেতে পারে। সেখানে শুরুতেই বলা হয়েছে ‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো’। কী বলতে চাইছেন কবি? প্রথমেই একটা প্রশ্ন থামিয়ে দেয় পাঠককে। এই সন্ত্রাস সবকিছু ধুয়েমুছে নিয়ে যাচ্ছে শহর থেকে। পালাচ্ছে সবাই, পালাচ্ছে মহাজ্ঞানী, মহাজন মোসাহেব, সিপাই, সান্ত্রি, এমনকি রাজস্ব আদায়কারী যারা ছিল। কিন্তু কবির প্রশ্ন, তিনি একা কোনদিকে ভেসে যাবেন। তিনি আর পাঁচজনের সঙ্গে নিজেকে রাখছেন না। কবি শুধু দেখছেন তাঁর ভাবনার নিরিখে –

এবং হঠাৎ

সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে

বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়মত্ম বলস্নম!

বজ্র-শিলাসহ বৃষ্টি, বৃষ্টি : শ্রম্নতিকে বধির ক’রে

গর্জে ওঠে যেন অবিরল করাত-কলের চাকা,

লক্ষ লেদ-মেশিনের আর্ত অফুরমত্ম আবর্তন!

 

নামলো সন্ধ্যার সঙ্গে অপ্রসন্ন বিপন্ন বিদ্যুৎ

মেঘ, জল হাওয়া, –

হাওয়া, ময়ূরের মতো তার বর্ণালী চিৎকার,

কী বিপদগ্রস্ত ঘর-দোর,

ডানা মেলে দিতে চায় জানালা-কপাট

নড়ে ওঠে টিরোনসিরসের মতন যেন প্রাচীন এ-বাড়ি!

(‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’, উত্তরাধিকার)

 

শহীদ কাদরী তাঁর তরুণ বয়সে আল মাহমুদের কবিতার দুটি লাইন পড়ে খুব হাসাহাসি করেছিলেন (এক সাক্ষাৎকারে শহীদ কাদরীর উক্তি)। লাইনদুটো ছিল এমন : বিছানায় শরীর ঢেলে, জানালায় বৃষ্টির তীর মেরে। সেই কাদরী নিজেই এক অহংকারী দাপটের সঙ্গে লিখে ফেললেন এমন কবিতা। বলে ফেললেন ‘বিদ্যুতের উড়মত্ম বলস্নম’। বাংলা সাহিত্যের চিরাচরিত বর্ষা বা বৃষ্টিকে দিলেন নতুনত্ব। কবি আরো বেশি মহিমান্বিত করলেন বৃষ্টিকে। এ বর্ষা কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথের বর্ষা নয়। নয় বিষ্ণু দে-রও। এক নতুন বর্ষার প্রকৃতিকে কবি পরিচয় করিয়ে দিলেন বাঙালি পাঠকের কাছে। চমকে দিলেন বাংলা কাব্য-অঙ্গনকে। কিন্তু এর পরেও কি এমন ধাঁচের কোনো কবিতা লেখা হয়েছে? তবে কি শহীদ কাদরীর দ্বারাই এটা সম্ভব? ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ কবিতাটি প্রথম ছাপা হয় সমকাল পত্রিকায়। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বলতে গেলে অগ্রজরাও থমকে গিয়েছিলেন। এর আগে যাঁকে বা যাঁদেরকে আমরা নাগরিক কবি বলে হইচই করেছি, সেখানেও কিছুটা থিতু ভাব এলো। নাগরিক কবি হিসেবে সবার ওপরে স্থান পেলেন শহীদ কাদরী। এত গতি আর এত বিপস্নবসমৃদ্ধ কবিতা এর আগে কেউ দ্যাখেনি কখনো। তাও আবার শহুরে বৃষ্টি। বর্ষাকে নিয়ে আরো কয়েকটি কবিতা আছে এমনই। এর মধ্যে একটি হলো : ‘ভরা বর্ষায় একজন লোক’। এখানেও বর্ষা নিজ দর্পে সম্পূর্ণ নতুন।

শহীদ কাদরী প্রথমে বলতে গলে বাক্যচর্চা করেছেন এক নেপথ্যভূমিতে, পাঠকের আড়ালে থেকে। তাঁর কবিসত্তা সেই নেপথ্যভূমিতেই পক্বতা পেয়েছে। তাই উত্তরাধিকার হাতে পাওয়ার পর কোনো সমালোচক আর বলতে পারেন না, এটা তাঁর প্রস্ত্ততিকালের কবিতা-সংকলন। সেই সময়ের সকল সমালোচকই একমত হয়েছিলেন যে, কাদরীর কবিতা পরিণতি পেয়েছে তাঁর প্রথম গ্রন্থেই। কবি তাঁর কাব্যচর্চার পথচলায় অনেকটা প্রথাগতের উল্টো দিকের যাত্রী। তাঁর প্রথম গ্রন্থেই তিনি হয়েছেন সিরিয়াস ও গম্ভীর। বলতে গেলে কিছুটা লঘু হয়েছেন তাঁর পরবর্তী গ্রন্থগুলোতে। কবি ও আমাদের বাংলা সাহিত্যের যোগ্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ এ প্রসঙ্গে বলেছেন : কাদরীর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগেই কবি হিসাবে তিনি প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলেন – বই বেরোনোর আগেই লোরকা’র কবিতা যেমন মুখে-মুখে ফিরতো, অতোটা না হ’লেও তারই সঙ্গে তুলনীয়। একবার গ্রন্থকার হিশেবে উপস্থিত হ’য়ে কাদরী ক্রমাগত নিজের আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তি করেননি, ক্রমাগত এগিয়েছেন, আবার তাঁর মৌল-আমি অটুট রেখেছেন। এইভাবে এক স্থির-অস্থিরতায় তিনি হ’য়ে উঠেছেন এদেশের একজন প্রধান কবির অন্যতম।২ শহীদ কাদরী তরুণদের মধ্যে সবসময় অনেক বেশি জনপ্রিয় কবি; তখন থেকে এখন পর্যমত্ম। তিনি মারা যাওয়ার পর পত্রিকা তো বটেই, ফেসবুকে তরুণদের এত শোরগোল, এত হাহাকার এর আগে কখনো দেখিনি। মজার ব্যাপার, তিনি লিখেছেন অনেক কম, আর জনপ্রিয় হয়েছেন অনেক বেশি।

তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। করলেও কবিকে করা হবে খ–ত। কারণ, একটার সঙ্গে আর একটার মাখামাখি অনেক জমাট। তাছাড়া এখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ছন্দ, অলংকরণ অর্থাৎ কোনোকিছুর বাড়াবাড়ি নেই। অথচ সাজগোজে নিপুণতা ঈর্ষণীয়। মেদহীন আর কংক্রিট। নিখুঁত গড়নে গড়ে তুলেছেন তাঁর কাব্য-পিরামিড। এখান থেকে কোনো কিছু সরিয়ে রাখার মতো বাড়তি বস্ত্ত নেই।

কবির কাছে শুধু বর্ষা নয়, শীতও এসেছে নিঃসঙ্গ দিনের পাখির মতো। বর্ষার গতির বিপরীত গতি শীতে। সে আগাম বসমেত্মর স্তনকেও শীতল করে দেয়। ‘এই শীতে’ নামক কবিতায় কবি বলেছেন :

শীতার্ত নিঃস্বতায় কিছুই বাঁচে না যেন

বেঁচে থাকা ছাড়া, বসমেত্মর শিথিল স্তন

নিঃশেষে পান করে নিঃস্বার্থ মাটি

লতা-গুল্ম গাছ কাক শালিক চড়ুই

এমনই অসহায় গর্তের দেয়ালের জীব…

… … …

এবং আরো একজনের চোখে দেখি

লক্ষ সূর্যের আসা-যাওয়া এবং সেও একা

আমারই আত্মার মত

প্রাঙ্গণের তরুণ কুকুর!

কবিতাটি পড়লে মনেই হবে না এটি কোনো ১৪ বছর বয়সী কিশোর কবির লেখা। প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন তরুণ কবির আত্মা কেন এত নিঃসঙ্গ আর একা। কবির এই নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্ব শেষতক চিরকালীন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমৃত্যু। তাঁর অনেক কবিতায় তা ফুটে উঠেছে শৈল্পিক হাহাকারের মর্যাদায়। এই কবিতাটি ছাপা হয় কবিতা পত্রিকায় (১৯৫৬)। সেটাই ছিল নাকি কবির টার্নিং পয়েন্ট। তাঁর কবিসত্তার উন্মীলন নাকি ঘটিয়েছে কবিতা পত্রিকা। কবির নিজের ভাষায় – কবিতা পত্রিকায় যদি লেখা ছাপা না হতো, তাহলে হয়তো আমি কবিতায় লেগেই থাকতাম না। বুদ্ধদেবের রুচির ওপর আমাদের আস্থা ছিল। তিনি যদি মনে করেন কবিতা, তাহলে ওটা কবিতা হয়েছে। উনি মনে না করলে হয়নি। অবশ্য সে সময়ের অধিকাংশ কবিরই আকাঙক্ষা ছিল, তার একটি কবিতা কবিতা পত্রিকায় ছাপা হোক। নিজের রুচির ওপর নিজের যতটা আস্থা কিংবা নিজের কবিতার ওপর নিজের যতটা আস্থা, তার অধিক আস্থা ছিল বুদ্ধদেব বসুর ওপর। তাঁর ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য অনেকেই অস্থির থেকেছেন সে সময়। সাজ্জাদ শরিফ এই প্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বুদ্ধদেব বসু তখন আধুনিক বাংলা কবিতার বিধাতাপ্রায়।’ আমার অবশ্য ভিন্নমত। কবিতার বিধাতা থাকে কবির অমত্মরে। তার বিধাতার গুমর যত বেশি, তার কবিতা ততই উচ্চ আসনে আসীন। তাছাড়া আমরা কেন জানি সমকাল পত্রিকার অবদানের কথা ভুলে যাই। সেই সময় বাংলার কবি ও কবিতার ক্ষেত্রে (বিশেষ করে ঢাকার) সমকালের অবদানের কথা খাটো করে দেখবার নয়।

অনেকে বলেছেন শহীদ কাদরী সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও সমর সেন দ্বারা প্রভাবিত কবি। প্রতিটি কবির ওপর কোনো না কোনো অগ্রজের ছায়া কিছুটা পড়তেই পারে। কিন্তু প্রভাবিত হয়েছেন এ-কথা বোধহয় ঢালাওভাবে না বলাই ভালো। আমার মনে হয় শহীদ কাদরী নিজেই নিজেকে প্রভাবিত করেছেন বারবার। তিনি প্রতিটি গ্রন্থে থেকেছেন স্বতন্ত্র। তাঁর গ্রন্থ চারটি পরপর সাজালে একটি থেকে আর একটি যে আলাদা তা সহজেই চোখে পড়ে। একটা থেকে আর একটাতে নতুন-নতুনভাবে বেরিয়ে এসেছেন কবি। অনেকে বলতে পারেন, কাদরী উত্তরাধিকারে যতটা ঘন ছিলেন পরবর্তী সময়ে ততটা আর নেই। যেমন – আমাদের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সৈয়দ আলী আহসান তাঁর সম্পর্কে বলেছেন : উত্তরাধিকার কাব্যগ্রন্থ দ্বারাই শহীদ কাদরীর যথার্থ কবিস্বীকৃতি। এ-গ্রন্থটি ছাড়া তাঁর আরও যে দুটি কাব্যগ্রন্থ (তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই) আছে কিন্তু সেগুলোতে তিনি বড় বেশি সাম্প্রতিকতায় জড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর যে বিশৃঙ্খলা এবং অব্যবস্থা চতুর্দিকে লক্ষ্যগোচর হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ তুলেছিলেন পরের কাব্যগ্রন্থগুলোতে। এই প্রতিবাদগুলো বড় বেশি সাময়িক, যার ফলে এগুলো কবিতার প্রকোষ্ঠ ছুঁয়েছে কিন্তু অভ্যমত্মরে প্রবেশ করতে পারেনি। শহীদ কাদরীর পরিচয় তাঁর উত্তরাধিকার কাব্যগ্রন্থ দিয়েই। আসলে একজন কবির প্রস্ত্ততিপর্ব প্রতিনিয়ত চলে। নতুন করে প্রস্ত্ততি নেন কবি নতুন কিছু সৃজনের বেদনা থেকেই। কবি সবসময় চাইবেন মানুষের কথা বলতে, মানুষের কাছে যেতে, সময়ের যন্ত্রণাকে উপভোগ করতে। সংগত কারণেই নিজেকে অনেক সময় আলগা করতে বাধ্য হন কবি। তাছাড়া নির্জনতা-বিলাসী শিল্পীর দিন অনেক আগেই গেছে। চারদিকে প্রতিনিয়ত ভাঙছে আর গড়ছে। এই ভাঙা-গড়ার যজ্ঞে সকল শিল্পীর উপস্থিতি কামনা করে বর্তমানের নিরুপায় প্রকৃতি। আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাষ্য এরকম : সমাজজীবনের ভাঙাগড়ার মাঝখান দিয়ে চলেছে ইতিহাসের যে-ধারা, কোন শিল্পী যদি তাঁর সৃষ্টিক্ষেত্রকে তার তরঙ্গাঘাত থেকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখেন তবে তার উর্বরতা যাবে নষ্ট হয়ে, তা আর শস্যশ্যামল থাকবে না, হবে ধূসর মরুভূমি। কাদরী তাঁর ক্ষেত্রকে ধূসর মরুভূমি হতে দেননি। তিনি আরো বেশি করে হতে চেয়েছেন সাধারণ পাঠকের। এগিয়ে এসেছেন তরুণের কাছাকাছি। সৈয়দ আলী আহসান তাঁর অন্য একটি লেখাতে বলেছেন, যা তাঁর প্রথম উক্তির ক্ষেত্রে খানিকটা স্ববিরোধিতার মতো। যেমন তিনি বলেছেন – ‘বর্তমানকালের কাব্যনিরীক্ষায় আর একটি সত্য আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। তা হচ্ছে সমাজ-জীবন ক্রমশঃ জটিল হচ্ছে, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং নতুন নতুন সম্পদের প্রাচুর্যে সম্ভবতার সঙ্গে এত বেশি জড়িয়ে পড়েছে যে বর্তমানকালে আমাদের কবিতায় আমাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো প্রাত্যহিক জীবনের উপলব্ধির বাইরে খুব বেশি যেতে পারে না। সুতরাং প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের যে অভিজ্ঞতা তাকে সঞ্চয় করেই কবিতা রচনায় অগ্রসর হওয়া আমাদের কর্তব্য।’ শহীদ কাদরী সংগত কারণেই তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থকটিতে এমনটি করেছেন।

১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা। এখানে প্রকাশ পেয়েছে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবর্তন আর অস্থিরতা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও তার পরবর্তী সময়। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়কে যেভাবে উপমা-প্রতিউপমা, তুলনা-প্রতিতুলনা আর উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। যেমন – ‘সেলুনে যাওয়ার আগে’ কবিতায় কবি মাথার চুলকে প্রতীকের মাধ্যমে কোথায় না নিয়ে গিয়েছেন। কবি বলেছেন –

আমার ক্ষুধার্ত চুল বাতাসে লাফাচ্ছে অবিরাম

শায়েসত্মা হয় না সে সহজে, বহুবার

বহুবার আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম

পাড়াতে চেয়েছি। ‘বর্গীরা আসছে তেড়ে’,

ঘুমাও ঘুমাও বাছা!’ কিছুতেই কিছু হয় না যে তার

… … …

চুলের চটুল অহঙ্কার সহনীয় নয় কোনো সুধীম-লীর কাছে

অতএব খাটো হতে হবে তাকে,

… … …

তবু সে আমার চুল

অন্ধ

মূক ও বধির চুল মাস না যেতেই

আহত অশ্বের মতো আবার লাফিয়ে উঠছে অবিরাম।

চুলকে যতই দমিয়ে রাখবার চেষ্টা করা হোক না কেন, সে মাস না যেতেই তরতর করে লাফিয়ে উঠবে। আহত তেজি ঘোড়ার সেরে উঠবার মতো। স্বাধীনতাকামী মানুষও এমনই, তাকে দমিয়ে রাখা যায় না। এই গ্রন্থের কিছু কবিতায় কবি সরাসরি তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কখনো তিনি ক্ষোভও দেখিয়েছেন সরাসরি। তুলনার আশ্রয় নেননি। যেমন –

রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে স্বাধীনতা দিবসের

সাঁজোয়া বাহিনী,

রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে রেসকোর্সের কাঁটাতার,

কারফিউ, ১৪৪-ধারা,

… … …

রাষ্ট্র মানেই স্ট্রাইক, মহিলা বন্ধুর সঙ্গে

এনগেজমেন্ট বাতিল,

… … …

রাষ্ট্র মানেই রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা

রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা মানেই

লেফ্ট্ রাইট, লেফ্ট্ রাইট, লেফ্ট্ –  !

(‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট্ রাইট লেফ্ট্’)

যখনই কবিচিত্ত তিক্ত-বিরক্ত কিংবা তির্যক বিদ্রূপ এসেছে মনে, তখনই বলে ফেলেছেন এমন সরাসরি কথা। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন?, স্বাধীনতার শহর, নিষিদ্ধ জার্নাল থেকেসহ কিছু কবিতা। কবি কখনো নিজেকে বলেছেন কাপুরুষ আর ভীরু। তবে কবির আশা, সাহস যা কিছু, তা হলো তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতা বিস্ফোরণের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে তাঁকে। কিন্তু কবিতা তাঁর বিস্ফোরিত হয়নি। এতে কবি আরও অভিমানিত। কবি অভিমান করে বলেছেন –

স্বাধীনতার সৈনিক যেমন ঊরুতে স্টেনগান বেঁধে নেয়,

কিম্বা সমত্মর্পণে গ্রেনেড নিয়ে হাঁটে,

তেমনি আমিও

গুপ্তচর দৃষ্টির আড়ালে অতি যত্নে লুকিয়ে রেখেছি

যেন তুমি নিদারুণ বিস্ফোরণের প্রতিশ্রম্নতিতে

খুব বিপজ্জনক হ’য়ে আছো।

 

শেষতক কবি হতাশ হয়ে বলেছেন –

মধ্যরাত্রি পর্যমত্ম অনিদ্রা এবং অস্থির জাগরণ ছাড়া তুমি কিছু নও,

কপালে দাও নি তুমি রাজার তিলক কিম্বা প্রজার প্রতিশ্রম্নতি

তবে কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছি তোমার পদমূলে!

 

বরং এসো করমর্দন ক’রে যে যার পথের দিকে যাই,

তবু আরো একবার বলি :

যদি পারো গর্জে ওঠো ফীল্ডগানের মতো অমত্মত একবার…

(‘কবিতা, অক্ষম অস্ত্র আমার’)

তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা গ্রন্থের কবিতা যেন ১৯৭১ ও তার পরবর্তী সময়ের চলমান ঘটনাপ্রবাহ। একটা কবিতার সঙ্গে আর একটা কবিতার পরম্পরা রয়েছে ধারাবাহিকভাবে। এর পরের গ্রন্থ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। এখানে শহীদ কাদরী ভিন্নরূপে আমাদের সামনে এলেন। এখানে খেলেছেন অন্য খেলা। খুব দ্রম্নত সরে যাচ্ছে কবির সময়; তাঁর শিল্পও। একটা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে বেশি সময় তিনি থাকতে চাননি। কারণ, কবির একটা ভয় ছিল, তাঁর শিল্পবোধের মধ্যে যেন পুনরাবৃত্তি না আসে। এখানে কবিকে প্রায়শই পাচ্ছি বড় নিঃস্ব আর অনিকেত হিসেবে। কবি তাঁর ‘অটোগ্রাফ দেয়ার আগে’ নামক কবিতায় একের পর এক বিছিয়েছেন ক্ষোভ আর অভিমান। তিনি মায়ের আঁচল থেকে শুরু করে কতশত জায়গাতেই লিখেছেন তাঁর নাম। স্বাক্ষরে স্বাক্ষরে ভরে দিয়েছেন চারদিক। শেষতক কবির ক্ষোভ –

…কিন্তু কী লাভ!

এখন তো সেই বয়েস যখন

নির্জলা নামের প্রেম খুব শব্দহীনভাবে উবে যায় –

এই নাম দেউলিয়া! তোমরা কি জানো না

ব্যাঙ্কগুলো ভীষণ বিব্রত : নিয়মিত ফেরৎ পাঠাচ্ছে বারবার

জলহীন নদীর রেখার বিষণ্ণ স্বাক্ষরবাহী চেকগুলো আমার!

ঠিক এমন ধরনের আরও কয়েকটি কবিতা আছে এই গ্রন্থে। যেমন – কেন যেতে চাই, প্রত্যহের কালো রণাঙ্গনে, আমি নই কবিতা। শহীদ কাদরী নিঃসন্দেহে একজন যোগ্য আর স্বঘোষিত নাগরিক কবি। তবে এই গ্রন্থের কিছু কবিতা পড়লে আমাদের কেন জানি মনে হয়, তিনি ইচ্ছা করে নাগরিক হতে চাননি। গ্রামে ফেরারও একটা তাগিদ তাঁর মধ্যে ছিল। নিঃসঙ্গ কবি শহরের কোলাহলের ভিড় ঠেলে চলতে-চলতে যেন ফতুর হয়ে গেছেন। তিনি কখনো আবার গ্রামে গিয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছেন। কারণ তাঁর প্রেম, সেলাম আর প্রাণের স্পন্দন সবকিছু শোষণ করছে সমরবিদ, বিজ্ঞানী, সার্জেন্ট-মেজর অর্থাৎ নগর-সভ্যতার অলীক সৌন্দর্য। কবির সহজ আর অভিমান মিশ্রিত উক্তি –

চায়ের ধূসর কাপের মতো রেসেত্মারাঁয়-রেসেত্মারাঁয়

অনেক ঘুরলাম।

এই লোহা, তামা, পিতল ও পাথরের মধ্যে

আর কতদিন?

এখন তোমার সঙ্গে ক্ষেত-খামার দেখে বেড়াবো।

এই কবিতার শেষে কবি শহরের কাছে প্রশ্ন রাখছেন অভিমান নিয়ে –

আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ।

আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ

আমি এবার গাঁও-গেরামে গিয়ে

যদি ট্রেন-ভর্তি শিউলি নিয়ে ফিরি

হে লোহা, তামা, পিতল এবং পাথর

তোমরা আমায় চিনতে পারবে তো হে!

(‘এবার আমি’)

কবি সমস্ত শহর চষে বেড়িয়েছেন, ঘুরছেন কোলাহল টপকে। সবাইকে আপন করতে চেয়েছেন নিজের মতো করে; কিন্তু সবাই যেন তাঁকে ফিসফিস করে বলছে, তুমি অপরাধী। কবি যতই উদ্বাস্ত্ত হয়ে চরকির মতো গোটা শহর ঘুরে বেড়ান না কেন, কবির দিকে তাকাবার মতো সময় শহরের নেই; তারা বড় বেশি ব্যস্ত। তারা তৈজসপত্রের রং, টেবিল ও চেয়ারের ঢং, জানালার পর্দা ইত্যাদি বদলাতে আর গোছগাছ করতে বড্ড ব্যস্ত। কবিভাষ্য –

ক্বচিৎ-কখনো খুব কাছ থেকে তোমাদের প্রচ- ব্যস্ততা আমি দেখি,

দিগমত্ম আঁধার-করা সজল শ্রাবণও বৃষ্টি ঝরানোর জন্য

অমন ব্যস্ত নয়,

তাক-করা রাইফেলের অমোঘ রেঞ্জ থেকে উড়ে পালানোর জন্য

হরিয়ালের ঝাঁকও অমন ব্যস্ত নয়,

কর্কট-রোগীর দেহে ক্যান্সারের কোষগুলো ছড়িয়ে পড়ার জন্য

অমন ব্যস্ত নয়

… … …

তোমরা বডড বেশি ব্যস্ত

অথচ আমি তো আজীবন তোমাদেরই দিকে যেতে চাই।

কেন যেতে চাই!

এমন প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরেফিরে এসেছে কবির মনে। তাই হয়তো নিজেকে সহজেই ভাবতে পেরেছেন ঝোড়ো নদীতে কাগজের নৌকার মতোই পলকা। সেই দোলাচল থেকেই কিনা আমাদের নাগরিক কবি লিখেছেন ‘খুব সাধ ক’রে গিয়েছিলাম’ কিংবা ‘দাঁড়াও আমি আসছি’র মতো কবিতা। তবে এ-কথা স্বীকার্য যে, এখানে ব্যবহৃত উপমার তীক্ষনতা গ্রামীণ আবহকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক দূর। সেদিক থেকে বিচার করলে, আমরা যে ঢাকঢোল পিটিয়ে শহীদ কাদরীকে উপাধি দিয়েছি নাগরিক কবি, তা নতুন করে বিবেচনার দাবি রাখে। অবশ্য এটা আমাদের ট্র্যাডিশনও বটে। আমরা খুব সহজেই সিদ্ধামত্ম টানতে খুব পটু। একটুতেই বলে ফেলি গ্রামীণ কবি, পলিস্নকবি, বিদ্রোহী কবি, নাগরিক কবি ইত্যাদি। আমার কেন জানি মনে হয়, একজন কবির দীপ্র প্রতিভাকে কিছুটা আড়াল করার জন্যেই এই তকমা এঁটে দেওয়া হয়। তিনি কবি হিসেবে কালকে কতটা জয় করতে পেরেছেন, সেটাই বড় বিবেচ্য হওয়া উচিত। তাঁর দেখবার পরিভাষা কতটা শানিত, বলবার দক্ষতা কতটা মার্জিত আর নির্মেদ, পাঠকের মনে পুলক-তরঙ্গ কতটা অনুরণিত করতে পারে তাঁর কবিতা; এটাই মূল বিবেচ্য হওয়া উচিত। সেদিক দিয়ে আমি বলব, শহীদ কাদরী পাথরে ফুল ফোটানোর কবি। রসিক বটগাছ, যিনি কিনা ইট-পাথরের দেয়ালেও রসের সঞ্চার এনে নিজেকে পলস্নবিত করবার ক্ষমতা রাখেন। তাই বলে বটগাছকে আমরা নাগরিক বলতে পারি না। বরং বটগাছের এ-এক অতিরিক্ত ক্ষমতা, যে শহরকে আত্মস্থ করে নিজের সহজাত শৈল্পিক ক্যারিশমা (ডালপালা, ঝুড়ি, শিকড়-বাকড়) ফুটিয়ে বিশ্বকে বা বিশ্বের একটি অংশকে শোভিত করার দাবি করতেই পারে। শহীদ কাদরীও যেন তাই। তাঁকে বিশেষ কোনো পরিচয় দিলে, বরং খাটো করাই হয়। বাংলা সাহিত্যের নন্দিত সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার এ-প্রসঙ্গে বলেছেন : কাব্য পাঠ করিয়া সাধারণ পাঠক – যাঁহার যতটুকু রসবোধ আছে, সেই অনুপাতে-আনন্দ পাইয়াও, কবির একটা অবামত্মর পরিচয় কাব্য হইতে খাড়া করিয়া, কাব্যের অর্থ-সঙ্গতি বা অর্থ-গৌরব অথবা অর্থ-লাঘব করিতে চান; ইহাতে কবি ও কাব্য উভয়েরই মর্যাদাহানি হয়।

এই গ্রন্থের আর একটি বিশেষ দিক হলো মৃত্যুর শিল্পরূপ নির্মাণ। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, এ শিল্পরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পরূপ নয়। মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : শিবের হাসির মত শামত্ম আর সুন্দর (চার অধ্যায়)। আবার বলেছেন – মরণ রে/ তুঁহু মম শ্যাম সমান। সেক্ষেত্রে শহীদ কাদরীর মৃত্যু-শিল্প বড় খোলামেলা, রাগালো আর তীক্ষন। যেমন –

একটি মাছের অবসান ঘটে চিকন বটিতে,

রাত্রির উঠোনে তার আঁশ জ্যোৎসণার মতো

হেলায়-ফেলায় পড়ে থাকে

কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না….

(‘কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না’)

ঠিক এমন ধারার আরো কয়েকটি কবিতার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো, মৃত্যুর প্রাঞ্জল শিল্প, একটা মরা শালিক নামক কবিতা। তবে আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও গ্রন্থে মৃত্যুর শিল্পরূপ মৃত্যু-চেতনায় পর্যবসিত হয়েছে। এখানে মৃত্যু যেন তাঁর খুব কাছাকাছি। একে একে মেঘ বৃষ্টি, বাতাস, পূর্ণিমা, তরঙ্গ ভরা নদীও তাঁর কাছ থেকে দ্রম্নত সরে যাচ্ছে দূরে। শুধু পিতামহ স্বরূপ মহাকাল নিস্পৃহ গলায় বলে – এই ব্যাটা অকালকুস্মা-, বজ্জাত, মাতাল তবু রাত্রির নদীতে ভাসা ও তরঙ্গে কেঁপে ওঠা সারি সারি লণ্ঠনের মতো ঝলমলে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি লিখে রেখে কোথায় যেন চলে গেছে। অর্থাৎ মৃত্যু সবাই কামনা করলেও তাঁর কবিতাকে কেউ অস্বীকার করতে পারছে না।

আবার কেউ বলছে –

…. কীর্তিনাশার কালো জলে

যাযাবর এই লোকটা ডুবে গেছে নিঃশব্দে

ওর কণ্ঠস্বর আর শুনবে না কেউ কোনদিন।

(‘সবাই তাকে ছেড়ে গেছে’)

এছাড়া কবিকে স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে তাড়া করে ফেরে তাঁর মৃত্যুচিমত্মা। কবি যেন আপন মনে চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছেন, তাঁর মৃত্যুর পর তরুণ কবি, প্রবীণ কবি, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, সমালোচক কে কী করছেন তার চমৎকার একটা তথ্যচিত্র এঁকেছেন ‘স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে একদিন’ কবিতায়। যার কিছুটা এখানে না দিলেই নয় –

আমার অকালমৃত্যু ও বিরল সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে

আমার সতীর্থদের

না-ছুঁই পানি, না-ছুঁই মাছ ধরনের

মমত্মব্য। একজন বললেন : ‘দৈহিক মৃত্যুর ঢের আগে

তাঁর আত্মিক মৃত্যু ঘটেছিল – এই আমার দুঃখ’

আরেকজন বললেন, ‘দু’একটা রচনা মন্দ নয়’

কে একজন হেঁকে উঠলো ‘কফিন এবার

কবরে নামাও। একজন গৌণ কবি যিনি মৌন দীর্ঘকাল

তাঁকে নিয়ে সময়ের এই অপচয় কেন! দাফন শেষ করো

কবরে নামাও।

শুধু তাই নয়, লাশ কবরে শোয়াবার পর হঠাৎ বেঁচে উঠলে কার কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তাও বর্ণনা করেছেন এই কবিতায়। দুঃখিত হয়েছেন সাহিত্যের সমালোচকরা, হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন সতীর্থ সহযাত্রীরা। শুধু তরুণতমরাই জয়ধ্বনি দিতে-দিতে প্রদক্ষিণ করেছেন সারা শহর। কবির এই দূর-বাণী আমরা মিলতে দেখলাম পরবর্তীকালে। তাঁর চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় হাহাকার দেখেছি তরুণদের মধ্যেই। অনেক সমালোচক বলে থাকেন শহীদ কাদরী বিদেশবিভুঁইয়ে খুব আরাম-আয়েশেই থাকছেন, তাকেই ভেবে নিয়েছেন আপন দেশ। কিন্তু তিনি কেন বিদেশে গেছেন আর পড়ে আছেন সেখানে। মনের ভেতরে কীভাবে গুমরে মরেছেন দেশের জন্য তা ফুটে উঠেছে অনেক কবিতায়। বিশেষ করে আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও গ্রন্থের কোথায় প্রবেশাধিকার, তাই দীর্ঘ পরবাস, একা, মধ্যবয়স, কোন নির্বসনই কাম্য নয়সহ আরো কিছু কবিতায়।

শহীদ কাদরীর প্রথম গ্রন্থ (উত্তরাধিকার) পাঠ করে কোনো কোনো আলোচক বলবেন, কবির ঝোঁক শক্তিশালী উচ্চারণের দিকে, কংক্রিট উজ্জ্বলতার দিকে, আবার কেউ বলবেন মিতব্যয়ী শব্দ প্রয়োগের দিকে। বুদ্ধদেব বসু কবিদের মধ্যে দুটো জাত আবিষ্কার করেছেন। তিনি প্রথম জাতকে বলেছেন, এঁরা ঝোঁকের মাথায় লেখেন; আর দ্বিতীয় জাতকে বলেছেন এঁরা ভেবেচিমেত্ম লেখেন। প্রথম জাতের কবিদের আবেগই প্রধান উৎস, আর দ্বিতীয় জাতের কবিরা হলেন বুদ্ধিনির্ভর। উত্তরাধিকার পড়ে যে কেউ কাদরীকে দ্বিতীয় জাতের কবি বলবেন। তবে পরের কবিতাগুলো পড়ে মনে হবে তিনি দুই জাতেরই কবি। বুদ্ধদেব বসুর কবি-জাতের দুই সত্তা এখানে মিলেমিশে একাকার। আর তা কাদরীর নিজকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বলও।

শহীদ কাদরী প্রথাগত ছন্দ-নির্ভর কবিতা বেশি লিখেননি। এখানেও তাঁর একটা নিজকীতা কাজ করেছে। কারণ তাঁর কবিতার যে-মেজাজ, বলার যে-ভঙ্গি, শব্দ প্রয়োগের মিলমিশ, দেখার দৃষ্টি সবকিছু একটা ছন্দের ছকে নিয়ে আসার চেষ্টা কবি ইচ্ছা করেই করেননি। তবে মাত্রাবৃত্তে, স্বরবৃত্তে আর অক্ষরবৃত্তের সরল পথেও কিছু কবিতা লিখেছেন। যেমন – উত্তরাধিকারে  প্রেমিকের গান, প্রিয়তমাসু, শত্রম্নর সাথে একা, কবি কিশোর প্রভৃতি। তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমায় চুরি, জতুগৃহ, বৈষ্ণব, গোধূলি, হে হিরণ্ময়, সেলুনে যাওয়ার আগে প্রভৃতি। কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই গ্রন্থে শীতের বাতাস, মৃত্যুর প্রাঞ্জল শিল্প, উত্থান প্রভৃতি। আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও গ্রন্থেও কিছু কবিতা আছে ছন্দোবদ্ধ। যেমন – পথে হলো দেরি, যাত্রা। যদিও শহীদ কাদরীর ছন্দ শৈলী নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন মোহাম্মদ মাহ্ফুজউলস্নাহ। তিনি সমালোচনা করেছেন তাঁর পর্ববিন্যাস ও যতি স্থাপনের রীতি নিয়ে। তিনি বলেছেন, কাদরীর কবিতা অনেক সময় ক্লামিত্মকর।১০ মাহফুজউলস্নার কথা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিক হলেও, তা হয়েছে কাদরী প্রথাগত রীতির বাইরে যাওয়ার কারণেই। সে সময় মাত্রাবৃত্তের একটা স্রোত চলছিল। কিন্তু  আমাদের আলোচ্য কবির চিমত্মার স্রোত মাত্রাবৃত্তের ঝংকারের সঙ্গে যেন মিলল না। তাঁর ঝংকার অন্য কোথাও গিয়ে পৌঁছালো। জাগরণ এলো তারুণ্যের।

স্বাধীন এক নটরাজের মতো বেড়ে উঠেছে শহীদ কাদরীর কবিসত্তা। তাই তো কোনো আদর্শবাদ কবির ওপর অভিভাবকত্ব করতে পারেনি। কোনো মতবাদিক বিবরে না ঢোকার জিহাদ অনেকভাবেই ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়; ফুটে উঠেছে নৈরাষ্ট্রিক উচ্চারণে। তিনি অল্প বলেই বুঝিয়েছেন অনেক কিছু। কবি বলেছেন ‘এক’ কিন্তু তার চারধারের ‘দুই তিন, অযুত নিযুত’ যা আছে তা না বলেও বুঝবার সুযোগ দিয়েছেন পাঠককে। যেমন – আমি কিছুই কিনব না (উত্তরাধিকার) নামক কবিতাটি এর উজ্জ্বল উদাহরণ হতে পারে। তিনি শহরের সর্বত্র বিরাজ করছেন আর কোলাহলের মধ্যেও সবকিছু দেখছেন নিখুঁতভাবে। কিন্তু তাদের মধ্যে নিজে জড়িয়ে পড়ছেন না। এভাবেই কবি নিজেই একাকী দর্শক হয়ে সময়ের গতিধারাকে উপলব্ধি করেছেন। শহীদ কাদরীর কবিতাকে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন – একজন নিঃসঙ্গ পথিকের একাকী অবস্থার স্মারকলিপি। এ ক্ষেত্রে পাবলো নেরুদার এক আত্মস্মৃতির কথা বলা যেতে পারে। তিনিও বলেছেন নিঃসঙ্গতাকে ভালোবাসার কথা। নির্জন বাস নেরুদাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কথায় – ‘নিঃসঙ্গতাকে ভালবেসেও জনতার মাঝে স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ এ যুগের কবির জন্য অপরিহার্য। নির্জন-বাস আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। দেখেছি চিলির উপকূলে বারে বারে আঘাত হানা ঢেউয়ের লড়াই। তীরের সাথে ঊর্মির সংগ্রাম, জলের আঘাতে ক্ষয়ে যাওয়া খাড়া পাহাড়, সামুদ্রিক জীবনের বৈচিত্র্য, যাযাবর পাখীদের নিখুঁত সারি, লোনা জলের ঝকমকানি – এ সব দৃশ্যই আমাকে মুগ্ধ করে।

কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা দিয়েছে জীবন-জোয়ারের ঊর্মিল তরঙ্গ, আমার দিকে এক সাথে চেয়ে থাকা হাজার হাজার চোখে যে আবেগ ঝরে পড়ে তা-ই। সম্ভবত সব কবিই এটা অনুভব করে না। কিন্তু যারা অনুভব করে তারা চিরকাল একে হৃদয়ের গভীরে লালন করে, তাদের রচনায় স্থান দেয়।’১১ আমাদের কবিও নিঃসঙ্গতাকে ভালোবেসে জনতার মাঝে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করেছেন। তিনি মুগ্ধ হয়েছেন শহুরে-সংগ্রামের কোলাহল দেখে। তাই তিনি এই কোলাহলকে পরিণত করতে পেরেছেন শৈল্পিক কলকাকলিতে। বিরাট বিরাট শহরে বহু মানুষ থাকে একত্রে। কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। নগর জীবন পরিণত হয় একাকী মানুষের ভিড়ে। অভাব দেখা যায় মানুষের জন্যে মানুষের সহানুভুতির। মানুষ হয়ে উঠে নিঃসঙ্গ একাকী; ভোগে বিশেষ শূন্যতাবোধে। এই শূন্যতাবোধেরই পূর্ণময় কবি কাদরী। তাছাড়া আধুনিক কবিকুলের মূল সম্বল এক বিশেষ প্রকৃতির অমত্মর্দৃষ্টি। যে দৃষ্টি তাকে তার দেখা বস্ত্ত দ্বারা শাসিত হতে দেয় না। বরং সেই দৃষ্টি ওই বস্ত্তকেই শাসন করে আর তার অমত্মরসত্যকে আবিষ্কার করে। ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর সমাজজীবনে শিল্প-হুল ফুটাতে হলে ওই দৃষ্টি একামত্ম আবশ্যক। কাজেই একজন কবি প্রাত্যহিক জটিল জীবনের অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করে এবং তার জারিত রসে কাব্য-ক্যানভাসে যে কাব্য-প্রতিমা নির্মাণ করেন, তা-ই বোধহয় বুদ্ধিপ্রধান কবিতা। আর বুদ্ধিপ্রধান কবিতা প্রকাশের মূল মাধ্যম হলো প্রতীক। যাপিত জীবনে আমাদের যে নানাবিধ চৈতন্যের সমন্বয়, তাকে কবিতায় প্রকাশ করতে গেলে প্রতীকের আশ্রয় নিতেই হবে। সেটি অবশ্যই কর্মের মধ্যে, যন্ত্রণার মধ্যে, স্খলনের মধ্যে; এক কথায় নিত্য কাজের মধ্যে মানুষকে আবিষ্কারের জন্য। শুধু প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, তা আবিষ্কারের জন্য নয়। মোটকথা অভিজ্ঞতা-সঞ্চয় সমৃদ্ধ কবিতা হচ্ছে আধুনিক কবিতার মূল ঐশ্বর্য। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় যা বলেছেন এভাবে – অভিজ্ঞতাকে যদি আমরা যথার্থ প্রকাশ করতে পারি, যদি অভিজ্ঞতা একটা বিশেষ প্রতীকী বিন্যাসের মাধ্যমে সকল জ্ঞানের সম্মুখে উদ্ভাসিত হতে পারে তা হলে তার মধ্যে লোকায়ত এবং লোকোত্তরের সাযুজ্য ঘটবে এবং বহিঃপ্রকৃতি ও অমত্মরাত্মারও একটি আশ্চর্য মিলন ঘটবে।… অভিজ্ঞতা যখন প্রতীকীরূপে উদ্ভাসিত হচ্ছে তখন সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে আমরা বহিঃপ্রকৃতি এবং অমত্মরাত্মার মিলন দেখতে পাবো এবং লোকায়ত ও লোকোত্তরের সাযুজ্য দেখতে পাবো।১২

ওপরের কথাগুলো বললাম শহীদ কাদরীর প্রতীকের ব্যবহার দেখে। যতই তাঁকে নাগরিক কবি বলা হোক না কেন, তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিশেষভাবে প্রতীকাশ্রয়ী কাব্য-ভাষার জন্য। তার দেখবার দৃষ্টি, তাকে রোমন্থন করবার শক্তি এবং কাব্যে প্রয়োগ করবার শৈল্পিক সাহসে কাদরী অনন্য। এ-বিষয়ে কিছু উদ্ধৃতি না দিলে ঘাটতি থাকবে আমার প্রদত্ত শিরোনামের ক্ষেত্রে।

উত্তরাধিকার :

০১. টুপি থেকে; অগ্রজের তীক্ষন ভৎর্সনায় বজ্র যেন

জানালায় যমদূতের মতন ত্রাস নেচে নেচে

কেবলই দেখিয়ে যায়, গহবর, কবর আর মস্নান

পা-ুর রোগের রাত স্বপ্নহীন শীতার্ত শয্যায়;

(‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’)

পরম পাৎলুন আর চকচকে চালাকির মত সব চোখামুখো জুতো,

পরিত্যক্ত একা ট্রেন রৌদ্রঝড়ে, বুড়ো মুখ পোড়া জানালায়

প্রাচীন আর্শির মত পারা-ওঠা, সবকিছু আতঙ্ক রটায়।

(‘পতন’)

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা :

ধ্বংসসত্মূপের পাশে, ভোরের আলোয়

একটা বিকলাঙ্গ ভায়োলিনের মতো – দেখলাম তে-রাসত্মার মোড়ে

সমস্ত বাংলাদেশ পড়ে আছে…

(‘নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে’)

বস্ন্যাক আউট অমান্য করে তুমি দিগমেত্ম জ্বেলে দিলে

বিদ্রোহী পূর্ণিমা।…..

(‘বস্ন্যাক আউটের পূর্ণিমায়’)

কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই :

লাল পাগড়ি-পরা পুলিশের মত কৃষ্ণচূড়া

হেঁকে বলল

‘তুমি বন্দী’

(‘আজ সারাদিন’)

হে আমার মোরগের চোখের মতন খুব ছেলেবেলা!

(‘যাই, যাই’)

আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও :

দু টুকরো রুটি কিংবা লাল শানকি ভরা

এবং নক্ষত্রকুচির মতন কিছু লবণের কণা

দিগমেত্মর শামত্ম দাওয়ায় আমাকে চাও নি তুমি দিতে –

তাই এই দীর্ঘ পরবাস।

(‘তাই এই দীর্ঘ পরবাস’)

কিন্তু বৈশাখের খররৌদ্রে সোনালি খড়বাহী গরুর গাড়ির মতো

মন্থরভাবে এগিয়ে চলেছে এই কবিতা…..

(‘একে বলতে পারো একুশের কবিতা’)

ওপরের উদ্ধৃতির সংখ্যা বাড়াতে থাকলে আর তা বিশেস্নষণ করতে গেলে, সেটি দিয়েই একটি গ্রন্থ রচনা হয়ে যাবে। কারণ এমনটিই ছড়িয়ে আছে তাঁর প্রায় প্রতিটি কবিতার শরীরজুড়ে। এমন খরদীপ্র প্রতীকাশ্রিত উপমা বাংলা সাহিত্যে বিরল। শিক্ষিত নাগরিকের দৃষ্টিসম্পন্ন কবি তিনি। তাঁর দৃষ্টির ভাষাই হলো কাব্যভাষা। যে-কবিদৃষ্টি বিপরীতের মধ্যে বিনিময়ের একটা সেতু তৈরি করে দেয়। এ-প্রসঙ্গে আমরা আবদুল মান্নান সৈয়দের কথায় কথা মিলাতে পারি – কাদরীর আত্মদৃষ্টিপ্রসাদী কাব্যভাষার বিশিষ্টতা সন্ধান করা যেতে পারে তাঁর বিশিষ্ট কাব্যকুশলতার ভিতরে। এই কুশলতা ভর রেখে আছে তাঁর মুদ্রাঙ্কিত উপমা, প্রতিমা ও প্রতিতুলনার ওপর। কাদরীর আত্মভাষা বিশেষভাবে জাগ্রত হয়েছে তাঁর প্রতিতুলনা, প্রতিষঙ্গ ও প্রতিসাম্যের উপর; তাঁর উপমা ও প্রতিমা দুই-ই দাঁড়িয়ে আছে প্রতিতুলনার দক্ষতায়, দুই মেরুর একত্রনিবেশে, দুই স্তনের সন্দীপক যৌথ ভূমিকায়।১৩ আবদুল মান্নান সৈয়দের এমন উক্তির পরে কাদরীর বিশিষ্টতা নিয়ে আর নতুন করে বলবার আবশ্যকতা আর বিশেষ থাকে না। তার পরেও শহীদ কাদরী আমাদেরকে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। এর অন্যতম কারণ, তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে নবায়ন করে গেছেন তাঁর কাব্য-জমিনে। তিনি নবায়ন করেছেন একটি গ্রন্থ থেকে পরের গ্রন্থে। এমনকি নবায়ন করেছেন এক কবিতা থেকে পরের কবিতায়। তাই হয়তো তাঁকে বেশি লিখবার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু তাঁর লেখার সংখ্যা সামান্য হলেও ব্যঙ্গময় জীবনদর্শন অসামান্য তবে সম্পূর্ণ; দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট তবে নিঃসংশয়; প্রকাশ অনবদ্য তবে মেদহীন। এক কথায় শহীদ কাদরী এক নিজকীয় ও নবতর বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যের শরীরে লেপে দিয়েছেন। আর সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন আমাদের কাব্যভা-ারের। সৃষ্টি করেছেন এক নতুন দিগমেত্মর।

 

তথ্যসূত্র

মফিদুল হক, শহীদ কাদরীর কবিতা : প্রকাশকের নিবেদন; সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯২।

আবদুল মান্নান সৈয়দ, করতলে মহাদেশ : শহীদ কাদরী; শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৩।

সাক্ষাৎকার : শুরু যেভাবে করলাম, সেভাবে তো শেষ করতে পারলাম না, প্রথম আলো, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬।

প্রথম আলো : ২৯ আগস্ট ২০১৬।

সৈয়দ আলী আহসান, আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে : শহীদ কাদরী; গতিধারা, ঢাকা, ২০০১।

আবু সয়ীদ আইয়ুব, ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক : সাহিত্যের চরম ও উপকরণ মূল্য; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ।

উচ্চারণ : ২৩ সংখ্যক মমত্মব্য, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ১৯৬৮।

মোহিতলাল মজুমদার, সাহিত্য-বিচার : কবি ও কাব্য, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৬।

বুদ্ধদেব বসু, কালের পুতুল : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : অর্কেস্ট্রা

মোহাম্মদ মাহ্ফুজউলস্নাহ, পঁচিশ বছরের কবিতা : ‘উত্তরাধিকার’, শহীদ দিবস সংখ্যা, ১৯৭৪।

পাবলো নেরুদা, আত্মস্মৃতি ও কয়েকটি কবিতা : কবিতা ও রাজনীতি, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭৬।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ, নাভানা, কলকাতা, ১৯৬২।

আবদুল মান্নান সৈয়দ, পূর্বোক্ত