শাহাবুদ্দিনের অগ্নিতৃষ্ণা

‘এ  দেশ কি ভুলে গেছে দুঃস্বপ্নের রাত…’ – রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ পাই’ কবিতাটি শাহাবুদ্দিনের বধ্যভূমি’ ছবিটির সামনে দাঁড়ালেই মনে পড়ে। এ-প্রদর্শনীর সবকটি ছবির সামনে দাঁড়ালে একেকটি কবিতার কথা মনে পড়বে। এবারের প্রদর্শনীর কাজে সেই চিরচেনা শাহাবুদ্দিনকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায়। তেলরং মাধ্যমে শাহাবুদ্দিনের দক্ষতা ও শক্তি সত্তরের দশকের শুরুতেই প্রতিভাত হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করার পর তাঁর ক্যানভাসে ফিরে এসেছে মানব-জয়ের আখ্যান।

শাহাবুদ্দিনের শক্তিশালী বাস্তববাদী চিত্রকলার অনিঃশেষ শক্তি দর্শকদের মাতিয়ে রাখে গত শতকের সত্তরের দশক থেকেই। বাস্তবতা যুক্ত করে তিনি ইউরোপীয় ধারা অনুসরণ করেছেন, ফলে চিত্ররচনার আধুনিকতা ও পাশ্চাত্য ঢংয়ের রচনাশৈলী থেকে শাহাবুদ্দিন বিচ্যুত হননি।

মানবশরীরের শক্তিমত্তা আর অফুরন্ত গতির দ্যুতি তিনি ছড়িয়ে দেন ছবিতে। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁর ছবিতে প্রত্যক্ষ করে তোলেন মানবশরীরের গতিময়তা দিয়ে। শাহাবুদ্দিন মানবশরীর রচনা করেন একটি যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাঙালির যুদ্ধজয়ের উল্লাসধ্বনির শব্দ থেকে। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে যে-বিজয় অর্জন করেছেন, সে-অগ্নিচেতনা তাঁর সৃষ্ট ফিগারগুলোতে দেখা যায়।

তুলির ক্ষিপ্র চালনা, চিত্রতলের ব্যবস্থাপনা, বিন্যাস, পটভূমি থেকে শূন্যে তুলে দিয়ে তিনি মানুষকে ভাসমান গতিতে ভাসিয়ে নেন। শাহাবুদ্দিনের চিত্রকলায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনিঃশেষ শক্তি যেমন প্রতিভাত হয়ে উঠেছে, তেমনি উজ্জ্বল দীপ্ত মশাল-হাতে মানুষের এগিয়ে চলাকেও মূর্ত করে তুলেছে।

এ-প্রদর্শনীর কাজগুলোতে আগের কাজের পুনঃবর্ণনা রয়েছে বলে মনে হলেও এখানে কিছু কাজে নতুন করে ক্যানভাসকে সাজানো হয়েছে। কয়েকটি পর্বে কাজগুলো সাজানো – জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি প্রতিকৃতিতে দেখা যায় চিন্তামগ্ন বঙ্গবন্ধুকে। এ-ছবিতে ক্যানভাসের ওপরের দিকে বঙ্গবন্ধু মুষ্টিবদ্ধ হাতে মাথা নুয়ে চিন্তা করছেন।

ক্যানভাসের বেশিরভাগ জমিন শূন্য রেখে দিয়ে বাঙালি জাতির শূন্যতাকে প্রকাশ করেছেন তিনি। ‘স্বাধীনতা’ শিরোনামের আরেকটি ছবিতে ক্যানভাসকে ভাগ করেছেন কৌণিকভাবে – ক্যানভাসের ওপরের দিক লাল-সবুজ পতাকায় ঢাকা। দুজন যোদ্ধা সেই পতাকার দিকে ছুটে যাচ্ছে।

লাল-সবুজ পতাকার দিকে ছুটে চলা স্বাধীনতাকামী মানুষকে নতুন করে দর্শক দেখতে পান ছবিটিতে।

শাহাবুদ্দিনের আঁকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর ছবিতে এক শোকাবহ পরিবেশ দেখা যায়। সেই চেনা সাদাকালো রঙের পোশাকের দ্যুতি ছড়িয়ে আছে পুরো ক্যানভাসে। শিল্পী শাহাবুদ্দিন বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে যান। ক্যানভাসটির রং আর রেখায় ছড়িয়ে যাওয়া দ্যুতি আমাদের শোকগ্রস্ত করে।

শিল্পীর প্রিয় একটি চরিত্র ‘নায়িকা’।  এ-শিরোনামে একটি উল্লম্ব ক্যানভাস প্রদর্শনীতিতে রেখেছেন তিনি। স্নানরত রমণীর বাস্তবধর্মী দেহভঙ্গি প্রকাশ করেছেন রেখার দ্রুত প্রয়োগে।

শাহাবুদ্দিনের আঁকা ছবিতে আমরা তিন ধরনের মানবশরীর দেখতে পাই। প্রথমত, স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব যেমন – রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, গান্ধী, মাদার তেরেসা থেকে শুরু করে সদ্যবিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান বারাক ওবামার ছবি।

দ্বিতীয়ত, যুদ্ধরত, ছুটেচলা, মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষের অবয়ব। তৃতীয়ত, নারীদেহের নানা ভঙ্গি; নৃত্যরত নারী, স্নানরত নারীসহ নানা ভঙ্গিমায় নারীর অবয়ব।

ক্যানভাসের ব্যবস্থাপনায় শাহাবুদ্দিন পরিণত। এ-প্রদর্শনীর কাজগুলোর চিত্রতল ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ স্থান বা পরিসরে বিষয়ের উপস্থাপনাকে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন শিল্পী। একটি ছবির রচনাশৈলী দর্শকদের যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি ছবির জমিনে বিভাজন বা বিষয় উপস্থাপনায় শিল্পীর দক্ষতাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শাহাবুদ্দিন আহমেদের শিল্পকলাকে আমরা বলতে পারি বাস্তবতার সঙ্গে রেখা ও ফর্মের বিন্যাস সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপিত হয়ে ওঠা শিল্প। এর জন্য তাঁর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়াকেও আমরা উল্লেখ করতে পারি। মানবশরীরে সৃষ্ট প্রচণ্ড গতিময়তা কোথাও কোথাও অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য করার পাশাপাশি কোথাও ক্যানভাসের তলের সঙ্গে মিলিয়ে দেন। এখানেই শিল্পী বিশেষ হয়ে ওঠেন।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় যে-শাহাবুদ্দিন রংতুলি ছেড়ে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন – সে-শাহাবুদ্দিন সব সময় মুক্তি-সংগ্রাম প্রসঙ্গে বলেন – বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, বাঙালি – এগুলো সব সময় আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই তো সব সময় তুলির প্রবল ক্ষিপ্রতা তাঁর ক্যানভাসে হাজির হয়। তাঁর ফিগারের ক্ষিপ্রতা এতই গতি সঞ্চার করে, যেটি দর্শকের দিকে ক্রমশ ছুটে আসতে চায়।

বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় ৭ মার্চ শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হবে ১৭ এপ্রিল।