শুদ্ধাচারী মাজহারুল ইসলামকে সালাম

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ঢাকাকে স্থাপত্যের দিক থেকে আধুনিক করেছেন মাজহারুল ইসলাম। পাকিস্তান আমলের কিংবা কোম্পানি আমলের ভারি, ওজনদার আলঙ্কারিক স্থাপত্যের জায়গায় তিনি রোদ ও হাওয়ার ভেতর গড়েছেন তাঁর কাজ। তাঁর বিভিন্ন নির্মাণ : গৃহ হোক, ইনস্টিটিউট হোক এবং বহুব্যাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় হোক, সব ফেলে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন রোদ ও হাওয়ার মধ্যে তাঁর বিভিন্ন নির্মাণ। এসব নির্মাণ সবকিছুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে। ভূপ্রকৃতির নিয়ম মেনে নির্মাণ তৈরি হলেও মানুষের জীবনযাত্রা মহাবিশ্বের নিয়মের অধীন হয়। এই নিয়ম মানা দরকার, এই নিয়মকে তিনি তাঁর কর্মের প্রথম শর্ত বলে ভেবেছেন। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, যাঁরা এই নির্মাণ ব্যবহার করবেন তাঁদের চোখের সঙ্গে পাখপাখালি এবং গাছপালার সম্পর্ক তৈরি করা। তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, এই সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে ইট-পাথর নিজের বৈশিষ্ট্য ফিরে পায়। চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, এই ফিরে পাওয়ার মধ্যে দিয়ে মানুষের সঙ্গে ভূপ্রকৃতির, ভূপ্রকৃতির সঙ্গে গাছগাছালি ও পক্ষীকুলের মমতার বোধ তৈরি হয়। মমতা বাদে নির্মাণ হয় না।
চারুকলার সিঁড়ির কথা ভাবুন। কিংবা ভাবুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়ানো ক্যাম্পাস। কিংবা ভাবুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপার বিস্তৃতি। চারুকলার সিঁড়িটি আস্তে আস্তে হালকা এক পাখির মতো আকাশে উড়ে গেছে। বাঁয়ে দাঁড়িয়ে গাছগাছালির বয়সী উচ্চতা দেখা যায়। দেখা যায়, ছেলেমেয়েদের রঙিন চলাফেরা। সিঁড়িটা ভবনটাকে আকাশের মহিমা দিয়েছে, ভবনের বাইরে সিঁড়ি, মনে হয় ভবনের ভেতর থেকেই উঠেছে, যেন গাছপালা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস লালমাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে ছড়ানো বিভিন্ন ভবন। বিভিন্ন ভবন বিভিন্ন ঝিলের মধ্যে নম্রভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আর ছেলেমেয়েরা পাখিদের সঙ্গে উড়ে-উড়ে চলেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছোট-ছোট টিলার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। হাত বাড়ালেই টিলা, হাঁটতে চাইলেই উঁচু-নিচু রাস্তা, একেকটা রাস্তা বিভিন্ন ভবন ঘিরে টিলাগুলো পাহারা দেয়।
প্রকৃতির সঙ্গে, নিসর্গের সঙ্গে এভাবে সম্পর্ক তেরি করে তিনি বিভিন্ন নির্মাণ করেছেন। অনেক সময় অনুযোগ তোলা হয় : তিনি বিভিন্ন ক্যাম্পাসে জমির অপচয় করেছেন। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট : ক্যাম্পাস তো বস্তি নয়, ক্যাম্পাস তো গলির পর গলি নয়, ক্যাম্পাস হচ্ছে স্বস্তি ও স্বাধীনতা। তিনি এটাকে বিশ্বাস করতেন। তিনি টাওয়ারের দিকে যাননি। তিনি মানুষকে, শিক্ষার্থীকে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছেন। তিনি স্থাপত্য ক্ষেত্রে টাওয়ারের দিকে যাননি। তিনি গেছেন রেখার ঋদ্ধতা ও সরলতার দিকে। স্থাপত্যের আধুনিক জ্ঞানের এই দৃঢ় ট্র্যাডিশন নেহাত মতাদর্শিক বিরোধ নয়, বরং মানুষের বেঁচে থাকার টেকনিক ও জীবনযাপনের আচরণমালার সিস্টেম। এখানেই স্থাপত্যের আধুনিকতার ইতিহাস। মাজহারুল ইসলাম শুদ্ধতার দিকে গেছেন, রেখার শুদ্ধতার দিকে, যেখানে নিহিত হৃদয়ের শুদ্ধতার উৎস প্রবল এবং সিস্টেম্যাটিক ট্রেনিং। রেখার শুদ্ধতার মধ্যে আছে আধুনিক স্থাপত্যের গ্লেস। তিনি যেন বলেন, আমি আমার আত্মীয়স্বজন, আমার দেশ, আমার দেশের ঐতিহ্য, সম্মান আমার নির্মাণের মধ্যে পেতে চাই। তাহলেই হৃদয় শুদ্ধ হবে। সেজন্যে স্থাপত্য কাজ একধরনের তীর্থযাত্রা, বিনয়ের এক ট্রেনিং, মহাপৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ করার শর্ত। বিনয় ছাড়া রেখার শুদ্ধতা হয় না, রেখার শুদ্ধতা ছাড়া হৃদয়ের শুদ্ধতা মানুষজনকে উপঢৌকন দেওয়া যায় না। এই শুদ্ধাচারীকে সালাম।