শূন্যতা ও মিঠু

সাঈদ খোন্দকার

 

এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলায় বাংলাদেশের হেরে যাওয়ার রেশটা তখনো কাটেনি। বাইরের কাজ সেরে বাসায় ফিরলাম। সময় বিকেল সোয়া ৩টা। বন্ধু জাহাঙ্গীরের ফোন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে – ‘মিঠু অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, গণস্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে আয়।’ ছুটলাম গণস্বাস্থ্যের দিকে। শ্যামলী থেকে ধানম– ৬ – মনে হচ্ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে আমাকে। গাড়িটা ছিল জেমীর (আমার স্ত্রী) কাছে। ইতিমধ্যে গুলশান থেকে সেও রওনা দিয়েছে।

ইমার্জেন্সিতে মিঠু নেই। রাস্তা পার হয়ে ছুটলাম মিঠুর ধানম–র ৪নং সড়কের বাসায়। সঙ্গে চৌধুরীভাই। আলাপ প্রসঙ্গে রিকশাওয়ালা বলল, ‘স্যার, কিছুক্ষণ আগে ৪ নম্বর রোডে একটা লোক গাছচাপা পড়ছে। শুনছি খারাপ অবস্থা।’ যাওয়ার পথে গাছটাকে দেখে নিলাম। বিশাল বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ, উপড়ে পড়ে আছে। রিকশাওয়ালা দেখাল, ‘ওই মোটা ডালটাই ওই লোকের মাথায় পড়ছে।’ এরই মধ্যে ছয়-সাতজন লোক করাত দিয়ে গাছটা কাটতে শুরু করেছে। গাছটাকে ঘিরে মিডিয়ার লোকজন।

মিঠুর ৩৭/১-এর বাসাটা লোকে-লোকে ভরে গেছে। কান্না আর মানুষের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে মিঠু বেঁচে নেই। কনক (শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা, মিঠুর সহধর্মিণী)। এদেশের নারী চিত্রশিল্পীদের অন্যতম। কনক তখন গুলশানের একটি আর্ট ক্যাম্পে ক্লাস নিচ্ছিল। সেও চলে এলো। কান্নায় বাড়িটি আরো ভারী হতে লাগল।

মিঠুকে গোসলের জন্য নেওয়া হয়েছে ৩২ নম্বর ব্রিজ সংলগ্ন তাকওয়া মসজিদে। মিঠুর অবস্থান তাকওয়া মসজিদের লাশঘরে। আমার ছোট ছেলে তমাল আর বন্ধু জাহিদের ছেলে মিঠুকে গোসল করানোয় সহযোগিতা করছে। বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট পর্যমত্ম চেষ্টা করেও রক্ত বন্ধ করা গেল না। কান আর নাক দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরছিল। শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। গোসল করানো লোকটা দেখাল আঘাতটা মাথার পেছন দিকে। ব্যান্ডেজই একমাত্র উপায়। অ্যাম্বুলেন্স করে মিঠুকে নিয়ে আসা হলো ধানম–র বাসায়। জানাজার আগে কনককে দেখানো হলো মিঠুর লাশ। নিথর মিঠুকে ছুঁয়ে কনকের শেষ কান্না। মিঠুর ছেলে আর্য, পড়াশোনা করতে কয়েক মাস আগে লন্ডন গেছে। শেষবার জানুয়ারিতে এসেছিল। এরই মধ্যে চ্যানেল আইয়ের সাগর ভাই ও শাইখ সিরাজ ভাই আর্যের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। আর্য ফিরবে আগামীকাল সন্ধ্যায়। জানাজাশেষে মিঠুর বর্তমান অবস্থান স্কয়ার হাসপাতালের ফ্রিজিং রুমের কোনো এক ফ্রিজে।

 

৮ মার্চ ২০১৬

সারাদিন মানুষের আনাগোনা আর মানুষের সমবেদনায় পুরো বাড়ির চেহারা পালটে গেছে। সন্ধ্যা ঘনাতেই আর্য চলে এলো। ওকে জড়িয়ে শিরোপার (মিঠুর মেয়ে) কান্না। কনকের মেঘলা আকাশের কালো মেঘ বর্ষণে রূপামত্মরিত হলো। অসুস্থ কনককে নেওয়া হলো স্কয়ার হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে।  ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়ানো হলো।

নিয়তির এ কেমন খেলা? কনক স্কয়ার হাসপাতালের যে-বেডে শোয়া, সেই বেডের ৪০-৫০ গজ নিচেই ফ্রিজিং রুম। একজন জীবিত অবস্থায় অক্সিজেন নিচ্ছে, অন্যজন হিমশীতল ফ্রিজে হিমায়িত হচ্ছে। হয়তো মিঠুর একাকিত্বই প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণীকে টেনে এনেছে হাসপাতালে।

 

৯ মার্চ ২০১৬

মিঠুর লাশ নিয়ে কনকসহ গেলাম শহীদ মিনারে। সেখানে

সাংস্কৃতিক জোট মিঠুর  জন্য শেষ শ্রদ্ধার আয়োজন করেছে। শহীদ মিনার থেকে চারুকলা (মিঠুর তীর্থস্থান), বিএফডিসি হয়ে চ্যানেল আইয়ে জানাজা। চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে উপস্থিত করা হয়েছে মিঠুর মা বিশিষ্ট লেখক বেগম মমতাজ হোসেনকে। একমাত্র সন্তান হারানোর বেদনায় তিনি নিথর। সামত্মবনা দিচ্ছেন বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন। মিঠুর বর্তমান অবস্থান বনানীর খালুর কবরের ওপর। মিঠু আর কনক মহাকাব্যের হয়তো এটিই শেষ অধ্যায়।

 

ফিরে দেখা

 

১৯৭৮ সাল

সবে ঢাকা চারুকলায় (তৎকালীন আর্ট কলেজ) ভর্তি হয়েছি। অনেক প্রতিযোগিতাশেষে ভর্তি হলাম পঞ্চাশজন। ক্লাসে লম্বা ছাত্র চারজন। (১) মুসলিম, (২) কামাল, (৩) খান মজলিস ও (৪) মিঠু। তাদের মধ্যে মিঠুর উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। গলায় ক্যামেরা, কাঁধে ব্যাগ, হাতে পেপার রোল মিলিয়ে মিঠুকে আলাদা করা যায়। ভালো

ব্যবহার, গণসংযোগ, হাসি-ফাজলামো আর সিরিয়াসনেস – এসব যেন তাঁর সহজাত স্বভাব।

কয়েকদিনের মধ্যে জেনে গেলাম প্রখ্যাত চলচ্চিত্র-নির্মাতা আলমগীর কবির মিঠুর মামা। আর মা সে-সময়ের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল সকাল সন্ধ্যার লেখক বেগম মমতাজ হোসেন। মিঠুর পুরো নাম খালিদ মাহমুদ মিঠু। আমরা যখন ২০ী ৩০র্ কার্টিজ পেপারে স্কেচ বা জলরঙে ছবি িআঁকি, মিঠু তখন বড় মাউন বোর্ড জোড়া লাগিয়ে বিশাল-বিশাল স্কেচ বা জলরঙে ছবি িআঁকে। শারীরিক উচ্চতা ও ছবির সাইজে সে যে আলাদা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ক্লাসশেষে চারুকলার লিচুতলার সবুজ ঘাসে আড্ডা। মধ্যমণি কখনো নবী স্যার, কখনো হক স্যার, কখনো আমিন স্যার, না-হয় শহিদ কবীর স্যার। শিশির ভট্টাচার্য (শিক্ষক ও কার্টুনিস্ট), ইউনুস ভাই (শিক্ষক), জামালভাই (শিক্ষক), অকিলভাই, মৃণাল হক,

নিসার ভাইকে (চারুকলার বর্তমান ডিন) নিয়ে চলত আড্ডা। আড্ডার মুহূর্তগুলো ধরে রাখা হতো একটি এসএলআর ক্যামেরায়। আর এর ফটোগ্রাফার মিঠু। দু-একদিন পর সাদা-কালো ছবিগুলো পৌঁছে যেত আমাদের হাতে।

এ-বছরই হঠাৎ করে মিঠু অসুস্থ হয়ে পড়ল। ব্রংকাইটিস রোগে আক্রামত্ম হলো। ভর্তি করা হলো মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। আমার খালুকে বলে কেবিনের ব্যবস্থা করলাম। মিঠুকে থাকতে হলো কয়েক সপ্তাহ। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, একটি মেয়ে প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসে এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা মিঠুর কাছে থাকে। বুঝতে বাকি রইল না এই মেয়েটিই কনক। আমাদের ক্লাসেই পড়ে কনক চাঁপা চাকমা। রাঙামাটি থেকে এসে সবে ভর্তি হয়েছে মেয়েটি। চটপটে, সুন্দরী, কাজের প্রতি সিরিয়াস – সব মিলিয়ে একশতে একশ। মিঠুকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘কিরে কিছু হয়েছে নাকি?’ মিঠু হেসে উত্তর দিলো, ‘দোসত্ম, কেন যেন ওর জন্য মনটাতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়।’

হায় শূন্যতা!

এ-শূন্যতাই মিঠুর জীবনের আরেক অধ্যায়। মিঠুর জন্ম ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি। বয়স যখন তিন-চার বছর, তখন বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। একা এই শিশুটাকে বলা হলো প্রবলেম চাইল্ড। মা বিয়ে করলেন পুলিশের বড় কর্মকর্তাকে। মিঠু হয়ে গেলে একা। চার বছরের মিঠুর আশ্রয় হলো খালাদের বাসায়। খালু রোমান্টিক মানুষ। সকালের নাস্তার টেবিলে গান আর পত্রিকা ছাড়া তার দিনই শুরু হতো না। খালা-খালুর স্নেহে কিছুটা শূন্যতা লাঘব হলো। মামা আলমগীর কবিরের কাছ থেকে ফটোগ্রাফি শেখা, চলচ্চিত্রের অনুভব – সবই মিঠুর ভিতর তৈরি করতে লাগল আবেগ আর ভালো লাগা। মিঠুর আরেক মামা প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শহিদ কবীরের রং-তুলি আর ক্যানভাস মিঠুকে আকৃষ্ট করত। পরবর্তীকালে এই ধারা নিয়েই চারুকলায় ভর্তি হয়।

চারুকলা থেকে পাশ করেই হঠাৎ বিয়ে করি জেমীকে। বাসার ঠিকানা শ্যামলীর হলি লেন। চাকরি করি ব্র্যাকে ডিজাইনার হিসেবে। উলটো দিকের বাসায় থাকতেন আলমগীর কবির আর মিঠু। প্রায়ই কনক এসে জেমীকে নিয়ে যেত সে-বাসায়। অতঃপর মিঠু ও কনকের বিয়ে ১৯৮৬ সালে। সাক্ষে আমি, জাহাঙ্গীর ও জাহিদ।

 

এবার নতুন সংসার

লেকসার্কাস (কলাবাগান) আটশো স্কয়ার ফিটের একটি বাসা। এক সঙ্গেই দুটি পরিবার। দুদিকে দুই বেডরুম, মাঝে লিভিংরুম। আমি চাকরি করি ইউনিসেফে আর মিঠু চাকরি নিল বিটিভিতে ক্যামেরাপারসন হিসেবে। সারাদিন কাজ, সন্ধ্যায় আড্ডা আর কার্ড খেলা। সময়টা ভালোই কাটছিল।

আমার কেনা সেকেন্ডহ্যান্ড সাদা-কালো ১৭ ইঞ্চি টিভি। এই টিভিতে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখার স্মৃতি আজো স্মরণীয় অধ্যায়। জীবনের প্রয়োজনে বড় বাসা নেওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমরা।

 

১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল

এরই মধ্যে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সঙ্গে মিঠুর সম্পৃক্ততা অনেক বেড়ে গেছে। মিঠুর মিউজিক ভিডিও হতে থাকে – ব্যান্ডসংগীত, না-হয় আধুনিক, না-হয় দেশাত্মবোধক গান – এরই মধ্যে সংখ্যায় তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মিঠু নির্মাণ করে ফেলল অসংখ্য নাটক।  মিঠু নিজেই এখন গল্পকার, নাট্যকার, ক্যামেরাপারসন – সবমিলিয়ে সে এখন পরিপক্ব পরিচালক আর এগুলোর শিল্পনির্দেশক কনক।

সময়ের সঙ্গে গড়িয়ে মিঠু আর কনকের ঝুলিতে এরই মধ্যে জমা হয়েছে অনেক জাতীয় ও আমত্মর্জাতিক পুরস্কার। আর সবই তো ছবি িআঁকা ও ফটোগ্রাফির জন্য। মিঠুর মনে আবারো সেই শূন্যতা। আলাপ প্রসঙ্গে মিঠু বলেই ফেলল, ‘দোসত্ম, চলচ্চিত্র বানাতে হবে, ৩৩ মিলিমিটার, যা হবে দেশের জন্য, জাতির জন্য, আমত্মর্জাতিক অঙ্গনের জন্য, সর্বোপরি অস্কারের জন্য।’

 

২০১০ সাল

সিদ্ধামত্ম আর কাজ দুইয়ের সমন্বয়ে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে তৈরি করা হলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি গহীনের শব্দ (যে-ছবি জাতীয় ও আমত্মর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়)। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা পিতার জীবনের কষ্ট, মেয়ের হারানো প্রেম – সবমিলিয়ে সমাজের অসংগতির এক চিত্র। মিঠুর ভাষায়, ‘দুঃখের ছবি পুরস্কার পায়, আর সুখের ছবি জনগণ চায়।’

 

২০১৪ সাল

তৈরি করা হলো অন্যরকম একটি ঝকঝকে আনন্দের চলচ্চিত্র জোনাকীর আলো। এ-ছবি প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, ‘জোনাকি নিজেই নিজের আলোতে জ্বলে, অন্ধকারকে সে আলোকিত করে।’ মিঠুর মতে, প্রতিটি মানুষকে হতে হবে জোনাকির মতো। তাহলে দেশ-জাতি আলোকিত হবে। মানুষ হবে সোনার মানুষ। এটিও জাতীয় ও আমত্মর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হলো।

 

২০১৬ সাল

ফেব্রম্নয়ারির শুরুতেই মিঠুর নতুন ভাবনা, তৈরি করব অন্যরকম একটি ছবি। জলের মানুষদের নিয়ে। ছবির নাম গাঙের মানুষ। তৈরি করা হলো গল্প, শেষ হলো নাট্যরূপ, শেষ হলো না চলচ্চিত্রে হাত দেওয়া।

 

শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই নয়, চিত্রকলার প্রতিও নিবেদিতপ্রাণ ছিল মিঠু। ২০০৭ সালে বেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত হয় তার একক চিত্র-প্রদর্শনী। সে-প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ব্রোশিওরে

শিল্প-সমালোচক  মইনুদ্দীন খালেদ উলেস্নখ করেন :

বস্ত্তর রূপ স্থির নয়। আলোর প্রক্ষেপণে তা নিত্যপরিবর্তনশীল। সুনির্দিষ্ট আকার নয়, আকারের রূপামত্মর প্রক্রিয়া প্রদর্শনই খালিদ মাহমুদ মিঠুর

চিত্র-রচনার অন্যতম খেয়াল। ধ্বনিময়, বর্ণময় ও আলোকময় পৃথিবী অনুভবের ইতিবৃত্তটা তিনি অবয়ব-নিরপেক্ষ শিল্পভাষায় অনূদিত করতে চান। বস্ত্তর অতিচেনা রূপ তাঁর ছবির জমিনে তেমন চোখে পড়ে না। কখনো তিনি পরিচিত রূপ আংশিকভাবে িআঁকেন। কখনো-বা কোনো জ্যামিতিক গড়ন অনির্ণেয় বোধকে স্পষ্ট সংকেতে প্রকাশ করতে চায়। তবে চেনা ও অচেনা অনুষঙ্গ মিলেমিশে মিঠুর ছবিতে এক অখ-তার আবেশ তৈরি হয়। বর্ণের বিবিধ গতি-প্রকৃতি ও টেক্সচার-জালে জড়িয়ে চেনা অবয়ব আর বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না; ছবির বর্ণতলে তা দ্রবীভূত হয়ে যায়।…

পেইন্টিং, ফটোগ্রাফি, চলচ্চিত্র – এই তিন মাধ্যমে মিঠু সমামত্মরালভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর জীবন ডিজিটাল মিডিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রে সম্পর্কিত। একজন শিল্পী যখন অনেক মাধ্যমে কাজ করেন, তখন এক মাধ্যমের অভিজ্ঞতার সূত্র অন্য মাধ্যমে যুক্ত হয়ে যায়। মিঠুর কাজে যে আমরা বর্ণিল ধ্বনিময়তা অনূদিত হতে দেখি তার একটা বড় কারণ ডিজিটাল মিডিয়ার ক্যামেরা হাতে শিল্পীর অনুষ্ঠান ধারণ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। মিঠু অনেক কিছুই সাদা চোখে দেখেন না। তিনি লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখেন। লেন্সের ভেতর দিয়ে ইমেজকে নানাভাবে বদলে দেখা যায়। মানুষের চোখ আর ক্যামেরার লেন্স একইভাবে বস্ত্তকে পর্যবেক্ষণ করে না। পেইন্টিং ও ফিল্মের নন্দনতত্ত্ব পরস্পরিত হয়ে আছে তাঁর কাজে।

খালিদ মাহমুদ মিঠু বিমূর্ত শিল্পাদর্শের শিল্পী। ছবি যতই বস্ত্তনিরপেক্ষ, অবয়বনিরপেক্ষ হোক না কেন, তাতে সুনির্দিষ্ট বস্ত্ত অবলোকনের চিহ্ন থেকে যায়। মিঠুর ছবির দিকে তাকালে বোঝা যায় তিনি আবেগের রুদ্র রূপ প্রকাশ করতে চাচ্ছেন। পুরো স্পেসে যখন মৃদুলয়ে রং লতিয়ে লতিয়ে চলে তখন সহসা স্পষ্ট জ্যামিতিতে একটি মোটিভ ভেসে ওঠে। এই ছবি দেখে মনে অনেক বাদ্যযন্ত্রের সংগীতে যেন হঠাৎ একটি যন্ত্র জোরালো শব্দে বেজে উঠল। মিঠুর ছবিতে বর্ণের উৎসব আছে।…

বর্ণের সে-উৎসব থামিয়ে দিলো লাল কৃষ্ণচূড়া।

 

পরিবার আর সন্তান। এ-জায়গাটি ছিল মিঠুর সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গা। হাজারো ব্যসত্মতার মাঝে সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া ছিল তার রুটিন-কাজ। শৈশবে বাবাকে হারানো, মায়ের দূরে চলে যাওয়া – সবই তাকে কষ্ট দিত। তাই এক মুহূর্তও সে সন্তানদের ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে পারত না। গত বছর মিঠু আয়োজন করেছিল পঞ্চম টোন আমত্মর্জাতিক মিনিয়েচার প্রতিযোগিতার। বহু দেশ থেকে অসংখ্য শিল্পী অংশগ্রহণ করেন এ-প্রতিযোগিতায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী বলেছিলেন, ‘মিঠু শুধু চিত্রশিল্পীই নয়, আমার দেখামতে মিঠু এসময়ের একজন শ্রেষ্ঠ সংগঠক।’

মিঠুর সফলতা ছবি িআঁকায়, সফল সে স্থিরচিত্রে, সফল সে চলচ্চিত্র নির্মাণে। ব্যক্তিজীবনে সফল স্বামী, সফল পিতাও।

মিঠুর বাসার ড্রইংরুমে মিঠুর িআঁকা একটি বিমূর্ত চিত্রকলা চোখে পড়ল। মিঠু তাতে হালকা করে লিখেছে, ‘কিছু কিছু গল্প কখনোই লেখা হয় না, কিছু কিছু গল্প রয়ে যায়…’। আসলে মিঠুর গল্পগুলো অসমাপ্তই রয়ে গেল।

শীত গড়িয়ে প্রতি বছর ফিরবে নতুন কোনো বসমত্ম। কৃষ্ণচূড়ার ডালে-ডালে ফুটবে লাল ফুল। উপড়েপড়া সে-কৃষ্ণচূড়াটিতে আর কখনোই ফুটবে না লাল ফুল। কারণ সে তো নিজেকে রাঙিয়েছে মিঠুর লাল রক্তে।