শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য-বিচার

আহমদ রফিক

ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে এ-তাবৎ কম কাটাছেঁড়া হয়নি, যদি রবীন্দ্রবিদূষণের কথা বাদও দিই। বলা বাহুল্য, তা তার

পক্ষে-বিপক্ষে, নানা প্রেক্ষাপটে। রবীন্দ্রনাথ এক নান্দনিক মহীরুহ বলেই বোধহয় তাতে এত ঝড়ঝাপটা; প্রবাদবাক্য ভুল নয়, অন্তত রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে।

দেশবিভাগ-উত্তর পূর্ববঙ্গে তথা পূর্ব পাকিস্তানে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও সেই একই কথা। তাঁকে নিয়ে তর্কবিতর্ক, এদেশীয় সমাজে তাঁর অবস্থান ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যত কথা তার চেয়ে তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ ও মূল্যায়ন অপেক্ষাকৃত কম। তবে ইদানীং রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে নানামাত্রায় বিচার-বিশেস্নষণ অনেক বেড়েছে। শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রবিচার তেমন একটি প্রচেষ্টা। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রমানসের বিচার অপেক্ষাকৃত কম। সেজন্য কবির সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত এ-গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য নিয়ে তৎকালীন সংস্কৃতি অঙ্গনে যে-পরিমাণ গরল উত্থিত হয়, তাতে ক্ষুব্ধ হলেও রবীন্দ্র-প্রতিক্রিয়া কখনো সুরুচির মাত্রা অতিক্রম করেনি। প্রসঙ্গত, আরো অনেকের সঙ্গে বিশেষভাবে নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কুরুচিপূর্ণ রচনাদি স্মরণযোগ্য। বহু কারণের মধ্যে এ-জাতীয় আচরণের মূল কারণও একাধিক। যেমন তৎকালীন হিন্দু সমাজের বৃহৎ অংশের চরম রক্ষণশীলতা, তেমনি ঠাকুর পরিবারের খ্যাতি ও আধুনিকতা, প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও সাংস্কৃতিক ধারাকে অস্বীকার এবং তাদের হাতে অভিনবত্বের প্রবর্তন ও নতুন ধারার দিকনির্দেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে। তাই আক্রমণ ঠাকুর পরিবারের সবচেয়ে প্রতিভাবান সদস্যটির প্রতি। কবির মৃত্যুর পরও এ-ধারা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এছাড়া ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিচারে রবীন্দ্র-সমালোচনা, যা এখনো বিদ্যমান।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দীর্ঘ সময় পরও পক্ষে-বিপক্ষে এত কথা বলার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিকতা। স্বদেশ, সমাজ ও সাহিত্যের এমন দিক কমই আছে, যে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছু লেখেননি বা বলেননি। রবীন্দ্রনাথের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, নিজস্ব মত দৃঢ়তার সঙ্গে উপস্থাপন, তাঁর মতো করে যুক্তির সাহায্যে। এ সবকিছু মিলে রবীন্দ্র-সমালোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।

দুই

পূর্বোক্ত বক্তব্যের পরও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত আলোচনার কারণ রবীন্দ্রপ্রতিভা বিশ্বমাত্রিক। তাই দেশে-বিদেশে রবীন্দ্র-ব্যক্তিত্ব ও তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনা। চিত্রকলাসহ সাহিত্যের এমন কোনো দিক নেই, যা রবীন্দ্রপ্রতিভা স্পর্শ করেনি। এদিক থেকেও রবীন্দ্রনাথ অনন্য, যদিও তাঁকে তুলনা করা হয় শেক্সপিয়র, গ্যেটে বা টলস্টয়ের সঙ্গে, যাঁদের সৃষ্টিশীলতা এতটা বহুমাত্রিক নয়। এছাড়া সমকালীন সমাজ, সম্প্রদায় ও রাজনীতির সমস্যাজটিল গভীরে প্রবেশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ সমস্যার সঠিক রূপ নির্ধারণে এবং সমাধানের উপায় উদ্ভাবনে।

এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে বিতর্ক ও ভিন্নমত খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে তা কতটা সঠিক, কতটা বেঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিভাগোত্তর পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শাসকশ্রেণির দৃষ্টিতে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে। পূর্ববঙ্গীয় সংস্কৃতি-ভুবনের তৎকালীন সংখ্যাগুরু অংশ ধর্মীয় রক্ষণশীলতার কারণে রবীন্দ্রবিরোধী। সম্প্রদায়বাদী পাকিস্তানি চেতনা তখন শিক্ষিত মুসলমান সমাজে প্রবল।

ইতিমধ্যে সংঘটিত বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন পূর্ববঙ্গীয় সমাজ ও সংস্কৃতি অঙ্গনে যে-ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়, হয়তো সে-প্রভাবে কবির জন্মশতবার্ষিকীর উদ্যাপন ঢাকায় যথাযথ মর্যাদায় সম্পন্ন হয় মূলত উদারচেতা ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের কল্যাণে, যদিও সেক্ষেত্রে শাসকশ্রেণির বিরোধিতা ছিল যথেষ্ট। শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটির প্রণেতা ষাটের দশকের প্রগতিশীল ছাত্র-আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা হায়দার আকবর খান রনো ওই জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে তাঁর অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন পূর্বোক্ত গ্রন্থে।

তাঁর ভাষায়, সে-সময়ে দৈনিক আজাদ ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্রবিরোধী প্রচার চালিয়েছিল। অভিযোগ, রবীন্দ্রনাথ হিন্দুকবি, ভারতীয় কবি।… তাই রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালনের উদ্যোগটি একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল, যা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে খ-ন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই ‘সংগ্রামে’ ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সংশিস্নষ্টগণই শাসকদের বিরুদ্ধে।

রবীন্দ্রবিরোধিতা শুধু ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতার অচলায়তন থেকেই ছিল না, ছিল রাজনৈতিক অঙ্গন ও মতাদর্শিক অবস্থান থেকেও। প্রমাণ অতিবাম ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির রবীন্দ্রবিরোধিতা। যেমন ১৯৪৮-৫০-এ, তেমনি সত্তরের দশকে অতিবাম হঠকারিতার রবীন্দ্রবিরোধিতা (ভবানী সেন প্রমুখের প্রগতিসাহিত্যের আত্মসমালোচনামূলক প্রবন্ধাবলি দ্রষ্টব্য) এবং নকশালপন্থীদের রামমোহন-বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙার মতো ঘটনাদি স্মরণযোগ্য। পরে ভবানী সেন প্রমুখ প্রবন্ধ লিখে ভুল সংশোধন করেন। আবার তাঁদের কেউ-কেউ অতি দক্ষিণে ঝুঁকে পড়েন, যেমন অচ্যুত গোস্বামী, নরহরি কবিরাজ প্রমুখ।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ডান-বামের অযৌক্তিক টানাপড়েন প্রায়শ দেখা গেছে, এখনো এর বিরল নমুনা দেখা যায় বাংলাদেশে। একসময় রবীন্দ্র-নজরুল বিতর্কও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, যেমন এখনো দেখা যায় বাঙালি মুসলমান সমাজের একাংশে। রনো এ-বিষয়টা নিয়েও সংক্ষেপে যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা শেষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের যথাযথ স্থান নির্ধারণ করে, কিছু উদ্ধৃতির সাহায্যে।

তবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের নকশালপন্থী তাত্ত্বিকদের অবশেষ মূল্যায়ন এখন কোন পালস্নায় তা রনো উল্লেখ করেননি, আমারও জানা নেই। সমর সেন-সম্পাদিত ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার ফাইল আগাগোড়া পাঠে বা অনুরূপ বাংলা সাময়িকীর মতামতে হয়তো তা জানা যেতে পারে। অবশ্য বর্তমান শিক্ষিত মহলে রবীন্দ্রবিচার অনেকটা যুক্তিবাদী ধারায় চলার পক্ষপাতী বলে মনে হয়, যদিও এ-বিষয়ে উগ্রপন্থার হঠাৎ ঝলকানি যে একেবারে নেই তা নয়।

 

তিন

হায়দার আকবর খান রনো বামপন্থী রাজনীতিক, মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। হয়তো তাই রবীন্দ্রবিচার প্রসঙ্গে সংগত কারণে তিনি ‘শিল্প সাহিত্য প্রসঙ্গে মার্কসবাদ’ ও ‘ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ’ শীর্ষক দুটো পরিচ্ছেদ এ-আলোচনায় যোগ করেছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে তুলতে। বিশেষ করে এ-সত্য বোঝাতে যে, শিল্পসাহিত্য-বিচারে মার্কসবাদ কোনো প্রকার যান্ত্রিক বা উগ্র সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে না।

দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যেমন অবশ্যগ্রাহ্য, তেমনি তা হওয়া উচিত দেশ-কাল, ঐতিহ্য ও সমাজবাস্তবতার পরিপ্রেক্ষেতে। সেক্ষেত্রে ভাববাদ ও বস্ত্তবাদের স্ববিরোধী অবস্থানও কখনো বাস্তব সত্য হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত রনো বহুকথিত মার্কসের শেক্সপিয়র এবং লেনিনের পুশকিন পাঠ ও তাদের প্রশংসার কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে এঙ্গেলস, ব্যালজাক সম্বন্ধেও অনুরূপ ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। মার্কসবাদের উদ্ভাবক ও প্রবর্তকদের সংকীর্ণতাবিরোধী যৌক্তিক (‘র‌্যাশনাল’) দৃষ্টিভঙ্গির একাধিক উদাহরণ টেনেছেন রনো, যেখানে আরো উলিস্নখিত দান্তে, গ্রিক মহাকাব্য, তলস্তয়, দস্তয়েভ্স্কি প্রমুখ অনেক মহৎ কবি-লেখকের নাম। এসব ক্ষেত্রে মানবিক চেতনা সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয়। রবীন্দ্রনাথও এই গোত্রের কবি-শিল্পী হিসেবে বিবেচিত।

রনো উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের প্রধানদের ইতি ও নেতির দিক এবং এর সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন রেনেসাঁসের কনিষ্ঠ সদস্য রবীন্দ্র-চেতনার স্ববিরোধিতার যুক্তিগ্রাহ্য সূত্র খুঁজে পেতে। তবে এই খ–ত রেনেসাঁসের প্রভাবে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সাহিত্য ও তার রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক প্রভাবও ছিল বিশদ আলোচনার যোগ্য, যা শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দ্বিজাতিতত্ত্ব, ধর্মীয় রাজনীতি এবং পরিণামে রক্তাক্ত দেশভাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি জাতীয় জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ

যে, রবীন্দ্রনাথ জাতপাত-আচার-আচরণভেদের অমানবিকতা ‘সামাজিক পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছেন সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থে এসব বর্জনের।

 

চার

উনিশ শতকের মধ্যক্ষণ পেরিয়ে যার জন্ম (১৮৬১) সেই রবীন্দ্রনাথের (বিশেষ করে যিনি প্রধানত কবি ও গীতিকার) চেতনায় তৎকালীন ধর্মীয়-সামাজিক প্রভাব, ভাববাদ ও ভক্তিবাদের অবস্থান স্বাভাবিক ঘটনা। রনো তাই পৈতৃকসূত্রে, পারিবারিকসূত্রে রবীন্দ্র-চেতনায়

উপনিষদের গভীর প্রভাবের কথা যথারীতি উল্লেখ করেছেন। উলিস্নখিত হয়েছে বাউল ও সুফি-প্রভাবের কথা। সঠিক চরিত্র-বিচারে তাঁর মন্তব্য :

বাউল-সুফি দর্শনের মধ্যে ভাববাদ ও আধ্যাত্মিকতা

থাকলেও তার মধ্যে যে ধর্মনিরপেক্ষতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবকেন্দ্রিক দিক আছে, বিশেষ করে ঐতিহাসিক তার যে প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল (এমনকি এখনো অনেক ক্ষেত্রে আছে) তা অস্বীকার করা যাবে না। এই মানবিক দিকটাই মূর্ত হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রভাবনায় ও রবীন্দ্রসাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথ যে বাউল ও সুফি দর্শনের নির্যাস গ্রহণ করে নিজের মতো করে কাব্য ও গান রচনা করেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।

আসলে এমন মিশ্র আদর্শের সারাৎসার থেকে জন্ম রবীন্দ্রচৈতন্যের মূল দার্শনিক সূত্র (বিশ্বাস) মানবতাবাদের। তাই রবীন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় এমন সত্য ব্যক্ত করতে পেরেছেন যে, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তার ধর্ম নয়, মানবধর্মই মানুষের জন্য আচরণযোগ্য প্রকৃত ধর্ম। বৈষ্ণব ধর্ম থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী সন্তগণ, যেমন রামানন্দ, নানক, কবীর, রজ্জব প্রমুখ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অতীব প্রিয়। কবীরের শত দোঁহার অনুবাদ প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ নিজের ধর্মীয় দর্শনের প্রকাশ ঘটান, যা পশ্চিমা দেশের বোদ্ধা মহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ডে প্রদত্ত হিবার্ট       বক্তৃতায় (‘দ্য রিলিজিয়ন অব ম্যান’) রবীন্দ্রনাথ মানবধর্মের যুক্তিসম্মত জয়গান করেছেন, যা উল্লেখ করেছেন রনো রবীন্দ্রনাথের মানববাদী ধর্মের কথা বলতে গিয়ে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ভাববাদের পাশাপাশি বাস্তববাদেরও প্রকাশ ঘটেছে, সে-কথা এ-গ্রন্থের আলোচনায় প্রকাশ পেয়েছে উদ্ধৃতি সহযোগে। রবীন্দ্রচেতনায় দুই বিপরীতের অবস্থান কত রূপে ও প্রতীকে পরিস্ফুট তা রবীন্দ্রকাব্যের বিশদ বিশেস্নষণে ধরা পড়ে। এবং তা সোনার তরী-চিত্রা-চৈতালি পর্ব কিংবা গীতাঞ্জলির ভক্তিবাদী পর্বেও লক্ষণীয়। এখানে উদাহরণ হিসেবে এসেছে ‘দুই বিঘা জমি’, ‘পুরাতন ভৃত্য’, ‘এবার ফিরাও মোরে’ ইত্যাদি কবিতার বস্ত্তবাদী বা জীবনবাদী চরিত্র।

এক্ষেত্রে লেখকের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য : ‘দুই বিঘা জমি’র মতো এত উৎকৃষ্ট একটি কাহিনিভিত্তিক কবিতাকে শ্রেণিসংগ্রামের কবিতাও বলা যায়।’ সত্যিই এদেশে প্রগতিবাদী তরুণদের ‘দুই বিঘা জমি’ বা, ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতা থেকে জীবনবাস্তবতা ও জীবনসংগ্রামী পঙ্ক্তি আবৃত্তি বা উদ্ধৃত বা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এগুলোতে রয়েছে নিম্নবর্গীয় মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের ছবি, আহবান রয়েছে প্রতিবাদী আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর।

বহু আলোচিত ‘সোনার তরী’ কবিতার ভাববাদী রহস্যময়তার প্রতীকেও যে কৃষি ও কৃষক-জীবনের বাস্তব ছবি শাব্দিক রেখায় চিত্রিত, সে-আলোচনা পাঠকের জন্য চিত্তাকর্ষক হতো। এ-কবিতাটির মার্কসবাদী ব্যাখ্যা এবং উপনিবেশবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বিচার

একসময় বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। ‘সোনার তরী’ পর্ব যে কবির মানবিক জীবনবাদী বিশ্বাসেরও প্রতীক, এ-কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রভাষ্যে তা লক্ষ করা যায় : ‘মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল।… সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে।’ মানবীয় মমতাধৃত জীবনচিত্রও আঁকা হয়েছে ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায়। সর্বশেষ কবিতায় রয়েছে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র রহস্যময়ীর কথা।

নৈবেদ্যর অধিকাংশ কবিতা যেন এক ও অনন্য ব্রহ্মের উদ্দেশে নিবেদিত (নৈবেদ্য) পঙ্ক্তিমালা, উৎসর্গ পূজনীয় পিতৃদেবকে। কিন্তু বিস্ময়কর যে, এতে রয়েছে কয়েকটি তীব্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবিতা, যা রনো উদ্ধৃত করেছেন। এ-প্রসঙ্গে এসেছে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটির কথা। তবে রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রবন্ধাবলিতেও রয়েছে প্রকট সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিবাদ। এবং তা ভক্তিবাদের পাশাপাশি। যে-ভক্তিবাদ বৈরাগ্যে মুক্তি খোঁজে।

তবে পরবর্তী গীতাঞ্জলি পর্বের ভক্তিবাদ ভিন্ন চরিত্রের। এখানে ঈশ্বর, মানুষ, প্রকৃতি পরস্পর সংলগ্নতায় একটি ত্রিভুজ তৈরি করেছে। আর মানবসত্তার রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, যেজন্যে বলা সম্ভব হয়েছে ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।’ মানুষের মহিমা ও গুরুত্ব এভাবে গীতাঞ্জলি পর্বের ভক্তিবাদে পরিস্ফুট। সে-মহিমার টানে ঈশ্বর অমর্ত্যলোক থেকে ‘নীচে’ নেমে এসে মর্ত্যলোকবাসী। রবীন্দ্রনাথের এ মানবীয় ভক্তিবাদের দার্শনিক চরিত্রটি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনার দাবি রাখে এবং ভক্তিবাদী গানের উপভোগ্যতার পাশাপাশি আলোচিত হলে পাঠক উপকৃত হতেন।

তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যৌবনের শক্তিকে পুঁজি করে বলাকার গতিবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। লেখকের ভাষায় ‘শা-জাহান’ কবিতায় ‘অতি উচ্চাঙ্গের ভাববাদী দর্শন’ প্রতিফলিত হলেও এখানে রয়েছে শুভ্র পাষাণে সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জ রচনা করে প্রেমের মৃত্যুঞ্জয় রূপ প্রকাশের চেষ্টা, যদিও মৃত্যু জীবনের এক অবধারিত বাস্তবতা, যেখানে ভাববাদ-বস্ত্তবাদ একাকার।

অবশ্য বলাকার দুটো দিক বস্ত্তবাদী দর্শনের আলোকে আলোচনাযোগ্য। যেমনটা দেখা যায় ‘চঞ্চলা’ কবিতায় বস্ত্তপুঞ্জের গতির শক্তিতে রূপান্তরের বৈজ্ঞানিক সত্যটি, তেমনি ‘ঝড়ের খেয়ায়’ সংগ্রামী মর্ত্যের প্রকাশ। শেষোক্ত বিষয়টি বিশদ আলোচিত। সময়ের বিভিন্ন পর্বে বিপস্নবী বা বিপস্নববাদী সংগ্রামী তরুণদের উদ্দীপ্ত করেছে ‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রম্নধারা’ ইত্যাদি পঙ্ক্তি।

ঊনসত্তর-একাত্তরে ঢাকার ছাত্র এলাকায় এসব পঙ্ক্তির দেয়াললিপির ঝাপসা চেহারা দীর্ঘদিন পরও দেখা গেছে। স্কুল-কলেজে সংগ্রামী ছাত্রদের আবৃত্তি করতে শোনা গেছে এ-কবিতার উদ্দীপক নির্বাচিত পঙ্ক্তি।

সাম্রাজ্যবাদী, মানববিধ্বংসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে ‘নূতন সৃষ্টির উপকূলে/ নূতন বিজয়ধ্বজা তুলে’ উত্তরণের আহবান জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঝড়ের খেয়ায় চড়ে। দীর্ঘ এ-কবিতাটির বিশেষ একটি পঙ্ক্তি – (‘এ আমার এ তোমার পাপ’) নিয়ে সংগত প্রশ্ন তুলেছেন লেখক এই বলে যে, ‘পাপ করেছে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ। তারাই যুদ্ধ বাধিয়েছে। অথচ কবি সকলকেই এক কাতারে ফেলেছেন। কারণ কবির মতে সকল মানুষই অবিভাজ্য।’

সত্যি, গোটা কবিতায় যেখানে অন্ধকার থেকে আলোতে আসার আকাঙক্ষা প্রতিফলিত, সেখানে মৃত্যুর দায়ভারে এমন একটি পঙ্ক্তি যুক্ত হলো কেন। কবিতাটির পূর্বাপর বক্তব্যের সঙ্গে এ-পঙ্ক্তিটি ঠিক মেলে না। মেলে না কবির পূর্বাপর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বক্তব্যের সঙ্গে, যেমন বুয়র যুদ্ধ, বক্সার যুদ্ধ, তিববত দখল ইত্যাদি প্রসঙ্গে কবির প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে। তাই প্রশ্নবিদ্ধ একটি বা দুটি পঙ্ক্তি কবিতাটির পরিস্ফুট তাৎপর্য বিচারে বিচ্ছিন্ন ও প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়, হয়তো বিশেষ কোনো আবেগে লেখা।

হতে পারে এ-কবিতায় উলিস্নখিত সংগ্রামবিমুখ ‘ভীরুর ভীরুতাপুঞ্জ’কে কবি দায়ী করছেন, গণ্য করেছেন ‘পাপ’ হিসেবে। কিন্তু এমন ব্যাখ্যায়ও পূর্বোক্ত পঙ্ক্তিটির যৌক্তিকতা যথেষ্ট স্পষ্ট হয় না। তাই এ-পঙ্ক্তিটির সংযোজন যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না এবং তা কবির সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাবের সঙ্গে মেলে না।

যাই হোক, একটি তথ্য সর্বজনগ্রাহ্য যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিষয়-মাহাত্ম্যে বহুমুখী, ‘বিচিত্রগামী’। তাই মানসীর রোমান্টিক প্রেমপর্ব থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর কবিতা গ্রামবাংলার

প্রকৃতি ও সোনালি ধানের জীবনবাস্তবতা নিয়েও সোনার তরী পর্বে কাব্যসুন্দরীতে মুগ্ধ। ক্ষণিকার চলতি চালের হালকা রোমান্টিকতা এবং গীতাঞ্জলি পর্বের মানবিক ভক্তিবাদ পেরিয়ে বলাকা পর্বে যৌবনের জয়গান, গতিবাদ ও যুদ্ধবিরোধিতা পরস্পর থেকে চরিত্রধর্মে কত ভিন্ন! বিচিত্র এ-পর্বগুলোকে দুই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছেন লেখক।

 

পাঁচ

এরপর একেবারে ভিন্ন এক রবীন্দ্রনাথ জীবনবাস্তবতার ভিন্ন নিরিখে, নারীজীবনের দুঃখ-বেদনা বা আনন্দিত পথচলার স্বাচ্ছন্দ্য বয়ানে কী নিরাভরণ কাব্যপরিক্রমা পলাতকা থেকে শিশু ভোলানাথে। লেখকের মতে, ‘পলাতকার কয়েকটি কবিতা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতার অন্তর্ভুক্ত।’ জীবনের গভীর উপলব্ধি থেকে চিত্রিত এসব কবিতা জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়ে দেয়, যে-চেনার আলো সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকে। এ-পর্বে শিশুমনের বিচিত্র ভাব ও ভাবনা অসাধারণ দক্ষতায় চিত্রিত।

প্রসঙ্গত রনোর উপলব্ধি, ‘রবীন্দ্রনাথ কখনোই পুরোপুরি বস্ত্তবাদী হতে পারেননি।’ এক্ষেত্রে ‘বস্ত্তবাদী’ কথাটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। একই সঙ্গে আবার একথাও বলেছেন : ‘পলাতকায় ভাববাদের কোনো কিছু দেখি না। সেখানেও পরবর্তীতেও বড় করে এসেছে মানুষ। সব কিছু ছাপিয়ে বিশ্বমানবিকতা সর্বোচ্চ আসন পেয়েছে।’ তাহলে বিষয়-বিবেচনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? ভাববাদ নেই, বস্ত্তবাদও নেই, কী আছে তাহলে?

লেখকের বিচারে একদিকে অনিঃশেষ আধ্যাত্মিকতা, অন্যদিকে অব্যাহত মানবিক চেতনা – প্রায় সমান্তরাল ধারায়। কখনো দুইয়ের মিশ্রণে। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের মধ্যে মানুষের প্রকাশ – ওই যে রবীন্দ্রভাষ্যে ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’, অনেকটা সেরকম। কিন্তু লক্ষ করার বিষয় যে, তিরিশের দশক থেকে অর্থাৎ রবীন্দ্রজীবনের শেষ দশকের কবিতায় জীবনধর্মী মানবতাবাদী চেতনার গভীর প্রকাশ, দৃষ্টিভঙ্গির গুণগত পরিবর্তন স্পষ্ট। বিশেষ করে রাশিয়া সফর শেষে কুবের দেবতার দেশ আমেরিকায় গণতন্ত্রের চরিত্র বুঝে নেওয়ার পর থেকে। তখন এমন কথাও বলতে পেরেছিলেন : ‘ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো।’ যদিও তাতে ধর্ম-সম্পর্কে ক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পেয়েছে, তবু প্রতিক্রিয়াটি কি মিথ্যা বা একেবারে অর্থহীন?

এই মনোভাবের সঙ্গে মিল রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্কতা যা শুধু বিশ্ব পরিচয় রচনাতেই নয়, পরিস্ফুট তাঁর কবিতায়, তাঁর গদ্য রচনায়, তাঁর সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে লেখা নাটকে ও প্রতিবাদী আচরণে। যেমন বিহার-ভূমিকম্পে গান্ধীর অন্ধ সংস্কারবাদী মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, তেমনি মার্গারেট ম্যাঙ্গারের জন্মনিয়ন্ত্রণ-বিষয়ক আধুনিকতার সমর্থনে (এক্ষেত্রে গান্ধীর ছিল আপত্তি)।

তাই এমন মন্তব্য খুবই সংগত যে, ‘রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনাও প্রখর ছিল।… বিশ্বপরিচয় এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা বৈকি।… পদার্থবিদ্যার জটিল বিষয়কে সহজভাবে তুলে ধরার প্রয়াস এমন সার্থক রচনা আমাদের বিস্মিত করে।… কবি জীবনরহস্য, সৃষ্টিরহস্য ও মানবচেতনা সম্পর্কিত যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তার মধ্যে বিজ্ঞানের ছোঁয়া আছে।’ শেষ দশকের বিজ্ঞানমনস্ক, মৃত্যু সম্পর্কে বাস্তববোধের অধিকারী রবীন্দ্রনাথকে তাই পূর্বাপর অধ্যাত্মবাদী পরিচয়ে চিহ্নিত করা সঠিক কিনা তা ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।

 

ছয়

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক-চেতনা বহু আলোচিত ও বাদ-প্রতিবাদের বিষয়। বিতর্ক রয়েছে তাঁর প্রথম দিককার ‘বড়ো ইংরেজ ছোটো ইংরেজ’-বিষয়ক ধারণা নিয়েও, রয়েছে সমালোচনা। বিষয়টি যেমন বড়ো ক্যানভাসের, তেমনি এ-বিষয়ে আলোচনাও দীর্ঘ হতে বাধ্য। সংক্ষেপে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ পূর্বাপর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, কংগ্রেসের ‘আবেদন-নিবেদনের’ সমালোচনা করেও তিনি ‘গণ-ভিত্তিসম্পন্ন’ জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য, তাদের নিয়মিত চাঁদা দিতেন, আবার স্বদেশি ডাকাতি ও গুপ্তহত্যার বিরোধী হয়েও বিপস্নবী তরুণদের সাধ্যমতো সাহায্য করতেন, এমনকি শান্তিনিকেতনে আশ্রয় দিতেন, কাজে নিয়োগ করতেন, যেজন্য গোয়েন্দা-পুলিশের খাতায় ‘সন্দেহজনক ব্যক্তি’ হিসেবে তাঁর নাম লেখা ছিল। প্রশাসনের নির্দেশ ছিল, যাতে সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানগণ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে পড়তে না যায় (বিশদ চিন্মোহন সেহানবিশ : ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিপস্নবী সমাজ’)।

রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধ, ‘গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ সকল সময়ই জাগ্রত ছিল’ এমন মন্তব্য হায়দার আকবর খান রনোর। একই সঙ্গে স্বদেশি আন্দোলন ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথের ইতিবাচক দিক সম্বন্ধে বক্তব্য শেষে রনোর মন্তব্য : ‘রবীন্দ্রনাথ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী।’ প্রসঙ্গত উলিস্নখিত জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটনায় রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ, হিজলি ক্যাম্পে গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মতো একাধিক ঘটনা এবং চীন ও স্পেনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো ঘটনাবলি।

সন্ত্রাসবাদ নীতি হিসেবে সমর্থন না করেও বিপস্নবীদের দুঃসাহসী আত্মদানের ভূয়সী প্রশংসা রবীন্দ্রনাথের। এ-বিষয়ে একটি রাবীন্দ্রিক উদ্ধৃতি-সহযোগে রনোর মন্তব্য : ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে সঠিকভাবে ধরেছেন যে, রাষ্ট্রবিপস্নব বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ব্যক্তির কাজ না। গণবিপস্নবে বিশ্বাসী মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের সঙ্গে তার চিন্তায় এখানে মিল রয়েছে। কিন্তু… (তিনি) সশস্ত্র বিপস্নবে বিশ্বাস করতেন না।’

একথা যেমন ঠিক, তেমনি ঠিক যে, শোষিত ‘ইউরোপীয় শ্রমজীবীদের গুমরে মরার পেছনে বিপস্নবের সম্ভাবনার’ কথাও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমন ছিল পর্বপর্বান্তরে রাবীন্দ্রিক স্ববিরোধিতা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ভূমিকা, যার শুরু উনিশ শতকের শেষদিক থেকে, সেইসঙ্গে তিনি যুদ্ধবিরোধী ও বিশ্বশান্তির প্রবক্তা। এ-বিষয়ে

রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞগণ তাঁদের বিচার-বিশেস্নষণে একমত, এমনকি আলোচ্য গ্রন্থের লেখকও। তবে মতাদর্শগত বাস্তবায়নে রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি সমাজতন্ত্রের অন্তর্গত হতে পারেননি, এ আক্ষেপ অনেকের মতো গ্রন্থকারের। এমনকি জীবন-সায়াহ্নে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও। কিন্তু রবীন্দ্রজীবনের সমকালীন সামাজিক রক্ষণশীলতা, রাজনৈতিক পরিবেশ, পারিবারিক প্রভাব ইত্যাদি বিচিত্র বৈপরীত্য বিবেচনায় এমন প্রত্যাশার পক্ষে যুক্তি নেই বললেই চলে। একই কথা খাটে রাজনীতিক্ষেত্রে রবীন্দ্রোত্তর যুগে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে যতই পঞ্চাশের প্রগতিবাদী তরুণদের একাংশ তাকে ‘রেড ডিন অব ক্যান্টারবেরি’ নামে অভিহিত করুক না কেন। পরিবেশ প্রভাবে গজানো শিকড়বাকড় সব উপড়ে ফেলা বাস্তবে অসম্ভব হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ ও জমিদারি উচ্ছেদ প্রসঙ্গটি বহু আলোচিত। রনোও একইভাবে প্রশ্ন তুলেছেন যে, প্রজাবৎসল হয়েও রবীন্দ্রনাথ জমিদারি উচ্ছেদের এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের পক্ষে কথা বলেননি। প্রমথ চৌধুরীর রায়তের কথার জবাবে একই শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যে গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য দুই প্রকার যুক্তিই রয়েছে, বিচারের মানদ- বলা বাহুল্য রাজনৈতিক আদর্শগত যা ব্যাখ্যায় উলটপালট করা যায়।

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘জমিদার জমির জোঁক, সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব’, যখন বলেন, ‘শ্রম না করে, উপার্জন না করে অলস ঐশ্বর্যভোগের কথা, তখন তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পাশাপাশি চলেন। কিন্তু যখন ‘কাকে জমিদারি ছেড়ে দেব’ – এই প্রশ্ন তুলে তখনকার পরিবেশে এক জমিদারের জায়গায় বহুসংখ্যক ছোট জমিদার তথা জোতদারের অনিবার্য আবির্ভাবের কথা এবং কৃষকের পুনর্মূষিক অবস্থার কথা বলেন, তখন ব্রিটিশ বঙ্গের কৃষিব্যবস্থার বাস্তবতা কি অস্বীকার করা চলে? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বড়ো মাছ ছোট মাছকে গিলে খাওয়ার মতো ধনী জোতদার দরিদ্র কৃষকের জমি গিলে খেয়ে তাকে ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকে পরিণত করবে। বাস্তবে করেছেও। একালে বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষকের বিপুল সংখ্যা তার প্রমাণ।

তাই বলে সামন্তবাদী, অত্যাচারী জমিদারিব্যবস্থা তো টিকিয়ে রাখা চলে না। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, জমি যে চাষ করে জমিতে তার অধিকার। রবীন্দ্রনাথও এমন যুক্তি মানেন যে, ‘জমির স্বত্ব রায়তের’। লেখেন জমিদারের অত্যাচারের কথা, বেগার খাটানোর কথা তাঁর কবিতায়, গল্পে, প্রবন্ধে। স্বীকার করেন নিজের জীবনযাত্রার অসহায়তার কথা, জীবিকার অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় জমিদারি ছেড়ে দিতে না পারার কথা। এমনকি জমিদারি ব্যবসায়ে লজ্জাবোধের কথাও প্রকাশ করেন। কিন্তু জীবনযাত্রার তাগিদে জমিদারি ছেড়ে দিতে না পারায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নিজে হয়ে ওঠেন প্রজাবৎসল জমিদার, কৃষকের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্যে শুরু করেন নীতিগত মডেল হিসেবে সমবায়ভিত্তিক গ্রামোন্নয়ন-পলিস্নপুনর্গঠন কর্মকা-, গ্রামীণ ব্যাংক স্থাপন করে ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তায় দরিদ্র কৃষককে মহাজনের শোষণ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালান।

কিন্তু এসব তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কার ব্যবস্থা। তবু ভেবেছেন জমিদার-প্রজাদের সমবায়ভিত্তিক ব্যবস্থার কথা (সেই বিখ্যাত উক্তি ‘আমাদের জমিদারি যেন প্রজাদেরই জমিদারি হয় – আমরা যেন ট্রসটির মতো থাকি। অল্প কিছু খোরাক পোষাক দাবি করতে পারব’ ইত্যাদি) যা অর্থনীতিবিদ ও সমাজতন্ত্রীরা আখ্যা দেবেন ‘ইউটোপীয়’ চিন্তা হিসেবে। এসবই কবির অসহায়তা বনাম মানবিক চিন্তার দ্বন্দ্বের প্রকাশ। রাবীন্দ্রিক এরকম অসহায়তার মধ্যেই কবির ‘উদার বুর্জোয়া চেতনার’ মানবিক মহত্ত্ব চিহ্নিত করেছেন রনো। সেইসঙ্গে রথের রশি ও রক্তকরবীর রচয়িতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য : তিনি এগুলোতে ‘শ্রমিক বিপস্নবের ছবি এঁকেছেন, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে পবিত্র তীর্থস্থান বলে মনে করেছেন।’

এমনকি বলেছেন : ‘পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে… বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের বিপস্নবের চিন্তা গাঢ়তর হয়েছে। রুশবিপস্নব যে তার মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই।’ বস্ত্তত একথা ঠিক যে, ১৯৩০-উত্তর রবীন্দ্রজীবনের শেষ দশকে আমরা ভিন্ন এক রবীন্দ্রনাথ, প্রগতিবাদী রবীন্দ্রনাথকে দেখি। যদিও মাঝেমধ্যে ভাববাদের তলানি প্রকাশ পায়, তবে তা প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে না।

রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ রাশিয়ার চিঠি একসময় প্রগতিবাদী তরুণদের উদ্ধৃতিধন্য হয়ে ওঠে। আবার দু-একটি বিষয়ে সমালোচনাও, যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে। রনোও যথারীতি একই ঘরানার। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যে, রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত সম্পত্তি সম্পর্কে মধ্যপন্থী। সমাজতন্ত্রে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষেতে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে এ-সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের যুক্তিগুলো। তিনি মনে করেন, মানুষের সহজাত প্রকৃতিগত আকাঙক্ষা তার নিজের বলে কিছু থাকা। একথা যেমন কৃষকের জমি, তেমনি অন্যদের সম্পত্তি বিষয়ে খাটে।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে স্পষ্টভাষায় বলেছেন, সম্পত্তির পরিমাণগত মাত্রায় সীমারেখা থাকা দরকার, যা অতিক্রম করা যাবে না। সে সীমারেখা সংশিস্নষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা ঠিক করে দেবেন। এটা ‘অবাস্তব’ বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। যেমন এদেশে একসময় পরিবারপিছু ১০০ বিঘা জমির সর্বোচ্চ সীমা সবাই মেনে নিয়েছিলেন, অবশ্য কেউ-কেউ বলেছিলেন, ওটা ৫০ বিঘা হলে ভালো হয়। আমি নিজে ‘ঘড় চবহংব ড়ভ নবষড়হমরহমং’-এ বিশ্বাসী হয়েও সাধারণের জন্য সীমিত সম্পত্তি অধিকার নিয়ে বিতর্কও ভেবে দেখার পক্ষপাতী। এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নীতিগত চিন্তা তাঁর বাস্তববোধের পরিচায়ক বলে মনে করি।

আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। তাই ধর্ম, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা সম্বন্ধে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ধর্ম সম্বন্ধে সাময়িক সনাতনী মনোভাবের পর রবীন্দ্রনাথ বরাবরই ধর্মবিচারে মানবতাবাদী, আর কঠোরভাবে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার সমালোচক – গোরা, ঘরে বাইরে থেকে তাঁর প্রবন্ধাবলি তার প্রমাণ। জাতপাত ও অস্পৃশ্যতা সম্বন্ধেও একই কথা সত্য।

কাছারিতে হিন্দু-মুসলমানের জাজিম তুলে বসা সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে রনোর প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ এ বৈষম্যমূলক প্রথা তুলে দিয়ে নিম্নবর্গীয় প্রজাদের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। এমন তথ্য রবীন্দ্রজীবনীকারসহ অমিতাভ চৌধুরীর। নারী-স্বাধীনতা সম্পর্কে রনোর মন্তব্য : ‘রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নারীমুক্তির যে সংগ্রামের উদ্বোধন করেছিলেন তা পরবর্তীতে আরো তীব্র ও বলিষ্ঠ হয়েছে।’ একথা যেমন ঠিক, তেমনি ঠিক অভয়া ও কমল চরিত্র বাদে শরৎচন্দ্রের নারী-স্বাধীনতা সামন্তবাদী ধ্যানধারণায় বন্দি। যেমন বন্দি বিবেকানন্দের উদারতা, চ-াল পর্যন্ত আসার পরও তাঁর উদাত্ত আহবানে মুসলমানের স্থান হয়নি। অথচ ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ অস্তসূর্যের দিকে মুখ করে নামাজ শেষ করা কৃষককে ‘ভাই’ বলে আহবান জানাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ। সমাজের বহুবিধ সমস্যা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, দিনমজুরের জৈবনিক জটিলতা, প্রেমের টানে নষ্টনীড় ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। যৌতুক-প্রথার বিরুদ্ধে তার কশাঘাত স্মরণযোগ্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গল্প বা উপন্যাস নেই। এমন মন্তব্য করেও রনো লিখেছেন ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের নায়ক শশীভূষণের প্রতিবাদী ভূমিকার কথা। তবে আরো একটি গল্পে রয়েছে ব্রিটিশ শাসকবিরোধী মনোভাব (‘রাজটিকা’)। স্মর্তব্য, গোরায় বিদ্রোহী কৃষক নেতা ফরা সর্দারের কাহিনি ও

নায়েব-গোমস্তাদের শাসক সমর্থনে নিষ্ঠুর আচরণ। ফরু-তমিজ-নাপিত কাহিনি গোরার আত্মদর্শনের আয়না, যেখানে নিজকে, সমাজকে, ধর্মকে সঠিক পরিচয়ে দেখা সম্ভব হলো।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসবিষয়ক ব্যঙ্গবিচারে রনো স্বচ্ছদৃষ্টিতে এগিয়েছেন চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ

প্রভৃতি উপন্যাসের আলোচনায় এবং আলোচনা যথারীতি চার অধ্যায় নিয়ে, যেটি নিয়ে বরাবরই চলে বাদ-প্রতিবাদ। প্রশ্নটা বিশেষত এ-কারণে যে, নীতিগতভাবে বিরোধী হলেও বিপস্নবী তরুণদের প্রতি সহানুভূতিশীল রবীন্দ্রনাথ এমন একটি উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন, যেটি শাসকশ্রেণি বিপস্নবীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে?

এসব প্রশ্নের সর্বজনস্বীকৃত সদুত্তর মেলে না, মিলবে বলেও মনে হয় না। এ-ঘটনা রবীন্দ্রসৃষ্টিতে প্রক্ষিপ্ত বা স্ববিরোধিতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। স্বভাবতই চার অধ্যায় প্রশ্নে রনো অন্যান্য সমালোচকের ধরাবাঁধা পথেই এগিয়েছেন। তবে মনে রাখতে হবে যে, চার অধ্যায় যেমন সত্য, তেমনি সত্য বিপস্নবী অরবিন্দ ঘোষের মুক্তিতে অভিনন্দন জানিয়ে লেখা দীর্ঘ কবিতা (‘অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার’), নকশা ক্যাম্পে আটক বিপস্নবীদের উদ্দেশে লেখা কবিতা, বিপস্নববাদের সমর্থক নজরুলের ধূমকেতুর (১৯২২) জন্যে পাঠানো আশীর্বাণী কবিতা যেখানে ‘আঁধারে অগ্নি সেতু বেঁধে আধমরা, ‘অর্দ্ধচেতনদের জাগিয়ে তোলা’র কথা বলা হয়েছে।

অনুরূপ আরো দু-একটি তথ্য। চিন্মোহন সেহানবিশ  লিখেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন এবং গগনেন্দ্রনাথ নিয়মিত বিপস্নবীদের অর্থসাহায্য করতেন। তাঁর ভাষ্যে : ‘১৯০৫ সালে আরো দু একজন বিপস্নবী জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দেখা করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, তাঁর সঙ্গে একযোগে কাজ করার প্রস্তাব নিয়ে।’ অবশ্য অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ সমিতির সদস্য হননি (সেহানবিশ)। রবীন্দ্রনাথ এ-সময় বিপিনচন্দ্র পাল-সম্পাদিত ইংরেজি ভাষার বিপস্নবী পত্রিকা বন্দেমাতরমের

গ্রাহক হন।

এ-সময়েই লেখা রবীন্দ্রনাথের বিপস্নববাদী পঙ্ক্তিমালা : ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ ইত্যাদি, যা বিপস্নবী নেতা ও কর্মীদের

মুখে-মুখে ফেরে। উল্লেখ্য, এই কবিতাটি নিয়ে হোম ডিপার্টমেন্টের

ব্যাখ্যা-মন্তব্যও রয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথের নাম পুলিশের নজরদারিতে আসে (সুমিত সরকার, শিশির কর প্রমুখ)। এরপর ঘটে ক্ষুদিরামের মুজফফরপুর বোমা হামলা এবং ভুলক্রমে নিরপরাধ হত্যা, যে-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা। এসব নিয়ে বিশদ তথ্যনির্ভর বিবরণ রয়েছে নেপাল মজুমদার ও পূর্বোক্ত সেহানবিশ ও আরো কারো লেখায়।

অন্যদিকে সন্ধ্যা পত্রিকার বিপস্নবী সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠজন, ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের উপদেষ্টা। তিনিই রবীন্দ্রনাথের কপালে ‘গুরুদেব’ উপাধির টিপ পরিয়ে দেন। পরে একসময় শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান। উপাধ্যায়সহ বিপস্নবীদের ভুলভ্রান্তি ও ভুলক্রমে নিরপরাধ মানুষ হত্যা ইত্যাদি ঘটনাই কি চার অধ্যায় লেখার কারণ?

 

সাত

রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণ তথা ‘তীর্থদর্শন’ যে রবীন্দ্র-চৈতন্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি, যৌথ খামার, সমবায় ইত্যাদি নিয়ে, তার প্রভাব পড়ে তাঁর লেখায় ও সমাজচিন্তায়, গ্রামোন্নয়ন ও পলিস্ন পুনর্গঠনে এবং কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে। কালের যাত্রা ও রথের রশি নাটকে তাঁর পরিবর্তিত চিন্তা ও নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে পরিবর্তন ঘটানোর শক্তি সম্পর্কে আশাবাদ প্রকাশ পেয়েছে।

অবশ্য এর আগে অচলায়তন, মুক্ত ধারা, রক্তকরবী, বিশেষভাবে রক্তকরবী নাটকে অসাধারণ প্রকাশ সর্বপ্রকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং জাগরণের পক্ষে। এগুলোর বিশদ আলোচনা শেষে রনোর মন্তব্য : রবীন্দ্রনাথ এসব নাটকে শোষিত মানুষের বিদ্রোহ ও বিপস্নবের ছবি আঁকছেন। কবি বিপস্নবকেই সমস্ত অন্তর দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন।

এ-বইয়ে কবির অর্থনৈতিক চিন্তাও আলোচিত হয়েছে। লেখকের মতে, রবীন্দ্রনাথ সমাজের সবরকম শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েও ‘মার্কসীয় অর্থনৈতিক তত্ত্ব দ্বারা শ্রেণীশোষণকে বিশেস্নষণ করেননি বলে শোষণ অবসানের পথ দেখাতে পারেননি। যেমন পারেননি তলস্তয়।’ তাই কৃষি ব্যাংক, পলিস্নমঙ্গল, উন্নয়ন কর্মকা- সত্ত্বেও গোটা দেশের শোষণমুক্ত সমাজ পরিবর্তনের মডেল তৈরি সম্ভব হয়নি।

শ্রেণীদৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যকর্মের অবশেষ বিচারে দেখা যাচ্ছে, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা পত্তনের সদিচ্ছা

থাকা সত্ত্বেও সঠিক রাজনৈতিক আদর্শের চিন্তা না থাকায়

সমাজ-পরিবর্তনের সঠিক দিকনির্দেশনা তিনি দিতে পারেননি। তবে ভবিষ্যৎ মানুষ, অপরাজেয় প্রাজ্ঞ মানুষ যে একদিন সে-অর্জন নিশ্চিত করবে, তেমন বিশ্বাসের কথা, ‘চরম আশ্বাসের কথা’ তিনি তাঁর শেষ টেস্টামেন্ট ‘সভ্যতার সংকটে’ও বলে গেছেন। এবং তা আসবে ‘পূর্বদিগন্ত থেকেই’।

শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে হায়দার আকবর

খান রনো রবীন্দ্রনাথের শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা, স্ববিরোধিতার

মধ্যেই একজন সমাজ-পরিবর্তনকামী মহৎ কবি-শিল্পীকে প্রত্যক্ষ করেছেন, দেখেছেন সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদ বিরোধ, বিশ্বশাস্তির প্রবক্তা রাজনীতি-সচেতন কবি ও সমাজকর্মীকে।