সংগীতসাধক দ্বিজেন্দ্রলাল সার্ধশত জন্মবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিশ্বজিৎ ঘোষ

রবীন্দ্র-সমসাময়িককালে সাহিত্যচর্চা করলেও প্রথম থেকেই ভুবনপ্রসারী রাবীন্দ্রিক প্রভাববলয় থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সাধনা করেছেন যাঁরা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) তাঁদের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের জন্মের দুবছর পরে জন্মেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, কিন্তু মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্র-প্রয়াণের ২৮ বছর পূর্বে। ৫০ বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবনে বাংলার সাহিত্য ও সংগীতের জগতে যা দিয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। প্রধানত গীতিকার এবং নাট্যকার হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সমধিক; তবে কবি হিসেবেও তাঁর অবদান অতুলনীয়। বাংলা কবিতা ও গানে হাস্য-কৌতুকরস সৃজনে দ্বিজেন্দ্রলালের খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য, বাংলা নাটকের বিকাশে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সার্ধশতজন্মবর্ষে দ্বিজেন্দ্রলালের কর্ম ও সৃষ্টির দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টিপাত করলে, অনুধাবন করা সম্ভব, তাঁর সাধনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা, বুঝে নেওয়া সম্ভব তাঁর স্বকীয়তা, নির্দেশ করা সম্ভব তাঁর শিল্পবোধের স্বাতন্ত্র্য ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা।

দুই

কৃষ্ণনগর-মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের গৌরবিত রক্ত ধমনীতে বহন করে জন্মেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। অভিজাত ঐতিহ্যিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা দ্বিজেন্দ্রলাল কৈশোর থেকেই ছিলেন দুঃসাহসী, খানিকটা প্রথাদ্রোহী। কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, ইংল্যান্ড গেছেন কৃষিবিদ্যায় উচ্চতর পড়ালেখার জন্য, ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখেছেন, লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার নই Lyrics of Ind – কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর তরী এসে ভিড়েছে বাংলার ঘাটে, বাংলার ইতিহাসে।

দ্বিজেন্দ্রলাল জন্মেছিলেন আজ থেকে সার্ধশত বছর পূর্বে, আর মৃত্যুবরণ করেছেন শতবর্ষ পূর্বে। দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে বর্তমান সময়ের ব্যবধান বেশিই বলতে হবে – তবু কেন তিনি এখনো প্রাসঙ্গিক, কেন তিনি এখনো স্মরণীয়? লেখার অপেক্ষা রাখে না যে, দ্বিজেন্দ্রলালের অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতার একটি প্রধান শক্তি-উৎস তাঁর সংগীতভুবন, তাঁর কবিতাভুবন। বস্ত্তত, তাঁর কবিতা ও গান যুগলবন্দি – একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি শনাক্ত করা প্রায় দুরূহ। বাঙালি সংগীতপিপাসুদের কাছে বহুল উচ্চারিত ‘পঞ্চগীতিকবি’র একজন দ্বিজেন্দ্রলাল – বাকিরা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ-অতুলপ্রসাদ-নজরুল-রজনীকান্ত। বাকি চারটি নামের সঙ্গে এককাতারে বসা দ্বিজেন্দ্রলালের নামটি দেখেই তো অনুধাবন করা সম্ভব বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর স্থান ও অবস্থান।

সামাজিক অসংগতিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপবাণে বিদ্ধ করাই দ্বিজেন্দ্রলালের গানের কেন্দ্রীয় প্রবণতা। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পাশাপাশি তাঁর গানে আছে প্রেম ও প্রকৃতির কথা, আছে দেশের কথা। তবে সমসাময়িক সামাজিক প্রবণতাকে ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করাই যেন তাঁর সংগীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য :

যখন দ্বিজেন্দ্রলাল বিলাত হইতে এদেশে ফিরিয়া আসেন তখন বাঙালায় ভাবস্থবিরতা ঘটিয়াছিল।… ন্যাকামির প্রভাব চারিদিকে বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছিল। সেই সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল বিলাতের humour বা ব্যঙ্গের এদেশে আমদানি করিয়া, দেশীয় শ্লেষের মাদকতা উহাতে মিশাইয়া বিলাতী ঢঙের সুরে হাসির গানের প্রচার করিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান বাঙালী সমাজে একটা ভাববিপ্লব ঘটাইয়াছিল।

বাংলা সংগীতের বিকাশধারায় দ্বিজেন্দ্রলালের অনন্য কৃতিত্ব হাস্যরসের সাংগীতিক ব্যঞ্জনা নির্মাণ। বস্ত্তত, তিনিই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম হাস্যগীতি-রচয়িতা। ব্যঙ্গ ও কৌতুক গানের মাধ্যমে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ করেছেন তাঁর সমাজচেতনা ও দেশাত্মবোধ; আর রঙ্গগীতিতে ধরা দিয়েছে তাঁর মর্মগত প্রেম-ভালোবাসা-মুগ্ধতা- সৌন্দর্যবাসনা। বাংলা হাস্যরসের ধারায় দ্বিজেন্দ্রলালের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে গিয়ে কালিদাস রায় লিখেছেন – ‘সুরকার হিসেবে তাঁর প্রতিভার উন্মেষ হয় প্রথমে হাসির গানে।… এইসব গানের বাঙালির হৃদয়ের সহজ মাধুর্যের সঙ্গে বিলাতি সুরের প্রাণ-প্রাচুর্য সম্মিলিত হয়ে সকলকে চমকিত করেছিল। নন্দলাল, পাঁচশো বছর, গীতার আবিষ্কার ইত্যাদি হাসির গানের সুরে এমন একটা সবল গতিপ্রবাহ পরিস্ফুট হলো যে, সকলে বুঝতে পারল এদেশে এই সুরধারার প্রবর্তন সম্পূর্ণ নতুন। কবি নিজে যখন এই গান গাইতেন, তখন হাসতে হাসতে সকলের বুকে-পিঠে খিল ধরে যেত। তা কি শুধু কথার জন্যে? দরাজকণ্ঠে উদীরিত সুরের জন্যেই প্রধানত। গানগুলি শুধু পড়লেই হাসি পায়। আবৃত্তি শুনলে সে হাসির উদ্দীপনা বাড়ে। কিন্তু এর আসল সুরে গাওয়া শুনলে হেসে গড়িয়ে পড়তে হয়। সুরকার কবি নিজে যখন গাইতেন, তখন অট্টহাস্য রোধ করা কঠিন হতো। বাণী ও সুরের অপূর্ব সম্মিলন যে কী অদ্ভুত হাস্যরসের সৃষ্টি করতে পারত তা  একেবারে অজ্ঞাত ছিল।’ ব্যঙ্গের আঘাত কী তীব্র হতে পারে, হতে পারে মর্মভেদী, বকধার্মিকতা কীভাবে উন্মোচিত হতে পারে, নিচের গানটি থেকে তা উপলব্ধি করা যায় :

যদি চোরই হও, কি ডাকাত হও, তা গঙ্গায় দেও গে ডুব, আর গয়া, কাশী, পুরী যাও সে পুণ্যি হবে খুব; আর মদ্য, মাংস খাও – বা যদি হ’য়ে পড় শৈব; আর না খাও যদি বৈষ্ণব হও; – এর গুণ কত কৈব। (কোরাস) – ছেড়োনাক এমন ধর্ম, ছেড়োনাক ভাই, এমন ধর্ম নাই আর দাদা, এমন ধর্ম নাই।

নর-নারীর প্রেম-রোমাঞ্চকে কটাক্ষ করেও দ্বিজেন্দ্রলাল লিখেছেন অনেক হাসির গান। রোমান্টিক ও ভাবপ্রবণ প্রেমধারণাকে তিনি ব্যঙ্গের কশাঘাতে রক্তাক্ত করেছেন – নির্মাণ করেছেন প্রেমের ক্ষেত্রে গদ্যের বাস্তবতা। বিয়ের অব্যবহিত পরে যে নারীকে মনে হয়েছিল ঊর্বশী, ক্রমে সে পরিণত হলো এক যন্ত্রণাময় মাংসপিন্ডে, তারই নিপুণ ব্যঞ্জনা এই সংগীত :

দেখলাম পরে প্রিয়ার সঙ্গে হলে আরো পরিচয়,

উর্বশীর ন্যায় মোটেই প্রিয়ার উড়ে যাবার গতিক নয়;

বরং শেষে মাথার রতন লেপ্টে রইলেন আঠার মতন,

বিফল চেষ্টা বিফল যতন, স্বর্গ হতে হল পতন –

রচেছিলাম যাহারে

ভাবলাম বাহা বাহারে।

সমাজসত্যকে কবিতা ও গানের যুগলবন্দিতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপনে দ্বিজেন্দ্রলালের জুড়ি নেই। তাঁর এ-ধরনের সৃষ্টিকে প্রথম পাঠে নির্মল কৌতুকই মনে হয়। কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণেই প্রতিভাত হবে ওই নির্মল কৌতুকের আবরণে দ্বিজেন্দ্রলাল তুলে ধরেছেন কী নির্মম সমাজসত্য। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, তাঁর ‘নন্দলাল’ শীর্ষক রচনা। ওই রচনায় নন্দলালের ঠুনকো দেশপ্রেম ও সমাজকল্যাণ বাসনা নিয়ে কৌতুকরস বাঙালি স্কুল-শিক্ষার্থীর একটা প্রিয় অনুষঙ্গ। বড় উপভোগ্য দ্বিজেন্দ্রলালের এই কৌতুক ও ব্যঙ্গ :

নন্দ ত একদা একটা করিল ভীষণ পণ –

স্বদেশের তরে, যা’ করেই হোক, রাখিবে সে জীবন।

সকলে বলিল, ‘আ-হা-হা কর কি, কর কি নন্দলাল?’

নন্দ বলিল, ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?

আমি না করিলে, কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’

তখন সকলে বলিল, – বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।

… …. ….

নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;

চড়িত না গাড়ী, কি জানি কখন উলটায় গাড়ীখানি;

নৌকা ফি সব ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিশন’ হয়;

হাঁটিতে সর্প কুক্কুর আর গাড়ী-চাপা-পড়া ভয়;

তাই শুয়ে-শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল।

সকলে বলিল, – ভ্যালারে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।

নির্মম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হাস্য-কৌতুক মৌল প্রবণতা হলেও এইসব ভাবের মধ্যেই দ্বিজেন্দ্রলালের গান সীমাবদ্ধ নয়। দ্বিজেন্দ্রলালের ছিল একটি সহানুভূতিপূর্ণ আবেগসিক্ত শিল্পীচিত্ত। ওই শিল্পীচিত্তের আন্তরটানে মানুষের সামূহিক ঋদ্ধির স্বপ্ন দেখেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। সামাজিক-সাংসারিক-জাগতিক অসংগতি দেখে অসহায় মানসতায় কখনো-বা দ্বিজেন্দ্রলাল রচনা করেছেন নির্ভেজাল রঙ্গরস – ‘বাহবা দুনিয়া কি মজাদার রঙিন।/ দিনের পরে রাত্তির আসে, রেতের পরে দিন।/ গ্রীষ্মকালে বেজায় গরম, শীতকালেতে ঠান্ডা;/ একের পিঠে দুয়ে বারো, দুই আর একে তিন।/ শিয়াল ডাকে হোয়া হোয়া,/ আর গরু ডাকে হাম্বা,/ হাতীর উপর হাওদা আবার/ ঘোড়ার উপর জিন।’ দ্বিজেন্দ্রলালের অনেক হাসির গানের শিল্প-উপকরণ স্থূল, কিন্তু জীবনার্থের প্রভাবে এই শিল্প-উপাদানগুলোকে কালোত্তীর্ণ সৃষ্টির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। তাঁর এই সাংগীতিক প্রবণতা সম্পর্কে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের কথা স্মরণ করা যায় :

… ভন্ডামি ও বোকামির পিছনে রহিয়াছে চিরন্তন মানবাত্মা, যে আত্মা শিশুর মতো অসহায় ও সরল, একটু কৃত্রিম বা খাঁটি আনন্দ, সৌন্দর্য, উল্লাস দিয়া খেলাঘর সাজাইতে সর্বদাই ব্যস্ত। এই খেলাঘর বিধাতার নিষ্ঠুর আঘাতে ভাঙিয়া যাইতেছে, সেইজন্য মানুষের চিরন্তন ক্রন্দন। এই ক্রন্দনের রোল ‘হাসির গান’-এর প্রতি মূর্ছনায় ও ঝঙ্কারে ধ্বনিত হইতেছে।

হাসির গান ছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল প্রেম, প্রকৃতি, ঈশ্বর, স্বদেশবন্দনা প্রভৃতি ভাব নিয়ে অনেক গান রচনা করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রকৃতি-বিষয়ক গানগুলোতে মানবাত্মার সঙ্গে প্রকৃতিকে ঐকাত্ম্যসত্তায় দেখার একটা আকাঙ্ক্ষা ভাষারূপ পেয়েছে। তাঁর ঈশ্বর-বিষয়ক গানগুলোতে শিল্পিতা পেয়েছে একধরনের আচ্ছন্নতাবোধ ও সমর্পণবাসনা। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রেম-বিষয়ক গানে মানবাত্মার সুপ্ত বিরহচেতনাই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাঁর এ-ধরনের গানের প্রধান স্বরটাই যেন এমন – ‘দুঃখশোক পরিপূর্ণ এই ধরাতলে।/ আসে নরগণ হেথা কাঁদিতে কেবল।’

দ্বিজেন্দ্রলাল দেশপ্রেম নিয়ে খুব যে গান লিখেছেন, এমন নয়। তাঁর এ-ধারার গানের সংখ্যা পঞ্চাশের কম। তবু ওই স্বল্পসংখ্যক গানের মধ্য দিয়েই দেশের প্রতি, দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দ্বিজেন্দ্রলালের অন্তরমথিত ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে। দেশের প্রতি মানুষের উদাসীনতাকে আঘাত করতে চেয়েছেন তিনি। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তিনি গেয়েছেন অখন্ড বাংলার চিরায়ত এক বন্দনা, নির্মাণ করেছেন রূপসী বাংলার শাশ্বত এক ছবি :

ধন ধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা

তাহার মাঝে আছে দেশ এক –

সকল দেশের সেরা; –

ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ

স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না ক তুমি,

সকল দেশের রানী সে যে –

আমার জন্মভূমি।

দেশবন্দনার গীত রচনায় দ্বিজেন্দ্রনালাল পূর্বসূরি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কেই প্রধানত অনুসরণ করেছেন। দেশগৌরব, নিসর্গশোভা, মাতৃভাষা-বন্দনা, দেশকে জননী হিসেবে কল্পনা, জন্মধন্যতাবোধ – এসব বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল পূর্বসূরিকে মান্য করেছেন। কিন্তু গানের সুর রচনায় তিনি স্বতন্ত্র রীতি অনুসরণ করেছেন। রাগসংগীতের সঙ্গে প্রতীচ্যের সুরপ্রয়োগ রীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে সুরবাহিত উল্লাস আর উদ্দীপনার ব্যঞ্জনা সৃষ্টিই দ্বিজেন্দ্রলালের অনুসৃত সুর-পদ্ধতির মৌল বৈশিষ্ট্য। বাংলা গানের সুর-পদ্ধতিতে এই বৈশিষ্ট্য ইতঃপূর্বে আর কারো গানে লক্ষ করা যায়নি। প্রসঙ্গত কালিদাস রায় জানাচ্ছেন – ‘সঙ্গীতের এই প্রাণোচ্ছল শক্তি আমাদের দেশে ছিল না। দ্বিজেন্দ্রলাল এই প্রাণশক্তি ইউরোপীয় সংগীত থেকে আত্মসাৎ করে বাংলা গানে সঞ্চার করেছেন। এই গীতগুলির অধিকাংশই কোরাসগর্ভ গীত। এই গানগুলি যখন নানা রঙ্গমঞ্চে গাওয়া হতো, তাতে উদাত্ত গম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হতো। যে সভামন্ডপে গাওয়া হতো সে মন্ডপ যেন গম্বুজের তলের মতো গম-গম করত। যে পথে গাওয়া হতো সে পথ যেন সুরঙ্গায় পরিণত হতো।’ ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’, ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে’, ‘আছি গো তোমার চরণে জননী’ এসব গানের উল্লেখ করে কালিদাস লিখেছেন :

এই গানগুলির সুর বেশ সরল বটে। কিন্তু এদের সুরের উত্থানপতনের সঞ্চলন খুব সহজ নয়। বিলাতি সুরে যাকে বলে মুভমেন্ট, তা দ্বিজেন্দ্রলালই প্রথম এদেশের সুরে প্রবর্তন করেন। আমাদের দেশে সুরের বিস্তার হয় সচরাচর ধীরে সুস্থে, উদ্দীপনা বা উন্মাদনায় নয়। দ্বিজেন্দ্রলালই লক্ষ্য করেন, উন্মাদনার বা মাতামাতিরও সার্থকতা আছে, এতে স্বরগ্রামের পরিধি বা পরিসর বিস্তৃত হয় এবং এতে সুরের মধ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়। এই গানগুলিতে দ্বিজেন্দ্রলাল কেবল উন্মাদনা নয়, সুর সঞ্চরণের পরিসরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই সকল গানেই সুরকার হিসেবে কবির প্রতিভার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

– রাগসংগীতের আশ্রয়ে প্রতীচ্য সংগীতের উত্থান-পতন এবং স্বরগ্রামের বৈচিত্র্য ও স্বরবিরাম মিশিয়ে বাংলা দেশবন্দনার গানে দ্বিজেন্দ্রলাল যে নতুন মাত্রা সঞ্চার করেছিলেন, তার তুল্য দৃষ্টান্ত তাঁর পূর্বেও লক্ষ করা যায়নি, পরেও নয়।

বাংলা প্যারোডি গানের ধারায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কৃতিত্ব অসামান্য। অনেক বিখ্যাত গান ও কবিতা অবলম্বন করে তিনি উৎকৃষ্ট প্যারোডি রচনা করেছেন। হাসির গানের ‘এস এস বঁধু এস’ গানটি একটি বিখ্যাত বৈষ্ণব পদের ব্যঙ্গানুকৃতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী কাব্যের ‘তোমরা ও আমরা’ কবিতা ভেঙে দ্বিজেন্দ্রলাল রচনা করেন দুটি সার্থক প্যারোডি  – ‘আমরা ও তোমরা’ এবং ‘তোমরা ও আমরা’। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের দুটো রচনাংশ উদ্ধৃত করলেই প্যারোডি রচনায় তাঁর সার্থকতা অনুধাবন করা যাবে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা :

আমরা বৃহৎ অবোধ ঝড়ের মতো,

আপন আবেগে ছুটিয়া চলিয়া আসি।

বিপুল আঁধারে অসীম আকাশ ছেয়ে

টুটিবারে চাহি আপন হৃদয়রাশি।

তোমরা বিজুলি হাসিতে হাসিতে চাও,

আঁধার ছেদিয়া মরম বিঁধিয়া দাও,

গগনের গায়ে আগুনের রেখা আঁকি

চকিত চরণে চলে যাও দিয়ে ফাঁকি।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্যারোডি :

আমরা খাটিয়া বহিয়া আনিয়া দেই –

আর তোমরা বসিয়া খাও।

আমরা দুপুরে আপিসে ঘামিয়া মরি –

আর তোমরা নিদ্রা যাও।

বিপদে আপদে আমরাই প’ড়ে লড়ি,

তোমরা গহনাপত্র ও টাকা কড়ি

অমায়িকভাবে গুজায়ে পাল্কী চড়ি’ –

দ্রুত চম্পট দাও।

কেবল ভাবসম্পদ নয়, গানের সুর-সৃষ্টিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রেখেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভার স্বাক্ষর। সুররচনা পদ্ধতিতে দ্বিজেন্দ্রলাল সাধন করেছেন মৌলিক পরিবর্তন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রেমসংগীতগুলোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বাংলা প্রেমসংগীতের ধারায় প্রাক-দ্বিজেন্দ্র যুগে টপ্পা বা টপ্পাঙ্গ সুরের একাধিপত্য চলছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল ঘুরিয়ে দেন এই ধারা। টপ্পার পাশাপাশি তিনি খেয়াল এবং টপ খেয়ালের সাংগীতিক বৈশিষ্ট্য বাংলা প্রেমগীতিতে সংযুক্ত করেন। তাঁর গানে কীর্তন এবং লোকসংগীতের নানামাত্রিক প্রভাবের কথাও বলা যায়। কোনো কোনো গানে নৈপুণ্যের সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্য সংগীতের ঢং সমীকৃত করে দিয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতের প্রধান অবলম্বন ছিল রাগসংগীতের রূপবন্ধ। ‘কি দিয়ে সাজাব মধুর মুরতি’, ‘এ জীবনে পুরিল না সাধ ভালোবাসি’, ‘সে মুখ কেন অহরহ মনে পড়ে’, ‘যদি এসেছো এসেছো বঁধু হে’, ‘এস প্রাণসখা এস প্রাণে’, ‘আমি রব চিরদিন তব পথ চাহি’, ‘তোমারেই ভালোবেসেছি আমি’, ‘তুমি হে আমার হৃদয়েশ্বর’ – এসব গানে সুরসৃষ্টিতে দ্বিজেন্দ্রলালের রাগসাংগীতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ সুস্পষ্ট।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় হাজার বছরের বাংলা কাব্য-সংগীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। গানের বিষয় এবং আঙ্গিক, ঢং এবং সুরসৃষ্টি – সবক্ষেত্রেই দ্বিজেন্দ্রলাল রেখেছেন তাঁর প্রাতিস্বিক প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর জন্মের সার্ধশত বছর পরে, মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও তাই তিনি এখনো সমান প্রাসঙ্গিক বাংলাভাষী মানুষের কাছে। দ্বিজেন্দ্রলালের গান, বাঙালি সংগীতপিপাসুদের এখনো পরম আশ্রয় – এখানেই তাঁর কালোত্তীর্ণ প্রাসঙ্গিকতা। r