সমাজসচেতন শিল্পী চিত্তপ্রসাদ

শরীফ আতিক-উজ-জামান

 

চিত্তপ্রসাদ (১৯১৫-৭৮) বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মানুষ, জন্মেছিলেন ১৯১৫ সালে নৈহাটিতে। ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু কখনো নামের সঙ্গে ভট্টাচার্য উপাধি ব্যবহার করেননি। কোনো পৈতেও পরতেন না। জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে এ ছিল তাঁর নিজস্ব ও নীরব এক প্রতিবাদ। প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে তিনি সারাজীবন পথ চলেছেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। পরিবারের ইচ্ছায় চিকিৎসক বা কাকার ইচ্ছায় ব্যবসায়ী কোনোটাই হওয়া হয়নি তাঁর। শিল্পের প্রতি যাঁর আগ্রহ আবাল্য, চিত্রী হওয়াটাই তাঁর ভবিতব্য। সেজন্য প্রয়োজন পড়েনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। এরকম একজন মেধাবী শিল্পীকে কলকাতার আর্টস্কুল বা শান্তিনিকেতনের কলাভবন ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। একেবারে স্বশিক্ষিত শিল্পী তিনি। একবার নন্দলাল বসুর কাছে আঁকা শিখতে গিয়েছিলেন। তাঁর ছবি দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার তো শেখা হয়ে গেছে – নতুন করে আর শিখবে কী?’ এই কথার মধ্যে প্রশংসা না তাচ্ছিল্য ছিল, আমরা জানি না। তবে নন্দলাল তাঁকে আঁকা শেখাননি, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তা তাঁর শিল্পী হওয়ার পথে কোনো অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। কলেজে পড়ার সময় থেকেই জাতীয় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া চিত্তপ্রসাদ পোস্টার, ড্রয়িং, ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে থাকেন। এ-সময়ই অগ্নিযুগের বিপস্নবী পুর্ণেন্দু দসিত্মদার তাঁকে দলে টেনে নেন। ১৯৪০  সালে  (মতান্তরে ১৯৪১) তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সে-সময় যুদ্ধ চলছিল। মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত, অনাহারক্লিষ্ট। চট্টগ্রাম শহর থেকে বেরিয়ে তিনি ঘুরতে লাগলেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তুলির আঁচড়ে তুলে আনতে লাগলেন বুভুক্ষু-অসহায় মানুষের সংকটময় অবস্থা। চট্টগ্রাম থেকে কমিউনিস্ট ছাত্রনেতারা তাঁকে এনে ছাত্র ফেডারেশনের আসত্মানা কলকাতার কলাবাগানের একটি দোতলা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তাঁর ছবি তখন ছাপা হতে লাগল জনযুদ্ধপিপল্স ওয়্যার পত্রিকায়, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতে।

১৯৪৩ সালে তিনি পার্টি থেকে দুর্ভিক্ষ, দামোদরের বন্যা ও মেদিনীপুরের সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব পেলেন। মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে লিখলেন হাঙ্গরি বেঙ্গল। আঁকা ছবি আর ঘটনার বিবরণে প্রকাশিত সে-বই ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। তবে ‘চট্টগ্রামের পর মেদিনীপুরের এই মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতাই নিয়ন্ত্রণ করেছে চিত্তপ্রসাদের জীবন ও মনন শেষদিন পর্যন্ত।’ বিজন চৌধুরীও তেমনি মনে করেন। তাঁর সম্পর্কে এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন :

আসে দুর্ভিক্ষ ও ১৩৫০ সালের মহামন্বন্তর। … চিত্তপ্রসাদ এইসময়ে রাজনীতি সচেতন শিল্পী হিসেবেই তাঁর দায় পালন করছিলেন এই আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে অসংখ্য সাদা-কালো রঙের চিত্র এঁকে। এইসময় অনেক চিত্রেই তাঁর পূর্বের উলিস্নখিত অংকনশৈলীর কিছু পরিবর্তনও ঘটে। কার্টুন ও ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় একজন সমালোচকের ভূমিকায় শিল্পীকে আমরা দেখতে পাই। প্রকাশরূপেতে আসে কল্পিত প্রতীকের ব্যবহার ও আকৃতি বিকৃতকরণ।

সে-কারণেই তিনি হয়ে রইলেন মন্বন্তরের শিল্পী। ১৯৪৬ সালে তেভাগার ঠিক আগে পি সি যোশী তাঁকে মুম্বাই নিয়ে না গেলে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা তেভাগার চিত্র পেতাম, যা হতো বাংলার চিত্রকলার মূল্যবান সম্পদ। তবু যে-চিত্রগুলো তিনি এঁকেছেন তার মধ্যে ‘তেভাগার প্রতিরোধ’, ‘ফসলের অধিকার’ শিরোনামের ছবি দুটি ছাড়াও শিরোনামহীন আরো কয়েকটি ছবি দেখতে পাই। ছবিগুলোর প্রতিটিতে আন্দোলনের সময়কার আবহ ফুটে উঠেছে। কালি-তুলিতে আঁকা ‘তেভাগার প্রতিরোধ’ ছবিটাতে দেখতে পাই, সন্তানের মমতায় কর্তিত ধানের আঁটি বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বসে আছে এক কৃষকরমণী, আর তার পাশে লাঠি হাতে পাহারায় এক যুবক কৃষক। অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কী অসাধারণ জীবন্ত প্রতিচ্ছবি! ‘ফসলের অধিকার’ ছবিটাতে দেখতে পাই ফসলের মাঠে পড়ে থাকা প্রাণহীন এক কৃষকের দেহ, বুকের তলে কর্তিত ধানের গোছা, কাস্তেটা তখনো ডান হাতে ধরা, বাঁহাত মুষ্টিবদ্ধ, বুকের নিচ থেকে রক্তের ধারা বয়ে চলেছে, ভিজিয়ে দিয়েছে সবুজ ধান, পাশে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরা লাঠি নিয়ে ছুটে চলেছেন সুঠাম দেহের কৃষক শত্রম্নর মোকাবেলায়, আর এ-দুটি ফিগরের মাঝে একটি নারীমূর্তি বাঁহাতে একটি ঝান্ডা নিয়ে ছুটে চলেছে সামনে। ছবিটির এই নারীমূর্তি মনে করিয়ে দেয়, ১৮৩০ সালে ফরাসি চিত্রকর ইউজেন দেলাক্রোয়ার আঁকা ‘লিবার্টি’ ছবিটির কথা। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মৃতদেহ ডিঙিয়ে প্রবল বিক্রমে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন এক নারী, যার ডান হাতে ঝান্ডা আর বাঁহাতে রাইফেল। অসাধারণ প্রতিবাদী চেতনার ধারক ছবিটি। চিত্তপ্রসাদ ছবিদুটি এঁকেছিলেন তেভাগার অনেক পরে। ‘তেভাগার প্রতিরোধ’ ১৯৫১ সালে, আর ‘ফসলের অধিকার’ ১৯৫৭ সালে। অন্য ছবিগুলোর একটিতে দেখতে পাই বিসত্মীর্ণ ফসলের মাঠ, একপাশে এক কৃষক রমণী ধান কাটছেন, অন্য আরেক রমণী আঁটি বাঁধছেন, তার পাশে জড়ো করা হচ্ছে ধান, তা ঘিরে বসে আছেন সতর্ক কৃষক, পাশে লাঠি হাতে দণ্ডায়মান কিষানি। অন্য একটি ছবিতে দেখতে পাই, কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা ঝান্ডা পুঁতে জমির সীমানা নির্ধারণ করে ধানকাটা চলছে। কিষানি ধান কাটছেন, পাশে লাঠি হাতে পাহারায় সুঠামদেহী কৃষক, কাটা ধান আঁটি বেঁধে মাথায় তুলে নিরাপদ গন্তব্যে ছুটছেন তারা, একহাতে মাথার আঁটি সামলাচ্ছেন, অন্য হাতে নিরাপত্তার জন্য বহন করছেন বাঁশের লাঠি। অসিত্মত্বের সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ে কৃতসংকল্প কৃষকের প্রত্যয়ী চিত্র। অন্য আরেকটি ছবিতে রাইফেল তাক করে অবস্থান নেওয়া পুলিশের মুখোমুখি লাঠি হাতে প্রতিরোধ-উদ্যত জনতা, গুলিতে একজন লুটিয়ে পড়েছে। আন্দোলনের সময় পুলিশি বর্বরতার চূড়ান্তরূপ এই চিত্রে ধরা পড়েছে। বস্ত্তত স্বল্প হলেও চিত্তপ্রসাদ তেভাগা আন্দোলনের যে- ছবি এঁকেছেন তা সে-সময়কার পরিস্থিতির অনেকটাই আমাদের উপলব্ধিতে এনে দেয়। কিন্তু শিল্পী চিত্তপ্রসাদের মূল্যায়নে তাঁর তেভাগার ছবি নিয়ে সমালোচকরা কোনো মন্তব্য করেন না। যেমন, রণজিৎ সিং চিত্তপ্রসাদের ছবির বিষয়বস্ত্ত নিয়ে যে-মন্তব্য করেছেন তা পড়লে মনে হবে চিত্তপ্রসাদ নিছকই আটপৌরে জীবনের শিল্পী, যিনি জীবনের সুখময় আনন্দঘন দিকগুলোই তুলে ধরতে চেয়েছেন। তার লেখনী থেকে আমরা তেমনই একটি চিত্র পাই :

শিল্পী চিত্তপ্রসাদ তাঁর সময়ের বিসত্মৃত ভূখ- হেঁটে ঘুরেছেন। মানবজীবনকে তার পরিম-লে দেখেছেন। পূর্ণতার অভিযাত্রী মানুষ তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে। তাঁর শিশু আর ফুল পরস্পরের প্রতিকল্প। পূর্ণতার সৃষ্টি তারা। তাঁর শিশুরা বিশ্বের অঙ্গনে বসে শান্তির সেস্নাগান লেখে, তাদের মধ্যে মানবজাতির সকল ভাষার আদান-প্রদান চলে। তাঁর শিশুরা অভুক্ত থেকেও, প্রহৃত হয়েও, খাটুনির ধকলে ঘুমিয়ে পড়েও রূপকথার রাজ্যে চলে যায়। আর কী স্বাস্থ্যময়, প্রসন্ন আর ঢলোঢলো মুখের সেসব শিশু। তাঁর ছবির বন্ধনীর মধ্যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, তৈজস, আসবাব, খেলনা, আলপনা, লতা, পাতা, ফুল, ফসলের গোছা রূপময় হয়ে ওঠে। তাঁর গৃহবধূ-পোশাকে ও অলংকারে সুন্দরভাবে সেজে, ছোট্ট ছেলের দেওয়ালির প্রদীপধরা দুটি হাত, সযত্নে ধরে রাখেন, প্রদীপশিখার আলোয় শিশু আর জননীর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। ওই প্রদীপের আর পেছনের শহরের বাড়িগুলির অসংখ্য প্রদীপের আলো আকাশকে উদ্ভাসিত করে।

কিন্তু এই মন্তব্য খ–ত। চিত্তপ্রসাদ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনের দুর্দশা ও দ্রোহ দেখেছিলেন। সেই দ্রোহের কাহিনি চিত্রিত করেছিলেন। কিন্তু তা কেন এই সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল বোধগম্য নয়। চিত্তপ্রসাদের শৈলী নিয়ে দু-একটি কথা না বললেই নয়। তাঁর ছবির মানুষরা খুবই স্বাস্থ্যবান। হাত-পা মোটা মোটা, প্রচলিত অ্যানাটমিকে অনুসরণ করে আঁকা নয়। মানুষের ভেতরের শক্তির দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ প্রদান করেছেন তাকে অস্বাভাবিক আকৃতিতে চিত্রায়ণের মাধ্যমে। এ-কথার সমর্থন মেলে বিজন চৌধুরীর মন্তব্যে :

বাস্তবতা তাঁর চিত্রে অন্যভাবে উপস্থিত হয়েছে বারবার। বিষয় ও মানুষের আয়তন বাড়িয়ে, বলিষ্ঠ গতিবেগ সঞ্চারিত করে, প্রচলিত চিত্রপ্রকাশভঙ্গির যে গ– তার বাইরেই থেকেছেন চিত্তপ্রসাদ। কোনো সনাতনী ও নিশ্চল শিল্পকলাশৈলী বন্ধন তাঁর ছিল না। এসব কারণে শিল্পী হিসেবে চিত্তপ্রসাদ আধুনিক ছিলেন বলা অসংগত হয় না।

বস্ত্তত চিত্তপ্রসাদ তাঁর লালিত বিপস্নবী-চেতনার কারণে সক্রিয় অংশগ্রহণ বা প্রত্যক্ষ অবলোকন ছাড়া তেভাগার যে-চিত্র রচনা করেছেন তা সময়ের বিচারে আজ আমাদের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু অন্য শিল্পীরা তখন বা পরবর্তীকালে কেন তেভাগা নিয়ে চিত্রসৃষ্টি করলেন না তার ব্যাখ্যা মেলা ভার। ফলে চিত্রকলায় তেভাগা উপেক্ষিতই থেকে গেল বলা চলে।

চিত্তপ্রসাদও যে খুব বেশি ছবি এঁকেছিলেন তা নয়, কয়েকখানা মাত্র। তাও আবার আন্দোলনের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে নয়। তেভাগা যখন সংঘটিত হয়, চিত্তপ্রসাদ তখন বাংলা থেকে অনেক দূরে মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে। বাংলায় থাকলে নিশ্চয় তিনি আন্দোলনের অভিঘাতকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। না, শুধুমাত্র পার্টির সদস্য ছিলেন বলেই নয়। তার চেতনায় মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য যে-দরদ ছিল তাই ছিল তাঁর সৃষ্টির নিয়ামক। মুম্বাইয়ের শ্রমিক সমাবেশে পুলিশের গুলিতে আহত এক মজুরকে বুকে টেনে নিয়ে দীর্ঘদেহী যে-মানুষ উঁচু লোহার রেলিং ডিঙিয়ে যেতে পারেন, ’৫০-এর মন্বন্তরের সময় যিনি চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুরের গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে মন্বন্তরের ঘটনা টুকে আনতেন, করে আনতেন স্কেচ, তেভাগার মতো খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রাম তার চিত্তে নাড়া দিত এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্দোলন থেকে সহস্র মাইল দূরে অবস্থান করায় তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক কোনো ছবি আমরা পাই না। যা পাই তা কল্পনানির্ভর। আর হয়তো সে-কারণেই তিনি দুর্ভিক্ষের চিত্রী হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তাঁকে নিয়ে বিজন চৌধুরী, রণজিৎ সিং বা মুরারি গুপ্তের লেখা প্রবন্ধে তাঁর তেভাগাবিষয়ক কোনো ছবির উলেস্নখই দেখতে পাই না। ব্যতিক্রম শুধু অশোক ভট্টাচার্য। তিনিও মন্তব্য করেছেন, ‘কৃষকসভার তেভাগা আন্দোলনের ওপর আঁকা প্রত্যক্ষ ছবিও তাঁর নেই তেমন, যেমন ছিল দুর্ভিক্ষের সময়কার কৃষকদের দুর্দশার সাড়া জাগানো ছবি।’ দুর্ভিক্ষের ছবি তিনি বেশি এঁকেছেন এ-কথা সত্য। ‘দুর্ভিক্ষের কবলে মেদিনীপুর’, ‘দুর্ভিক্ষের কবলে কন্টাই’ শিরোনামে তাঁর একাধিক ছবি রয়েছে। কালি-তুলিতে করা ছবিগুলোতে নিরন্ন মানুষ, বিবর্ণ গ্রাম-জনপদ, অভাবের তাড়নায় গরু, কাঁসার ঘটিবাটি, কলসি ইত্যাদি শেষ সম্বল বন্ধক রাখার জন্য সুদখোর মহাজনের দরজায় অভাবী মানুষ, মৃত মানুষের মাথার খুলি-হাড়গোড় এঁকে আকালের ভয়াবহতা তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। দুর্ভিক্ষ কীভাবে তাঁকে বিপর্যস্ত করেছিল তার বর্ণনা পাই তাঁর বোন গৌরীর বয়ানে,

…দাদা ফিরত অনেক রাতে। পরিশ্রান্ত উস্কোখুস্কো চুল, ময়লা ধুলোভরা জামাচটি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মায়ের ঘরে বসে বলত সারাদিন যা দেখেছে যা শুনেছে যা জেনেছ তার মর্মান্তিক কাহিনী, ব্যাগ থেকে বের করত খাতা, কাগজ, ওতে অজস্র ছবি আঁকা। গ্রাম-গ্রামান্তরে হেঁটে হেঁটে লিখে আনা ঘটনা, এঁকে আনা ছবি একে একে দেখাত মাকে, পড়তে পড়তে গলা ধরে যেত দাদার, আর মা কাঁদেন ছবি দেখে আর ঘটনা শুনে।

চিত্তপ্রসাদের শিল্পী ও রাজনৈতিক সত্তা এক কথায় অভিন্ন। গণনাট্য সংঘের প্রতীকটির স্রষ্টাও তিনি। লিনোকাটে করা ‘খরার কবলে কোলাপুর’, ‘বন্যার কবলে,’ ‘বিশ্বশান্তির পক্ষে’ প্রভৃতি ছবি মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ সহমর্মিতার প্রকাশ। মার্কসবাদের দীক্ষা তাঁকে শোষিত শ্রেণির শিল্পী করে তুলেছিল হয়তো; কিন্তু এর মাঝেও তিনি লিনোকাটে করেছেন ‘মা’, ‘মা ও শিশু’, ‘ফসলকাটা’, ‘নিসর্গ’র মতো অসামান্য সব জীবনমুখী ছবি। এক পর্যায়ে দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভেঙে গেল। তবে যে-আদর্শ নিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীসত্তা গড়েছিলেন তা থেকে সরে আসতে পারলেন না, সম্ভব ছিল না। দলের অনেকেই তাঁর কাছে আসতেন, যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। সে-কারণেই ক্রশ রোড নামে দলের যে-সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ছিল তাতে নিয়মিত ছবি আঁকতেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই চিত্তপ্রসাদ ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লিনোকাট মাধ্যমটি নিয়ে তিনি খুবই আশাবাদী ছিলেন। ‘লিনোকাট অবলম্বন করে একটা কিছু খাড়া করার বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। কারণ লিনোকাট দিয়ে কম খরচে কম সময়ে সারা দেশময় সারা পৃথিবীময় ছবি অর্থাৎ এদেশের কাহিনি ছড়িয়ে দেওয়া যায়।’ তখন থেকে লিনোকাটই হয়ে ওঠে তাঁর প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। এরপর পুতুলনাচের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এর জন্য বেছে নিয়েছিলেন গোপাল ভাঁড়কে। কিন্তু পুতুলনাচের মাধ্যমে নাটক মঞ্চস্থের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো না। পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিশ্রুতিদানকারীরা পিছুটান দেওয়ায় তিনি হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলেন। স্টোরি অব ইন্ডিয়া এবং বাংলার ইতিহাসের ছবির বই করার পরিকল্পনায়ও হাত দিতে পারেননি। ব্যক্তিজীবনের ভালোবাসাও পরিণতি লাভ করল না, কিন্তু তাতে তাঁর সৃষ্টিশীলতা থেমে থাকেনি। লিনোকাটের সঙ্গে প্যাস্টেল, জলরঙে এঁকেছেন নিসর্গ ও চেনা আটপৌরে জীবন।

চিত্তপ্রসাদকে শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষের চিত্রী হিসেবে চিত্রায়ণে অধিক আগ্রহ তাঁর অন্য সৃষ্টিসম্ভারকে খানিকটাও হলেও আড়াল করে। একজন শিল্পীর সৃষ্টির গায়ে বিশেষ ধারা বা সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার মোহর লেগে গেলে তা মুছে ফেলে নতুন পরিচয় নির্মাণ করা বেশ মুশকিলই। চিত্তপ্রসাদ দুর্ভিক্ষের ছবি বেশি এঁকেছেন হয়তো, কিন্তু খেলনাহাতি, বেত বোনা, দৌড়, ফসলকাটা, রাখালছেলে, রামায়ণ চিত্রণ, ফুল ইত্যাদি ছবি দেখলে এ-ধারণা পাল্টে যেতে বাধ্য।

শৈলীর ক্ষেত্রে তিনি বাংলার লোকচিত্রকলার শৈলীকে বেছে নিয়েছিলেন। সাদা-কালোতে নারী-পুরুষ-শিশু, খরা, বন্যা, রামায়ণ ইত্যাদি ছবিতে তাঁর নিজস্ব অ্যানাটমি দৃষ্টি কাড়ে। জীবিতাবস্থায়ই তাঁর খ্যাতি দেশের গ– ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। চেকোসেস্নাভাকিয়া, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু দেশে কতটুকু মূল্য পেয়েছেন? মাত্র দুটি প্রদর্শনী তাঁর শিল্পসম্ভার ও শিল্পীসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে দর্শকদের কাছে তুলে ধরেনি। ৬৪ বছর বয়সে কলকাতায় একপ্রকার নিভৃতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর গুণমুগ্ধ ও অনুসারীর সংখ্যাও খুবই স্বল্প। তবে তাতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। আজো তাই চিত্তপ্রসাদ জরুরি।

 

তথ্যসূত্র

 

১. অশোক ভট্টাচার্য, কালচেতনার শিল্পী, কলকাতা, জানুয়ারি

২০০৩, পৃ ৭৬।

২. প্রাগুক্ত, পৃ ৫২।

৩. বিজন চৌধুরী, ‘চিত্তপ্রসাদ আজও একান্ত প্রাসঙ্গিক’, পরিচয়,

১৯৯৪, ৬৪ বর্ষ ৪-৫ সংখ্যা, পৃ ১০৯।

৪. রণজিৎ সিং, চিত্তপ্রসাদ, প্রগতির পথিকেরা, সম্পাদনা

দেবাশিস সেনগুপ্ত, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ ৯৭।

৫. বিজন চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ ১১০।

৬. অশোক ভট্টাচার্য, কালচেতনার শিল্পী, কলকাতা, জানুয়ারি

২০০৩, পৃ ৮।

৭. প্রাগুক্ত ৫২।

৮. মুরারি গুপ্তকে লেখা চিত্তপ্রসাদের চিঠি, শারদীয় দেশ, ১৩৮৮, পৃ ১৪।