সম্পর্ক

চব্বিশ মাস ধরে নীপা যেভাবে আজকের দিনটির কথা ভেবে এসেছে, তার সঙ্গে কিছুই তেমন মিলছে না।

ঘরের সাদা দেয়ালে একটা দাগ, সম্ভবত মশা মারতে গিয়ে চেপ্টে দেওয়া হয়েছিল, মুখ থুবড়ে-পড়া ডানাভাঙা, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখলে দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজের মতো দেখাবে। পরিষ্কার দেয়াল বলে দাগটা চোখে পড়ছে। মশা? নাকি অন্য কোনো পোকা! দাগের নিচে ছোট্ট গ্লাস টপ টেবিলের ওপরে রাখা টিভি, সামনে পানির গ্লাস, হাবিজাবি কাগজ, কেনাকাটার রসিদ, মানিব্যাগ খালি করলে যেমনটা বের হয়। ঘরের কোনায় হাতলঅলা কাঠের চেয়ারে ভাঁজ করা কম্বল। নিরাভরণ, কিন্তু কেমন দমবন্ধ ঘর। নীপার মনে হচ্ছে এখানে কোনো বাতাস বইছে না। জানালা খুলে দেবে? বরকে জিজ্ঞেস করে, নাকি না করে?

ওর বর নিচে রাস্তায় বাসেতভাইয়ের গাড়ি থেকে স্যুটকেস উঠিয়ে আনতে গেছে। হয়তো দুজনেই ধরে তুলবে। কাঠের সিঁড়িতে মটমট শব্দ হবে। ঘরের দরজা খোলা, শুনতে পাবে নীপা। ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে; কিন্তু ঘরের কোথাও বিছানা দেখছে না। সঙ্গে লাগোয়া রান্নাঘর, সেখানে গোলাকার খাবার টেবিলের পাশে দুটো চেয়ার। ইলেকট্রিক চুলা বেশ পুরনো, বার্নারগুলোর ধার ঘেঁষে জংধরা। বিদেশের বাড়িঘর, সিনেমা, ছবিতে যেমন দেখেছে তার সঙ্গে রান্নাঘরের জানালার সাদা লেসের পর্দাটাই কেবল চেনা চেনা লাগছে।

ওদের ফিরে আসতে কেন যেন দেরি হচ্ছে। নীপা ফ্রিজের দরজা খোলে, ফস করে বাতি জ্বলে ওঠে ভেতরে। দু-তিনটা হাঁড়ি আর স্ন্যাক্স বাক্সে কীসব যেন রাখা। ফ্রিজের হাতলের সঙ্গে বাঁধা প্লাস্টিক ব্যাগে ময়লা জমানো, ফেলে দেওয়ার সময় পায়নি?

নীপার ক্ষুধাবোধ হয়; কিন্তু তার চেয়ে বেশি ঘুম পায়। মাথার ভেতরে এখনো ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্নোত্তর বিজবিজ করছে। ঢুস ঢুস করে পাসপোর্টে সিল মারার শব্দ পরিষ্কার কানে বাজে।

সে কি সত্যিই কানাডায়, মন্ট্রিলে চলে এসেছে! এ-বাসার জানালা দিয়ে নিচে ব্যস্ত রাস্তা আর ওপর থেকে দূরের পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ের ওপর গম্বুজঅলা গির্জার মাথায় সটান ক্রসচিহ্ন। বাইরের কোনো শব্দ শোনা যায় না, নীপার মনে হচ্ছে সে দূরে কোথাও বেড়াতে এসেছে, পাকাপাকিভাবে থাকতে আসেনি।

স্যুটকেস ওপরে উঠিয়ে বাসেতভাই চেয়ারে বসে একগ্লাস পানি খেয়ে নিজেই তড়িঘড়ি বিদায় নিতে চায়। আবারো তার সঙ্গে নিচে নামতে চাইলে দু-হাতে নিরস্ত করে দরজা টেনে নেমে যায়। নীপার বর এবার দরজা ভালো করে বন্ধ করে। জ্যাকেট খুলে দরজার পেছনে হুকে ঝোলায়। পোলো নেক টি-শার্টের বেড় থেকে সামান্য ভুঁড়ির আভাস নীপার দিকে এগিয়ে আসে। হাতখানেক দূরত্বে এসে থেমেও যায়। নীপাকে বলে – ‘টায়ার্ড হয়ে গেছ? আমিও। আজকে বরং চলো ঘুমিয়ে পড়ি। দৌড়াদৌড়ি হবে জানতাম, তাই ছুটি নিলাম কালকে। বেলা করে ঘুম থেকে উঠব।’

বাসেতভাই ওদের জন্য রাতের খাবার এনে দিয়ে গেছে। ‘কেএফসি’ বলে হাসিমুখে কাগজের প্যাকেট খোলে নীপার বর। তারপর চেয়ার টেনে বসে ঘাড় বাঁকা করে খেতে শুরু করে, বোঝা যায় তার ক্ষিদে পেয়েছে। বাসেতভাইয়ের বউ আর মেয়ে দেশে বেড়াতে গেছে, তা না হলে নাকি রীতিমতো দাওয়াত দিয়ে পোলাও-কোরমা রেঁধে খাওয়াত।

ভাত খেতে ইচ্ছা করছে নীপার, একটু ডাল কিংবা ডিমভাজা দিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর এক সপ্তাহের জন্য দেখা হওয়া আর মাঝেমধ্যে ফোনে কথা বলা স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে এসে সংকোচ হচ্ছে। প্রথমদিনই কি বলা যায় যে – ভাত খাব!

টেবিলে ভাজা মুরগির বুক আর ঠ্যাং বেহায়ার মতো চিৎ হয়ে আছে। সে বরং ঢোক ঢোক পেপসি খায়, যদিও সেভেনআপ বেশি ভালো লাগে তার।

ওর বর কাগজের ঠোঙায় খাবার এগিয়ে দেয়।

– ‘আমি আলুর চিপস খাই না’ – নীপা বলে।

– ‘চিপস না, এখানে বলে ফ্রাইজ, ফেঞ্চ ফ্রাই’ – খাবার

মুখেই কথা বলে ওর বর।

রান্নাঘরের আলোটা কেমন হলদেটে, বাল্বের পাওয়ার কম?

– না না, – খাবার মুখে উঠে গিয়ে কোনায় আরেকটা সুইচ টিপে দেয় নীপার বর। মুহূর্তে সাদা আলোর প্রপাত খেলে যায় ঘরের মধ্যে।

– ‘খাওয়া শেষ, থালাবাটি ধোয়ার ঝামেলা নেই, দেখেছ?’ – ওর বর প্যান্টের বোতাম আলগা করে লুঙ্গি বদলায়।

মেঝের ওপরে রাখা স্যুটকেস খুলে নাইটি বের করে নীপা, বুকের কাছে কুঁচি, হাতায় সাদা লেস।

বাথরুমে কমোডের পাশে বেগুনি রঙের তুলট পাপোশ, ময়লাটে। হয়তো অনেকদিন ধোয়া হয়নি। নীপা হাত দিয়ে ঘষে ঘষে আয়না থেকে সাবানের ছিট তুলতে চেষ্টা করে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে ঘরে একটা বিছানা পাতা, সোফা উধাও! ওর বর বিছানার মাপের চেয়ে ছোট একটা সিন্থেটিক চাদরের ভাঁজ খুলে দেখায়।

– ‘আমার সোফা কাম বেড, দেখেছ দিব্যি খাট হয়ে গেল, নাও চাদরটা বিছাও।’

বিছানার বড় চাদর দেশ থেকে নিয়ে আসা যেত, আগে যদি জানত নীপা!

আগামীকাল সংসারের কেনাকাটা হবে, শুনতে শুনতে সে ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘ বিমানযাত্রা, এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস মাথায় রিলে রেস করে যায়, স্যুটকেস খুলে স্বামীর ফরমায়েশে আনা ছানার মিষ্টির প্যাকেট কেমন নির্দ্বিধায় ফেলে দিলো কাস্টমস অফিসার।

কোথায় যেন ঘ্যাঁচ করে গাড়ি ব্রেক করার শব্দ হয়, আশ্চর্য! মে মাসের শুরু হলেও পুরো গরম পড়েনি। দরজা-জানালা বন্ধ। নৈঃশব্দ্যের ভেতর কোথাও হঠাৎ গাড়ি থামার শব্দ খুব কানে লাগে। হঠাৎ ঘুম চটে যায় নীপার। পাশে ঘুমন্ত লোকটা মৃদু, ধীর নাক ডাকছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে। কার পাশে শুয়ে আছে সে? ধড়ফড়িয়ে উঠতে ইচ্ছা করে। কিছুতেই আর ঘুম আসছে না।

এই বিয়েটা কেন, কী দরকারে করতে হলো সে ক্লিশে কথাবার্তা নীপা ভাবতে চায় না। ক্লিশে কথাটা সে সাজেদীনভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছে। খুব বেশি কথা বলত না সাজেদীনভাই; কিন্তু হঠাৎ মুড হলে কী সুন্দর গুছিয়ে বলত, বিশ্ব ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজনীতি, মানুষের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক। আর তার জন্যই সে আবৃত্তির গ্রুপে যোগ দিয়েছিল। সেসব কতদিনের কথা, তবু মনে হয় – সেদিন সকাল!

ঘুম ভাঙল বুকের ওপর চাপ অনুভব করে। চোখ খুলতেই কড়া সূর্যের আলোর সঙ্গে নীপার বর মুখের ওপরে মুখ নিয়ে ঝুঁকে আছে। অনেকদিন পর এত কাছে একজন পুরুষের মুখ, পরপুরুষ কেউ না। তবু হঠাৎ অস্বস্তি হয় নীপার, বলতে ইচ্ছা করে – ‘দাঁত মেজে আসো।’

না বলে অন্য কথা বলে সে, বলে – ‘সরো, নাইটিটা খুলি।’ কেন জানি মনে হয় যে গোলাপি, নরম নাইটিটা এই চাপ সহ্য করতে পারবে না।

এ-বাসার জানালায় পর্দা নেই, সেটা কালকে রাতে ভালো করে খেয়াল হয়নি। জানালার ফ্রেমের নিচে তাকের মতো জায়গায় একটা ফুলদানিতে বাসি ফুল, শুকিয়ে গেছে, আশ্চর্য ওর চোখে পড়েনি! সেখানে একটা আধখাওয়া পানির বোতল।

নীপার জানালার দিকে তাকানো দেখে ও বলে – ‘এখানে তিনতলায়, বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না।’

ফুলদানিতে শুকিয়ে আসা ফুল দেখে নীপা, যেন ফুলগুলোর দৃষ্টিশক্তি আছে। ওর বর তার চাহনি অনুসরণ করে বলে – ‘আমার জন্মদিনে বাসেতভাই আর ভাবি নিয়ে আসছিল।’

নীপা কি জন্মদিনে ওর বরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল? টেক্সট করে, ফোন করে, ফেসবুকে? এ-মুহূর্তে কিছু মনে পড়ছে না কেন? বিছানার চাদরটা গুঁড়িয়ে দলামোচড়া হয়।

কিছু সময় পর ওর বর পুলকিত দেহ-মনে লাফ দিয়ে বাথরুমে গেলে নীপা বিছানায় বসে থাকে, ভেজা, পিচ্ছিল অনুভূতিতে গায়ের চামড়া কেমন রি রি করে। জানালা দিয়ে ডাকাতের মতো রোদ ঢুকে টেবিলে রাখা পানির গ্লাসে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে ফিকে নীল আভা ছড়াচ্ছে। বিছানার চাদরটা টানটান করে বিছিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। স্যুটকেস খুলে একটা শাড়ি বের করে জানালায় ঝুলিয়ে দিলে বেশ পর্দা হয়ে যায়; কিন্তু নীপা কিছুই করে না, বসে থাকে।

– ‘কোনটা আগে করবা, দেশে আম্মাকে ফোন, নাকি নাস্তা?’ এক হাতে টাওয়েলে মুখ মুছতে মুছতে কৌতুকের কণ্ঠে জানতে চেয়ে অন্য হাতে ফোনটা এগিয়ে দেয় ওর বর।

– ‘প্রথমে জিরো ওয়ান ওয়ান দাও, তারপর ডবল এইট, তারপর তোমার আম্মার মোবাইল নম্বর ডায়াল করো।’

নীপা জিরো জিরো (যেভাবে যমুনা উচ্চারণ করে) বলতেই ওর বর বলে – ‘জিরো বলবা না, সব বাঙালি যিরোকে জিরো বলে। এখানে বলে…’ ইংরেজি জেড অক্ষরের উচ্চারণ বর্গীয় জ আর ঝ-এর মাঝামাঝি কেমন হওয়া উচিত এ-বিষয়ে জ্ঞানলাভ হলে লজ্জিত হয় নীপা। আবৃত্তির গ্রুপে তার উচ্চারণ সবচেয়ে ভালো গণ্য করা হতো – এ-কথা শুধু শুধু মনে পড়ে, সেই কবে গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছে সে। ওর মায়ের ফোন নম্বর থেকে ব্যস্ত টোন আসে দেখে কেন জানি স্বস্তি হয়, মাছের মতো ভেজা অনুভূতি নিয়ে আম্মার শতেক কৌতূহলের উত্তর দিতে ভালো লাগত না।

বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়ে খেয়াল হয়, সে হিলতোলা স্যান্ডেল পরলে ওর বরকে আরো উঁচু জুতো পরতে হবে। দেশ থেকে আনা নীলরঙা ফতুয়া গায়ে দিয়েছে, পায়ে কোলাপুরি চটি। ওর বরের গোলগাল মুখে চকচকে চোখ। আমোদ ভালোবাসে সে। সোজা, ঘন চুলের ভারে ওর বরের মাথা শরীরের তুলনায় বড় দেখায়।

শাড়ি পরবে কিনা জানতে চাইলে ওর বর নিষেধ করে। বেরোনোর আগে ফ্রিজের দরজায় ময়লার ব্যাগ, বেসিনে আধোয়া কাপ দেখায় নীপা। ‘এসব সেরে বের হলে হয় না?’

– ‘নাহ্ থাক, ফিরে এসে করো। বাসেতভাই নিচে অপেক্ষা করছে। আর হ্যাঁ, বেসিন না, সিংক। কিচেনে সিংকে আমরা ধোয়া-পাকলা করি। আর শোনো, এখন থেকে একটু ইংরেজি বলার অভ্যাস করতে হবে।’

আসার আগে গত কয়েক মাস খুব মন দিয়ে ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করেছে নীপা। ওর বর ফোনে পইপই করে বলেছে – ‘বিদেশ যাওয়ার আগে ইংলিশ না শিখে যাওয়া আর অন্ধ হিসেবে যাওয়া এক কথা।’

সহজ বিষয় লিখতে-পড়তে মোটামুটি পারে সে, শুধু বলাটা সড়গড় না, আসলে বলার সুযোগ পেল কোথায়? দেশে কি আর তার আশপাশের কেউ বাংলা ছাড়া অন্য কিছু বলে? স্বামীর ওপর অভিমান করতে গিয়ে থেমে যায় নীপা। এই লোককে কি সে চেনে তেমন? এই যে নিজের কাছেও সে ‘আমার বর, আমার বর’ করছে, তার কারণও কি এই নয় যে, ওর বরের নামও নাকি এখানে এসে বদলে গেছে আর বদলে যে গেছে তা জেনেছে বিয়ের মাস-আষ্টেকের মাথায়, যখন তাকে স্পন্সর করার ফরম ফিলাপ করে ও পাঠাল। জানল যখন পাসপোর্টে স্বামীর নামের ঘরে শফিকুর রহমানের বদলে ইকবাল আহমেদের নাম লিখে দিলো। সতর্ক হয়ে অভিমানের বাক্সটা কাজেই ঠাস করে বন্ধ করে দেয় নীপা।

দিনের প্রথম কাজ বাসেতভাইকে নিয়ে সার্ভিস কানাডার অফিসে গিয়ে নীপার সোশ্যাল ইন্স্যুরেন্স নাম্বারের জন্য দরখাস্ত করা।

ওর বর হাতে কাগজপত্র দিয়ে বলতে থাকে – ‘দেখো, তোমার জন্য কত ইজি করে দিলাম, অ্যাপ্লাই করবে আর স্ট্যান্ডার্ড সিন নাম্বার জুটে যাবে, তারপর বৈধভাবে কাজ করো, কী আরাম! আর আমারটা জোগাড় করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।’

ভেঙে না বলা কাঠখড় পোড়ানোর ইঙ্গিত নীপা পরিষ্কার বুঝতে পারে না। তবে সে বুঝে যায় যে, তার বর এখন থেকে তুলনা দিতে থাকবে, কানাডায় বৈধ হতে তার কী কী পুলসিরাত পার হতে হয়েছে আর নীপার জন্য কেমন প্রশস্ত রাস্তা সে বানিয়ে দিয়েছে।

মে মাসের শুরু, একদম নাকি শীত নেই। নীপার তবু হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা বোধহয়,  সালোয়ার-কামিজের ওপরে জ্যাকেট চাপিয়ে জবুথবু হয়ে হাঁটে, দেখে বাসেতভাই আর ওর বর হাসাহাসি করে। দু-চার বছর এখানে থাকার পর সেও নাকি এ-সময় সোয়েটার ছাড়া বাইরে বেরোবে!

শপিংমলে সঙ্গের পুরুষ দুজন সামনে আর নিজে পেছনে হাঁটতে গিয়ে বেগম রোকেয়ার গল্পের কথা মনে পড়ে নীপার। ভাগ্যিস সে বোরকা পরেনি আর এখানে তেমন ভিড় নেই। বাসেতভাইয়ের টাকমাথা পেছন দিক থেকে চকচকে দেখায়। বেঁটে-খাটো-মোটা শরীর নিয়েও একটা শিশুর সরলতা আছে ভদ্রলোকের।

কী অদ্ভুত, গত সপ্তাহেও নীপা এই লোকের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত না। আর আজকে মনে হচ্ছে সে তাদের সংসারের পরম বন্ধু।

ফুড কোর্টে নীপার বর বিফ বার্গার কেনে। হলুদ আর লাল মিলিয়ে বড় এম লেখা সাইনবোর্ডের কাছাকাছি টেবিলটা দখল করে বসে থাকে সে। তাড়াহুড়োহীন মানুষজনের আনাগোনা দেখে। দেশের রাস্তাঘাটের ধুন্ধুমার স্রোতের কথা মনে পড়ে। এখানে কেউ দৌড়াচ্ছে না, কারো গায়ে ধাক্কা লাগছে না। আজ তো ছুটির দিন না, এদের কি কাজকর্ম নেই?

– ‘সবার কাজ এক সময়ে না। কেউ হয়তো রাতে কাজ করে, কেউ ছুটিতে, কেউ দেখেন গিয়ে আনএমপ্লয়মেন্ট ইন্স্যুরেন্স পাচ্ছে, ম্যাটারনিটি লিভ, প্যাটারনিটি লিভ, কতকিছু, আর সবকিছুর বাইরে অনেকে আছে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে, কাজটাজ করে না, মাস গেলে সরকারি ভাতা!’ বাসেতভাই ধৈর্য ধরে কথা বলে।

– ‘ওরাই সবচেয়ে আরামে আছে, ক্যাশে আন্ডার টেবিলে কাজ করে কেউ কেউ’ – নীপার বর দীর্ঘশ্বাস ফেলে – ‘তোমাকে স্পন্সর করার জন্য সেই যে আমার কাজে ঢুকতে হলো আর শেষ হলো না, হবেও না।’ শুনে অপরাধী চেহারা হয়ে যায় নীপার। সত্যিই তো, তাকে কানাডায় নিয়ে আসতেই তো…

– ‘মিয়া, এখন যে বউয়ের যত্নআত্তি পাইতাছেন সেই খবর আছে?’ বাসেতভাই সম্ভবত নীপার মুখের ছায়া বুঝতে পারে। কথা ঘোরাতে তার দিকে ফেরে – ‘ভাবি, উইকেন্ডে মলে বেশি ভিড় থাকে, তবে গা ঠেলাঠেলি পর্যায়ের নয়’ – তার কাছ থেকে ভাবি ডাক শুনে অস্বস্তি লাগে নীপার। প্রথমে মনে হয় অন্য কাউকে ডাকছে, ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। খেতে গিয়ে বার্গার থেকে লেটুস, শসার কুচি বেরিয়ে পড়ে নীপার। ওর বর দুহাত দিয়ে কায়দা করে কামড় দেয়। মুখভর্তি খাবার নিয়ে বলে – ‘বার্গার খাওয়ার সিস্টেম আছে। সবকিছুর সিস্টেম জানলে অসুবিধা হয় না। এই দেখো কিচ্ছু বাইরে পড়বে না।’

বাসেতভাই হাসে। নীপা অপ্রস্তুতমুখে বার্গার খাওয়া শিখতে থাকে।

দোকানপাট ঘুরে ঘুরে দেখে ওরা। শপিংমলের সেন্ট্রাল স্টিরিওতে শ্রুতিমধুর কী এক বাজনা বেজে যাচ্ছে। এখনো গরমকালের মূল্যহ্রাস শেষ হয়নি।

নীপার বর বলে – ‘যা কিছু কিনবা, সেইল থেকে কিনতে পারলে ভালো। সব সময় ‘সেইল’ আর ‘ডিল’ ধরতে হবে। তাহলে লাভই লাভ।’

– ‘একটা ময়লা ফেলার ঝুড়ি কিনলে হতো না?’

রান্নাঘরে ফ্রিজের কথা মনে পড়ায় নীপার সংসারী হতে ইচ্ছা করে।

– ‘গার্বেজ বিন। এখানে ওটাকে বলে গার্বেজ বিন।’

বিছানার চাদরের কথা আর বলতে ইচ্ছা করে না নীপার। কে জানে সেটাকে আবার কী বলে এখানে!

বিয়ের সময় সপ্তাহখানেক দেশে থাকা অবস্থায় ওর বরের পায়ের তলায় সরষেদানা ছিল। আজকে নোয়াখালী তো কালকে সাভার, আজকে বড়ভাইয়ের বাসা তো কালকে চাচির বোনের। দাওয়াত আর দাওয়াত, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ফোনে কথা আর কথা। মনে হচ্ছিল অনেকদিন অনুপস্থিতির শোধ সে সপ্তাহখানেকে তুলে নেবে। নাকি নীপাকে বিয়ে করার গর্বমাখা মুখ সে সবার কাছে উজ্জ্বল করে তুলে ধরতে চায়! বউয়ের গুণের মধ্যে তার কাছে এক ঢাল চুল আর হরিদ্রা গাত্রবর্ণ, হাসতে হাসতে বলাটা রেডিওতে বহুবার বাজানো চটুল গানের মতো লেগেছে। সবার সঙ্গে যোগাযোগের কী এক মাতাল আবহে ডুবে ছিল যে, মানুষের সামনে এমন ভুল ধরে ধরে শুধরে দেওয়ার সুযোগ পায়নি। নাকি ধরেছে, নীপাই অন্যমনস্ক ছিল, বিয়ের পরের দু-চারদিনের উষ্ণ, সরব সুখের পুকুরে গা ডুবিয়ে ছিল!

তিনজন শপিংমলের ভেতরে ধীরপায়ে ঘোরে। দোকানের হরেক জিনিস আর সুগন্ধিতে পায়ের গতি ধীর হয়ে আসে নীপার। সবচেয়ে ভালো লাগছে ছোট ছোট বাচ্চা দেখতে। কী ফুটফুটে একেকটা শিশু। ওর বর তাড়া দেয় – ‘জলদি হাঁটো।’

বের হয়ে পার্কিং লট থেকে গাড়ি খুঁজে নেয় বাসেতভাই। মন্ট্রিল শহর ঘুরিয়ে দেখাবে। দূরের রাস্তা দিয়ে যায়। বড় বড় হাইওয়ে, চক্ষু ধাঁধিয়ে দেওয়া নতুন গাড়িবহর দেখলে সামনে বসা ওর বর কলকল করে কথা বলে। কাঁধ উজিয়ে পেছনে তাকায়। বাসেতভাইয়ের গাড়িতে বসে ওর বশংবদ ভাবটা ভালো লাগে না নীপার। তার চোখে সদ্য কেনা সানগ্লাস। মূল্যহ্রাস থেকে কেনা। বাইরে প্রকৃতিতে গ্রীষ্ম শুরুর শান্ত কিন্তু চনমনে ভাব, গাছে গাছে কি কচি সবুজ পাতা! যত্নে গড়ে তোলা বিশাল বিশাল রাস্তাঘাট আর অগুনতি গাড়ি। আচ্ছা, নীপা কি থাকতে এসেছে? কেন জানি খুব অবাক লাগে ভেতরে, গাড়ির ভেতর দুজন মানুষকে হঠাৎ করে অচেনা মনে হয় তার।

সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের কাছে শহর দেখার চত্বর, গাড়ি পার্ক করার জায়গা। নিচে গিরিখাদ, চত্বরের সীমানা তাই লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা, পাশ দিয়ে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে খাদে। রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে কয়েকটা দুরবিন, পিলারের সঙ্গে আটকানো, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দূরে দেখা যায়। দূরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের ওপরে শহরের আদি গির্জা দুরবিনে চোখ রাখলে একদম কাছে চলে আসে। নীপার বর ওকে ডেকে চোখের মাপে দুরবিনে বসিয়ে দেয়। দূরের গাছপালাসহ ঘন জঙ্গল, পাহাড়ের খাঁড়ি সব কাছে চলে আসছে। বিল্ডিং, রাস্তার যান চলাচল। বুকের মধ্যে একদলা কান্নার বৃষ্টি ঝেঁপে আসে নীপার। আহ্, এভাবে যদি দেশটাও কাছে চলে আসত। তার আর আম্মার যৌথ ঘর। চুল বিছিয়ে ফ্যান ছেড়ে ভাতঘুম দেওয়া দুপুর।

ওর বর হঠাৎ ছোঁ মারার মতো দুরবিন টেনে নিয়ে তাকেও টান দেয় – ‘চলো চলো, বাসেতভাইকে কাজে যেতে হবে, দেরি হলে সর্বনাশ।’

ওর বরও নাকি বিকেলের দিকে কাজে যায়। বিকেল তিনটা থেকে রাত এগারোটার শিফট। আজকে সে ছুটি নিয়েছে।

নীপার মনে হয় ছুটি না নিলেই ভালো ছিল। একা একা এই ভূখণ্ড দেখার জন্য বুকের ভেতর ফোঁটা ফোঁটা সাহসের জন্ম দেওয়ার জন্য একা থাকা দরকার নীপার। বর থাকুক, তার মতো। নীপার সঙ্গ দরকার হলে থাকুক, যতটা না থাকলেই নয়।

চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র টেবিলে রাখে নীপার বর।  ফতুয়া খুলে বিছানায় ছড়িয়ে দেয়।

এই ঘরটা তাদের, নীপা ভাবে। আম্মার সঙ্গে যৌথ ঘর খুব যে বেশি ভালো লাগত তা নয়। নিজের একটা ঘরের জন্য প্রাণ আইঢাই করত। অবচেতনে সে কি ভেবেছিল বিয়ের পর তার নিজের গৃহকোণ হবে! গৃহকোণ কথাটার মানে কী? ঘরটার এ-মাথা থেকে ও-মাথা দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখতে থাকে নীপা, এখানে তার জায়গা আছে। আছে কি? নাকি তাকে তৈরি করতে হবে? কত কঠিন কাজ সেটা? সে পারবে তো!