সম্পাদকীয়

শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ (১৯২২-২০১২) নিত্যনব উদ্ভাবনী কৌশল, সূক্ষ্ম বোধ ও বুদ্ধির সমন্বয়ে এদেশের চিত্রকলা আন্দোলনকে প্রাণময় করে রেখেছিলেন। বিশেষত ছাপাই ছবির ভুবনটি তাঁর হাতেই শিল্পগুণসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। চল্লিশের দশকে তিনি যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যয়ন করছেন, তখনই তিনি ছাপাই ছবিতে নবমাত্রা সঞ্চার করে শিল্পানুরাগী ও শিক্ষকমন্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। বিশেষত উড এনগ্রেভিং, ড্রাই পয়েন্ট ও এচিংয়ের করণকৌশলে পারদর্শিতা এবং সৃষ্টিতে রসসঞ্চারের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন বিশিষ্ট।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে তিনি চলে আসেন ঢাকায় এবং আচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে শিল্প-শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দেন।
১৯৪৮ সালের শেষদিকে মাত্র দুটি কক্ষ নিয়ে পুরান ঢাকার জনসন রোডে সরকারি আর্ট ইনসটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পঞ্চাশ বছর শিক্ষকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন। এই সময়ে অগণিত শিক্ষার্থী তাঁর সাধনা, সৃজনধারা ও ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়েছে এবং তাঁর সৃজনধারাকে অবিস্মরণীয় বলে বিবেচনা করেছে।
১৯৫৭ সালে তিনি চিত্রকলা ও ছাপাই ছবি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য লন্ডনে যান এবং দুবছর সেখানে অবস্থান করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি লন্ডনে একটি একক প্রদর্শনী করেন। বিলেতে শিল্পচর্চা ও শিক্ষাগ্রহণ তাঁর সৃষ্টির ভুবনকে নবমাত্রা দান করে। বিশেষত ছাপাই ছবি নানাদিক থেকে হয়ে ওঠে শিল্পগুণসম্পন্ন। করণকৌশল, উদ্ভাবনা ও সৃজন-উৎকর্ষে তাঁর ছাপাই ছবি ভিন্ন মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।
এদেশের ছাপাই ছবির তিনিই হয়ে ওঠেন শিল্পগুরু। ছাপাই ছবির প্রসার ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি তেলরঙেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তেলরঙের কাজে তাঁর আলাদা চিত্রভাষা স্বতন্ত্র অনুভব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ড্রইং ও তেলরঙের সকল সৃষ্টিতে তাঁর বোধ ও মননের প্রাখর্যে চিত্র হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। শক্তিমত্তা, পরিশীলিত মন ও আবেগের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পরিস্ফুট হয় তেলরঙের চিত্রগুচ্ছে।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০ মে ২০১২-য় নববই বছরপূর্তির মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর তিরোধানে এদেশের চিত্রকলা-আন্দোলনের যে-ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হবে না।
তাঁর জীবদ্দশায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই শিল্পীর সম্মানে প্রতিষ্ঠিত করেছে সফিউদ্দীন বেঙ্গল প্রিন্টমেকিং স্টুডিও। ছাপাই ছবির প্রসার ও প্রচারে এই স্টুডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা যায়। এছাড়া ইতালির বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্কিরার সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানের Great Masters of Bangladesh : Safiuddin Ahmed নামে একটি মনোগ্রাহী গ্রন্থ।
কালি ও কলম সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যাটি শিল্পগুরু সফিউদ্দীনের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত হলো। এই সংখ্যাটি এই পত্রিকার শততম। এই সংখ্যা প্রকাশে আমরা অনেকের সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছি। তাঁদের সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।