সাফল্য, ব্যর্থতা ও সুখ-দুঃখের কথা

গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া

 

পড়ন্ত বেলার গল্প

এ বি এম হোসেন

 

অ্যাডর্ন

ঢাকা, ২০১৫

 

৭৫০ টাকা

 

জীবনের একটি পর্যায়ে মানুষ তাঁর অতীত স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেখে বারবার। তার সাফল্য, ব্যর্থতা, দুঃখ-সুখ কিছুই বাদ যায় না। প্রতিটি মানুষ পরিণত বয়সে এসে তার কর্মজীবনকে মূল্যায়ন করে। শৈশব থেকে কৈশোর, যৌবন থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত সময়ের নানা পর্যায় অতিক্রম করে একজন মানুষ পূর্ণতা অর্জন করে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের গ্রামীণ সমাজ থেকে এসে মেধা ও শিক্ষার মাধ্যমে দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিক হওয়া সহজ কথা নয়। এ ধরনের একজন হলেন বর্তমান গ্রন্থের লেখক ড. হোসেন। বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা কর্মজীবনে সফলতা অর্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক নাগরিকই স্মৃতিকথা লিখেছেন। নীরদ চৌধুরী, এসএন ব্যানার্জি, রবিঠাকুরের স্মৃতিকথা দেশ-বিদেশে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। রাজনীতিকদের মধ্যে আবুল মনসুর আহম্মদ, আবুল হাশিম অথবা সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীও লোকপ্রিয়তা পেয়েছে। শিক্ষাবিদ-লেখকদের মধ্যে আনিসুজ্জামান, আবু রুশ্দ, তপন রায় চৌধুরীর স্মৃতিকথা পাঠকদের মাঝে বেশ আলোচিত। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. এ বি এম হোসেন। তাঁর স্মৃতিকথামূলক বয়ান গ্রন্থটিতে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমানে যেসব বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ এখনো সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন ড. হোসেন নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অগ্রণী।

লেখক তাঁর স্মৃতিকথার শুরু যেভাবে করেছেন তা বেশ আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ। কুমিল্লা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ধামতিতে তিনি যে-সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে-সময় ছিল ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়। নিজের জন্য যে-বিদ্যালয়টি তিনি পেয়েছিলেন, সেটি হলো দেবীদ্বার রেয়াজউদ্দীন হাই স্কুল। আত্মীয়বাড়ি থেকে স্কুলে পড়াশোনা করে তিনি পরবর্তী পর্যায়ে কুমিল্লা শহরে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ভিক্টোরিয়া কলেজের বিদ্যায়নিক তথা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে। কুমিল্লা অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান ছিলেন কলেজ অধ্যক্ষ। আর ড. হোসেনের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আবুল খায়ের আহম্মদ। অধ্যাপক খায়ের আহম্মদ ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অসাধারণ ফল করায় অধ্যাপক খায়ের তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস পড়ার পরামর্শ দেন। সে-সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ শিক্ষকবৃন্দ। ছিলেন আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ্, ছিলেন আবদুল হালিম প্রমুখ। সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন ড. হোসেন। তাঁর কক্ষসঙ্গী ছিলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। হলের ভিপি ছিলেন ইশতিয়াক আহমদ (পরে বিখ্যাত আইনজীবী)। তাঁর পরে ভিপি হন আবুল মাল আবদুল মুহিত। সে-সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ জানার জন্য বর্তমান গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পঞ্চাশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পূর্ববাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার পর লেখক ড. হোসেন কুমিল্লার ময়নামতিতে শালবন বিহারের খননকাজে অংশ নেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে এ-কাজ চলছিল। একজন অবাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. খানের নেতৃত্বে এ-ধরনের খননকাজ হয়েছিল। বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন হারুন অর রশীদ, এমএ গফুর প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে একজন ও লেখক নিজে ইসলামের ইতিহাস থেকে মনোনীত হয়ে এখানে আসেন। শ্রমিকদের সঙ্গে খননকাজ করার সময়ে তিনি এক কলসিভর্তি সোনার আংটি পেয়েছিলেন। এসব আংটি ময়নামতি জাদুঘরে রক্ষিত হয়েছিল, তবে বাংলাদেশ হওয়ার পর এগুলো আর জাদুঘরে পাওয়া যায়নি। বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানিরা নিয়ে গেছে।

গ্রন্থটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায়টি হলো, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকের গবেষণা-পর্ব। স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (SOAS) লেখক ছিলেন অনার্স ও পি-এইচডি পর্যায়ের ছাত্র-গবেষক। এই সময়ে তিনি বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লিউইস, পল উইটেক, ফিলিপ প্যারি ও ব্যাশমের সংস্পর্শে আসেন। লন্ডনের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সতীর্থ বন্ধুদের নিয়ে লেখকদের স্মৃতিগুলো বেশ আকর্ষণীয়। তুর্কি-গবেষক কুবলাই অথবা ইরাকি ছাত্র আযিযের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে সমান কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। লন্ডনে থাকা অবস্থায় অধ্যাপক শাহানারার সঙ্গে লেখকের বিয়ে হয়। পরবর্তীকালে ড. শাহানারা হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ইতিহাসবিদ এই দম্পতির বাংলাদেশে বিশেষ পরিচিত রয়েছে। এই অধ্যায়ের মাধ্যমে সোয়াশের অ্যাকাডেমিক ব্যবস্থা, গবেষণার মান এবং কৃতী অধ্যাপকদের পরিচয় জানা যায়।

লন্ডনে থাকা অবস্থায়ই লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য নিয়োগপত্র পান। তবে তাঁর মনে স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার। কিন্তু তাঁর বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপকদের অসহযোগিতার জন্য তা আর হয়ে ওঠেনি। তাই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেই থেকে অর্ধশতক ধরে তিনি রাজশাহীতে রয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক জীবনে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর প্রাণনাশে চেষ্টা হয়েছিল। নিতান্তই দৈবক্রমে বেঁচে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কেমন ছিল তা তাঁর লেখা থেকে জানা যায়। ইউনেস্কোর একজন ফেলো হিসেবে তিনি ভারত, তুরস্ক ও স্পেনের স্থাপত্যকীর্তিসমূহ পরিদর্শন করেন। গ্রন্থটির শেষের দিকে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতাসমূহ উপস্থাপন করেছেন। ইতিহাস-অনুরাগী পাঠকদের কাছে এগুলো বেশ আকর্ষণীয় হবে ধারণা করি।

বর্তমানে স্মৃতিকথামূলক লেখা গবেষণার অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বি এম হোসেন-লিখিত গ্রন্থটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগৎ অনুধাবন করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। গ্রন্থে বেশকিছু মুদ্রণপ্রমাদ রয়েছে। পরবর্তী সংস্করণে সেগুলো সংশোধিত হবে আশা করি। চমৎকার গদ্যে লেখা এ-গ্রন্থটি পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে প্রত্যাশা করি। শেষে এবিএম হোসেনকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। সেইসঙ্গে অ্যাডর্নের কর্ণধার এটি প্রকাশ করে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন।