সাহিত্যের দুনিয়াদুয়ার

নওশাদ জামিল

 

লেখাজোখার কারখানাতে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স

ঢাকা

৩৫০ টাকা

 

সৃজনশীল লেখক হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সর্বব্যাপী কৌতূহল যেন, জগৎ-সংসারের নানা বৈচিত্র্যময় বিষয় ও ভাবনা খেলা করে তাঁর করোটির ভেতর – লেখক সে-ভাবনাগুলো স্থান দেন নানারকম লেখাজোখায়। কখনো ফিকশনের আদলে, কখনো-বা ননফিকশনের অবয়ব নিয়ে হাজির হয় তাঁর ভাবনাগুলো। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝবেন – আলাপে, বিস্তারে তিনি কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গল্প করেন। লক্ষ করি, কথাসাহিত্যে তিনি যেমন বিচিত্রমুখী, প্রবন্ধসাহিত্যেও তেমন সর্বত্রগামী। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ জীবনের নানা মানবিক, অমানবিক বোধ নিয়ে তাঁর যেমন বিস্তর কৌতূহল, ঠিক তেমনই শিল্প-সাহিত্যের নানা অলিগলি নিয়েও তাঁর সুতীব্র আকর্ষণ। গভীর বিস্ময় নিয়ে এও লক্ষ্য করি, শুধু কথাসাহিত্য নয়, তাঁর আগ্রহ শিল্প-সাহিত্যের শেকড়-বাকড়, ডালপালা, লতাপাতাসহ সমস্তটা নিয়েই। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে তাঁর গভীর অনুসন্ধান ও কৌতূহলের এক উজ্জ্বল স্মারক লেখাজোখার কারখানাতে শিরোনামীয় গ্রন্থটি। বিশ্বসাহিত্যের বিশেস্নষণধর্মী ২৬টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে এ-বই। প্রথাগত প্রবন্ধ যেমন হয়, বইটির রচনাগুলো তেমন নয়। দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়, প্রবন্ধগুলো চলনে-বলনে-গড়নে অন্যরকম। পেশায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; অবাক করা বিষয়, তিনি যখন প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন, প্রবন্ধের বিষয় জটিল-কুটিল হলেও তাতে প্রথাগত টীকা-টিপ্পনী নেই; পা–ত্য দেখানোর জন্য বাগাড়ম্বরতাও নেই, সহজ ও প্রাণবন্ত ভাষায় লিখেছেন তাঁর ভাবনার জটাজাল, যার ফলে পাঠকের তরী এগিয়ে যায় তরতরিয়ে। অধ্যাপক হিসেবে নন, শিল্পসমালোচক হিসেবে নন, কলামনিস্ট হিসেবেও নন – সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সৃজনশীল লেখক হিসেবেই মেলে ধরেছেন তাঁর ভাবনার ঝাঁপি।

বইটি পড়তে-পড়তে টের পাই – কী গভীর তাঁর পঠন-পাঠন, কী অতলস্পর্শী তাঁর ভাবনার জগৎ। তাতে পত্রস্থ হয়েছে বিদেশের সাহিত্য ও লেখক সম্পর্কে নানা প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। ইউরোপ-আমেরিকা ও লাতিন সাহিত্য ছাড়াও পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্য নিয়ে তিনি অনুসন্ধানী রচনা লিখেছেন। লিখেছেন মনোগ্রাহী ও বিশেস্নষণধর্মী প্রবন্ধ। তাঁর এসব লেখা চিমত্মায়-মননে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনই পাঠে আনন্দদায়ক।

কথাসাহিত্য তাঁর ধ্যানজ্ঞান হলেও বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন দেদার। বিদেশি লেখক ও বিদেশের সাহিত্য নিয়েও লিখেছেন প্রচুর। বিশ্বসাহিত্যের একজন অনুসন্ধানী পাঠক তিনি। বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার সময় বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তাঁর ভেতর তৈরি হয় তুমুল আকর্ষণ। আশির দশকের শুরুতে তিনি পিএইচ.ডি শেষ করে যখন দেশে ফিরে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন বিশ্বসাহিত্যের প্রচুর বই। ততদিনে তাঁর পড়া হয়ে গেছে বিশ্ব-সাহিত্যের অনেক কিছুই। তখন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক আবুল হাসনাত, যিনি এ-দেশের একজন অগ্রগণ্য সাহিত্য সম্পাদক, শিল্প-সমালোচক, তাঁর বিশেষ অনুরোধে লিখতে শুরু করেন বিশ্বসাহিত্য নিয়ে। সংবাদের পাতায় নিয়মিত পাক্ষেক কলাম লেখেন প্রায় ২০ বছর। মধ্য আশির দশক থেকে ধারাবাহিকভাবে শুরু হওয়া ‘অলস দিনের হাওয়া’ শিরোনামে তাঁর কলামটি শেষ হয় শূন্য দশকের মাঝামাঝি সময়ে। কলামটি অগ্রসর এবং বিদগ্ধ পাঠকের নজর কেড়েছিল প্রথম থেকেই। সেখান থেকে নির্বাচিত লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বই অলস দিনের হাওয়া। বইটি পাঠকের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। তারপর প্রকাশিত হলো এই ধারার দ্বিতীয় বই লেখাজোখার কারখানাতে। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ-শিল্পী রফিকুন নবী।

 

দুই

শিরোনাম দেখে কেউ-কেউ হয়তো মনে করবেন, লেখালেখির কলাকৌশল নিয়ে বোধকরি এই পুস্তক। এক অর্থে এ-ধারণা মিথ্যে নয়, আবার তা পুরোপুরি সত্যও নয়। লেখাজোখার কারখানাতে কলমশ্রমিক হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যে-মূর্তি নির্মাণ করেছেন, তাতে যেমন মূর্তি গড়ার রসায়ন আছে, তেমনই আছে সেই অবয়বের রূপ-রহস্যের উদ্ঘাটনও। ধারাবাহিকভাবে বইটি পাঠশেষে লক্ষ করি, সাহিত্যের বেশ কিছু প্রবণতা আবিষ্কারের নেশা যেন পেয়ে বসেছিল তাঁকে। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে, অনুসন্ধানী পাঠক হিসেবে তাঁকে পাঠ করতে হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়। অ্যাকাডেমিক পাঠপ্রক্রিয়া এক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ সহায়ক ছিল; কিন্তু তিনি যখন লিখেছেন, পাঠকের জন্য ভেবেছেন, তখন পাঠ্যপুস্তকের ধারাটি অনুসরণ করেননি, নিজের উপলব্ধি ও মননসঞ্জাত ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বেশি। শিল্পের সৃষ্টি প্রক্রিয়া, সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখার মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক, সাহিত্যের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিক লেনদেন, বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল নিয়ে গভীর আগ্রহ ও জিজ্ঞাসা, বিশ্বের জরুরি লেখক ও রচনা নিয়ে তাঁর অভিমত, পাঠপর্যালোচনা – সর্বোপরি বিশ্বের নানা পথ ও মত নিয়ে বোঝাপড়ার প্রয়াস পেয়েছেন। পাশাপাশি নন্দনতত্ত্ব, আধুনিকতা-উত্তরাধুনিকতা, শিল্প-সাহিত্যে রাজনৈতিক দায়, ঔপনিবেশিক প্রভাব ইত্যাকার নানা বিষয় উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন।

বইটির অধিকাংশ রচনা কথাসাহিত্যের দিগন্ত নিয়ে, তবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিশ্বকবিতারও খোঁজখবর রাখেন। নিবিষ্ট পাঠকের মতো আগ্রহ নিয়ে পড়েন অনেকের কবিতা। বিশ্বের নানা দেশের কবি ও কবিতা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ যেমন সমৃদ্ধ, তেমনই অবশ্যপাঠ্য। আফ্রিকার কবি ও কবিতা নিয়ে তাঁর রচনা ‘একজন নিভৃতচারী কবির প্রতিকৃতি’ পড়তে গিয়ে চোখের সামনে খুলে যায় আফ্রিকার কবিতা নিয়ে একটি জানালা। তাতে নিভৃতচারী নাইজেরিয়ার কবি গ্যাব্রিয়েল ওকারার কবিতা শুধু নয়, লেখক তুলে ধরেছেন আফ্রিকার কবিতার নানা প্রবণতাও। ঠিক তেমন করেই বাঙালি পাঠকগোষ্ঠীর সামনে তিনি তুলে ধরেছেন ক্যারিবিয়ান কবিতার নানা দিক। বাংলা ভাষায় ওয়ালকট ছাড়া অন্যান্য ক্যারিবীয় কবির পরিচিতি তেমন নেই। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের অপরিচিত কবিদের শুধু পরিচিতই করাননি, পাশাপাশি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামসহ নানা বিষয় তুলে এনেছেন অনিবার্যভাবে।

বইটির একটি অনবদ্য প্রবন্ধ ‘উমবার্তো ইকোর দ্বিতীয় কিসিত্ম’। ইতালির কালজয়ী এ-ঔপন্যাসিককে নিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যে-বিশেস্নষণধর্মী রচনা উপহার দিয়েছেন, তাতে যে-সাবলীল উপস্থাপনা, পরিমিতিবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে, বাংলা সাহিত্যে উমবার্তো ইকো নিয়ে তেমন রচনা বিরল। শুধু কথাসাহিত্য নয়, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিশ্বসাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে যে-প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তার তুলনাও মেলা ভার। কবিতা, প্রবন্ধ, বিশ্বসংস্কৃতি, রাজনৈতিক টানাপড়েনসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে বইটিতে।

বইটির দ্বিতীয় রচনা ‘উইলিয়াম গোল্ডিং : পুনরাবৃত্তির বিপদ’। তাতে বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের অতিকথন ও পুনরাবৃত্তি নিয়ে নানা দিক থেকে আলোচনা করা হয়েছে। কালজয়ী কিছু উপন্যাসের পাশাপাশি তাঁর ‘পানসে’ লেখার সংখ্যাও কম নয়। এ-প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার বক্তব্য। অতিকথন প্রসঙ্গে কুন্ডেরা বলেছেন, ‘অতি-লিখন এমন একটি স্ব-বিধ্বংসী প্রক্রিয়া যে, এর প্ররোচনায় যিনি আত্মহারা হয়েছেন তার বিপদ অবশ্যম্ভাবী।’

বইটির অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ ‘মাহফুজ এবং মার্গারেট ড্র্যাবেলের কথা’। মিশরের লেখক নাগিব মাহফুজ যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন বাংলাদেশে তাঁর তেমন কোনো পাঠকই ছিল না। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন যে, এমন একজন ঔপন্যাসিক নোবেল পুরস্কার পেলেন, যাঁর একটি লেখাও কখনো পড়িনি। তবে এ-ক্ষেত্রে নাকি ব্যতিক্রম ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি নাকি আগেই একটি উপন্যাস পড়েছেন এবং তা সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী নিবন্ধও লিখেছেন। মাহফুজ সাহিত্যে সর্বপ্রথম মুসলমান নোবেল পুরস্কার বিজয়ী – এ নিয়ে অনেকের তখন প্রবল উচ্ছ্বাস। সৈয়দ শামসুল হক এ-বাড়তি উচ্ছ্বাসের বিরোধী ছিলেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। ধর্ম পরিচয় যদি মুখ্য হয়, তবে তাতে লেখার গুণাগুণ চাপা পড়ে যায়।

নাগিব মাহফুজ সম্পর্কে বলতে-বলতে লেখক চলে যান ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মার্গারেট ড্র্যাবেলের প্রসঙ্গে। ব্যক্তিগত আলাপ-পরিচয়ের সূত্র ধরে মার্গারেট ড্র্যাবেল সম্পর্কে লেখক তুলে ধরেছেন নানা তথ্য। তাঁর উপন্যাসের কথা, বাংলাদেশ ও ভারত নিয়ে তাঁর আগ্রহের কথা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ। সব মিলিয়ে রচনাটি যেমন আনন্দদায়ক, তেমনই শিক্ষণীয়।

বইটির একটি গভীর বিশেস্নষণধর্মী রচনা ‘ওই অন্তহীন অন্ধকার’। তাতে এশিয়া মহাদেশের সঙ্গে, বিশেষ করে আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে লাতিন আমেরিকার বাস্তবতার নানা দিক আলোচিত হয়েছে। দুটি মহাদেশের মধ্যে বিস্তর অবস্থানগত দূরত্ব; এছাড়া মানুষ, প্রকৃতি, নিসর্গ,
সংস্কৃতি, ধর্মসহ নানা বিষয়ে রয়েছে যোজন-যোজন দূরত্ব। তারপরও আমাদের সঙ্গে লাতিন জনগণের মিল অনেক। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ছাড়াও রাজনীতি নিয়ে আমাদের অঞ্চলের সঙ্গে লাতিন অঞ্চলের প্রভূত সাদৃশ্য। লেখক সেসব বিষয়কে তুলে ধরে আলোচনা করেছেন লাতিন মহাদেশের দুটি বই সম্পর্কে। তাতে উলেস্নখ করেছেন, অবস্থানগত দূরত্ব থাকলেও শাসকদের চরিত্র প্রায় একইরকম। আশির দশকে ফকল্যান্ডকে ঘিরে যে-যুদ্ধ হয় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, সেটাকে আর্জেন্টিনার লেখক ওসবাল্ডো সোরিয়ানো বলেছেন ‘ডার্টি ওয়ার’। কথা সত্য, এ-ধরনের যুদ্ধ সবসময়ই নোংরা হয়। মূলত এ-পরিপ্রেক্ষেতেই তিনি লিখেছেন এ ফানি ডার্টি  লিটল ওয়ার। লেখক এ-গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে-করতে বর্ণনা করেছেন সামরিক শাসন, সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার, ক্ষমতালিপ্সাসহ নানা বিষয় নিয়ে। সবমিলিয়ে সুখপাঠ্য এবং তথ্যলিপিতে পূর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা এটি।

বিশ্বসাহিত্যের অলিগলিতে ঘুরে  তিনি লিখেছেন ‘উত্তর-আধুনিক উপন্যাস ও বর্ণনাকারীর ঐতিহ্য’, ‘শেমাস হিনি’, ‘একজন নিভৃতচারী কবির প্রতিকৃতি’, ‘প্রান্তবাসীজন’, ‘পুশকিনের উপন্যাস’ ইত্যাদি। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে রচিত এ-রচনাগুলোয় পাওয়া যায় তাঁর সৃজনশীল বিশেস্নষণের ক্ষমতা এবং অপরিমেয় দক্ষতা।

 

তিন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন বই পড়েছেন, লেখক পরে তাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়াও লিখেছেন। প্রথাগত পাঠপর্যালোচনা যেমন হয়, তেমন নয়। আলোচনা করতে-করতে লেখক শুধু বইটিতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছেন অন্যান্য বই ও লেখকের দুনিয়ায়। যেমন, হুয়ান সোতের একটি গল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সৈয়দ মজুরুল ইসলাম ছোটগল্পের গতিপ্রকৃতি, বাংলা ছোটগল্পের অবস্থানসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। ফলে লেখক শুধু একটি বইয়ের মধ্যে আটকে থাকেননি, নিজের চিমত্মা, অভিজ্ঞতা নানা প্রসঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের রচনা পড়তে-পড়তে কেবলই মনে হয় – তাঁর লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এটি। এক চিমত্মার সঙ্গে অন্য চিমত্মার
মিল-অমিল খুঁজে বিস্তৃতভাবে নিজের পরিধিকে লেখক ছড়িয়ে দিতে চান পাঠকদের মধ্যে। আমার বিশ্বাস, লেখকের এ-কৌশল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। তাতে বরং পাঠকেরই লাভ বেশি।

নাইজেরিয়ার ঔপন্যাসিক অ্যামোস টুটুওলাকে নিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন অনবদ্য রচনা ‘টুটুওলার বিদায়’। তাতে শুধু একজন লেখককেই শ্রদ্ধা জানানো হয়নি, পাশাপাশি আফ্রিকার অন্যান্য লেখক সম্পর্কেও আলোচিত হয়েছে। আফ্রিকার সাহিত্যের প্রবণতা, বৈশিষ্ট্য, উত্তর-ঔপনিবেশিক চিমত্মা, আফ্রিকার লোকজ ঐতিহ্য-বিশ্বাস নিয়ে উঠে এসেছে চমকপ্রদ বিষয়। লেখক এখানে আটকে থাকেননি, নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের পাঠ-পরিধি যেমন ব্যাপক, ঠিক তেমনই বিশাল তাঁর চিমত্মার জগৎ। নিজের পাঠপ্রতিক্রিয়াকে লেখক নিজের মধ্যে রাখেননি, ভাগাভাগি করে নিয়েছেন পাঠকের সঙ্গেও। এশিয়া থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা অঞ্চলের সাহিত্য পাঠ করেছেন তিনি। তাতে শুধু সাহিত্য নয়, ওই অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে অবলীলায়। পাঠক তা
পড়তে-পড়তে অন্যরকম জার্নি অনুভব করবেন, বলা বাহুল্য, পাঠকের জন্য এ-ভ্রমণ যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনই শিক্ষণীয়।

এছাড়া বইটিতে পত্রস্থ হয়েছে ভিন্নস্বাদের ভিন্নধারার নানা প্রবন্ধ। তার মধ্যে ‘কবিতীর্থে : জন কিটসের হ্যাম্পস্টেডে’, ‘ঔপন্যাসিক ইয়েটস’, ‘দক্ষেণ আফ্রিকার উপন্যাস এবং জে এম কুদজিয়া’, ‘নির্বাসনের সাহিত্য ও অগুসেত্মা রোয়া বাসেত্মাস’, ‘রুথ প্রাওয়ার জাহবালার উপন্যাস’, ‘হ্যাভেলের উদ্ভট পৃথিবী’, ‘ক্যালিবানের উত্তরাধিকার’, ‘গ্রিনের অবস্থান’, ‘উত্তর-আধুনিকতা ও জ্যাকসন পলোক’, ‘মানুষ ও মিনোটর : ল্যাটিন আমেরিকার উপন্যাস’, ‘নোবেলের ভূগোল ও ডেরেক ওয়ালকট’, ‘ইয়েটস্‌-এর যুদ্ধ’, ‘উপমণ্যু চ্যাটার্জীর দি লাস্ট বার্ডেন’ ইত্যাদি।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অনবদ্য বইটি পড়তে-পড়তে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়; নতুন করে ভাবতে হয়। কী বিপুল শ্রম দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন প্রবন্ধ-নিবন্ধের এ-সৌধ, তাতে তাঁর সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ স্ফূরণও লক্ষণীয়, হয়তো এ-কারণেই বইটি হয়ে উঠেছে সৃজনসম্ভারের এক নবদিগন্ত। বাংলাদেশের মননশীল ও সৃজনশীল সাহিত্যে যে-বহুমাত্রিক ধারা তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন, তা এ-দেশের সাহিত্যকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করেছে; সব শ্রেণির পাঠকের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে।

নিজের আগ্রহকে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন, বিশ্বের নানা প্রামেত্মর সাহিত্য নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তুলে ধরেছেন লাতিন উপন্যাসের গোলকধাঁধা, তুলনা করেছেন আমাদের উপন্যাসের সঙ্গে লাতিন উপন্যাসের মিল-অমিল, তেমনিভাবে ইউরোপ ও আফ্রিকার সাহিত্যকেও মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। বিশ্বসাহিত্যের পথে-প্রান্তরে যেন পাঠককে হাত ধরে নিয়ে গেছেন। সবমিলিয়ে উৎসাহী পাঠকের সামনে খুলে দিয়েছেন সাহিত্যের দুনিয়াদুয়ার। যাঁরা সৃজনশীল লেখালেখি করেন, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন – শুধু তাঁদের জন্য নয়, সব ধরনের সাহিত্যামোদীর জন্য এ এক অবশ্যপাঠ্য বই।