সূর্য অস্ত যায় না কখনো

মোস্তাক আহমাদ দীন

 এই শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে গত শতকের পঞ্চাশের দশকের কবিদের মেজাজমর্জি ও বিশিষ্টতার চিহ্নগুলো কারো কাছে আর অস্পষ্ট নয়, নানা বিচার-বিবেচনা শেষে সেই দশকের কবি বলতেও এখন হাতেগোনা – এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় দিলওয়ারকে গণ্য করা যায় কি-না, আজ, এ-প্রশ্ন তুললে পাঠক-সমালোচকদের মধ্যে নানামুখী তর্ক শুরু হতে পারে। সব মুখ্য/ গৌণ কবিরই কিছু-না-কিছু          ভক্ত-পাঠক/ সমালোচক থাকে, এখানে তারা বিবেচ্য নয়, বলছি সময়-নির্ধারিত রুচির কথা, বলছি কালোত্তরণের নানা হিসাব-নিকাশের পরের কথা – সেখানে, দিলওয়ারের কাব্যবৈশিষ্ট্য সদর্থ-নঞর্থ দুই অর্থেই পৃথক। পঞ্চাশের প্রধান কবিদের প্রথম বইয়ের পাশাপাশি দিলওয়ারের প্রথম বই জিজ্ঞাসাকে পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে বিষয় ও অঙ্গ – উভয় দিক থেকেই এ-কথার যাথার্থ্য মিলবে, আর এজন্যই, পঞ্চাশের দশকের কবিতার অধিকাংশ আলোচনায় বিষয়গত কারণে এবং সময়ের বহুজট যুগযন্ত্রণা ধারণ করেনি বলে দিলওয়ারের নামটি রয়ে যায় অনুপস্থিত।

পঞ্চাশের দশকের কবিরা বিষয় ও অঙ্গ দুই দিক থেকে জীবনানন্দ ও তিরিশ-চল্লিশের কবিদের নানা অভিব্যক্তি এবং বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার কাব্যচেতনা থেকে প্রেরণা ধারণ করে যে-কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন, দিলওয়ার সে-পথে যাননি। তাই বলে তিরিশের দশকের কবিদের সময়ে বাস করেও যতটুকু দূরত্বে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখে কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন কবিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সমকালিকদের সঙ্গে দিলওয়ারের কাব্যচেতনাগত দূরত্ব ততটা নয় – ষোলো বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ জিজ্ঞাসার কথা বাদ দিলে, পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ থেকে অঙ্গগত দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে।

তবু দূরত্ব শেষপর্যন্ত রয়েই গেছে, তবে তা অঙ্গগত নয়, বিষয়গত – এবং এই দূরত্ব অচেতন সাহিত্যচর্চার পরিণাম নয়, এই দূরত্ব ইচ্ছাকৃত এবং অবশ্যই কাব্যাদর্শগত। দিলওয়ার নানা চিন্তাভাবনা করে তাঁর লেখার গতিমুখ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণায় পৌঁছে লিখেছিলেন :

…একটা কথা বারবার আমাকে তাতিয়ে তুলতো। প্রশ্ন জাগতো, এখানে কী ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হবে?…

যেহেতু আমার চারদিকের বৃহত্তর মানবতার দারুণ শোকাবহ জীবন আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতো, আমি তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেছি অত্যন্ত সাদামাটা সেই জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ বক্তব্য তুলে ধরতে।

তাঁর এ-চেতনার সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের অন্যান্য কবির কাব্যচেতনার দূরত্ব চোখে পড়ার মতো। এ-কথার সত্যতা খুঁজে পেতে গেলে দিলওয়ারের প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতার পাশে বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের প্রধান চার কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতা থেকে কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে :

শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ

অথবা প্রখর ধূ ধূ পিপাসায় অাঁজলা ভরানো পানীয়ের খোঁজ

শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্ণের কাছে এসে রোজ

চাইনি তো আমি। দৈনন্দিন পৃথিবীর পথে চাইনি শুধুই

শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল।

(‘রূপালি স্নান’, শামসুর রাহমান)

ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে

আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে

তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায়

নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহূর্তমুকুরে।

(‘বিষয়ী দপর্ণে আমি’, আল মাহমুদ)

বৃষ্টি এসে ভেজায় কখন নাগেশ্বরীর মাঠ।

দুরন্ত এক বাতাস নাড়ে বুনো চালতা ফল –

হৃদয় যেন। রংগপুরের কনকরঙা মেয়ে

হঠাৎ সাড়া জাগিয়ে দিয়ে লুকোয় পরান পণে।

এই দেখেছি এই দেখিনি বৃষ্টিভেজা মাঠ।

(‘বুনোবৃষ্টির গান’, সৈয়দ শামসুল হক)

সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘর-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে

যারা ছিলো তন্দ্রালস দিগ্বিদিক ছুটলো, চৌদিকে

ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মতো যেনবা মড়কে

শহর উজাড় হবে, – বলে গেল কেউ – শহরের

পরিচিত ঘণ্টা নেড়ে নেড়ে খুব ঠান্ডা এক ভয়াল গলায়

 (‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’, শহীদ কাদরী)

পৃথিবীতে এসে কেঁদে যায় যারা বেদনার গেয়ে গান;

হতাশার কালো নয়নে মাখিয়া তপ্ত নিশ্বাস ফেলে :

নত করি শির চরণে নিজের দুঃখের পসরা ঠেলে,

মহাজীবনের ললাটে অাঁকিয়া তলোয়ার খরশান্

তাদের বিফল জীবনের লাগি, বলো ঠিক দায়ী কারা :

বিধি না জনক? শাক্ত না ধনী? কোথায় জবাব তার

লুকালো কোথায় উত্তরদাতা, সে কোন অন্ধাগার?

নিবিড় আবেগে কাঁপিছে আমার দুইটি অাঁখির তারা!

(‘জিজ্ঞাসা’, দিলওয়ার)

আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক ও শহীদ কাদরীর কবিতা থেকে উদ্ধৃত অংশের সঙ্গে দিলওয়ারের কবিতার চেতনাগত সাদৃশ্যের প্রশ্নই আসে না, এমনকি শামসুর রাহমানের যে-কবিতাটির মধ্যে ফরহাদ মজহার ‘কড়া রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রতিজ্ঞা’ খুঁজে পেয়েছেন, তার সঙ্গেও দিলওয়ারের রাজনীতি/ গণচেতনার পার্থক্য দুস্তর। এর কারণ, পঞ্চাশের অন্য কবিরা যেখানে তিরিশের প্রধান কবিদের পরম্পরা ধারণ করেছেন, তিনি তা করেননি, এ-দিক থেকে তাঁর পূর্বসূরি নজরুল, সুভাষ ও সুকান্ত। পরবর্তীকালে বাংলা কবিতা নজরুল-সুভাষ-সুকান্তের পথে না এগোলেও, দিলওয়ার সে-পথেই এগিয়েছেন, যে-কারণে বিষয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে তাঁর কবিতা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখলেও, পরবর্তীকালের কবিদের মধ্যে তাঁর কোনো অনুসারীর খোঁজ পাওয়া যায় না। সময়-রাজনীতি-গণমাধ্যমের নানা প্রভাবে এই বিশেষ মাধ্যমটির এমন ধারার স্বভাবকবিসুলভ উচ্চারণের অর্থ ও অনর্থময়তা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন পঞ্চাশ ও পঞ্চাশ-পরবর্তী কবিদের যুগযন্ত্রণার নানা চাপে চেতনায় সূক্ষ্ম-সংবেদনময় গূঢ় পথ অবলম্বন না করে উপায় ছিল না। ফলে এঁদের চেতনাজগৎ নানা কারণে হয়ে উঠেছিল জটিল : কেউ-কেউ সমাজচেতন, কেউ-কেউ হতাশাতাড়িত বলে পলায়নবাদী ও ক্ষয়শীল, কেউ-কেউ রোমান্টিক ও আত্মপরায়ণ, এর মধ্যে দিলওয়ারের স্বচ্ছ সাদামাটা একমাত্রিক গণচেতনাকেই মনে হয় যেন আরেকরকমের পলায়ন। স্বীকার করা উচিত, এই চেতনার বাইরেও দিলওয়ারের কয়েকটি কবিতা গণচেতনাময় কবিতাগুলোর ফাঁক-ফোকরে ছাপা হয়েছে, সেগুলোকে দুর্ঘটনা ভাবা মুশকিল, অন্তত ‘দুই বাঁক’ (এর ১-সংখ্যক কবিতা) এবং ‘জনৈক বিত্তবান কথক’, ‘বিধর্মী মোৎয়েমের কবিতা’ এবং ‘প্রেম : নির্ভয়ে’র মতো কবিতা যিনি লিখেছেন, নিশ্চয়ই এই ধারায় তাঁর আরো অনেক বলার ছিল, কিন্তু সেই আগুন ছাইচাপা রেখে, বলা উচিত অবদমিত রেখে, বৃহত্তর ডাকে নিরন্তর সাড়া দিয়ে গেছেন কবি, দায়পালনের চিন্তায় তিনি ছিলেন আমৃত্যু অভিভূত, তৃপ্ত এবং অবিচল। দিলওয়ারের কবিতা পাঠ ও বিবেচনার ক্ষেত্রে এই কথাটি মনে রাখলে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হবে।

দুই

১৯৮৭ সালে দিলওয়ারের জন্মের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত নির্বাচিত কবিতার শেষ প্রচ্ছদে মুদ্রিত মন্তব্যে উল্লিখিত হয়েছে : ‘সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় অনাচার ও শোষণ তাঁকে পীড়া দেয় এবং তিনি এর বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠকে সোচ্চার করে তুলেছেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পসম্মতভাবে, প্রচারসর্বস্বতাকে পরিহার করে।’ কথাটি দিলওয়ারের ক্ষেত্রে আংশিক সত্য, জিজ্ঞাসায় প্রচারসর্বস্বতা প্রকটভাবেই ছিল, নামকবিতাসহ ‘এবার এলো’, ‘মাউ মাউ-দেরে’, ‘কোন এক এগারো বৎসরের ধর্ষিতা মেয়েকে’ কবিতাগুলোর বিষয় গণচেতনারই পরিচয়বহ; কিন্তু সেগুলোতে প্রচারের হাওয়া তীব্রতর হওয়ায় শিল্পের দায় পালন হয়নি।

দ্বিতীয় বইয়ে এ-চেতনা পরিশীলিত হয়েছে, কোথাও-কোথাও বক্তব্য আরো জোরালো হওয়া সত্ত্বেও, উতরে গেছে। বইটির শুরু হয়েছে পরবর্তীকালে বিপুল জনপ্রীতিপ্রাপ্ত ‘কীনব্রীজে সূর্যোদয়’ কবিতাটির মাধ্যমে এবং আমাদের কাছে এ-কবিতা তাঁর সমগ্র কাব্যজগতের প্রবেশপথরূপে বিবেচিত। কবিতাটির ভাষা সাবলীল, স্বচ্ছ, এতে আছে ‘জনতার চলা’র বর্ণনা, কিন্তু এই গুণটিই শুধু এ-কবিতার বিশেষত্ব নয়, এ-‘চলা’র সঙ্গে আকাশবাতাসসূর্যরাত্রিপাখি এবং নদী সংশ্লিষ্ট হয়ে তার সঙ্গে জীবনব্যাপারের নানা প্রসঙ্গ জড়িত হওয়ায় কবিতাটি সপ্রাণ ও গতিময় হয়েছে – এখানে কবি শোনেন কলকল বেগবতী সুরমার ভাষা, যার গতিবন্ত প্রাণ জীবনের আশার সমতুল্য, যে-বীজ সৃষ্টিক্ষেত্রে ‘অক্ষয় প্রজ্ঞার’ বীজ বোনে, আর সবচেয়ে বড়ো কথা – যা তাঁর কাব্য-অভিপ্রায়ও বটে – করুণ রজনী অন্তর্হিত করে বর্শার ফলার রূপে সেই সূর্যরশ্মির আবির্ভাব :

ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা

কীন্ব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।

সম্পূর্ণ ব্রিজটি এখানে বাঁধানো খাঁচার প্রতীক, তার ওপর আঘাত না হানলে, বলা উচিত, না হানালে/ না জাগালে ‘জনতার চলা’ শুরু হয় না, অথচ ‘জনতাকে চলা’নো, এগিয়ে-দেওয়াই তো কবির উদ্দেশ্য, আমৃত্যু এ-কাজটিই করে যেতে চেয়েছেন দিলওয়ার। অন্যান্য কবিতা বা কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তার রূপ-ভাব ও প্রকৃতি হয়তো ভিন্ন, কিন্তু সেখানেও ‘চলা’তেই চেয়েছেন, কারণ এই ‘চলা’য় পথিক নিজেও তো কবির কাছে প্রতিশ্রুত : ‘মনে রেখো তুমি দিয়েছ আমারে কথা/ যেখানে অাঁধার সেখানেই তুমি জ্বলবে’, এবং এ-ক্ষেত্রে, এই ‘চলা’য়, তিনি খুবই একাট্টা ও দুঃসাহসী :

মনে রেখো তুমি : পরম দয়ালু বিধি

নরদানবের শিবিরে নিয়েছ ঠাঁই,

বুকে ধরে এই শুভ প্রত্যয় নিধি,

ঈশ্বর হতে আমরা চলেছি তাই।

এই ‘চলা’টা বা ‘চলা’নোটাই এ-ধারার কবিদের সার্থকতা, অন্যভাবে ভোগবৃত্তিতে বা স্থিরশান্ত ঔদাস্যেও তাঁরা সবসময় অতৃপ্ত। তাঁর পূর্বসূরি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো স্পষ্টভাবেই লিখেছিলেন, তাঁকে কেউ বলুক তিনি তা চান না, তিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হেঁটে যেতে চান, এই তাঁর লক্ষ্য :

আমি চাই কথাগুলোকে

পায়ের উপর দাঁড় করাতে।

আমি চাই যেন চোখ ফোটে

প্রত্যেকটি ছায়ার।

স্থির ছবিকে আমি চাই হাঁটাতে।

রবীন্দ্রনাথ কবিতাকে যে ‘সবাক ছবি’ বলেছেন, তাতে সায় ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের, কিন্তু তাঁর কবিতা যা বলে বা বলতে চায়, তা হলো : ছবিকে শুধু বাঙ্ময় হলে হয় না, তাকে স‘চল’ হতে হয়, হাঁটতে হয়, হাঁটাতে হয়। এর জন্য শক্তি ও গতি দরকার – এই গতি সুভাষ কি সুকান্ত, নজরুল বা দিলওয়ার সংগ্রহ করেছেন নানাবিধ নজির থেকে। দেখা গেল ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা চাঁদে গেলে তাঁর সেই গতিকে চলার/ ওড়ার প্রেরণারূপে অনায়াসে ব্যবহার করলেন দিলওয়ার : ‘পণ করেছে কাব্য আজ বুঝি/ ‘ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা’ হবে,/ রইবে না সে গৃহের কোণ খুঁজি/ মেলবে ডানা অলৌকিক নভে’। দিলওয়ার তাঁর কবিতায় পথচলার এই প্রেরণা গ্রহণ করেছেন কখনো চারপাশের উদাহরণ থেকে, কখনো  রাজনীতি-ইতিহাস-পুরাণের নানা নানা চরিত্র ও ঘটনা ও পূর্বসূরি কবিদের কাছ থেকে।

তিন

মার্কস, লেনিন, নেলসন মানদেলা, পল রোবসনসহ আরো কিছু ইতিহাসখ্যাত চরিত্রের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের কথা তো সকলেরই জানা। ‘অমোঘ সত্য’ কবিতায় লিখেছিলেন – পৃথিবী এখন অমাবস্যার অন্ধকারে লেনিনের হাত ধরে তারা/ আলো খুঁজছে। মার্কস ও লেনিনের বহু বাণীও যে তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে তাঁর প্রমাণ রয়েছে তাঁর লেখায়; ‘নেলসন মানদেলা : একটি আগ্নেয় স্মরণ’ কবিতায় লিখেছেন, তাঁর বজ্রনাদ শুনে ধবল প্যান্থার ও শ্বেতাঙ্গ অসুরবৃন্দ কীভাবে জ্বরার্ত শিশুর মতো কাঁপছে, আর ‘ফেডিপাইডিসের প্রতি’ কবিতায় উল্লিখিত হয়েছে বিশ শতকের হারকিউলিস এখন শতাব্দীব্যাপী দানব দমনে অস্থিচর্মসার, সে এখন নেড়ি কুকুরের সঙ্গে খাদ্যলাভের চেষ্টায় ব্যস্ত, তাই কবির উক্তি : ‘ফেডিপাইডিস, আমি যন্ত্রণার সমস্ত শাখা প্রশাখা/ কেটে ছিন্নভিন্ন করে দেবো/ যদি তুমি আমাকে আত্মঘাতী আলস্য নাশের মহামন্ত্র দাও’ – বিভিন্ন উৎস হতে আহরিত এই প্রেরণা আসলে সমষ্টির চেতনা, কবি যাকে বলছেন ঐকতান। এমনিতে ঐকতান কাব্যগ্রন্থের নামকবিতাটি রচিত হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমে, এর বিষয় মাকে লক্ষ্য করে সন্তানদের বক্তব্য, তার স্বর উত্তম পুরুষের বহুবচন – শেষ স্তবকে এসে এর স্বর-ব্যঞ্জনা আর ভাষা-পটভূমির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি :

রাতের কপালে দিনের খড়্গাঘাত

আমরণ তাই আমরা চালিয়ে যাবো,

অন্তরে রবে তোমার কমল হাত,

ঐকতানেই নিখিলের প্রাণ পাবো।

এই ঐকতানের চেতনাই তার কাব্যচিন্তার মূলাধার, যার প্রমাণ অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায় :

‘ঐকতানে’ই রয়েছে আমার জীবনের শেষ সত্য

দীর্ঘ আয়ুকে করে গেছি তাই শ্রম-সাধনার পথ্য।

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন ‘জীবনদেবতা’, তেমনই তাঁর কবিতায় ‘ঐকতান’ – যে-চেতনা ব্যষ্টিচেতনা ভুলিয়ে দেয়, এমনকি শয্যা পর্যন্ত যে সেই চেতনা প্রবল হয়ে আছে তার প্রমাণ রয়েছে তাঁর কবিতায়। ‘একটি প্রশ্ন : বউকে’ কবিতায় আছে, রাতে একটি ছোটো বিছানায় রয়েছেন পাঁচজন, বাইরে তিমিরে ঘামছে পেঁচা ও ইঁদুর, ওদিকে রাতের বাসরে ক্ষুধার কারণে পাহাড়ি ফুলের গাছে বাঘের শানানো থাবা। কবিতার শেষ দুটি স্তবক পড়লে বোঝা যায় কী কারণে কবির ব্যক্তিগত জীবন নৈর্ব্যক্তিক জীবনচেতনায় একাত্ম হয়ে ঐকতানে কণ্ঠ মিলিয়ে স্বস্তি খুঁজেছে :

ছোট্ট ঘরের পরিবেশে নই

আমরা পাঁচ :

শোনো কথা কয় হাজারো জনতা :

ডাঙার মাছ।

গৎবাঁধা এই মঠের জীবন :

রাত্রি বাস,

বলো তো আনছে জীবনে কাদের

সর্বনাশ?

বোঝা যায় তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ-প্রেম প্রভৃতির অনুভব কীভাবে ঐকতানের প্রভাবে আচ্ছন্ন থেকে গেছে সবসময়, কিন্তু এ নিয়ে তাঁর কোনো খেদ ছিল না। বরং প্রেমের অর্থ যে তাঁর কাছে নর-নারীর প্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সেই মনোভাব স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে অনেক কবিতায়। দিলওয়ারের একটি কবিতার শিরোনাম ‘একটি প্রেমের কবিতা’। প্রচলিত ধারণায় এ-কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এখানে থাকবে ব্যক্তিগত প্রেমের প্রসঙ্গ, কিন্তু আসলে তা নয় – সুকান্ত ভট্টাচার্যকে উৎসর্গিত এ-কবিতাতে রয়েছে সুকান্ত তাঁর জীবনে একান্তভাবে যা যা গ্রহণ করেননি তার তালিকা : কারো খোঁপার ফুলের গন্ধ, রাতুল পায়ের ছন্দ, ব্যাকুল মনের আবেগমুখর দ্বন্দ্ব, যক্ষের মেঘমন্দ্র, অভিসার-রাতের পূর্ণচন্দ্র, অস্থিরতার রন্ধ্র এবং হিংগুল সম্বিৎ প্রভৃতি, কারণ, ‘শ্রমজীবী প্রেমে জাগে সুকান্ত বিশ্ব’। তাঁর একাধিক কবিতার শুরু হয়েছে প্রেমাস্পদকে সম্বোধন করে, কিন্তু তাতেও কোনো ধরনের ভাবাবেগের প্রকাশ নেই। ‘মর্মজ্বালা’ কবিতায় রয়েছে প্রিয়তমার চোখের জলে তাঁর পৌরুষ বিপন্ন হওয়ার কথা, বিবেকের সূচিমুখ দংশনে-দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার কথা; ‘একটি বিনিময়’ কবিতায় রয়েছে জাতিসংঘের সদর দপ্তর ও তার অনন্ত ক্ষমতার জলজ্ব্যান্ত ছায়ার প্রসঙ্গ যা তাঁর প্রিয়তমা দেখতে চেয়েছিল; তাঁর স্ত্রী আনিসাকে সম্বোধন করে শুরু হয়েছে ‘নেল্সন মানদেলা : একটি আগ্নেয় স্মরণ’ কবিতাটি, কিন্তু সেখানেও নেই কোনো ধরনের ভাবাবেগ :

আনিসা শুন্তে পাও ‘উহুরু’ ‘উহুরু’ সেই ডাক?

অগ্নিগোলকের মতো কৃতঘ্ন অাঁধার ভেদ করে

সে ডাক ছুটন্ত দ্যাখো। রৌদ্র নৃত্য কালের অধরে!

কৃষ্ণ সাগরের স্রোতে শ্বেত দৈত্য আতংকে নির্বাক।

এই ‘প্রেমে’র ধারণা ‘আমার মৃত্যুর পর’ কবিতায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন দিলওয়ার। বলেছেন তাঁর সেই প্রেমিক হৃদয়ের কথা, যে-হৃদয় জন্মান্ধ আবেগ নিয়ে বারবার বাস্তবকে অস্বীকার করেছে, (কিন্তু তা একক কারো জন্য নয়) তাই যখনই বুক খুলে ধরেছেন বীণার জন্য, সেখানেই বেজেছে বন্দুক, বারবার বিদীর্ণ হয়েছে প্রত্যয়, আর সে-কারণেই তাঁর প্রেম আর একক কারো সঙ্গে যুক্ত না হয়ে, যুক্ত  হয়েছে বাংলার সঙ্গে – বাংলার বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে :

আমার মৃত্যুর পরে তাই যদি তুমি

কখনো খুঁজতে যাও এই মর্মভূমি

মনে রেখো তবে :

বাংলার হৃদয় নিয়ে কেটেছে আমার দিন

প্রতীচ্যের যুক্তির রৌরবে।

অন্যত্র, ‘পৃথিবী স্বদেশ যার, আমি তার সঙ্গী চিরদিন’ বলে ঘোষণা দিলেও তাঁর হৃদয়-মন আজন্ম বাংলার মাটিতেই প্রোথিত, তাঁর রক্তে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা-গঙ্গা-কর্ণফুলীর মিলিত স্রোতের ধারা, তবে তাঁর কবিতায় তিনি যে-আশাবাদের কথা বলেন, তার সঙ্গে শুধু বাংলার নয়, পৃথিবীর বহু মণীষার/ বহু মানুষের তান মিলে এ-‘ঐকতান’, এবং এতে আশাবাদ এজন্যই এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, দেবতা অ্যাপোলো বা আমরা যে সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখি, তা আসলে একপ্রকার ‘ভ্রান্তি’, আর সত্য হলো ‘সূর্য অস্ত যায় না কখনো’। r