অনিরুদ্ধ বিশ্বাস
জন্মতারিখ (২৭-১২-১৯৩৫) ও মৃত্যুতারিখ (২৭-০৯-২০১৬) যেন কবিতার মতো মিলে গেল। দুই বাংলা মিলে গেল আবেগে, শ্রদ্ধায়, দুঃখে, শোকে। এমন প্রতিভাকে কেই-বা হারাতে চায়, যিনি বলেন –
কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাঁতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানীর আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।
যিনি মৃত্যু আসন্ন জেনে, জীবনের সময় বড়ো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসছে জেনে, আরো চারটি নাটক লেখার কাজে হাত দেন, মৃত্যুশয্যায় প্রায় দুশো কবিতা লিখে ফেলেন, তিনি কি সাধারণ কেউ! না, মোটেই নয়। তিনি বর্তমান বাংলাদেশের ‘সব্যসাচী লেখক’ সৈয়দ শামসুল হক। পরিচিতজনের হকভাই। এ-লেখা যখন চলছে তখন তাঁর মৃত্যুর বয়স সবে দুদিন। ‘কর্কট’হানায় যাঁকে চলে যেতে হলো অমৃতলোকে : না-ফেরার দেশে। তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখার মাধ্যমে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো এক শ্রেষ্ঠতম পথ বলেই মনে হয়। তাই এ-লেখার অবতারণা।
দীর্ঘায়ু (প্রায় ৮১ বছর) লেখকের জীবনও খুব দীর্ঘ। প্রায় ৬২ বছরের। আক্ষরিক অর্থেই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লিখে গেছেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি বলে গেছেন, তাঁর স্ত্রী প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কখনো বা পুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে সাহিত্যের সমস্ত শাখাতেই তিনি নিজস্ব সৃজনী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ – সবেতেই তিনি সাবলীল। স্বচ্ছন্দ। সেই কারণেই তাঁকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। তাঁর লেখার স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কারসহ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘একুশে পদক’ও তিনি পান ১৯৮৪ সালে। তাঁর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫, কুড়িগ্রাম, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত। মৃত্যু, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। ইউনাইটেড হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ।
আমি এ-লেখায় তাঁর বহুধাবিস্তৃত সাহিত্যকর্মের মধ্যে মাত্র একটি নাটক নূরলদীনের সারাজীবন নিয়ে কিছু কথা লিখব। তারও একটা সংগত কারণ আছে। বিগত সাত-আট মাস (মার্চ ২০১৬ থেকে) এই নূরলদীনের সারাজীবন নাটকটির সঙ্গেই যাপন করেছি। এখনো করে চলেছি। অর্থাৎ এ-বছর ‘কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রে’র নাট্য প্রযোজনা এই নূরলদীনের সারাজীবন। এ-নাটকের একটি চরিত্রে আমি অভিনয় করি। তাই গত বেশ কিছু মাস এই প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত সকলেই ‘নূরলদীনে’র সঙ্গে যাপন করেছি। এ-যাপন এখনো বর্তমান। একটা ‘টেক্সট’ নিয়ে এতটা অন্তরঙ্গতার সুবাদে কিছু কথা নিজেরও তৈরি হয়ে যায়। সেই ভাবনা থেকেই এ-লেখার পরিকল্পনা। তার আগে একটা আর কোনোদিন না-মেটা আক্ষেপের কথা বলে নিই। আগামী ডিসেম্বরে (২০১৬) আমাদের ‘কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রে’র ঐতিহ্যবাহী ‘নাট্যোৎসবে’ নূরলদীনের সারাজীবন (২৫-১২-২০১৬) নাটকটি দেখতে স্বয়ং সৈয়দ শামসুল হক আসবেন বলে স্থির ছিল। কিন্তু আরো একবার প্রমাণ হলো, এ-পৃথিবীর কোনো কিছুই স্থির নয়। ওঁর সামনে ওঁরই লেখা। অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকে অভিনয় করে ওঁকে শ্রদ্ধা জানানোর এ-বিরল সুযোগ এসে গিয়েছিল আমাদের সামনে। কিন্তু তা আর হওয়ার নয়। এ-আক্ষেপ অনন্ত।
যার সঙ্গে গত কয়েক মাসের নিবিড়তা, ঘনিষ্ঠতা, আসি সেই নূরলদীনের সারাজীবন প্রসঙ্গে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম দশটি কাব্যনাট্যের নাম করতে গেলে প্রথম দিকেই স্থান দিতে হয় এই নাটকটিকে। সৈয়দ শামসুল হক সারাজীবনে আর কিছু যদি নাও রচনা করতেন, শুধু নূরলদীনের সারাজীবনের জন্য তিনি অমর হয়ে থাকতেন, এ-কথা বলাতে কোনো অত্যুক্তি হয় না। কাব্য করে-করে অনেক শব্দশিল্পী অনেক সাহিত্য নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তাঁদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতে হয়, সৈয়দ হকের এ-সৃষ্টি প্রায় অলৌকিক। একথা একান্তই নিজস্ব উপলব্ধি থেকে বলছি। এই নাটকটিতে অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত হতে-হতে প্রতিমুহূর্তে বিস্মিত হয়েছি। কারণ একে ইতিহাসনির্ভর কিছু চরিত্র, তার সঙ্গে একটা সত্যিকারের বিদ্রোহ। তারও সঙ্গে কিছু কাল্পনিক চরিত্র মিলেমিশে তৈরি এ-কাব্যনাট্য। বড় শিল্পী বা মহৎ শিল্পী কিংবা অতিশক্তিমান শিল্পী না হলে এ-নাটক মেলোড্রামা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত। কাব্য-রূপকল্প-অন্তর্গত বোধ-ইতিহাস-কল্পনা-অমোঘতা-বাস্তবতা-সংবেদ – হাত ধরাধরি করে মিশেছে, মিলেছে এ-কাব্যনাট্যে। নাট্যকার নাটকটি রচনা করতে গিয়ে বলেছেন –
ইতিহাস থেকে আমি পেয়েছি নূরলদীন, দয়াশীল ও গুডল্যাডকে; কল্পনায় আমি নির্মাণ করে নিয়েছি আব্বাস, আম্বিয়া, লিসবেথ, টমসন ও মরিসকে। নূরলদীনের আত্মা ও প্রেরণা আমি ইতিহাসের ভেতর থেকে সংগ্রহ করেছি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক সংকট আমি সম্ভবপরতার ক্ষেত্র থেকে আবিষ্কার করে নিয়েছি।
(নূরলদীনের সারাজীবন : ‘সবিনয় নিবেদন’ অংশ)
এ-নাটক ঐতিহাসিক নয়। তবে ইতিহাস-অবলম্বিত। মাত্র তিনটি চরিত্র ইতিহাসসম্মত। বাকি সব চরিত্রই কাল্পনিক। ঘটনা ইতিহাস-স্বীকৃত। একটি অজানা অখ্যাত স্থানিক বিদ্রোহকে মূল কেন্দ্রে রেখে, একজন বিপ্লবী মানুষের কয়েক সপ্তাহের অসফল বিদ্রোহকে নিয়ে যে-জীবনবেদ নাট্যকার রচনা করেছেন তা তুলনারহিত। আমাদের দেশের এমন অনেক ছোট ছোট বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি। কেউ তা নিয়ে ভাবেনওনি। কিন্তু এ-কথাও তো সত্য যে, এই ছোট-ছোট বিদ্রোহ আসলে একটি দেশের ‘মোটিফ’কেই তুলে ধরেছিল। সেদিক থেকে এই বিদ্রোহগুলো মানুষের হৃদয়ের পরিচায়ক। একটি জাতি এরকম নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়। হয়েছে। সেই ছোট ইতিহাস বড় ঐতিহাসিকেরা ভুলে গেলেও কেউ-কেউ তাকে লেখায় বাক্সময় করে তোলেন। ভবিষ্যৎ জাতিকে অতীত সম্পর্কে মনে করিয়ে দেন। সৈয়দ শামসুল হক সেই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন এ-নাটকে।
এই ইতিহাস অবিভক্ত বাংলার। অবিভক্ত ভারতবর্ষের। পরাধীন ভারতবর্ষের কৃষক-সাধারণ নিজের মাটির অধিকারের জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য বারবার সংঘবদ্ধ হয়েছেন। বিদ্রোহ করেছেন। এমনই এক বিদ্রোহ হয়েছিল ১৭৮৩ সালের ১৮ জানুয়ারি, নূরলদীন নামে এক অকুতোভয় বীরের নেতৃত্বে। এই বীরের নাম সম্পর্কে নাট্যকার নাটকের ভূমিকায় বলেন –
ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় নামটি লিখেছেন নূরুলউদ্দিন, আমরা বলব ওটা হবে নূরুদ্দীন, কিন্তু আমি ব্যবহার করেছি – নূরলদীন, রংপুরের সাধারণ মানুষেরা যেমনটি উচ্চারণ করবে।
অবিভক্ত বাংলার রংপুরের (রঙ্গপুর) ডিমলা, কাকিনা, টেপা, পাংশা, কাজিরহাট, ফতেপুর প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নূরলদীনের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। কাদের বিরুদ্ধে ছিল এই বিদ্রোহ? অবশ্যই ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ইংরেজদের সঙ্গে যুক্ত এদেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধেও দেশীয় জনগণ একজোট হয়েছিলেন। এ-ঘটনাই নাটকে উঠে এসেছে।
নাটকে দেখানো হয়েছে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২-৭৩ সাল থেকে কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের স্বত্ব বিক্রি করেন দেশীয় জমিদারদের কাছে। সেই সূত্রে দেবী সিং ১৭৮১-৮৩ পর্যন্ত রংপুরে রাজস্ব আদায়ের স্বত্ব পান। এ-স্বত্ব পেয়েই তিনি রাজস্ব আদায়ের নামে কৃষকদের ওপর ভয়ানক অত্যাচার শুরু করেন। এই অসহনীয় অত্যাচারের ফলে কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু লেফটেন্যান্ট ম্যাক ডোনাল্ডের নেতৃত্বাধীন সংগঠিত কোম্পানির বাহিনীর হাতে শেষ পর্যন্ত নূরলদীনের মৃত্যু হয়। কিন্তু আন্দোলনের কী মৃত্যু হয়? সে-কথাই নাট্যকার নূরলদীনের মুখে তুলে ধরেন –
হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই।
এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,
হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।
এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়,
অযুত নূরলদীন য্যান আসি যায়,
নিযুত নূরলদীন য্যান বাঁচি রয়।
চোদ্দোটি দৃশ্যে রচিত নাটকের স্পষ্টতই দুটি দিক। ইংরেজদের হাতে এদেশীয় সাধারণ প্রজার অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা একদিকে বর্ণিত, অন্যদিকে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী অভিজাত ইংরেজ অর্থাৎ লর্ড, ডিউক, ব্যারনদের হাতেই শোষিত প্রান্তিক ইংরেজরা, যারা মনোরম ইংল্যান্ডের আবহাওয়া, সুযোগ-সুবিধা, সর্বোপরি স্বদেশ ছেড়ে বিদেশবিভুঁইয়ের ভ্যাপসা গ্রীষ্মের আবহাওয়ায় নানারকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকেন। এই দুটি বিপরীত চিত্রকে নাট্যকার নিপুণভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন এ-নাটকে। আসলে শোষকদের চরিত্র সর্বকালে সর্বদেশে একই। মারামারি করে মরে শুধু শোষিতরাই। তারা শোষকের গজ, বোড়ে ইত্যাদি। চালের ওপর নির্ভর করবে তাদের চালচলন। এ-দিকটিও ভেবে দেখার মতো এ-নাটকে।
তবে নাট্যকারের মুখ্য উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল দেশীয় ইতিহাসকে বর্ণনা করা। সে-বর্ণনা খুবই স্পষ্ট। গভীর। কখনো তা আবেগময়। কখনো ব্যঞ্জনাধর্মী। আবার কখনো তা উপমাধর্মী। যেসব উপকরণের গুণে প্রকৃত কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়, তার সবই এ-নাটকে বিদ্যমান। নূরলদীনের মুখের একটি সংলাপ এ-প্রসঙ্গে উদ্ধারযোগ্য :
পুন্নিমার চান বড় হয় রে ধবল।
জননীর দুগ্ধের মতন তার দ্যাখোঁ রোশনাই।
এমন পবিত্র উপমা বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। এ-উপমাই তো জীবনের অন্যতর সত্যে পৌঁছে দেয় দর্শক-পাঠককে, যা সাহিত্যের সত্য। বাস্তবের সঙ্গে হয়তো তার মিল নেই। কিংবা আছে।
আর একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে কলম থামাব। সেটি হলো – নাটক দৃশ্যকাব্য, তার সাফল্য সবসময়েই অভিনয়ে। কিন্তু এ-নাটকের পাঠ্যগুণও উচ্চমানের। শুধু পাঠ করেই পাঠকের রসতৃপ্তি ঘটে। তবে সর্বোপরি একথা বলা যায়, কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র নূরলদীনের সারাজীবন মঞ্চে যেভাবে প্রয়োগ করেছে, অভিনয় করেছে – তা সত্যি-সত্যিই অন্য ধরনের রসের জোগান দেয়। অনেক অচেনা অনুভূতিকে খুঁচিয়ে দেয়। সবশেষে নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের কালজয়ী এ-নাটক কালের বিচারে উত্তীর্ণ হবে বলেই বিশ্বাস করি। কারণ, এমন লেখা, এমন কাব্যনাট্য বাংলা সাহিত্যে একটি-দুটিই হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.