স্থাপত্যেরও অধিক প্রখর যাঁর মূল্য পরিমাণ

আমিমুল এহসান

যদি বাংলা সাহিত্যের আকাশ আলো করে থাকেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্রকলায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, তাহলে স্থাপত্যে অবিসংবাদী হয়ে থাকবেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তাঁর হাত ধরে এই ভূখন্ডে আধুনিক স্থাপত্যের সূচনা হয়েছে। ইসলামি স্থাপত্যরীতি আর ঔপনিবেশিক অলংকরণের মিশ্রণে যে-নির্মাণধারা পঞ্চাশের দশক থেকে চেপে বসেছিল আমাদের নগরে, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম তাকে একাই চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। স্থাপত্যকে তিনি বাহুল্য থেকে মুক্তি দিয়েছেন, আড়ম্বরকে অব্যাহতি দিয়েছেন। নির্মাণকে তিনি সত্যনিষ্ঠ করেছেন কাঠামোর প্রতি, নির্মাণসামগ্রীর প্রতি আর ব্যবহারিক উপজীব্যতাকে প্রয়োজনে ছাপিয়ে নিয়ে গেছেন নতুন সম্ভাবনার কাছে। আধুনিক স্থাপত্যের বিশ্বজনীন রূপকে তিনি আমাদের নদীবিধৌত ভূমিরূপে প্রখর রৌদ্রকিরণ আর বৃষ্টি-অধ্যুষিত জলবায়ুর সঙ্গে গ্রন্থিত করেছেন। তাঁর ভবনের দেয়ালে ইট আর কংক্রিটের কাঠামোয়, জানালায় ও করিডোরের গভীরতায় আলো-ছায়ার ব্যাপ্তি ট্রপিক্যাল স্থাপত্যকে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যে-স্থাপত্যরীতি একান্তভাবে আমাদের নিজস্ব আধুনিকতা থেকে উৎসারিত। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সমাজসংস্কারক, পরিবেশবিদ এবং সর্বোপরি একজন মহান স্থপতি।

মাজহারুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন, বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার জন্য সবার আগে নিজের মাটিতে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্থাপত্যের ভাষায় তিনি কথা বলেছেন তাঁর শিখরস্পর্শী একেকটি নির্মাণে। পঞ্চাশের দশকে বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট ছিল তাঁর প্রথম কাজ – এই বাস্তবতা এখন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। শূন্য অবস্থানে দাঁড়িয়ে স্থাপত্যের এমন মাইলফলক পঞ্চাশের দশকে আমাদের স্থাপত্যযাত্রায় সাহসী সূচনা এনে দিয়েছিল। অবিরল নিসর্গের মধ্যে এ-ভবনের স্থাপনা আমাদের দেশজ লোকায়ত আবাসনকল্পের সব অনুষঙ্গকে নতুনরূপে পরিচিতি দিয়েছিল। সমুখের প্যাভিলিয়ন, অন্তর্বর্তী উঠান, সিঁড়ির ভাস্কর্য ও দীর্ঘ বারান্দায় আনুভূমিক ‘ফিন’, ‘জালি’ কিংবা ‘বেড়া’র ব্যবহার ইটকে ইট, কাঠকে কাঠ কিংবা কংক্রিটকে কংক্রিটের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে গিয়ে তাতে নিখুঁত এক বুনন তৈরি করা – এসবই ছিল এ-অঞ্চলে সম্পূর্ণ নতুন এক স্থাপত্যভাষা। প্রকৃতির বিস্তারকে তিনি কোথাও প্রতিহত করেননি, বরং প্রকৃতিকে গ্রহণ করেছেন, আবার প্রকৃতির মধ্যেই এই নির্মাণকে নিবেদিত করেছেন। স্থাপত্যের নন্দনে রূপ, বুনোট, অনুপাত, আকার ও শূন্যতার বিন্যাস এখানে ধ্রুপদ মাত্রায় সন্নিহিত।

স্থপতি মাজহারুল ইসলামের প্রকল্পগুলোর দিকে তাকালে স্থপতির ব্যক্তিগত সততার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়। এই সত্যনিষ্ঠতা স্থানিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি, ভূমিরূপের সঙ্গে ছন্দময় অবস্থানের প্রতি, সর্বোপরি নির্মাণকে শিল্পরূপে স্থাপনা দেওয়ার প্রতি নিবিষ্ট থেকেছেন। তাঁর হাতে বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যধারা বিকশিত হয়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে যাওয়া পথপ্রদর্শক। বাংলার স্থাপত্যে তিনি একাই আধুনিক যুগের সূচনা করেছিলেন এবং ধীরে ধীরে তিনি এই স্থাপত্যভাষাকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে গেছেন।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ছিলেন বাঙালির বিকাশপর্বের এক প্রবাদপুরুষ। তাঁর কৈশোরের সন্নিহিত সময়ে বেঁচেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো কবিরা। তিনি আত্মস্থ করেছেন মহাত্মা গান্ধী, অরবিন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দের মতো প্রাজ্ঞজনের ব্যক্তিত্বকে। তাঁর বেড়ে ওঠার সময় ছিল এ-অঞ্চলের ঋদ্ধতার সময়, যা আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর রাজনৈতিক ধারাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। সুশীল, সত্য ও সুন্দরের প্রতি নিবেদিত ছিলেন যুগ পরিবর্তনের এই মহানায়কেরা, যার প্রভাব পড়েছিল স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ব্যক্তিচরিত্রে ও মূল্যবোধে।

এই শুদ্ধতা তাঁকে নিবেদিত রেখেছে সত্যের প্রতি। স্থাপত্যে তিনি যেমন ব্যবহারিক বিধি, নির্মাণকাঠামো আর নান্দনিক রূপ বিধৃতির মধ্যে সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন, তেমনি রাজনীতিতে তিনি সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেছেন। সমাজতন্ত্রকে তিনি শোষণমুক্তির একমাত্র পথ ভেবেছেন, যার প্রতি তিনি স্থাপত্যের মতোই একনিষ্ঠ থেকেছেন সারাজীবন। তিনি ছিলেন নির্মোহ, নির্লোভ ও ত্যাগী এক ঋষিজ ব্যক্তিত্ব। স্থাপত্যের নন্দন তাঁকে পরিতৃপ্ত করেনি বলে তিনি সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিকে গন্তব্য জেনেছিলেন। স্থাপত্যকে তিনি চার দেয়াল থেকে মুক্ত করে সমাজের সর্বস্তরে এর সৌন্দর্যকে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন। তাই শাসকগোষ্ঠী বারবার তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা আর সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির কারণে তাঁর সময়ের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্রকার প্রভৃতি পেশার আলোকিত ব্যক্তিরা মাজহারুল ইসলামের কাছে আসতেন। তাঁর স্থাপত্য-উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ‘বাস্ত্তকলাবিদে’ ভিড় করতেন সবাই। কেননা, তিনি সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর কর্মে ও চিন্তায় তিনি দেশ গঠনের দিকটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এমন এক পরিবেশে শিক্ষাপর্ব শুরু করেন, যখন স্থাপত্য সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। ১৯৪২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর শিবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় শিক্ষকরা তাঁর অঙ্কনশৈলীর প্রশংসা করতেন, যা তাঁকে ধীরে ধীরে স্থাপত্যের প্রতি অনুরাগী করে তোলে। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রকৌশলবিদ্যা শেষ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে স্নাতক পর্ব শুরু করেন। ১৯৫২ সালে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি বৃত্তি নিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত অ্যা স্কুল অব আর্কিটেকচারে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে চলে যান। ১৯৬১ সালে আবার বিদেশে যান রকফেলার ফেলোশিপ নিয়ে ইউরোপের সমকালীন স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে। এই দীর্ঘ শিক্ষাকাল ছিল তাঁর প্রস্ত্ততিপর্ব। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে নির্মাণ করেছেন, শাণিত করেছেন, পরিণত স্থপতি হয়ে ওঠার কঠিন শ্রমে নিয়োজিত রেখেছেন। পেশাজীবনে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিনিয়র স্থপতি হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়ে এ-অঞ্চলের স্থাপত্যিক সমৃদ্ধির জন্য তিনি বিশ্ববিখ্যাত স্থপতিদের নিয়ে এসেছেন এদেশে। স্ট্যানলি টাইগারম্যান, জ্যাঁক মিশেল, পল রুডলফের মতো জগদ্বিখ্যাত স্থপতিদের এদেশে কাজ করার বিষয়ে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এই ধারায় তাঁর সবচেয়ে বড় অবদানের কথা অনেকেই জানেন না। স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন ডিজাইনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ১৯৬২ সালে। তিনি কিছুদূর কাজ এগিয়ে এ-দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর আগ্রহে এবং কর্মপ্রচেষ্টায় বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি লুই আই কান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলাদেশের সংসদ ভবন ডিজাইনের জন্য নিয়োজিত হন। বাংলাদেশকে বিশ্বমানে নিয়ে যেতে চেয়েছেন বলে নিজের পদ এভাবে ছেড়ে দিয়েছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইমলাম।

স্বাধীনভাবে, নিজস্ব ধারায় কাজ করার প্রবল তাগিদ নিয়ে সরকারি চাকরি থেকে সরে দাঁড়ান ১৯৬৩ সালে। শুরু করেন নিজস্ব উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ‘বাস্ত্তকলাবিদ’। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ – এই সাত বছরকে বাংলার স্থাপত্য ইতিহাসে সবচেয়ে ঋদ্ধ সময় বিবেচনা করা হয়। ১৯৫৩-৫৪ সালে তিনি ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউট আর পাবলিক লাইব্রেরির ডিজাইন করেছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ – এই সময়পর্বে তিনি একাধারে পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি ভবনগুলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মতিঝিলে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ভবন, জীবন বীমা ভবন প্রভৃতির কাজ সম্পন্ন করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে থেমে থেমে চলেছে তাঁর স্থাপত্যকর্ম। বাম রাজনৈতিক আদর্শের কারণে তাঁকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া চলেছে। ন্যায্য ফি না দিয়ে অসম্মান করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, আর রাজনৈতিক নিপীড়ন-নিগ্রহ চলেছে বিবিধ পর্যায়ে। এই সময়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ জয়পুরহাটে চুনাপাথর-সিমেন্ট প্রকল্পের হাউজিং মাস্টারপ্ল্যান ও ডিটেইল ডিজাইন, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও ন্যাশনাল আর্কাইভ ভবন, বিশ্বব্যাংক অফিস ইত্যাদি।

বস্ত্তত, যে-সময়ে মাজহারুল ইসলামকে থামিয়ে দেওয়া হলো, তখন তিনি ৫০ বছরে পা দেবেন। স্থপতি লুই আই কান বলেছিলেন, ৫০ বছরে এসে একজন পরিণত স্থপতি হয়ে ওঠেন, আর সে-বয়সে এসে স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে সরে দাঁড়াতে হলো এই সৃজনশীল পেশা থেকে। কেননা, তিনি ভেবেছিলেন, তিনি আপস করবেন না – যা তিনি সত্য জেনেছেন, তার বিপক্ষে যাবেন না। তিনি কাজের জন্য চাটুকারিতা করবেন না। তিনি অভিমানহত হয়েছেন, নিভৃত হয়েছেন, নিজের গহিনে আবৃত হয়ে থেকেছেন দীর্ঘকাল। বাংলাদেশ তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেনি, কিন্তু সারা পৃথিবী স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে ‘লিভিং মাস্টার’ হিসেবে জেনেছে। বিশ্বমানের অনেক স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় তাঁকে জুরি বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে।

১৯৯৯ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন। সে-বছরেই তিনি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের ফেলোশিপ সম্মাননা পান এবং জে কে সিমেন্ট গ্র্যান্ডমাস্টার পুরস্কার লাভ করেন।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন, কেবল বিচ্ছিন্ন স্থাপত্য দিয়ে আমাদের দেশ সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে না। তিনি নগরের সব উপকরণ একসঙ্গে গুছিয়ে কাজ করার কথা বলতেন। কৃষিভিত্তিক গ্রাম আর অর্থনৈতিক গতিশীল কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র শহর – এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এক নতুন নগরায়ণের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। এই স্বপ্ন তিনি ব্যাপিত করেছেন নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের মধ্যে। স্থাপত্য আর নগর পরিকল্পনা – এই দুইয়ের সুষম সংযোগ ছিল তাঁর ঐকান্তিক চাওয়া। তাঁর উদ্যোগে পাকিস্তান পর্বে গঠিত হয়েছিল মিনিস্ট্রি অব ফিজিক্যাল প্ল্যানিং। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তিনি এ-মন্ত্রণালয় খোলার জন্য উদ্যোগী ছিলেন, যার মাধ্যমে দেশের জলাভূমি, কৃষিভূমি, রাস্তাঘাট, আবাসন, বনাঞ্চল, গ্রাম-শহর, পরিবহন – সবকিছুকে পরিকল্পনার আওতায় এনে গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা যাবে।

পঞ্চাশে থেমে যাওয়া স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ব্যক্তিগত নির্বাসনকালের সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর পরিবার-পরিজন আর কিছুসংখ্যক স্থপতি-শিক্ষানুরাগী। আশির দশকে তাঁর হাত ধরে ‘চেতনা’ অধ্যয়ন চক্র এগিয়ে চলে। বাংলার স্থাপত্য ছাড়াও চিত্রকলা, দর্শন, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে স্বশিক্ষিত উদ্যোগী মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে চেতনা একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।

মাজহারুল ইসলাম ধর্মপ্রচারকের নিবিড় মগ্নতায় এভাবে সচল রেখেছেন তাঁর চিন্তা, যা তিনি প্রবাহিত করেছেন নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের মধ্যে। তিনি শঙ্কিত হয়েছেন নগরায়ণের এই ভয়াবহ তান্ডবে। তিনি বিচলিত হয়েছেন জনসংখ্যার বিপুল বিস্ফোরণে। তিনি আশাবাদী হয়ে বারবার নতুন প্রজন্মকে অাঁকড়ে ধরেছেন। তিনি বিশ্বাস রেখেছেন, বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তরুণ নেতৃত্ব একদিন আমূল বদলে দেবে এ-দেশকে – এই আপ্তবাক্য তিনি স্মরণ করিয়েছেন পরিপার্শ্বের সব সহযাত্রীকে।

স্থপতি হিসেবে একটা ঘর বানানোর আগে জানতে হবে, সে ঘরে কয়জন মানুষ বাস করবে। শহরের বিষয়টাও তা-ই। একে সুন্দরভাবে গোছাতে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা তাই চলে আসে। স্থাপত্য আর নগর পরিকল্পনা – এ দুইয়ের সংযোগে পুরো দেশের ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে সবাই মিলে কাজ করার প্রবণতা একেবারেই নেই। কিন্তু একা তো কিছু করা যাবে না। শহর গোছানোর কাজটা সবাইকে নিয়েই করতে হবে।

স্বাধীনতার পর সরকারকে আমি ভৌত পরিকল্পনার জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় করার কথা বলেছিলাম। তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার এ-বিষয়ে কথা হয়েছিল। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমাদের দেশটা গ্রামপ্রধান। আর গ্রামে এত দরিদ্র জনসাধারণ থাকে! এই সমস্যা সমাধানে স্থাপত্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কিনা?’ আমি তখন বলেছিলাম দেশজুড়ে নগরায়ণের কথা; যেখানে শহর, গ্রাম, নদীনালা, রাস্তাঘাট, কৃষিক্ষেত্র – সব মিলেমিশে থাকবে। শহরে পুরুষ ও নারীর কাজ করার পাশাপাশি আলাদা খেলাধুলার জায়গাও থাকবে। এ বিষয়ে একটি লিখিত প্রতিবেদন ও কিছু ড্রয়িংও আমি তাঁকে দিয়েছিলাম। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরই তিনি সপরিবারে নিহত হন। তিনি আমার দেখা বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি স্থাপত্য ও পরিকল্পনা এবং পরিকল্পিত নগরায়ণের গুরুত্ব বুঝেছিলেন।

ভারত-পাকিস্তানের অনেক শহর কিন্তু বহু আগেই এ-বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। এজন্য প্রচুর পড়াশোনা ও সমন্বিত প্রয়াসের প্রয়োজন। অথচ তা আমরা এখনো করতে পারছি না।

আমরা আমাদের এ-শহরের রাস্তায় ১২-১৩ ধরনের যানবাহন চলতে দেখি। অথচ আমাদের রাস্তাগুলোর নকশা তেমন নয়। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ এখানে পথ চলতে পারেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সবাইকে অনেক কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কিন্তু শহরের এ-সমস্যাগুলো যাঁরা বোঝেন, তাঁদের দায়িত্ব এর সমাধান সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের বোঝানো। শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য বাঁচতে হবে। নকশা তৈরি করে, নিয়মনীতি তৈরি করে সবাইকে তা বোঝাতে হবে। এ বয়সেও আমি স্বপ্ন দেখতে পারছি, একদিন এ-শহর একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে। আমি নই, কিন্তু আমাদের সন্তানরা কিংবা তাদের সন্তানরা নিশ্চয় বাংলাদেশকে একটা সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে দেখবে।

বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে সূচনা হয়েছিল এই ঢাকা শহরের। সেই নদীকে ভুলে গিয়ে আজ আমরা কত দূরে শহরটিকে বাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছি! ২৫ বর্গমাইলের শহরকে ছয়শো পঞ্চাশ বর্গমাইলে নিয়ে গেছি। অথচ সবই অপরিকল্পিত রয়ে গেছে।

আমি বিশ্বাস করি, এই শূন্য অবস্থা থেকে আমরা উঠে দাঁড়াতে পারব। খুব ক্ষুদ্রভাবে হলেও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি যেন থেমে না যায়। এটা একটা সারাজীবনের যুদ্ধের মতো ব্যাপার। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারলে আমরা নিশ্চয় সমগ্র বাংলাদেশকে দৃশ্যগত এবং কার্যকর – উভয় ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সুন্দর করতে পারব।’

[স্থপতিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ফেব্রুয়ারি, ২০০৬]

১৫ জুলাই ২০১২ তাঁর মৃত্যুকাল হিসেবে নির্ধারিত হয়েছিল। তিনি ৮৯ বছরের দীর্ঘ জীবনকাল পেয়েছিলেন বলে মনে করা যায়। কিন্তু সত্যি কি তিনি দীর্ঘ জীবন বেঁচেছিলেন? বিশ্বমানের এই  স্থপতি কি স্বাধীনতা-উত্তরকালে, ব্যক্তিগত ৫০ বছর বয়সেই  থেমে যাননি? ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ – সেই জ্বলজ্বলে সাতটি বছরের পর এমন দীর্ঘ কর্মহীন ও নিভৃত জীবনকাল কেমন নিষ্প্রভ আর মৃত্যুময় কেটেছে, তা নিশ্চয় জানেন তাঁর পরিজন আর স্থপতি-স্বজনরা।

মৃদু বাক্যে, ধীরলয়ে, সৌমকান্তি এই ঋষিজ মানুষটি আর ফিরে আসবেন না। দীর্ঘ মৃত্যুর দিন পার করে তিনি সত্যি সত্যি মৃত্যুর দেশে পৌঁছে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের ভেঙেপড়া সমাজকাঠামো, ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি আর অপরিকল্পিত নগরায়ণ কোথাও একটু থমকে যাবে কি? তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আমরা ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’ বুঝি কি না। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একটি অপরাহেণ তিনি আমাদের বলেছিলেন, প্রথম সামরিক সরকারের সময় তাঁকে তিনদিন একটি দরজা-জানালাহীন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হয়েছিল। তারপর এক বছরের গৃহবন্দিত্ব। তাঁর পেশাজীবিতাকে, সামাজিক বলয়কে, মুক্ত বিচরণকে ও সুস্থ-স্বাধীন চিন্তাকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। যিনি আমাদের স্থাপত্যের পরিসরে অবারিত আলো আর বাতাসকে তরঙ্গায়িত করেছিলেন, তিনি এদেশের কাছে আলো-বাতাসহীন ‘সলিটারি কনফাইনমেন্টে’র বিনিময়মূল্য প্রতিদান হিসেবে পেয়েছিলেন – এ সত্যবাক্য আমরা যেন ভুলে না যাই।

এই দেশ ও জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি কীভাবে নিষ্ঠুরতম অবস্থা আর অসম্মান স্থাপন করে চলেছে – প্রবাদপ্রতিম এই স্থপতি নীরব-নিঃশব্দতায় তা আরেকবার জানিয়ে গেলেন।

তবু আমার বিশ্বাস, এমন অগণন ক্ষোভ আর দীর্ঘশ্বাস শেষ হয়ে গেলে বাংলার স্থাপত্য ইতিহাসে, বিশ্ব মানচিত্রের বিপুল ব্যাপ্তিতে এবং আমাদের ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গ ঋদ্ধতার স্বপ্নযাত্রায় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম চিরদিন বেঁচে থাকবেন