স্মৃতির ছায়াপাত

 

\ ৯ \

 

অনিতা সেনের স্মৃতিকথা

বাবা জাস্ট জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। ডায়াবেটিস অসম্ভব বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে তড়িঘড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। শরীরটা শুকিয়ে পাটকাঠি, অথচ রস জমা পা দুটি টুসটুসে কদলীবৃক্ষ। বাবাই একদিন হাঁটুর ওপর ধুতি তুলে ক্ষীণ হেসে কথাটা বলেছিলেন আমাদের প্রতিবেশী দত্তবাবুকে। চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসা বারণ ছিল বাবার। দিনমান শুয়ে থাকতেন বিছানায়। মা তাঁর পায়ের নিচে উঁচু বালিশ গুঁজে দিয়ে ভাবতেন – পায়ের রস আপনিই নেমে যাবে। তখনো আমরা জানতাম না যে, বাবার কিডনি দুটি অকেজো হয়ে পড়েছে।

সিলেটের বানিয়াচঙ্গে দুর্ভিক্ষ। আমি বাবার বিছানার কাছে গিয়ে আসেত্ম করে বলি – ‘পাঁচশো টাকা ডোনেশন করো, বাবা। তুমি তো জেলে ছিলে তাই জানো না, মানুষ না খেয়ে মরছে।’ আমাকে বিদায় দিয়ে মা স্নানে গেছেন। বালিশের তলা থেকে চাবি বের করে দিলেন বাবা। আমি আলমারির ড্রয়ার খুলে গুনে দেখি – সাকল্যে পাঁচশো টাকাই আছে। সবটা নিয়ে নেব! বাবার ওষুধ-পথ্য, সংসারের খরচ! বাবা কবে কোর্টে, চেম্বারে ফিরে যেতে পারবেন কে জানে। নিশ্চয়ই আরো টাকা-কড়ি আছে কোথাও। মা চলে এলে একশ টাকা নিয়েও বেরোতে পারব না। বস্নাউজে পাঁচশো টাকা গুঁজে তাড়াতাড়ি আলমারিতে চাবি দিচ্ছি, পেছনে বাবার গলা – ‘কবে ফিরবি?’ এ-প্রশ্নের জবাবে আমি সবসময় বলতাম – ‘বিপস্নবের পর।’ নিমেষে বিদায়লগ্নটা বাতাসের মতো লঘু মনে হতো। দুয়ারে দাঁড়িয়ে হাসতেন বাবা-মা। সেদিন ঘুরে তাকিয়ে দেখি, বাবা বালিশ থেকে মাথা তুলে সজল চোখে তাকিয়ে আছেন। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল বাবার চোখের জল মুছিয়ে দিই। ছোট্ট করে চুমু খাই তাঁর চওড়া কপালটায়। আমার তখন অসম্ভব তাড়া। ঘরের দরজা টেনে দিতে দিতে বললাম – ‘খুব শিগগির, আমার প্রিয় বাবা!’

হু-হু করে ডাউকি ব্রিজ পেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাস। আমার খুব বিষণ্ণ লাগছিল। শিলং কি আর শিগগির ফেরা হবে? পার্টি তো এতগুলো দিন এখানে থাকতে দিয়ে আমার প্রতি অসম্ভব দয়া দেখিয়েছে। মা তখন একা বাড়িতে। বাবা জেলখানায়। পার্টি কংগ্রেসের যুদ্ধবিরোধী সহিংস আন্দোলনের নিন্দা জানালেও আগাগোড়া সোচ্চার ছিল বিনা কারণে বাবার মতো লোকদের হাজতবাস, আন্দোলনকারীদের ওপর রাজের জেল-জুলুম ও হত্যাকা- চালানোর বিরুদ্ধে। অসুস্থ হলেও বাবা ছাড়া পেয়েছেন। তার মধ্যে কত কী ঘটে গেছে! কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীরা সুরমা উপত্যকা ঘুরে গেছেন। সাক্ষাৎ হলো না। বম্বেতে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট কনফারেন্সে যেতে পারিনি বলেও মনে দুঃখ। তবু পার্টি যত টাকা ডোনেশন চেয়েছে, পুরোটাই আনতে পারায় শস্নাঘাবোধ করছিলাম। তা সত্ত্বেও সিলেট এসে আরো চাঁদা তোলায় নামতে হলো। বানিয়াচঙ্গে দুর্ভিক্ষের তখন দ্বিতীয় ফেস – মহামারি শুরু হয়ে গেছে। পুরো গ্রাম শ্মশান। থেকে থেকে রাস্তার কুকুরগুলো কেঁদে ওঠে। ‘বাইন্যাচঙ্গের প্রাণবিদারী, ম্যালেরিয়া মহামারি, হাজার হাজার নর-নারী মরছে অসহায়…’ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানটি গেয়ে সিলেটের পাড়া-মহলস্নায় ভিক্ষার ঝুলি হাতে ঘুরছি। লোকজনও সাধ্যমতো টাকা-কড়ি, চাল-মুড়ি দিচ্ছে। জনযুদ্ধের প্রচারে নেমে যেসব লোকের গলাধাক্কা খেয়েছি, ওরাও দেখি ডেকে ডেকে টাকা-পয়সা দেয়! চার্চিল সাহেব দুর্ভিক্ষ বাধিয়ে ভালোই জনসংযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আমাদের। তখনো অবশ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ‘পোড়ামাটি নীতি’ বা ‘ডিনায়াল পলিসি’ লোকের বুঝে উঠতে ঢের বাকি। তা তাদের বোঝারও কথা নয়। যুদ্ধ মানে তো বস্ন্যাকআউট, বাফার ওয়াল বা ট্রেঞ্চ কাটা। মানুষ মরলে বোমার ঘায়ে বা গুলিতে মরবে। না খেতে পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে কেন? রাজের পোড়ামাটি নীতির কারণে সত্যিকারে তা-ই হয়েছিল। জাপানিরা এসে চাল খেয়ে নেবে, যত পারো খাদ্যশস্য সরাও। শত্রম্ন যাতে দেশময় ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্য সমুদ্রোপকূল আর নদীকূলের তিরিশ মাইলের মধ্যে কোনো নৌকো থাকা চলবে না। সব স্থানীয় লোকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলো, নয় ডুবিয়ে দাও। তখন তো পূর্ববাংলায় জালের মতো বিছানো নৌরুট। লোক চলাচল, দ্রব্যসামগ্রী স্থানান্তর সবই হতো নৌপথে, নৌকোতে করে। নিমেষে মাঝিরা বেকার, জেলেরা কর্মহীন। তেতালিস্নশের দুর্ভিক্ষে ওরাই মরেছে বেশি। ‘ডিনায়াল পলিসি’ থেকেই ফুড প্রকিউরমেন্ট, নৌকা-ডোবানো, অবাধ কালোবাজারি। সেসব কালোবাজারি, মুনাফাখোর আর মজুতদারের সাজাও হয় না। ওয়ার ফান্ডে মোটা অংকের টাকা দিয়ে রেহাই পেয়ে যায়। ফলত বছর গড়াতেই চলিস্নশ লাখ মানুষ না খেতে পেয়ে সাফ।

ব্রিটিশরাজ খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করছিল যুদ্ধের সিভিল সাপস্নাই বহাল রাখতে, তার যুদ্ধ জেতার প্রয়োজনে। সেই যুদ্ধের শরিক না হয়েও তাদের সাম্রাজ্য রক্ষার যাবতীয় কিছুর জোগানদার তখন ভারতবর্ষ। তা সেনাসামন্ত, খাদ্যশস্য, আর্মস-অ্যামুনেশনসহ যুদ্ধের আনুষঙ্গিক কাঁচামাল। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই – ৭০ হাজার টনেরও বেশি চাল ভারত থেকে চালান যায়, যা দিয়ে এখানকার ৪ লাখ লোকের সম্বৎসরের আহারের সংস্থান হতো। আর এ সমস্ত কিছু ঘটেছে প্রায় বিনা প্রতিরোধে। যদিও আগস্ট আন্দোলনের সময় সরকারের ফুড প্রকিউরমেন্টে বাধা দেওয়া হয়েছিল কিছু কিছু জায়গায়, তাতে খুন-জখম-কয়েদবাসই সার, ঠেকানো যায়নি। পার্টি বলত – এসব করে জাপানিদের সুবিধে করে দিচ্ছে কংগ্রেস। সৈন্যরা খাবার না পেলে ফ্যাসিস্টবিরোধী লড়াই হবে কীভাবে। সারাক্ষণ সেই ভাঙা রেকর্ড (আমার মায়ের ভাষায়) – জাপানিরা আক্রমণ করছে, পঞ্চম বাহিনীর গুণ্ডামি রুখো। তাই আগস্ট আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন জাপানি আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতিস্বরূপ ভলান্টিয়ারদের ড্রিল করাতে ব্যস্ত পার্টি। কমরেডস! লাইন বাঁধো। আরামে দাঁড়াও। লেফট-রাইট। লেফট-রাইট। অ্যাবাউট টার্ন। কুইক মার্চ। হল্ট। কুইক মার্চ। ডবল মার্চ…

সে-সময় আশু খাদ্যসংকটের সমাধানের কথাও বলেছে পার্টি। অঙ্গুলি তুলেছে ডিনায়াল পলিসির দিকে নয়, কালোবাজারি, মজুতদার, মুনাফাখোরদের দিকে। দুর্ভিক্ষের জন্য শ্যামাপ্রসাদ আর হকসাহেব দায়ী করছিলেন নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভাকে। নাজিমুদ্দিন করছিলেন বিগত শ্যামা-হক মন্ত্রিসভাকে। কারো দৃষ্টি চার্চিল অবধি পৌঁছোয়নি। কিছুসংখ্যক হিন্দু পত্রিকা তো দুর্ভিক্ষের জন্য সরাসরি সিভিল সাপস্নাই মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে দোষারোপ করছিল। তাঁর দুর্নীতির জন্যই নাকি এত বড় দুর্ভিক্ষ।

মানতেই হবে, সেদিনের সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পার্টির চোখ অন্ধ হয়ে যায়নি। সে হিন্দুত্ববাদ বা মুসলমানিত্ব যাই বলি। ফ্যাসিস্টদের রোখাই ছিল একমাত্র ভাবনা। এত দূরের দেশ সোভিয়েত রাশিয়া! আমরা না পারছি অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদের শীতার্ত, ক্ষুধার্ত, বিপন্ন মানুষের মুখে এককণা খাবার তুলে দিতে। না পারছি লালফৌজে শামিল হতে। পার্টির তখন রাজের ফ্যাসিস্টবিরোধী যুদ্ধের ধুয়ো ধরা ছাড়া উপায় কী। তাই করা হয়েছে। চার্চিলের ডিনায়াল পলিসি তখন খতিয়ে দেখা হয়নি। বা জোর গলায় প্রতিবাদ করেনি তাঁর ভারতীয় বিদ্বেষ আর তুলনাহীন মিথ্যাচারের।

সত্যি বলতে, ব্যক্তিগতভাবে আমিও তখন ভাবতাম না এসব। হাতে সময়ই ছিল না ভাববার। আজ সুনামগঞ্জ, কাল হবিগঞ্জের গ্রাম, পড়শু করিমগঞ্জ। সেবার জনরক্ষার প্রচারে সুরমা নদীতে নৌকোয় ছিলাম টানা দুদিন। সঙ্গের একটু চিড়ে জলে ভিজিয়ে নরম করে খাই। পুরো রাত, পুরো দিন নৌকো করে নবীনগর না কোথায় গেলাম। সেই প্রথম দুর্ভিক্ষ দেখলাম। দুর্ভিক্ষের গন্ধ শুঁকলাম। মানুষের অক্ষিকোটরে পাথুরে চোখ দেখলাম, যে-চোখে ভাষা নেই। দুর্ভিক্ষের আকাশে শকুন ওড়ে। মড়ার সদগতি করে শেয়াল, কুকুর, শকুনে মিলে। আজ ভাবি, কী করে সেসব সহ্য করেছি! এ তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না!

একবার ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে থাকলাম দশ দিন। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে রোজ পনেরো-কুড়ি মাইল হাঁটতে হতো। যখন মুসলিম গ্রামে যেতাম, আমাদের ভাবত আর্মির লোক, ভয়ে দরজা বন্ধ করে সে এক হুলস্থূল কা-। তার মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই/কংগ্রেস-মুসলিম লীগ ঐক্য চাই – এসব সেস্নাগান দিয়ে বেড়াচ্ছি। আর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অসংখ্য গান। সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড প্রায় সময় সঙ্গে যেত। আমরা আমাদের আদর্শ নিয়ে আছি। বলে বেড়াই ধর্ম হচ্ছে আফিম। শোষণের হাতিয়ার। ওদিকে ধর্মের নামে গোটা ভারতবর্ষ যে তখন বিভক্ত, উন্মাতাল, সে-খেয়াল নেই।

ব্রিটিশেরও বলিহারি! মানুষ না খেয়ে মরছে আর কর বসাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে। যুদ্ধের উদর কিছুতেই যেন ভরতে চাইছে না। সরকারকে ব্যঙ্গ করে এ নিয়ে গান বাঁধা হলো। তখন তো কালচারাল স্কোয়াড পুরোপুরি মাঠে নেমে গেছে। মন্বন্তর নিয়ে অসংখ্য গান। ‘আজ বাংলার বুকে দারুণ হাহাকার, সোনার বাংলা হইল রে ছারখার’ – গানটা শুনতে শুনতে যে-কারো চোখে জল চলে আসত। সেদিন বাঙালির দুঃখে বাঙালিই শুধু কাঁদেনি। স্টেজে বাঙালি মেয়ের মুখে ‘ভুখা হ্যায় বাঙাল’ গানটা শুনে ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের লোকও বুক ভাসিয়ে কেঁদেছে। আর টাকা, গায়ের গহনা খুলে দিয়েছে ভুখা বাঙালকে বাঁচাতে। যুদ্ধের পর লেখা নেত্রকোনার রসিদউদ্দিনের একটি গান ছিল খুব মর্মস্পর্শী – ‘ভাইরে ভাই – তেরশো পঞ্চাশের কথা মনে কেউর পড়ে, ক্ষুধার জ্বালায় বুকের ছাওয়াল মায়ে বিক্রি করে।’

এসব আমার নিজের চোখে দেখা। তখন মায়েরা সমত্মানের খুনিতে পরিণত হয়েছিল, গ্রামগুলো পতিতাপলস্নীতে আর বাবারা আবির্ভূত হয়েছিল কন্যাসমত্মানের পাচারকারী হিসেবে।

শুধু গানবাজনা নয়, গণনাট্য সংঘ তখন পথনাটক করে টাকা তুলত ভুখা মানুষের সাহায্যের জন্য। আমাদের কাজ ছিল নাটকশেষে দর্শকের সামনে বাটি ধরা। যে যা দেয়। একবার মূল শিল্পী অসুস্থ থাকায় আমাকে প্রক্সি দিতে হয়েছিল দুর্ভিক্ষপীড়িত এক মুসলিম কিষাণির ভূমিকায়। আমার নাকের পাটায় ফুটো নেই। কিন্তু নাকফুল পরতেই হবে। একজন সুচ নিয়ে প্রস্তুত। আমি শিউরে উঠে বললাম – চরিত্রটা একটু ইমপ্রম্নভাইজ করলে হয় না! পেটের দায়ে নাকফুলটা বেচে দিয়েছে কৃষাণী! কথাটা নাট্যকারের মনে ধরে। গীতিনাট্য তো। গান গাইতেই হবে। আমার দৌড় জাতীয়সংগীত বা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক, তাও কোরাসে। সেদিন অভিনয় যেমন-তেমন, গান গাইলাম সাংঘাতিক খারাপ। শহরের স্টেজে হলে ঠিক পচা ডিম ছুড়ত। r  (চলবে)