হায়াৎ সাইফের কবিতা : চেতনার ধ্রুপদী বিন্যাস

কামরুল হাসান

ভূমিকা

বাংলা কবিতার দশকওয়ারি বিভাজন ও আলোচনায় ষাট খুবই উজ্জ্বল কাব্যদশক। যদিও প্রধান দুজন কবি পঞ্চাশের ঘরানার, তবু ষাটের মতো একসঙ্গে এতসংখ্যক প্রতিভাবান কবির আগমন অন্য কোনো দশকে ঘটেনি। ষাটের কবিরা ষাট ছাড়িয়ে সত্তর, আশি, নববইয়ের দশকে কাব্যচর্চা করেছেন, নতুন শতাব্দী পেরিয়ে ষাটের জীবিত কবিরা আজো কাব্যাঙ্গন মুখর করে রেখেছেন। অনেক উজ্জ্বল কবি অনেক নক্ষত্রজ্বলা ষাটে অনুজ্জ্বল থেকে গেছেন চারপাশের অতিআলোর ঝলকানিতে। বিশেষ করে কবি নিজেই যদি হন নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ তবে তাঁকে পাঠকের পক্ষে চেনা কঠিন। ষাটের কবি হায়াৎ সাইফ এমনি একজন নিভৃতচারী, মেধাবী কবি। এ পর্যন্ত তাঁর আটটি কাব্য বেরিয়েছে। হায়াৎ সাইফের কবিতাগ্রন্থের প্রকাশক সত্তরের শক্তিমান কবি আবিদ আজাদ তাঁকে বাংলা কবিতার বিশিষ্ট কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলেছেন। ষাটের কবিরা, আবিদ আজাদের ভাষায়, ‘কাব্যকুশলতার দিক থেকে যেমন স্বাতন্ত্র্য-অভিসারী, তেমনি কাব্য-বিশ্বাসেরও। এঁরা লগ্ন হয়েছিলেন বিশ্ব-কবিতার বহমান ধারা ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে।’

 

এক

ত্রিশের আধুনিকতাকে মর্মমূলে ধারণ করে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু। যে-অনুসরণ শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে, ষাটে এসে তা বেগবান হলো। পঞ্চকবির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারকারী হলেন জীবনানন্দ দাশ। এরপরই উঠে আসে বুদ্ধদেব বসুর নাম, যার সচ্ছল, স্মার্ট কাব্যভাষা কবিদের টেনেছিল। সে-তুলনায় ত্রিশের শক্তিমান কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অনুসারীর সংখ্যা কম। জীবনানন্দের কবিতার আঙ্গিকের বিপরীতে সুধীন দত্তে আমরা পাই ভারি শব্দের নিরাবেগ প্রকাশ, বাক-বাহুল্যের বিপরীতে মিতকথন; হৃদয় নয়, তা উদ্দীপ্ত করে বোধকে। হায়াৎ সাইফের কবিতা পাঠ করতে গিয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বিস্ময়কর মিল খুঁজে পেয়েছি। অপ্রচলিত, ভারি শব্দেরা তাঁর কবিতায় পরস্পরের পিঠে পিঠ দিয়ে বসে থাকে, উপমা-উৎপ্রেক্ষাহীন এক ভাষায় নিরাবেগে বলে যায় চেতনাপ্রসূত মর্মবাণী। কবিতার প্রথাগত অলংকার চিত্রকল্প, উপমা, প্রতীক এড়িয়ে সরাসরি কথা বলেন কবি হায়াৎ সাইফ। অপ্রচলিত, ভারি শব্দের ব্যবহার তাঁকে ষাটের অন্য কবিদের থেকে আলাদা করেছে। কালের পরিক্রমায় কাব্যভাষা সহজতর হয়ে এসেছে, কবিরা কবিতাকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন গণমানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি, সে-বিচারে হায়াৎ সাইফের কবিতার ভাষা বিরল এবং বিরল বলেই শনাক্তযোগ্য এক বৈশিষ্ট্য তাঁর কবিতার। কালের পরিক্রমায় তাঁর কবিতার ভাষাও সহজ হয়ে এসেছে, কিন্তু আবির্ভাবের হায়াৎ সাইফ দুর্বোধ্য ও সুধীন্দ্রনাথীয়। হায়াৎ সাইফের কবিতাকে দুটি কালপর্বে বিভক্ত করে নেওয়া যায়। যে-চারটি কাব্য ঘিরে প্রথম পর্বের আলোচনা, তাতে উপর্যুক্ত প্রতিপাদ্য অটুট। এ কাব্যসমূহ হচ্ছে – সন্ত্রাসে সহবাস (১৯৮৩), সব ফেলে দিয়ে (১৯৮৪), প্রধানত মাটি ও মানুষ (১৯৮৭) এবং এপিঠ ওপিঠ (১৯৯২)। শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হায়াৎ সাইফের কবিতাগ্রন্থটিতে (তখন পর্যন্ত) কিছু অগ্রন্থিত কবিতাও রয়েছে। বইটির ভূমিকায় স্বয়ং কবি সমালোচনা প্রসঙ্গে সতর্কবার্তা শুনিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এমন দুষ্কর্মে (সমালোচনায়) লিপ্ত হওয়া বিধেয় কিনা সে-মীমাংসায় না গিয়েও যদি তাকে একটা কৌতূহলোদ্দীপক খেলা হিসেবে নিই, তাহলে আর কিছু না হোক অন্তত খানিকটা নির্মল আনন্দ তো নিঃসন্দেহে লাভ করা যেতে পারে।’ সেই নির্মল আনন্দের খোঁজেই এ-‘দুষ্কর্ম’টির যাত্রা!

ষাটের সকল কবিই আধুনিক এবং আধুনিকতাই ষাটের প্রধান কাব্যদর্শন। হায়াৎ সাইফ ব্যতিক্রম নন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবীর এক ধূসরচিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়, যেখানে ব্যক্তি নির্জন, অসহায়  ও পর্যুদস্ত। বাইরের পৃথিবী হিংসার উন্মত্ততায় ধস্ত, চারপাশে পঙ্কিলতা, শঠতা ও পতন। অমন বিরুদ্ধ-সময়ে ব্যক্তি হয়ে ওঠে নামচিহ্নহীন, আত্মগ্লানিময়; গালিভার রাষ্ট্রের থাবাতলে অসহায় লিলিপুট। সমাজে স্থৈর্য ও সুচেতনা নেই, আছে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিষোদ্গারের কুটিলতা। ওই অস্থির সময়ের প্রতিফলন দেখি হায়াৎ সাইফের কবিতায়।

প্রথম কাব্যের প্রথম কবিতা ‘স্বস্তি দেবে না’ আমাদের স্বস্তি দেয় এক নতুন কবির দার্ঢ্য স্বরের আবির্ভাবের চমকে –

এতোটুকু স্বস্তি দিলে না তাকে। অপহৃত যোদ্ধার নির্মোক।

দুর্দান্ত হাতে তাকে দিলে না রাইফেল, স্টেন, বায়বীয় শোক,

এবং দিলে না ভাঁড়ার ভ’রে সোনালী শস্যের বীজ, বিতত

সবুজের ক্ষেত।

বহুব্রীহি অতএব সে ছিলো না কখনও এবং এখন অবিরত

শীলিত

সঙ্গোপন খুঁজে ফেরে নিমগ্ন একাকী।

 

অকস্মাৎ খুলে গ্যালো জাগ্রত আলোকিত দিন চতুস্পর্শ্ব

সমুজ্জ্বল হলুদে পিঙ্গলে

বর্ণের প্রস্রবণ যেন ছোটে দিগ্বিদিক – উত্থিত লাঙ্গুল? যেন

ধাবমান বৃষ এক

স্ফুরিত নাসায় আর গলকম্বলে বুঝি বা আন্দোলিত অন্তরীণ

গোপন তাবিজ।

 

একটি নতুন কাব্যভাষা যেন উঁকি দিচ্ছে দিগন্তে, ঘটছে অধিবিদ্যার প্রকাশ। আঙ্গিকে মিশ্ররীতি আর পারম্পর্যহীন বিপর্যয় উদ্ভাসিত করে তোলে নতুন কোনো প্রতীক ও সত্যকে, যা পাঠককে চমকে দেয়। ছন্দে কুশলী এ-কবি মাঝে মাঝেই রচনা করেছেন নিটোল ছন্দোবদ্ধ পদাবলি। ‘সাজানো বাগান’ এমনি একটি নিটোল চতুর্দশপদী –

 

সাজানো বাগানে কখনো যেয়ো না একা

সেখানে হলুদ ক্রিসান্থিমামে যদি দেখো বিভীষিকা

কিংবা কোমল কুঞ্জলতায় সাপের দোদুল ফণা

বিগতদিনের পাপ ডেকে আনে বিপুল অস্তরাগ

পরবর্তী গ্রন্থে ‘সাজানো সংসার’ নামে একটি কবিতা আছে, যেখানে তাঁর ভাষা সহজ, এমনকি গতর এবং বেবাকের মতো খাঁটি বাংলা শব্দ পুরে দিয়েছেন, যা তাঁর তৎসম বুনটের সঙ্গে বেমানান। কবিতাটি পুরো উদ্ধৃত করছি :

 

বাইরে থেকেও চোখে পড়ে তার সাজানো সংসার।

সমস্ত গৃহস্থালি যেন দিনযাপনের কঠোর সম্রাজ্ঞী হয়ে

অবিরাম আত্মকেন্দ্রিক। গতরে দারুণ রাগ। এখনি আমরা সব

বেবাক এতিম পরিত্রাহী রব ছেড়ে ছিটকে যাবো এদিক ওদিক।

মাংসের মন্দিরে তার বিগ্রহ হৃদয় কোথা? আছে কি না আছে।

দোর্দন্ড প্রতাপে অন্ততঃ অাঁচলে ওজনদার চাবির গোছা থাকে।

কতো ধানে কতো চাল দেখে নেবে এখনি আবার এই ফাঁকে।

আটপৌরে সবই আছে ঘটিবাটি বাসনকোসন শিল নোড়া।

দেহের তদবিরে বেশ রয়েছে গোছানো তুংগে তোলা যৌবন

তাহার

পড়ন্ত হলেও তার পাট করে রাখা আছে যেখানে যেমন

প্রসাধনী শাড়ি গয়না পেটিকোট ব্রা ব্লাউজের উপচানো স্তূপ।

তবু কজন বাউন্ডুলে উটকো প্রজা মৃত্যুঞ্জয় জেগে আছে।

সহজ দেখার চোখ জ্বেলে রাখে যখন তখন। অতএব

এবম্বিধ দেখে যাই অবরোহী কিস্তিমাত খেলা। তুমুল

গ্যাঞ্জাম চারভিতে। একরোখা রগচটা জীবনযাত্রার

রীতিনীতি বেমালুম ভুলে গিয়ে পড়ে আছি তাই আপাতত

কণ্ঠরোধী

পাঁকে। চারদিক অাঁস্তাকুড় আর পোকার দংগল। অাঁশটে

গন্ধ মিশে থাকে বিবর্ণ চাতালে। দেয়ালে লিখন থাকে

এবং কখনো নেপথ্য থেকে শুনি বিষণ্ণ গলিতে

কে যেন বলছে হেঁকে জোরে – ওরে ও বেল্লিকের দল

তৈরি থাক কখন যে বেজে ওঠে মেঘের মাদল।

 

এই কবিতাটি হতে পারতো হায়াৎ সাইফের প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা, কেননা এতে তিনি ক্রমাগত পুরে দিয়েছেন বিশেষ্যের সম্ভার যা বিবরণমূলক হয়েও অভিনব এবং মৌলিক; অধিবিদ্যার সঙ্গে মিশেছে দর্শন। সারাজীবন একটি নতুন কাব্যভাষা খুঁজে খুঁজে হয়রান হন একজন কবি, কিন্তু কখনো নিজের অজান্তেই একটি ডিকশন চলে আসে। হায়াৎ সাইফ যেমন শুরুতেই উপর্যুক্ত ডিকশনটি পেয়ে যান, যদিও তা খুব সাবলীল নয়, নয় তেমন কাব্যিক এবং কবি নিজেও তা ক্রমাগত অনুসরণ করেননি, তবু বলব এ-পঙ্ক্তিমালা আলাদা স্বাদের। শুরুর এই বৈশিষ্ট্য তিনি ধরে রাখেননি; প্রথম পর্বে দুর্বোধ্য শব্দাবলির আঁটোসাঁটো বাঁধনে, দ্বিতীয় পর্বে ফ্রি ভার্সের স্রোতে ভেসেছে তাঁর কবিতা।

হায়াৎ সাইফের কাব্যসমগ্রে এক প্রেমাকাঙ্ক্ষী সত্তার হাহাকার শুনতে পাই, যে-প্রেমের আভাসমাত্র তিনি পেয়েছিলেন কিন্তু পরিপূর্ণ দেখা পাননি, সেই প্রেম না-পাওয়ার বেদনা ছড়িয়ে আছে কবিতাসমূহে। কবি যদিও তাঁর প্রেমাস্পদের দেখা পান না, ‘তুমি’ সর্বনামটির দেখা পাওয়া যায় সর্বত্র। বেশকিছু কবিতায় প্রেমিকার প্রতি তাঁর সনির্বন্ধ অনুরোধ – সে যেন তীব্র চিৎকারে বলে ওঠে ‘ভালোবাসি’। চিৎকার করে বলতে বলার ভেতর হাহাকারের তীব্রতা ধরা পড়ে। আধুনিক মানুষ নিঃসঙ্গ, পরিপূর্ণ প্রেমের দেখা সে পায় না, মরীচিকার মতো প্রেমের আলেয়া প্রেমহীন মরুভূমে কবিকে কেবলই ঘুরিয়ে মারে, পিপাসার্ত করে তোলে, তৃষ্ণার পানীয় কিংবা শান্তির ছায়া দেয় না। তবু প্রেমসতৃষ্ণ এ-কবি –

তবু ক্যানো এখনো ইচ্ছে হয়

খুঁজে পেতে একটি হৃদয়,

এবং সেখানে আবার জ্বালি

শুদ্ধতার শুভ্রতার অমল ধবল এক আলো।

(‘শুদ্ধপট’, সন্ত্রাসে সহবাস)

 

এ-আর্তি ধরা পড়েছে প্রথম কাব্যে, তৃতীয় কাব্যেও তা অনপনেয় – ‘তবু বারবার তোমাকেই খুঁজে ফিরি/ স্বপনে জাগরে দুখে বৈভবে শিল্পে ও যৌবনে।’ ‘নারী’ কবিতায় লেখেন,

বার বার তবু

তোমাতেই ক্যানো

ফিরে আসি আমি,

নারী;

অগুনতি দিন

শানিত হৃদয়

হয়েছিলো

তরবারি।

 

অন্য একটি কবিতায় নারীর সঙ্গে তরবারির অন্ত্যমিল এ-প্রতীতি জাগায়, তিনি নারীকে ধারালো কিছু ভাবেন। প্রেমের জন্য হাহাকার দেখা গেলেও তিনি উচ্ছ্বাসে বেসামাল নন, বরং হৃদয় সংবেদের চেয়ে চেতনার অনুরণন ঢের বেশি তাঁর কবিতায়। রোমান্টিক কবির মতো প্রেমে উচ্ছ্বাস নেই আধুনিক কবির, নেই কোনো রোমান্টিক ভ্রান্তিও। কেননা, তিনি জানেন ‘আমার প্রেমে ঘুণ ধরেছে/ বিষাদ আমার গ্রহণ করো/ পিঁপড়েরা খায় স্মৃতির সময়/ এতকালের সফেদ মিনার/ এবার বুঝি পড়োপড়ো।’ (‘সত্যভাষণ’)। ‘কীটদষ্ট’ কবিতায় লেখেন,

 

চেয়ে দেখি                প্রীতি নেই

প্রমিতিও নেই

সুডৌল স্তনশৃঙ্গে কম্পমান ঝ’রে যায়

পাপিষ্ঠা পীযূষ

বহুকাল পলাতক

অনিন্দিত মন্দাক্রান্তা –

কীটদষ্ট পুঁথি!

 

ক্ষয়িষ্ণু প্রেম কীটদষ্ট পুঁথির মতোই অপাঙ্ক্তেয়। প্রেমে আস্থা না থাকলেও প্রেমিকার রূপবর্ণনায় তিনি যত্নবান, ফিরিয়ে আনেন মধ্যযুগীয় পদাবলির মৌতাত, প্রগলভতায় কখনো ছাড়িয়ে যান রোমান্টিক কবির প্রশস্তিগাঁথা।

মৃণাল বাহুতে সুবর্ণ বন্ধনী

অাঁখির কোরকে ঘন অঞ্জন অাঁকো

হৃদয়ের মতো তাম্বুল টিপ ঘিরে

বঙ্কিম ভুরু পাখা মেলে আছে যেন!

 

আকাশের মতো দুর্লভ ’ও ললাট

উজ্জ্বল ক’টি স্বচ্ছ স্বেদের তারা

কপোলে তোমার যেন ঋতু পরিবর্তনে

নিমেষে নিমেষে আলোছায়া করে খেলা

 

লুলিত অধর আর পীন পয়োধরে

ভাস্কর যেন ক’রেছিলো কারুকলা

ক্ষীণ কটিতট গুরুনিতম্বে হারা

স্পন্দিত চলা কামনার গাইসার।

 

‘গাইসার’ শব্দের অর্থ উষ্ণ প্রস্রবণ। প্রিয় নারীকে ‘কামনার গাইসার’ বলা অভিনব। কিন্তু তিনি সর্বতোভাবে আধুনিক কবি, রোমান্টিক নন। তাই কবিতাটি শেষ হয় বিপ্রতীপ বোধ দিয়ে, শেষে দ্বারস্থ হন ত্রিশীয় উপলব্ধির।

এত বিন্যাস তবু কাছে এলে ক্যানো

উদাসীন মন উন্ন্যাসী অশ্লীল

এতো আবেদন তবু ইপ্সিত ক্ষণ বন্ধ্যা,

পদ্মপাতায় শুভ্র শিশির সম

ক্ষণস্থায়ী যে তোমার মনের এষণা!

মিথ্যাচারী যে ও রূপের দীপশিখা

হীনম্মন্য তোমার মজ্জাগত। (‘মিথ্যাচারী’, সন্ত্রাসে সহবাস)

উপর্যুক্ত কবিতাটি তাঁর প্রথম পর্বের কবিতার কাঠামো ও ভাষা ব্যবহারের একটি নমুনা হতে পারে। আধুনিক এ-কবি দেহজ প্রেমে উদার ও সংস্কারহীন। রোমান্টিক কবিদের মতো শুদ্ধাচারী ব্রত নেই তাঁর, কেবলই হৃদয়ের  সৌরভে আমোদিত নন তিনি, জানেন মনের সীমান্ত পেরুলেই দেহের প্রান্তর। তাই নির্দ্বিধায় লেখেন, ‘তোমার শীৎকারে স্বেদে, কামে রাত্রির শেষযামে/ শব্দনামে মনে অবিরল অনুক্ষণ ঝরে-পড়া বৃষ্টির মতন।’ ‘শীর্ণ করপুটে’ কবিতার একটি পঙ্ক্তি, ‘জংঘায় ঢেউ তোলে ম্রিয়মাণ যৌবনের জ্বালা’ দ্রুতই ক্ষয়িষ্ণু প্রেমের কান্না আর জরার যন্ত্রণায়, সহস্র কীটের বিষ গন্ধময়       আস্তানায় পুঁজ ও প্রমেহের মাঝে হারিয়ে যায়। এ-পর্বের কবিতাকে বোঝার জন্য দুটি প্রতিনিধিত্বশীল স্তবক তুলে ধরতে চাই যা হায়াৎ সাইফের কাব্যিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে :

বিম্ববতী সুন্দরে থাকে ছেদ ও যদি সমাসন্ন,

কলস্বনা তোমার দেহে চমকে উঠুক এই প্রমিতি,

ইন্দ্রিয়জ এই নিসর্গ-অগ্নিশিখা আমার দেহে সঞ্চারিত,

বর্ণমালা জীবনভ্রূণে রক্তকণায় উন্মীলিত;

 

গর্ভকোষে পরাগ এমন গন্ধঢালা সুরধুনি লেপ্টে গেলে

অবিচ্ছিন্ন একটি গোলাপ রাখতে দিও এই প্রগলভ করতলে,

যেমন রাখে ভারের সাম্য চঞ্চলিত শিশিরকণা

তেমনি করে সুপ্রসন্ন পত্রপুটে,

তোমার তুমুল হৃদয় দাহন হোক অবিকল অগ্নিশিখা অকপটে।’

(‘অগ্নিশিখা’, সন্ত্রাসে সহবাস)

 

আধুনিক মানুষ ভিড়ের মধ্যেও একা। ‘অষ্টপ্রহর’ কবিতায় তাঁর উপলব্ধি, ‘কিন্তু আমি, হায়াৎ সাইফ, সকল কিছুর মধ্যে থেকেও এখানে নেই’। তিনি জানেন কুসুম পঙ্কে জারিত, ক্লেদজ তার সুষমা। জীবনের খাতা শূন্যই পড়ে থাকে, মেলে না কোনো হিসাব। ‘কাঙ্ক্ষিত’ কবিতায় তিনি নিজেকে উদ্দেশ্য করেই বলেন, ‘এই তোর কাঙ্ক্ষিত জীবনের অপরাহ্ণের প্রাগুক্ত প্রাপ্যতা?/ ক্লেদজ কুসুম কিছু বিমোহিত বর্ণ ধরে রাখে/ কিন্তু কূটজ কুসুম শুধু ম্রিয়মাণ বিকেলের পান্ডুবর্ণ।’ এর আগে একই কবিতায় লিখেছেন – ‘সমস্ত কামনা এবং বাসনা/ অকস্মাৎ অন্ধকারে প্রোথিত হয়ে গ্যালো/ ফুসমন্তর চুপসে যাওয়া বিনষ্ট বেলুনের মত।’ আধুনিক মানুষ উন্মূল, কেউ তাকে চেনে না, না সে চেনে নিজেকে। ‘নির্বাসিত তবু’ কবিতায় তার স্বীকারোক্তি :

 

সম্প্রতি যেন নির্বাসিত হয়ে গেছি আপন সংসার থেকে

কারো সনির্বন্ধ প্রেম ছায়া হ’য়ে আমাকে ঘেরে না আর

এবং স্বনামে অথবা বেনামে কেউ যেন আমাকে চেনে না,

 

আত্মপরিচয়হীন মানুষ তাই প্রতিবাদী, কেননা ‘পঙ্গপালের দঙ্গল খায়/ স্বপ্নের খুদকুঁড়ো’ এবং ‘কেবলি ক্ষিপ্ত এবং লিপ্ত/ প্রেমহীন নিধূবনে/ সম্মুখে তার/ বেঘোর অন্ধকার’। তাই ‘বিশ্বাসে আজ/ বিনষ্টি আনে/ পেলব অঙ্গে তার/ এবং এখন/ হায়াৎ সাইফ/ স্বপ্ন দেখে না আর’ (‘প্রতিবাদ’)। তাঁর নিদারুণ হতাশার, স্বপ্নভঙ্গের চিত্রটি এখানে অাঁকা হয়ে গেছে। কেবল ব্যক্তিমানুষ নন, এখন স্বদেশের নিসর্গ অপুষ্পক, বৃক্ষে কোনো ফল ধরে না, মরা ডালে গানের পাখিরা নেই। ‘এমনকি ঘাসগুলো পুড়ে যায় খরদাবদাহে’ এবং ‘নরম পলির ওপরে বার বার গাঢ় রক্ত ঝরে’ (‘নির্বাসিত তবু’)। মানুষের লোকালয় ছেড়ে তিনি বনে চলে যেতে চান – ‘লোকালয় ছেড়ে’ কবিতার শুরুটা এরূপ – ‘লোকালয় অনেক দেখেছি/ এবার হোক বনের বিজয় … তবুও আজকে ফের অরণ্যকেই ঢের বেশী কাম্য মনে হয়।’  মনে পড়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিস্মরণ-অযোগ্য পঙ্ক্তিমালা ‘চোখ খুললেই এবার যেন দেখতে পারি তোকে/ সন্ধ্যেবেলার নদী/ মানুষ আমি অনেক দেখলাম/ ঘাটের মানুষ, মাঠের মানুষ/ কাছের মানুষ, দূরের মানুষ/ মানুষ আর না’। ‘নিরম্বু’ কবিতায় হায়াৎ সাইফ লেখেন, ‘সবকিছু ছেড়েছুড়ে উলঙ্গ উদ্ভট/ নারকীয় কোন রাজ্যে গেলে/ ভালো হতো বড় ভালো হতো।’ নিজেকে তুলনা করেছেন বুকজলে হাঁটা জলের শামুকের সঙ্গে। বর্তমান সময়ের প্রতি তিনি এতখানিই বীতশ্রদ্ধ। সন্ত্রস্ত সময়ে এ-পৃথিবীতে পদার্পণ করতে চাননি কবি। মাকে উদ্দেশ করে মৃত সন্তানের স্বগক্তিতে সেই অভিপ্রায়ের কথাই তিনি বলেন,

এই যন্ত্রণা ধরেছিলি ক্যানো মা?

কোন সন্ত্রাসে সহবাস ছিলো তোর?

সপ্তনরক মন্থন করা পাপ

পেটে নিয়ে যেন উন্মাদ পঞ্জর

মনে পড়িয়ে দেয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’ কিংবা শহীদ কাদরীর ‘জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে’ পঙ্ক্তিদ্বয়। প্রতিটি শিশুর জন্মের ভিতর যে-আদিপাপ রয়ে গেছে, তা তিনি নিপুণভাবে মনে করিয়ে দেন। দুটো বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ তান্ডব দেখে আধুনিক কবিরা কেবল বিমর্ষ নন, গভীরভাবে বিপর্যস্ত। এই বিমর্ষতা ও বিপর্যস্ততা ফুটে উঠেছে কবিতার শেষ    স্তবকে, ‘তবু ক্যানো আজো নিরুদ্ধ ঘরে-বাস/ বিষে জর্জর যেটুকু অস্থি বাকি,/ ওপরে ও নিচে শ্বাপদের শীৎকার/ জ্বলছে পাঁজর জ্বলছে ঈপ্সা মৃত্যুর ভর্তুকি।’ কেবল মাতা নন, বিধাতার প্রতিও তাঁর অভিযোগ,

বিধাতা হে, জন্ম দিলে যদি

কি কুক্ষণে কালের আবর্তনে

এমন সময় ভাগ্যে আমার দিলে

জীবন ধারণ বিড়ম্বনা বটে

                   (‘আত্মগত’)

একদিকে মিছিল করে আসা তৎসম, অর্ধতৎসম শব্দের দীর্ঘ পঙ্ক্তির ভারি ফ্রি ভার্স, অন্যদিকে ছোট ছোট পদের ছন্দোবদ্ধ কবিতার হালকা দুলুনি – এ দুই বৈপরীত্যের দেখা মেলে তাঁর প্রথম পর্বের কবিতায়। ছন্দে চমৎকার দখল এ-কবির। ছন্দোবদ্ধ কবিতার পাশাপাশি প্রচুর গদ্যগন্ধী পদ্য লিখেছেন ভাবপ্রকাশের জন্য। ছন্দোবদ্ধ কবিতায় অত্যন্ত মিতবাক তিনি, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এ-পর্বের কবিতায় অপরিমেয় উচ্ছ্বাস কম। তিনি আড়াল ভালোবাসেন, যা হওয়া উচিত সকল কাব্যের অভীষ্ট। উদাহরণ হতে পারে ‘কবরের হাত’ কবিতাটি :

কবরের ভিতরে ছিলো হাত

সেই হাত বাহিরে ফিরেছে

ভিতর বাড়িতে থিতু ভীতু রাতে

তার হাত প্রতীক বাসর বিছায় –

তারপর অবুঝ প্রেমের বশে

প্রীতিরসে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকে

কবরের সুনসান শব্দহীর ঘরে

যেন এক নিষ্প্রভ বিকট পাথর।

রাতকে ‘থিতু ভীতু’ আর মৃতদেহকে ‘নিষ্প্রভ বিকট পাথর’ বলা ছাড়াও কবিতাটির মিতবাক প্রশংসনীয়। জীবনের প্রীতিরস, অবুঝ প্রেম আর প্রতীক বাসর ছেড়ে কিংবা তাদেরই মিলিত ফলাফলে অবশেষে ছিন্নভিন্ন হয়ে দেহ পড়ে থাকে কবরের সুনসান ঘরে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে হতাশাবিধুর এ-কবির কাছে বৃহৎ পৃথিবী তেমনভাবে ধরা দেয়নি, প্রকৃতিও দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে অনুপস্থিত তার কবিতায়। যদিও পৃথিবীকে নীলছোপানো গ্রহ বলেছেন কয়েকবার, ত্রিশঙ্কু অবস্থায় শূন্যে সে ঝুলে আছে, সে-উপলব্ধিও তাঁকে স্বস্তি দেয় না।

… এমন নীলছোপানো গ্রহের থেকে ছড়িয়ে যাবো

গ্রহান্তরে যেন শূন্যে ঝুলছে অবাক

ত্রিশঙ্কু এক –

 

‘মিথ্যা পরমাদ’ কবিতায়ও পাই নীল গ্রহের উল্লেখ। মাঝে মাঝে মহাবিশ্বের অসীমে উলম্ফন ঘটলেও (‘আর অকস্মাৎ যেন ফেটে পড়ে রাশি রাশি পরমাণুপুঞ্জের সংহত শক্তির বিক্ষুব্ধ সৌরঝড়’) আমি মনে করি তাঁর কবিতার ভুবনটি খুব বৃহদাকার নয়, আমি-তুমির ভেতরে অনেকখানি সীমাবদ্ধ, যে-তুমির সঙ্গে অবিরত তাঁর কথোপথন। ‘আমি’র অবলোকনে যতখানি দেখা যায় বহির্বিশ্বের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ মুখ সেটুকু তিনি তুলে আনেন। ষাটের কবিদের সম্পর্কে একটি সাধারণ অভিযোগ, তাঁরা ব্যক্তি বিনষ্টি ও বিপর্যয় দেখেছেন, গণআন্দোলনের উত্তাল জনসমুদ্র দেখেননি, সংক্ষোভ জানিয়েছেন, কিন্তু বিদ্রোহে যোগ দেননি, তাঁরা বরঞ্চ ‘পলায়ন’ করেছেন বিপ্লব থেকে। সমাজের পচন ও পতনের বিরুদ্ধে এ-কবির তীব্র ঘৃণা রয়েছে, কিন্তু সে-ক্ষত নিরসনে সাহসী ভূমিকা নেই। আশ্চর্য হই যে, ষাটের গণঅভ্যুত্থানের আঁচ নিয়ে গনগনে কোনো কবিতা নেই তাঁর কাব্যচুল্লিতে। মহান মুক্তিযুদ্ধও সেভাবে ছায়াপাত করেনি কবিতায় (দুটি কবিতা ব্যতিক্রম)। তবে ক্ষুধা ও দারিদ্রে্যর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার, শোষণ ও জুলুমের প্রতি ধিক্কার জানাতে কুণ্ঠাহীন মানবিকবোধে উদ্দীপ্ত এ-কবি। বহিঃপৃথিবীর অব্যবস্থাপনা তাঁকে ক্ষুব্ধ করলেও তিনি মূলত অন্তর্লোকের কবি। তাঁর প্রতিবাদও বুদ্ধিদীপ্ত, সত্তরের কবিদের মতো স্লোগানমুখর নয়। প্রথম গ্রন্থ সন্ত্রাসে সহবাস নামকরণ থেকেই বোঝা যায় তিনি দুঃসময়ে বাস করছেন।

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হায়াৎ সাইফ স্বভাবতই ইংরেজি কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বিদেশি কবিতার পঠন উদ্দীপ্ত করে এ-কবিকে, তাঁর অনেক কবিতার শুরু উদ্ধৃতি দিয়ে। সন্ত্রাসে সহবাস গ্রন্থে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের উদ্ধৃতি এসেছে তিনবার। সুধীন্দ্রনাথের মতোই তাঁর কবিতা হৃদয়ে দোলা জাগায় না, মস্তিষ্কে চেতনা জাগায়। মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক কবিতা লিখেছেন তিনি। প্রেমের জন্য তাঁর হাহাকারও মার্জিত ও সংযত, কূলপ্লাবী নয়। বলা হয়ে থাকে, একজন কবি একটিমাত্র বিস্মরণ-অযোগ্য পঙ্ক্তির জন্য অনাদিকালের পাঠকের কাছে টিকে যেতে পারেন। সমগ্র মিলে শক্তিমান হলেও তেমন একক কবিতা কিংবা পঙ্ক্তি তাঁর কবিতায় দুর্লভ। অণু-পরমাণু জোড়া দিয়ে যেমন বস্ত্ত, তাঁর কবিতাও তেমনি। ধ্রুপদী মেজাজ তাঁর কবিতার, অাঁটোসাঁটো তাদের গড়ন। ভালো কবিতার যে-বাকপরিমিতি ও আড়াল – দুটোই রয়েছে তাঁর অধিকাংশ কবিতায়, কিন্তু নিজের ভাষাটি তিনি খুঁজে পাননি। এসব কবিতা হৃদয়ে আলোড়ন তোলে না, কিন্তু চেতনায় স্পন্দন জাগায়। সুতরাং তাঁর কবিতা জনপ্রিয়, সহজপাঠ্য না হলেও সেসব সৃষ্টিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

আগেই বলেছি, হায়াৎ সাইফের কবিতায় কাব্যিক অলঙ্কারের বাহুল্য দূরে থাক, প্রয়োজনীয় অলঙ্কারও পরিমিত। প্রসাধনহীন এসব কবিতা একটি স্মার্ট নাগরিক ভাষায় রচিত, যেখানে কবি মুখাপেক্ষী হয়েছেন অপ্রচল, ভারি শব্দের। শব্দের পিঠে শব্দ বসিয়ে তিনি পাঠকে করে তোলেন দুরূহ, স্বাচ্ছন্দ্যহীন। ত্রিশ বছরের দুস্তর ব্যবধান পেরিয়ে অবিকল সুধীন্দ্রনাথীয় কিংবা বিষ্ণু দে-র ভঙ্গিতে তৎসম শব্দের প্রতুল ব্যবহারে তিনি আলাদা করে নেন নিজের কবিতা। কেননা, এ-পথে ষাটের কবিরা বেশিদূর হাঁটেননি। দুর্বোধ্য নয়, দুরূহ তাঁর কবিতা। দুরূহতা বক্তব্যে নয়, বলার ভঙ্গিতে। ‘বিপ্রতীপ’ কবিতায় তিনি নিজেকে উদ্দেশ করেই লেখেন –

আজকে তুই একান্ত নির্মূল

একাকিত্বে কেমন নিষ্প্রভ

নিরুত্তাপ সুকঠিন প্রস্তরে স্থাপিত

স্পন্দহীন নির্ণিমেষ মূর্ত দৃষ্টি

মেলে দিলি আগন্তুক সময়ের দিকে।

‘পর্যাস’ কবিতার প্রথম স্তবকেই পাই অনেকগুলো অপ্রচলিত শব্দ (অভ্রংলিহ, শুক্তিমেখলা, প্রস্বন, আয়ুধ)।

ক্ষীণ দিগন্তে অভ্রংলিহ মন

শুক্তিমেখলা সমুদ্র জরায়ুতে

ঝাউ শাখে শাখে বায়বীয় প্রস্বন

তীক্ষ্ণ তিয়াষ তারণ্য আয়ুধেতে।

একই কবিতায় নির্ধূত, অম্বর, প্রাবৃট, পাটলবর্ণ, পর্যাস, নিষিক্ত প্রভৃতি অপ্রচলিত তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‘তৎপুরুষ’ কবিতায় আরো অনেক সংস্কৃতঘেঁষা শব্দের সঙ্গে প্রিয়ঙ্গু, বিভঙ্গিত, পিশুন, শ্রোণিতলে, শিৎকৃত, অঙ্কুশ, উচ্ছ্রত, প্রায়িক, পল্বলে, প্লাবমান ইত্যাদি কম প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন তিনি। ‘অনুকল্প’ কবিতার শুরুর স্তবক ‘গতস্য শোচনা নাস্তি/ ভবিতব্য ভারাক্রান্ত ভাবনা শুধু/ বর্তমান বিতাড়িত উত্তীর্ণ সময়ে/ শঙ্কা হানে ত্রিশঙ্কু মনন’ স্বস্তি দেয় না পাঠে। বোঝা যায় তিনি নিজ প্রকাশের ভাষা খুঁজে  বেড়াচ্ছেন, আশ্রয় নিয়েছেন দুরূহ শব্দরাজিতে। তাঁর অনুপ্রাসও দুরূহ, ‘হিরণ্য নয় হত্যা হলো হিতৈষণা’। প্রধানত মাটি ও মানুষ কাব্যের ‘এখনো ঠিক করিনি’ কবিতায় তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি ‘এখনো ঠিক করিনি কোন পথে যাবো/ বয়েস যথেষ্ট হলেও/ এখনো আমার এই মন ঠিক করতে না পারার দুষ্ট ব্যধিটি রয়েই গেল।’  কেবল কবি একা নন, তাঁর মাতৃভূমিও ঠিক করতে পারেনি সে কোনপথে যাবে।

 

দুই

প্রথম পর্বের দুর্বোধ্যতা, দুরূহ প্রকাশ থেকে সরে এসে কাব্যসাধনার দ্বিতীয় পর্বে তিনি সহজ হয়ে এলেন, তাঁর কবিতা হলো সহজবোধ্য, তৎসম শব্দরাজির হাত ছেড়ে অর্ধতৎসম, তদ্ভব ও খাঁটি বাংলা শব্দাবলির হাত ধরল। প্রথম পর্বের তৃতীয় গ্রন্থ প্রধানত মাটি ও মানুষ থেকে তাঁর কবিতার বাঁকবদল শুরু, যদিও তখনো তিনি প্রচুর পরিমাণে বিষ্ণু দে-র মতো সংস্কৃতঘেঁষা শব্দ, সুধীনদত্তীয় বাকসংযম ব্যবহার করছেন। বইটির নামকরণের মধ্যেই ফুটে ওঠে ব্যক্তিমানুষের ধূসর জগৎ ছেড়ে মাটি ও মানুষের দিকে ফেরার ইঙ্গিত। ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতাটি হতে পারত প্রতীকী, যেখানে তিনি মাটি ও মানুষের কথা বলেছেন,

প্রধানত মাটি ও মানুষ বড় কাছাকাছি থাকে

বিশেষত এই সমতলে পাশাপাশি বাস করে নদী ও মানুষ

পাঠক হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করি, তিনি প্রত্যাবর্তন করছেন মাটি ও মানুষের কাছে, কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়। এ-প্রত্যাবর্তন কবির ও সকল মানুষের সৃষ্টিকর্তার কাছে। একই কাব্যে ‘নদী ও মানুষ’ এবং ‘মাটি ও মানুষ’ নামের দুটো কবিতা বরং ভিন্ন বার্তা বহন করে। ‘নদী ও মানুষ’ কবিতাটিকে বরঞ্চ বলা যায় তাঁর দ্বিতীয় পর্বের কাব্যরীতির সূচনা। দীর্ঘ পঙ্ক্তির প্রবহমান ধারা কেবলই কূলপ্লাবী নদীর মতো বয়ে যায়, তাতে অতিকথন আছে, আছে ক্যাটালগিং জাতীয় পুনরাবৃত্তি, একই সঙ্গে আছেই দ্বিধাহীন সত্য উচ্চারণ –

কোনো সত্যই নিরঙ্কুশ সত্য  নয় কোনো সুন্দর নয় বিশুদ্ধ সুন্দর

কোনো জন্মই নয় জীবনের মৌলতম শুরু কোনো মৃত্যুই নয়

নিরন্তর

চলমানতার শেষ

কোনো শুভ বা অশুভ নয় অবিমিশ্র শুভ অশুভ

নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের মধ্যেই জন্ম ও মৃত্যুও চিরায়ত দোলাচল

জীবনের মধ্যে ভয় ভরা মেঘনার মত্ত স্রোত ভাঙা ও গড়ার                                                                      অমোঘ ইতিহাস

প্রজ্ঞা নয় বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নয় কেল বহমান অবিনয়ী কালের কম্পন

প্রবাহের মধ্যে জীবনের চলমান বিকীর্ণ পরাগ অনশ্বর আবেগ সরল সত্য পুনরুল্লেখের ভেতর যেমন প্রবহমানতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে রীতি ও শব্দের পুনরাবৃত্তি, তবু মাঝে মাঝে ‘বিকীর্ণ পরাগ অনশ্বর আবেগ’-এর মতো কবিতাংশ চমকে দেয়। দ্বিতীয় পর্বের কবিতার যাত্রামুখ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে এই কবিতাটি। একই কবিতায় ‘প্রত্যহ প্রবহমান’ শব্দবন্ধ দিয়ে শুরু হয়েছে ছয়টি পঙ্ক্তি (ক্যাটালগিং), রীতির দিক থেকে নতুন কিছু নয়, কিছুটা মিশ্ররীতির, তবু কবিতাটিকে আমি তাঁর একটি প্রতিনিধিত্বমূলক কবিতা বলব। এ-গ্রন্থেও তিনি তৎসম শব্দের নিরঙ্কুশ ব্যবহার করেছেন; অতৃপ্ত প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও আধুনিক নিষাদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।

পরের গ্রন্থ এপিঠ ওপিঠে বাঁকবদলের জোরালো ইঙ্গিত নেই, রয়েছে পুরনো রীতির পুনঃপ্রকাশ, তবে ক্রমশই বিরল হয়ে এসেছে অপ্রচলিত তৎসম শব্দের ব্যবহার। তখনো তিনি লিখে চলেছেন ‘রিরংসার ঋত্ত্বিক সর্প খেলা করে’ (তোমার বিলোল চোখ), ‘পশ্চিমাকাশের জবাকুসুমসকাশে’ (প্রাত্যহিক), ‘সেই শিখার উজ্জ্বল শক্তিতে বরারোহ তোমার অধিষ্ঠান!’ (পুনরাবৃত) ইত্যাদি। তখনো প্রেমে সকাতর তিনি, লেখেন ‘তোমারি পদতলে আমার বিশ্ব’ (তোমার জন্য) কিংবা  ‘তোমাকে অনেক সময় বড় অধৈর্য হয়ে খুঁজি’ (অন্বেষণ), ‘তুমিই বিশেষ্য এবং তুমিই জগতের সমস্ত সর্বনামের’ (তুমি বিশেষ্য তুমিই সর্বনাম) মতো আবেগতাড়িত পঙ্ক্তি। মাটি ও মানুষের কাছে পৌঁছাতে তাঁর বিলম্ব হয়ে যায়।

প্রথম পর্বের রেশ থেকে যায় পঞ্চম গ্রন্থ প্রধানত স্মৃতি আর মানুষের পথচলার নামকরণে। এ-গ্রন্থে হায়াৎ সাইফের কবিতার আঙ্গিক পুরোপুরি বদলে গেল। নতুন শতাব্দীর কবিদের মতোই (কবিতাগুলো ২০০৩ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে লিখিত) টানা গদ্যে লিখলেন ৪১টি কবিতা, যেখানে অদেখা প্রিয়ার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন আরো সম্প্রসারিত হয়, পথ চলতে চলতে তিনি তাকে আবিষ্কার করেন পৃথিবীর বিভিন্ন ভূগোলে, কখনো ম্যানিলায়, কখনো সাংহাইয়ে। পৃথিবী ভ্রমণরত কবির কাছে সে বিভিন্ন রূপে ধরা দেয়, বাংলার উঠোন ছেড়ে বৈশ্বিক প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়ায়। বাঙালি কবির মানসে যে-প্রতিমা ছবি, তা বাঙালি নারীরই প্রতিচ্ছবি, বিদেশিনীর চুলেও তাই বাংলার খইয়ের ঘ্রাণ, তার প্রসাধনে পদ্মরেণু। তাকে তিনি ফুলজোর নদীর তীরে মন্দাকিনী গ্রামে অধিষ্ঠান দেন। জীবনানন্দ দাশ সিংহল সমুদ্র থেকে অশোকের বিম্বিসার ধূসর জগৎ পর্যন্ত হেঁটেছিলেন; আর এ-কবি কখনো রাইনের পাশ ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে সিয়েনের বাঁকে চলে যান, কখনো মহাদেবপুর থেকে বাঁক নিয়ে যান সাপাহারে, আবার কখনো ফিরে আসেন বরেন্দ্রভূমিতে, যেখানে ‘রবীন্দ্রনাথের দুই একটি যূথভ্রষ্ট তালগাছ সাঁওতাল পাড়ার দিকে টানে।’

আঙ্গিকের পরিবর্তন তাঁর অভিযোজনের সাক্ষ্য দেয় এবং কবিতা পাঠকে করে তোলে সহজবোধ্য। প্রথম পর্বের দুর্বোধ্য ভাষার জামাটি তিনি একটানে খুলে ফেলেছেন এ-কবিতাসমূহে। সরল আত্মজৈবনিক ধরনের টানাকথনের ভেতর এক জীবনের অভিজ্ঞতা ও নির্যাস ফুটে ওঠে, অবশ্যম্ভাবীরূপে তাতে প্রবিষ্ট হয় দর্শন, মৃত্যুচিন্তা, পারলৌকিকতা। এক জীবনের ভিতর বদলে যায় সমাজের উপরিকাঠামো, প্রযুক্তি আর রাজনীতি, কিন্তু মানুষের পথচলা, সম্পর্কের জ্যামিতি, জীবনযুদ্ধ রয়ে যায় আদিম বিন্যাসে আবৃত, শোষণ ও নির্যাতনের বর্গিরা আসে ভিন্ন সাধু চেহারায়। মানুষের মৌলিক বিপন্নতা, ভিড়ের মধ্যে একা হওয়া, প্রবঞ্চিত হওয়ার বোধ কাটে না। পঙ্ক্তিমালা কখনো পরাবাস্তবতা ধারণ  করে :

… … …  যেন গভীর মাটি খুঁড়ে গহীন অন্ধকার থেকে

বেরিয়ে  এলো এক অসম্পূর্ণ বিশালকায় ডায়নোসর।

ভাঙাচোরা স্টিলফ্রেম আর

কংক্রিটের ভেতর থেকে নড়েচড়ে উঠল একটা দানব যার

দেহে প্রাচীন গন্ধ আর

প্রাগৈতিহাসিক সব জীবাশ্মের ছাপ

(‘অসমাপ্ত প্রকল্প’)

এই ডায়নোসর সে-সময়ের ভ্রান্ত রাজনীতির ফসল সামরিক সরকার, মাঝে মাঝেই যা নড়েচড়ে ওঠে আর অতিকায় গ্রীবা আর গহবর ঝুলিয়ে উদরস্ত করতে আসে গণতান্ত্রিক কাঠামোর নরোম হাড়। ‘বন্দীদশা’ কবিতায় লেখেন, ‘ঠিক ওই দরোজাটার পেছনে একটি শব আমার কাপড়গুলো পরে নিচ্ছে। এক মৃত ব্যক্তি আমার জুতো গলিয়ে দিচ্ছে পায়ে।… পেছন ফিরে দেখি আয়নায় প্রতিবিম্বিত যে মুখ সে তো মৃত।… নিজের মূর্তির পেছনে আরো আরো মৃতমানুষের মুখ।’ ‘অসমাপ্ত প্রকল্প’ নামে আরো একটি কবিতা আছে শেষ গ্রন্থে। ফলে প্রতীয়মান হয়, তিনি জীবনকে একটি অসমাপ্ত প্রকল্প হিসেবেই দেখেছেন। সংসারে থেকেও প্রবল বিবাগী তাঁর মন, তিনি ছিলেন এবং ছিলেন না সংসারে। অরণ্যে বা পর্বতে চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সকল কবির মাঝেই কিছু পরিমাণ লুক্কায়িত থাকে, হায়াৎ সাইফে তা প্রবল। পুরোপুরি বাউল তাঁর মন। ‘চাওয়া ও পাওয়া’ কবিতায় তাঁর সংশয়, ‘এই পথে যুধিষ্ঠির গ্যাছে। এই পথে রাবণ গ্যাছে কি?’ এরপরেই তাঁর নিঃসংশয় উচ্চারণ, ‘বারবার দানব ও দেবতার মুখ একে অপরের বিপ্রতীপে থাকে’। এবং ‘দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে পরে পৃথিবীর পাললিক আবেগের ভেতরে সেগুলো জীবাশ্ম হয়ে যায়।’ বস্ত্তত ‘সময়’ এসব কবিতার একটি বড় ডাইমেনশন। ‘পথ ও বিদ্যাপিঠ’ কবিতায় ষাটের সতীর্থ কবিদের জড়ো করেছেন স্মৃতির বিদ্যাপিঠে। ‘সত্তা ও স্মৃতি’ কবিতায় তার প্রতীতি, ‘সব শেষ হলে সত্তা নয়, স্মৃতি পড়ে থাকে। সেই স্মৃতি থেকে অতঃপর স্বস্তি চলে যায় মানুষের।’ হায়াৎ সাইফের কবিতায় মৃত্যুচিন্তা ফিরে ফিরে এসেছে অপ্রাপ্তির হাহাকারময় অগ্রসরমান জীবনে, কখনো বলেছেন তিনি যাবার জন্য প্রস্ত্তত; কিন্তু এও জানেন, মনোরথ এখনো শেষ হয়নি। বলেছেন, আমাদের পরাভূত নশ্বর জীবন অবিরাম মৃত্যু অভিমুখে চলে (অন্যতর যাত্রা), মৃত্যুর দেশকে বলেছেন নতুন দেশ (দেশের গল্প), দেখেছেন মধ্যরাতের প্রহরেও কবর খোঁড়া তাল তাল মাটি উঠে আসে (কবরের মাটি)। আশ্চর্য যে, তিনি প্রথম কাব্যেই ‘এপিটাফ’ নামের কবিতা লিখেছিলেন, আবার এ-গ্রন্থেও টানাগদ্যের শেষ কবিতার নাম ‘এপিটাফ’। মৃত্যুর জন্য তিনি প্রস্ত্তত (চলে যেতে চাই), কেননা জীবন সংঘাতের রূঢ় বাস্তবতা ও দেয়ালের গায়ে সাঁটা বিদ্বেষী লিফলেট। জীবনের ‘ঠিকানায় এখন আর কোনো পোস্টম্যান আসে না’ (পোস্টম্যান আসে না)। একই কবিতায় তাঁর মনে হয় ভুল চাবিতে জীবন কিংবা কবিতার দরোজার তালা খোলার চেষ্টা করে গেছেন (মনে পড়ে রফিক আজাদের অবিস্মরণীয় কবিতা – ‘ভুল চাবি হাতে এক অন্ধ/ দাঁড়িয়ে রয়েছে পাথরের মতো ভারি আর বন্ধ/ দরোজায়’/ প্রেম)। কবিতার পঙ্ক্তিরা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধরত, আর শব্দেরা অনবরত ছিটকে পড়ে কবিতার খাতা থেকে। আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান কবিদের একটি প্রবণতা, হায়াৎ সাইফে এই অনুসন্ধান নিবিষ্ট ও নিরন্তর। দ্বিতীয় পর্বে এ-অনুসন্ধান জোরালো হয়েছে। হায়াৎ সাইফের টানা গদ্যে লেখা সহজিয়া দার্শনিকতার কবিতাগুলোর কোনোটিই তাঁর বাছাই কবিতাগ্রন্থ ‘নিমগ্নতা ও ভালবাসার কবিতা’ গ্রন্থে ঠাঁই পায়নি, না ঠাঁই পেয়েছে ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ Selected Poems (edited by Supeep Sen)-এ। এর কারণ এসব কবিতা লেখা হয়েছে ওই দুটো গ্রন্থ প্রকাশের পর। এ তাঁর কাব্যের নববিভঙ্গ, তবে নববই বা শূন্য দশকের টানাগদ্যে লেখা কবিতার তুলনায় হায়াৎ সাইফের কবিতা প্রতীক, চিত্রকল্প, উপমায় কম বর্ণিল, প্রকাশেও অধিকতর সরল, কেবল জীবনোপলব্ধিতে ঢের ঋদ্ধ। উত্তরাধুনিকতার কোনো ছায়া দেখি না তাঁর কবিতার ধ্রুপদী প্রান্তরে।

প্রথম পর্বের ওই টানটান ছন্দোবদ্ধ অবরুদ্ধতা পুরোপুরি ভেঙে পড়ল দ্বিতীয় পর্বে। রসুন বোনার ইতিকথা দিয়ে এর শুরু। কেবল বাক্যমালার প্রগলভতা আর অতিকথন নয়, পঙ্ক্তিমালা দীর্ঘ হতে হতে এতই দীর্ঘায়িত হলো যে, তাদের ধরে রাখার জন্য তাঁর শেষ গ্রন্থ মনোরথ শেষ হয় নাই ছাপতে হলো ‘ল্যান্ডস্কেপ’ ফরম্যাটে, পোর্ট্রেট ফরম্যাটে কুলাল না। সেখানে কোনো কোনো পঙ্ক্তির মাত্রা সংখ্যা ৫১ ছাড়িয়ে গেছে, যা দিয়ে লেখা হতে পারে তিনটি হাইকু (তিনি মাঝে মাঝে হাইকু লেখেন)। হায়াৎ সাইফের এই পরিবর্তনটি তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবিদ আজাদের কবিতার আঙ্গিকের পরিবর্তনের সঙ্গে মিলে যায়। তাঁদেরও প্রথম পর্বের ঘনসন্নিবিষ্ট পদাবলি পরবর্তীকালে তরলরূপ নিয়েছিল। কেবল এরাই নন, দুরূহ থেকে সহজ হওয়া কবিতা কার্ভের এই বাঁকটি লক্ষ করি অনেক বড় কবির বেলায়। ইংরেজি সাহিত্যে এর সুপ্রচুর প্রমাণ রয়েছে, রয়েছে বিপুলভাবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথে এবং শামসুর রাহমানে।

রসুন বোনার ইতিকথা (২০১০) ইতিহাস, সময় ও বিবর্তনের চিত্র তুলে ধরে এক বৃহৎ ক্যানভাসে। একদা বর্গিদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য খাজনা হিসেবে রসুন বুনতো আমাদের পূর্বপুরুষগণ। বর্গিরা চলে গেছে, কিন্তু রসুন বোনার দিন শেষ হয়নি, কেননা বর্গিরা ফিরে এসেছে নতুনরূপে।  কবির আক্ষেপ, ‘সহস্রাব্দ চলে যায় এই বাংলায় সেই গল্প কিন্তু শেষ হয় না।’ এবং ‘কয়েকটা দিন সবুর করতে করতে সহস্রাব্দ তো শেষ হয়ে এলো।’ গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘সহজ নয়’-এ ফিরে আসে একই উপলব্ধি ­-

এই বঙ্গে ঋতুরঙ্গে রসুন বোনার সময় আসে আর চলে যায়

শতাব্দীর পর শতাব্দী, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ,

রসুন বোনা তো হয় না, ফলে না নতুন ফসল – সোনালি শস্য;

গৃহস্থ খাজনা দেবে কিসে ভেবে পায় না এখনো।

 

রসুন বোনার ইতিকথা এক চক্রব্যূহের মধ্যে ঘুরতে থাকে অবিরাম।

রসুন বোনার ইতিকথা গ্রন্থের সবচেয়ে দীর্ঘ কবিতা ‘অন্তর্জলী’; সবচেয়ে ঋদ্ধ কবিতাও এটি। কবি তাঁর এক জীবনের অভিজ্ঞতা জড়ো করেন এ-কবিতায়। এক মিশ্ররীতি – কখনো ফ্রি ভার্স, কখনো ক্যাটালগিং, কখনো ছন্দোবদ্ধ পদে রচনা করেন কবিতাটি। এ-গ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই ফ্রি ভার্সে লিখিত, যাদের কাব্যশরীর সাদামাটা, কাব্যিক আবেদন সামান্য। তবে অনেক দুর্বল কবিতার ভিড় দেখতে পাই এ-গ্রন্থে। সেসবের মাঝে উজ্জ্বল ‘আলোকের দুধরাজ’ কবিতাটি। তিনি লেখেন,

মানুষের তপস্যা শেষ হয়ে গেলে

আলোকের দুধরাজ যায় উড়ে দূরে

সুনিদ্রা শেষ হলে স্বপ্নের সন্নিধি বেড়ে চলে

অলীক প্রহরে

প্রেম-অপ্রেম সব কলরব গিয়ে মেশে সে-পাখির অবয়বে তনুতে মরমে অণুতে। সুন্দরবনের অনিন্দ্যসুন্দর পাখিটিকে উদ্দেশ্য করে তিনি কখনো নিরাশা (‘মেলে না শরীরে মহীরূহ অন্ধকার ছাড়া/ কঠিন নিদ্রাহারা’), কখনো আশাবাদের কথা শোনান (‘গানে গানে সেই প্রাচীন বারতা আর চারিদিকে রটে যায় ক্রমে -/ সংগ্রামে কর্ষণে শ্রমে আমি বটে এই বাংলার’)। তিনি হতাশ কেননা এই বঙ্গের চতুরঙ্গে দুর্যোধনরা রয়ে গেছে, দ্রৌপদীর শাড়িতে আজো তাদের কামুক হাত;  ‘আছে এক দঙ্গল করুণ দ্বিপদী/ দুধরাজ চেনে না তো পেরিগ্রীন ভালো করে চেনে/ স্বদেশে বুভুক্ষু ছিলো প্রবাসে প্রণম্য পদলেহী হয়ে থাকে… আর ক্রমান্বয়ে অভিবাসী হীনমন্যতায় ভোগে’। তাঁর হাতে হঠাৎই উদ্ভাসিত হয় আশ্চর্য পঙ্ক্তিমালা –

তবু আমি সন্ধান জানিনি কোনো বহুব্রীহি বাথানের

থেকে গেছি এই মাঠে ঘাটে উড়ানির চরে হালটে হালটে

দেখেছি বটের বৃক্ষ

সূক্ষ্ম কোনো বুদ্ধির গমকে দমকে ছমকে মেলাতে পারিনি

হায় হাতে

রুপোলি বৃক্ষের ফল

তিনি যে ঐতিহ্যের ধারক তার কৃতজ্ঞ উল্লেখ ‘বারবার এসে যায় স্বর্ণকুম্ভ মাতৃস্মৃতি লোকগীতি চর্যাপদ/ পঞ্চকবির গান বলবান হৃদয়ে মেলায় প্রসন্ন গৈরিক।’ পঞ্চকবির কাছে ঋণ পঞ্চাশ ও ষাটের সকল কবির। এ-গ্রন্থে কবির পরিভ্রমণের ভেতর ইতিহাসে গতায়ত, নিজ কৃষ্টির শেকড় সন্ধান দেখা যায়। কবি নিজে মনে করেন, বাংলা কবিতার অনির্বাণীয় প্রাণশক্তি আর বাঙালির আত্মপরিচয়ের দুর্মর পলিমাটির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর কাব্য-ঘরানা। এ-গ্রন্থের টানা গদ্যে লেখা ‘শৈশব’ আর প্রতীকধর্মী ‘বদ্ধ জলাশয় নয়’ কবিতাদ্বয় পাঠককে টানবে। মুক্তছন্দে লেখা কবিতার প্রতি হায়াৎ সাইফের পক্ষপাতিত্ব দেখি তাঁর বাছাই করা কবিতার গ্রন্থ নিমগ্নতা ও ভালবাসার কবিতা কবিতা নির্বাচনে। গ্রন্থের অর্ধেকের বেশি কবিতা মুক্তছন্দে রচিত দীর্ঘ পঙ্ক্তির বাঁধভাঙা জল। শুরুর ওই সুধীনদত্তীয় পর্বটি বাদ দিলে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুক্তছন্দের পদ্য লিখেছেন, অতিকথন সে-পদ্যের সর্বাঙ্গে জড়ানো।

তাঁর বেড়ে ওঠার পেছনে, বিশেষ করে কবি হয়ে ওঠার পেছনে, সবচেয়ে বেশি প্রভাব ও অবদান মায়ের। মা ঘুরে-ফিরে এসেছেন কবিতায়। ‘নিদ্রিতা’ কবিতায় কবির বিষাদাক্রান্ত উচ্চারণ, ‘হেতম খাঁর শীতল জমিনে আমার মা এখন ঘুমাচ্ছেন।’ মৃত্যুর অমোঘ মিছিলে মা চলে গেছেন, সন্তানকেও যেতে হবে, অতঃপর তস্য   সন্তানেরা। তিনি লেখেন,

আমার  পেছনে থাকে আমারি বিমূঢ় ছায়া

স্মৃতি সঙ্গ অনুভব মন্দ্রিত জনপদে ঘোরে।

মানুষেরা চলে যায় যেমন গেছেন মাতা।

মা চান সন্তান যেন সুখে থাকে, থাকে দুধে-ভাতে; কিন্তু মা নেই, সন্তান তাই অরক্ষিত। সন্তানের কাতর উক্তি – ‘মা তো নিদ্রিতা এখন। আর আমার চতুর্দিকে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র ঘুমায়।’ একইভাবে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন দুটি কবিতা যেখানে আদর্শবাদী পিতার পৃথিবী নিবিড় প্রাঞ্জলরূপে প্রতিভাত, বলেছেন, ‘বড়োই মসৃণ ছিল তাঁর সফেদ জায়নামাজের বিতত জমিন।’ অন্য কবিতায় পিতার তসবির প্রতীকে পুণ্যবান জীবনের কথা বলে এ-আক্ষেপ করেছেন যে, পুত্র জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত, যার নাকের ডগায় মোহময় গাজর ঝুলছে আর সে নিজে অনন্ত ছুটে চলা গাধাটি। নিজের প্রতীকে মূলত সকল মানুষের কথাই বলেছেন কবি। তাঁর প্রতীতি আমরা শুভ সময় পেছনে ফেলে এসেছি। কখনো কখনো তিনি রহস্যময় পঙ্ক্তিমালার এক ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করেন। যেমন আপাতসরল এই কবিতাটির মাঝে হঠাৎই তিনি লিখে ফেলেন,

বেশ কিছুকাল থেমে থাকা চিৎকৃত সঙের মতোন আর হঠাৎ

করে রাত্রিটাও চিরে গেল

সেই সমূহ চিৎকারে যখন জানান দিলাম – এইবার চাও

আর নাই চাও আমি তো এলাম

সেই জঘন্য চিৎকার এখনো ঘুরছে যেন সমূহ বিকার, হায়রে

স্মৃতিতে আনন্দগীতি রীতিনীতি

অসীমের গান গায় যেন ছোট প্রাণ আর কারো মন শুধু

উচাটন কে যেন চালায় তাহাকে ভ্রান্তপথে সমূহ শীৎকার;’

(‘আমার পিতার তসবি আর একটি গাধা’)

ভাষার একটি সম্ভাবনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে, কিন্তু ওই পর্যন্তই! কবি ফিরে যান সরল পঙ্ক্তিমালার ধারাভাষ্যে। ভাষা ব্যবহার ও কবিতার আঙ্গিক নিয়ে এ-কবি যতপ্রকার নিরীক্ষা করেছেন তা নবীন কবিদের অনুসন্ধিৎসার একটি বিষয় হতে পারে। অস্থির হয়ে তিনি খুঁজে বেরিয়েছেন নিজ কণ্ঠস্বর! সময়ের ফেনা যখন থিতিয়ে যায় তখন ভেসে ওঠে সেসব রচনা যা প্রাজ্ঞ ও অন্তর্লীন, যাতে বোনা আছে মেধা ও শ্রমের সোনালি ফসল। হায়াৎ সাইফের কবিতার বেলাতেও এটা ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।

শেষ গ্রন্থ, মনোরথ শেষ হয় নাই পূর্ববর্তী কাব্য রসুন বোনার ইতিকথার সম্প্রসারণ। কথা বলার এক প্রবল ঝোঁক পেয়ে বসেছে এ-কবিকে। যিনি ভেবেছিলেন তাঁর পরমায়ু নিঃশেষিত, দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছিল, অসমাপ্ত জীবন অসমাপ্তই থেকে যাচ্ছে। রোগশোক জয় করে তিনি ফিরে এলেন, ঘোষণা দিলেন ‘মনোরথ শেষ হয় নাই’। দীঘল পঙ্ক্তির  ফ্রি ভার্স পাঠের স্বাচ্ছন্দ্য আনে (তাও আনে কি?), সহজ করে তোলে বিষয়। আগেই বলেছি, তাঁর প্রথম পর্বের কবিতার যে-আড়াল ছিল, তা পুরোপুরি অন্তর্হিত হলো দ্বিতীয় পর্বের কবিতায়, বিশেষ করে শেষ দুটো গ্রন্থে। ‘মনোরথ শেষ হয় নাই’ কবিতায় তাঁর ইতিহাস পরিভ্রমণ এলোমেলো পদবিক্ষেপে এগোয়, কপিলাবস্ত্তর গৌতম, আরশিনগরের লালন ফকির, বাম বিপ্লব ঘুরে আসে নিরেট বর্তমানে এবং এসে উপলব্ধি হয় ‘সহস্রাব্দ চলে যায় তবু হায় বৌদ্ধিক বড়াই ও বদ্ধতা চুল পরিমাণও বদলায় নাই।’ নিঃসন্দেহে হতাশ এ-কবি যিনি আগের গ্রন্থে বলেছিলেন, রসুন বোনার কাল আজো শেষ হয়নি। সকল কবিই সংসারে বেমানান। জীবনযুদ্ধে তাঁরা কেবল ক্লান্ত নন, বিরক্ত। ‘এখনো তো মনোরথ শেষ হয় নাই’ নামের আরেকটি কবিতায় তিনি লেখেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় এইসব প্রাত্যাহিক প্রকট দায়িত্বাবলি/ এইসব অর্থহীন অনুপুঙ্খ বাধ্যবাধকতা,/ এইসব তথাকথিত অসার সামাজিক প্রবণতা/ সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে একেবারে কপর্দকহীন চলে যাব কোনো এক দিগন্তের দিকে।’ কেননা সংসারের চতুর্দিকে মানুষের মুখ, দেবতার মুখের পাশাপাশি দানবের মুখও থাকে, জীবন পথের বাঁকে কেবলি বাধ্যতা, অবিমৃষ্যকারিতা আর বিবেকী যন্ত্রণা। ‘এই চলমানতা’ এবং ‘এই চলে যাওয়া’ কবিতাদ্বয়ের ভেতর পাই     নিরন্তর বয়ে চলা জীবনের প্রবাহ, কথক কবির বয়ান, অদৃশ্য ‘তুমি’র সঙ্গে কথোপকথন। কাব্যিক অলঙ্কার ও আড়ালহীন এসব পদাবলি মুগ্ধ করে না তেমন, কিন্তু সমগ্র মিলে একটি সময়কাল ও যাত্রাকে তুলে ধরে যা প্রণিধানযোগ্য। কখনো কখনো মুগ্ধ করে তাঁর বয়ান :

নীলগন্ধা নদী, কখনো বা নীলাকান্ত ধরণীর গলে সমুদ্রের

কুসুমিত ফেনা দোলে,

কেওড়া আর সুন্দরী জেগে থাকে, হিম সৈকতে বহুদূর

দূরগামী জাহাজের মাস্ত্তল দোলে,

একজন হেমকান্ত সৈকত দেখেছিল, কুলকুন্ডলিনী জেগেছিল

কোনো এক দুর্বাসা তান্ত্রিকের;

অথচ আজ দুই কুড়ি পনেরোটা বছরের পর সে মানুষটা নেই

আর, শুধু ভেসে আসে

তার ঋত্বিক কণ্ঠস্বর,

বাংলার দক্ষিণে ঘন অরণ্য গিয়ে মেশে জলে, দলবলে

অট্টহাস্য করে, বাংলার প্রখর ঝড় ক্কড়ক্কড় কাঁপে

দক্ষিণে ঝাঁপে কঠিন কুয়াশা-বৃষ্টি, এই বর্ষায় ধীমান ধৈবতে

বৃষ্টি নামে,

প্রেমে-কামে দক্ষিণে বামে সেইখানে

যেইখানে স্থির নিশ্চিত থাকে বাংলার মূল বৈধতা।

                                 (‘প্রাথমিক ভ্রূণ’)

স্বস্তি পাই দক্ষিণের প্রখ্যাত বনটি কবির পৃষ্ঠায় তুলে দেয় সেই নিসর্গ ও প্রকৃতি, যা তার বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাপ্রবাহের ভিতর এতোকাল অনুপস্থিত ছিল। লক্ষণীয় দুই কুড়ি পনেরো বছরের পর যে মানুষটির ঋত্বিক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। হায়াৎ সাইফ কতখানি আড়ালসম্পন্ন কবি তা এ থেকে বোঝা যায়, তাঁর সমসাময়িক অনেক কবির মতো তিনি শেখ মুজিবের নামোচ্চারণ করে কবিতা লেখেননি। সুন্দরবন পুনর্বার ফিরে আসে ‘ভালোলাগা উঁকিঝুঁকি দেয়’ কবিতায়।

তবুও এখনো চাঁদ ওঠে অতীন্দ্রিয় আলোকের মত ছায়া ছায়া বৃক্ষপট চিত্রময় জলাশয় বালুতট

সুন্দরী গেওয়ার বন, কেওড়ার নন্দিত সবুজ,

এইসব অবুঝ দৃশ্যপট নিপাট চালচিত্র যেন নিরন্তর তোমাকে ডাকে, সূর্য ডোবে বর্ণের ঝঞ্ঝাবার্তা যেন পশ্চিম আকাশে,

শেষোক্ত পঙ্ক্তিটি এ-গ্রন্থের একটি প্রতিভূ লাইন হতে পারে – যা কেবল দীর্ঘ নয়, অতিশয় দীর্ঘ। ‘কোনো এক হেমন্তের রাতে’ কবিতার শুরুটা এরূপ :

কার্তিকের পূর্ণিমায় এই বিভ্রান্ত বাগানে এই বিব্রত জলের

কিনারে

হৃদয়টা ধুয়ে নিয়ে নব্য প্রসাধনে রুপোলি জ্যোৎস্নায় তুমি

আসবে কি?

এই দুরন্ত চন্দ্রিমার বিস্রস্ত বিবেক নিয়ে হন্তদন্ত, সরোবরের

কাছে তুমি আসবে কি?

‘তুমি আসবে কি’র পুনরুক্তিটি (গোটা কবিতায় তা আরো তেরোবার এসেছে) বাদ দিলে কার্তিকের পূর্ণিমা কিন্তু ভালোই আলো ছড়াচ্ছে। তবু লক্ষযোগ্য বিশেষায়িত করার প্রবণতাটি আধুনিক – ‘বিভ্রান্ত বাগান’, ‘বিব্রত জল’, ‘বিস্রস্ত বিবেক’ ইত্যাদি। জীবনানন্দের হেমন্তের মতোই বিবর্ণ তার হলুদ প্রান্তর। সুধীন্দ্রনাথীয় ঘরানার কবির কাব্যপ্রকাশে জীবনানন্দ নেই, জীবনানন্দ আছেন তাঁর  চেতনার অন্তঃসলিলে, যেমন আছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরুর অনিঃশেষ প্রভাবের দূরনক্ষত্রজ্বলা দ্যুতি হায়াৎ সাইফের চেতনায় দারুণ ফুটতে দেখি। ত্রিশের দশকের একটি নির্যাস তিনি অলক্ষে ধারণ করেন। অবিশ্বাসী হয়েও মনে করেন বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল। এ-গ্রন্থের সর্বত্র রয়েছে মৃত্যুচিন্তা। জীবনের সারাংশ অভিজ্ঞতা, চলে যাওয়ার অনিবার্যতা, জীবন-খেলাধুলার রীতিনীতি, কবিজীবনের ব্যর্থতার অমোঘ সত্য কখনো টানাগদ্য, কখনো ক্যাটালগিং, কখনো ছন্দের অপূর্ব দোলা, কিন্তু বেশিরভাগটাই গদ্যগন্ধী পদ্যের উন্মুক্ত অবিরল যাত্রা; কিন্তু তার ভেতরে উপর্যুক্ত উদাহরণের মতো, অলীক বাতাসের দুলুনির মতো রয়েছে কাব্যের ফুলকলি, অধিবিদ্যার চুম্বক, জীবন-নিংড়ানো উৎপ্রেক্ষা আর কবির চোখে দেখা নদী ও পাললিক মাটি। নদী তাঁর নিসর্গের প্রধান প্রতীক, লিখেছেন ‘আমার ভেতরে নদী, বাইরেও নদীর উপমা’র মতো অনবদ্য পঙ্ক্তি। বাংলার বর্ষা তাঁকে ভেজায় আর তার জ্যোৎস্না রাখে রোমাঞ্চিত : তিনি ফিরতে চান বাংলার পাললিক শিলার স্তরের ভেতর ইতিহাস অন্বেষায়। মানুষের যাত্রা অন্তহীন, তাঁর পথ ফুরোবার নয় – এ-সত্য বারবার ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। এ-গ্রন্থের ‘যাযাবর আত্মার খোরাক’ কবিতাটি মনোযোগ দাবি করে, যেখানে কবির অভিজ্ঞতা ও দৃশ্যাবলি নদীর স্রোতের মতো প্রবহমান, চিত্তাকর্ষক। স্মরণে আসে আগে উদ্ধৃত প্রথম পর্বের ‘সাজানো সংসার’ কবিতাটি। কবিতায় ক্রমাগত শব্দ ও বাক্য ঠেসে ধরে পঙ্ক্তির প্রবাহ সৃষ্টির এ-আঙ্গিকটি হায়াৎ সাইফে খুবই পরিদৃশ্যমান এবং বিশিষ্ট।

 

উপসংহার

হায়াৎ সাইফ লেখালেখি শুরু করেন ষাটের প্রথমার্ধে, তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় সিকান্দার আবু জাফর-সম্পাদিত বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা সমকালে, ১৯৬২ সালে। ষাটে শুরু করলেও প্রথম গ্রন্থ সন্ত্রাসে সহবাস প্রকাশিত হয়েছে ঢের পরে, ১৯৮৩ সালে। সর্বশেষ গ্রন্থ মনোরথ শেষ হয় নাই প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তিনি খুব সক্রিয়। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে সৃষ্টিশীল থাকা প্রমাণ করে কবিতা ফল্গুধারার মতোই এ-কবির অন্তঃসলিলে প্রবহমান। বিশেষ করে যখন আমলে নিই কর্মজীবনে তাঁর পেশাগত দায়িত্বের বিস্তৃততর পরিধি, অনিঃশেষ সাংসারিক ও সামাজিক দায়িত্ব, তখন এ-প্রতীতি দৃঢ়বদ্ধ হয়। আমৃত্যু তিনি কাব্যসাধনায় মগ্ন থাকবেন – এ-কামনা যদি আমরা নাও করি, তবু তিনি যে কাব্যদেবীর আরাধনায় মগ্ন থাকবেন – সে-কথা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়, কেননা, কবিতার প্রথম পাঠক কবি নিজেই, কেউ বরমাল্য নিয়ে এগিয়ে না এলেও তিনি গোপন প্রণোদনায় কাব্যমাল্যে নিজেকে ভূষিত করবেন। নিভৃতচারী এ-কবি পুনঃমনোযোগ দাবি করেন পাঠের, বিশেষ করে তাঁর কবিতার নিরীক্ষা ও বিবর্তনের দিকে ফিরে তাকাবার সময় এসেছে। ষাটের কবিদের ভেতর নিঃসন্দেহে তিনি বিশিষ্ট, যাকে ঠিক অন্য কারো সঙ্গে মেলানো যায় না। যিনি বিশ্বাস করেন ‘কবিতার উচ্চারণ একটি অত্যন্ত গভীর নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার ভেতর দিয়ে উঠে আসা স্ফটিক, যা একটি ভাষার সমূহ সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করে’ এবং  এ-প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, ‘বাংলাভাষার শৈল্পিক সম্ভাবনা কবিতার জন্য প্রায় অসীম’ এবং যিনি পাঁচ দশকের পরিক্রমায় এখনো সৃষ্টিশীল, তাঁর কাছে বাংলা ভাষা নতুন নতুন কাব্য সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করবে সেটাই অনুমেয়। এ-আলোচনার ইতি টানি তাঁরই কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে –

তবুও তো খেলা শেষ হয় নাই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে

আকাশগঙ্গা বয়েই চলেছে যেখানে তোমার মুখটি ভাসে।