হৃদয় হতে উৎসারিত রং

ইব্রাহিম ফাত্তাহ(5)Radha in Brindaban-3

মানুষ আর প্রকৃতি একে অপরের শত্রু না মিত্র – এ-প্রশ্নটি ঘুরপাক খায় আমাদের অনেকের মনে। এ-ভাবনা শিল্পেও এসে ঠাঁই নিয়েছে। কারণ শিল্পীর ক্যানভাসে-কাগজে কালি ও কলমে, বর্ণের বুনটে মানুষকে দেখি বৃক্ষের সঙ্গে মিশে আছে। কানাডাপ্রবাসী শিল্পী সৈয়দ ইকবাল তথৈবচ নিসর্গের সঙ্গে মানব-মানবীর অবয়বকে একীভূত করে ছবি এঁকেছেন। সেরকম কাজগুলো নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে তাঁর একক চিত্র-প্রদর্শনী হয়ে গেল।

সৈয়দ ইকবাল একাধারে শিল্পী, লেখক, প্রচ্ছদশিল্পী। ইলাস্ট্রেশনেও তাঁর বিশেষ দক্ষতা সুবিদিত। গত শতকের আশির দশকে ঢাকার স্বনামধন্য এক বিজ্ঞাপন সংস্থায়ও কাজ করেছেন। আশির দশকের শেষদিকে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে এবং ১৯৯০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডিনার প্লেট গ্রাফিক অ্যান্ড আর্ট কলেজ থেকে চারুকলায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। ১৪টি একক প্রদর্শনী ছাড়াও পাঁচটি দ্বৈত প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। এছাড়া বহু দলগত প্রদর্শনীতেও তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে ১৯৯৬ সালে সেরা প্রচ্ছদশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৯ সালে কানাডায় সাউথ এশিয়ান ফেস্টিভালে সেরা শিল্পীর পিপলস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। উত্তর আমেরিকার প্রাচীন শিল্পী সংগঠন ওন্টারিও সোসাইটি অব আর্টিস্টস এবং সোসাইটি অব কানাডিয়ান আর্টিস্টসের একজন সক্রিয় সদস্য তিনি। শিল্পী ইকবালের চিত্রকর্ম টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী গ্যালারি এবং অটোয়াতে কানাডার জাতীয় পার্লামেন্টের সংগ্রহে স্থান পেয়েছে।

প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘রং উৎস হৃদয়’।

হৃদয় থেকে উৎসারিত রং ও রেখা শিল্পী মেলে দিয়েছেন তাঁর একেকটি চিত্রপটে। নিজে ইলাস্ট্রেশন করেছেন বলে তাঁর চিত্রকর্মে সেরূপ চিত্রসজ্জার প্রভাবও বিদ্যমান। একটা অবয়ব থেকে প্রকৃতির গহিনে ঢুকে যাওয়ার গল্প তাঁর কাজে আমরা পেয়ে যাই। সে-গল্পে আছে মানবীর তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য তিয়াসা, আছে তার প্রতি শিল্পীর প্রেমাবেগের অভিলিপ্সা। এই কল্পরমণী যেন শিল্পীর মানসভূমের প্রেয়সী। তাকে তিনি রাঙিয়েছেন কখনো স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে, কখনো বা ঘষে-মেজে।

ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা ৫০টি চিত্রকর্মে বুনট ও টেক্সচারের প্রাধান্য। ত্রিমাত্রিক ইফেক্ট আনার জন্য কানাডায় একধরনের টেক্সচার মিডিয়া পাওয়া যায়। এটির সঙ্গে আমাদের দেশের বালুমাটিও ব্যবহার করেছেন শিল্পী। মানুষের হৃদয়বৃত্তিক অনুভূতির সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে পরিবেশ-ভাবনাও উঠে এসেছে তাঁর নানা চিত্রকর্মে। নিজের কাজ নিয়ে তাঁর উপলব্ধি নিজের আবেগ, সভ্যতার পরিবর্তন, প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞ – এসব নিয়ে ভাবনার প্রতিফলন ঘটে তাঁর চিত্রপটে।

বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্রমাগত বৃদ্ধি একদিকে মরুকরণের বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে, অন্যদিকে হিমালয়সহ অন্যান্য পর্বতও উষ্ণতার হুমকির সম্মুখীন। প্রকৃতি যেন যাত্রা করছে মরুভূমির দিকে। এ-বিষয়টি মানুষকে বোঝাতে ছবিতে বালুর রং ব্যবহার করেছেন শিল্পী। গাছ এঁকেছেন – তাতে ফুল নেই, পাতা নেই।

‘অশ্রুসজল প্রকৃতি’ শিরোনামের কাজগুলোয় শিল্পীর প্রকৃতিভাবনা ফুটে উঠেছে। এখানে প্রকৃতি মানুষের অবয়বে জায়গা নিয়েছে। সে-অবয়বের একদিকে আছে বাতাসের কম্পন, জলের বুদ্বুদ, বৃক্ষের রেখা, জলাধারের মাছ প্রভৃতি। সবমিলিয়ে যে-রূপটি তৈরি হয়েছে তার চোখে কান্নার আবেগ।

সৈয়দ ইকবালের সব কাজের পেছনেই আমরা গল্পের আভাস পাই। যেমন – ‘জলজ জীবন’ চিত্রে দেখি হাঁসের ভঙ্গিমায় এক নারী। তার এক হাত জলের তলে আর অন্য হাতে এক নৌকো। নারী এখানে জলদেবী সদৃশ। এ-ধরনের আরেকটি ছবিতে যে-অবয়ব সেটি পুরুষ সদৃশ, তার একটি হাতে সাদা গোলক ও গোলকের মাঝে পটলচেরা চোখ। এ-চোখটি কি ক্যামেরা? শিল্পীই এর সদুত্তর দিতে পারবেন।

তবে ইকবালের চিত্রগঠন, উপস্থাপন অনেকটাই অতিপ্রাকৃত ধরনের। স্যুররিয়ালিজমের প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে শিল্পী সহজেই রহস্যময়তার দিকে নিয়ে যান দর্শকদের। রহস্য-সৃজনের সুবিধা হচ্ছে, এর ভেতর ঢুকে পড়লে গল্পের যে-আস্বাদ পাওয়া যায়, সেটির অনুরণন শিল্পকৃতির চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে।

পাশাপাশি দুটি ক্যানভাসে ‘মাইন্ড দ্য গ্যাপ’ শিরোনামের চিত্রকর্মে নীলরঙের আধিক্য। এর একটিতে নারী এবং অন্যটিতে পুরুষের দেহাবয়ব – যেন একে অপরের দিকে ছুটছে চিরন্তন টানে। ক্যানভাসে বিপদসংকেত চিহ্নিত করেছেন হলুদরঙের চড়া রেখায়। নারী-পুরুষের সম্পর্ককে নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখে ইতিবাচকভাবেই তা দেখা প্রয়োজন। এরকম ভাবনা শিল্পীর অন্যান্য কাজে আমরা লক্ষ করি। যেমন ‘বৃন্দাবনে রাধা’ এবং ‘লালবর্ণের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ’ শীর্ষক চিত্রকর্মে আমরা যে প্রেমজ আবেগের সন্ধান পাই, তা আমাদের আলোড়িত করে। এ দুটি প্রেমজ চরিত্রকে  আধুনিক শিল্পধারায় বিশে�ষণ করেছেন শিল্পী, যাতে ঐতিহ্য-বন্দনাও হলো, আবার সমকালীনতায় আনা গেল কিংবদন্তিকে।

ইকবালের সাম্প্রতিক চিত্রকর্মের বর্ণবুনট প্রবল। রেখা ও আকৃতির সঙ্গে বর্ণের তুমুল সখ্য তাঁর এবারের কাজে। বর্ণের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে কোথাও কোথাও সোনালি বা রুপালি রং প্রয়োগ করেছেন। এতে চিত্রকর্ম দৃষ্টিনন্দন হয়তো হয়, কিন্তু বর্ণের পরম্পরা, প্রতি পরতে পরতে শিল্পীর অনুভূতি প্রকাশের সৌম্য দর্শন কিন্তু এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন – রবীন্দ্রসংগীতের আকুল উচ্চারণ হৃদয়ের ভেতরে যে গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে, তাকে ব্যান্ডসংগীতে বাঁধা যাবে না।

তাঁর চিত্রকর্মে চমক আছে। দৃষ্টির নান্দনিকতাও তাতে দৃশ্যমান; কিন্তু সৎশিল্পীর কর্মসাধনার অন্তরঙ্গতা তাতে উপেক্ষিত। একটা ক্যানভাস কিংবা চিত্রপটকে আকর্ষণীয় করা খুব কঠিন নয়, তবে তাতে ছন্দ আনা, পরতে পরতে বর্ণবুনট বানানো শ্রমসাধ্য এবং সাধনার বিষয়। এ-জায়গাটিতে ইকবাল খুব বেশি শ্রম-সাধনা  করেননি। সত্যিকারের একজন শিল্পীর জন্য এ-জায়গাটিতে ছাড় দেওয়ার কিছু নেই। ক্রাফটসম্যানশিপে সৈয়দ ইকবাল যে-দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, চিত্রসাধনায় সেটি প্রতিফলিত করা গেলে তাঁর কাজ আরো পূর্ণাঙ্গ হতো।

দশদিনের এ-প্রদর্শনী হয়েছে ১০ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত।