অচিন উইলো ও ঘুমন্ত বালিকা হারুকি মুরাকামি

অনুবাদ : রাফিক হারিরি

 

চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসের ঘ্রাণ আমার ওপর আছড়ে পড়ল। মে মাসের বাতাস শুষ্ক রুক্ষ চামড়ার ফল যেন অনেকগুলো বীজ নিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। আমার হাতের ওপর বীজগুলো ছিটকে পড়ে ব্যথার একটা অনুভূতি তৈরি করে দিয়েছে।

‘কয়টা বাজে?’ আমার চাচাতো ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করল। সে আমার চেয়ে লম্বায় আট ইঞ্চি ছোট, আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ওপরের দিকে মুখ তুলে কথা বলতে হয় তাকে।

আমি ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে বললাম, ‘দশটা বিশ।’

‘ঘড়িটা কি ঠিকমতো সময় দেয়?’

‘আমার তো তাই মনে হয়।’

আমার চাচাতো ভাই আমার কব্জিটাকে শক্ত করে ধরে ঘড়িটা দেখল। তার চিকন পাতলা শুকনা আঙুলগুলোতে দারুণ জোর।

‘এই ঘড়িটা কি অনেক দামি?’

‘নাহ। বেশ সস্তা এটা।’ আমি ঘড়িটার দিকে আবারো তাকিয়ে বললাম।

সে কোনো উত্তর দিলো না।

আমার চাচাতো ভাইয়ের চোখেমুখে কেমন একটা বিভ্রান্তির দৃষ্টি।

‘ঘড়িটা আসলেই সস্তা।’ আমার ভাইয়ের ডান পাশে সাবধান চোখ রেখে আবারো বললাম। ‘ঘড়িটা সস্তা কিন্তু খুব ভালো সময় দেয়।’

আমার চাচাতো ভাই মৃদু মাথা নাড়ল।

চাচাতো ভাই তার ডান কানে ভালো শুনতে পায় না। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় তার ডান কানে বেস বলের আঘাত লাগে। তারপর থেকেই ডান পাশ দিয়ে শোনার বারোটা বেজে গেছে। সেটা এখন আর ভালো কাজ করে না। ক্লাসে সে সবসময় সামনের সারিতে বসত আর ডান পাশে থাকত। যাতে করে তার বাম কানটা শিক্ষকদের দিকে ভালোভাবে রেখে সব কথা শোনা যায়। তার পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ ছিল না। তবে বছরে একবার কি দুবার তার দুই কান দিয়েই সে কোনো কিছু শুনতে পেত না। এই রকম যখন ঘটত তখন তার জীবন যেন জানালা দিয়ে পালাত। সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিত। ডাক্তাররা তার এই সমস্যা নিয়ে বেশ বিপদে ছিলেন। কারণ তারা কখনোই কানের এই রকম কোনো সমস্যার কথা শোনেননি। ফলে তাদের কিছুই করার ছিল না।

‘ঘড়ি দামি হলেই যে সেটা ভালো সময় দেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।’ আমার চাচাতো ভাই আমাকে খুশি করার জন্য বলল। ‘আমি খুব দামি একটা ঘড়ি একসময় ব্যবহার করতাম। কিন্তু সেটা অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকত। ঘড়িটা পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই আমি সেটা হারিয়ে ফেললাম। তারপর আমি আর ঘড়ি ব্যবহার করিনি। আমাকে ঘড়ি কিনে দেওয়া হয়নি।’

‘ঘড়ি ছাড়া চলাটা মুশকিল’ আমি বললাম।

‘কী?’ সে জিজ্ঞেস করল।’

‘একটা ঘড়ি ছাড়া চলতে বেশ অসুবিধা, ঠিক না?’ তার ডান পাশে তাকিয়ে আমি কথাটা আবারো বললাম।

‘না মোটেও সেরকম না। আমি কোনো পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা দুর্গম এলাকায় বসবাস করছি না। ঘড়ির সময় জানতে চাইলে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই হবে।’ সে মাথা নেড়ে বলল।

‘সত্য কথা।’ আমি বললাম।

কিছুক্ষণের জন্য আমরা আবারো চুপ হয়ে গেলাম।

আমি জানতাম হাসপাতালে পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমার ভাইটিকে একটু শান্ত রাখতে, তার প্রতি একটু ভালোবাসা প্রকাশ করতে আমাকে আরো বেশি কিছু বলতে হবে।

আমার ভাইটিকে আমি সর্বশেষ দেখেছিলাম পাঁচ বছর আগে। এর মধ্যে সে নয় থেকে চৌদ্দ বছরে উন্নীত হয়েছে আর আমি বিশ থেকে পঁচিশ বছরে পড়লাম। কিন্তু বয়স আমাদের মাঝে ছোট একটা বাধা তৈরি করে দিয়েছে। ফলে আমি যখনই ভাইটিকে কিছু বলতে যাই আমার গলা শুকিয়ে আসে, ঢোক গিলতে হয়।

‘এখন কয়টা বাজে?’ সে আবারো জিজ্ঞেস করল।

‘দশটা ঊনত্রিশ।’ আমি বললাম।

ঠিক দশটা বত্রিশে বাসের দেখা মিলল।

যে-বাসটা এলো সেটা একেবারেই নতুন ধরনের। আমি স্কুলে যেতে যে-বাস ব্যবহার করতাম এটা দেখতে মোটেও সেরকম না। চালকের সামনের কাচটা বেশ বড়, আর বাসটাতে আমার ধারণার চাইতেও বেশি ভিড় ছিল। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না, কিন্তু তারপরও আমরা বসতে পারিনি। আমরা খুব বেশি দূর যাব না। তাই বাসের ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঠিক এই সময়টাতেই কেন বাসটাতে এত ভিড় সেটা একটা রহস্য। কারণ বাসটা কোনো পর্যটক এলাকার ভেতর দিয়ে আসে না। আর যে-এলাকার ভেতর দিয়ে আসে সেখানে এত ভিড় হওয়ার কথা না।

গাড়িটা একদম নতুন ছিল। সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকে চলে এসেছে। গাড়ির দেয়ালগুলো এত মসৃণ ছিল যে, সেখানে তোমার চেহারার প্রতিফলন দেখা যাবে।

গাড়িটা নতুন কিন্তু গাড়ির ভেতর অপ্রত্যাশিত ভিড় আমাকে চুপসে দিয়েছে। সম্ভবত আমি সর্বশেষ এই বাস দিয়ে যাতায়াত করার পর বাসের রাস্তা বদলেছে। বাসটি এখন নতুন রুটে চলাচল করে। আমি সাবধানে বাসের ভেতর আর তার চারপাশটা মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম। নাহ, ঠিকই আছে। বাইরে সেই পরিচিত আবাসিক এলাকা। আমার মনে পড়ছে।

‘আমরা তো ঠিক বাসেই উঠেছি?’ আমার চাচাতো ভাই কিছুটা শঙ্কা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমরা যখনই বাইরে কোথাও গিয়েছি তখনই আমার চেহারায় একটা শঙ্কার ভাব ছিলই।

‘ভয় পেয়ো না।’ আমার ভাইকে আর নিজেকে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম। ‘এই রুটে কেবলমাত্র একটা বাসই চলাফেরা করে। সেটা হলো এই বাস।’

‘তুমি যখন হাইস্কুলে পড়তে তখন কি এই বাসটা দিয়েই যাতায়াত করতে?’ আমার ভাই জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।’

‘স্কুল তোমার ভালো লাগত?’

‘তেমন ভালো না। তবে সেখানে আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো। ফলে এই যাত্রাটা খুব লম্বা মনে হতো না।’ আমি বললাম।

‘তাদের সঙ্গে কি তোমার এখনো দেখা হয়?’

‘না দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে দেখা হয় না।’ আমি খুব সাবধানে বললাম।

‘কেন দেখা হয় না? কেন তুমি তাদের সঙ্গে দেখা করো না?’

‘কারণ আমরা একে অপর থেকে অনেক দূরে থাকি।’ এটা আসলে মূল কারণ ছিল না। কিন্তু আমি বিষয়টাকে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার অন্য কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আমার ডান পাশেই বুড়োদের একটা দল বসেছিল। একটু পরেই আমি বুঝতে পারলাম এই জন্যই বাসটা আজ খুব বেশি ভিড় মনে হচ্ছে। সব মানুষই পাহাড়ে ওঠার অদ্ভুত পোশাক পরে আছে। তাদের দেখতে যে কী অদ্ভুত লাগছিল। কিন্তু যে-বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে সেটা হলো বাসের এই রুটে তো কোনো পাহাড়ে চড়ার কিছু নেই। আশপাশে কোনো পাহাড় নেই যেখানে অভিযানপ্রিয় মানুষগুলো উঠতে পারে। তাহলে এই লোকগুলো পৃথিবীর কোথায় যাচ্ছে?

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমি বিষয়টা ভাবছিলাম। কিন্তু আমার মাথায় ভালো কোনো ব্যাখ্যা এলো না।

‘চিকিৎসায় যদি এই মুহূর্তে আঘাত আরো বেশি হয় তাহলে আমি অবাক হব।’ আমার চাচাতো ভাই বলল।

‘আমি জানি না। আমি বিস্তারিত কিছুই শুনিনি এ-বিষয়ে।’ আমি বললাম।

‘তুমি কি কখনো কানের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?’

উত্তরে আমি মাথা নাড়লাম। আমি জীবনে একবারের জন্যও কানের ডাক্তারের কাছে যাইনি।

‘এটা কি আগেও কোনো কষ্ট দিয়েছিল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না তেমন কষ্ট দেয়নি। আসলে এটাতে তেমন কোনো ব্যথা বোধ নেই। মাঝে মাঝে একটু-আধটু ব্যথা লাগে। তবে সেটা তেমন ভয়ংকর কিছু না।’

‘আশা করি আজকেও সেই একইরকম হবে। তোমার মা বলেছে যে তারা স্বাভাবিকের বাইরে ব্যতিক্রম কিছুই করবে না।’

‘কিন্তু তারা যদি সব সময় একই কাজ করে তাহলে সেটা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে?’

‘তুমি জানো না। কারণ অনেক সময় অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।’

‘তুমি কি বলতে চাও যেভাবে একটা বল এসে কানে আঘাত করে, এরকম কিছু?’

আমি ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম আমার ভাইয়ের কথায় কোনো ঠাট্টা বা শ্লেষ আছে কিনা। তবে সেরকম কিছুই দেখলাম না।

‘নতুন একজন ডাক্তারের কাছে গেলে বিষয়টা ভিন্ন রকমও হতে পারে। একটু পরিবর্তন হয়তো পুরো প্রক্রিয়াটায় নতুন কোনো ফলাফল আনতে পারে। আমি এত সহজে হারতে চাই না।’ আমি বললাম।

‘আমিও হারতে চাই না।’ আমার চাচাতো ভাই বলল। ‘তবে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা বিরক্ত। ভয় কোনো বিপজ্জনক কিছু না। তবে আমি যে ব্যথার কল্পনা করছি সেটা মূল ব্যথার চেয়েও অধিক বেদনাদায়ক। তুমি বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাই?’

‘হ্যাঁ। আমি জানি।’ আমি বললাম।

সেই বসন্তে অনেক কিছুই ঘটে গেল।

একটা নতুন পরিস্থিতির কারণে আমি ছোট্ট যে বিজ্ঞাপনী সংস্থাটিতে গত দুবছর ধরে কাজ করতাম সেখানকার চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম। একই সময়ে আমার কলেজজীবনের সঙ্গী প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙে গেল। তারও এক মাস পর আমার দাদি মারা গেল। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম ছোট্ট একটা সুটকেস হাতে নিয়ে আমি এই শহরে ঢুকলাম। আমার পুরনো ঘরটা আমি যেভাবে রেখে এসেছিলাম সেভাবেই আছে। বুক-সেলফের বইগুলো সেই আগের মতোই গোছানো, সাউন্ড রেকর্ডগুলোও আছে। তবে সবকিছু একেবারে শুকনা খটখটে, ধুলায় আচ্ছন্ন। অনেক আগেই এদের গন্ধ আর রং হারিয়ে গেছে। সময় শুধু সেখানে একা দাঁড়িয়ে আছে।

দাদির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হওয়ার দুইদিন পর আমি আবারো টোকিওতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা কাজ বাগাতে হবে। ভাবলাম দৃশ্যপট পাল্টানোর জন্য নতুন একটা ফ্ল্যাটে উঠব। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। আমার পুরনো ঘরে পুরনো রেকর্ড শুনে আর পুরনো বইগুলো পড়েই আমার সময় কাটতে লাগল। বাগানের আগাছা পরিষ্কারের কাজে নেমে গেলাম। কারো সঙ্গেই আমার দেখা হলো না। তবে কয়েকদিন পর আমার পরিবারেরই একজন সদস্যের সঙ্গে কথা হলো। আমার চাচি এসে বলল আমি যেন আমার চাচাতো ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তাঁর নিজেরই নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু একটা কাজের জন্য তিনি সেটা করতে পারছেন না। আমারও কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। তাই আমি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করলাম না। হাসপাতালটা আমার পুরনো স্কুলের কাছেই ছিল। চাচি একটা খামে করে কিছু টাকা দিলেন আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য।

হাসপাতাল পাল্টানোর কারণ হলো পুরনো হাসপাতালের চিকিৎসায় আমার চাচাতো ভাইয়ের তেমন কোনো উপকার হচ্ছিল না। চাচি হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে ডাক্তার বলল সমস্যাটার চিকিৎসা হাসপাতাল থেকে বাড়ির ভেতরের পরিবেশের ওপর নির্ভর করছে বেশি। আমার চাচাতো ভাই কাছেই থাকত। কিন্তু আমি ছিলাম তার চেয়েও দশ বছরের বড়। ফলে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কোন একটা কারণে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন এমনটা হলো। আমি লক্ষ করলাম সে আমার কথা শোনার জন্য যখনই বাম কানটা ঘুরাত তখন বিষয়টা আমার কাছে খুব স্পর্শকাতর মনে হতো।

আমাদের বাসটা সাত থেকে আটটা স্টপেজ পার হওয়ার পর আমার চাচাতো ভাই উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকাল।

‘হাসপাতালটা কি আরো দূরে?’ সে বলল।

‘হ্যাঁ। আরো কিছু পথ বাকি আছে। এটা খুব বড় হাসপাতাল, আমাদের চোখ এড়াবে না।’

জানালা দিয়ে আসা বাতাসে বাসের ভেতর যে বৃদ্ধরা বসে ছিল তাদের মাথার টুপির ফিতাগুলো বারবার উড়ছিল। আমি ভাবছিলাম এই বৃদ্ধগুলো কোথায় যাচ্ছে?

‘হেই তুমি কি আমার বাবার কোম্পানিতে কাজ করবা?’ আমার ভাই জিজ্ঞেস করল।

আমার চাচার অনেক বড় একটা ছাপাখানার অফিস আছে। এই ধারণাটা আমাকে কেউ এর আগে বলেনি।

‘কই আমাকে তো কেউ এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করলে?’ আমি বললাম।

আমার ভাই একটু হেসে বলল, ‘আমি ধারণা করেছিলাম তুমি সেখানে কাজ করবে। কিন্তু কেন তুমি সেটা করছ না? এখান থেকে তোমার চলে যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি থাকো। সবাই খুশি হবে।’

বাসের রেকর্ড মেসেজে পরবর্তী স্টপেজের ঘোষণা দিচ্ছিল। কিন্তু কাউকে সেখানে নামার তেমন তোড়জোড় দেখা গেল না।

‘টোকিওতে আমার কাজ আছে। আমাকে ফিরে যেতে হবে।’ আমি বললাম।

আমি জানতাম সেখানে আমার কোনো কাজ ছিল না। তারপরও এখানে কোনোভাবেই আমি থাকতে পারছি না।

বাসটা যখন পাহাড়ে উঠছিল, আমি লক্ষ করলাম আশপাশের ঘরবাড়ির সংখ্যা কমে আসছে।

কয়েকটা অদ্ভুত ডিজাইনের বাড়ি আমরা দেখলাম। বাসটা যখনই পাহাড়ের বাঁকে উঠছিল তখনই আমরা অনেক দূরে নিচে সমুদ্রের দৃশ্যটা দেখছিলাম। আবার মুহূর্তেই সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে।

অবশেষে হাসপাতালের সামনে বাসটা থামলে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সেই দৃশ্য দেখলাম।

‘যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে সেটা আমি একাই সামলাতে পারব। ভয় নেই। তুমি অন্য কোথাও গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো।’ আমার চাচাতো ভাই বলল।

ডাক্তার আসার পর আমি ঘর থেকে বের হয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে হাঁটা দিলাম।

সকালে খুব হালকা নাশতা করেছিলাম। তাই টের পেলাম আমি বেশ ক্ষুধার্ত। কিন্তু মেনুতে ক্ষুধা দূর করার মতো তেমন খাবার পেলাম না। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম।

সপ্তাহের ছুটির দিন ছিল এটা। ক্যাফেতে শুধুমাত্র ছোট্ট একটা পরিবার আর আমি ছিলাম। পরিবারের বাবার বয়স চল্লিশ হবে, নীল রঙের একটা শার্ট পরা, সঙ্গে প্যান্ট, পায়ে হালকা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। মার সঙ্গে যমজ মেয়ে, তারা দুজনেই সাদা পোশাক পরা। মেয়েদুটোর চেহারায় খুব সিরিয়াস একটা ভাব। তারা কমলার জুস খাচ্ছে। নিচে বেশ বড় খোলামেলা জায়গা। সবুজে ঢাকা। গ্রীষ্মের বাতাস বইছে সবুজ ঘাসগুলোর ওপর দিয়ে। পাশেই একটা টেনিস কোর্ট। অনেক দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হলো এই দৃশ্যটা আমি আগেও একবার দেখেছি। কমলার জুস খাওয়া দুটি মেয়ে আমার পাশে বসে আছে, নিচে বিশাল সমুদ্র। এটা নিশ্চয় আমার মনের কল্পনা ছাড়া আর কিছু না। কারণ আমি এই হাসপাতালে আগে কখনোই আসিনি।

ক্যাফেটেরিয়ার চেয়ারে লম্বা করে আমার পা বিছিয়ে দিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলাম। চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মাঝে স্মৃতির একটু আলোর ঝলকানি দেখা গেল। আস্তে আস্তে                   সে-আলোটা বিস্তৃত হতে থাকল। নানা আকৃতি দেখা গেল। বিভিন্ন রকমের স্মৃতির চরিত্ররা ফুটে উঠতে থাকল।

আট বছর আগে আমি অন্য আরেকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সমুদ্রের পারে ছোট্ট একটা হাসপাতাল। খুব পুরনো, আর হাসপাতালটার মধ্যে কেমন বৃষ্টির ঘ্রাণ। আমার বন্ধুর প্রেমিকার বুকের অপারেশন হয়েছিল। আমরা দুজন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম সেই হাসপাতালে। ওর অপারেশনটা তেমন মেজর কিছু ছিল না। খুব অল্প সময়েই মেয়েটার অপারেশন শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ডাক্তার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। তাই আমার বন্ধুর প্রেমিকাকে হাসপাতালে দশ দিন থাকতে হয়েছিল। আমি আর আমার বন্ধু বাইক হাঁকিয়ে সেখানে গেলাম। রাস্তার মাঝখানে সে একটা দোকান থেকে কিছু চকোলেট আর খাবার কিনল। আমি পেছনে বসেছিলাম। গ্রীষ্মের গরম। দুজনেই ঘেমে উঠছিলাম আবার সেই ঘাম বাতাসে শুকিয়ে যাচ্ছিল। আমার বন্ধুর ঘামের গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম। তবে সে মারা যাওয়ার পর খুব বেশিদিন গন্ধটা আমার মাথায় ছিল না।

বন্ধুর প্রেমিকা আমি আর বন্ধু আমরা তিনজন ক্যাফেটেরিয়াতে বসলাম। সিগারেট খেলাম। বন্ধুর প্রেমিকা ক্ষুধার্ত ছিল। সে একটা হটডগ খেল, কোক খেল, আইসক্রিম খেল।

আমার বন্ধু তার প্রেমিকাকে বলল, ‘হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর তোমাকে ভালো কোথাও যেতে হবে সুস্থতার জন্য।’

‘ভয় নেই আমি সুস্থ হয়ে উঠব।’ প্রেমিকা বলল।

তারা যখন কথা বলছিল তখন আমি বাইরে জানালা দিয়ে অনেক দূরে তাকিয়ে থাকলাম। ক্যাফেটেরিয়ায় হাসপাতালের গন্ধ ছিল। এমনকি খাবারেও।

আমরা এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমার বন্ধুটি যৌনতা নিয়ে কথা বলা শুরু করল। সে সত্যিকার অর্থেই গল্প বলতে জানে। এমনভাবে সে যৌন গল্পগুলো বলা শুরু করল যে, তার বান্ধবী গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করল।

‘দয়া করে আমাকে এভাবে হাসিও না। জোরে হাসলে আমার বুক ব্যথা করে।’ বান্ধবী বলল।

‘ঠিক কোথায় ব্যথা করে?’ আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করল।

মেয়েটা তার জামার ওপর বাঁ-বুকের ঠিক ডানপাশটা দেখাল।

আমার বন্ধু এটা নিয়েও মজার কিছু বলল। তার বান্ধবী তখন আবারো হেসে উঠল।

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। আমার চাচাতো ভাইটা এখনো ফিরে আসেনি।

দুপুরের খাবার সময় হয়ে যাচ্ছে। ক্যাফেটেরিয়াতে লোকজনের ভিড় আস্তে আস্তে বাড়ছে। নানা ধরনের শব্দের পাশাপাশি সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যাফেটা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। আমি আবারো সেই পুরনো স্মৃতির ভেতর ডুব দিলাম।

আমার মনে পড়ছে আমার বন্ধুর প্রেমিকার বুক পকেটে একটা সোনালি রঙের কলম ছিল। আমার এখন মনে পড়ছে সে এই কলমটা দিয়ে ন্যাপকিন পেপারের ওপর কিছু একটা লিখেছিল। খুব সম্ভবত সে একটা ছবি এঁকেছিল। ন্যাপকিনটা এত নরম ছিল যে কলমের খোঁচায় সেটা বারবার কুঁচকে উঠেছিল। এর মধ্যেই সে খুব সাবধানে একটা পাহাড়ের ছবি অাঁকল, পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা ঘরের ছবি। সেই ঘরে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। বাড়ির চারপাশে অদ্ভুত দর্শনের উইলো গাছ। সেই উইলো গাছের ছায়ায় আর বাতাসে মেয়েটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

‘এটা আবার কেমন উইলো গাছ?’ আমার বন্ধুটি বলল।

‘এইরকম একটা গাছ আছে।’

‘আমি কখনোই এমন গাছের কথা শুনিনি।’

‘সেজন্যই এটা আমি তৈরি করেছি।’ আমার বন্ধুর প্রেমিকা বলল। ‘এই অচিন উইলো গাছের ফুলের পরাগ অনেক বেশি। পাতাগুলো খুব সরু। ফুলের গন্ধ আর বাতাস মেয়েটাকে আরামে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।’

বন্ধুর প্রেমিকা আবার নতুন আরেকটা পেপার নিয়ে সেখানে অচিন উইলো গাছের ছবি অাঁকল।

‘এই অচিন উইলো গাছটি ওপরে দেখতে ছোট হলেও মাটির নিচে এর শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই গাছটা বড় অদ্ভুত। গাছটার ফুলগুলোর অনেক পরাগরেণু। আর ঘরের মেয়েটি এই গাছের ছায়াতেই ঘুমিয়ে আছে। গাছটার পরাগগুলোতে অনেক অনেক শুয়োপোকা। সেই পোকাগুলো ঘুমন্ত মেয়েটাকেও চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে। তারপর পোকাগুলো মেয়েটাকে আস্তে আস্তে খেয়ে নিচ্ছে।’

 

আমার মনে পড়ে সেই গ্রীষ্মে আমার বন্ধুর বান্ধবী কেবল অচিন উইলো গাছ নিয়ে দীর্ঘ একটা কবিতা লিখেছিল। এটাই ছিল তার সামারের অ্যাসাইনমেন্ট। মেয়েটা আরো অনেক চিন্তাভাবনা করে নানা রকম কল্পনার ভেতর দিয়ে একটা গল্প দাঁড় করিয়েছিল। একজন তরুণ সেই পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে অচিন উইলো গাছটি তার শাখা-প্রশাখা দিয়ে যে মেয়েটাকে আটকে রেখে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল তাকে উদ্ধার করার জন্য উঠল।

‘তাহলে সেই ছেলেটা নিশ্চয় আমি ছিলাম।’ আমার বন্ধু আবারো মজা করার চেষ্টা করল।

‘না সেটা তুমি না।’ বান্ধবী বলল।

‘তুমি নিশ্চিত?’

‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। তুমি কি রাগ করলে? রাগ করো না।’

‘তুমি বাজি ধরো সেই ছেলেটা আমি।’ আমার বন্ধু ভ্রু কুঁচকে রসিকতার ছলে বলল।

আমার বন্ধুর বান্ধবী তখন তার ছবির গল্পটা আবারো বলা শুরু করল। তো সেই যুবকটাই প্রথমবারের মতো অচিন উইলো গাছগুলোর সব বাধা উপেক্ষা করে তার চারপাশে গুনগুন করা প্রজাপতি আর মাছিগুলোকে তাড়িয়ে পাহাড়ের ওপর উঠে গেল মেয়েটিকে লম্বা ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য।

‘কিন্তু ছেলেটা সেখানে পৌঁছার আগেই মেয়েটাকে পোকাগুলো খেয়ে ফেলে ঠিক না?’ আমার বন্ধু বলল।

তার বান্ধবী কোনো কিছু না বলে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কী মনে করো এই গল্পের বিষয়ে।’

‘দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা দুঃখের কাহিনি।’ আমি বললাম।

 

বারোটা বিশে আমার চাচাতো ভাই ফিরে এলো। আমার ছোট ভাইয়ের হাতে একটা ওষুধের ব্যাগ। তার চোখেমুখে অন্যরকম কিছু একটা আছে। সে ক্যাফেতে ঢুকে আমাকে খুঁজে বের করতে তার বেগ পেতে হলো। যখন আমাকে দেখল তখন দুলতে দুলতে আমার কাছে এলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না।

আমার কাছে এসে লম্বা করে একটা শ্বাস নিল।

‘সব কিছু ঠিকমতো হয়েছে তো?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ইমম।’ আর কিছুই বলল না।

আমি অপেক্ষা করছিলাম সে আর কিছু বলবে। কিন্তু কিছুই বলল না।

‘তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে মৃদু মাথা নাড়ল।

‘তুমি কি এখানেই খাবে নাকি বাস ধরে শহরে গিয়ে খাবে?’

আমার ছোট্ট চাচাতো ভাই খুব অনিশ্চিতভাবে তার চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘এখানেই ভালো।’

আমি খাবারের টিকিট নিয়ে এলাম। খাবার আসার আগ পর্যন্ত আমার ভাই আমার মতো করেই একদম চুপ হয়ে বাইরের যে-দৃশ্যগুলো আমি দেখছিলাম সেদিকে তাকিয়ে দূর-সমুদ্রের দৃশ্য দেখতে থাকল।

আমাদের টেবিলের পাশেই মধ্যবয়স্ক একজোড়া দম্পতি তাদের এক বন্ধুর বিষয়ে আলোচনা করছিল, যার পাকস্থলীর ক্যান্সার হয়েছে। আমাদের খাবারের মেনু খুব সামান্যই ছিল। ভাজা সাদা মাছ, সবজি, সালাদ আর রোল। আমরা দুই ভাই পাশাপাশি বসে চুপচাপ খেতে লাগলাম। আমাদের পাশেই সেই দম্পতি তখনো ক্যান্সার নিয়ে আলোচনা করছে। স্ত্রী প্রশ্ণ করছে আর স্বামী উত্তর দিচ্ছে।

 

‘সব জায়গায় তুমি একই বিষয়ই দেখবে। সেই গৎবাঁধা পরীক্ষা-নিরীক্ষা।’ আমার ভাই তার হাতের দিকে নীরবে তাকিয়ে বলল।

হাসপাতালের সামনে একটা বেঞ্চে বসে আমরা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখনই বাতাস আসছে তখনই আমাদের মাথার ওপর সবুজ পাতাগুলো ঝরঝরিয়ে উঠছে।

‘কখনো কি এমন হয় যে তুমি কিছুই শুনতে পাও না?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। তখন আমি কিছুই শুনতে পাই না।’ চাচাতো ভাই বলল।

‘আসলে সেটার অনুভূতিটা কি রকম?’

মাথাটাকে সে একদিকে ঝুঁকিয়ে একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘হঠাৎ করেই এমন হয় যে আমি কিছুই শুনতে পাই না। তবে কখনো কখনো সেটা উপলব্ধি করা যায় যে তুমি একটু পরেই আর কিছু শুনতে পাবে না। এটা এমন যে, কানের দুই পাশে তুমি ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে সমুদ্রের গভীর তলদেশে শুয়ে আছো।’

‘এটা কি বিরক্তিকর?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে তার মাথাটা নেড়ে বলল, ‘আমি জানি না কেন, তবে সত্য কথা বলতে কী এটা আমাকে তেমন বিরক্ত করে না।’

বিষয়টা আমি ভাবার চেষ্টা করলাম। তবে কল্পনা করে তেমন কোনো চিত্র অাঁকতে পারলাম না।

‘তুমি কি কখনো জন ফোরডের ফোর্ট এপাচি মুভিটা দেখেছ?’ আমার চাচাতো ভাই জিজ্ঞেস করল।

‘অনেক আগে দেখেছি।’ আমি বললাম।

‘টিভিতে কয়েকদিন আগে দেখাল। মুভিটা আসলেই খুব ভালো।’

‘হুম।’ আমি সম্মতি দিলাম।

আমার ভাইটা কিছুক্ষণ সেভাবে বসে থাকল। তারপর আবার বলল, ‘তুমি কি আমার কানের ভেতরটা একটু দেখবে?’

‘তোমার কানের ভেতর?’ আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

‘বাইরে থেকে কেবল কানের ভেতরটা দেখবে আর কিছু না।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু কেন তুমি আমাকে এটা করতে বলছ?’

‘আমি জানি না। আমি কেবলমাত্র চাচ্ছিলাম যে, তুমি দেখো তারা আমার কানের ভেতর কী দেখেছে।’

‘ঠিক আছে আমি দেখব।’

আমার চাচাতো ভাই ঘুরে বসল। তার কানের আকৃতি আসলেই ভালো। আমি এর আগে কারো কানই এত মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। আসলে কানের ভেতরে তাকালে এর গঠনটা সত্যিকার অর্থেই রহস্যময় মনে হবে। কানের ভেতরে তাকালে মনে হবে যে অন্ধকার কোনো গুহার ভেতর আস্তে  আস্তে নেমে যাচ্ছে।

তখন আমার সেই বন্ধুর প্রেমিকার কথা মনে পড়ল। আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ছোট ছোট শুয়োপোকা বন্ধুর প্রেমিকার কানের ভেতর আস্তে আস্তে বাসা বাঁধছে। ছয় পা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের ভেতর বাসা বানিয়ে সেখানকার সব তরল খেয়ে তার ভেতর ডিম পারছে।

‘ঠিক আছে এতেই চলবে।’ আমার ভাই বলল। ‘তুমি কি কানের ভেতর উল্টাপাল্টা কিছু দেখছ?’

‘বাইরে থেকে আমি যা দেখলাম ভেতরটা তেমন স্বাভাবিকই মনে হলো।’

‘তেমন কিছু দেখো নি? কোনো অনুভূতি কিংবা অন্য কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা?’

‘তোমার কান আমার কাছে বেশ স্বাভাবিকই মনে হলো।’

আমার চাচাতো ভাইকে এই উত্তরে বেশ বিমর্ষ দেখাল। মনে হয় আমি সঠিক কথাটা বলতে পারিনি।

‘ডাক্তার কি তোমাকে চিকিৎসা করতে গিয়ে কষ্ট দিয়েছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না। সবকিছু আগের মতোই হয়েছে।’

 

‘ওইতো ২৮ নাম্বার। ওটা নিশ্চয় আমাদের বাস?’ আমার চাচাতো ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল।

আমি কিছু একটা চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলাম। যে-বাসটা আসছিল সেটার সামনে ২৮ নাম্বার থাকলেও সেটাই কি আমাদের বাস ছিল কিনা? আমি কিছুতেই বসার বেঞ্চ থেকে উঠতে পারছিলাম না। চোখের সামনে আমার বন্ধুর প্রেমিকার কথা মনে হচ্ছিল। মেয়েটাকে অচিন উইলো গাছের শাখা আটকে রেখেছিল।

আমার চাচাতো ভাই বেশ জোরেশোরে আমার কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছো? কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

আমি আবার সেই সময় বাস্তবে ফিরে এলাম। এক ঝটকায় আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। এবার আমার দাঁড়াতে কোনো সমস্যা হলো না। আমি আবারো আমার ত্বকে মে মাসের মিষ্টি বাতাসের স্পর্শ টের পেলাম। আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবারো সেই দৃশ্যের সামনে দাঁড়ালাম। আমি যা দেখছিলাম এখন সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই। আমাদের ২৮ নাম্বার সঠিক বাসটা চলে এলো।

দুজনেই বাসের ভেতর উঠে ভালো একটা জায়গায় চলে গেলাম।

আমার চাচাতো ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে আমি তাকে বললাম, ‘আমি ঠিক আছি। ভয় নাই।’

 

হারুকি মুরাকামি : জাপানিজ ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হারুকি মুরাকামি গত কয়েক বছর ধরেই নোবেল তালিকায় মনোনীতদের শীর্ষে ছিলেন। তবে নোবেল তাঁর ভাগ্যে এলো না। ‘অচিন উইলো ও ঘুমন্ত বালিকা’ গল্পটি হারুকি মুরাকামির সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন গ্রন্থের। এই গ্রন্থের গল্পগুলো ১৯৮১ থেকে ২০০৫-এর মধ্যে লেখা। ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন গল্পগ্রন্থটি লিখে হারুকি মুরাকামি বলেন, ‘উপন্যাস লেখা আমার কাছে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ। সে-তুলনায় গল্প খুব স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। কারণ উপন্যাস লেখা হলো বিশাল একটা বন তৈরি করা আর গল্প হলো ছোট্ট শৌখিন বাগান তৈরির মতো।’ জাপানিজ ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির জন্ম ১৯৪৯-এ জাপানের কোয়েটায়। তাঁর অন্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে নরওয়েজিয়ান উড, কাফকা অন দ্য শোর, হিয়ার দ্য উইন্ড সং, অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ উল্লেখযোগ্য।