অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না

রবিশংকর বল

বাবা বলেছিল, তারা একদিন আমাদের এখানে আসবে। তারা, পাঁচজন অদৃষ্টবাদী। তারা আসবে এক অন্ধকার রাতে – প্রবল বৃষ্টি আর হাওয়ার রাত – শুনতে পাবে কাছে-দূরে বড়-বড় গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ, নদীর গর্জন একেবারে ঘরের ভেতরে এসে লেজ আছড়াতে থাকবে। আর তারপর ভোরের দিকে সব শান্ত হয়ে আসবে, কিন্তু সূর্য উঠবে না, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকবে, কতদিন তা বলা যায় না, ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত বইবে, তুমি বুঝতে পারবে, অদৃষ্টবাদীরা আমাদের ওখানে পৌঁছে গেছে।

কিন্তু ওরা এখানে আসবে কেন?

না এসে যাবে কোথায়? একদিন না একদিন তো আসতেই হবে। সারা দেশ ওরা ঘুরে বেড়ায়, কিছুদিনের জন্য কোথাও বিশ্রাম নেয়, তাই এখানেও আসবে, থাকবে কয়েকটা দিন, তারপর আবার চলে যাবে।

এমন তো হতে পারে, আমি মরে যাওয়ার পর তারা এলো।

আমার মন বলছে, তুমি অদৃষ্টবাদীদের দেখে যেতে পারবে।

তা প্রায় দশ বছর হয়ে গেল বাবা মারা গেছে; আমিও স্কুলের চাকরি থেকে রিটায়ার করেছি। চাকরি-জীবন শেষ করার পর আমি আর বাড়ি থেকে বেরই না। সারাদিন বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে খবরের কাগজ, এটা-ওটা বই পড়ে, রেডিওতে পুরনো হিন্দি গান শুনে সময় কেটে যায়। সকালে-বিকেলে সামনের ছোট্ট বাগানের কয়েকটা ফুলগাছে জল দিই। গদাধরের কৃপায় চারবেলার খাবার সময়মতো ছুটে যায়। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সে গদাধর আমাদের বাড়িতে চাকর হিসেবে বহাল হয়েছিল, এখন সে আমারই বয়সী, একষট্টি-বাষট্টি; তার আচরণ আমার অভিভাবকের মতো। মাঝে মাঝে বলে, সারাদিন বারান্দায় বসে থাকো, একটু বড় রাসত্মার দিকে, বাজারে ঘুরে আসতে পারো তো।

আমার সত্যিই আর বেরতে ভালো লাগে না; বড় রাসত্মার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ভয় করে। কী দ্রম্নতগতিতে ছুটে চলেছে বাস-লরি-নানারকম নতুন-নতুন গাড়ি, মনে হয় আমাকে পিষে দিয়ে চলে যাবে। এত গাড়ি দেখতে-দেখতে আমার মাথা ঝিমঝিম করে। মাসে একবার বেরতেই হয়, ব্যাংক থেকে পেনশন আনতে। অটোতে  যাওয়া-আসার সময় আমার হৃৎপি–র গতি বেড়ে যায়, জ্যামুক্ত তীরের মতো ছুটতে থাকে অটোগুলো, আমার মনে হয়, এই বুঝি কোথাও ধাক্কা মারল, আর সঙ্গে-সঙ্গে বাস বা লরির চাকার তলায় আমার রক্তাক্ত মাংসপি-টা দেখতে পাই।

গদাধর বলে বটে, কিন্তু বাজারই বা কোথায়। দুয়েকটা দোকান টিমটিম করে টিকে আছে আর কিছু দূরেই কাচ-লাগানো, আলো ঝলমলে পাঁচতলা শপিং মল, সেখানে নতুন-নতুন ইংরেজি আর হিন্দি গান বাজে। আমি একদিন দেখার জন্য ঢুকে পড়েছিলাম। কী আলো, কী আলো, চোখ ধাঁধিয়ে যায়; সরীসৃপের মতো সিঁড়িগুলো উঠছে-নামছে, সঙ্গে-সঙ্গে মানুষও ওপরে উঠে যাচ্ছে, নিচে নামছে। বিরাট টিভিস্ক্রিনে কারা সব নাচছে, অনেকে ভিড় করে নাচ দেখছে, তাদের উল্লাসধ্বনি থেকে কয়েকটা নাম ভেসে আসছে… অক্ষয়…করিনা… ঋত্বিক…

বাড়ি থেকে না-বেরনোর আরো একটা কারণ, পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। সত্যি বলতে কী, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমি বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাই না। চারপাশের নানা বিষয় ও ঘটনা নিয়ে তাদের কতরকম মতামত – বলতে-বলতে তারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে – আমি ততই কুঁকড়ে যেতে থাকি, আমার তো কিছুই বলার নেই। শুধু অদৃষ্টবাদীরা কবে এখানে আসবে, সেজন্যেই আমার অপেক্ষা।

কিন্তু তেমন রাত কি আর আসবে, ঝড়-বৃষ্টি-বজ্র-বিদ্যুতে আলোড়িত? পৃথিবীর পরিবেশই তো বদলে যাচ্ছে, কিছুই আর ঠিক সময়ে ঘটে না, ঋতুদের আসা-যাওয়ার মধ্যে কোনো নিয়ম নেই, দিনের পর দিন এই গ্রহের উত্তাপ বেড়েই চলেছে। অনেকদিন হল প্রবল বৃষ্টি হয় না। অদৃষ্টবাদীরা আসার জন্য কবে ঝড়-বৃষ্টির রাত আনবে আমাদের এখানে?

বাবার কথা মিথ্যে হলো না। একদিন দুপুর থেকেই এখানকার আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। তারপর কোথা থেকে ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত এসে ঢুকে পড়ল। ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট, আমার মনে হলো, অদৃষ্টবাদীরা কাছাকাছি কোথাও এসে গেছে। বিকেল থেকে হাওয়া বাড়ল, সঙ্গে ঝিরঝির বৃষ্টি, নিকষকালো আকাশে বিদ্যুৎসর্প, কাছে-দূরে বজ্রপাত, গাছগুলো দুলতে শুরু করেছে।

তারা কি আজ রাতে আসবে? গদাধর এসে ফিসফিস করে আমাকে বলে।

মনে হয়।

তাহলে আজ সেই গল্পটা আবার বলো। কাক ও হংসের উপাখ্যান।

বইটা নিয়ে আয়।

বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদ থেকে আমি গদাধরকে পড়ে শোনাই, সমুদ্রতীরবর্তী কোনো দেশে এক ধনবান বৈশ্য ছিলেন, তাঁর বহু পুত্র ছিল, সেই পুত্রেরা তাদের ভুক্তাবশিষ্ট মাংসযুক্ত অমস্ন দধি ক্ষীর প্রভৃতি এক কাককে খেতে দিত। উচ্ছিষ্টভোজী সেই কাক গর্বিত হয়ে অন্য পক্ষীদের অবজ্ঞা করত। একদিন গরুড়ের মতো দ্রম্নতগামী এবং চক্রবাকের মতো বিচিত্রদেহ কতকগুলি হংস বেগে উঠে এসে সমুদ্রের তীরে নামল। বৈশ্যপুত্ররা কাককে বললে, বিহঙ্গম, তুমি ওই হংসদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তখন সেই উচ্ছিষ্টভোগী কাক সগর্বে হংসদের কাছে গিয়ে বলল, চলো, আমরা উড়ব। হংসেরা বললে, আমরা মানস সরোবরে থাকি, ইচ্ছানুসারে সর্বত্র বিচরণ করি, বহুদূর যেতে পারি, সেজন্যে পক্ষীদের মধ্যে আমরা বিখ্যাত। দুর্মতি, তুমি কাক হয়ে কী করে আমাদের সঙ্গে উড়বে?

 

কাক বলল, আমি একশ প্রকার ওড়বার পদ্ধতি জানি এবং প্রত্যেক পদ্ধতিতে বিচিত্র গতিতে শত যোজন যেতে পারি। আজ আমি উড্ডীন অবডীন প্রডীন ডীন নিডীন সংডীন তির্যগ্ডীন পরিডীন প্রভৃতি বহুপ্রকার গতিতে উড়ব, তোমরা আমার শক্তি দেখতে পাবে। বলো, এখন কোন গতিতে আমি উড়ব, তোমরাও আমার সঙ্গে উড়ে চলো। একটি হংস হাস্য করে বলল, সকল পক্ষী যে-গতিতে ওড়ে আমি সেই গতিতেই উড়ব, অন্য গতি জানি না, রক্তচক্ষু কাক, তোমার যেমন ইচ্ছা সেই গতিতে উড়ে চলো।

হংস ও কাক পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উড়তে লাগল, হংস একই গতি এবং কাক বহুপ্রকার গতি দেখাতে-দেখাতে চলল। হংস নীরব রইল, দর্শকদের বিস্মিত করার জন্য কাক নিজের গতির বর্ণনা করতে লাগল। অন্যান্য কাক হংসদের নিন্দা করতে-করতে একবার বৃক্ষের ওপর উড়ে বসল, আবার নিচে নেমে এল। হংস মৃদুগতিতে উড়ে কিছুকাল কাকের পিছনে রইল, তারপর দর্শক কাকদের উপহাস শুনে বেগে সমুদ্রের ওপর দিয়ে পশ্চিম দিকে উড়ে চলল, কাক শ্রান্ত ও ভীত হয়ে ভাবতে লাগল, কোথাও দ্বীপ বা বৃক্ষ নেই, আমি কোথায় নামব? হংস পেছনে ফিরে দেখলে, কাক জলে পড়ছে। তখন সে বললে, কাক, তুমি বহুপ্রকার গতির বর্ণনা করেছিলে, কিন্তু এই গুহ্য গতির কথা তো বলোনি! তুমি পক্ষ ও চক্ষু দিয়ে বারবার জলস্পর্শ করছ, এই গতির নাম কী?

পরিশ্রান্ত কাক জলে পড়তে-পড়তে বললে, হংস, আমরা কাকরূপে সৃষ্ট হয়েছি, কা-কা রব করে বিচরণ করি। প্রাণরক্ষার জন্য আমি তোমার স্মরণ নিলাম, আমাকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে চলো। প্রভু, আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করো, যদি ভালোয়-ভালোয় নিজের দেশে ফিরতে পারি তবে কাকেও অবজ্ঞা করব না। কাকের এই বিলাপ শুনে হংস কিছু না বলে তাকে পা দিয়ে উঠিয়ে পিঠে তুলে নিলে এবং দ্রম্নতবেগে উড়ে তাকে সমুদ্রতীরে রেখে অভীষ্ট দেশে চলে গেল।

গদাধর হা-হা করে হেসে উঠল, বলতে লাগল, আজ মহাপ্রলয়ের দিন। বাবামশায় ঠিক বলেছিলেন, আজ রাতেই তাঁরা আসবেন।

 

বাবা যেমন বলেছিল, তেমনই এক অন্ধকার রাত এল, কিছু দেখা যায় না – প্রবল বৃষ্টি আর হাওয়ার রাত, কাছে-দূরে বড়-বড় গাছ ভেঙে পড়ার মড়মড় শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল, নদীর গর্জন ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে এমন ঝাপটা মারছিল, মনে হচ্ছিল, ঘরটা উড়ে যাবে বা ভেঙে পড়বে। আজ সকালেই খবরের কাগজে পড়ছিলাম, আগামী পঁয়ত্রিশ বছরে হিমালয়ের হিন্দুকুশ অঞ্চলে তাপমাত্রা এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। কোথাও-কোথাও বছরে চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। জলসংকট দেখা দেবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, সালউইন ও মেকং নদীর উৎসমুখে। যেসব দেশের মধ্য দিয়ে এই পাঁচটি নদী বয়ে গেছে – ভারত, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম – সংকটে পড়বে তারা। সারারাত জুড়ে ঝড়-বজ্র-বিদ্যুৎ-বৃষ্টির উন্মাদনা আর আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, মরুভূমির পর মরুভূমি – বালুরাশি গ্রাস করছে সবকিছু, যতদূর দেখা যায়। বালির ঝড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে গৃহহীন মানুষের কাফেলা। কোথায় গেলে একটু জল পাওয়া যাবে, সে-ই খোঁজেই বেরিয়ে পড়েছে তারা। পাশের ঘরে গদাধর নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।

সূর্যহীন, আলকাতরা-ছড়ানো সকাল এল। আকাশ কালো হয়ে আছে। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত, আমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমাকে তো বেরতেই হবে। এ-পর্যন্ত বাবার কথা মিলে গেছে; পুরোটা ঠিক হলে অদৃষ্টবাদীরা রাতেই আমাদের এখানে এসে পৌঁছে গেছে। আলোয়ান জড়িয়ে নিয়ে, ছাতা হাতে আমি বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, গদাধরের ডাক শুনতে পেলাম, চা খেয়ে যাবে না?

আগে দেখে আসি, ওঁরা এসেছেন কিনা।

আমিও তবে যাই –

তুই থাক, আমি আগে দেখে আসি।

নদীর কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম, জলপ্রবাহ এখন শান্ত, পাখির ঝাঁক উড়ছে। আরো কিছুটা এগলে ভাঙা বাড়িটা দেখতে পাব। ঝাউবন আড়াল করে রেখেছে বাড়িটাকে। বাড়িটা কার, কবে তৈরি হয়েছিল, কেউ বলতে পারে না, বাবাও পারেনি। ছোটবেলা থেকে বাবাও নাকি ভাঙা বাড়িটাই দেখেছে, কিন্তু আজো ভেঙে পড়ে মাটিতে মিশে যায়নি। শেষের দিকে বাবা বলত, একেকটা বাড়ি ধ্বংসসত্মূপ হয়েই জন্মায়, বছরের পর বছর, হয়তো শতাব্দী পেরিয়ে যায়, বাড়ির খ-হর দাঁড়িয়েই থাকে।

ক্ষয়ে যাওয়া ইট বেরুনো, ভেতরে জঙ্গল হয়ে যাওয়া বাড়িটার মধ্যে আমরা ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলেছি। এখানে-ওখানে পাখির বাসা, মাকড়সার জাল, সাপের ফেলে যাওয়া খোলস, ডিম, চামচিকেদের ওড়াউড়ি, কারা যেন মাঝে-মাঝে জঙ্গল সাফ করে দিয়ে যেত, আবার কিছুদিনের মধ্যেই বুনো গাছপালায় ভরে উঠত বাড়ির বারান্দা, তিনটে ঘর, পাশের ছোট বিগ্রহহীন মন্দির। ওই বাড়িতেই লুকোচুরি খেলতে-খেলতে আমরা বড় হয়ে উঠেছি।

বাড়ির সামনে এসে দেখলাম, একটা ঘর থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে। অদৃষ্টবাদীরা তাহলে এসে গেছে?

কিন্তু অদৃষ্টবাদী কারা? বাবা সে-কথা বলে যায়নি, আমারও জিজ্ঞেস করা হয়নি। এক অর্থে, আমরা সবাই তো অদৃষ্টবাদী; নিয়তিতে বিশ্বাস করি। আমার তো মাঝে-মাঝেই মনে হয়, এই যে আমাদের জীবন, তা হয়তো কেউ স্বপ্নে দেখে চলেছে বা প্রত্যেকের জন্যই এমন কোনো আদি-কাহিনি কোথাও লুকিয়ে আছে, যাকে সে এই জীবনে অনুসরণ করে চলেছে। তাহলে আলাদা করে অদৃষ্টবাদীদের কথা আসে কোথা থেকে?

ভাঙাচোরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখলাম, একটি ঘরের জঙ্গল সাফ করা হয়েছে, সেখানে আগুন জ্বলছে, কালো আলখাল্লা পরা পাঁচজন মানুষ আগুন ঘিরে বসে সেঁক নিচ্ছে। কয়েকটা ছেঁড়াফাটা ঝোলা, কাঠের রংচটা কিছু পুতুল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। আমার পায়ের শব্দে অদৃষ্টবাদীরা মুখ তুলে তাকাল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হাসল। তারপর সমস্বরে বলে উঠল, ভেতরে এসে বসুন।

আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? আমি জিজ্ঞেস করি।

তারা কোনো কথা বলে না, একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর পাঁচজনেই হেসে ওঠে, যেন পিশাচের হাসি।

হাসছেন কেন? কোত্থেকে এসেছেন?

একজন অদৃষ্টবাদী হাই তুলতে-তুলতে বলে, আমাদের কোনো ঘর নেই, হুজুর। দেশ একটা ছিল, সে কবেই সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে। কবে থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দেশের নামও ভুলে গেছি।

এমনি-এমনিই ঘুরে বেড়ান?

না তো। আরেকজন বলে, ওই যে দেখছেন – । সে আঙুল তুলে রংচটা কাঠের পুতুলগুলো দেখায়। আমরা ঘুরে-ঘুরে পুতুলনাচ দেখাই।

কী নাচ দেখান?

বেহুলা-লখিন্দর, সাবিত্রী-সত্যবান, নল দময়মত্মী, কর্ণের মৃত্যু, গান্ধারীর অভিশাপ, অহল্যার কথা, কারবালার যুদ্ধ, ইউসুফ-জুলেখার মহববত – সবই, হুজুর, নিয়তির কেচ্ছা। আরেকজন হেসে বলে।

নিয়তি?

অদেষ্ট। অদেষ্টর খেলাই তো চলছে, হুজুর। ধরেন কিনা, এই পুতুলদের জীবনের সুতা আমাদের হাতে – এরা কখনো বেহুলা হয়, কখনো সাবিত্রী আবার জোলেখাও সাজে – আর আমাদের জীবনের সুতো তাঁর হাতে।

কে?

তিনিই ঝড়-বৃষ্টি আনেন, হাওয়া আনেন, আকাশে কালো মেঘ লেপে দেন, কেয়ামতের দিনও তিনিই আনবেন।

একজন অদৃষ্টবাদী উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে, সেদিন প্রথম শিঙ্গা-ধ্বনি বিশ্বকে প্রকম্পিত করবে, পরে দ্বিতীয় শিঙ্গা-ধ্বনি হবে, সেদিন হৃদয় সন্ত্রস্ত হবে, মানুষের দৃষ্টি ভীতিবিহবলতায় নত হবে। যেদিন কেয়ামত উপস্থিত হবে, মানুষ তার ভ্রাতা, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সমত্মানদের পরিহার করবে। সেদিন প্রত্যেকে অপরের চিমত্মা না করে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। অনেকের মুখম-ল সেদিন হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুলস্ন এবং অনেকের মুখম-ল সেদিন ধূলি-ধূসর ও কালিমাচ্ছন্ন হবে; এরাই সত্যপ্রত্যাশাকারী ও দুষ্কৃতকারী।

প্রথম শিঙ্গা বেজে গেছে। একজন অদৃষ্টবাদী হা-হা করে হেসে ওঠে। দেখেছেন হুজুর, দুনিয়া কেমন কালো আর স্থির হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় শিঙ্গা কবে বাজবে? বলতে-বলতে অনুভব করি, আমার গলার ভেতরে মরুভূমি ছড়িয়ে যাচ্ছে।

আজ রাতেই। তার আগে রান্নাবান্না হবে। তিনি আমাদের জন্য খাদ্য নিয়ে আসবেন। মুগ-মসুর, মাংস, পেঁয়াজ, ময়দা। আজ রাতে আমাদের অমিত্মম ভোজ হুজুর। আপনার দাওয়াত রইল। আসবেন কিন্তু –

কে আসবেন আপনাদের খাবার নিয়ে?

আমরা তাকে চিনি না, কখনো দেখিনি। শুধু খবর পাঠিয়েছেন, মগরিবের নামাজ শেষ করে তিনি আসবেন।

 

বিকেল থেকে আবার ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল, হাওয়ার তেজ বাড়ল। গদাধরকে ঠেকানো গেল না, সে অদৃষ্টবাদীদের একবার দেখতে চায়। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম, ঘর অন্ধকার, চারিদিকে কোথাও কিছু দেখা যায় না, মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের আলোয় অনেকটা ছবি জেগে উঠেই হারিয়ে যায়। অদৃষ্টবাদীরা কি তাহলে চলে গেল? টর্চের আলো ফেলে বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছতেই গুনগুন করে গানের সুর শুনতে পেলাম, সঙ্গে তারযন্ত্র বাজছে।

হুজুর, এসে গেলেন? ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এল।

অন্ধকার কেন? আলো জ্বালেননি?

তাঁর আসার সময়ে আলো জ্বালানো যায় না, হুজুর। আপনারা ভেতরে এসে বসুন। তিনি এলেন বলে –

ধূপের হালকা গন্ধ জড়িয়ে আছে সারাঘরে। আমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। অদৃষ্টবাদীদের জন্য তিনি খাবার নিয়ে আসবেন, তারপর শুরু হবে অমিত্মম ভোজের জন্য রান্নাবান্না।

একজন মৃদুস্বরে গেয়ে চলেছে :

 

জগতের মূল কোথা হতে হয়।

আমি একদিনও চিনলাম না তাই \

 

কোথায় আল্লাহর বসতি কোথায় রসুলের স্থিতি।

পবনপানির কোথায় গতি কিসে তা জানা যায় \

 

কোন্ আসনে আল্লাহ আছে কোন্ আসনে রসুল বসে।

কোন্ হলেস্নালে মীন মিশে কোন্ রঙে রং ধরায় \

 

দালে মিম বসালে যা হয় সেই কি জগতের মূল কয়।

কোথায় আরশ কোথায় বা মিম একথা কারে সুধাই \

 

আল্লাহ নবি যাঁরে বলে দেখতে পায় মন এক হলে।

লালন বলে কাতর হালে আমার কী হবে উপায় \

 

গানের মাঝেই আমরা ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পাই, সিঁড়ি বেয়ে তিনি উঠে আসছেন, ঘরে এসে ঢোকেন, তাঁর গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে অন্ধকার ঘরে, আর কোনো শব্দ শোনা যায় না, ঝড়-বৃষ্টি-হাওয়ার শব্দও মিলিয়ে গেছে, বুঝতে পারি, তিনি অনেক জিনিস মেঝেতে নামিয়ে রাখছেন, তারপর একসময় সেই ভারী পদাঙ্ক সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়, ঝড়-বৃষ্টি-হাওয়ার গর্জন আবার জেগে ওঠে।

অদৃষ্টবাদীরা এবার আগুন জ্বালায়, সেই আলোয় দেখতে পাই, তাদের রান্নাবান্নার জন্য খাদ্যদ্রব্য এসে গেছে। তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে। দেখি, দেয়ালে হেলান দিয়ে যার যার বসানো আছে পুতুলগুলো, তাদের জামাকাপড় পরিয়ে সাজানো হয়েছে।

আজ কি পুতুলনাচ হবে? জিজ্ঞেস করি।

একজন হেসে বলে, ওদেরও তো আজ শেষ ভোজ। তাই সাজিয়ে-পরিয়ে দিলাম।

পুতুলরাও খায়? গদাধরের গলায় বিস্ময়।

খাবে না কেন? এ দুনিয়াদারি কি শুধু মানুষেরই জন্য? শুধু মানুষ আর মানুষ। তার পোঁদে ফুঁ দিতে-দিতে আমরা কেয়ামতের দিনে পৌঁছলাম রে ভাই। আজ রাতেই দ্বিতীয় শিঙ্গা বাজবে।

অদৃষ্টবাদীরা তাদের রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মনে হল, একটা পুতুল হুবহু আমার মতো দেখতে। আর ওই যে পুতুলটা, একেবারে গদাধরের মতো।

পুতুলটা দেখতে একেবারে আপনার মতো, তাই না? একজন অদৃষ্টবাদী হেসে বলে।

হ্যাঁ।

আরেকজন বলে, এই দুনিয়ায় যত নর-নারী আছে, সবাই কোনো না কোনো পুতুলে তাদের মুখের আদরা খুঁজে পায়। খোদা কী যে মজার খেলা তৈরি করেছেন।

রান্নাবান্না শেষ হওয়ার পর আমরা সাতজন খেতে বসলাম। অদৃষ্টবাদীদের একটা ঝোলা থেকে অলংকৃত পোর্সেলিনের থালা ও বাটি বেরোল। একজন বলল, এসব হল পারস্যের কারুকাজ। ওই যাকে আপনারা এখন ইরান বলেন।

মোটা, পুরু রুটি আর ডাল ও মাংসের সুরুয়া দিয়ে অদৃষ্টবাদীদের অমিত্মম ভোজ। তাদের খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল, অনেকদিন কিছু খায়নি। মুখের লালা আর সুরুয়া মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছিল, আধ-চিবোনো রুটির খ- ছিটকে-ছিটকে যাচ্ছিল। এমনভাবে তারা খাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, কেউ এসে তাদের খাবার কেড়ে নেবে।

ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে আমাদের ফেরার সময় পাঁচজন অদৃষ্টবাদী আগুনের শিখা ঘিরে নাচছিল।

 

মাঝরাতে বিরাট কিছু ভেঙে পড়ার শব্দে জেগে উঠলাম। বারান্দায় এসে দেখলাম, ঝড়-বৃষ্টি-হাওয়ার প্রাবল্য কমেছে। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে অনেক মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেলাম, তারপর সাইরেনের আওয়াজ, দমকলের ঘণ্টা…। সারারাত আর ঘুম এলো না। ভোরবেলা চারদিক শান্ত, কিন্তু সূর্য ওঠেনি, আকাশ একইরকম কালো, ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমি ও গদাধর বেরিয়ে পড়লাম।

বড় রাসত্মায় উঠে দেখি, অদূরেই শপিংমলটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে আছে। যেন একটা দৈত্য হাড়গোড় ভেঙে শুয়ে পড়েছে, তাকে ঘিরে এখানকার বহু মানুষ, পুলিশ, দমকলের লোকদের ছোটাছুটি। শপিংমলের ধ্বংসসত্মূপ থেকে ধোঁয়া কু-লী পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে।

অনেক দূরে ওরা। কালো আলখাল্লা পরা পাঁচজন অদৃষ্টবাদী। ওরা চলে যাচ্ছে। একসময় অদৃষ্টবাদীদের আর দেখা গেল না। আমার খুব শীত করছে। গদাধরের হাত চেপে ধরে আমি বলে উঠেছিলাম, আমাদের অদৃষ্টের ভেতর থেকে এখুনি যে-শিখা লকলক করবে, আমরা সে-আলোয় পরস্পরকে চিনে নিতে চাই।

[এই কাহিনির নামকরণ করা হয়েছে কবি আল-মাহমুদের একটি কবিতার শিরোনাম থেকে। শেষে ‘আমাদের অদৃষ্টের ভেতর থেকে…’ লাইনটি ওই কবিতা থেকেই নেওয়া হয়েছে।]