অনন্য শিল্পী

হাশেম খান

একটি নিসর্গচিত্র – হার্ডবোর্ডের ওপর তেলরঙে অাঁকা। ছবির মাপ : উচ্চতায় দুই ফুট এবং পাশে তিন ফুট। ১৯৬০ সাল থেকে যথাসম্ভব যত্ন নিয়ে নিজের কাছেই রেখেছি ছবিটি। কয়েকবার ছবির সংগ্রাহকরা ভালো অর্থের বিনিময়ে ছবিটি তাদের সংগ্রহে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। নানা কারণ দেখিয়ে চিত্রটি কিছুতেই হাতছাড়া করিনি।
চিত্রটি বিশেষ কিছু কারণে আমার কাছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সুন্দর নিসর্গদৃশ্যের কারণে কারো কারো কাছে ছবিটি আকর্ষণীয় মনে হলেও সাধারণভাবে ও শিল্প-বোদ্ধাদের কাছে সাদামাটা একটি ছবি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। ছবিটি এঁকেছিলাম পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের সামনে বসে। চিত্রকলা শেখার বিষয়ে, শিল্পকলার উপলব্ধি ও বোধ বিষয়ক অনেক অজানা তথ্য ও তত্ত্বের দুয়ার তিনি আমার সামনে সে-সময়ে খুলে দিয়েছিলেন।
১৯৬০ সালের জুলাই মাস। চারুকলা শিক্ষার চতুর্থ বর্ষ শেষ করে আমরা পঞ্চম বর্ষে বা শেষ বর্ষে পা দিয়েছি। প্রথম ক্লাস বা পাঠ ঠিক হলো – তেলরঙে নিসর্গদৃশ্য অাঁকতে হবে। শ্রেণিশিক্ষক শিল্পী আবদুর রাজ্জাক ভালো করে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন – অাঁকার পদ্ধতি এবং প্রস্ত্ততিতে কী কী প্রয়োজন ইত্যাদি। যেহেতু নিসর্গচিত্র, তাই নিসর্গে গিয়েই ছবি তৈরি করতে হবে। তবে চারুকলা ইনস্টিটিউশনের চত্বরের মধ্যেই থাকতে হবে। বাইরে যাওয়া চলবে না। কারণ শিক্ষক ঘুরে ঘুরে সবার কাজ দেখবেন – পরামর্শ দেবেন। আর চারুকলার চত্বরটি অনেক খোলামেলা, প্রচুর গাছপালা। নিসর্গচিত্রের বিষয় নির্বাচনে কোনো ঘাটতি পড়বে না।
চারুকলা ইনস্টিটিউশনের সামনের দিকের প্রধান ভবনের ঠিক পেছনেই যে গোলাকার পুকুরটি রয়েছে, তার পশ্চিমপাড়ে তখন কোনো ভবন তৈরি হয়নি। পুরো এলাকা জুড়ে নানারকম গাছপালার চমৎকার এক বাগান। ছাত্র-বন্ধুরা ইজেল, বোর্ড ও রং-তুলি নিয়ে দুদ্দাড় করে পশ্চিমের বাগানে চলে গেল। দ্রুত যে যার সুবিধামতো ও উপযুক্ত জায়গা বেছে নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমি সবার মতো বাগানে না গিয়ে স্কেচ খাতা নিয়ে চারুকলার চত্বরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাজ্জাক স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার তখন বাগানে ছাত্রদের কাজ দেখছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন – তুমি কোথায় দাঁড়িয়েছ? তোমাকে যে অনেকক্ষণ দেখিনি।
– আমি অাঁকছি স্যার।
বলেই স্যারের সামনে আমার স্কেচ খাতা খুলে ধরলাম। স্যার আমার তিনটি স্কেচ দেখে বললেন –
– বাহ্, ভালো তো। আগেই ড্রইং ও কম্পোজিশন করে নিয়েছ – একটি স্কেচ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন –
– এটাই অাঁকো! সুন্দর হবে; কিন্তু কোথা থেকে অাঁকবে?
তারপর স্যারকে বিস্তারিত জানালাম। গোলাকার পুকুরের পুব-দক্ষিণ পাশে ছাপচিত্র বিভাগের ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে অাঁকা যায়।
– ছাদের ওপর থেকে? বলো কী? খাঁ-খাঁ রোদে চারদিন ধরে তোমাকে অাঁকতে হবে। অসুস্থ হয়ে যাবে। সম্ভব না। তার চেয়ে একটু ছায়া দেখে জায়গা ও বিষয় ঠিক করে নাও।
রাজ্জাক স্যারকে তখনই অনুরোধ করে বসলাম।
– স্যার আপনি যদি আমার হয়ে সফিউদ্দীন স্যারকে একটু বলে দেন। তাহলে স্যারের ক্লাসে ইজেল নিয়ে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই এ-নিসর্গদৃশ্য অাঁকতে পারি। রোদে দাঁড়াতে হবে না। আর ছাপচিত্রের ক্লাসের পশ্চিম দিকের বড় বড় জানালা খুলতেই পশ্চিমের এই গাছপালার বাগানটা খুব সুন্দর দেখা যায়।
রাজ্জাক স্যার মাথা নাড়লেন। বললেন –
– দেখ, এরকম অনুরোধ সফিউদ্দীন স্যারকে করা যাবে না। তাঁর ক্লাসের অসুবিধা হতে পারে। আর তোমাকে অনুমতি দিলে তোমার বন্ধুরা, বিশেষ করে মেয়েরা, যদি আবদার করে বসে যে তারাও একটু আরামে বসে অাঁকবে, তখন আমার জন্য এবং সফিউদ্দীন স্যারের জন্যও বিড়ম্বনা হয়ে যাবে। আর জানোই তো সফিউদ্দীন স্যার নিয়মনীতির বিষয়ে বেশ কঠোর।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ – শিক্ষক হিসেবে প্রথম থেকেই দেখে এসেছি – গতানুগতিক থেকে তিনি একটু ব্যতিক্রম, আলাদা। চলনে-বলনে, আলাপচারিতায় এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদে একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি পরিচিত। তাঁর গুণগ্রাহী সবাই। তাঁকে সমীহ করে যেমন, অন্যদিকে নিয়মনীতির ক্ষেত্রে তাঁর যথাযথ অবস্থান, শিক্ষকতা ও অন্যান্য কাজে সততা ও কঠোরতার কারণে তাঁকে ভয় করে চলতেও ভালোবাসে সবাই।
ইতিপূর্বে সফিউদ্দীন স্যারের কাছে গিয়েছি বা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলাম লিথোগ্রাফ ও কাঠখোদাইয়ের তিন-চারটি ক্লাসে। তাঁর ক্লাসে আমাদের সবাইকে খুব সাবধানে কাজ করতে হতো। সব সময় তটস্থ হয়ে থাকতাম, যাতে ভুল না হয়। কোনো ভুল করে বসলে বা নিয়মনীতির বাইরে কাজ করে বসলে আর রক্ষা নেই। সফিউদ্দীন স্যারের তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়া বা মন্তব্যের একটা ‘ভয়’ সবসময় মনে রাখতে হতো। পারতপক্ষে বা খুব প্রয়োজন না হলে স্যারের মুখোমুখি হতে চাইত না কেউ। তবে স্যারের প্রশ্নবাণ ও মন্তব্য তীক্ষ্ণ হলেও প্রায়শ রসাত্মক ছিলেন। তাঁর মন্তব্য নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক মজার গল্পের স্মৃতি হয়েছে, যা ছাত্র-শিক্ষক সবার কাছেই ছিল উপভোগ্য। যেমন সময় পার করে কেউ দেরিতে ক্লাসে ঢুকলে – স্যার জিজ্ঞেস করতেন – ‘কী হে, ঢুকছ না বেরোচ্ছ।’ (অর্থাৎ সে এত দেরিতে এসেছে যে, ছুটির সময় তো হয়ে এলো)।
দুদিন ধরে স্যারের ক্লাস করছি। লিথোগ্রাফের ক্লাস। কাগজ, কালি, পানি ইত্যাদি মিলে সাত-আটজনের একটা এলোমেলো অবস্থা। স্যার আমাদের কাজের অগ্রগতি দেখতে এসে বললেন –
বাহ্, ক্লাসটাকে তো নিজেদের বৈঠকখানা বানিয়ে ফেলেছ। এমন কাজ যে, কী করেছ এ-বৈঠকখানার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। এমন আলুথালু বেশে কাজ করছ এবং জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছ, এটাকে আর ক্লাস ভাবা যায় না। তা বেশ – বৈঠকখানাই যখন বানিয়েছ – কাজ শেষ করে প্রতিদিন একটু গুছিয়ে যাবে, ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে যাবে। সরকার কিন্তু শুধু ক্লাসরুম পরিষ্কার করার জন্যে ও চত্বর ঝাড় দেওয়ার জন্য একটি পদ তৈরি করেছে।
ব্যস – সেদিনই ক্লাস শেষে সবাই মিলে ক্লাসরুমটি পরিষ্কার করে গেলাম। এবং পরদিন ঠিকঠাকমতো পরিচ্ছন্নভাবে ক্লাস করে গেলাম।
ফিরে আসি তেলরঙে নিসর্গচিত্র অাঁকার প্রথম পাঠের বিষয়ে।
রাজ্জাক স্যারের কাছ থেকে ফিরে এসে অনেক ভাবলাম। যে-‘কম্পোজিশন’, ঠিক করেছি সেটিই অাঁকব এবং সাহস করে সফিউদ্দীন স্যারের কাছে গিয়ে অনুমতি চাইব। দুরু-দুরু বক্ষে সফিউদ্দীন স্যারের কাছে গিয়ে আমার আর্জি জানালাম। স্যার সব শুনে শান্ত ও স্বাভাবিক শিক্ষকসুলভ অবস্থান থেকে বললেন – ‘নিসর্গ’ বিষয়ে ছবি অাঁকতে হলে নিসর্গের মধ্যে থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ভালোভাবে জেনে ছবি অাঁকাই উত্তম। আর সেজন্যেই তোমাদের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক গাছপালার কাছে তোমাদের নিয়ে গিয়েছেন। তিনি নিজেও তোমাদের সঙ্গে থাকতেন। তুমি সেখানে বা সামনের দিকে এই লিচুতলায় বা আমগাছের নিচে ছায়ায় বসে অাঁকতে পারো। আর তোমাকে এ-ক্লাসে বসে অাঁকতে দিলে অন্যরাও একইভাবে আমার কাছে আসতে পারে। কয়জনকে এভাবে ক্লাসে জায়গা দিতে পারব? ছাপচিত্রের ছাত্ররা আমার কাছে আসে – তাদের ক্লাস নিতে হয়। বিভাগের শিক্ষকরা আসেন। তাঁরা এখানে বসে আলাপ-আলোচনা করেন।
সফিউদ্দীন স্যারের প্রথম কথাগুলো আমার মনে দাগ কাটল। তাই তো নিসর্গের ছবি নিসর্গের মধ্যে থেকে অাঁকতে হবে। চারুকলা পাঠে গাছপালা-প্রকৃতির অন্যান্য বিষয় চাক্ষুসভাবে দেখে উপলব্ধি করেই অাঁকতে হয়। তা না হলে ক্লাসে বসেই আলোকচিত্র দেখেও অাঁকা যেত। কিন্তু চারুকলার শিল্পীরা কখনোই ‘আলোকচিত্র’ দেখে অাঁকে না। সেটা সত্যিকারের চিত্রকলা হয় না। সেটা হতে পারে ‘নিসর্গের’ নকল ছবি।
কিন্তু আমি তো নিসর্গের ছবি সরাসরিই অাঁকছি। আমি ক্লাসে বসে আরামে অাঁকার জন্যেই শুধু স্যারদের অনুরোধ করিনি – স্যারের কামরা থেকে জানালা দিয়ে তাকালে সুন্দর একটি (কম্পোজিশন) চিত্র রচনা করতে পারি, যা স্যারের কামরার ছাদে দাঁড়িয়ে খাতায় স্কেচ করেছিলাম। সফিউদ্দীন স্যারকেও স্কেচ তিনটি দেখিয়েছিলাম। তিনিও রাজ্জাক স্যারের মতো একটি স্কেচ দেখিয়ে বললেন, এটি বেশ সুন্দর। এটি তেলরঙে অাঁকলে সুন্দর হবে।
আর আমি ভাবতে পারলাম না। কী করব! প্রায় দেড়দিন পার করে দিয়েছি। এখনো ছবি শুরুই করতে পারলাম না। চারদিনে ছবি শেষ করতে হবে। বন্ধুরা ইতোমধ্যে অনেক এগিয়ে গেছে। ক্লাস থেকে ইজেল, ছবি অাঁকার হার্ডবোর্ড ও রং-তুলি নিয়ে প্রিন্টমেকিং বা ছাপচিত্র বিভাগের ছাদের মাঝখানেই দাঁড়ালাম। সে-আমলে ছাত্র-শিক্ষক অনেকেই হার্ডবোর্ডেই তেলরঙের ছবি অাঁকতেন। ‘ক্যানভাস’ সবসময় পাওয়া যেত না। দামও ছিল ছাত্রদের নাগালের বাইরে।
প্রখর রোদ। শ্রাবণ মাস। কয়েকদিন পরই গরমে কাঁঠাল পাকবে। এমন রোদে দাঁড়িয়ে ছবি অাঁকতে শুরু করি। নিজের ওপরই রেগে যাই। স্যারদের আমার ইচ্ছাটা ঠিকমতো বোঝাতে পারিনি। স্কেচবইয়ে যে প্রাথমিক চিন্তাটা করেছি সেটাই যে আমি তেলরঙে ফুটিয়ে তুলতে চাই। অন্য কোনো কম্পোজিশন করে হয়তো আনন্দ পাব না।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বোর্ডে নিসর্গদৃশ্যটির কম্পোজিশনসহ ড্রইং করে ফেলি। বেশ দ্রুত অাঁকতে পারায় ভালো লাগল। কিন্তু গরম যে অসহ্য। রোদের গরমের চেয়ে বেশি ছাদের গরম। এমনভাবে তেতে উঠেছে যে, খালি পায়ে এক মিনিটও দাঁড়ানো যায় না। ছাদ থেকে গরম ভাপ উঠছে। ঘণ্টাখানেক পর পাশের বারান্দার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। ভাবলাম এভাবেই ছবি এঁকে যাব। কিছুক্ষণ অাঁকব, আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব। দারোয়ান হানিফ মিয়া যাচ্ছিল বারান্দা দিয়ে। তাকে বললাম একটা ছাতা নিয়ে আসতে। এক হাতে ছাতা, আরেক হাতে রং লাগাচ্ছি। বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। হানিফ মিয়া সাহায্য করল। আধা ঘণ্টা সে ছাতা ধরে থাকল – আমি অাঁকলাম। কিন্তু আধা ঘণ্টার মধ্যেই ছাদের গরমে সে অস্থির হয়ে উঠল। একে তার মোটা ও দশাসই শরীর, তার ওপর এই গরম। অস্থির স্বরে বলে উঠল –
– এত গরমে দাঁড়িয়ে আপনি ছবি অাঁকবেন? অসম্ভব – জ্বর হয়ে যাবে। এরকমভাবে ছবি অাঁকা পাগলামি। আধা ঘণ্টায় আমি কাহিল।
– হানিফ মিয়া আপনার কাজ আছে। আপনি কাজে যান। আমি দেখি কী করি।
– বাপরে বাপ, এ-গরমে দাঁড়িয়ে ছবি অাঁকা?
বলতে বলতে হানিফ মিয়া চলে যায়।
একটু পরেই দীর্ঘ ছায়ার মানুষটিকে দেখে আমি অবাক। ধীর পায়ে এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়েছেন। সফিউদ্দীন স্যার। বললেন –
– তাহলে এ-গরমে রোদে দাঁড়িয়েই ছবি অাঁকবে ঠিক করেছ? – ছাদ থেকে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। তুমি তো একটু পরেই অসুস্থ হয়ে যাবে হে। অনেকখানি এঁকেও ফেলেছ দেখছি। কিন্তু কতক্ষণ পারবে? না, এভাবে ঠিক হচ্ছে না। রোদ আর অসহ্য গরমের কষ্ট নিয়ে ভালো করে ছবি অাঁকা হয় না। তুমি এখন শিখছ – মনটা প্রফুল্ল রেখে, স্বাভাবিকভাবে অাঁকতে পারলে শেখাটা ঠিকমতো হবে। এক কাজ করো – ইজেল বোর্ড নিয়ে এক্ষুনি আমার কামরায় চলে আসো।
– না স্যার, এখানে থেকেই অাঁকতে পারব।
কিছু না ভেবেই, হয়তো খানিকটা অভিমানেই, তক্ষুনি বলে ফেললাম।
সফিউদ্দীন স্যার মৃদু হেসে আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে পরক্ষণেই চলে যেতে যেতে বললেন – চলে এসো।
শিক্ষক সফিউদ্দীন আহমেদের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুত রং চাপাচ্ছি আমার হার্ডবোর্ডে। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে অাঁকা ড্রইংটা মুছে ফেলতে দেখে স্যার কারণ জানতে চাইলেন। বললাম – একই বিষয় হলেও এখন ‘পরিপ্রেক্ষিত’ পালটে গেছে শুনে স্যার খুশি হলেন।
নির্দিষ্ট চারদিনের মধ্যে আজ দুদিনের মাত্র দেড়ঘণ্টা আগে অাঁকতে শুরু করেছি। একদিকে দ্রুত অাঁকতে হচ্ছে – আগামী দুই দিনের মধ্যেই শেষ করতে হবে। অন্যদিকে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের মতো শিক্ষক আমার অাঁকার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখছেন – একটা ভয় বারবার আমাকে অন্যরকম অনুভূতিতে নিয়ে যাচ্ছে। আদৌ ছবিটা ঠিকমতো অাঁকতে পারব তো। আজকের মধ্যেই পুরো ছবিতে তেলরঙের প্রথম প্রলেপ শেষ করতে হবে। রাতে রং শুকাবে। তা না হলে আগামীকাল এসে খুব বেশি এগোতে পারব না।
একনাগাড়ে রং লাগিয়ে যাচ্ছি – প্রথমে তেলরঙে নিসর্গছবি অাঁকছি। এমন সময় ঘণ্টা বাজার শব্দে চমকে উঠলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি – বিকেল চারটা পাঁচ মিনিট। ছুটি হয়ে গেছে। স্যার এখন কামরা বন্ধ করে চলে যাবেন। তিন ভাগের দুই ভাগ রং চাপাতে পেরেছি। প্রথম প্রলেপ আজ শেষ হলো না।
সফিউদ্দীন স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে নিরীক্ষা করলেন ছবিটা। বললেন, তোমার রং চাপানোটা সুন্দর, বাকিটুকু আজই শেষ করে যাও। দুটি হলেও প্রথম প্রলেপ শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি থাকব। তুমি নিশ্চিন্তে অাঁকো – আমি একটু অফিসে যাচ্ছি।
সেদিনের মতো ছবি শেষ করে ঘর থেকে বেরোতেই দেখি বন্ধুরা অনেকেই আমার অপেক্ষায়। আমাকে ঘিরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন –
– কী রে? তোর ভয়ডর নেই?
– সফিউদ্দীন স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি অাঁকা – পারলি কী করে?
– স্যার তোকে অনুমতি দিলো? তোরে বকল না?
– তুই স্যারের ঘরে দাঁড়িয়ে ছবি অাঁকছিস? বাপরে, আমি ভাবতেও পারি না?
– স্যার তোর অাঁকা দেখে কী বলছে রে?
ইত্যাদি সব প্রশ্ন ও কৌতূহল আমার বন্ধুদের আর আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল – সফিউদ্দীন আহমেদের মতো শিক্ষক ও শিল্পীর স্নেহের পরশ পেয়ে।
পরদিন যথারীতি ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্ত্ততি নিচ্ছি – তেলরং মাধ্যমে ছবি অাঁকার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করব। তুলিতে রং লাগিয়ে ছবিতে লাগাতে যাব, এমন সময় প্রায় নাটকীয়ভাবে সফিউদ্দীন স্যার বলে উঠলেন –
– অ্যাই, থামো। কী করছ তুমি?
স্যার আমাকে ছবি অাঁকা থেকে বিরত থাকতে বলে জানতে চাইলেন – তুমি এখন কীভাবে অাঁকতে যাচ্ছিলে। একটু ব্যাখ্যা করো।
প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও পরে নিজকে সামলে নিয়ে বললাম –
– তেলরঙে ছবি অাঁকার নিয়ম যা জেনেছি – কম্পোজিশন ঠিক করে ড্রইং করার পর তেলরঙে তারপিন মিশিয়ে একটু পাতলা করে পুরো ক্যানভাসে বা বোর্ডে প্রাথমিক প্রলেপ দিয়ে শুকানোর অপেক্ষায় থাকতে হবে। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ছবির বিষয়টি ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তোলার জন্য যথাযথ ড্রইং ও আলোছায়া পরিপ্রেক্ষিত ইত্যাদি ঠিক করে নিতে হবে। রঙের সঙ্গে এ-সময় তিশির তেল মিশিয়ে অাঁকতে হবে। তৃতীয় পর্যায়ে ছবিটিকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য কী কী কাজ বাকি রয়েছে তা খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলো সম্পূর্ণ করতে হবে। ছবির ‘ডেপ্থ’ অর্থাৎ যেখানে যেখানে রং গাঢ় করা প্রয়োজন, তা ঠিক করে নিতে হবে। আমি এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে ছবিতে রং লাগিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ড্রইংগুলো ঠিক করে দৃশ্যটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।
সফিউদ্দীন স্যার সব শুনে বললেন –
– অ্যাকাডেমিক ছবি বা শেখার প্রথম দিকে এগুলো সাধারণ নিয়ম। তবে যে-কোনো সৃজনশীল শিল্পকলায় শেখার সময় থেকেই যদি ভাবা যায় – অাঁকা ছবিটা সুন্দরভাবে তৈরি করতে হবে বা ফুটিয়ে তুলতে হবে, গান শেখার সময় যদি মনে ধারণ করা যায়, যা শিখছি, যা গাইছি তা অন্যের কাছে শুনতে ভালো লাগবে তো? একইভাবে নাটকে, অভিনয়ে, স্থাপত্যকলায়, ভাস্কর্য তৈরিতে এ ভাবনাগুলো ধারণ করে শিল্পচর্চা করতে হয়, যেটাকে একটি ছোট্ট শব্দে বলা যায় ‘শিল্প’। অন্যভাবেও বলি আমরা যেমন – নান্দনিকতা। একই রবীন্দ্রসংগীত পাঁচজন বা অনেক শিল্পী ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিবেশন করেন – সুর, তাল, লয় সব ঠিক থাকা সত্ত্বেও কোনো একজনের গান বা কারো কারো গান আলাদা হয়ে অন্যদের বা শ্রোতাদের হৃদয়ে দোলা দেয়। এই যে ভালো লাগা, এ-বিষয়টাই হলো ‘শিল্প’। ছবি অাঁকার ক্ষেত্রে দেখো – ক্লাসে যখন ‘প্রতিকৃতি’ অনুশীলন করা হয়, প্রত্যেক ছাত্রই সাধ্যমতো চেষ্টা করে ‘মডেল’ দেওয়া মানুষটির মুখাবয়ব মেলাতে। সবার ছবিই ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখলে লোকটি কে (মডেল) – সবাই চিনতে পারবে। কিন্তু সবার ছবিই কি সমান আকর্ষণীয় বা হৃদয়গ্রাহী হয়? হয় না। দু-তিনটি ছবি হয়তো অনেকেরই ভালো লাগে। ওই দুই-তিনজন শিল্পীর অাঁকার কৌশলে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা শৈলী থাকে যার জন্যে চিত্র সুন্দর রূপ ধারণ করে। এ বৈশিষ্ট্যই হলো ‘শিল্প’।
– এবার তোমার ছবির কথায় আসা যাক। গতকাল তোমার রং চাপানোর পুরোটাই আমি দেখেছি। তুমি শিক্ষানবিশ। তা সত্ত্বেও নিয়ম থেকে বেরিয়ে এসে ছবিতে কাজ করেছ। প্রাথমিক পর্যায়ের মতো রং না চাপিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের মাঝামাঝিতে থেকে তুমি ছবির বিষয়টা প্রায় ফুটিয়ে তুলেছ। ছবিতে যা যা দরকার তার অনেকটাই একবারে তুমি নিয়ে এসেছ। সুতরাং ছবির সব জায়গাতেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের রং নিয়মমাফিক লাগানোর প্রয়োজন নেই। তোমার ছবির প্রায় সত্তর ভাগ কাজই শেষ। বাকি তিরিশ ভাগ হলো – এই এই অংশগুলো।
সফিউদ্দীন স্যার আমার ছবিতে কিছু কিছু অংশ যা আছে তাই রেখে দিয়ে, বাকি কিছু বিষয়ে আলোছায়ার বিষয়ে কাজ করতে বললেন। কোনো কোনো জায়গায় ড্রইংগুলো আরো স্পষ্ট করে পরিপ্রেক্ষিত বা সামনে-পেছনে ইত্যাদি যথাযথভাবে এঁকে কাজটি শেষ করতে পরামর্শ দিলেন। তারপর আরো জানালেন – যেহেতু প্রথমবার রং লাগানোর সময় বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার একটা চিন্তা মাথায় ছিল এবং ছবিতে তা একবারেই এসে গেছে তাই দ্বিতীয়বার রং লাগানোর আগে বিষয়টা ভালো করে দেখে বুঝে তারপর কাজ করা উচিত। ছবি অাঁকতে অাঁকতেই একজন শিল্পীর অনুভবে ও বোধে কিছু গুণ ও ক্ষমতার অর্জন হয়। চেতনে বা অবচেতনে সেসব গুণের প্রকাশ ঘটে। যেমন পরিমিতি বোধ, সৌন্দর্যবোধ, শৃঙ্খলাবোধ ইত্যাদি। শিল্পীর অাঁকা ছবিতে এগুলো সম্পদ। একবারেই তোমার অাঁকা নিসর্গচিত্রে সাবলীল-স্বাভাবিক প্রকাশের একটি বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তুলি সঞ্চালনে একটি আলাদা রূপ ছবিতে পরিস্ফুট। তাই দ্বিতীয়বার রং লাগানোর পর ছবির উল্লিখিত গুণগুলো হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একটা সুন্দর ছবি অাঁকার জন্যে সব নিয়ম-কানুন মাথায় রেখেই শিল্পীকে বুঝতে হয় কতটুকু অাঁকব এবং কতটুকু অাঁকবো না। ছবির সব বিষয়বস্ত্ততে সমান গুরুত্ব দিতে হবে কিনা সেটাও বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়।
শিক্ষানবিশকালের প্রথম তেলরঙে অাঁকা নিসর্গচিত্রটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং একান্তই আমার নিজের জন্য। এ চিত্রটি অাঁকার সূত্র ধরে সফিউদ্দীন আহমেদের মতো একজন মহান শিল্পী, একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষকের খুব কাছে চলে আসার সুযোগ ঘটেছিল। অবশ্য ছাপচিত্রের ক্লাসে তাঁর উজ্জ্বল সান্নিধ্য আমরা পেয়েছি; কিন্তু এ-তেলচিত্রটি তাঁর সান্নিধ্যে ও উপস্থিতিকালে চিত্রকলা নির্মাণ, শিল্পকলাবোধ ও নান্দনিক বিষয়ে তাঁর আলাপচারিতা ও শিষ্যকে পরামর্শ আমার বোধের জগতের অনেক দুয়ার খুলে দিয়েছিল – যা আমি সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই আমার অর্জন – হ্যাঁ, ‘মূল্যবান অর্জন’ বলেই আজো পর্যন্ত ধারণ করে চলেছি।
সফিউদ্দীন আহমেদের মতো শিল্পীর কাছে ছবি অাঁকা শেখা ও তাঁর উষ্ণ সান্নিধ্যের আশ্রয় পাওয়া আমার মতো অনেক ছাত্র ও শিল্পীরই সৌভাগ্য হয়েছে। ছাত্র বা শিষ্যের আগ্রহ ও নিষ্ঠাই একজন শিক্ষকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সফিউদ্দীন আহমেদও আগ্রহী ছাত্র বা শিল্পীকে কাছে টেনে নিতেন। বাইরে থেকে তাঁকে নিশ্চুপ ও খানিকটা কঠিন মনে হলেও আসলে তিনি ভেতরে ভেতরে দরদি ও স্নেহপ্রবণ একজন মানুষ ছিলেন। কিছুদিন তাঁর সঙ্গে মেশার সুযোগ ঘটলেই বোঝা যেত যে, তিনি একজন উদার মনোভাবের আলোকিত মানুষ।
বাংলাদেশের শিল্পকলার ক্রম-অগ্রসরমান ও যে সমৃদ্ধতর অবস্থানে পৌঁছেছে তার পেছনে প্রেরণা, শক্তি ও সাংগঠনিক কারিশমার মূলে ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ ও তাঁর সহকর্মী সমসাময়িক শিল্পীবৃন্দ। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, শফিকুল আমিন, যাঁরা বাংলাদেশ নামক অঞ্চলে শিল্প-আন্দোলন শুরু করেন, তাঁরা তাকে প্রতিষ্ঠাও দিয়েছেন। শিল্পকলার চর্চা শুধু কয়েকজন ছবি অাঁকবে সেজন্যে নয়, চারুকলা চর্চা মানব কল্যাণের জন্য, দেশের মানুষের মধ্যে শিল্পবোধ তৈরির জন্য। সর্বোপরি উন্নত সমাজ গঠনে ‘চারুকলা চর্চা’ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে – ইত্যাকার বিষয়কে আমাদের এ-প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পীরা গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের চারুকলা চর্চার ক্ষেত্রে ছাপচিত্রকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব। চারুকলা ইনস্টিটিশনে গ্রাফিক আর্ট বিভাগের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪৮ সাল থেকেই দিনের পর দিন কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে তিল তিল করে ছাপচিত্রের জন্য নতুন ও সৃষ্টিশীল শৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজের ছাপচিত্র যেমন তৈরি করেছেন, অন্যদিকে ছাত্রদের উৎসাহিত করেছেন। সীমিত প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে নিজের মেধা ও অন্বেষার স্ফুরণ ঘটিয়ে দেশে-বিদেশে শিল্পবোদ্ধাদের কাছে সমাদৃত হয়েছেন। তাঁরই ছত্রছায়ায় তৈরি হয়েছে বেশকিছু মেধাবী ছাপচিত্রী, যাঁদের ছাপচিত্রের কাজ বাংলাদেশের শিল্পকলার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে। ছাপচিত্রের প্রতি শিল্পরসিক ও বোদ্ধাদের যে উৎসাহ ও শিল্পপ্রিয়তা তার পেছনে প্রধান শক্তিই হলেন শিল্পী ও শিক্ষক সফিউদ্দীন আহমদ। আজ তাই নির্দ্বিধায় বাংলাদেশে ‘ছাপচিত্রের জনক’ হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ – নিজের প্রতিটি শিল্পকর্ম তৈরিতে ছিলেন নিষ্ঠাবান ও সৎ। তৈলরঙের ছবি, কাঠকয়লার ছবি, বিভিন্ন মাধ্যমের ড্রইং কিংবা তাঁর ছাপচিত্র – কাঠখোদাই, এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট – যে-কোনো মাধ্যমের ছবিই হোক – খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবির প্রতিটি ইঞ্চি দেখলে বোঝা যায়, সফিউদ্দীন শিল্পসৃষ্টিতে কী পরিমাণ দায়বদ্ধ ছিলেন – কোথাও কোনো খুঁত বা দুর্বলতা রাখতে চাইতেন না। নিজের সৃষ্টিকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং ভালোবাসতেন। তাই জীবনভর একটা নীতি কঠিনভাবেই পালন করার চেষ্টা করেছেন – নিজের সৃষ্টি, ছবি, বিক্রি করা বা হস্তান্তর করতে চাইতেন না। যদিও তাঁর অনিচ্ছাসত্ত্বে কিছু ছবি হস্তান্তর হয়েছে। এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত শিল্পী সফিউদ্দীন অন্যদের থেকে আলাদা এবং অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর সারাজীবনে সৃষ্টি করা অমূল্য সব চিত্রসম্ভার – আগামী প্রজন্মের জন্যই রয়ে গেল। অমূল্য সম্পদকে তিনি দেশের কল্যাণেই রেখে গেলেন। 