অনিল বাগচীর একদিন : তার অন্তর্লোক-বহির্লোকের আলোয়

আবদুলস্নাহ আল মাসুদ অপু

চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ট্র্যাজিক চলচ্চিত্র অনিল বাগচী একদিন একজন হিন্দু যুবকের অস্তিত্বের টানাপড়েন এবং তার বিয়োগান্ত পরিণতির এক চমৎকার চলচ্চিত্রিক প্রকাশ।

অনিল বাগচী একজন যুবক, হিন্দু যুবক। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে সে প্রচ- রকম আতঙ্কগ্রস্ত, নিরাপত্তাহীন ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ঢাকার একটি মেসবাড়িতে অবস্থান করছে। এই উত্তাল সময়েও সে জীবিকার আশ্রয়ে তার অফিসে নিয়মিত যাচ্ছে। যে-অফিসটি একজন অবাঙালি বিহারির মালিকানাধীন। দৃশ্যত নিঃসঙ্গ অনিল তার স্বভাবসুলভ সততা ও ব্যক্তিত্বের স্নিগ্ধতার জন্য মানুষের আপনজনে সহজেই পরিণত হয়।

যে-রাত শেষে দিনের গল্প দিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়, সে ভয়াল রাতে প্রকৃতির ভয়াল রূপ আর পরিপার্শেবর বিরূপ ভয়াল আবহে অনিল নিদ্রাহীন, আতঙ্কগ্রস্ত।

মা-মরা অনিলের চেতনার নিত্যসহচর তার স্কুলশিক্ষক বাবা, যাঁর সাহচর্য আর মানবিক শিক্ষা অনিলের পৃথিবীপাঠের অভিজ্ঞতা। অনিলের নিজস্ব যে-জগৎ তা বহির্বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন তার নিজস্ব এক প্রত্যক্ষির জগৎ। সেই ভয়াল রাতে অনিল বারবার ডুবে যায় সে-জগতের সুখস্মৃতিগুলোর মধ্যে, যে-স্মৃতি তার বাবা আর বোনটার সাহচর্যের স্মৃতি। আমরা দেখি সেই স্মৃতি অনেক বেদনা, অনেক একাকিত্বের মধ্যেও অনিলের মানসপটে কতটা রঙিন। এ ভয়াল সময়ে অনিলের এই মগ্নতা যেন তার প্রাণের আকুতি বাবা আর বোনটার সাহচর্য পাওয়ার। মানব-অস্তিত্বের একটা অংশ সময় ও স্থানের সীমা অতিক্রম করতে পারে। একই সময়ে যে-কোনো স্থান এবং সময়ে সে বিচরণ করতে পারে।

মাঝরাতে পাশের ঘরের গফুর চাচার আমন্ত্রণে চা-পানের অবসরে সে ক্ষণিকের জন্য হলেও কিছুটা স্বস্তি পায়। শেষরাতে ঘুমুতে গিয়ে অনিলের স্বপ্নে ক্ষণিক মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমপাড়ানি গানের সুরে ঘুমের আবেশ। যে-মায়ের কোনো স্পর্শই সে পায়নি, মা তার মারা গেছেন তাকে জন্ম দিতে গিয়েই।

যেমনটি ফ্রয়েড বলেছেন – ঘুমের স্বল্পকাল স্থায়ী নিরীহ অবস্থায় মনের নির্জ্ঞান স্তরের ইচ্ছাপূরণ। অথচ অনিল জাগ্রত অবস্থাতেই অকাট নিরীহ।

সকালে গফুর চাচার কোরআন তেলাওয়াতের সুরে সদ্য-ঘুমভাঙা অনিলের মনে সঞ্চার করে অন্যরকম প্রশান্তি। সেই সুরের টানে অনিল যখন বারান্দায় এসে সদ্য বৃষ্টিস্নাত দিনের প্রথম আলোতে বিমোহিত, তখনো তাকে সঙ্গ দেয় তার বাবা, তার চেতনার রঙিন আলো, তার নিজস্ব জগতের রূপকার। যা তুমি তোমার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছ, নিজস্ব করে নেওয়ার জন্য তাকে অর্জন করো (গ্যেটে, ফাউস্ট, প্রথম খ-)। অনিল কি অর্জন করেছিল তার হিন্দুত্ব, নাকি সে যে অনীল সেই মানব-পরিচয়। তখনো অনিল জানে না, বর্তমানের ধূসর কালো দিনগুলোর আজকের দিনটিতে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। একসময় গফুর চাচা এসে তাকে জানায় ডাকে-আসা চিঠির কথা। তার বাবার স্কুলের হেডমাস্টারের লেখা চিঠিতে জানা যায় তার বাবার হত্যার কথা, হেডমাস্টারের বাড়িতে তার বোনটার অবস্থানের কথা। অনিল সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে যাওয়ার। অফিসে যাওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনীবেষ্টিত বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবের মুহূর্তে আবারো অনিলের অন্তর্জগতে তার বাবার কণ্ঠের অনুরণনে তার চেতনাকে সাহসী করে তোলে। অস্তিত্বের চরম সংকট মুহূর্তে সেই ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে আপাত ভীতু অনিল হয়ে ওঠে চরম সাহসী। সে একজন হিন্দু, সে জবাব দিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। অবরুদ্ধ ঢাকার পরিস্থিতি সাংবাদিককে বলতেও দ্বিধা করে না। এমনকি বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে অফিসে বসের পাশ দিয়ে সহযোগিতার সুযোগও সে প্রত্যাখ্যান করে। এ যেন ঠিক ফ্রয়েডের কথাতেই – বহির্জগতের সঙ্গে সংঘাতে এলে অহং আবার আর একটি জিনিস গঠন করে। তা হলো অধিশাস্তা (super ego), আমরা যাকে সাধারণত বলি নৈতিকতা।

একসময় অনিল গ্রামের পথে বাসে যাত্রা করে। সহযাত্রী এক পরিবার আর তার কর্তা আইয়ুব আলী মুহূর্তেই অনিলের আপন হয়ে ওঠে। আইয়ুব আলী যখন জানতে পারে অনিল হিন্দু, তখন সে তাকে তার শ্যালক পরিচয়ে পাকিস্তানি আর্মি চেকপোস্টে পরিচয় দিতে বলে। কিন্তু অনিল আজ অন্য মানুষ। ছোটবেলায় মেলায় দেখা সেই খড়গ-হাতে কালী যেন আজ তাকে নিতে চায়। যে-দৃশ্যটি আমাদের মনে করিয়ে দেবে ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণ রেখা ছবিতে সীতার সেই কালীরূপী বহুরূপী দর্শনের কথা। সেই সীতাও যেমন জীবনে এক নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন হয়, অনিলও আজ তেমনি – আর্মি চেকপোস্টে সে অবলীলায় বলে তার পরিচয়, তার নাম অনিল বাগচী। যথারীতি সেও খুন হয়। নিভে যায় তার চোখের আলো। যে-আলো বাস্তবের নির্মমতায় ধূসর, অবর্ণিল সাদাকালোর দ্বন্দ্বময়। আর জ্বলে ওঠে তার চেতনার-মনের আলো, যে-আলো বহু বর্ণিল, রঙিন।

ছবিটিতে ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ধীরগতির ক্যামেরা মুভমেন্টের যাত্রাপথে আইয়ুব আলীর মুখে হুমায়ূন আহমেদের চিরপরিচিত হাস্যরসাত্মক সংলাপ চলচ্চিত্রটিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। ক্যামেরার কাজ, লাইটিং, চরিত্রায়ন, সংলাপ, দৃশ্যসজ্জার আবহ, সংগীত ও সম্পাদনা – সবকিছুর চমৎকার এক সাযুজ্যপূর্ণ সংগত ছবিটিতে দেখা যায়। বিশেষ করে রাতের দৃশ্যে। রাতের দৃশ্যগুলোতে গ্রামের আবহ ও জ্যোৎস্নার চাঁদের আলোর আবহ তৈরিতে আলোর ব্যবহারে চিত্রগ্রাহক মুন্শিয়ানা দেখিয়েছেন। বিশেষ করে ক্যামেরার ধীরগতির সঙ্গে গল্পের টেনশন একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থার সৃষ্টি করে। চরিত্রায়ন বিশেষ করে অনিলের চরিত্রে আরিফ সাঈদ, আর অনিলের বাবার চরিত্রে তৌফিক ইমনের অভিনয়, সঙ্গে ক্যামেরা ও আবহসংগীতের ব্যবহার, চরিত্রের মুভমেন্ট, সংলাপ- প্রক্ষিপণ Larger than life image-কে জোরালো করে।

ছবিটিতে সংগীতের ব্যবহার দৃশ্যের বিমূর্ততা সৃষ্টিতে আবেদন রেখেছে। অনিলের বোন অতসীর নিঃসঙ্গতা তার মনের অনুভূতির রূপ হয়ে প্রকাশিত হয় দৃশ্যের সংগীত। যদিও সে-মুহূর্তে জানা যায় না অতসীর একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গ-মনের অভিব্যক্তির ভাষা। কেবল দৃশ্যের সাদাকালো দ্বন্দ্ব প্রকট করে তার মনের বিমূর্ত নিঃসঙ্গতার অনুভূতি। এ নিঃসঙ্গতার কারণ জানা যায় শেষ দৃশ্যে – আইয়ুব আলীকে বলা অনিলের সংলাপ থেকে – তার বোন যেন তার পছন্দের ছেলেটিকে বিয়ে করে। যদিও আমরা কখনো জানতে পারি না ছেলেটিকে। কেবল সাদাকালো দৃশ্যের ভাষা জানান দেয় বিপরীত কোনো পাত্রের কথা। চলচ্চিত্রটিতে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক প্রসঙ্গকে মেলাতে চেয়েছিলেন আঁদ্রে বাজা। মোরশেদুল ইসলামের বর্তমান ছবিটিতেও যার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই।

বর্তমান সময়ের সাদাকালো দৃশ্য আর কল্পনার রঙিন দৃশ্য চলচ্চিত্রটিতে এক চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক আবহ তৈরি করে। আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফরাসি নির্মাতা ক্লদলিলচের মন Homme et un femme (A man and A women)-এর আঙ্গিকের কথা। যদি অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রটি এক ভিন্নমাত্রার প্রকাশ। ফিল্মকাব্য। এ শুধু বাঙালি মননেরই প্রকাশ। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে জীবনঢুলী, মেঘমলস্নার আর অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রগুলোতে ব্যক্তি অন্তর্লোকের টানাপড়েন, অস্তিত্ব সংকটের চলচ্চিত্রিক প্রকাশ লক্ষ করা যায়। অনিল বাগচীর একদিন এক্ষেত্রেও অনন্য – চলচ্চিত্রে সাহিত্যের অস্তিত্ববাদ মতবাদের প্রকাশ। চলচ্চিত্রটিতে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহে অনিলের ব্যক্তিঅস্তিত্বের টানাপড়েন শুধু নয়, তার অভিজ্ঞতার চিত্রণে আমরা দেশভাগ-উত্তর পূর্ববঙ্গের সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্বের সংকটের চিত্র খুঁজে পাই। পাশাপাশি যুদ্ধকালীন সংকটের সমগ্র চিত্রও দেখতে পাওয়া যায়।

অনিলের মনোবাস্তব আর বহির্বাস্তবের প্রকাশভাষাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফ্রান্সের ‘আভাগার্দ’ চলচ্চিত্রগুলোর কথা। ছবিটিতে আমরা আত্মিক ও সচেতন-অসচেতন মনের ক্রিয়ার প্রকাশ দেখতে পাই। অনিলের নিজস্ব যে-জগৎটুকু তা যেন এক স্বপ্নের জগৎ। অনিলের সুযোগ গ্রহণের সমস্ত বাস্তবতাকেই পরিচালক প্রত্যাখ্যান করেন; যা মানুষের প্রচলিত আত্মিক প্রশান্তিলাভের ধারণাকে আঘাত করে। আবার মনোজগৎ আর বাস্তবজগতের ঘনঘন অতিক্রম এবং ব্যক্তিজীবনের টানাপড়েনের সংকট আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফরাসি ‘নিউ ওয়েভ’ চলচ্চিত্রগুলোর কথা। এখানেও অস্তিত্ববাদের সাহিত্যিক ধারার সফল চলচ্চিত্রিক প্রকাশ আমরা দেখি। ফরাসি ‘নবতরঙ্গে’র চলচ্চিত্রকার অ্যালো রেনে তার ছবিতে যে-ভাষার প্রচলন করেছিলেন তাতে অতীত ও বর্তমান কখনো-বা ভবিষ্যৎও মিলেমিশে এক হয়ে যায়। অনিল বাগচীর একদিন ছবিটির ক্ষেত্রেও আমরা দেখি অনিলের স্মৃতি, বর্তমান সময়ের অনিশ্চয়তা আর বাড়ির পথে যাত্রার ক্ষেত্রে কিংবা চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী গ্রামে তার বোনটি আশ্রিত রয়েছে তার সদ্য খুন হওয়া বাবার স্কুলের হেডমাস্টারের বাড়িতে, অনীল কি সেখানে পৌঁছাতে পারবে, তার কী হবে? এরকম ভবিষ্যৎমুখী একটা ভাবনাও দর্শককে তাড়িত করে। এমনকি শেষ পর্যন্তও যখন অনিলের চোখের আলো নিভে যায়, আমাদের মনের আলো একটু হলেও খোঁজে – অনিলের বোন অতসীর কী হবে, এমনতর ভবিষ্যৎমুখী উত্তর। ‘নবতরঙ্গে’র চলচ্চিত্রকারদের সমসাময়িক কিন্তু ভিন্ন মেজাজের চলচ্চিত্রকার রোঁবের ব্রেসের চলচ্চিত্র বিষয়ের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায় অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রে, যার বৈশিষ্ট্য – নায়ক-নায়িকার মনস্তত্ত্ব আর নিঃসঙ্গতার দিক।

অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রটি বোধ করি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে অনন্য সংযোজন।