শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
শনিবারের চিঠিতে পণ্ডিত রবিশঙ্করের কথা লিখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কারণ ওঁর স্মৃতিচারণায় আমাকে বলেছিলেন যে, মাইহারে বাবা উস্তাদ আলাউদ্দিনের কাছে সংগীতশিক্ষার দিনগুলোয় ভারতবর্ষ ও প্রবাসীর পাশাপাশি উনি নিয়মিত শনিবারের চিঠিও পড়তেন। যেটা নিয়ত লক্ষ করেছিলাম সে-সময় তা হলো যে, প্রায় সারাটা জীবন শহর থেকে শহর, দেশ থেকে দেশ এবং হোটেল থেকে হোটেল ঘুরেও তিনি ছেলেবেলার কাশী, চোদ্দোয় পা দিয়ে আবিষ্কার করা কলকাতা, পড়তে শুরু করা বয়সের পড়া অজস্র বাংলা পত্রপত্রিকা ও বই আর ওই বয়সে শোনা রবিঠাকুর, ডিএল রায় ও রজনীকান্তের অজস্র গান নিটোলভাবে স্মৃতিতে ধরে রেখেছিলেন। যখনকার কথা বলছি তখন ওঁর বয়স ৫৭-৫৮, সুযোগ পেলেই উনি মনে-মনে এবং কথায়-কথায় ওঁর ছেলেবেলায়, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে ফিরে যেতেন। স্মৃতির কিছু-কিছু গানও একটু-আধটু গেয়ে দিতেন। আর একবার গাড়িতে দার্জিলিং পাহাড়ে চড়ার সময় গাড়ির সিটের মাথায় তাল ঠুকে-ঠুকে দিব্যি আমার সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে গেয়ে গেলেন তাসের দেশের আট-দশটা গান। আজও কানে ভাসছে ওঁর কী দারুণ ড্রামা করে গাওয়া ‘বাণিজ্যেতে যাবই আমি যাবই’ গানটা।
দার্জিলিং-পর্বটা নিয়ে আরেকটু বলি। দেশে রাগ-অনুরাগ ধারাবাহিক বেরোবার পর আমরা দার্জিলিং গিয়েছিলাম বই করে বার করার আগে গোটা রচনাটির সম্পাদনার জন্য। এছাড়া দেশে প্রকাশিত নানা চিঠির উত্তর লেখার জন্য। উইন্ডামেয়ার হোটেলের দুটি কটেজের একটিতে থাকছিলেন রবিশঙ্কর ও ওঁর সঙ্গিনী কমলা চক্রবর্তী আর অন্যটিতে আমি ও স্ত্রী ইন্দ্রাণী। প্রথমদিন দার্জিলিং পৌঁছতে-পৌঁছতেই বেলা হয়ে গেল, তাই কাজ শুরুর সময় ঠিক হলো পরদিন সকাল। অথচ কিছু একটা কাজ না সেরে ডিনারের অপেক্ষায় থাকতে রাজি নন। তখন ঠিক হলো সন্ধে নামলে গানের আসর বসাবেন ঘরে।
আসর মানে কী? না, সেতার বাজিয়ে গাইবেন কোনো বন্দিশ, তারপর সেই বন্দিশের তালিম দেবেন কমলা ও ইন্দ্রাণীকে। তো যেই বাইরেটা অন্ধকার হলো রবিশঙ্কর একের পর গেয়ে চললেন খাম্বাজ, তিলক শ্যাম ও ইমনে বাঁধা ওঁর অপূর্ব সব গান। শেষে ‘সরস্বতী, সরস্বতী’ বাণীর ইমন গানটা উনি শেখানো শুরু করলেন যতœ করে মোমবাতির আলোয় সাজানো ওঁর কটেজের বসার ঘরে। মাঝে একসময় ট্রেতে করে চা-কফি পরিবেশন করে গেছে ওয়েটার। বসন্তের সন্ধেয় জাঁকিয়ে ঠান্ডা। ঘরের জানলা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে শহরের আলোগুলোকে হাজার-হাজার জোনাকি ঠাহর হচ্ছে। আর ঘরের মধ্যে মৃদু আলোয় গানে বিভোর দুই নারী ও রবিশঙ্কর। আমি শুধু নীরবে শুনছি আর দেখছি। এ এমন এক আনন্দ ও শিহরণ যা একটা গোটা বই লিখেও বুঝিয়ে উঠতে পারব না। রাগ-অনুরাগ বা স্মৃতি বা অন্য রবিশঙ্কর বইগুলো হাতে তুলে পড়তে গেলে আমার এই এক দশা এখন। এরকম অপূর্ব সব স্মৃতি মনে ভিড় করে আসে আর চোখ ভরে জল আসে।
পরের দিনের সকাল-দুপুর কেটে গেল কাজে-কাজে। সন্ধে পড়তেই ফের গান। আর ওই গানের ফাঁকেই রবিশঙ্কর ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, আমরা ডাইনিং হলেই খাব, তবে দেরিতে। ম্যানেজার বুঝলেন একঘর লোকের সঙ্গে খেলে অনেকেই হয়তো এসে আলাপ জুড়তে চাইবে। বললেন, নো প্রবলেম, আপনার সময় হল বিলকুল ফ্রি থাকবে। রবিশঙ্কর ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফের সেতার তুলে নিলেন।
রাতের খাওয়া সারতে-সারতে রহস্যের উন্মোচন হলো। ডেসার্ট শেষ করে, একটু চা ঢেলে কাপে রবিশঙ্কর পরশুরামের গল্প থেকে একেকটা চরিত্র অভিনয় করে দেখাতে লাগলেন। সেইসব কণ্ঠের সংলাপ সেই ধরনের উচ্চারণ ও ধ্বনিতে। আমরা তিনজন হেসে গড়িয়ে পড়ছিলাম – অভিনয়টা এতোই পোক্ত – আর আমি সমানে ভেবে চলেছি, সেই কৈশোরে পড়া রচনার এতসব কী করে মগজে বেঁধে রেখেছেন! খানিক পরে স্মরণে এলো এও যে, কৈশোরে শেখা গান, বাজনার তালিম, কাশী-কলকাতা ক্যালিফোর্নিয়া-প্যারিসের দৈনন্দিনের স্মৃতিও অবলীলায় বয়ে চলেছেন। নয় কি?
যাই হোক, মজাদার গপ্পোসপ্পোর পরে রবিশঙ্করকে পেয়ে বসল ভূতের গল্পে। কয়েকটা ভয়ের গল্প শুনিয়ে আমায় বললেন, তোমার তো ভূতের গল্পের স্টক ভালোই, কিছু শোনাও দেখি। আমি রসিয়ে ভূতের গল্প বলছি আর ওদিকে দেখি, ইন্দ্রাণী ভয়ে সিঁটিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। কারণটা আমাকেই ব্যাখ্যা করতে হলো। বললাম, একে ভীষণ ভূতের ভয় ওর, তার ওপর মাসখানেক আগে গ্রেগরি পেকের ওই ভূতের ছবিটা, মানে ওমেন, দেখে চারগুণ ভয় বেড়েছে। ছবিতে কুকুরের ডাকটা মাথার মধ্যে ঘোরে। রাতে রাস্তায় কুকুরের ডাকেও চমকে যায়।
ভূতের গল্প শেষেও অনেক রাত অব্দি আমরা ডাইনিং হলে বসে রাতের পাহাড় দেখলাম। তারপর নিজেদের কটেজে গিয়ে লেপ-কম্বলের মধ্যে ঢুকেও পড়লাম। নিদ্রার একটা ঝোঁক সবে এসেছে হঠাৎ ইন্দ্রাণী আমায় ঠেলে জাগিয়ে বলছে শুনি, অ্যাই, শোনো, শোনো, ফের সেই কুকুর ডাকছে। এখানেও কি কুকুর ঘুরে বেড়ায় নাকি?
অগত্যা আমি উঠে কুকুর সামলাতে দরজা খুলে কী দেখি? না, কমলদিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কটেজের দরজার গায়ে দাঁড়িয়ে অবিকল কুকুরের ডাক ছেড়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিখ্যাত রবিশঙ্কর! সে-দৃশ্য দেখে আমি হাসব না কাঁদব জানি না, উনি তখনো ভূতের ছবিমার্কা কুকুরের ডাক করে যাচ্ছেন – হাউউউউউ! হুইউউউউউ! হাউ হাউ হাউ!
এই আনন্দময় পুরুষটির চোখেও জল চিকচিক করতে দেখেছি লন্ডনে যখন স্ত্রী অন্নপূর্ণার প্রসঙ্গ প্রথম উঠল। দেখেছি কলকাতার কেনিলওয়র্থ হোটেলে এক দুপুরে মা হেমাঙ্গিনী দেবীর জীবন বর্ণনা করছেন। ‘বেণী মাধবের ধ্বজা থেকে আইফেল টাওয়ার’ শীর্ষক এক স্মৃতিচারণায় কাশীর সেই বাল্যকাল ধরা আছে। অনেক বারই, নানা প্রসঙ্গে, মায়ের কথা ঘুরেফিরে এসেছে। প্রতিবারই ওঁর মধ্যে এক আর্তবালকের ভাব ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। তাতে একটা ধারণাও একটু-একটু করে দানা বেঁধেছে। তা হলো, রবিশঙ্করের সমস্ত শক্তি ও বড় হওয়ার আকাক্সক্ষার উৎস মায়ের এইসব স্মৃতি। পিতৃদেব শ্যামশঙ্কর চৌধুরীকে তাঁর মেধা, পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্বের জন্য অপার শ্রদ্ধা করতেন ঠিকই, কিন্তু মাকে ছেড়ে গিয়ে বিলেতে মেম বিয়ে করার জন্য ভেতরে-ভেতরে একটা anti-father feeling-ও তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই বাল্য থেকেই। আর ভুলতে পারেননি বম্বের জাহাজ-ডকে মাকে শেষবারের মতো দেখা। দাদার ট্রুপের সঙ্গে জাহাজে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে বালক রবি, আর চোখে চশমা আর ঢাকাই শাড়ি পরে ডকে দাঁড়িয়ে হাত নেড়েই চলেছেন মা।
রবিশঙ্করের এই স্মৃতি রেকর্ড করার কিছুদিন পর লন্ডনে গিয়েছিলাম ওখানে রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সব অনুষ্ঠান রিপোর্ট করতে। যাওয়ার কদিন বাদে শুনলাম রবিশঙ্করও নাকি লন্ডনের বেলি’জ হোটেলে এসে উঠেছেন দিন-কয়েকের জন্যে। তো এক সকালে ফোন করলাম হোটেলে। ওদিক সেই চিরাচরিত øেহদ্রব কণ্ঠ, কী গো খোকা, অ্যাদ্দিনে মনে পড়ল? সত্বর প্রতিবাদ করলাম, তা কেন রবুদা, আমি কালকে মাত্র জানলাম আপনি বেলি’জ-এ উঠেছেন। আজ আসব কি? উত্তর এলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাজ শেষ হলেই চলে এসো। আমি আছি।
সকালে একটা কাজ সত্যি ছিল। সেটা শেষ হতেই লন্ডনের বন্ধু নিশীথ গাঙ্গুলি, কলকাতা থেকে আসা বন্ধু শঙ্কর ও ওঁর নৃত্যশিল্পী স্ত্রী অঞ্জনা এবং লন্ডনে যে-বন্ধুর বাড়িতে আছি সেই বিবিসি রেডিওতে কর্মরত মানসী বড়–য়াকে নিয়ে দেখা করতে গেলাম বেলি’জ-এ। শুধু যাওয়ার সময়টাতেই গণ্ডগোল। ঠিক যখন রবুদা দুপুরের বিশ্রাম নিচ্ছেন! আমার ফোনেই বেচারির ঘুম ভাঙল, জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ঘরে চলে এসো।
দলবল দেখে একেবারেই ঘাবড়ালেন না। বরং ঢিপ-ঢিপ করে সবার প্রণামপর্ব শেষ হতে মানসীকে বললেন, কেটলি চা চিনি দুধ সব আছে, একটু চা করে খাওয়াবে সবাইকে। মানসী তো বলামাত্র চা বানানো শুরু করল, রবিশঙ্কর আমাকে পাশে বসিয়ে কাঁধে হাত রেখে গলা নামিয়ে বললেন, আজ তোমার ওপর একটু রাগ করেছি!
রাগ? কেন? কী করলাম আমি? দেরিতে ওঁর খোঁজ নিয়েছি বলে? নাকি অসময়ে…
মনের কথাগুলো বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিলাম, উনি আমাকে কথার মধ্যে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ঘুম ভাঙানোর জন্যই, তবে আসলে কেন জানো তো?
জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
বললেন, বহুদিন পর মাকে স্বপ্নে দেখছিলাম। ছোটবেলার সেই কাশীতেই। মা আমাকে আদর করে কীসব বলছিলেন।
জানতে চাইলাম, কী বলছিলেন?
– সেটাই তো জানা হলো না। তোমার ফোন এসে সব মাটি করে দিলো।
বলা বাহুল্য, এক ভীষণ লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম তখন। শুধু বলতে পেরেছিলাম ফিসফিস করে, স্যরি! ভেরি স্যরি!
আমাদের বিয়ের আগে রবিশঙ্কর একবার কলকাতায় এসেছিলেন। বললেন, তুমি তো দুনিয়ার লেট লতিফ। বিয়েতে সময়মতো পৌঁছতে পারবে তো? তবে আমি তো আর বিয়েতে থাকতে পারছি না, তাই আগে একদিন গিয়ে আশীর্বাদ করে আসবখন।
এলেন। আশীর্বাদ করলেন। তারপর মুড়িঘণ্টর ডাল, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, কচি পাঁঠার মাংস দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারতে সারতে বললেন, দক্ষিণেশ্বরে একবার মায়ের দর্শন নিতে যাব। যাবে?
আমরা গিয়েওছিলাম সবাই একসঙ্গে এক সকালে। সেই থেকে সেদিনের দৃশ্যগুলো সিনেমার মতো মনের মধ্যে ঘোরে। চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়েছিলেন রবুদা মায়ের প্রতিমা আর ঠাকুরের খাটের সামনে। তারপর একসময় ঠাকুরের ঘরের দোরগোড়ায় হাত ঠেকিয়ে বহুক্ষণ নীরব হয়ে বসলেন। ওঁর সেই ধ্যানভঙ্গির এক সুন্দর ফটো তুলেছিল আলোকচিত্রী অলোক মিত্র। আর ওঁর ওই দক্ষিণেশ্বর-মুগ্ধতা দেখে ‘জলসাঘর’ সংগীত সংস্থার রবিন পাল তখনই মনে হয় মনস্থ করেন মন্দিরের ওই বিস্তীর্ণ উঠোনে শিল্পীর সেতারের আসর বসাবেন। এক-দু বছরের মধ্যেই এক দোলসন্ধ্যায় রবিশঙ্করের অনুষ্ঠান হয়েছিল ওই চাতালেই। শিল্পী সেদিন হাজার-হাজার শ্রোতার জন্য বাজিয়েছিলেন রাগ বসন্ত। আকাশে তখন টকটক করছে বসন্ত পূর্ণিমার চাঁদ আর মায়ের সেবায় রবিশঙ্কর বাজাচ্ছেন বসন্ত পঞ্চম, আদি বসন্ত, বসন্ত মুখারি!
শেষ করার আগে আরেকবার ফিরে যাব লন্ডনের দুটো স্মৃতিতে। প্রথমটার সঙ্গে রবিশঙ্করের মেধার সম্পর্ক, দ্বিতীয়টির সঙ্গে হৃদয়ের। প্রথম স্মৃতি ওঁর বই পড়া ও চিন্তার ব্যাপার নিয়ে। আমাদের কাজ চলছিল রাগ-অনুরাগ নিয়ে। একদিন একটু বেশি তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়েছিলাম ওঁর চেলসি ক্লয়েস্টার্স হোটেল অ্যাপার্টমেন্টে। আমায় দেখেই বললেন, আমি চান করতে যাচ্ছি, তুমি টাইমের এই স্টোরিটা একটু পড়ে ফেলো তো। পরে কথা হবে।
টাইম ম্যাগাজিনের স্টোরি মানে সদ্য বিশ্বের নজরে আসা, তখনো তরুণ, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে নিয়ে দুপাতা জোড়া দারুণ একটা আলোচনা। কৃষ্ণগহবর নিয়ে ওঁর তত্ত্ব, সেই সব ব্ল্যাকহোল থেকে বিকীর্ণ আলো, যাকে বলা হচ্ছে হকিং রেডিয়েশন ইত্যাদির সমাহারে তরুণ বিজ্ঞানীর এক আকর্ষক পরিচিতি। হকিংয়ের নামের সঙ্গেও কোনো পরিচয় ছিল না তার আগে, তাই গোগ্রাসে গিললাম লেখাটা এবং শরীরের বাধা ভেদ করে বিজ্ঞানীর ওই বৌদ্ধিক অভিযানের বৃত্তান্তে বুঁদ হয়ে পড়লাম। তারপর আর পাতা ওলটাতে পারছি না, চুপ মেরে বসে আছি। হঠাৎ পিঠে একটা হাত আর পাশ থেকে ধ্বনি, কী খোকা, ভাবতে পারো এমন একটা কীর্তিমান লোক? আমি চমকে ঘুরে দেখি রবিশঙ্কর। তারপর সামনে এসে বসে বললেন, কে বলে ইংরেজরা ফুরিয়ে গেছে? ঠিক-ঠিক সময়ে একটা না একটা প্রতিভা এরা বার করে আনবেই।
আস্তে আস্তে হকিংয়ের ব্রহ্মাণ্ডচিন্তা থেকে রবুদা পৌঁছে গেলেন স্বর, নাদ এবং ওঁ-এ। বললেন, শাস্ত্রে বলছে ওই ওঁ-এর মধ্যেই বিশ্বজগৎ ধরা, ওখানেই উৎপত্তি, ওখানেই শেষ। সে মিউজিক অব দ্য স্ফিয়ার্স বলো, চাই বিগ ব্যাং! এর কিছু পর রবিশঙ্কর ওঁ কী করে ধ্বনিত করতে হয় দেখাতে লাগলেন উচ্চারণ করে করে, নাভি থেকে শ্বাস টেনে-টেনে। বললেন, বাঙালিরা ওঁ-কে ওং উচ্চারণ ক’রে, তাতে ধ্বনির পুরো চেহারাটা আসে না। সংস্কৃত ধ্বনিটা অলো অউম্… তারপর যতক্ষণ বুকে টানতে পারো। দেখবে ভেতর থেকে একটা ভাইব্রেশন তৈরি হচ্ছে। আলাপে, ধ্র“পদে এই ধ্বনির আন্দোলন কাজ করে সুর প্রতিষ্ঠায়।… এরপর – আমার কী সৌভাগ্য! – রবিশঙ্কর ললিতের আলাপ গাইতে লাগলেন। আমি আরো একবার বুঁদ হয়ে পড়লাম।
দ্বিতীয় স্মৃতিটার সঙ্গে ওঁর দাদা উদয়শঙ্করের স্মৃতিজড়িত। দাদা চার দিন আগে প্রয়াত হয়েছেন, সেই দাদাকে নিয়ে ‘আমার দাদা’ শিরোনামে অপূর্ব লেখা লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। আমি সেদিনের দুকপি কাগজ নিয়ে ওঁর কাছে গেছি। উনি মস্ত মনোযোগে নিজের লেখা এবং দাদাসংক্রান্ত সমস্ত খবর পড়লেন, তারপর চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। শেষে কীরকম এক উদাস দৃষ্টিতে বললেন, হায়, হায়, কলকাতার মতো এরকম গ্র্যান্ড ফেয়ারওয়েল আর কোনো শহর দিতে পারত?
আমি বললাম, না, এর চেয়ে ভালো শেষযাত্রা হয় না।
তখন আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়ে বললেন, তাহলে কলকাতাতেই মারা যাওয়াই ভালো হবে, কী বলো? এতো ভালোবাসা নিয়ে চলে যাওয়া!
দুঃখের কথা, এই মহাপুরুষটিকে দেহরক্ষা করতে হলো দূর বিদেশে, দেশবাসীর চোখের আড়ালে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সে-কথা ভেবে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে শুধু শেষ, অশেষ প্রণামটুকুই জানাতে পারছি। ওঁ…
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.