অন্তর্লীন

প্রশান্ত মৃধা

 

দশার মন্ত্রের পরে ছেলে এই ঘরে এলো। মু–ত মস্তক, এভাবে শরৎচন্দ্রের কোনো একটা চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছিলেন স্কুলের প–ত মশাই। এখন তার ছেলের তাই, মাথা কামানো, ন্যাড়া। মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে কেশ বিসর্জন। অশৌচ পালনের এই শেষ দিন।

পাপ্পু অবশ্য পুলকেশের সামনে এসে দাঁড়ায়নি। নিজের কোনো প্রয়োজনে এসেছে। ফরসা গায়ে আটহাতি খাটো ধুতি-পরা ছেলেকে এ-সময় তার অচেনা লাগে! অথচ, অচেনা লাগার কোনো কারণ নেই। সুস্থ-সবল অরুণিমা দেখতে-দেখতে বিছানপড়তা হওয়ার পরে এই ছেলেই তো এই দুটো বছর মাকে টেনেছে। ডাক্তার বলো, হাসপাতাল বলো, এমনকি কবিরাজ বলো কি বদ্যি বলো আর যদি বলো সাধু-ওঝা, পির-ফকিরের ঝাড়ফুঁক সর্বত্রই সামলেছে পাপ্পু!

পুলকেশ কখনো হাত-পা গুটানো মানুষ নন, কিন্তু ছেলের তৎপরতায় তার  প্রায় করতে হয়নি

কিছু। বরং, পাপ্পুর তৎপরতায় পুলকেশ ভেবেছে, সত্যি অরুণিমা গত জনমে অনেক পুণ্য সঞ্চয় করেছিল, তাই এই জনমে এমন ছেলে পেয়েছে।  এই কথা অবশ্য পুলকেশ একলাই ভাবত না, জ্ঞাতিগুষ্টির মানুষজন, আত্মীয়স্বজন সবাই বলত। এমনকি সদর হাসপাতালের বড়ো ডাক্তারসাহেব একদিন তাকে বলেছিলেন, ‘পুলকেশবাবু, আপনার বড়ো ছেলে প্রণবেশ দারুণ কাজের! ওর মায়ের দিকে যা খেয়াল!’ প্রণবেশ পাপ্পুর কাগজপত্রের নাম। আর সে পুলকেশের বড়ো ছেলে নয়, ছোট ছেলে। বড়ো ছেলে অরুণেশ। অরুণিমার থেকে অরুণেশ, পুলকেশ থেকে প্রণবেশ। বড়োজনের নাম মায়ের নামের কাছাকাছি, ছোটজনেরটা বাপের নামের। একসময়ে অরুণিমা আর পুলকেশ ভাবতও তাই, বড়োজন অরুণিমার ছেলে, ছোটজন পুলকেশের। কিন্তু আজ মায়ের এই মন্ত্রের সময়ে, কি মায়ের শেষযাত্রায় সেই ছেলেটা উপস্থিত থাকতে পারল না। সেসব সামলাল এই পাপ্পু! অবশ্য এই নিয়ে অরুণেশের করারও তো কিছু নেই। ছোটবেলায় তাকে নিয়ে গেছে অরুণিমার ছোটদা, ইন্ডিয়ায়। তখন তো ভেবেছিল, একসময় তারাও চলে যাবে। কিন্তু আজ যাই, কাল যাই, আজ প্রণবেশের বাবা অসুস্থ, কাল মা; প্রণবেশ বড়ো ছেলে, পৈতৃক বাড়ি, ঘরদোর, এই জায়গাজমি রেখে যাওয়া হয়নি। তখন ভেবেছে, পাপ্পু আর একটু বড়ো হলে পাঠিয়ে দেবে। ভেবেছে, একটা গেছে, আর এই একটা আছে চোখের সামনে, এটা গেলে আর থাকল কী? তাছাড়া পুলকেশের মা কোনোভাবে ছোট নাতিকে হাতছাড়া করতে চায়নি। তখন পুলকেশের বাবা মারা গেছে, তার

মায়ের চোখের সামনে এই পাপ্পু। ফলে মায়ের অমতে তাকে ওদেশে পাঠানোর কথা আর ভাবতে পারেনি তারা।

এদিকে তখন মাকে নিয়ে আর অরুণিমা ও পাপ্পুসহ যে পুলকেশ ওদেশে চলে যাবে, সে-সুযোগও তখন আর নেই। পাপ্পু হওয়ার পরপরই অরুণিমা গার্লস স্কুলে স্থায়ী চাকরি পায়। ছেলের বউয়ের এত গুণে পুলকেশের মা বলত, সোনার পিত্তিমা বউ আমার!

একথা পুলকেশের মা কেন, প্রতিবেশী আর আত্মীয়দের কেউ-কেউও বলত। অরুণ হওয়ার সময়েও অরুণিমা বেশ রোগা; কিন্তু উজ্জ্বল ফরসা গায়ের রং আর বড়ো দুটো চোখ ও খাড়া নাকটার জন্যে সহজেই চোখে পড়ত। কিন্তু সোনার প্রতিমা নিশ্চিত কেউ বলত না। এমনকি রংঢং করে পুলকেশের ভাইয়েরা কেউ একবারও রেখা কিংবা শ্রীদেবীও বলত না। বড়জোর শাবানা বলতে পারত। গ্রামে তখন সবে ভিসিআর ঢুকেছে, কেউ-কেউ ইন্ডিয়ায় গেলে হিন্দি ‘বই’ দেখে এসে নায়িকাদের নানান ছলাকলার গল্প বলত, দেওর-ননদদের সেই গল্পে পুলকেশের মায়ের এই সোনার পিত্তিমা পুত্রের বউয়ের চেহারা নিয়ে কোনো প্রকার উচ্ছ্বাসের কথা মনে পড়ে না পুলকেশের।

কিন্তু সেই পাপ্পু পেটে এলে, ধীরে শরীর ভারি হলো অরুণিমার, একটু মোটাও হলো, কোটরে ডুবে থাকা চোখদুটো একটু ভেসে উঠল, মুখখানা আরো ভরে গেল, তখন সেই আশ্বিন মাসে অরুণিমার দিকে তাকিয়ে পড়লে, কুচিবগার বারোয়ারি কোলার দুর্গাপ্রতিমার থেকে চোখ ফেরানো গেলেও অরুণিমার থেকে নজর সরাতে পারত না পুলকেশ। আর তখনই তার ডিগ্রি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে পাশ করবে একথা ভাবেনি কেউ। অরুণকে টেনেটুনে, পেলেপুষে কখনো শাশুড়ির কাছে দিয়ে যতটুকু পড়াশোনা, তবু এর ভেতরে, পুলকেশ বলত, ‘দেও, যা হয় হবে, আর নয় সামনের বার!’ তাতেও অরুণিমা প্রায়শ কোনো খেদ প্রকাশ করত না, যেন শাশুড়ি না-শোনে এমন চাপা গলায় বলত, ‘এহোন একজন, সামনের বার দুইজন, ‘মোশায় কতা যে এক একটা কও কোনো হিসাব থাহে!’ পুলকেশের মুখজোড়া হাসি, পানের রসে ঠোঁট রাঙানো। সেই হাসিতে যেন আরো খেপে উঠত অরুণিমা, ‘যাও এহেন দে, সামনে যাও, পড়তি দেও। ছওয়ালডা ঘুমতিচে, এই সুযোগে এট্টু রিভাইজ দিয়েনি। ওনার আছে খালি হাস। হাইসে দুনিয়া উদ্ধার… বাদানোর সময় কোনো খেয়াল থাহে না?’ এও নিচু গলায়। সন্তানসন্ততি শত সাধনার ধন। শাশুড়ি শুনলে গলা উঁচু করে ঝাড়বে। মানুষ শতচেষ্টায়ও পায় না। দেবতার কাছে দুচোখের জল ছেড়ে কাঁদে কতজন তবু মেলে না, যদি একদিন যেত সে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি কি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে, তাহলে দেখতে পারত কী অবস্থা!

কিন্তু অরুণিমার ওই নিচুগলার কথায় কি আর পুলকেশের হাসি থামে। হাসির আরেক কারণ, অরুণিমার দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। তবু, এই কথায় একটা অন্তত সান্তবনা দেওয়া লাগে, অন্তত বোঝানো লাগে, তারও বোধ-বিবেচনা কিছু আছে। শুধু হেসে আর টরে সিটের পাতলা ফিনফিনে জামা বানিয়ে, তাতে আচ্ছাসে ক্রিচ ফেলে গায়ে দিয়ে ঘুরে সে জীবন পার করছে না। বরং, বউয়ের যাতে ভালো হয়, সে যেন লেখাপড়াটা ঠিকঠাক মতন করতে পারে, সেদিকেও কিছু বিবেচনা তার আছে। তাই, অমন মুহূর্তে দ্বাদশীর চাঁদের মতন প্রায় গোল হয়ে আসা অরুণিমার মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘রেডিয়ো সারাদিন কানের ধারে কয় – ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তান যথেষ্ট! আমাগো এই দুইজনেই সই! কী কও!’ এবার অরুণিমার অস্ফুট হাসির পালা, ‘হইচে এহোন যাও। পড়তি দেও। মা শুনলি ছাড়াইয়ে দেবেনে তোমার ফেমিলি পস্নানিং!’

সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে ডিগ্রি পাশ করল অরুণিমা। তার কিছুদিন আগে জন্ম পাপ্পুর। আর সেবার দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন দিয়ে পাল-ভাস্কর কালীপ্রতিমা গড়তে না গড়তে এই ঘটনা ঘটায় পুলকেশের মা তো বলতেই পারে, বউ তাদের সোনার পিত্তিমা! তা সত্যি! সে-ই সোনায় সোহাগা হয়ে দেখা দিলো আরো কিছুদিন বাদে। যখন স্থানীয় গার্লস স্কুলে চাকরি হয়ে গেল অরুণিমার! আসলে, পুলকেশের মনে হতো, এখনো মনে হয়, দারুণ মাথাশক্তি ছিল অরুণিমার। অরুণেশ মায়ের এই গুণটা পেয়েছে ষোলো আনা। ওদেশে একলা থাকল। একলা বলতে সেই ছোটবেলার পর আর বাপ-মায়ের কাছে থাকল কদিন। সেখানে স্কুল ফাইনালে ফার্স্ট ডিভিশন, হায়ার সেকেন্ডারিতেও তাই, তারপর কোথায় কটকে না কোথায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ল, এখন ব্যাঙ্গালুরুর ওদিকে চাকরি করে। ওই মাথাশক্তির জন্যেই ছেলেটা সারাটা জীবন কোন দূর-দূর দেশে থাকল। একবার আসল বিছানপড়তা মাকে দেখতে। তাও মাত্র কয়দিনের জন্যে। তারপর যাওয়ার সময় বুঝে গেল, আর কোনোদিন হয়তো তার আর মাকে দেখা হবে না। তখনো অরুণিমা উঠতে পারে, উঠে বসে দুটো ভালো-মন্দ কথা কইতে পারে। সেই অরুণেশ থাকার দিনগুলোতে কতবার উঠতে চেষ্টা করেছে ছেলেকে নারকেলপাতায় চিংড়ির বড়া খাওয়াবে। শেষবার ইন্ডিয়ায় যাওয়ার আগে অরুণেশ নাকি বলেছিল চিংড়ির বড়া রান্না করতে। সে-দৃশ্য আজো চোখে ভাসে অরুণিমার। কাঁঠালি চিংড়ির বড়া তার সামনে খাইছে ছেলে। এবার তার শরীরে সেই শক্তি নেই। এখন আছে সে-বাবদ চোখের জল ফেলানো। চোখের জল ছেড়ে দিয়ে পাপ্পুর সামনে সে-কথা বলেছে অরুণিমা। চাপা নিচু স্বরে, যেন কোনোভাবেই অরুণেশ না শোনে। ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বিবেচনাবোধ সম্পর্কে ভালোই ধারণা অরুণিমার। শুধু অরুণিমার কেন, পুলকেশেরও। জানত, যদি বড়ো ছেলে শুনতে পায় তাহলে আর রক্ষা নেই। কী বলবে তাও জানা আছে তাদের। সে কি ওই পাতায় ভাজা মাছ খাওয়ার জন্য এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে? এসেছে মাকে দেখতে। সেখানে তার এই সবই অর্থহীন!

যদিও পাপ্পু থাকতে এই বিষয়ে কোনো চিন্তা তাদের করা সত্যি অপ্রয়োজনীয়। সে-কথা অরুণিমাকে নিচুগলায় বলেছিল ছেলেটা। শুধু পুলকেশ যেন হাট বা বাগেরহাট বাজার থেকে এনে দেয় কাঁঠালি চিংড়ি, তাহলেই কীভাবে মায়ের মতো করে রান্না করতে হয়, তা তার ভালোই জানা আছে। ঘটেছিল তাই। মোটামুটি সাইজের, পেটে তেমন ডিম নেই কিছু কাঁঠালি চিংড়ি জোগাড় করেছিল পুলকেশ। পাপ্পু রান্নায় ওস্তাদ। তারা জানত, ও ছেলে পারবে। সে একেবারে অরুণিমার মতো করেই রান্না করেছিল। কিন্তু মায়ের মন, নিজে রান্না করতে পারল না। তবু যেটা কখনো ঘটে না, তা-ই পাপ্পুকে বলেছিল অরুণিমা, অরুণের ভাত তার সামনে দিতে। অরুণ খাবে, সে দেখবে। তবু নিজহাতে রান্না করে ছেলেকে খাওয়াতে না পারার আফসোস অরুণিমার কোনোদিনও যায়নি। চোখের জল ছেড়ে দিয়ে এরপরও ওই গান গেয়েছে। তখন সেই দৃশ্য পুলকেশের কাছে যেন মা দুর্গার চোখে জল!

কিন্তু অরুণিমার যাওয়ার দিনটা যদি ছেলেটা থাকত। কী করা, থাকবে কীভাবে। তবু বড়ো ছেলে। পুলকেশের আফসোস যায় না কোনোভাবে। কিন্তু তাঁর আগে, এ সবকিছুর আগে তার মনে হয়,  অরুণিমার যাওয়া লাগল কী জন্যে। একটা ছেলেরও বউ দেখে দেখে যেতে পারল না। কত ইচ্ছা ছিল, তারা তিনজন মিলে যাবে ওদেশে অরুণেশের বিয়ের সময়। অরুণিমার ছোটদাকে বলেছিল মেয়ে দেখতে। আগে তো চিঠি চালাচালি ছিল, আজকাল সব ফোনে, বিছানপড়তা অবস্থায়ও কতদিন অরুণিমা তার ছোটদার সঙ্গে কথা বলেছে। তখনো কি পুলকেশ জানত, এসব কথা শুধু কথার কথাই হয়ে থাকবে, অরুণিমা দেখে যেতে পারবে না কিছুই। এমন রোগে পড়েছে যার চিকিৎসা নেই। ধীরে-ধীরে শুকিয়ে একদিন বিছানার সঙ্গে মিশে সোজা খালকূলে শ্মশানে গিয়ে উঠবে!

পাপ্পু সামনে থেকে সরে গেল, পুলকেশের মনে হয়, একবার গিয়ে দেখে, ছেলে কেন এখানে হঠাৎ এসেছিল। তারপর কী মনে করে গেল না। বসে থাকল এই ভেতরের ঘরের খাটে পা ঝুলিয়ে। অরুণিমার আজ পর্যন্ত সব কাজ ঠিকঠাকমতো হয়েছে। পাপ্পু কোনো কিছুই বাকি রাখেনি। আজকে আত্মীয়-বান্ধব-প্রতিবেশীসহ জ্ঞাতিগুষ্টির লোকজন যারা আসবে, তাদের চিড়ে-কলা-দই খাওয়ানোও ছেলে কোন ফাঁকে তদারকি করছে। পুলকেশের কাছে বসা তার দুই মামাতো-পিসাতো

ভাইকে এসে এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করে গেছে, তারা চা খাবে কিনা! তারপর আবার চলে গেছে। একটু বাদে এসে এই ঘর থেকে
পেছনে-লাগোয়া রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে তারপর এসে জানতে চেয়েছে, কে কে চায়ে চিনি খাবে, কে খাবে না, আর পুলকেশকে এখন আবার চা দেবে কি না। পুলকেশ বোঝে, ছেলে চায় বাপ তার ভাইদের সঙ্গে আলাপে-আড্ডায় থাকুক। তাতে অন্তত একটু চাঙ্গা থাকবে। কিন্তু পুলকেশ জানে, বোঝে সে যথেষ্টই চাঙ্গা আছে। মৃত্যুর মতো সত্য এই দুনিয়ায় আর নেই। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কে কোথা কবে?’ কবির এই অমর বাণী তার জানা। ভাগবৎ পাঠের আসরে কিংবা গীতার দুই-একটা অধ্যায় পাঠ তো তার শোনা আছে। সেই মৃত্যুর অন্ধকারে লীন হয়ে গেছে তার অরুণিমা। এ তো বাস্তব সত্য। তিলে-তিলে সেই মৃত্যু। প্রতিদিন একটু-একটু করে এগিয়ে যাওয়া। সে-কথা কলকাতার ডাক্তার ফিরিয়ে দেওয়ার পর, সে আর তার দুই ছেলে অরুণেশ আর প্রণবেশের কাছে চরম সত্য হয়ে উঠেছিল। তারা জানত, এই দিন আসবে। পৃথিবী থাকবে পৃথিবীর মতো, এই দুনিয়াদারিতে প্রতিদিন সূর্য ওঠে, সেভাবেই উঠবে তার পরের দিন, এমনকি সে যখন থাকবে না, সেদিনও। সেই দিনটির দিকে অরুণিমার প্রতিটি দিন একটু-একটু করে এগিয়ে যাওয়া তো তাদের মেনে নেওয়া। তার মেনে নেওয়া, পাপ্পুর মেনে নেওয়া, গুষ্টির লোকজনের প্রস্ত্ততি নেওয়া। এমনকি বড়োসড়ো মানুষটা শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে যাওয়ায় তার ভাইপোরা কেউ-কেউ অরুণিমাকে পোড়াতে কোন আমগাছটা কাটতে হবে, তাতে তাদের খুড়ি বা জেঠি ঠিকঠাক পুড়বে কি-না, তা নিয়েও হিসাব করেছে। সে হিসাবে এই মৃত্যু তো কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়।

কিন্তু কোত্থেকে পুলকেশের মনে উড়ে আসে সেই কথা, মৃত্যু যত ধ্রম্নবই হোক, তাদের পূর্বপ্রস্ত্ততির অংশই হোক, তবু আকস্মিক হওয়াই যেন ছিল ভালো। তাহলে যে অরুণিমা থাকত তার চোখের সামনে, সে সেই প্রতিমা! তা না, ধীরে-ধীরে মানুষ ক্ষয়ে গেল, তাকে অসহায় করে দিয়ে গেল, নিঃস্ব করে দিয়ে গেল, ছেলেটাকে দুই বছর ভোগাল, পাশ করার পর কোথাও চাকরির জন্যে চেষ্টা করতে পারেনি। না পারুক, জোয়ান ছেলে, জলেখালে পড়ার কোনো কারণ নেই, তা দেখে গেছে। কিন্তু তাদের সামনে থেকে যে-মানুষটা চলে গেল, সে-মানুষটাকে তো কোনোভাবেই মনে রাখতে চায়নি পুলকেশ!

চায়ে ছোট্ট চুমুক দিয়ে পুলকেশের মামাতো ভাই ধনঞ্জয় বলে, ‘বোঝল না বড়দা, তোমার এই ছোডো ছ’লডার গুণের কোনো অন্ত নেই -’

‘হয় ভাইডি। ও ছেলো বইলেই বাঁইচে রইচি -’

পুলকেশের কথা শেষ হওয়ার আগে ধনঞ্জয় রান্নাঘরের দিকে হাঁক দেয়, ‘রান্নাঘরে কারে টের পায়, এট্টু চিনি নিয়ে আয়?’

সেখানে পাপ্পু ছিল। সে জানতে চায়, ‘ও কা, কী লাগবে?’

‘এট্টু চিনি দে। চা বানাইচো ফাইন, কিন্তু বাবিচিস আমি মনে হয় তোর বাবার মতন চিনি কোম খাই -’

পাপ্পু একটা চামচে চিনি আনতে-আনতে বলে, ‘র-চার আবার ভালো মন্দ কী কাকা? এয়া বানালিই হয়।’

ধনঞ্জয় বলে, ‘হয়, সবাই পারে নিকি? আমারে দিয়ে সারাজীবনেও হলো না। আমি বানালি হয় পানসে হবে আর নয় কড়া।’

পুলকেশ ধনঞ্জয়ের সঙ্গে পাপ্পুর আলাপ শোনে। তার ডান দিকে চেয়ারে বসা পিসতুতো ভাই নিখিলের চুপচাপ বসে থাকা দেখে। পাপ্পু একবার নিখিলের দিকে তাকিয়েছে, তার চিনি কম বেশি হয়েছে কি-না, সেই ইঙ্গিত করে। আর এর ভেতরে থেকেও পুলকেশ যে এই চা খেতে-খেতে পুরো ঘটনার বাইরে চলে গেছে, তা বোঝা যায়, যখন এই একই সময়ে পাপ্পু, ধনঞ্জয় আর নিখিল কথা বলছে, কিন্তু পুলকেশ যেন এর ভেতরে নেই। অথবা, আছে কিন্তু এই মুহূর্তে সে এখান থেকে সরে গেছিল। যদিও তাই মুহূর্তে হয়তো স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক। পুলকেশ জানে না।

যেমন, এইমাত্র ধনঞ্জয় অজ্ঞাতে পুলকেশকে সেখানে নিয়ে গেল। অথবা, ধনঞ্জয় তো এর কিছুই জানে না, এটা তার পিসিবাড়ি, এখানে সে কদিনই-বা এসেছে। যদি জানত, এই যে ধনঞ্জয় যেমন চায়ে চিনি চাইল, এমন হয়েছে এই বাড়িতে চা ঢোকার পরে, এমন রংচায়ে পুলকেশের বাবা চুমুক দিয়ে অরুণিমার উদ্দেশে হাঁক দিত, ‘কী রায়ের ঝি, তোমার বাবার বাড়ির দেশে চিনিটিনি কোম নাকি?’

পুলকেশের বাবার এই রায়ের ঝি ডাকটার অর্থ হলো, আবদার। তখন তার স্নেহ ঝরে পড়ছে। একই কথা বলত, ‘চা বানাইচো ফাইন, খালি এট্টু চিনি কম!’ অরুণিমা একটা চা-চামচে চিনি নিয়ে শ্বশুরের দিকে এগিয়ে আসত। যদি এমন আবদারের প্রসঙ্গ না আসত তাহলে পুলকেশের বাবা অরুণিমাকে বউমা ডাকত। এই আবদারের কারণও ওই, পুলকেশের বাবা চায়ে বেশি চিনি পছন্দ করত, আর অরুণিমা চাইত শ্বশুরের চায়ের কাপে চিনি কম দিতে।

এখন একমাত্র পুলকেশ ছাড়া বাকি সবার অজ্ঞাতে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। কেউ জানল, তাতে পুলকেশ এই জায়গা থেকে সরে পুরো ঘটনায় আবার অরুণিমার কাছে পৌঁছে গেল। ওদিকে পাপ্পু এই পেছনের ঘর থেকে মাঝখানের বড়ো ঘর, তারপর সামনের বারান্দা হয়ে উঠোনের দিকে গেলে, ধনঞ্জয় বলে, ‘বড়দা, তুমি কথার মাঝখানে কোতায় হারাইয়ে যাও?’

এ-কথায় চট করে এখানে ফেরেনি পুলকেশ, এমনিতেই সে এখানেই ছিল। যদিও কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না, সে এখানেই ছিল, এই সমস্ত কিছুর ভেতরেই, আবার এখান থেকে হঠাৎ একটু বাইরে অন্যত্র, অরুণিমার কাছাকাছি অথবা অরুণিমাকে নিয়ে ভাবনায় অন্যত্র চলে গিয়েছিল। এটা কি অন্যত্র যাওয়া বলে? হারিয়ে যাওয়া মোটেও নয়। সব কথাই শুনছিল সে। তাছাড়া, এই বিষয়ে এখন আর অত শোকতাপ নেই তার। এক প্রকার আয়োজনের ভেতর দিয়েই চলে গেছে অরুণিমা। দিনে-দিনে তিলে-তিলে, তাদের প্রত্যেককে তৈরি করে, তারপরে। এমনকি পাপ্পুর কাছ থেকে বিদায়ও নিয়ে, নিজের কাছে বসিয়ে অরুণেশকে ভাত খাইয়ে, যদিও সেই ভাত-মাছ কোনোটাই তার রান্না করা নয়, তবু অমন আনন্দের চোখে কেনোদিন অরুণেশের খাওয়ার দিকে সত্যি তাকায়নি অরুণিমা। সেই দৃশ্যটা কেন যে বারবার চোখে ভাসে পুলকেশের, সে জানে না। ছেলেটা আজ ব্যাঙ্গালুরুতে কী করছে? দশার মন্ত্র পড়েছে তো? একবার ভেবেছে পাপ্পুকে ফোন করতে বলবে। পাপ্পু ফোন করলে অরুণ কেটে দিয়ে ব্যাক করবে। তখন জানতে চাইবে। সবকিছু ঠিকঠাক করেছে কি-না। শুনেছে ওখানে খুঁজলে বাঙালি পাবে। আবার এও ভেবেছে, না, এসব কিছুই সে ছেলের কাছে জানতে চাইবে না। শুধু শুনবে ভালো আছে তো। আহা, মা মরা দুটো ভাই। একজনের সামনে তবু বাপ আছে, অন্যজন কোন বিদেশবিভুঁয়ে কোন রাজ্যে!

এ-মুহূর্তে অরুণেশ কেমন আছে, কোথায় আছে, কী করছে, এই সমস্ত যে ভাবল, তাতেও পুলকেশ আর তার বড়ো ছেলের মাঝখানে অরুণিমা উপস্থিত। অজ্ঞাতে সেখান থেকে সরে আসতে পুলকেশ ধনঞ্জয় আর নিখিলের কথায় ফেরে। ধনঞ্জয় যে জানতে চেয়েছে, সে-কথার মাঝখানে কোথায় হারায়, তার উত্তরে বলে, ‘হারাব কোথায়? তোগো সামনে বইসে রইচি। সে-জায়গাদে আর গেলাম কোথায়?’

নিখিল চকিতে পুলকেশের মুখের দিকে তাকায়। বাইরে রোদ,  পেছনের গাছের পাতায় রোদের ঝিলিক, সেই আলোর ঝলকানি এই ঘরে কিছুটা হলেও ঢোকে। আর, তাতে এই কথাটা বলা মাত্র এমন তীব্র আলোয় পুলকেশের খুব ফরসা মুখখানা বিষাদে ভরে গেল। নিখিল তা ভাবে না। একবারই তাকিয়ে তারপর অপেক্ষা করে এরপর পুলকেশ আর কিছু বলে কি-না। কিন্তু ধনঞ্জয় বড়ো বেশি কথা বলে। কোনো কথা মাটিতে ফেলতে দেয় না। প্রতিটি কথার পিঠেই নিজের কথা বলে সে। যেমন এইমাত্র পুলকেশের গলার

হতাশা আর মুখের বিষাদ কোনো কিছুই সে লক্ষ করেনি। নইলে বলে, ‘কোতায় হারাও সে তুমিই জানো। আগে তোমার ধারে বসলি একলা মাতাইয়ে রাখতা সারাবাড়ি।’

নিখিলের মনে হয়, এ-কথায় হয়তো পুলকেশকে একটু অন্যদিকে ফেরানো যাবে। সে বলে, ‘হয়, ধনঞ্জয়দা কইচে ঠিকই, আপনি পান এট্টা-এট্টা মুখে দেতেন, আর এডা-ওডা কতো কিছু নিয়ে গল্প করতেন।’

‘আর কইস না ভাইডি’, পুলকেশ জানায়, ‘সেইয়ে নিয়ে তোর বউদি কি আমারে কোমদিন কথা শুনোইচে। কইত, ‘বাপ ঘরে দুইটে ভাত থুইয়ে গেইচে, সেই জন্যি এইরাম ফুলো কথা কইয়ে জীবন কাটাইয়ে দিতি পারলাম!’ ‘ক’ ভাইডি, এই কথা আমারে কওয়া যায়, আমি নাকি কিছু করতাম না?’

আবারো পুলকেশের কথায় অরুণিমা। কিন্তু পুলকেশ অরুণিমার ওই উষ্মার কথাটা এমনভাবে বলল, তাতে নিখিল বা ধনঞ্জয় না হেসে পারল না। এমনকি এর সঙ্গে সে আরো জানায়, ‘কতা তো কইত গলা নিচে রাইখে, কিন্তু সেইয়ের মদ্যি ঠ্যাঁস দিতি ছাড়ত না।’

ধনঞ্জয় গলা তুলে হাসে। নিখিল এদের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট। ধনঞ্জয়ের এমন হাসির কারণ ঠিক বুঝতে পারে না। ধনঞ্জয়ের হাসিতে জোগাল দিয়েছে পুলকেশও। যদিও তা মুহূর্তমাত্র। সেখানে এখন বিষাদ ধরা না পড়লেও, ওই কথার বাকিটুকু আছে, ‘একদিন কয়, আমারে কও মা দুগ্গার মতন দশখান হাত, সেই উছিলায় নিজেরে মনে ভোলানাথ শিবঠাকুর ভাবো, না?’

এই বলে হাসে পুলকেশ। হাসিতে চোখের কোনা খানিকটা কুঁচকে গেল। ছোটদা তুতো ভাইদের সামনে একটু সলজ্জ এই হাসি। তাতে এবার নিখিল কোনো বিষাদ পেল না, কিন্তু অরুণিমাকে হারানোর বেদনা হয়তো আছে। সে নিয়ে কিছু বলবে ভেবেছিল সে, কিন্তু তার আগে ধনঞ্জয় বলে, ‘দুগ্গা প্রতিমা খালি, তার চাইয়েও সুন্দর!’ সে নিখিলকে জানায়, কারণ অরুণিমা আর পুলকেশের যখন বিয়ে হয়েছে নিখিল তখনো হাফপ্যান্ট পরে। তাই নিখিলকে বোঝানোর জন্যে ধনঞ্জয় বলে চলে, ‘নতুন বউ হইয়ে আসার পর পিসিবাড়ি আইসে বউদির সঙ্গে কত রাজ্যের ইয়ার্কি মারছি!’

‘তাই নাকি?’ নিখিল বলে, ‘দেইহে তো মনে হত বউদি কোনো ইয়ার্কি-টিয়ার্কি জানত না!’

‘ও তো তোগো সাতে। আমাগো সাতে কতায় রস ছেলো।’

‘ওরে সেয়া ছেল, মানুষটা সুন্দর মুখের কতাও ছেল সুন্দর। আমাগো এই বাড়িঘরের কেউর সাতে কোনোদিনও গলা উঁচু করে কতা কইনি। কিষান কও, হাইলে কও সবার সাতে ভালো ব্যবহার করত। ছাত্রীরা কত ভালোবাসত।’ এবার নিখিলের উদ্দেশে বলে পুলকেশ, ‘তোর ছোটবুন, আমাগো নিভা তো -’

নিখিল বলে, ‘হয়,  নিভা তো সারাডা জীবন বউদির পড়ানোর কতা কয়। ওরে যখন মোবাইলে সংবাদটা দেলাম, কী কান্না যে কান্দল। ঢাকায় রইচে আসতে পারবে না, তোমারে কইতে কইচে। পাপ্পুরে যেন এট্টু বুজোইয়ে কই… ’

যদিও নিখিলই চাইছিল অরুণিমার প্রসঙ্গ থেকে পুলকেশকে দূরে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু এখন নিজের অজ্ঞাতেই সে জড়িয়ে যাচ্ছে, শুধু সে কেন, ধনঞ্জয়ও তো সেই প্রসঙ্গের ভেতরই ঘুরপাক খাচ্ছে।  অথবা, এই মুহূর্তে তাদের পক্ষে অন্য কোনো প্রসঙ্গে যাওয়া অজ্ঞাত কারণে সম্ভব হচ্ছে না। অথবা, তারা জানে না, না চাইলেও ওই প্রসঙ্গই তাদের ঘিরে ধরছে বারবার।

এ-সময় আবার পাপ্পু আসে। একবারে আসেনি। দরজার বাইরে একটুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল যেন ধনঞ্জয়ের চোখে সে পড়ে। ধনঞ্জয় পাপ্পুকে ওখানে দেখে জানতে চায়, ‘ও বা কিছু কবি নাকি?’

‘হুঁ, ও কা, বাবারে এট্টা কতা কওয়ার ছেল।’

‘ক, মাস্টার্স পাশ ছওয়াল বাপ-খুড়ার কতার মদ্যি না আইসে দরজায় দাঁড়াইয়ে রইচিস্?’

‘এয়াও ওয়ার মায়ের শেখানো’, পুলকেশ বলে, ‘ক, ও পাপ্পু, ও বা, কী কবি?’

‘দাদারে এট্টা ফোন করবা না, ভারতে তো এহোন আড়াইটা বাজে?’

নিখিল পাপ্পুর মুখের দিকে তাকায়, ছেলেটা ইন্ডিয়ায় না বলে বলল ভারতে। কথাটা একেবারে কাটা-কাটা। নিশ্চিত এইভাবে বউদি ওকে বলত, ‘তোর দাদারে এট্টা ফোন কর ও পাপ্পু, ভারতে এহোন কয়টা বাজে, অফিস ছুটি হইচে?’

পাপ্পু নিখিলের তাকানোটা খেয়াল করেছে। হ্যাঁ, তাই, সে-কথা জানতেও চাইল, ‘ও কা, ওইভাবে তাকাইলা কী জন্যি আমার কথা শুনে? ভারতে কইচি সেই জন্যি? আসলে মা এইভাবে কইত আমারে!’

নিখিল এতে কোনো ধন্দে পড়েনি। কিন্তু সে যে-কথা ভেবেছিল এখন পাপ্পুর অরুণেশকে ফোন করতে চাওয়ায়, তাই ছেলেটা হরহর করে বলে গেল।

এদিকে পাপ্পুর ফোন করতে চাওয়ার কথা শুনে পুলকেশ একবার পাপ্পুর দিকে একবার ধনঞ্জয়ের দিকে তাকিয়েছে। এখন ফোন করবে না পরে করবে। তা বুঝে নিতে পুলকেশ পাপ্পুর কাছে জানতে চাইল, ‘আর কেউ আসপে না?’

ধনঞ্জয় বলে, ‘আইজকে আর আসপে কেডা, যা আসার আইচে মানুষজোন।’

ধনঞ্জয় এইসব তদারকে ওস্তাদ। তার একটা হিসাব আছে। দশার মন্ত্রে আত্মীয়-প্রতিবেশী যা আসার বেলা থাকতেই এসেছে। চিড়ে-মুড়ি দই-কলা যা খাওয়ার খেয়েছে। দূরের কেউ আজ আসবে না, আসলে ফোনে জানাত। যদি আসে পরশু-তরশু, মাছ-তেল স্পর্শের দিন। সেদিনও দূরের কেউ আসবে না। কারণ শ্রাদ্ধ খাওন এখন হবে না। বৃষ্টি-বাদলার সম্ভাবনা। তাছাড়া অরুণেশ এখন আসতেও পারবে না। পৌষের শেষাশেষি ছাড়া ও কাজের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। সেসব তো এই কয়দিন বেশ কয়েকবার আলাপ করেছে ধনঞ্জয়সহ পুলকেশ জ্ঞাতিগুষ্টির ভাইদের সঙ্গে, পাপ্পুর মতামত নেওয়া হয়েছে।

সে-প্রসঙ্গ এখন উঠছে না, পুলকেশ জানতে চেয়েছে এখন আর কেউ আসবে কিনা। পাপ্পু বলেছে, না আর কারো আসার তেমন সম্ভাবনা নেই। এদিনের সব ভালোমতো হয়েছে একথা অরুণেশকে জানানো যায়। অথবা, আরো পরে জানানো যায়। নিখিলের মনে হলো, পাপ্পু হয়তো এখন অরুণেশের সঙ্গে কথা বলে মায়ের উদ্দেশে তাদের কর্তব্যকে ভাগ করে নিতে চাইছে। আজকের মতো সব কাজ শেষ হওয়ায়, পাপ্পুকে কোনো অসহায়বোধ ঘিরে ধরেছে না তো। এতগুলো দিন এই মাকে নিয়েই ছিল, মায়ের শুশ্রূষায় গত দুটো বছর ছেলেটা যেভাবে লেগেছিল এখন হয়তো তার মনে হচ্ছে, সেই সবকিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারল। আর তাতে কোনো প্রকার বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি হয়েছে। এই পর্যন্ত ভেবে নিখিলের মনে হলো, এইসব যে ভাবছে, ছেলেটা তা আবার বুঝে গেল না তো?

ধনঞ্জয় পুলকেশকে বলল, ‘বড়দা এটা কিছু কইয়ে দেও। ছেলেটা দাঁড়াইয়ে রইচে -’

‘কবো কী? তোরা কী মনে করিস, এহোন ফোন করবে, না পরে?’

‘বোঝলা ও নিখিল কা, বাবার এই দোটানা স্বভাব কোনোদিন গেল না। আইজকে মা থাকলি দেত এক ঝাড়ি।’

পাপ্পুর কথায় সবাই একটু হাসির সুযোগ পায়। ‘আচ্ছা, আরো ঘণ্টাখানেক বাদে করিস -’ ধনঞ্জয় বলে।

পুলকেশও তাতে সায় দেয়, ‘সেই ভালো -’

একথা বলল ঠিকই পুলকেশ। বলার পরপর পাপ্পু তার সামনে থেকে রান্নাঘরের দিকে চলে গেছে। এখনই আবার চা দেবে কিনা জানতে চাইবে। অনেকখানিক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে নিখিল এসেছে। নিখিলের আসাটা পাপ্পু, পুলকেশসহ সবার কাছেই অপ্রত্যাশিত। একটু পরেই আবার উঠবে, বলবে, যাই। এসেছিলাম, দেখে গেলাম। সব ভালোমতো হয়েছে। আর পাপ্পু জানে, জানত অরুণিমাও, নিখিল চা পছন্দ করে। তাই রান্নাঘরে প্রতিবেশী ঘরের মেয়েটিকে আবার তাদের চা দিতে বলে পাপ্পু বেরিয়ে গেল। কিন্তু তখনো পুলকেশের কানে পাপ্পুর ওই কথাটা। আজ অরুণিমা থাকলে তাকে এই দোটানা নিয়ে ঝাড়ি দিত।

নিখিল লক্ষ করেছে, পাপ্পু একথা বলার পরপর আবারো অন্যমনস্ক হয়েছে পুলকেশ। আবার পুলকেশ অন্যমনস্ক হয়ে মুহূর্তেই অরুণিমার মুখখানা দেখে নিয়েছে। কী বলত তাকে? ভেবেছে সে। কিন্তু এখন নির্দিষ্ট কোনো কারণ ভাবতে পারে না। কতবার কত কারণে অরুণিমা তাকে গলা নিচু করে ঝাড়ি দিয়েছে। অরুণেশ কোনোদিনই কাছে নেই, কিন্তু পাপ্পু তো তার বাপকে মায়ের নিচু গলায় দেওয়া সেইসব ঝাড়ি শুনতে-শুনতে বড়ো হয়েছে। এখন সেই কথা বলে গেল।

একেবারে শেষদিকে, কলকাতার ডাক্তাররা ফিরিয়ে দেওয়ার পর, যখন অরুণিমার গলার স্বর ফ্যাসফেসে, মুখখানা ফুলে গেছে, চশমাটা চোখে দেওয়ার পর চোখদুটো মনে হতো কত গভীরে প্রায় কোটরে ঢুকে গেছে, সে-অবস্থায়ও এই টানা চোখদুটো একটু বড়ো করে পুলকেশকে একটা কিছু বলত। সেবার বলেছিল, কী একটা পরীক্ষা করানো নিয়ে। পাপ্পু জেনে এসেছে, নতুন হওয়া সুন্দরবন ক্লিনিকে এটা ভালো হয়। ওদিকে পুলকেশকে ধনঞ্জয় বলেছিল, এই চেকআপ খানজাহান ক্লিনিকে করানো ভালো। এ নিয়ে বাপে-ছেলেতে তর্ক হয়নি। পুলকেশ কোনোদিনও তর্ক করার মানুষ না; কিন্তু পাপ্পু যতই বলুক ধনঞ্জয় বলেছে অন্য ক্লিনিকের কথা, এখন যদি সুন্দরবন ডায়াগনস্টিকে চেকআপ করায় তাহলে ধনঞ্জয় কী ভাববে? এই কথা অরুণিমার সামনে বলতেই, পুলকেশ একেবারে মিনমিনে গলায় বলেছে, বলতেই অরুণিমা নিচু গলায় বলেছিল, ‘যাও, হাটে যাও, দরবার বসাও। তারপর মানুষ কোনদিকে বেশি রায় দেয়, সেই মতো ক্লিনিক ঠিক কইরো। তোমার এই দোটানা স্বভাব গেল না! ছাতার এক বস্নাড টেস্ট…। দুইদিন বাদে যাব মইরে, আর এহোন বাপ-পোয় ক্লিনিক নিয়ে আছে।’

আগের কথাটুকু পর্যন্ত যদি এখন মনে পড়ত তাহলে পুলকেশের জন্যে একপ্রকার আনন্দেরই হতো। পাপ্পু সে-কথার সামান্য শুনিয়েও গেছে, কিন্তু ওই কথার পরের টুকু! অরুণিমা তখনই বুঝে গেছে, জেনে গিয়েছিল সে আর বেশিদিন নেই, নাকি কলকাতার ডাক্তাররা ফিরিয়ে দেওয়ার পরে সে নিজেতে নিজে সিদ্ধান্ত করে নিয়েছিল, নাকি দুরারোগ্য ব্যাধির রোগীরা এক সময়ে জেনে যায়, সে আর কোনোভাবেই ভালো হবে না। তাই যদি না-হয়, তাহলে ওইদিন অমনভাবে অরুণিমা ওকথা বলেছিল কেন? আর কখনো কিন্তু বলেনি। ওদিনও কি তবে বলত না, শুধু তার আর পাপ্পুর কথাগুলো শুনে ফেলেছিল বলে, ওভাবে বলেছে।

পুলকেশের মুখখানায় আবার বিষাদের ছায়া পড়ল। কিন্তু ধনঞ্জয় তা লক্ষ করেনি। অথবা, ধনঞ্জয় ওই কথার পরপরই মোবাইল ধরতে একবার বাইরে গেছে। এখন ফিরে এসেছে। নিখিল বুঝল, পুলকেশ এখান থেকে হারিয়ে গিয়েছিল হয়তো, ধনঞ্জয় আসার সঙ্গে-সঙ্গে আবার ফিরে এলো। তখনই সে বলল, ‘ও ধলাই, তোর মনে আছে, এই মাস ছয়েক আগে একটা বস্নাড টেস্ট করানোর কথা?’

‘হুঁ – আমি কইলাম খানজাহান ক্লিনিক – ’

‘হ। পাপ্পু কইল সুন্দরবন। সেইয়ে নিয়ে আমরা বাপ-পোয় যহোন কী করব ভাবদিচি, তখন তোর বউদি ওই কথা কইল, এহোন পাপ্পু যা কইয়ে গেল -’

শুনে নিখিল হা-হা শব্দে হাসে। তারপর একেবারেই যেন অপ্রাসঙ্গিক কথা ঘোরানো দরকার এমনভাবে বলল, ‘তয় মাইনষে যে কয় -’

‘মানষি কী কয়?’

‘মানষি কয় ভাগ্যবানের মরে বউ, অভাগার মরে গরু।’

‘ও এই কথা?’ ধনঞ্জয় বলে।

‘শুনি তো -’

‘কৃষিবাদা আর্চে আইচকাল, সবই তো জমিজমা বান্দা লাগায়, তা’লি অভাগার গরু মরলি কী বা না মরলি বা কী? তয় বউ সত্যি ভাগ্যবানের মরে!’

‘কেন, তুমি সেইয়ে চাও?’ নিখিল ধনঞ্জয়ের কাছে জানতে চায়।

‘না। কথা উঠোইচিস তুই। কেন, পুলকেশদারে আবার বিয়ে দিবি নিকি?’

‘না, সেয়া কইনি -’

কথার মোড় ঘুরেছে। পুলকেশের মুখখানা দেখে বোঝা যায়, তার দুই মামাতো-পিসাতো ভাইয়ের এই আলাপ এখন চললে চলুক। নিখিলও যেন তাই চাইছিল। তাতে এতক্ষণের পরিস্থিতির গুমোট দশাটা কিছুটা হলেও কাটে। তাছাড়া অনেকক্ষণ কথা বলা হলো, এখন উঠতে হবে। ধনঞ্জয় যদি তাকে মোটরবাইকের পেছনে বসিয়ে একটানে বাসস্ট্যান্ডে দিয়ে আসে, তাহলে সে সন্ধ্যার আগে শহরে চলে যেতে পারে। এই কথা থামতে-থামতেই উঠতে হবে। ধনঞ্জয়দা উঠলে হয়। নিখিল ভাবে।

ধনঞ্জয় জানতে চায়, ‘তা’লি কী কইচিস -’

‘কইচি, – ’ নিখিল বলতে গিয়েও বলল না। সে বলতে চেয়েছিল, বউ মরলে যদি মানুষ ভাগ্যবানই হবে, তাহলে পুলকেশদারে এইরকম অভাগা করে দিয়েছে কেন?

কে জানে, যেন নিখিলের সে-ভাবনা পুলকেশ বুঝে গেল। তাদের প্রায় অবাক করে দিয়ে বলতে থাকে, ‘কৃষিবাদার কতা ক’লি, ওয়া নেই। সেই গ্রামই আর গ্রাম নেই। চাইর দিক কী পরিবর্তন হইয়ে গেইচে। আমার তো মাঝে-মাঝে মনে হয়, কোন নতুন দুনিয়ায় আইসে পড়লাম। সব কীরম যেন লাগে, অপরিচিত, মনে হয় এতদিন সব এক রকম ছেলে, হঠাৎ দুনিয়াদারির সব পালটাইয়ে গেইচে।’

ধনঞ্জয় মাঝখানে বলতে গিয়েছে, ‘কীরাম?’ বলেছেও, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে নিখিল তাকে হাত নেড়ে থামায়।

পুলকেশ বলে চলে, ‘আসলে আমার মনে হয়, আমি পালটাইয়ে গেইচি… আইজকাল আর কিছুই নতুন ঠেকে না।’

নিখিল পুলকেশের এই থামার জন্যে অপেক্ষা করছিল। থামতেই বলে, ‘দাদা, আমার যাওয়া লাগে, দিন কয়েকের মদ্যি এদিক আসলি আবার আসপানে -’

‘যাবি। আয় তয়। তোরে পাইয়ে কয়ডা কতা কব ভাবিলাম, হলো না। আবার আসিস -’

নিখিলের মনে হয়, হঠাৎ যাওয়ার কথা বলে উঠে পড়েছে নাকি? অথবা, বসবে আরো কিছুক্ষণ? তবু ধনঞ্জয়কে সে বলে, ‘ধলাইদা, তোমার হাতে কাজ না থাকলি চলো আমারে একটানা দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত দিয়ে আসো।’

‘দাঁড়া, দুই মিনিট। ওই বাড়ির অনুপরে কল দিতি কইচি পাপ্পুরে, ও তোরে দিয়ে আসপেনে।’

‘বয় তয়।’ পুলকেশ বলে।

‘না। বাইরোই। বইসে তো থাকলাম কত সোমায় -’

তিনজনে উঠোনে নামার উদ্যোগ নিতে, পাপ্পু উঠোন থেকে বলে, ‘অনুপ সামনের রাস্তায় আইচে ধলাই কা। চাবি দাও -’

ধনঞ্জয় চাবি দিতে-দিতে বলে, ‘আমি আসতিচি, গিয়ারে এট্টা সমস্যা, ওরে কইয়ে দি, পারলি এট্টু মেকাররে দেখাইয়ে নিয়ে আসপে -’

পাপ্পু এগিয়ে যেতে, পুলকেশ নিখিলকে বলে, ‘আবার আসিস ভাইডি। তুই আসলি কত ভালো ঠেহে -’

নিখিল মাথা নাড়তেই পুলকেশ বলতে থাকে, ‘কেমন বদল শুনবি? এই যে বাড়ি ঘরদোর সব ঠেকায় কি একেবারে নতুন।’ পুলকেশ উঠোনে বাড়ির চৌহদ্দি দেখায়, ‘মনে হয়, এয়ার কিছুই চিনি না আমি। কিন্তু রাইতে যেই শুইয়ে পড়ি, আমি শুইতাম ওই খাটের ভিতরের দিক। এহোনও সেইহেনে শুই, আর মনে হয়, বাইর পাশে তোর বউদি শুইয়ে রইচে!’

শুনতে-শুনতে নিখিল আর ধনঞ্জয় সামনে হাঁটে। ইচ্ছে করেই দাঁড়ায় না। নিখিল পুলকেশের দিকে হাত নাড়তেই, ধনঞ্জয় নিখিলকে বলে, ‘কী বুঝলি, পুলকদা তার সোনার পিত্তিমা নিয়ে আছে!’

নিখিল কিছু বলে না। তার মনে হলো, অরুণিমার মৃত্যুতে চারপাশ মিলিয়ে চরম নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরেছে পুলকেশকে। r