অপঠিত পার্লবাক, প্রার্থনা ও বাজি

নুশেরা তাজরীন

আজকাল গুলশানের কথা বড় বেশি মনে পড়ে সন্ধ্যারাণীর। একটু খুঁটিয়ে দেখলে ঠিক গুলশান না, তার ঘরের তাকে রাখা কালচে-সবুজ মলাটের বইটার কথাই মনে পড়ে, প্রথম পাতায় নিউজপ্রিন্টের চোষকাগজে ফাউন্টেন পেনের নীল কালিতে শিরা-উপশিরা বের করা – ‘গুলশানকে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ক্ষুদ্র উপহার, ইতি কাজল’ – লেখাটাও তার চোখে ভাসে। বইটা সে পড়েনি, শুধু দেখেছিল; তাও অন্তত বাইশ-তেইশ বছর আগের কথা; কাজল নামটার মালিক মেয়ে না পুরুষ সেটা নিয়ে গুলশানের সঙ্গে কিছু হাসিঠাট্টাও হয়েছিল, যদিও বইয়ের গল্পটা – গুলশানের মুখে যতটুকু শোনা হয়েছিল – পুরোপুরি মনে রাখতে পারেনি সে। 

সেই সময়ের সন্ধ্যারাণীকে রতিপ্রস্ত্ততির বিশেষ মুহূর্তে মনে করে এখনো মনে মনে হাসে ত্রিশ-পেরোনো যুবাদের কেউ কেউ, যারা বেড়ে উঠেছিল পৌরসভার ওয়ার্ডের খাতায় নাম তোলার আগেকার গ্রামটাতে, পিচলেপা রাস্তাটায় যখন ইটের সোলিং ছিল। এমনকি তারও আগে যখন সেটা ছিল বিশাল মাঠের মাঝবরাবর সিঁথিকাটা মাটির রাস্তা, সেই পথে তারা নিয়মিত দেখা পেত পরিবার পরিকল্পনা অফিসের মাঠকর্মীর – কাঁধে প্লাস্টিকের ঝুড়িব্যাগ, মাথায় চূড়াখোঁপা, পায়ের পাতার বেশ ওপরে শলার ঝাড়ু হয়ে ছড়িয়ে থাকা গেঁয়ো গোছার কুচি, টায়ারের চটি ঠেলে বেরিয়ে আসা টুটাফাটা ওলকপি-গোড়ালি দাবড়ে হেঁটে চলা চেনামুখ সন্ধ্যারাণীর। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা ভিড়টা সুর করে ছড়া কাটত, ‘সইন্দা মাসি সইন্দা মাসি, যাইব গো কই গয়া কাশি’; পুনরাবৃত্তির রেশ ফুরানোর আগেই বিচ্ছিন্ন কিছু বালককণ্ঠ ঘ্যানঘেনিয়ে উঠত – ‘পোটকা দে রে সইন্দা…!’ অপোগন্ড দলের উৎপাতে জেরবার হয়ে একেক দিন কাঁধের ঝুড়ি থেকে খাবলা মেরে একটা প্যাকেট তুলে ছুড়ে দিত সন্ধ্যা, ঠিক যেভাবে ঘরের কোণের জবুথবু কুনোব্যাঙ তার হাতে পড়ে গতিবিদ্যার সূত্র মেনে নিক্ষিপ্ত হতো বাইরের আঙিনায়; পেছন ফিরে তাকালে হয়তো দেখতে পেত তাসের রাজার মাথাছাপা খোসা ছিঁড়ে পাওয়া বস্ত্তটি কোনো বালকের ঠোঁটে ঝুলছে, ফুঁয়ের প্রসারণে আকৃতি বদল করে মুলা থেকে কদু, কদু থেকে মস্তবড় চালকুমড়ার বেলুন হতে চলেছে।

গুলশানকে দেওয়া কাজলের উপহার সেই বইটায় নাকি একটা মেয়েমানুষের কথা লেখা ছিল, যার কোনো নাম নেই, সবাই ডাকে ‘মা’ অথবা ‘অমুকের বউ’ বলে – চীনা কি জাপানি সেই রমণীর জীবনকাহিনিতে গুলশান মিল খুঁজে পেয়েছিল সন্ধ্যারাণীর। গল্পের মেয়েটার অকর্মণ্য স্বামী গ্রাম ছেড়ে অজানা কোনো গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছিল সুখবিলাসী স্বপ্নে বিভোর হয়ে, সন্তান-সংসারের যাবতীয় দায় সেই হতভাগীর মাথায় চাপিয়ে, এমনকি নিজের বুড়ি মায়ের কথাও ভাবেনি সেই স্বার্থপর! যদিও সুবল সাহা লোকটা একা ঘর ছাড়েনি, সঙ্গে নিয়েছিল বড়ভাইয়ের পরিবার আর মাকে, অথবা ওদের সঙ্গেই গিয়েছিল সে; তাছাড়া ততদিনে সন্ধ্যা জেনেও গিয়েছিল সুবলরা কোথায় গিয়েছে, তবু গুলশানের কথায় মনে হয়েছিল গল্পের মেয়েটার সঙ্গে ডালপালায় না হলেও লতাপাতায় কোথাও তার সাদৃশ্য আছে। ইন্ডিয়ায় পৌঁছে কলকাতার ধারেপাশে যেখানে সুবলরা ঘর তুলেছে বলে সে খবর পেয়েছিল, সেই জায়গাটার নাম ব্যারাকপুর না হয়ে মোহনপুর হলেও তার জন্য দূরত্ব অথবা অগম্যতার হেরফের ঘটত না; মেয়েদুটোসহ সেখানে গিয়ে পৌঁছানোর অসামর্থ্য বিষয়ে সন্ধ্যারাণীর কোনো সন্দেহ কখনোই ছিল না।

বস্ত্তত ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা সারাজীবনে সন্ধ্যারাণী মাত্র একবারই ভাবতে পেরেছিল, সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নও ঘটেছিল ক্লাস নাইনে দ্বিতীয়বার পড়ার সময় – আশুগঞ্জের ঋষিপাড়ার মেয়েটা যখন পাবলিক হেলথের টিউবওয়েল কারিগর সুবল সাহার হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। তিন খেপে রেলজংশন বদল করার সময়েই আলিঝালি বুঝতে পেরেছিল ট্রেন অথবা ট্রেনের জানালার বাইরের দৃশ্য নয়, আসলে যা বদলে যাচ্ছে তার নাম জীবন; তারপর অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিল নোনাকাদার এই অচেনা অঞ্চলে। সন্ধ্যারাণী দাসী এখানে এসে হয়েছিল ‘সাউগো বাড়ির বউ’, এবং সাংসারিক রাজ্যপাটের দায়িত্বে ছিল শাশুড়ি-জা; কাজেই উঠানের তুলসীতলা আর শঙ্খের নিত্যচর্চায় তার হাতের ছোঁয়া নিষিদ্ধ ছিল অনেকদিন, তবু কোনোদিন বাপের বাড়ি ফিরে যাবার চিন্তা করেনি সে।

থাকার ঘরটাকে ছাড় দিয়ে গাছপালা-পুকুর-জমির সবটুকু তার অগোচরে বেচাবিক্রির বন্দোবস্ত করে সুবলরা যেদিন গোপনে দেশ ছাড়ল, তার দুদিন পরেই দুয়ারের বাইরে শিকল-তালা টেনে বেরিয়ে পড়েছিল সন্ধ্যা; তিন বছরের যমজ রিক্তা-রুপার কোমরে জড়ান দড়ির আরেক মাথা বাঁধতে একটা খুঁটির প্রয়োজন ছিল শুধু, হাতের কাছে ছিল চৌকির পায়া। গ্রামে গ্রামে ঘুরে রাজা কনডম আর মায়া বড়ির বিলিবণ্টনের সেই দিনগুলোতে নিয়মমাফিক হানা দিয়েছে ক্ষুধা-গ্লানি-অপমান-কানকথার দৈত্যদানবেরা; বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস আর বুকচাপা হাহাকারের যৌথ উদ্যোগে কোথাও গৃহীত হয়েছিল অশ্রুঢলে বাঁধ নির্মাণের একটি অতিদুরূহ অদৃশ্য প্রকল্প; তারপর একদিন হঠাৎ সন্ধ্যারাণী জেনে গেছে সময়-সময় সময়ও পাহাড়ের মতো চেপে বসে জীবনে, আর তাকে গায়ে-গতরে ঠেলে পার করাও যায়!

অতদূর পথ পাড়ি দিয়ে বাপের বাড়িতে কীভাবে কী উপায়ে ওই খবর পৌঁছেছিল জানা যায়নি, বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে দুঃসংবাদের কোনো পার্থিব প্রতিযোগিতা হয়তো সত্যিই আছে; তবে ঋষিপাড়ায় ফিরে গেলে বড়দা হারাধন খোল-করতাল ফেলে হাতে রামদা তুলে নেবে – ছোটভাই সুধনের বয়ে আনা এমন সংবাদেও খুব বেশি বিচলিত হয়নি সে, বরং অনেক বেশি শঙ্কিত হয়েছিল মেঝেতে মাদুর পেতে শুইয়ে রাখা রুপার জামার তলায় সুধনের ব্যস্ত আঙুলের কারুকাজ ফুটে ওঠার দৃশ্যটি দেখে। বড়দাবিষয়ক সাবধানবাণীর টাটকা স্মৃতি থেকেই হোক, অথবা ঘরে রামদা না থাকার কারণেই হোক, বঁটি-দা উঁচিয়ে তাড়া করে সুধনকে চিরতরে বিদায় করেছিল।

কদিন বাদেই লাগোয়া ঘরটা ভাড়া নিয়েছিল সিদ্দিক মাস্টারের পরিবার – শাঁখা-সিঁদুরটুকু বাদ দিলে সন্ধ্যারাণীর মতোই সাজপোশাকে হাজিরা খাতা বুকে চেপে বেরোত গুলশান, এগারো মাইল হাঁটাপথের জলকাদা-গু-গোবর ঠেলে চরের স্কুলে আসত-যেত রোজ; হাতের নাগালে একথালা মুড়ি রেখে রুপা-রিক্তার মতো তার ছেলের কোমরেও সকাল-সকাল দড়ি বাঁধা হতো, একই চুলায় পালা করে চড়ত তাদের ডালের হাঁড়ি, পাটখড়ির অাঁচে ফুটত চাল-আলু, কালেভদ্রে বড়জোর দু-একটা সাবধানী ডিম ডুব দিত পাতিলের গহবরে। বিকেলের মরা আলোয় মাটিতে ছড়ানো নেতানো মুড়ি পরম অধ্যবসায়ে একটা একটা করে খুঁটে তুলত গুলশান; আরো তুলত সারাদিনের জমে থাকা গল্প। হাতের বাজুতে নরপ্ল্যান্টের তাবিজ পরতে রাজি হয়নি সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষিকা, তবে শরীরের অন্দরে কপার-টি ঢোকাতে হাসপাতাল গিয়েছিল সন্ধ্যারাণীকে সঙ্গে নিয়েই, ফেরার পথে গুলশানের কেন যেন মনে পড়েছিল সেই গল্পটা – কথার ঘোড়া এলোমেলো ছুটিয়ে তলপেটের টনটনে ব্যথাটার মাথায় চড়ে বসা আটকানোর একটা চেষ্টাই হবে হয়তো – সন্ধ্যারাণীকে বলেছিল ক্ষেতখামারে কাজ করা স্বামীপরিত্যক্ত মেয়েমানুষটার কথা, যার বুড়ি শাশুড়ি খড়ের বিছানায় শুয়ে থাকত, একমাত্র মেয়েটা চোখের ঘায়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সংসারী বড় ছেলে ছিল স্বার্থপর, আর আদরের ছোট ছেলেটা ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে তাকের ওপর থেকে আয়না-চিরুনি-পমেডের কৌটা সরিয়ে বইটা টেনে নামিয়েছিল গুলশান; দুজনে মিলে দেখেছিল বইয়ের এপিঠে সাদাকালো ছবিতে ছাঁটাচুলের বিদেশি বুড়ির গলায় একছড়া পুঁতির মালা আর ওপিঠে দেশি লোকের গলায় ঝোলান টাই – তাদের সবাইকে দেখছিল ঘরের বেড়ায় সাঁটা চাররঙা পোস্টারের সুখী পরিবার।

আজকাল গুলশানের ঠিকানা খুঁজে তার সঙ্গে দেখা করার একটা বাসনায় হঠাৎ-হঠাৎ উচাটন হয় সন্ধ্যারাণী; মাস্টার দম্পতি অনেক ঘুরেফিরে পিটিআইয়ে গিয়ে উঠেছে বলে লোকমুখে শুনেছে সে, আরো শুনেছে তাদের বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে চলেছে – এমন একটা সুখবর। দুই যুগের ব্যবধানে সন্ধ্যারাণীর নিজেরও কাজকর্মের ঠিকানা পালটেছে; পৌরসভার চৌরাস্তায় মাতৃছায়া ক্লিনিকের অ্যাপ্রোনপরা আয়া শুধু নয়, গর্ভপাতচর্চার সুবাদে আশপাশের তিন জেলায় নাম অথবা বদনাম কুড়ান গাইনির ডাক্তারের অপরিহার্য সহকারী হিসেবে বাসাবাড়িতে প্রাইভেটেও ডাক পড়ে তার; অবাঞ্ছিত রক্তমাংসের বিশ্রী দলা কালো পলিথিনে মুড়ে ক্লিনিকের পেছনের পচা ডোবায় চালান করার সময় কোনো কোনোদিন তার মনে পড়ে, গুলশানের বইয়ের মেয়েমানুষটাও স্বামীর অন্তর্ধানের পর একবার পেট খসিয়েছিল – গ্রামের জমিদার না নায়েব কার যেন বাচ্চা ছিল সেটা! বাচ্চু ঠিকাদারের কথাও তখন তার মনে আসে, সুবলরা দুই ভাই যার কাছে জমিজমা বেচে গিয়েছিল নগদে, যার করুণায় পুকুর হাতছাড়া হওয়ার পরও ঘাটটা আগের মতোই ব্যবহার করতে পেরেছিল সে; এবং সেই করুণার বিনিময়ে বাজারে চালু থাকা একটি বিশ্বাসযোগ্য কাহিনি নিষ্প্রতিবাদ নীরবতায় হজম করে গেছে।

সামনের চৈত্রে বাচ্চু ঠিকাদারের ছেলেরা পুকুর ভরাট করে হাউজিং বানাবে – ইদানীং এমন সংবাদে বিচলিত বোধ করে সন্ধ্যারাণী; শুধু এ-কারণেই নয় যে, জলাশয়টির অবর্তমানে          সকাল-সন্ধ্যায় রুপার বিছানা থেকে বের হওয়া ময়লা কাঁথাকাপড়ের টাল ধোয়ার কী ব্যবস্থা হবে সেটা সে জানে না; পাশাপাশি নিজের ঘাট থেকে তিন ঘাট পরের আশীষদের বাড়িতে এ নিয়ে কেমন কথাবার্তা হতে পারে, সেটার আগাম নমুনা আঁচ করেও মুষড়ে পড়ে। কেননা, সে জানে, মানুষ যত যা-কিছু ভুলুক নিজের অপমানটুকু কোনোদিন ভোলে না; ডিভি পেয়ে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার বছরখানেক আগে ছন্নছাড়া আশীষ যখন ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিল রিক্তাকে, এই পুকুরঘাটে বসেই মেয়ের উছিলায় বেয়াইবাড়ির দিকে নিজের ছুড়ে দেওয়া বিদ্রূপের তীর – ‘মাজ লো মাজ, সাউবাড়ির মাইয়া, মালোগো বাড়ির বাসন মাজ!’ – এখন পাল্টা আঘাত হয়ে ফিরে আসতে পারে। আশীষদের ভাঙা ভিটায় দালান উঠে গিয়েছে – লোকে বলে ডিভি-ডলারের বাড়ি – সে-বাড়ির লোকেরা অবশ্য পাকা কলঘর ছেড়ে পুকুরঘাটে বড় একটা আসে না আজকাল।

দুবছর আগে একবার দেশে এসেছিল আশীষ-রিক্তা, সুখের দেশের বাড়ি-গাড়ির গল্প উপচে পড়ে ওদের চোখেমুখে; নিজেদের বাড়ি কিনে ওখানেও নাকি আম-লিচুর গাছ বুনেছে, মাচায় ঝুলিয়েছে শিম-লাউ। একমাস ছিল ওরা, শুরুতে নিয়মিত এলেও শেষদিকে আশীষ আর আসেনি সন্ধ্যারাণীর ঘরে, রিক্তার মুখে হঠাৎ করেই ঘনিয়ে এসেছিল অচেনা অাঁধার; যার মানে বুঝতে বড় বেশি সময় নিয়ে ফেলেছিল সন্ধ্যারাণী, যতটা দেরি হলে গর্ভপাতের জটিলতায় বোবাকালা কন্যার মাসিক রক্তপাত বেড়ে যায় কয়েকগুণ, আর নতুন করে অচেনা ক্ষরণে আক্রান্ত হয় জননীর অন্তর্গত ঘা।

গায়ের রংটা চাপা বলে রিক্তার অমন নাম জুটেছিল, অথচ তার যমজ রুপা দেবীপ্রতিমার মতো রংচেহারা আর ভরন্ত শরীর নিয়েও আজীবন বিছানায় পড়ে গোঙানোর কপাল নিয়ে এসেছে – এই পরিহাস একসময় প্রতিবেশীদের দার্শনিক আলোচনার সুযোগ দিত; বিব্রতমুখে সন্ধ্যারাণীও বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে অনেকদিন, তারপর কখন যেন ভাবতে ভুলেও গেছে, অথবা ভাবনাটা মিশে গেছে প্রতিদিনকার ভেজা কাপড়ের রুটিনবাঁধা বাষ্পীভবনে। তবু মেয়ের পিঠের ঘায়ে মলম লেপে ঢোলা জামাটার বোতাম অাঁটার ফাঁকে অথবা চুলের গোছা বেণিতে গেঁথে দেওয়ার সময়, সে নিজে অচল হয়ে পড়লে শয্যাশায়ী বোঝাটির কী হবে – এমন অনিবার্য প্রশ্নের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করায়, যার কোনো উত্তর কারো কাছে আছে কি না সন্ধ্যারাণী জানে না। শুধু জানে, জবাবটা তার নিজের কাছে নেই। গৃহদেবতা লক্ষ্মী বিষ্যুদবারের পাঁচালিতে তুষ্ট কি না, সে-কথা সন্ধ্যারাণীর মনে আসে না; যদিও বিজয়া দশমীর দিনে বিদায়ী ঠাকুরের সামনে অনেকগুলো ভেজা চোখের ভিড়ে আপন চোখের শুষ্কতা তাকে পীড়া দেয়, মেয়ের বিছানায় বর্জ্যশোষক কাঁথাকাপড়ের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে বাবার মুখে শোনা যযাতির যৌবনভিক্ষার কাহিনি মনে করার চেষ্টা করে, রুপার মতো একটা অচল সন্তান থাকলে যযাতি নিজের বদলে স্ত্রীর জন্য অনন্ত আয়ু চাইত কি না – সেরকম একটা প্রশ্ন পরদিন ভোরে পুকুরঘাটে বসে ধোয়া কাঁথা নিংড়ানো পানির সঙ্গে ঝরিয়ে দেয়।

রুপার আরোগ্যের অসম্ভব আশায় ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করেনি সে বহুদিন, তবে সংসারপলাতক সুবল সাহা সন্ধ্যারাণীর প্রার্থনায় যাতায়াত করেছে অসংখ্যবার, যে-প্রার্থনার ভাষা পালটে গেছে দফায় দফায়। প্রথমদিকে অঝোর অশ্রুপাতে যখন বলেছে ‘ঠাকুর, তুমি তারে মনে করাও’, প্রার্থিত স্মরণশক্তির আওতায় তখন শিশুসন্তান আর বিবাহিত স্ত্রীর দাবির অতিরিক্ত আরো কিছু ছিল;  হয়তোবা ক্লাস নাইনের পৌরনীতি বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা চিঠির শব্দবাক্যের উথলানো স্মৃতিকাতরতা – যে-প্রেমপত্রের হাতবদলের সময় আশুগঞ্জের বাতাসে ভাসছিল বাস্ত্তহারা শিমুলতুলার কণা, আকাশে সাদা ধোঁয়ার মেঘপথ তৈরি করেছিল নিঃশব্দে উড়ে যাওয়া ছোট্ট উড়োজাহাজ…

প্রার্থনা যখন নিজেই টের পায় তার পূরণ হওয়ার যোগ্যতা নেই, সে-প্রার্থনার জোর ফুরিয়ে যায়, অথবা মনস্কামনার  গতিপথ ঘুরিয়ে নেয় আশাহীন মানুষ; সন্ধ্যারাণীর প্রার্থনাও আমূল বদলে গেছে একটা সময়ে এসে, যখন প্রাণপণে স্বামীর স্মরণশক্তির বিনাশ কামনা করেছে সে, অবিরাম অভিশাপের তিক্ততা ছড়িয়ে। সেই পর্বও চুকে গেছে অনেকদিন – উদাসীনতা, নিস্পৃহতা কিংবা ক্ষমাশীলতার কোনো অবচেতনসূত্র মেনে নিয়ে তার কোনো প্রার্থনাই এখন আর রিক্তা-রুপার বাপের অস্তিত্ব জানান দেয় না।

অবশ্য প্রার্থনা বা চাহিদা ছাড়াও ভাবনার উপলক্ষ থাকা সম্ভব; তার প্রমাণ দিতে এতদিন পরেও গুলশানের বইটা সন্ধ্যারাণীর মনপুকুরে ঘাইমারা বোয়ালের বুদ্বুদ তোলে, এবং সুবল সাহা বিষয়ক ভাবনার একটা চোরাস্রোত সেখানে সন্তর্পণে কাজ করে। বইয়ের সেই মেয়েমানুষটা যাকে সবাই ‘মা’ নামে চেনে, তার স্বামীটা কোনোদিন ফিরে এসেছিল কি-না, সেই অনুমানের গভীরে ডুব দেয় সন্ধ্যারাণী; পড়ন্ত বেলায় জীবনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে তার মনে হয়, এতদিন ধরে ঈশ্বরের কাছে যে প্রকাশ্য অথবা প্রচ্ছন্ন প্রশ্নটি সে রেখে এসেছে, তার বকেয়া উত্তরটা ওই বইতেই আছে! এমন একটা যুক্তিহীন বিশ্বাসের সরু খুঁটি কীভাবে যেন গেড়ে বসেছে বোধবুদ্ধির কাদামাটিতে সে জানে না, শুধু জানে সিদ্দিক মাস্টারের বউকে তার খুঁজে পাওয়া চাই; ঘরের তাকে বইটা এতদিন টিকে থাকুক বা না থাকুক, গুলশানের নিশ্চয়ই মনে আছে গল্পের ঘরছাড়া লোকটা সংসারে ফিরে এসেছিল কি না। সে যদি ফিরে আসে তবে ফেলে যাওয়া সংসারে আবার ফিরে আসবে সুবল সাহাও, হঠাৎ কোনো ভোরবেলায় দেখা যাবে মাজাভাঙা জবাগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে লম্বা হাই তুলে মাথাভরা চুলের মানুষটা আড়মোড়া ভাঙছে দুহাত উঁচিয়ে – এই আশায় ভর করে শেষ বিকেলে বাড়ি ফেরে সন্ধ্যারাণী; পথে আচমকা হোঁচটে স্যান্ডেলের বিচ্ছিন্নপ্রায় ফিতেটা বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত টিকে থাকলে ঘরে ঢুকে দেখবে আজ রুপা বিছানা নোংরা করেনি – সাবধানী পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে কার্যকারণ-ফলাফলের এমন একটা ছেলেমানুষি সূত্র নির্মাণের চেষ্টা করে।