অপাপবিদ্ধা

অমর মিত্র

ছিট মদনাকুড়ির পরে বাংলাদেশ। মদনাকুড়ির আগে বাংলাদেশ। যুদ্ধে তারা বেঁচে গিয়েছিল। কী করে বাঁচল তাই-ই রহস্য। হেরাতুন বেওয়া বলে, যে করেই হোক আমরা ইন্ডিয়া, ভারত, আমরা বাংলাদেশ না, মহারাজার পোজা ছিলাম, তাঁর খাজনা দিতাম, তাই আমরা ইন্ডিয়া, কোচবিয়ার মুদের সদর, ইটা ফরেন না।

ফরেন মানে বাংলাদেশ। ওই দেশের দুই নাম, যেমন ইন্ডিয়ার দুই নাম। ভারত যেমন ইন্ডিয়া, ফরেন তেমন বাংলাদেশ। হেরাতুন তিন কাল গিয়ে এক কালে পৌঁছন বুড়ি। কতকাল ধরে বেঁচে আছে ওই সিঙ্গিমারি নদীর দিকে চেয়ে। ওই যে নদীর শেষ নাই। চর। চরে গাছগাছালি, ক্ষেত-খামার। তারপরে আবার নদী – শুনেছে সে তার বেটা বছর পঞ্চাশের জমিল মিঞার কাছে। জমিলের আগে বুড়ির পাঁচ মেয়ে। জমিলের পরে দুইটা। হেরাতুন এই ইন্ডিয়া পাকিসত্মানের সেরা ধাই। তার হাতে যে কত মানুষের জন্ম হয়েছে। লোকে বলে, মায়ের জন্মদুয়ারে বসে সে হাঁক দিত, আয় বাছা আয়, মারে আর কষ্ট দিসনে গো। সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসত নবজাতক। লোকে আরো বলে, হেরাতুন নিজের গর্ভে কতজনকে ধরেছে তার ঠিক নেই। সে নিজেই তাদের ডাক দিয়ে ভূমিষ্ঠ করাত। তাদের কতক বেঁচেছে, কতক মরেছে। সেই জন্মের পর মরেছে, আবার ডাগর হয়ে মরেছে। কত কী হয়েছে তার জীবনে? স্বামী মরার পর বছর বিয়োনি মাগি হেরাতুন থামে। হেরাতুনের স্বামী শাজাহান মোল্লা বছর পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্নয় পেটে ঘা নিয়ে ইন্ডিয়ার হাসপাতালে গিয়ে মরে। তখনো হেরাতুনের যৌবন ছিল, পেটে ধরার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু থামতে হয়। যে তাকে দেবে, সেই চলে গেল গোরসত্মানে। আছে ভিটের পিছনে শুয়ে। ছেলেপুলেতে তার ছিল নেশা। ধাই হয়ে সে তখন মানুষের জন্ম দিয়ে বেড়াতে থাকে। ছিটে-ছিটে ঘোরে। ইন্ডিয়ায় এক দর, বাংলাদেশ – ফরেনে আর এক দর। হেরাতুন এখন এই অবেলায় বসে আছে তার ভিটের উঠোনে। মুখখানি অন্ধকার। অকাল মেঘে ছেয়ে গেছে বুঝি চাদ্দিক। শেষেরটা হলো মেয়ে। তখনই তার বাপের ক্ষমতা ফুরোনোর পথে। পেটে ঘা। সে দিয়ে গেল এক হুরি। খলবল করছে এক আসমানি পরি। যেমন তার রং তেমনি তার চোখ, মুখ। হাসিতে মুক্তো ঝরে। মুক্তো কেমন জানে না হেরাতুন। মুক্তো সাগরে হয়। এই দেশে সাগর নাই। সে সাগর দ্যাখেনি। মেয়ের বাপে বলত, আসমানে এক তারা আছে, সেই তারার হাসি পানি হয়ে সাগরে পড়ে মুক্তো হয়ে যায়। সেই হাসি আসমান থেকে সাগরের পানিতে না পড়ে হেরাতুনের গর্ভ-পানিতে এসে পড়েছিল। সেই পানিতে পড়ে এমন সুন্দরী মেয়ে এসে পড়ল তার মায়ের কোলে। এই সব কইতে-কইতে হেরাতুনের স্বামী শাজাহান হাসপাতালে গেল। মরল। ভাবলে এখনও বুক হু-হু করে ওঠে। বাপে তো দেখল না সেই মেয়ে বড় হয়ে জান্নাতের হুরি হয়ে উঠল কেমন। বাপে তো দেখল না সেই জান্নাতের হুরি, তার বুকের ধন জিন্নতের কী হলো শেষে।

হেরাতুন অনেক বিইয়েছে, তাদের সবাই বাঁচেনি। জন্মের পর কিংবা শিশুকালে মরেছে। পেটেও মরেছে। গর্ভপাত হয়ে গেছে। রক্তারক্তি! দিনহাটার হাসপাতাল বাঁচিয়েছিল। সেবার এই মানসাই নদীতে বান ডেকেছিল খুব। কোন দেশের পাহাড়ে বৃষ্টি হয়েছিল, সেই জল নেমে আসতে সিঙ্গিমারি, যার আর এক নাম মানসাই, যে ফরেনে গিয়ে ধরলা, সে ভাসিয়ে দিয়েছিল সমস্ত এলাকা। তখন কে ফরেন কে ইন্ডিয়া তার কোনো বাছ-বিচার ছিল না। ইন্ডিয়ার ছিট এই মদনাকুড়ি যেমন ভাসল, পাকিসত্মানের ছিট কিসমৎ বাতৃগাছ মশালডাঙা, কাজিরহাটও ভাসল। নদী যা করে না, মানুষ তা করে। সেই পানিতে ভেসে গিয়েছিল একজন, তার নাম খুসবু, পাঁচ বছর হয়েছিল। তার আর খোঁজ পায়নি। ফরেনে নিয়ে গিয়েছিল নিজের সঙ্গে হয়তো। আসল বাংলাদেশে, যে-বাংলাদেশের নাগাল পায় না ইন্ডিয়ার ভিতরের বাংলাদেশ। ফরেনের ভিতরে ফরেন। বুড়ির সব মনে পড়ছে। ঘুরে-ঘুরে আসছে। সবে সে বিয়োনর উপযুক্ত হয়েছে, তখন থেকেই পেটে ধরেছে। পেটে ধরার কত কষ্ট কত সুখ। বছরের কতটুকু সময় সে খালি থাকত তা খুঁজে বের করা কঠিন ছিল। মাসিক বন্ধ না হলেও ওই সময়ে মনে হতো, কেউ আছে তার ভিতরে। সে মা জননী। সে যখন হাটে যায়, বাজারে যায়, অনেক মানুষ দেখে মনে হয়, সব তার গভ্ভো থেকে বেরিয়েছে। কচি-কাঁচা, জোয়ান-জোয়ানি, বুড়ো-বুড়ি… সব। ভাবে আর নিজের মনে হাসে। লোকটা যদি পেটে ঘা হয়ে না মরত, লোকটা আরো দিত। যতদিন সে পারার মতো থাকত, পেরে যেত। বুড়ি বসে আছে শূন্য চোখে। তার বেটা জমিল নয়িম করিম পাশে-পাশে ঘর বেঁধে আছে। এক বেটা সাহিল থাকে দিনহাটায়। সে বিয়েলারো আপিসের পিয়ন। মাসকাবারি বেতন পায়। তাকে কিছু দেয়। সকলের যাওয়া-আসা হচ্ছিল। দুই মেয়ে মনিরা আর সালমা এসেছিল জামাই নিয়ে। ফিরে গেল। আর এক মেয়ে লায়লা আসেনি। সে খবরও পায়নি যে তাদের সবার ছোট বোন জান্নাতের হুরি জিন্নত নেই। শ্বশুরঘরে মরেছে। বিয়োতে গিয়ে মরেছে। হাসপাতালে গিয়ে মরেছে। প্রথম পেটে ধরেছিল শাদির চার বছরের মাথায়। কিন্তু মা-বেটি কেউ বাঁচেনি। তাকে ডাকেনি জামাই। সবেবানেশে জামাই। তাকে ডাকতে বলেছিল নাকি মেয়ে, তা না করে হাসপাতালে। হাসপাতালেই যায় এখন বেশি। আর কোলে বাচ্চা নিয়ে ফেরে। কিন্তু তা হয়নি। ইন্ডিয়ার ছিটের মেয়ে ইন্ডিয়ায় মরেছে। আর সেই ইন্ডিয়া ছিট নয়। সেই ইন্ডিয়ার পরে শুধুই ইন্ডিয়া, ছিট নয়, যেতে হলে বাংলাদেশ পার হতে হয় না। এইটুকু তার সান্তবনা।

কে এলো এই শূন্য উঠোনে। কত খলবল কত ছোটাছুটি ছিল এখেনে। সব সময় ভরে থাকত ট্যাঁ ভ্যাঁ, হি হি হি, হা হা হা, হো হো হো। সব থেমে গেছে। ফাল্গুন মাসের আকাশ থমথমে। পাতা ঝরছে কদম গাছের। উঠোন আর কত ঝাঁটাবে বুড়ি। কী হবে, জান্নাতের হুরি বাঁচল না, কার জন্য করবে? শাদির পর মেয়ে আরো

রূপ পেয়েছিল। আল্লাহ তাকে ভরে দিয়েছিল। তাঁর দেওয়া ছাড়া অমন রূপ হয় না। কিন্তু মা হওয়া তার হলো না। জান্নাতের হুরি মা হয় না। চিরকাল কুমারী থেকে যায়। তাই মরল নাকি? মসজিদের ইমাম কুরবান আলি ওই কথা বলে গেছে বুড়িকে। বেহেসেত্মর হুরি বেহেসেত্ম গেছে হেরাতুন, নইলে তুমার হাতে এতো জন্ম, তুমার বেটি মা হতে হাসপাতালে যায়। মরত না হয় মার কোলেই মরত। কিন্তু তোমার হাতে কি কেউ মরেছিল কখনো খালাস হতে গিয়ে।

কে ডাকল, আম্মু। চমকে ওঠে হেরাতুন। আর আম্মু, মা ডাক শুনতে চায় না। মাথা তোলে হেরাতুন, দ্যাখে ফরেনি হবিব। মানে মশালডাঙা, বাংলাদেশি ছিটের হবিব। জিন্নতকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এই ফরেনি। কিন্তু ওর তো আসলে কোনো দেশ নেই।  ওর কাছে মেয়ে দেবে কেন হেরাতুন? ওকে যদি ইন্ডিয়া থেকে খেদিয়ে দেয়? তখন? এই তো আর বছরে বাংলাদেশ, মুসত্মাফির ছিটের দুটো লোককে নাজিরহাটে বিএসএফ তুলে নিয়ে চালান করে দিলো। সে আলিপুরদুয়ার জেলে পচছে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি হয়ে। প্রমাণ করো তুমি ইন্ডিয়ার, ভোটার কার্ড কই, রেশন কার্ড কই, তবে কী দিয়ে বলা যাবে তুমি বর্ডার পার হয়ে আসনি? ছিটের লোক! ছিটের লোক ইন্ডিয়ায় ঢুকবে কেন? কিঁউ, বোল কিঁউ? ওদের নাকি মাসে কটা করে কেস দিতে হয়। ফরেনি কেস। জিন্নতকে বিয়ে করার পর যদি ওকে বিএসএফ তুলে ঢুকিয়ে দেয়? কী হতো মেয়ের?

ইন্ডিয়ার মেয়ে বাংলাদেশে যাওয়া মানে, তার না থাকবে ভোটার কার্ড, না থাকবে রেশন কার্ড। তাদের না থাকবে বিডিও, না থাকবে পঞ্চায়েত? তাদের আসলে কিছুই নেই। ভিখিরির গাঁয়ে কেন দেবে সুন্দরী মেয়ে? সে বিয়োবে যখন দিনহাটার হাসপাতালে নেবে না। অমন জায়গায় মেয়েকে কেউ দেয়? কিন্তু না দিয়ে তো বাঁচাতে পারেনি। বুড়ির প্রাণ হু-হু করে ওঠে। জিন্নতের মৃত্যু সংবাদ পেয়েই হবিব এসেছে। ছিটের অবস্থা সেই রকমই আছে। ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা দিবসে ইন্ডিয়ার ফ্ল্যাগ তুলে ইন্ডিয়া হতে চায়। কিন্তু হয় না। হচ্ছে না। কত দরখাস্ত দিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, কোচবিহারের ডিয়েমের কাছে, হয়নি। ছিটবিনিময় হচ্ছে না। বিনিময় হলে ওরা ইন্ডিয়ার ভিতরে ইন্ডিয়া হয়ে যেত। বুড়ি হেরাতুন অনুকম্পার চোখে তাকায় হবিবের দিকে। এসেছে কেন, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে? মরেছে, আমার মেয়ে মরেছে, তোর কী? ওখেনে ম’লে তো গোরসত্মান হতো ছিটে। ছিটেই থেকে যেতে হতো। জান্নাতের হুরি জান্নাতে ফিরে যেতে পারত না।

হেরাতুন জিজ্ঞেস করল, তুমু কেনে?

তুমারে দেখতি এলা আম্মু। হবিব বলল।

হেরাতুন কপালে হাত দিলো, আমু তো মরে নি গো।

হবিব তার সমুখে বসেছে। রোগা। চোখমুখ বসা, গালে দাড়ি রাখছে হবিব এখন। সে নাকি ছিটের মসজিদে ইমামতি করবে। ইমাম কুরবান আলির ভাই এরফান আলি তাকে শেখাচ্ছে। এখন সে মুয়াজ্জিন, আজান দেয়। এখন ছুটি নিয়ে এসেছে। বলল, আম্মু, আমি বসব না, শুধু বলতি এলা সে আল্লা পাকের আশ্রয়ে গেছে, তুমি মন খারাপ কর না।

আমার মেয়ে মরেচে, আমি মন খারাপ করব না, ফুত্তি করব? হিসিয়ে উঠল হেরাতুন।

হবিব চুপ করে থাকে। তার মুখে কথা জোগায় না। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আসলে তার মনের কথা মুখে আসে না ভালো করে। তার কথা শুনে হাসত জিন্নত। কিন্তু তাকে ভালো তো বাসত। বলত, তুমার মুখে আমি কথা জুগিয়ে দেব, তুমি ইন্ডিয়ায় এস।

আমি তো তাই আছি। মুগ্ধ চোখে জিন্নতকে দেখতে-দেখতে সে বলেছিল।

না তা নেই, তবে শাদির পর হলে হতি পার। জিন্নত বলতে-বলতে তার হাত ধরেছিল, দ্যাখো, আমি ওই ফরেনে শাদি করলা যদি ফরেনি হই যাই, তুমি তো তেমনি ইন্ডিয়ায় শাদি করে ইন্ডিয়ার হতি পার।

কী করে হবে? জিজ্ঞেস করেছিল হবিব।

শাদির পর তুমি এই ইন্ডিয়ায় এসে থাকো। জিন্নত বলেছিল।

তখন ভুটার কাড হবে?

হবে, রেশন কাডও হবে।

কন্টোলের কেরাচিন?

হ্যাঁ, আমু আর তুমু এক ঘর, ডবল কেরাচিন।

ইন্ডিয়ার বিপিয়েল?

হ্যাঁ, বিপিয়েল।

নিজির নামে মুবাইল?

হ্যাঁ, মুবাইল।

সেই কতা হেরাতুনের কানে যেতে সে খরখর করে উঠেছিল। মেয়ের ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কী করে হবে? মেয়েমানুষই তো পুরুষমানুষের ঘরে সংসার করতে যায়। কে শুনেছে পুরুষমানুষ আসে মেয়েমানুষের ঘরে? ইন্ডিয়ার ছিটের মেয়ে বিয়ে করে ও ইন্ডিয়ার লোক হয়ে যেতে চাইছে। জানে না তখন জিন্নতের বিপিয়েল, কেরাচিন, ভুটার কাড, রেশন কাড… সব জমা করে যেতে হবে ইন্ডিয়ায়। খালি হাতে খালি ঘরে ঢুকতে হবে। সোয়ামির দেশই বিবির দেশ হয়।

হবিব বলল, আমি তারে সুখে রাখতাম আম্মু, কী হয়ে গেল।

বুড়ি হাঁ করে চেয়ে থাকল হবিবের দিকে। আবার সে ভাবল এক, বলল আর এক।

তুই সুখে রাখতিস না দুখে রাখতিস তা শুনিয়ে লাভ কী? যদি সুখেই রাখতিস তো মেয়েকে বের করে আনতে পারতিস নাজিরহাট গিয়ে? দেখতে পেলে তোকে বিএসএফের হাতে তুলে দিত জিন্নতের শ্বশুর হাতেবর মিঞা, নাজিরহাট পঞ্চায়েতের প্রধান। সে জেনে গিয়েছিল সব। এই নিয়ে অশামিত্ম ছিল। তবে হেরাতুন গিয়ে বলে এসেছিল, বাংলাদেশি ছিটের আদমি এই করে ইন্ডিয়ার হয়ে যেতে চাইছে, মেয়ে আমার ভালো, পবিত্র কুমারী, জান্নাতের হুরি, আসমানের পরি।

শুনে একদিনেই পর্দা, বোরখায় তাকে ঢেকে দিয়েছিল শ্বশুর। কাঁটালের মাছির মতো ভনভন করছে ইবলিশ পুরুষমানুষের চোখ। তারা শুধু বেপর্দা মেয়েমানুষের জোয়ানি দেখতি চায়। পাকা ফলের মতন সে টুসটুস করেতেছে। ঢেকে রাখ তার সব। নইলে বাদুড় এসে ঠোকর মেরে যাবে। মেয়েছেলেকে ঢেকে রাকতি হয়। যেমন তুমি গয়নাগাটি ঢেকে রাখো তেমনি নিজিরিও ঢাকো। হেরাতুন শুনে এসেছিল তা মেয়ের কাছে। আহা, অমন রূপ ঢেকে দিল। তার মনে হয়েছিল, মাথার উপরের নীল আসমান, ঢেকে গেল মেঘে, সেই ভুটান পাহাড় সবুজ মাঠ সিঙ্গিমারি নদী… সব ঢেকে গেল কালো পর্দায়। পর্দার ভিতরে মেয়ের চোখে পানি। দেখতে পেত হেরাতুন।

কী বলতি এয়েচ তুমি ফরেনি? হেরাতুন জিজ্ঞেস করে।

কিছু না আম্মু, তুমারে দেখতি এলা। বলল হবিব।

আম্মু তো মরেনি।

আম্মু, সে ভালো আছে, দুঃখু করনি। বিড়বিড় করে বলতে থাকে হবিব। তাকে কথাগুলো শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠিয়েছে এরফান আলি। সে হাত কচলায়, আম্মু, তার কোনো কষ্ট হবেনি, আল্লা নিজির কাছে টেনে নেছেন তারে।

আমার কপাল, মরার পর গোরে শুয়ে ভালো থাকুক মন্দ থাকুক, আমার কী, আমি কী দেখতি পাব হে। বলতে-বলতে হেরাতুন বেওয়া ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

হবিব এসেছিল জোহরের নামাজের পর বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ হয়ে আবার ইন্ডিয়ায়। মানে ছিটের পর ছিট পেরিয়ে। হবিব বসেছিল উঠোনে তালপাতার চাটাইয়ে। বুড়ি মাথা নিচু করে কাঁদছিল। হবিব হাত কচলে বলল, ছিট হয়ে সবেবানাশ আম্মু, ছিট না হলে আমি জিন্নতরে বিবি করতে পারতাম।

হুম। বুড়ি মাথা তুলে দেখেছিল হবিবকে।

হবিব বলেছিল, এই মদনাকুড়ি যদি বাংলাদেশ ছিট হতো, তাহলিও আমি জিন্নতরে ঘরে তুলতে পারতাম।

বুড়ি ফোঁস করে উঠেছিল, কেনে, আমরা রাজার পোজা।

রাজার পোজা তো আমরাও ছিলাম আম্মু। হবিব বলেছিল।

তোদের ত্যাগ করেছিল রাজায়। বলতে-বলতে হেরাতুন বেওয়া উঠে গিয়েছিল। তার শোক কমে গিয়েছিল আচমকা। তারা যে রাজার প্রজা ছিল শেষ অবধি এ বড় অহঙ্কারের জায়গা। এই মদনাকুড়ি নাকি কোচবিহারের রাজা জিতে নিয়েছিল রঙ্গপুরের নবাবের কাছ থেকে। পাশা খেলায় বসল দুই প্রভু। রুপোর টাকা ঝনঝনাত পড়তে-পড়তে ফুরিয়ে গেল। তখন জমি বাজি। জমি মানে মৌজা। বাজিতে রাজা তাদের মদনাকুড়ি জিতে নিয়েছিল। বাজিতে হারেনি রাজা। বুড়ি কেমন যেন ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছিল হবিবকে। জিন্নত ছিল ওই আসমানের এক তারার চোখের পানি। তা ভুঁইয়ে নামতে গিয়ে বুড়ির গায়ে এসে পড়েছিল। সোয়ামি শেষবারের মতো তাকে বীজ দিলো। লোকটার তখন রোগ ধরে গেছে। কিন্তু তাতে যেন তার তেজ কমেনি। তারার চোখের পানি প্রাণরস হয়ে এলো তার ভিতরে।

বুড়ি হেরাতুন নিজে যৌবনকালে যতটা ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল জিন্নত। জিন্নতের মুখ ছিল খাস পুন্নিমের চাঁদ। টানা-টানা চোখ, ছোট কপাল, মাথাভর্তি চুল, সেই চুল পাছা ছাড়িয়ে নেমেছিল নিচে। গায়ের রং কাঁঠালি চাঁপার মতো। বুকদুটি ভরে উঠেছিল সেই বাড়ন্ত বয়স থেকেই। বুড়ি তাকে শুধু সতর্ক করত। নিজের মেয়েকে অবাক হয়ে দেখত। কোন অঙ্গ ছেড়ে কোন অঙ্গ দেখবে পুরুষ? অমন যৈবন, ভ্রমর তো আসবে। এসেছিলও। ওই হবিব। বাংলাদেশি ছিটের হবিব। তাদের বহুদূরের কেউ ছিল তারা। এখন আর কেউ না। আবার পাকিসত্মান হয়ে বাংলাদেশ হয়ে যেতে, আরো কেউ না। সেই হবিবের সঙ্গে আশনাই করেছিল জিন্নত। তা জানতে পেরে খোদ ইন্ডিয়ায় শাদি করিয়ে দিলো। নাজিরহাটে সংসার করতে গেল মেয়ে কাঁদতে-কাঁদতে। হবিবকে দেখে হেরাতুনের এখন মনে হলো, ওর হা-হুতাশই মেয়েটার ওই পরিণতির জন্য দায়ী। হবিবকে বলেছিল, তুই যা দেখি, তুই তো ফরেনি, তোর জন্যি আমার মেয়েটা মরেচে, তোর দিষ্টি পড়েছিল ওর উপর।

হবিব মাথা নিচু করে বলল, আম্মু আমি ওরে পেয়ার করতাম।

পেয়ার! তুই বাংলাদেশি ছিটের লোক, ভিনদেশি, ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ আলাদা।

মুই কদিন ধরে ঘুমুতি পারছি নে।

হেরাতুন বলল, তুই যা, তুই নিশ্চয়ই তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলি, নইলে তার খালাস আমার হাতে না করিয়ে হাসপাতালে দেয়, আর মরার পর বলে সে না পাক হয়ে গিছিল, তাই বাঁচল না, ভালোই হয়েচে না বেঁচে, না পাক বলল কেনে আমার জিন্নতকে?

হবিব বলল, মুই আর কোনোদিন নাজিরহাটে যাইনি।

তুই মুবাইলে মিসেজ দিতি পেয়ার করে, পেয়ার জানিয়ে।

না আম্মু, আমি আজান দিই, ইমামতি করব কদিন বাদে, মুই মিসেজ দিই নে, তা না পাক হতো।

হেরাতুন বলল, তুই মিথ্যেবাদী, চলে যা, যা গে গোরসত্মানে গে কাঁদগে যা।

হবিব চলে যেতে-যেতে হেরাতুনের ডাক শুনে ফিরে তাকিয়েছিল। হেরাতুন বলেছিল, তারে বন্দি করে ফেলল পর্দায়, আলো ঢেকে দিলো কালো বোরখায়, তুই তখন আসিস নি কেনে?

হবিব বলল, মুর দেশ নাই আম্মু, না ইন্ডিয়া না বাংলাদেশ, মুর বিপিয়েল, কেরাচিন, ভুটার কাড, বিডিও পঞ্চায়েত, কিছুই নাই, জিন্নতও থাকলনি, পরের ঘরে বিবি, তাই আসিনি, কী হবে এসে, মুই কী করতাম এসে?

অমন সুন্দর বিটি মুর, তারা বলে, না পাক হয়ে গিছিল, তাই মরেচে। হা-হা কান্নায় ভেঙে পড়ল হেরাতুন। কত মানুষের জন্মদুয়ারে ডাক দিয়ে সে কতজনকে এই ভূম-লে নিয়ে এসেছে, নিজের মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে মরেছে বাচ্চাসমেত, এই হাহাকার যাবে না। শোনা যাচ্ছে আর একবার তারার চোখের পানি পড়েছিল আসমান থেকে। যাকে পেটে ধরেছিল জিন্নত, সে ছিল পরমা সুন্দরী। কিন্তু না পাক হয়ে গিয়েছিল সেই তারার চোখের পানিও। তাই তাকেও নাকি রাখেনি। বেঁচে ছিল। বাঁচতে দেয়নি। প্রধানের কত ক্ষমতা। জন্ম মৃত্যু, পবিত্র অপবিত্র সব তার হাতে।

কী হতো মুই এলা?

নিয়ে পলাতি না হয় ইন্ডিয়ার ভিতরে। বলতে-বলতে হেরাতুন ঘুরে গিয়ে গরগর করে উঠল, পেয়ার করতিস বলা করছিস, উ টুকুন করা যেত নি, জিন্নত তুর জন্যি কালো বুরখার ভিতরে চোখের পানি ফেলত নিত্য।

হবিব বলল, না পাক হতো।

কী হতো?

না পাক হতো আম্মু। হবিব ধীরে-ধীরে বলল।

কেনে?

মনে-মনে বেপর্দা হওয়া না পাক আম্মু, উটা ঠিক হতো নি।

হেরাতুন অবাক হয়ে হবিবকে দেখতে লাগল, একটু দম নিয়ে বলল, তুই শাদি করে পর্দা দিতিস, কালো বোরখা?

হবিব বলল, জওয়ানি হলে মেয়েমানুষের পর্দা নিতে হয় আম্মু, মেয়েমানুষের যৈবন না-ঢাকা অপবিত্ত, না পাক।

হেরাতুন গরগর করে ওঠে, পাকা ক্যাঁটাল তো, আর তুই নীল ডুমো মাছি, যা যা যা, আমার সামনে থেকে যা।

ওইভাবে কথা কয়োনি হেরাতুন বেওয়া। গর্জে উঠল হবিব। এতদিনে এই প্রথম নিজের কথাটি নিজের মতো করে বলতে পারল সে। বলল, মুই ছিটের হলেও মসজিদের মুয়াজ্জিন বটে, উপরআলার কুনো দেশ নাই হেরাতুন মাগি, চুপ করে থাক,  তুর বিটির কথা ভাব, পদ্দার নিচয় চোখের পানি, উয়ার চেয়ে গুনা আর কী হয়, কবিরা গুনা, জানা ছিলনি, জানলাম। বলতে-বলতে হবিব পা বাড়াল তার ছিটের দিকে। আসরের নমাজের টাইম হয়ে গেল। আজান শোনা যাচ্ছে ইন্ডিয়ার ভিতরে বাংলাদেশের ছিট থেকে ইন্ডিয়ার ভিতরে ইন্ডিয়ায়।