অপ্রকাশিত আটটি কবিতা

সৈয়দ শামসুল হক
এক

সমস্ত দিনের ক্লান্তি
লাল নীল জামা
সমস্ত রাতের কষ্ট
ভয়াবহ বীজ বৃক্ষডালে
জামা আমি ঝুলিয়ে রেখেছি
কতকগুলো কর্কটবৃক্ষের পায়ে
রোপণ করেছি
এখন অনেক রাত
এক্ষুনি শিশির ফোঁটা ফোঁটা
ঝরে পড়বে
মাটির গভীর থেকে জেগে উঠবে কষ্ট
আর ক্লান্তির দু’টি দগ্ধ গাছ
আর আমার করোটি জলে সাঁতরাবে
খেলা করবে লাল নীল
নিষ্পলক কতিপয় শব্দ – মানে মাছ ॥

১৩/৯/২০১৬
সকাল ১০-১৫ মি.
ইউনাইটেড হাসপাতাল
দুই

কাল রাতে ভালো ঘুমিয়েছি
ব্যথাবিদ্ধ ক্লান্তক্লিষ্ট বেদনার স্বর
সমস্ত সমুদ্রের গভীর ভেতর
শয্যা পেতে শুয়েছিল
আর আমি মজ্জমান ছিলাম
না কষ্টে না বেদনায়
এক সোনালি খড়ের মতো ভাসমান
আসন্ন ভোরের প্রথম আলোয়।
এ কি স্থায়ী হবে
থেকে যাবে রক্তের গভীরে
শালিকের ঠোঁট থেকে খসে
আনন্দের তুমুল চিৎকার হয়ে
যতদিন শ্বাস।
কর্কটের পুষ্পডালে সবুজ শব্দের
আবার উত্থান দেখে
আমিও উত্থিত প্রসন্ন এ ভোরে
নৌকোর আভাস দেখে লাল সূর্যের নিচে
ধীরে ধীরে পাল ওঠাতেছে
নতুন গন্তব্য দিকে

গন্তব্যের শেষে তুমি দু’হাত বাড়িয়ে।
কাল কোনো কষ্ট ছিল না
আমি ভালো ঘুমিয়েছি
ব্যথাবিদ্ধ বেদনার মুহূর্ত সকলি
সবুজ সমুদ্রের নিচে শুয়েছিল
মৃত মাছ হয়ে ॥

১৪/৯/২০১৬
সকাল ৬-৩৫ মি.
ইউনাইটেড হাসপাতাল

তিন

একা হাতেই তো
একা হাতেই তো
এই একা হাতেই তো
এই মেয়েটি কাছেই কাছে আছে
যেন একটি সবুজ পাখি যন্ত্রণার গাছে
পাখা নাড়ছে
পাখা নাড়ছে
এক্ষুনি সে যাচ্ছে আমার কষ্ট নিয়ে
তার হলুদ দু’টি ঠোঁটে
এই মেয়েটির নামের আদি অক্ষরে যে ম
তাকেই আমি মঞ্জু বলি তাতেই উপশম
একটি মেয়ে পাশেই আছে
কাছেই আছে সবুজ দেহ নিয়ে
বাংলা মায়ের মাঠের সবুজ
কী অপরূপ ঝরছে তার অঙ্গে
জন্ম নিয়ে এই যে বেঁচে রয়েছি
ব্যথা বেদনায়
সেই বেদনা এই সবুজে কখন
মুছে যায় ॥

১৪/৯/২০১৬
সকাল ৬-৪৮ মি.
ইউনাইটেড হাসপাতাল

চার

ভৈরবের মন্দ্র সুরে একটি একটি করে
জেগে উঠছে বাংলার সবুজ ঘন পাতা
আবার সেই মরা নদ
ভৈরবের শুকনো খাদে জল উঠছে জল
তার এ কি কলরোল
ফলবান বৃক্ষের শব্দে সফলতার উদ্যান
তৈরি করছে আজ এই ভোরে
আর তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে
সুসংবাদগুলো
যা আমি এখনো দেখতে পাচ্ছি না
এভাবেই তো হয়
মৃত্যুর ভেতর থেকে নিশ্চয় এই ফল একদিন
সুস্বাদু হয়ে আমাদের স্বাস্থ্য দেবে
কবি নবীনচন্দ্রের মতো আবার
নতুন কোনো কবি
মরা ভৈরবের পাড়ে এসে
সন্ধ্যাকালে দাঁড়াবে
তার গর্জনে গর্জনে জীবনের সুসংবাদগুলো
আবার এক নবীন কবির কানে পৌঁছবে।
তার উন্মুক্ত মুখের গহ্বর থেকে
ভৈরবের জল আবার প্রবাহিত হবে এই যশোরে
দড়াটানা পুলটির পাশে
আর আমি তার সেই কবিতার লিখন নেবো
আমার এ কম্পিত বিদায়ী হাতের কলমে।
দাঁড়াও, নবীন তুমি ভৈরবের কাছে এসে দাঁড়াও
আবার তোমার পায়ের অপেক্ষায় আছে এই ভোরে
ভৈরবের বাদন কালে পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে।
এই স্তম্ভনের ভেতরেই
পৃথিবীর সুসংবাদগুলো আম্রপালি হয়ে ঝুলে
আমার সংগ্রহ করবার অপেক্ষায় ॥

১৪/৯/১৬
সকাল ৭টা
ইউনাইটেড হাসপাতাল
পাঁচ

বেলা উঠে যায়
লাল হয়ে যায়
আকাশ ভৈরবী রাগে
এ কি এ সুন্দর শোভা
রবীন্দ্রনাথের মতো
দেখিনি তো আগে ॥

১৪/৯/২০১৬
সকাল ৭টা
ইউনাইটেড হাসপাতাল
ছয়

জেগে উঠে হঠাৎ দেখলাম চোখে
দূর সেই বরিশালে ধানসিঁড়ি নদীটিকে আমি
নিস্তব্ধ জলের বুক কবিতার দীর্ঘ পঙ্ক্তি হয়ে অপেক্ষায় আছে।
তার বুকে একটি নির্জন চিল ঘুরে ঘুরে
কেঁদে যাচ্ছে
ভাষা দাও, কথা দাও এই স্তব্ধ সংসারে
আবার জল প্রবাহিত করো
আমার পায়ের কাছে
আমার কলমে তুমি সেই কালি দাও
যে কালিতে জেগে ওঠে কালীদহ
চাঁদ সদাগর
যে জলে আবার তার ডিঙার বহর ভাসায়
এখন স্তব্ধ তুমি কবিতার দীর্ঘ কোনো পঙ্ক্তির মতো
হয়তো মানুষ নয়
দেবতার কণ্ঠস্বর হয়ে
আবার আসিবো ফিরে
এই বাংলায়

১৪/৯/২০১৬
সকাল ৭-১৫ মি.
ইউনাইটেড হাসপাতাল

সাত

অকস্মাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়
আগুন পাখির সারি তারায় তারায়
রাত উঠে আসে মগ্নতায়
ঘুম ভেঙে যায়
কৌন দূর সংগীতে মন্ত্র মূর্ছনায়
এত অলৌকিক স্থির মগ্নতায়
কে বা কোথায়
নীরব স্বরোদ হয়ে একে একে
পাপড়ি খসে যায়
ভোর হয়ে আসে
নদী আবার ঘুমোয়
ছলছল আধকোষা নদীটির জলে
আমার স্বপ্নের শব্দ সোনার ডিঙায়
ঘুম ভেঙে যায়
নৌকো ঘিরে বাংলার অক্ষর নিয়ে
নবান্নের দিকে তার সোনার পসরা
নিয়ে নামাতে যে যায়
সঙ্গীতের মূর্ছনায় মর্মের ভেতরে বাজে
সুরে সুরে সেই গান হাজার বছর ধরে
জীবনের পূর্ণিমায় নারীকণ্ঠ উত্থানের
উত্তর বাংলায় ॥

১৫/৯/২০১৬
রাত তিনটে
ইউনাইটেড হাসপাতাল

আট

কর্কট বৃক্ষের নিচে মাথা গুঁজে
শুয়ে আছে সাপ
শেয়াল চিৎকার করে
জীবনের বাড়ে মনস্তাপ
ঠোঁটে চান্দ আধখানা শব্দ নিয়ে
ছড়ায় যে অমাবস্যা তার অন্ধকারে
সাপের মাথার মণি জ্বলজ্বল করে
ফণার ভেতরে তার মৃত্যু
নাকি আমারই তা দোলে
আমি শুয়ে আছি মঞ্জু তোমারই…

১৫/৯/২০১৬
রাত তিনটে দশ
ইউনাইটেড হাসপাতাল
অনুলিখন : আনোয়ারা সৈয়দ হক