ভূমেন্দ্র গুহের সৌজন্যে
৩৪-সংখ্যক কবিতার পান্ডুলিপির খাতা থেকে
৩৪/৬৮
ভোরের বেলা এই সাগরের নিঃশব্দ বাতাসে
দু’-একটা শুকতারা মর্মর পাথরের মত হয়ে আসে
মুছে যায় আকাশের থেকে
এখানে ভোরের স্পষ্টতায় সব উঁচু গাছ নিজেদের শান্ত ছায়া দেখে
নয় মাইল সান্ত্বনার কথা বলে যে যাহার পাশে
সে-সব গাছের দেহ পৃথিবীতে ম’রে গিয়ে আজ
এইখানে জেগে আছে সুত, মিত, নারীর সমাজ
আধো দাঁড়ায়েছে হয়ে চেয়ে আছে ব’লে১
সমুদ্রের শেষ পথে ভোরবেলা ঢেউএর বিনয়২
নীরব মানুষ, পাখি, রৌদ্র নিয়ে এইখানে৩ থামায় জাহাজ
মাইলটাক সিন্ধু এই : ধানসিড়ি নদীটির রেখা
নিঃস্বার্থ মুখের ভাবে সুদূরের মাইলগুলো তারই মত একা
সুশোভনা হোড়’কেও৪ এক বার আধ-বার বলি আমি একাগ্রতায়
কাহারও বুকের ’পরে হাত রেখে; সকালের বাতাসের স্বাভাবিকতায়৫
এসে সে৬ ছুরির মত ছানির ভিতরে খুলে দেখা দিয়ে যায়৭।
বিকল্প : ১. আধো-আলোকিত মনে হয়; ২. উদয়; ৩. কিছু ক্ষণ/ ক্ষণে-ক্ষণ; ৪. বনলতা সেন’কেও/ ইন্দিরা সান্যাল’কেও/ চারুবাক দেবী’কেও/ বনবীথি সেন’কেও; ৫. আলোর হাওয়ায়/ মির্মির হাওয়ায়; ৬. তবে সে; ৭. দিয়ে যায় দেখা।
৩৪/৬৯
জলের স্তব্ধতা আজ জেগে আছে এইখানে সমুদ্রবেলায়১
নির্জন পাম’এর ভিড় যে যাহার, পৃথিবীর স্থান বদলায়
সাত সমুদ্রের শব্দ সুদূরের মাইল থেকে এইখানে এসে
গলার আস্পর্ধা খাটো ক’রে নিয়ে শেষে২
নুড়ির ভিতর কিছু মুড়-মুড় শব্দে ভেঙে যায়৩
হয়ে এলে তুমি এই কিনারায় এক নারী – একাকী এখন
জনতার যে যাহার যখন মিশেছে তার জন-সাধারণ৪
হৃদয়ে ঘুমের পথে৫ – চারি-দিকে তবুও নীরব
সিন্ধুর পায়রাগুলো সে-রকম৬ আমাদের দু’জনের চোখ অনুভব
ক’রে ফেলে উড়ে যাবে৭ সময়ের৮ শব্দের মতন।
সকাল ও বিকেলের শুকতারা কখন কাহাকে
বিকেল বা ভোরবেলা দেখা যায় আকাশের ফাঁকে
সেই কথা শেষ ক’রে এইখানে সকল সময়
পরিচিত সাদা আলো ব’লে মনে হয়৯
খুলে আসে – বুজে যায় – গণনা-বিজ্ঞানী সব ঘুঘু’দের ডাকে
পৃথিবীতে ঢের দিন রাষ্ট্র-ভাষাভাষীদের ভাগে১০
বাটোয়ারা হয়ে তবু তাহাদের আগে১১
এখানেই সুখ পেয়ে তবুও শান্তির জন্যে কান পেতে থেকে১২
তোমার শাড়ির সাদা শরীরকে সামাজিক রমণীর মতন বিবেকে
দেখেছি নিজেরই ছায়া খুঁজে নিয়ে –
দুইটি ছায়া ঝিনুকের মত জোড়া লাগে।
বিকল্প : ১. বিকেলবেলায়; ২. কণ্ঠকে নমিত করে রৌদ্রের ছবির মত শেষে; ৩. উপলের বুকে লেগে অধিক স্তিমিত হয়ে যায়; ৪. জনমানবের সাথে যখন মিশেছে এসে জন-সাধারণ; ৫. ঘুমের ভিতরে কারু – চারি-দিকে তবুও নীরব; ৬. তেমনই জলের লোক; ৭. বয়ে যায়; ৮. শিশিরের; ৯. আধো-সাদাববিন’এর মত মনে হয়; ১০. এক দিন পৃথিবীতে রাষ্ট্র ভাষাভাষীদের চাপা বীতরাগে; ১১. অথবা মৃত্যুর পর সেই সব মৃতদের আগে; ১২. মির্মিরিত সাদা কাপড়ের সঙ্গে কান পেতে থেকে।
৩৪/৭০
যে-সব মানুষদের ঢের দিন ভালোবাসি আমি
আজ এই গোলমালে হারায়ে ফেলেছি
তাদের ভিতর থেকে একজন দু’জনের মুখ মনে ক’রে
যখন তোমাকে পেয়ে গেছি – দেখেছি কঠিন তুমি সামাজিক নারী
কোথায় তোমার সাথে দেখা হয়েছিল – পাশে এসে দিয়েছিলে আড়ি
সেই কথা ভালো ভাবে স্থির ক’রে নিতে
দু’পকেটে হাত রেখে মনে হয় – তুমি
এক দিন আমাদের নগরের পথে – পৃথিবীতে
হেমন্তের গ্যাস-আলোকে সমিতিতে দেখা দিয়েছিলে
কী ক’রে তখুনি তবু পাড়াগাঁ’র ধানসিড়ি নদীর এ-পারে
ও-পারে দাঁড়ায়ে এই আমলকী-ফলের মতন পৃথিবীকে
ধারণ করেছ তুমি সে-রকম লঘু ব্যবহারে
কী ক’রে লঘুতা এল – আজও আমি জানি না ক’কিছু
কোনও দিন জানা হবে না কি
ভিড়ের ভিতরে তুমি সকলের নিজের জিনিস
হয়েও আমার কাছে আমার একাকী
আশ্চর্য বস্ত্তর মত জন-মত; প্রান্তরের পথে
ঈশ্বরের চেয়ে কিছু কম গরীয়ান
নদী বা মানুষী১ এক – তবুও শরীরে
কৌটিল্য’র চেয়ে২ বেশি জ্ঞান।
বিকল্প : ১. মেধাবী মানবী; ২. ম্যাকিয়াভেলি’র চেয়ে/ প্লেটো’র চেয়েও।
৩৪/৭১
আমিও অনেক দিন ভেবে গেছি আলো অন্ধকারে
আমার জাতির তরে লিখে যাব দু’-চারটে কথা
যাহার ভিতরে জ্ঞান সে-রকম১ পরিশুদ্ধ নয়
রয়েছে জ্ঞানের সরলতা
কোনও এক মানুষীকে – ভালোবেসে – ভুলে
শতাব্দীর গোলমালে – তার পর – পড়েছে স্মরণে
কোথাও দেখেছি যেন কোনও এক মানবকে আমি
সারা-দিন ভ্রূকুটিল মুখ ক’রে মনে
প’ড়ে যায় তবে তাকে – হেমন্তের সকালবেলায়
যেন আমি কবেকার মৃত কুকুর’কে ডেকে দিই যদি শিস
(দিই যদি) তবে সেই কুকুর’এর পিছে তার মনিবের মত আজ সময়ের পথে
আমিও মৃত্যুর জীব; পৃথিবীর প্রাণের জিনিস
সাদা সাধারণ কোট গায়ে দিয়ে জীবন চাকায় ঘুরে চলে
কেবলই ঘড়ির শব্দে ব’লে যায় ঠিক – ঠিক – ঠিকই –
যত আমি বলি তাকে ভুল – ভুল – ভুল –
তার গুণে ম্যামথ হয়েছে টিকটিকি
তবুও সে প্রেতচ্ছায়া দেখে এক-চুল
পায় না ক’ভয়
সমাজকে গ’ড়ে – ভেঙে – পুনরায় গ’ড়ে
তবু তার আস্থাবান মনের বিনয়।
বিকল্প : ১. তত দূর।
কোনও এক বিশ্বাসীকে
৩৪/৭২
চেয়ে দেখি চারি-দিকে ডায়াস’এর প’রে
যাদের বসার প্রয়োজন তারা বসে
সজীব১ কফি’র প্রয়োজন যাহাদের
চা ছাড়া২ ছড়ায় খসখসে
মাইক্রোফোন’এ ঝড়ের জলের মত৩ কথা ব’লে যায়
তবুও তা হয়ে যায় ততোধিক তিতো৪
আমি তার প্রথম প্রতিভা ভালোবাসি
তার পর অমায়িকতায় অবহিত
হয়ে থেকে টের পাই – বহু দিন থেকে মৃত আমি
বরাবর নিম্ন নরকের দিকে ঝোঁক
শেয়াল বানর শনি শকুন’কে চিনে নিই আমি৫
শকুনপনায় আজও৬, হে চেতনালোক।
বিকল্প : ১. নিবিড়; ২. নির্ঝর; ৩. নদীর শব্দের মত; ৪. যে-কথা দু’-চার বার শুনে নিয়ে; ৫. আজও; ৬. আমি
অনেক পোলিটিক্যাল মিটিং’এর পরে।
৪৩/৭৩
চেয়ে দেখি যে যাহার পরিচিত স্থানে এসে বসে
প্রভাত জাগায়ে তোলে পৃথিবীর রোজ
রাতের ভিতর থেকে যে-রকম অবলীলা-ক্রমে ভোর নামে
সে-রকম স্বাভাবিক নয়, তবু তেমন সহজ
আপনার প্রকীর্তিত স্থান অধিকার ক’রে বসা
কবলে এনেছে যারা যে যাহার স্থান
প্রাগৈতিহাসিক মাছ বহু দিন ধ’রে
আপনার ঐতিহ্য-প্রমাণ
ক’রে লক্ষ বৎসরের জন্ম দিয়ে যায়
পুনরায় লক্ষ বৎসরের
মহাপৃথিবী ছেড়ে তিলের ভিতরে
হেস, মান, হ্যালিফ্যাক্স রূপসির গালের তিলের
সঙ্কুলান আছে জেনে জন-পরিজন নিয়ে আমি
ঢুকেছি যখন মুখ মায়াবীর বলে
আমাদের সকলকে অভ্যর্থনা ক’রে তারা যে যার আসন
পুনরায় নিয়ে গেল নিজের দখলে
কী ক’রে বিহিত তবু করা যায় এর
পৃথিবী সহজ আজ হয়তো-বা – তবুও অধিক
স্বাভাবিক না হয়ে সে অবিকল কলের আমোদে
যতই ব্রহ্মান্ডে ব্যাপ্ত হয়ে যায় ততই অমেয় আণবিক।
বিবিধ ইন্টারভিয়্যু’র শেষে
৩৪/৭৪
যদি বলি মানুষকে ঘৃণা করি আমি
তা হলে তা ভুল বলা হবে
অসত্য মানুষ, তবু অগণন হয়ে ওঠে রোজ
বিকেলবেলায় এই কুয়াশার মতন নীরবে
তবুও মানুষ সব যখন ভেবেছি পাখি আমি মনে-মনে
আমরা দু’জনে হেসে তবুও কঠিন ব্যথা পেয়েছি গোপনে
অনেক জীবন লোক চ’রে যায় চারি-দিকে আজ
একটি মৃতকে আজ মনে পড়ে হেমন্তের খেতে
কখনও-বা বেবিলন’এ জন্মেছিল কোনও এক দিন
এক-একটি শরীর সব সদ্যতন অভিনেত্রীর নতুন অঙ্ক ও
জ’ন্মে – ম’রে – শেষ হয়ে গেছে আজ ধুলোর ভিতরে
যদি আমি মনে করি তখুনি জীবন মনে পড়ে
অথবা মরি নি আমি
আরও ঢের নগরীর পথে বিবর্তন
রয়েছে শকুন, সূর্য, বৈষয়িক, বিলোচন হয়ে
কখনও পাখির মন, কখনও-বা মানুষের মন
অধিকার ক’রে নিয়ে শুনে যাব সর্বদাই দময়ন্তী উড়ায়েছে হাঁস
ব’লে টিটকারি দেয় সব কাজ শেষ হলে সন্ধ্যার বাতাস।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.