অমলের সময়

কালীকৃষ্ণ গুহ
অমল, আমার সময়?

সমীর সেনগুপ্ত

পত্রলেখা
কলকাতা, ২০১০

১৭০ টাকা

সময়ের কি কোনো অস্তিত্ব আছে? প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়াই হয়তো ভালো। তবু বলি সময়ের কোনো বাস্তব ও স্বনির্ভর অস্তিত্ব দেখতে পাই না আমরা, অথচ জীবন দিয়ে মেপে দেখতে গেলে দেখতে পাই শেষ পর্যন্ত সময়ই একমাত্র সত্য আর সত্য তার সহোদরা শূন্যতা। সময় ও শূন্যতার মিলিত যে-অবস্থান তার আধারেই এ-বিশ্বসৃষ্টি, যার তল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তো সময়ের অস্তিত্ববিষয়ক প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া অথচ যেতে গিয়ে সহসা প্রশ্ন শুনতে হয়, ‘অমল, আমার সময়?’ প্রশ্নটির অর্থ আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এ-প্রশ্নের বেদনা আমাদের মর্মে এসে লাগে। প্রশ্নটি করেছেন সম্প্রতি প্রয়াত ভাবুক লেখক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ সমীর সেনগুপ্ত। বলা যায়, তিনি তাঁর একটি প্রবন্ধ-সংকলনের মলাটে প্রশ্নটি এঁকে দিয়েছেন। প্রশ্নটির পাশে একটি মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছেন তিনি নিজের হাতে। আর, তার কিছুদিন পর, আমাদের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেগ ঘটিয়ে, বিস্ময়াবিষ্ট করে, বিদায় নিয়েছেন। পত্রলেখা-প্রকাশিত এ-সংকলনটি নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য এ-লিখনপ্রচেষ্টা।
ছোটবড় ২২টি নিবন্ধ নিয়ে গঠিত এ-বইটি থেকে আমরা পাই দুটি দিগন্ত। একটি ঘটনাবলির বিবরণে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ, অন্যটি লেখকের জীবনভাবনায় ঋদ্ধ। প্রশ্ন দুটি অবশ্য পরস্পরজড়িত, যা হওয়া অনিবার্য। প্রথম নিবন্ধে – ‘অমল, আমার সময়?’ – লেখক বুঝতে চেয়েছেন, একজন মানুষের জীবনে কোন সময়টা তার সময় – তার একান্ত নিজস্ব সময়। লেখক তাঁর জীবনের ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের ১০ বছর সময়কে অর্থাৎ ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫-র সময়কে নিজের সময় বলে নির্ধারণ করেছেন। কারণ, লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী – ‘এই সময় জীবন ছিল সবচেয়ে ঘন, সবচেয়ে দ্রুত, সবচেয়ে রহস্যময়, সবচেয়ে তরঙ্গময়, সবচেয়ে প্রশ্নময়, সবচেয়ে বেশি দুঃখের, সবচেয়ে বেশি সুখের। যদি কোনো সময়কে আমি বুঝে থাকি, তাহলে সেটা এই একটি দশক। আমি যা হয়েছি, আমি যা হইনি, আমি যা হতে পারতাম সবই এই দশটা বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গি।’ এ-কথা বলার পর লেখক এই এক দশকব্যাপী কালখণ্ডকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন একের পর এক নিবন্ধে। অসাধারণ এ-অবলোকন।
‘বড়ো হওয়ার আরম্ভ’ নিবন্ধে এসেছে শৈশব-কৈশোরের কিছু স্মৃতিকথন, যেমন স্বাধীনতা, দেশভাগ, গান্ধীহত্যা ইত্যাদি। কিন্তু লেখক জানাচ্ছেন, ‘এখন পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে ক্রমে আবিষ্কার করছি, অন্যমনস্কতার একটা অভেদ্য আস্তরণ দিয়ে আমার অস্তিত্বটা মোড়া ছিল। দেশ কাঁপানো যেসব ঘটনা আমার সময়ের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে সেগুলোর প্রায় কোনোটাই আমাকে তেমন স্পর্শ করেনি, সারাজীবনের কোনো সময়েই না।’ আসলে প্রতি সময়ই এক অর্থে সমসাময়িকদের কাছে স্বাভাবিক সময়। প্রাণের বা জীবিকার ওপর আক্রমণটাই শুধু স্বাভাবিক নয়। দেশবিভাগে, দাঙ্গায়, দুর্ভিক্ষে যারা কোনোক্রমে বেঁচেছে তারাই শুধু ওইসব সময়ের ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছে। বরিশালের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসক পিতার কর্মসূত্রে লেখকের পরিবার সেভাবে বিপদ বা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েননি। দর্শকের জায়গা আর ভুক্তভোগীর অবস্থান ঠিক এক নয় কখনই। তবু লেখকের এ-অবলোকনটি মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এ-বার্তাটিকে যে সমস্ত সময়েই জীবনের মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা থাকে, নিরুদ্বেগ চলমানতা থাকে।
এখানে বলে নেওয়া যাক, কে এই লেখক সমীর সেনগুপ্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে লালিত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ কৃত্তিবাসী কবিদের বন্ধু – বুদ্ধদেব বসু ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জীবনীকার এবং, সব থেকে বড় কথা, রবীন্দ্র-গবেষক হিসেবে এ-মুহূর্তে স্বনামধন্য। রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন এবং রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা নামের দুখানি কোষগ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে তাঁর নাম রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে বহুকাল উচ্চারিত হবে, এই আমাদের ধারণা। এ দুটি গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে তিনি যে ধৈর্য, মেধা ও মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন তা অবিস্মরণীয়। বস্তুত সওদাগরি অফিসের চাকুরে হিসেবে জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়ে একসময় স্বেচ্ছাবসর নিয়ে প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় এসে তিনি পড়ার টেবিলে বসে পড়েন। সেখান থেকে মৃত্যু পর্যন্ত (২৩ ডিসেম্বর ২০১১) আর ওঠেননি বলা যায়। আলোচ্য বইয়ের ‘সোনার হরিণ চাই’ নামের প্রবন্ধে তিনি লিখছেন – ‘খিদে পেলে যদি ডালভাত আলুসেদ্ধ জুটে যায় তাহলেই ঢের; যদি আশি বছরও বাঁচি, তাহলেও জীবনের তিন-চতুর্থাংশ পার করে দিয়েছি প্রায়; বাকি সময়টুকু আমার নিজের ইচ্ছেমতো কাটাতে চাই।’ এই ছিল তাঁর পড়ার টেবিলে বসে পড়ার প্রাককথন, স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার প্রাককথন। তিনি সারাজীবন যেভাবে কাটিয়েছেন, যেসব ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে বসবাস করেছেন তাঁদের কথায় ভরা এই বই যে-কোনো জিজ্ঞাসু বাঙালি পাঠকের হাতের কাছে থাকার মতো। বুদ্ধদেব বসুর ঘনিষ্ঠ ছাত্ররা, প্রায় সকলেই, তাঁকে অনুসরণ করেছেন কথা-বলার, উচ্চারণে, বিষয় নির্বাচনে, এমনকি জীবনযাপনের ধরনে ও মূলবোধে। সমীরও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না, অন্তত শুরুর দিকে। এ-বিষয়ে সমীর লিখছেন ‘বুদ্ধদেবকে রক্ষা করেছিল অহংকার – সাহিত্যিক, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর গগনচুম্বী অহংকার। কিন্তু আমার তো সে অহংকার নেই। কোনো রকম অহংকার করবার যোগ্যতাই নেই। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমার দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। এটা প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি।… ভাগ্যকে ধন্যবাদ যে আমি খুব তাড়াতাড়ি সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম – নিজেকে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলাম পথচলতি জনতার সঙ্গে।’ এ কথা বলা সত্ত্বেও আমরা দেখেছি যে, গবেষকের চেয়ারটিতে বসে তিনি যে-জীবন কাটালেন তা নিরহংকার জীবন হলেও ঠিক পথচলতি জনতার সঙ্গে তাঁর মিলিত হওয়ার অবকাশ বেশি ছিল না। আর ওই গবেষকের আসনটিতে তিনি যে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছিলেন, তার পেছনে ছিল তাঁর শিক্ষক বুদ্ধদেব বসুর আদর্শ।
রামকৃষ্ণ মিশন-পরিচালিত বিদ্যামন্দির নামের কলেজে তিনি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা করেন। কিন্তু এই আশ্রমিক জীবন তাঁর ওপর কিরকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা তাঁর কথাতেই শোনা যেতে পারে, ‘বিদ্যামন্দিরে থাকার সময় আমার মনোজগতে দুটি বড়ো বড়ো পরিবর্তন হয়, যা পরবর্তীকালে আমার ‘আমি’ হয়ে ওঠবার প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। একটি হলো, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আমার আস্থা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল – ঢুকেছিলুম চিন্তাহীনভাবে ঐতিহ্যবাহী হিন্দু হিসেবে, বেরিয়ে এলুম মানবতাবাদী কট্টর নাস্তিক হয়ে।’ তাঁর মধ্যে সেইসঙ্গে, দ্বিতীয় পরিবর্তন হিসেবে, এই বোধের জন্ম হলো যে, কবিতা পড়ে গান শুনে ছবি দেখে একধরনের সার্থক জীবন কাটানো যায়। অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মাচরণ জীবনের যে-শূন্যতা পূরণ করে তা করতে পারে কবিতা ছবি গান। তা মানুষের মনে আনে সেই বোধ যা বিমূর্ততা ও ‘অলৌকিকে’র সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। বলা যায়, ঈশ্বরবিশ্বাস হারিয়ে ধর্মাচরণ ত্যাগ করে সমীর আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের যোগ্য পাঠক হয়ে – শিল্পের জন্য গভীরতর আকুতি নিয়ে – যাদবপুরে এলেন। এখানে তাঁদের অন্যতম শিক্ষক নরেশ গুহ প্রথমেই শিখিয়েছিলেন ‘সাহিত্যপাঠের অআকখগুলি।’ বুঝিয়েছিলেন ‘যেসব মূল্যবোধ জন্মসূত্রে পাওয়া সেগুলি সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না – যে কারণে মাতৃøেহ নিয়ে কবিতা হয় না, দেশপ্রেম নিয়ে বড়ো সাহিত্য রচিত হতে পারে না – যদি ওই ভাবনাগুলিকে কোনো বৃহত্তর ও অপ্রাপ্য বেদনার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া না যায়।’ মানতেই হবে, বেদনার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে থাকলে কোনো গান বা কবিতাকে আমরা খুব উঁচু স্থান দিতে পারি না। একটা পরিব্যাপ্ত বেদনাবোধই সৃষ্টিকর্মের হয়তো প্রাথমিক শর্ত, তার অন্ধকার প্রস্থানভূমি।
পঞ্চাশের দশকের এক মহাচরিত্র, কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দীপক মজুমদার সম্পর্কে সমীর সেনগুপ্তের মন্তব্য মনে রাখার মতো, ‘সারা জীবন ধরে দীপক চেষ্টা করে গেছে অন্য রকমভাবে ভাববার, অন্যরকমভাবে বাঁচবার। ওর সেই চেষ্টা সুখের হয়নি। ওর নিজের পক্ষেও সুখের হয়নি। যাদের নিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করেছিল তাদের পক্ষেও সুখের হয়নি। হয় না, বিশ্ববিধান একজন দীপক মজুমদারের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু দীপকই একমাত্র যে সারাজীবন ধরে চেষ্টা করেছিল, মোম দিয়ে পালক জুড়ে জুড়ে পাখা বানিয়ে উড়ে যেতে চেয়েছিল সূর্য পর্যন্ত।’ কবি গায়ক জ্ঞানী নাট্যপরিচালক অভিনেতা বিপ্লবী এবং শেষ পর্যন্ত স্বোপার্জিত ব্যর্থতায় বিলীন হয়ে যাওয়া এ-মানুষটিকে দেখে আমরাও ধন্য হয়েছি। দীপকের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় চরিত্র হয়তো জ্যোতির্ময় দত্ত। এই বইয়ের বিভিন্ন আলোচনায় ফাদার ফাঁলো, ফাদার আঁতোয়ান, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, শক্তি-সুনীল-সন্দীপনসহ কৃত্তিবাসের লেখক-কবিদের বহু গল্প ছড়িয়ে রয়েছে। সবই আকর্ষক। আছে প্রতিভা বসুর কথা, বুদ্ধদেব বসুর পাশে যাঁর ছিল নিজস্ব একটা কর্মজীবন, ভাবজীবন। ইনি আশ্চর্য একজন মহিলা নিঃসন্দেহে, যিনি যৌবনের গায়িকা হিসেবে বিপুল খ্যাতি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সংসার নির্বাহের জন্য কলম ধরলেন এবং শেষ পর্যন্ত লিখলেন মহাভারতের কথার সমান্তরালে পাণ্ডিত্যবর্জিত একখানি অত্যাশ্চর্য বই মহাভারতের মহারণ্যে। বইটি মহাভারতের একটি সার্থক বিনির্মাণ, যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহাভারতকারের ঘোষিত বার্তার বিপরীত বার্তা ধ্বনিত হয়েছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সর্বক্ষণের বন্ধু ভক্তপাঠক ও ব্যাখ্যাতা হিসেবে সমীর সেনগুপ্তের প্রতিষ্ঠা সর্বজনবিদিত। একাধিক বই তিনি লিখেছেন শক্তির নানা কাণ্ডকারখানা নিয়ে, পুরো জীবন নিয়ে, কবিতা নিয়ে। এখানে একটি নিবন্ধের শেষে লিখছেন, ‘অচৈতন্য শক্তিকে পরিষ্কার করে নিজের জামাকাপড় পরিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি, একসঙ্গে বেড়াতে গিয়ে শক্তি আমার গেঞ্জিপাজামা কেচে দিয়েছে। কিন্তু তবুও ওকে ভালো করে চিনিনি কখনো। আমাদের জীবনবৃত্ত অতি ক্ষুদ্র জ্যা-তে পরস্পরের কক্ষ অতিক্রম করে। আমি সামান্য মরণশীল… সরস্বতীর মথিত চুম্বনে যার ওষ্ঠ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে তাকে কেমন করে চিনব?… মানুষ শক্তিকে দেখেছি খানিকটা, কবি শক্তি তার রচনার আড়ালে চিরকাল অপরিচিত থেকে গেছে।’ তুলনামূলক সাহিত্যের ক্লাসের তাঁর ছাত্রদের সিগারেট খাওয়াতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশ গুহের প্যাকেট থেকে সিগারেট প্রায় কেড়ে খেত তাঁর ছাত্ররা। এসবই যেন একটা মুক্তির অপরিচিত হাওয়া বইয়ে দেওয়ার জন্য। ফাদার আঁতোয়ান বন্ধু সুধীন্দ্রনাথের চিতার সামনে গেয়ে উঠেছিলেন ‘তবু প্রেম নিত্যধারা, হাসে সূর্য তারা -। প্রতিভা বসু অভিমানবশত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি-উপহার, এইসব বহু অবাক করে দেওয়ার মতো কথায় খচিত এ-বইটি। সীমিত পরিসরে সেসব কথার বিস্তারে না-গিয়ে ভাবুক হিসেবে সমীর সেনগুপ্তকে কিছুটা চিনে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তাঁর নিজের কথা থেকেই তাঁকে চিনে নেওয়া যাক।
১. বুড়ো না হবার হাজার আকর্ষণেও আমি মেনে নিতে পারব না আমার রুচির উপর জনগণেশের বলাৎকার; তার চেয়ে আমি বরং থাকব নিজের ঘরে প্রবাসী। লোকের কাছে আমার পরিচয় হোক কুতার্কিক বলে, আশাহীনভাবে অবাস্তববাদী বলে, এমনকি খিটখিটে বুড়ো বলে। সমস্ত দেশ যখন পেটজোড়া খিদে আর হাতজোড়া কম্পিউটার নিয়ে একুশ শতকের দিকে মিছিল করে এগিয়ে চলেছে, আমি তখন নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পুরোনো অ্যালবাম খুলে হলদে হয়ে যাওয়া ছবি দেখব। কিন্তু মিছিলে সামিল হব না।
কারণ, আমারও নেই ঘর – আছে ঘড়ির দিকে যাওয়া। (‘এ পরবাসে’)
২. এবারে গুছিয়ে বসতে হবে চুপচাপ, সব কোলাহল বারণ হল। উদ্ভাসিত রঙ্গভূমি অন্যদের হাতে ছেড়ে দাও। দর্শকদের গ্যালারিতে বসো এসে। সিংহের মুখে মাথা ঢুকিয়ে দেবে অসমসাহসী খেলোয়াড়, পাশে বসা রমণী কেঁপে উঠবে, তাকে শান্ত করো। সে জানে না তুমি খেলোয়াড়ের গুপ্তকতা জানো। রমণীর স্মরণ নেই, একদিন তোমার ওই খেলা দেখেই মুক্ত হয়ে সে তোমাকে বরণ করেছিল। (‘পঁয়তিরিশে পৌঁছে’)
৩. জীবন বয়ে চলেছে, শুধু মানুষের মধ্য দিয়ে তো নয়, পশুপাখির মধ্য দিয়ে, গাছপালার মধ্য দিয়ে – সেই বহতা স্রোতের সঙ্গে নিজের জীবনটাকে কোনোভাবে যুক্ত করে দিতে পারলেই হৃদয়ের ভিতর থেকে জীবন আপনিই কথা বলে উঠবে। (‘সাতষট্টিতে পৌঁছে’)
৪. কোনো কথা ভাবতে যাওয়া কোনো তর্কের মধ্যে প্রবেশ করা অর্থহীন বলে মনে হয়। আমি শুধু জানলায় বসে থাকি, পাখি দেখি, পোকামাকড় দেখি, রাস্তার কুকুরদের দেখি। ওই যে সুন্দর শালিকটি পোকা ধরে খাচ্ছে, কল্পনা করতে পারি, আমার কাছে ডাইনোসর যেমন বীভৎস মৃত্যুর প্রতীক, পোকাদের কাছে ওই শালিকটিও তেমনই। কিন্তু তা জেনে আমার কী হবে, পূর্ণসত্যে তো আমার অধিকার নেই, খণ্ডসত্যের বাইরে কিছু জানবার এখতিয়ার নেই আমার।… আমার চোখের সামনে রোদজ্বলা শিশিরভেজা ঘাসের ওপর শালিকেরা নেচে নেচে বেঁচে চলেছে। এই কি আমার পক্ষে যথেষ্ট নয়? (‘দিন যায়’)
৫. আমি নাস্তিক হতে পারি। কিন্তু আধুনিক নই। আমি মানুষের ধর্মে বিশ্বাস করি। ভালোবাসায় বিশ্বাস করি, মানুষের শুভবুদ্ধির উপর আস্থা রাখায় বিশ্বাস করি। বরং মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকতে রাজি আছি। কিন্তু অবিশ্বাস করে মনের শান্তি নষ্ট করতে রাজি নই। ঈশ্বরের মঙ্গলময়ত্বে বিশ্বাস করি না। কিন্তু সর্বজীবের মঙ্গলকামনায় বিশ্বাস করি, মানুষের চিরকাল ধরে হয়ে ওঠায় বিশ্বাস করি। স্বপ্ন দেখি এমন এক পাসপোর্টহীন পৃথিবীর, যেখানে কোনো শিশুকে পেটে খিদে নিয়ে ঘুমোতে যেতে হয় না। (‘নাস্তিকের ধর্মবিশ্বাস’)
যিনি নিজের সময়কে আবিষ্কার করে তাকে বুঝতে চেয়েছেন, যিনি নিজের সময় পার হয়ে এসে গ্যালারিতে চুপ করে বসে দেখেছেন সিংহের মুখে মাথা ঢোকানোর খেলা, যিনি কোলাহল থেকে, মিছিল থেকে, তর্ক থেকে একসময় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসেছেন। যিনি পশুপাখি পোকামাকড় আর গাছপালার মধ্যে নিজেকে প্রসারিত করতে চেয়েছেন, তিনি – অনেকের মধ্যে একজন – লিখে উঠতে পেরেছেন এ-বইয়ের লেখাগুলো। নক্ষত্রখচিত একখণ্ড আকাশের মতো এ-বই। লিখতে লিখতে বা, বলা উচিত, ভাবতে ভাবতে একটা দার্শনিক পরিসরের সরলতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন সমীর সেনগুপ্ত। আমার সৌভাগ্য, তাঁর সঙ্গে কিছুকাল, তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত, মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।