অরুণাভ সরকারের কবিতা

রেজাউদ্দিন স্টালিন
যে-আপনজন বেঁচে নেই; তাঁকে নিয়ে লেখা দুরূহ। কারণ তিনি আলোচক কিংবা কবিতার ব্যাখ্যা শুনতে অপারগ। বেঁচে থাকলে আরেক রকম ব্যাখ্যা হতো। এ পর্যন্ত কবিতা ও কবিবিষয়ক মহৎ সব আলোচনার সিংহভাগ সাধিত হয়েছে কবির অবর্তমানতায়। কিন্তু সব আলোচনা যদি হয় কবির মৃত্যুর পরে, তাহলে চলবে কীভাবে? কবি জীবদ্দশাতেই জানতে চান – তাঁর কাব্য-ভাবনা কতটা অন্যদের উদ্দীপ্ত করতে পেরেছে। আমার অগ্রজ অনেক প্রিয় কবি আছেন, যাঁদের কবিতা আমার পছন্দ, তাঁদের কবিতা নিয়ে কথা বলতে, লিখতে ইচ্ছে করে কিন্তু সবসময় তা করি না এ-কারণে যে, আমার বোধের লঘুত্ব হয়তো তাঁদের কাছে ধরা পড়ে যাবে। আজ অনেকটা সাহস করেই আমার প্রিয় কবি অরুণাভ সরকারকে নিয়ে আমার কিছু কথা লিখতে চাইছি, যখন তিনি আমাদের মাঝে নেই। তবে কবি এখনো আছেন মনোবিশ্বে। এই আলোচনা তিনি পাঠ করবেন কি-না তা আমি জানি না, তবে সব জেনেশুনেই লিখছি এ-কারণে যে, আমার যে-কোনো ভুল ও অজ্ঞতা তিনি ক্ষমা করে দেবেন – কারণ তিনি অনুজ হিসেবে আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। ষাটের দশকের শুরুতেই অরুণাভ সরকার কবিতার পৃথিবীতে আসেন। আমি তাঁর নাম জানতে শুরু করি ১৯৭৮ সাল থেকে। ইত্তেফাক ও সংবাদে মাঝে মাঝে তাঁর লেখা পড়তাম। খুব নিটোল। ধরে ধরে চিন্তা করে অর্থবহ শব্দ দিয়ে লেখা কবিতাগুলো। খুব দীর্ঘ নয়, কিন্তু পাঠ করার পর একটা অনিঃশেষ  কিছু থাকে, ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। চমৎকার। আবার যখন কবিতাগুলো আলোচনার জন্য পড়ছি, তখন আরেকরকম মুগ্ধতা। হেরাক্লিটাসের সেই অবিনশ্বর  উক্তি – ‘গতকালের মানুষ আজকের মানুষ নয়, এরা আগামীকালের মানুষ হয়ে উঠবে না।’ আমরা অনবরত পালটাই এবং বদলে যায় – একটি কবিতার প্রতিটি পাঠ, প্রতিটি পুনর্পাঠ এবং সেই পুনর্পাঠের প্রতিটি স্মৃতি আর পাঠ্যটির পুনরাবিষ্কার। পাঠ্যটি হেরাক্লিটাসের নদীর পরিবর্তন। ক্রোচের তত্ত্বকে স্মরণ করতে ভালোলাগে এ-মুহূর্তে – সাহিত্য এক অভিব্যক্তি এবং সাহিত্য কিংবা কাব্য শব্দনির্মিত আর ভাষা একটি নান্দনিক প্রক্রিয়া। অনেকে এর সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু প্রত্যেকের মধ্যে এর ধারাবাহিক ব্যবহার লক্ষণীয়। এই ধারাবাহিক নান্দনিক ব্যবহার আমি কবি অরুণাভ সরকারের কবিতায় পেয়ে যাই। আর সত্যিই আনন্দিত হই এবং পাঠ করি। পুনর্পাঠের মধ্য দিয়ে আমার আগের নান্দনিক ধারণাকে বদলে নিই এবং অবশ্যই নতুন এক ধারণা উদ্যাপন করি। কবিতা কোনো গ্রন্থাগারের বই নয় কিংবা  এমারসনের ম্যাজিক চেম্বারের বই নয়। কবিতা হলো বইয়ের সঙ্গে পাঠকের মুখোমুখি দ্বৈরথ, অন্যার্থে বইয়ের আবিষ্কার। কবি অরুণাভ সরকারের কবিতার বই নারীরা ফেরে না। এই গ্রন্থ আমার জন্য এক ভিন্ন নান্দনিক অভিজ্ঞতা। পুরো এক নতুন  চিন্তা, যার ভেতর কবি তাঁর কর্মকে ধারণ করেছেন এবং আবিষ্কার ও উচ্চারণ করেছেন। To invent and to discover একই অর্থ বহন করে। কিন্তু বাংলায় এই আবিষ্কারকে আমি প্ল্যাটোনিক তত্ত্বানুসারে উদ্ভাবন বলব – নতুন কিছুর আবিষ্কারের চেয়েও মহত্তম কিছু। ফ্রান্সিস বেকন এই উদ্ভাবন শব্দটির সঙ্গে একমত। এভাবে ঘটে, কেবলমাত্র আমরা দেখতে পাই না। কবি যখন লেখেন, ধরে নিই সেই সংবেদন, যা আগেই ছিল, জিনিসগুলো যেমন ছিল, তেমনি তারা অবগুণ্ঠিত ছিল। কবি হিসেবে প্রকৃত কাজটি হলো তাঁদের দেখা। ব্রাডলির কথা এখানে বলতে ইচ্ছে করে – কবিতাবলির প্রতিক্রিয়ার একটি হলো, এ কেবল কোনো কিছু নতুন আবিষ্কারের ধারণাই দেয় না, দেয় আমরা যা ভুলে গেছি তার কিছু আশ্চর্য স্মরণীয়তা; এটা আমরা যখন ভালো কবিতা পড়ি, কল্পনা করি – আমরাও এ লিখতে পেরেছিলাম, অর্থাৎ কবিতাটি ইতোমধ্যে আমাদের অভ্যন্তরে ছিল। অরুণাভ সরকারের একটি কবিতার উদাহরণ দিই – কবিতাটির নাম ‘সে’।

সে খুব দূরের নয়, শুধু ডাকার অপেক্ষা
এখন রয়েছে বসে থাবা পেতে
সামান্য তুতু-তে এসে লুটোপুটি খাবে
চুমু দেবে পায়ের পাতায় –
ছুটে গিয়ে, কামড়ে দেবে যাকে বল তাকে
সাপখোপ বৃক্ষলতা, ব্যক্তি ও ব্যষ্টিকে
সে খুব দূরের নয়, শুধু ডাকার অপেক্ষা

এই অভিজ্ঞতাটি আমাদের ভেতরেই আছে। প্রিয় বশংবদ কিন্তু থাবাময় হিংস্রশৈলী। আমরা এই উদ্ভাবনকে আমাদের ইন্দ্রিয়ের পারঙ্গমতা সঙ্গে মিলিয়ে নিলে আমরা প্ল্যাটোনিক  জগতে প্রবেশ করতে পারি। অভীপ্সাপূর্ণ, পরিবর্তনশীল, পবিত্র জিনিস এবং নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, কবিতা একটি নান্দনিক অভিজ্ঞতা আর কবিতার শিক্ষালাভ ঘটাবে এক অভ্যুথান বা বিপ্লব। আমি বিশ্বাস করি, কবিতা অনুভবে, প্রশিক্ষণে নয়। এখানে অরুণাভ সরকারের আরেকটি কবিতা উদ্ধৃত করছি :

 

তাই কি ভাল ছিল
বরং যদি মৃত্যু হতো ভ্রূণে
জীবন হতো কেবলই প্রস্থান
ভোরের ঘুমে কাকের ডাক শুনে
এমন করে হতো না উত্থান
তাই কি ভালো ছিলো?
তাই কি ভালো, তাই কি ভালো ছিলো
যদি আমার মৃত্যু হতো ভ্রূণে
এই যে এত অন্ধকার, আকাশ ভরা নীল ও
কোনো রেখাই টানতে না এক্ষুনে
তাই কি ভালো ছিল?

এই যে উচ্চারণের অভিনবত্ব মৃত্যুচিন্তায় দগ্ধ কবি, যা আমাদের অভিজ্ঞতাকে জাগিয়ে দেয়, বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে দোদুল্যমান করে দেয় এবং না জন্মাবার সীমানাকে চিহ্নিত করে। এই অভিজ্ঞতায় একটি ভিন্নপাঠ জীবনানন্দ দাশে পাই বারবার নানারূপে জন্মাবার সাধ তাঁর। ‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়, হয়তো বা হাঁস হবো কিংবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে কিংবা ঘাস হবো অথবা কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়।’ জীবনানন্দের ফিরে আসার মধ্যে যে নান্দনিক অভিজ্ঞতা তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অভিজ্ঞতায় কবি অরুণাভ সরকার ভ্রূণাবস্থায় মৃত্যুকে শ্রেয়জ্ঞান করেছেন। ষাটের দশকের অনেক কবির ভাবনায় এই মানবজীবনকে প্রশ্ন করার প্রয়াস দেখেছি। আবুল হাসানের কবিতায় পেয়েছি এরকম অসংখ্য লাইন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় তিনি বলেই  বসলেন – ‘আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে’। ষাটের কবি হুমায়ূন আজাদ বললেন, ‘এ আমার সময় নয়, আমি জন্মেছি অন্যদের সময়ে’। যে-কবি যে-সময়েই জন্মাক, সে-সময় ও সমাজ তার মনঃপুত হতে পারে না। মিল্টনের একটি সনেটে তিনি তাঁর অন্ধত্বকে নিয়ে বলেছেন, ‘তাঁর অন্ধকার জগৎ ও তার বিস্তার’। স্পষ্টভাবে অন্ধের জগৎ যখন তারা একা, হাঁটে হাত দুটো গ্রন্থের দিকে ছাড়িয়ে এবং খোঁজে অবলম্বন। আমরা এ-পর্যায়ে অন্য আরেকটি উদাহরণ স্মরণ করতে পারি। জেমস জয়েসের জীবনদর্শনে এক অদ্ভুত চরিত্র পাই – Portrait of an Artist as a youngman গ্রন্থে এর নায়কের অনুভব এবং গ্রন্থটির ভেতরে অসীম কবিতার উপাদান, যা ঘটেনি এবং যা ঘটতে পারত তার দিকে। এডগার এলানপো জানতেন এরকম এক জগতের কথা, তবু তিনি বলেন, আমি আমার নিজের সঙ্গে থাকতে চাই। উপভোগ করতে চাই। ভালো সেসবের জন্যে স্বর্গের কাছে ঋণী।

আমি বিশ্বাস করি, একজন কবি হয়ে-ওঠার কাজ সম্পূর্ণ হয় না কোনো নির্দিষ্ট সূচিতে। কেউই আটটা থেকে বারোটা কিংবা দুটো থেকে ছয়টা এভাবে কবি হয়ে ওঠে না। যেই কবি হোক সে সবসময়ের এবং সবসময় কবিতার দ্বারা অনবিরত তাড়িত। কয়েক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের দিকে নোবেল বিজয়ী গুন্টার গ্রাস এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনিও বাংলা একাডেমির এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমি কবিতার দ্বারা তাড়িত। সম্প্রতি সাংবাদিক ও লেখক এলিজাবেথের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্নটি ছিল কবিতা, ড্রয়িং ও ভাস্কর্য – এ তিনটি কাঠামোর মধ্যে আপনার কাছে কোনটি কি অর্থে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে? গুন্টার গ্রাস উত্তর দিয়েছেন, আমার কাছে কবিতা অনেক বেশি অর্থবহ। একটি উপন্যাসের জন্ম হতে পারে একটি কবিতা থেকে। আমি বলছি এটাই শেষ কথা। তবে আমি কবিতা ছাড়া কিছুই গড়ে তুলতে পারব না। এ-বিষয়টাকে আমি খুব সরাসরি দেখি। কবি অরুণাভ সরকারও কবিতা বিষয়টাকে সরাসরি দেখেছেন বলে আমার ধারণা। সরাসরি দেখার একটা দৃষ্টান্ত দিই। প্রশ্ন কবিতা।

ইতিহাস কি রোমান্টিক কবি!
গায়ের বাউল?
অসীম ক্ষমায় চলে যাবে দোতরা বাজিয়ে?
এই প্রশ্ন করেছিল অনিচ্ছুক যোনির শোণিত
ভিখারির বুকের পাঁজর
রাজপথে থেঁতলানো এক কিশোর দেহ

বাংলা কবিতায় আরো অনেক প্রশ্ন আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ ছিলো – ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠিয়েছো বারে বারে, দয়াহীন সংসারে/ তারা বলে গেলো ক্ষমা করো সবে বলে গেল ভালোবাস/ অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষনাশো/ বরণীয় তারা স্মরণীয় তারা তবুও বাহির দ্বারে/ আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।

রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নের চেয়ে অরুণাভ সরকারের প্রশ্নের ব্যবধান কয়েক যোজন। এ এক নাগরিক কবির নির্মম অভিজ্ঞতায় দগ্ধ প্রশ্ন। এবং তীব্র সরাসরি আর কিছুটা কটাক্ষ কলাকৈবল্যবাদীদের নন্দনবোধের প্রতিও। রৌদ্রের জন্যে এপিটাক কবিতায় অরুণাভ সরকার ভবিষ্যদ্বাণী করেন –

… সূর্যোদয় খুব লাল হবে, কাল, কালকেই

লাল ও সুন্দর
কালকের সূর্যের মুখে
মেঘের বসন্ত চিহ্ন নয়দ
নিকট সাগরে কোনো নিম্নচাপ
দৈনিকের পাতা জুড়ে শোকপ্রসূ বিশাল ব্যানার

তিনি কেন অকস্মাৎ আগামীকালের সূর্যোদয়কে লাল বললেন – সূর্যোদয় তো লালই হয়। নাকি আগামীকালের সূর্যের সঙ্গে রক্তের কোনো সম্পর্ক থাকবে? রক্তে ভেজানো ব্যানার কি সুন্দর হয়? হতে পারে, কেননা সে তো বিজয়প্রসূ। আর তা না হলে দৈনিকের পাতা জুড়ে শোকের ব্যানার হবে কেন? একি অরুণাভ সরকারের আগাম মৃত্যুচিন্তা এই কবিতাটি প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণের জন্য নতুন প্রতিনির্দেশ করে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা গোলাকার ও অগ্নিময় এই গোলকের নাম দিয়েছে সূর্য। ইংরেজিতে এর নাম sun এবং পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় সূর্য শব্দটি একই দ্যোতনাবাহী। কিন্তু যখন তা আগামীকাল অবশ্যম্ভাবিভাবে উদিত হবে এবং অবশ্যই লাল। পাঠক কি ভাববেন সূর্য কখনো হলুদ ছিল? যদি হলুদ হয় তা হলে বিষয়টি আমাদের কাছে কী নিয়ে আসে – হতাশা না আনন্দ? এ বিষয়টির মতো সম্পূরক একটি কবিতা জীবনানন্দের : ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে – আকাশে-আকাশে’। আকাশ নীল এবং তা ছড়িয়ে থাকে কিন্তু কবি যিনি বলেন, যে নীল হয়ে ছড়িয়ে আছে তখন যে অনন্ত অনুভূতি আমাদের আক্রমণ করে, পুরনো ধারণাকে বিপর্যস্ত করে, তাকেই বলে কবিতার মুখোমুখি হওয়া – কবিতার সঙ্গে সংঘর্ষ।’ কবি কার্ডুসির একটা বিখ্যাত লাইন শুনি – ‘মাঠগুলোর সবুজ নিস্তব্ধতা’র মধ্যেই আমরা মাঠের বিশালতা এবং তার নিরবচ্ছিন্ন নীরবতাকে পেয়ে যাই। আরেক নীরব সত্যের মতো একটা পটভূমি পাই যেখানে সব রং  আছে হলুদ, নীল, বাদামি, লাল, কালো এবং ধূসর একটি লাইনের মধ্যে – ‘শুধু একবার চলে গেলে/ নারীরা ফেরে না।’ অরুণাভ সরকার এই নগরে থেকেও একটা বড় মাঠের, একটা নীল আকাশের, একটা স্বাধীন দেশের কবি। নগরে থেকেও তিনি বাউল। তাঁর অনুপস্থিতিতেও তিনি অনিবার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।