অলস লিপি-লিখা

সুবর্ণা চৌধুরী

আমাদের বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ভাইবোনদের ঘুম ভেঙে সকালের প্রথম কাজ ছিল বাবার কাছে ধ্রম্নপদী সাহিত্যের পাঠ নেওয়া।  বাবা বাড়িতে থাকলে সেটা অত্যাবশ্যক বিষয় ছিল। ব্যত্যয় ছিল দেশের বাইরে থাকা দিনগুলো আর একাধিকবারের দীর্ঘ হাসপাতালবাস। সেসব পাঠ অতিঅবশ্যই স্কুলের পাঠ্যক্রমের বাইরের বিষয় – সাহিত্যের হাত ধরে এসে পড়ত বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ আর কিছু শিশুতোষ দার্শনিক তালিম। তারও আগে থাকত আমার গলা সাধার পাট। এরপর ছোটরা জেগে উঠলে পরে সেই বাধ্যতামূলক পাঠ এবং অতঃপর অন্যসব – সকালের নম্র হন্টন, শ্বাস-প্রশ্বাস চর্চা ও প্রাতরাশ। স্কুল, পরীক্ষার পড়া ইত্যাদি কম প্রয়োজনীয় কাজের গুরুত্ব সেসব জরুরি চর্চার তুলনায় তত নয়। মাঝে মাঝে অনধ্যায়ও ছিল, সেদিন কোনো বই পড়া নিষেধ। সেদিন প্রকৃতির পাঠ। পরীক্ষা আর পড়া অপেক্ষা করতে পারবে, মেঘ তো কারো জন্য বসে থাকবে না। খুব বৃষ্টি হওয়ার আগে যেদিন মেঘকালো আকাশ, সেদিন মেঘ দেখাও তো খুব জরুরি … তাই না?

আমাদের ভাইবোনদের জন্য একবার একজন গৃহশিক্ষক এলেন। তিনিও সুনির্বাচিত এবং কোনোক্রমেই কম রসিক নন। তাঁকে নির্বাচনের কারণ বোঝা গেল প্রথম সাক্ষাতেই। এসেই প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়ো, কেমন লাগে – এসব। আমার সঙ্গে আলাপপর্বে শেষ অবধি এইখানে এসে দাঁড়াল :

– গত পরীক্ষা কী রকম হলো?

– হলো একরকম।

– কেন একরকম কেন? ভালো নয় কেন?

– জানি না।

– ভালো। ফলাফল কী?

– দ্বিতীয়।

– তাই?

তারপর তিনি শান্তশিষ্ট নিরাসক্ত স্বরে বলতে শুরু করলেন – আচ্ছা, বলো তো দেশে স্কুলের সংখ্যা মোট কত? আর প্রতিবছর শুধু বাংলাদেশের সব স্কুলে প্রতি ক্লাসে যে অসংখ্য বাচ্চা প্রথম হয়, তারা শেষ পর্যন্ত কী হয়, কই যায়? তারা কি সবাই সফল মানুষ হয়? ভালো মানুষ হয়? তাহলে চাওয়াটা কী হওয়া উচিত? চাওয়াটা কী হওয়া উচিত সে নিয়ে তারপর থেকে কতই না ভেবেছি। এখনো ভাবি। তবে পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার কথা আর কোনোদিনই ভাবিনি।  আমার সেই শিক্ষক পরে খ্যাতনামা একজন হয়ে উঠেছিলেন। নামটা না হয় থাক না। …

তো সেরকম আশ্রমের দিনে – আমার তেরো বছর পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনের সকালেও যথারীতি ঘরে গান বাজছিল। সেদিন ছিল চিত্রাঙ্গদা। নতুন হরষে চিত্রাঙ্গদার গলায় গান – বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে … চিত্রাঙ্গদার বিবর্তন ও চরিত্র আলোচনার পরে আববার প্রাসঙ্গিক নির্দেশ – আলো-টালো লাগলে প্রথমে আমাকে বলতে হবে! একটু ভেবেটেবে বুঝলাম – ওহ রে, এ-কোন আলো। এ-ও বুঝলাম – গানটা তো আগে ঠিকমতো বুঝিনি, আববাই বুঝিয়ে দিলো – স্পষ্ট আদেশ মারফত! যখন সত্যি আলো লাগল, আই উইশ আই কুড টেল আববা। কোনো কোনো বাবা এরকম হয়। যাওয়ার তাড়া ছিল কে জানত? শুরু করলেন কিন্তু শেষ হয়নি আমার পাঠ নেওয়া। সেই অসমাপ্ত তালিমের জায়গায় একটা ফাঁকা ছিল। তবু সেই ফাঁকা তো ফাঁকা রয়ে যায়নি। ভরে উঠেছে আপন নিয়মে। নিজের সচেতন চিমত্মায়, অবচেতনের আবছায়া অনুভবে করণীয় স্থির হয়েছে আপন গতিতে। খুব সহজ-সরল নিয়মে। মায়ের অটল নির্দেশে, চারদিকের সত্যগুলোকে সেই শৈশবে পাওয়া তালিমের আলোয় বিশি­ষ্ট করে করে একদিন আমরা বড় হয়ে গেছি।

ভূগোল শিখিয়েছিল, কেন্দ্রাতিগ আর কেন্দ্রাভিগ – ওই দুই শক্তির টানে পৃথিবীটা ঠিকঠাক চলে – ভারসাম্য রেখে। আমাদের পৃথিবীর ওই দুই প্রান্তে – বাবা আর মা। আববা যখন বিবর্তনবাদ আর প্রগতিশীল শিক্ষার তুমুল তালিম দিচ্ছেন – পাঠশেষে আমরা কিন্তু ফিরে যাচ্ছি মায়ের চূড়ান্ত রক্ষণশীল জীবনচর্চায়। ওইখানে কোনো ছাড় নেই, ওই দুইয়ের দ্বন্দ্বে-দ্বিধায় তৈরি আমাদের লালিত শৈশব – ভাবনালোকে আমরা যখন ধুলায়-ঘাসে মুক্তি খুঁজি আলোয় আলোয় – বস্তুত আমরা তখন প্রথাগত চর্চাতেই রত অবিরত। আমরা মানে আমরা ভাইবোনেরা – যারা এখন প্রতিকারহীন তিন মহাদেশের বাসিন্দা। – তিন ভুবনে জীবন কাটাই – আহা জীবন! একদিন দুখী মনে ভাবতাম কবে আবার সবাই এক শহরে ফিরব। এখন জানি সে আর কোনোদিন হবে না। অফিসফেরত বিকেলের চা একটেবিলে আর কোনোদিন হবে না। হবে না, এটাই সত্যি। আমার শৈশব ফিরে পাওয়ার আদিখ্যেতা নেই। সবসময় বড়ই হতে চেয়েছি। কিন্তু সেই মানুষগুলোকে তো চাই। অবিরাম চেয়ে এসেছি – আকুলতায়, আনন্দে। ফেরেনি কিছুই। না মানুষ। না সময়। তবু ওগো সুখী শৈশব – তুমি কি ফিরে আসবে? কখনো? রুপালি চুলের ভাঁজে, বলিচিহ্নের খাঁজে, অভিমানী মনস্তাপে?

পেরিয়ে আসা সময়ের ছায়া তবু ভেসে আসে কখনো অবসরে, অথবা অসম্ভব ব্যস্ততার গুহার ভেতরে, সুড়ঙ্গের ভেতরেও প্রাসঙ্গিকতার মৃদুতম সুযোগে খুব ঝলসে ওঠে আমার আপাতনিরীহ জ্বলজ্বলে শৈশব। উদ্বাস্তু কৈশোর আর বিহবল তারুণ্যের সিঁড়ি ভেঙে আমার বড় হয়ে ওঠার ধাপে ধাপে জমে থাকা কত পুরনো প্রিজমের বর্ণিল দ্যুতি ঝিলিক দিয়ে জানিয়ে যায় – ওরা ছিল, ওরা আছে, এখনো। আমার মগজের বেহিসেবি নিউরনের ওপরে প্রথম অধিকার তো ওদেরই। সেই ঝিলিকে মিশে থাকে নম্র নিরহংকার প্রথা, থাকে গত দিনের আধোচেনা নতুনের ডাক  – উন্মুখ! সেইখানে তুমুল ছুটে আসে কত প্রতিবাদী হইরই, প­vবনের দিন, সমরবিরোধী সমর – অমর অমল সুখী স্মরণ। ঝিলমিল করে রোদ-মিছিলের ঝাঁজ, তার ভাঁজে ভাঁজে কত কারুকাজ!

মৌনতায় মিছিলে সমরে সংগীতে সংসার উৎসবে পেশার যুদ্ধে এবং উদ্বেল শিল্পের ডামাডোলে, আলিঙ্গনে সামাজিকতায়,
বিশ্বাসে- অবিশ্বাসে, ক্রোধে প্রেমে প্রগাঢ় আমার ভুবনজোড়া নিজস্ব নিরিবিলি উঠোন। সেইখানে অনেক পাওয়ার মধ্যে কবে কখন একটুখানি পাওয়া … সেটুকুতেই জাগায় দখিন হওয়া, আজো আপনাকে এই জানা আমার ফুরোবে না … আজো আপনি আমার কোনখানে বেড়াই তারই সন্ধানে। আমার জীবন তো আসলে গীতবিতানের পাতার ভেতর জেগে থাকা নির্ঘুম এক অসিত্মত্ব। এর চেয়ে বেশি কিছু নই আমি, আজো। খোলা হাওয়ায় ওড়ে তার পাতা … আমার বেলা যে যায় তোমার সুরে সুরে সুর মিলাতে –

গানের লীলার সেই কিনারে যোগ দিতে কি সবাই পারে? পারে – ‘তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে?’

 

দুই

‘এইখানেতেই দিন কাটে এই খেলার ছলে …’

আমি মাছ কাটতে শিখে গেছিলাম ওই দূর-শৈশবে। এখন বোধহয় ভুলে গেছি। মৎস্য-সমত্মানদের বাড়ি বয়ে এনে সংহার-কর্তনের চল নেই এখন আর। তারা এখন কর্তিত-প্রস্তুত হয়েই ভক্তভোক্তাগৃহে পৌঁছান। ওই মোহাবিষ্ট শৈশবে যখন হেঁশেলে, চুলার পাশে, আগুনের কাছে যাওয়ার বিষয়ে বিষম নিষেধ-বাধা ছিল, তখন যখন ঘরের বাইরে সারি বেঁধে মাছ কুটতে বসত অনেকে মিলে, আমিও জিদ ধরে বসেই যেতাম! রাঁধার জন্য মাছের টুকরোগুলোকে আকৃতি দেওয়া যে একটা শিল্পকর্মের মধ্যে পড়ে, তা আমাদের বাড়ির বিদগ্ধ আড্ডায় বেশ আলোচনা হতো এবং অবিশ্বাস্য হলেও ফল-এই অভাজনের পিচ্ছিল-মৎস্য ভস্মে ঢেকে করায়ত্ত করার কৌশল শিক্ষা! নেচে ওঠা দুরন্ত-জীবন্ত কই মাছকে কোন কায়দায় বন্দি করলে তাকে নিশ্চিত ঘায়েল করে শিল্পিত-রূপে পরিবেশনযোগ্য করে তোলা যাবে, তা শিখে গেছিলাম স্কুলে থাকতেই! ওই কই মাছের সঙ্গে দ্বৈরথ শেষ কবে! তবু ভাবি, আহা শক্তির কী বাজে ব্যয়! শুরুতে এমন ছিল একেকদিন সকালে যখন দূর-দূর থেকে মাছের বহর আসত, সারবেঁধে বসত বাড়ির কুশলী কর্মবীরেরা, সঙ্গে থাকত আশপাশ থেকে ডেকে আনা মেয়ের দল, তাদের সঙ্গে শেষ এক প্রান্তে আমিও ঠাঁই পেতাম কখনো, কনিষ্ঠতমের ক্ষুদ্রতম বঁটিতে নিরীহ কোনো মাছের সঙ্গে বোঝাপড়ায়। আরেক প্রান্তে থাকত সবচেয়ে মজবুত দক্ষ শিল্পী, যিনি শক্তিধর মাছগুলোকে পরিবেশনযোগ্য করার দুরূহতম কাজটি করতেন। বিশেষ ফরমায়েশে তৈরি তাঁর হাতের বিশাল সেই বঁটি; শুনতাম ভয়ধরানো সেই ট্রাকের স্প্রিং-গলানো-ইস্পাত রূপ পেত ওই আশ্চর্য ‘সংহারক-সংরক্ষক-শিল্পসহায়ক’ অস্ত্রে। সেসব দেখে দেখে সুখে-শিখে একদিন আমিও-

শীতের শুরুতে সোয়ারীঘাট থেকে আসত ঝাঁকাভরা মাছ, ভোরের আগেই, উৎসবের হাওয়া জাগিয়ে। সঙ্গে পাতার বাটির হাজি বিরিয়ানি – সবার জন্য নাস্তা। মাছের বহরে বিশাল-বপু চিতল আর রুইয়ের সঙ্গে থাকত কই, পাবদা, খলিসা, গুলশা বা ট্যাংরা, চাপিলা এমনসব নামের জলজপ্রাণী, সবার নাম কি আর এখনো মনে করতে পারি? চিনব কী ওই প্রত্যেক প্রজাতিকে? হয়তো না, অথবা হয়তো চিনে যাব ঠিক পুরনো দিনের আনন্দে-মায়ায়। ওই সংগ্রহের এক কারণ ছিল পরের দুই মাস শুকনো মৌসুমের খাবার উপযোগী মাছ সংরক্ষণ করা – কেটেকুটে ধুয়ে সাজিয়ে ধবলতুষার বক্ষে। ছোটবেলা থেকেই বলা হয়েছে ফাল্গুন-চৈত্রে যখন পানি কমে গিয়ে কাদা থকথকে হয়ে ওঠে, তখন মাছেদের কানকোর ভেতরে পোকা বাসা বাঁধে, মাছের গায়ে কাদার গন্ধ ঢুকে যায় – তখন মাছ খেতে নেই। দেশীয় ঐতিহ্যে তখন শাকপাতা, নিমপাতা, করলায় মন দেওয়ার কথা। এখনো মানার চেষ্টা করি, পারি – পেরে উঠি না, তবু ভুলি না। কিন্তু সেদিনের প্রথম শীতের সেই সংগ্রহ-অভিযান উদযাপনে পাড়াপড়শির অধিকার ছিল প্রশ্নাতীত। চেনা সবার বাড়িতে যেত কিছুমিছু – সুখে-আনন্দে। তারপরে দুপুরের ভোজ সুতিথির অতিথি সঙ্গে!

আর দূরপ্রবাসে দেশি মীনকুলস্বাদবঞ্চিত বাবার বন্ধু এবং বন্ধুসমদের মাছে-ভাতে বাঙালিত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্বও ছিল তারই। ঘনসবুজ কাঁচালঙ্কা আর ইলিশবঞ্চিতদের স্মরণে তৈরি হতো সারবাঁধা প্যাকেট। ভাজা মাছ যেন ভেঙে না যায়, তাই খুব যত্নে সমান-মসৃণ প্যাকেটবন্দি করে সঙ্গে দেওয়া হতো আলাদা প্যাকেটভর্তি বাছা তাজা সবুজ লঙ্কা। তাদের যাত্রা যে কার সঙ্গে হতো, কে জানে? কিন্তু যাঁদের উদ্দেশে যাত্রা করত, তাদের বিলক্ষণ চিনতাম। একেকদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম, মাছ ভাজার উৎসব চলছে। ইলিশ আর কই মাছের মসলামাখা সত্মূপ পাশে নিয়ে ভেজে চলছে কেউ। তখনো ঢাকার রান্নাঘরে গ্যাস এসে পৌঁছেনি। যে-কোনো বড় রান্নার উপলক্ষ হলেই সহায় বাগানের পাশে মাটি খুঁড়ে বানানো বড়সড় মাটির চুলা। তাতে প্রমাণ সাইজের কড়াই বসিয়ে ডুবো তেলে পাশাপাশি ভাজা হতো অচেনা-মাটিতে সাড়ম্বর-অভ্যর্থনা-অপেক্ষায় বিদেশযাত্রী ইলিশ আর কই। তখন দুপুর-মাঠভর্তি আলোতেও দর্শনেন্দ্রিয়ের চেয়ে ক্রিয়াশীল ঘ্রাণেন্দ্রিয় : সঘন হয়ে লাকড়ির কাঠের ধোঁয়ার গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভাজা হয়ে ওঠা সর্ষের তেল আর মসলা-মাখা মাছের তীব্র সুস্বাদু ঘ্রাণ। সর্ষের বদলে সয়াবিন নামের নতুন তেলের ব্যবহার বহুদিন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল আমাদের অতি-ঐতিহ্যিক গৃহকোণে। উঠান, বাগান, লন – যাই বলা হোক, ওই খোলা আকাশের নিচে ভাজার পর তাদের অন্দরে আনা হতো প্যাকেটবন্দি করার উৎসবে। উৎসবই তো, কারণ বাসার কাজ-বালকেরা মিলে মহাউদ্যমে বড় খাবার টেবিলটাকে একটা ফ্যাক্টরি ঘরের টেবিলের মতো বানিয়ে ফেলত, তার ওপর কয়েক পল্লায় চাদর আর কাগজ বিছিয়ে পরে পাতলা চওড়া থালার ওপর এক পরতে বিছিয়ে দেওয়া হতো মাত্র-ভাজা মাছের টুকরোগুলো – পাখার হাওয়ায় শীতল হবে বলে। ঘুরতে থাকা তড়িৎ-পাখার হাওয়ায় ঘরময় ছড়াতে থাকত তার মায়াভরা সুঘ্রাণ।

বহুদিন পর্যন্ত তেতে উঠতে থাকা সর্ষের তেলের সুগন্ধের আভাস মাত্র পেলেই আমার মনে পড়ে যেত গাঢ় করে ভাজা পোয়াপিঠার কথা। আম্মার তরিকাটাই ছিল ওই – গ্রাম থেকে আনা আলাদা করে আবাদ করা পিঠার চাল গুঁড়া করে, সে তাজা গুঁড়ির গোলা বানিয়ে একবেলা অপেক্ষা, গুঁড়ি পরিমাণমতো ভিজে নরম হয়ে ওঠার জন্য। তারপর সেই একই সুদূর নিবাস থেকে বয়ে আনা ঘানিভাঙা সর্ষের তেলে ভাজা! হ্যাঁ, ঠিক তাই হতো। নিজেদের ক্ষেতের ভাতের ও পিঠার চাল বস্তাবন্দি করে ঢাকা পর্যন্ত এনে পুরো বছরের জন্য রক্ষা করাও যে একটা দুরূহ এবং পরিশ্রমের কাজ, সেটা মনেই হয়নি কখনো। বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় সাধারণভাবে পচনশীল যে-কোনো কিছুই সম্বৎসর রক্ষা নিয়মিত বিপুল পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু শীতের ফসল অর্থাৎ আমনের চালটাই শুধু আহারোপযোগী বিবেচনায় সেই বাড়তি পরিশ্রম মেনে নিতে দ্বিধা করেনি কেউ। আমরাও কখনো ভাবিনি, এছাড়া অন্য কিছু সম্ভব। সেসব থেকে আমরা এখন অর্গানিকের যুগে! ‘মানতে চায় না বেয়াড়া মন দ্বীন ও দুনিয়ার ধাপ্পাবাজি …’ তো সেই শৈশবে আমাদের একমাত্র অনুমোদিত চাল ছিল বস্তাবন্দি হয়ে আসা গ্রামের লাল বিরই। আরো আসত খুব ছোট ছোট আলু, ঝুনকি বেগুন, খৈয়ের ধান, চ্যাপা শুঁটকি – খুঁটিনাটি আরো কত কী! সেসব আসে না আর, আবাদও হয় না হয়তো আর – কুমড়ো ফুল শুকিয়ে যায়, ঝরে পড়ে সজনে ডাঁটা, পুঁই লতারা নেতিয়ে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

এই কবিতার সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়েন সেন্টু চাচা : শৈশবের আরো এক প্রিয় মুখ, কিংবদন্তির কবি আবুজাফর ওবায়দুলস্নাহ। তখনো মেয়ে জন্মেনি তাঁর, এসে বলতেন, ‘আমাকে বাবা ডাক, তোর জন্য কবিতা লিখব।’ কে শোনে অমন উন্মাদ আলাপ? আমরা পালাতাম, উলটো তাঁর নামে কবিতা লিখতাম, নানাবিধ প্যারোডি –  এই মতো কতশত গল্পে-স্মৃতিতে সাতনরি হারের কবি, একুশের ভোরের অনিবার্য কবিতার কবি, শুনি সহসা দারুণ দিওয়ানা পথহারা। অপরূপা পুতুল চাচি থেকে রূপসী মণি চাচি! আহ্ পৃথিবী।

আসতেন কবি শামসুর রাহমান। একেবারে ঘরের মানুষের মতো আপন হয়ে। টানা অনেক বছর তিনি ছিলেন প্রতিদিনের অতিথি। তিনি ঢাকায় থাকলে এবং বাবা বাড়িতে থাকলে – এটা অনিবার্য ছিল; অবশ্য তা নিবারণের কারো কোনো ইচ্ছাও ছিল না। তার মতো প্রবল বিনয়ী কোমল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি, আর প্রথিতযশা কীর্তিমান মানুষের মধ্যে দেখেছি বলে মনেই করতে পারি না। এর মধ্যেই ১৯৭৭-এ তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদক হয়ে গেলেন। এরপর যেদিন এলেন, নেহাতই সুকুমারের ‘সম্পাদকের দশা’ কবিতাটা জানা বলে আমাদের বাচ্চাদের ঘর থেকে বাবার সঙ্গে বসে থাকা তাঁর কাছে চিরকুট গেল –

‘সম্পাদকী কাজ পাওয়া, সৌভাগ্য সে অতিশয়,

কিন্তু সেটা ঠিক নহে আদ্যোপান্ত মধুময়।’

পাঠোত্তর তিনিও তৎক্ষণাৎ পাশে লিখে দিলেন-

‘এ ব্যাপারে আমারও কিছুটা আছে ভয়,

তোমার এ কথা মনে রাখবো নিশ্চয়।’

 

এসব এতই অনায়াস সহজ ব্যাপার ছিল যে, ওই কাগজটা জমিয়ে রাখার কথা কারো মনেই হয়নি। তবে ওই ভয়ের মর্তবা বোঝা গেল কিছু পর, ১৯৮০-তে সম্ভবত যখন ওনার নামে তখনকার এক বা দুই টাকার একটা নোট ডাকে পাঠিয়ে জানানো হলো, ‘যা খাওয়ার খেয়ে নে’ জাতীয় কিছু। বিচিত্রায় একখানি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের ফল ছিল সেটা। অথচ তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সেই ’৭৭-এ আমি, হাসছি এখন, ইসলামিয়াত হোমওয়ার্ক করেছিলাম! একটা রচনা লেখার ছিল, রোববারের দুপুরে বাড়িতে অলস আড্ডায় আলাপ করে দাঁড় করলাম, এবং সেটিতে দ্বিতীয় হলাম! প্রথম যিনি হয়েছিলেন আমার প্রাণের সখী (এখনো এই দুই-কুড়ি বছরের পরেও) তাঁকে মাঝে মাঝেই খেপাই – ‘তুই ফার্স্ট আর শামসুর রাহমান সেকেন্ড!’ আসলে ওর পরামর্শক ‘ইসলামিয়াত স্যার’ প্রথম? কী সব ছিল দিন! বাবার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে কখনো পুরান ঢাকায় তাঁর বাসা, অকপট পরিবেশ। আহা, তুচ্ছ দিনের গানের পালা আজো আমার হয়নি সারা –

এসব নিয়ে আমার ওই একান্ত-নিরীহ-উন্মনা-শৈশবটা কি এক রকম করে যেন আমার চারপাশের সবার চেয়ে আলাদা ছিল, এতটাই যে খুঁজেও কারো সঙ্গে মেলাতে পারিনি ও পাইনি কাউকে, যার সঙ্গে কেটে যাওয়া ওই সুশীলশৈশব দিনগুলোকে মিলিয়ে বলতে পারি ‘আমাদের দিন’। বহুদিন ওই বোধ থেকে একরকম বিষণ্ণ একলাপন ছিল। চুলের ভাঁজে ভাঁজে রুপালি ঝিলিক পূর্ণ করে বুঝতে শিখে গেছি, ‘দ্যাট হ্যাজ মেইড অল দ্য ডিফরেন্স…’ আর সে বিষাদ নয়, আমার অনিঃশেষ আনন্দ-ভাণ্ডার … ‘আমার লাগল রে মন লাগল রে, তাই এইখানেতেই দিন কাটে এই খেলার ছলে …।’

 

তিন

‘কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলি সব ঝরছে পলে পলে’

জয়ধ্বনি জাগানো এক বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশেপাশে থেকে তার স্নেহে সম্ভাষণে কেটেছে আমার শৈশব, এবং মৃদু শৈশব থেকে উতরোল কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার দিনগুলো। হাওয়া-হিলেস্নালে তার মিহিনপাতার আয়েশি নাচ আর ক্রুদ্ধ ঝড়ের ঝাপটায় তার একলা প্রতিরোধ আর ভেঙে পড়া এবং তারও পরেও টিকে থাকা দেখতে দেখতে আমার শৈশব পেরোনো কিশোরী দিনের যাত্রা শুরু। তার ছায়ায় ছায়ায় – চিকন পাতার ফাঁক গলে তীব্র রোদের নম্র হয়ে আসা বিভায় আমার গ্রীষ্ম-বসন্ত দর্শন, বর্ষণ উদযাপন। পোষা যে রাজহংসী ও হংসেরা তাদের দীর্ঘ গ্রীবা পাতার চিক্কন নকশার অমলিন ছায়ায় মেলে দিয়ে বেলা পার করত, তাদের পালকে রোদের নৃত্য দেখতে দেখতে আমাদের কেটে গেছে অনেক সময়। সত্তর দশকে যখন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ আর শাহবাগের পথদ্বীপের
কৃষ্ণচূড়ায় আগুন লাগত, ছুটির সকালে আমরা সবাই মিলে যেতাম উপচেপড়া সেই বিরল সুন্দর দেখতে। কিন্তু তাদের কেউই আমাদের আঙিনার দীর্ঘদেহী সেই বৃক্ষটির মতো ছিল না। আমি অন্যদের কথা জানি না। কিন্তু ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কৃষ্ণচূড়া ফোটার মৌসুম একটা উৎসব মৌসুমই ছিল। জ্যৈষ্ঠ মাসের ফুল। ফুটতে শুরু করলে রোববার সকালে সফর শুরু হতো তখনকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সারবাঁধা কৃষ্ণচূড়ার শোভা দেখে। তারপর শাহবাগের ফুলসারি দেখে দুপুর-ভোজে যাত্রা। আর আমাদের বাড়ির অতি বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের গাঢ় লাল পাপড়িতে ভরে থাকত উঠান, ড্রাইভওয়ে, ফুলবাগান। অত বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ আমি আর কোথাও দেখিনি। আষাঢ়ের পরে ঘন বর্ষায় ফুল-ফুরানো দিনে বিশাল সেই কৃষ্ণচূড়ার নিচুতম ডালে কেউ দোলনা বেঁধে দিলে আমরা ভাইবোনেরা দিব্যি দোল খেয়ে কাটিয়ে দিতাম অবেলা ও সুখবেলার অঢেল সময়। (ওইসব ভেবে ক্লাবে ফুল-উৎসবের এন্তেজাম করছিলাম। কবে যে ফুটবে – চৈত্র-বৈশাখের আগুনরঙা ফুল, বর্ষায় সুবাসওয়ালা ফুলও! আহা ফুটবে তো?)

খুব মনে আছে, ছুটির দিনে উঠোনে বাগানে একলা হেঁটে অদরকারি ফুলপাতার নকশা আর আচরণে মনোযোগ দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি কত যে সকাল-দুপুর। ওই আনমনা ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে ফুলদের সঙ্গে, পাতাদের সঙ্গে একটা আনকোরা আহ্লাদি সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তখনই। এতটাই যে, ইচ্ছামতো মিশেল ফুল তুলে ঘরে এনে তাদের সাজাতাম অকারণেই – এক্কেবারে নিয়ম ছাড়া মনের মতো করে। স্কচটেপ নামের জিনিসটার মাধুর্য অমন কে আর জেনেছে কবে? হালকা আঠায় নানা জাতি-গোত্রের ফুলপাতা যুক্ত-যূথবদ্ধ করে বসার ঘরে খামোকা সাজানো শুকনো ডালে সেঁটে দিতে কি আনন্দ যে হতো। সারা দুপুর ঘুরে ফুলের সংগ্রহ নিয়ে ফিরে এলেবেলে সাজিয়ে অতঃপর স্নানাহার – অনেকটা বাঁধা রুটিনে দাঁড়িয়ে হিয়েছিল একটা সময়ের জন্য। তখন কি স্কুল ছিল না? কী জানি? কিন্তু বর্ষার ফুলগুলোর রং আর আলুথালু মেজাজ স্মৃতিতে এখনো ঝকঝকে। স্মৃতি নয়, এইমাত্র তুলে এনে রাখলাম ওদের। এক সন্ধ্যায় আববা ওই ফুলেল নকশা দেখে অবাক। তারপর থেকে বাড়িতে সব উদযাপনে-আয়োজনে ফুলের ওই নিয়মহারা সাজটাও নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। স্নেহমেশা বিস্ময়ে, প্রশ্রয়ে অতিথিরা সর্বদাই ভালোবেসেছিল সেই ফুলসাজ।

এমনিতেই বাড়িতে যে-কোনো অনুষ্ঠানের দিন – সে নিরেট প্রাশন হোক বা গান্ধর্ব-সমাবেশ, শিল্পীরা আসতেন সকাল থেকে – চিকন সাদা আলপনা আঁকা শুরু হতো মেঝেতে, সবদিক দিয়ে ঘরে ঢোকার পথে। বাড়িতে গানের দুর্দান্ত কদর ছিল, আদর ছিল পেইন্টিং আর সবরকম শিল্পকাজের, এমনকি সহজ সাদা আলপনার জন্য যে আহ্লাদ ছিল, তার সিকিও ছিল না ফটোগ্রাফির জন্য। না, কেউই ছবিবিমুখ ছিল না, ছবিও তোলা হতো ইচ্ছা হলে, শুধু তার আদর ছিল না ততটা, যতটা ছিল শিল্পীর হাতে জল-তেলরঙে আঁকা ছবির। প্রণয়ে বাহুডোরে বাঁধেনি তারে অজানা সে-কোন কারণে? ফল হলো, সেই পুষ্পবিন্যাসের কোনো ছবি রাখার কথা কারো মনেও আসেনি। না, আমারও না। আমাদের সেই উষ্ণ শৈশবে কোনো আবদার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের খুব একটা ছিল না; অথবা আমরাই কি চাইতাম না, না-চাওয়ার মতো কিছু? ঝলমলে এক সকালে আমার পঞ্চবর্ষীয় অনুজের হঠাৎ ‘বাংলা সিনেমা’ দেখার আশ্চর্য আবদার সেই বিরল অভিজ্ঞতার একটি। টেলিভিশনের কল্যাণে মাপা ফ্রেমে দেখা হয়ে গেলেও, হলে যাওয়ার কোনো কারণ-উৎসাহ-উদাহরণ আমাদের সামনে ছিল না। যত অসম্ভবই শোনাক, মুভি হলে গিয়ে বাংলা ছায়াছবি নামক শিল্প-শাখার রসাস্বাদনের প্রথম অভিজ্ঞতাটি ঘটে কলেজে পড়ার সময়। যদি তাকে রসাস্বাদন বলা যায় অবশ্য। সেও, কখনো যাইনি শুনে নতুন বন্ধুর হুলস্থূল প্রতিক্রিয়ায়। সেই অভিজ্ঞতারও তো বহুদিন হলো, জীবন গেছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পর, তবু মধুর! ও লাকি! তাকিয়ে বলল, ‘কখনো দেখিসনি?’ তারপর দাঁড়িয়ে গেল, ‘এক্ষণ চল’। আমরা চললাম অলকায়। এবং দেখলাম। তাতে আমার জীবনবোধে কোনো ফারাক ঘটেছিল, এমন বলতে পারব না। কিন্তু চাইলেই যে অনেক কিছু করেও ফেলা যায়, সেই বোধটুকু মনে গেঁথে থাকল।

মুভিবিহীন সেসব উজ্জ্বল রঙিন দিনে বাংলা কবিতার কিংবদন্তি সেই অভিবাদনের ‘প্রিয়তমা নাজমুন্নেসা’ অর্থাৎ পিয়ারী আপা আমাদের উঠানের কিনারে দাঁড়ানো সেই গাঢ় সবুজের পটে তীব্র লাল ফুলে ছাওয়া বিশাল সুন্দরের একটা ছবিও এঁকেছিলেন রংতুলিতে। পিয়ারী আপার আঁকা সেই ছবির ফুলগুলো এখনো তাঁরই মতো রঙে উজ্জ্বল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মৌসুমে গাছের নিচের এলাকাটুকু ঝরেপড়া পাপড়ি-প্রাচুর্যে রঙিন হয়ে থাকত। তার আধা ছিল আমাদের সীমানার ভেতরে আর অর্ধেক পৌরসভার রাস্তায়। মুগ্ধ এক শিশু তাই দেখে উৎসাহে একদিন লিখে ফেলল –

কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলি সব ঝরছে পলে পলে,

পথিক কি তার ইচ্ছামতন রাস্তা দিয়ে চলে?

এর ফল আর যা-ই হোক, আমার মায়ের যে সভয় শঙ্কার উদয় হলো, তার কথা এখনো সহাস্য মনে করি। শঙ্কা ছিল এই, ‘মেয়ে আমার আবার কবি হয়ে যাবে না তো?’ কাব্যচর্চা নিঃসন্দেহে ভালো, কিন্তু সে অন্যেরা করুক এবং অন্যেরটি পাঠ করাই নিরাপদ। কবির জীবন, শিল্পীর জীবন সুখের হয় না। ‘আমার সমত্মান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ মা, কিছু কিছু ব্যথা আছে যে অহোরাত্রি দগ্ধ করে প্রাণ। চর্চা হোক আর না-ই হোক, বেদনাটি গহনে রয়েই যায়। আমার সমত্মানদের তাই কখনো কেবল দুধে-ভাতেই থাকতে বলিনি। বরং বলি, যা পুড়ে খাক হ! শুদ্ধ হ, যদি তাই চাস।

 

চার

‘বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে’

উনিশশো চুয়াত্তর দেশে এক দুর্বিনীত বন্যার বছর। বয়ঃপ্রাপ্ত-পরিণত হতে হতে সেই অন্নাভাবের বৈশ্বিক ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে কত বিবরণই না জেনেছি; সেসব পেরিয়ে উন্নতির-তীরমুখী বাংলাদেশে অন্নাভাবের সঙ্গে সঙ্গে চেতনার বেড়ে ওঠা দৈন্য কেটে যেত দ্রম্নত – এইমতো ভাবি অবিরত। তবে সেই চুয়াত্তরে বানভাসি মানুষেরা দূর দূর থেকে এসে পড়েছিল রাজধানীতে। কোথা থেকে কিছু অচেনা মানুষ উঠে এসেছিল আমাদের বাসার সামনেও, রাস্তার ওপর গেটের আশপাশে ভিড় করে। বাসার গ্যারেজগুলো খালি করে তাতে কিছু শিশুসহ কজন নিমীলিত মানুষের জায়গা হয়ে গেল। কেউ ভাবেনি গাড়ির অযত্নের কথা! এখনো কি আমরা পারব তাই? সেই খুব আলোচিত দুর্ভিক্ষে মানুষ ক্লান্ত-কাবু। কাজের ছেলেরা এসে খবর দিলো, গ্যারেজের মানুষেরা ভাতের ফ্যানটুকু চায়। আমাদের ফ্যান ফেলার নিয়ম ছিল না, থাকলেও কেবল ফ্যান পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না, বাগানের সবজি আর কিছুটা চালে ওদের সহজ অধিকার জন্মে গেল। আর ছিল না নুন। যদ্দুর মনে পড়ে সেই চুয়াত্তরে লবণের দাম হয়েছিল খুব সম্ভবত, সেরপ্রতি সত্তর টাকা। লবণের দাবিও ছিল তাদের। আমার মনে আছে, যে লবণ পাওয়া যাচ্ছিল তা যথেষ্ট পরিষ্কার মনে হয়নি আমার জননীর। কৃষ্ণতিলকে সেজে ঘোলা হয়ে ওঠা নুন। অতএব, কিনে আনার পর তাকে জলে গুলে ছেঁকে জ্বাল দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা চলছিল। তাতে খুব সুবিধা হয়নি। আচ্ছা নুন তৈরি কি অত সহজ? হলে সাগরজলে যে-কেউ নুন বানাতে পারত। তবে ওই গলানো পরিস্রুত লবণ পেয়েছিল ওরা, সেদিনের অনাহূত অতিথিরা। আর ওই নুন বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে লিখে রাখার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। ওই সংগ্রহ অভিযানের কারণে এই অর্বাচীন জানতে পেরেছিল, সংসারে লবণ আর চিনির মতো মামুলি জিনিসও নিয়মিত কিনে সংগ্রহ-সংরক্ষণের একটা ব্যাপার আছে। তার আগে পর্যন্ত এই পক্ব জ্ঞানীর ধারণা ছিল, মানুষ বোধহয় নুন-চিনির মতো দরকারি জিনিসগুলো একবার কিনে নিয়ে ‘হ্যাপিলি এভার আফটার’ সংসার শুরু করে এবং ওতে জীবন পার হয়েও যায়!

সেই হ্যাপিলি-এভার-আফটার বাড়িতে পায়রা-কুকুর-কুক্কুট পরিবার আর একদল পোষা রাজহংসেরও বসত ছিল। এদের ভাবখানা এমনি ছিল যে, বাড়িটি ওদের, আমরাও থাকি। মাঠটি যখন-তখন দখল করে পায়রার ওড়াউড়ি, হাঁসেদের ছোটাছুটি এবং টানটান সরু রাজগ্রীবা মাটির সমান্তরালে নামিয়ে যাকে খুশি তাড়া করার অধিকার এবং উৎসাহী চর্চা তাদের ছিলই, সে-সঙ্গে ছিল বাড়ির কাজ-বালকদের কাজ বাড়িয়ে অকাতরে সব পুরীষে পূর্ণ করা। ছিল সোনালি-সাদা রেশমি-পশমে ঢাকা লুব্ধকের ছোটাছুটি। লুব্ধক : আমাদের প্রিয় পোষা সারমেয়, যার নাম শুনে কেউ সখেদে বাবাকে বলেছিলেন, ‘এত ভালো নাম এর রাখলেন! নইলে আমার ছেলের নাম রাখতে পারতাম।’ পুত্রসম বিবেচনায়ই তো ওই নামকরণ, যার এক অর্থ কুকুর বটে। আবার পৃথিবীর রাত্রি-আকাশের উজ্জ্বলতম তারাও সে বটে। সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো প্রিয় লুব্ধক দূরের রাস্তা থেকে মোড় ঘুরতে বাড়ির গাড়ির হর্ন বাজতে শুনলেই ছোটাছুটি শুরু করত এক গেট থেকে আরেকটিতে। এই উদ্বেল ছোটাছুটিতে কী প্রমাণ করতে চাইত জানি না, কিন্তু তাতে আবদুলের অবশ্যই সুবিধা হতো। সে দূরে থাকলেও চাবি নিয়ে তক্ষুনি গেটের দিকে দৌড় দিত, আর গেট না খোলা পর্যন্ত লুব্ধকের লম্ফঝম্প ননস্টপ! রাজহাঁসের দলটিকে প্রতিদিন বাড়ির কাছের লেকে জলবিহারে পাঠানো হতো। একটু বেলা করে, সকাল একটু বাড়ন্ত হলে বাড়ির কাজ-বালকেরা গেট খুলে তাদের লেক অবধি পৌঁছে জলে নামিয়ে দিয়ে ফিরত, আবার বিকেলশেষে ফিরিয়ে আনার জন্য।

সে-সময়ে এক ঘটনা আমাদের নাড়া দিয়েছিল খুব। তখন বন্যাজলের বাড়াবাড়ি, আসেত্ম আসেত্ম এগোচ্ছে জল, পায়ে পায়ে বাড়ছে সীমানা প্রতিদিন। তখনই একদিন শেষ দুপুরে এলাকার বালকের দল হইহই খবর আনল, ‘আপনাদের হাঁসেরে সাপে কাটসে …।’ বাড়ির ছেলেরা ছুটে গিয়ে কোলে তুলে ফিরিয়ে আনল, কিন্তু বাঁচানো গেল না তাকে। কৃষ্ণচূড়ার চিকন পাতার শীতল-ছায়ায় তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু পরদিন থেকে দেখা গেল, দলের একটি হাঁস আর জলবিহারে যাচ্ছে না। হাকিম আর আবদুল জানাল, সে কিছু খাচ্ছেও না। সেদিন থেকে ওই সমাহিতের পাশে  কৃষ্ণচূড়ার নিচেই তার অবিরাম নির্ঘুম-অনাহারী-অশ্রম্নভরা দিন। বোধহয় তিনদিন বেঁচেছিল। তার সমাধিও হলো প্রণয়ী হংসীর পাশে, কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়। সবার মন চঞ্চল হয়েছিল ওই অভিজ্ঞতায়। কতদিন ধরে সবাই এ-কথা জানিয়ে চমকে দিত অতিথিদের। নতুন মানুষের সঙ্গে হাঁসের দলের কথা-আলাপ হতোই হতো। অচেনা মানুষ বাড়ির সীমানায় পা রাখা মাত্র তারা মরাল-গ্রীবা বঙ্কিম করে সাঁই-সাঁই দৌড়ে আসত ব্যতিক্রমবিহীন। আমার মায়ের মতে, এরা ছিল বাড়ির দ্বাররক্ষীর চেয়েও নির্ভরযোগ্য প্রহরী। মাঝে মাঝে আমাকেও চারদিকে ঘিরে ধরে ডাকাডাকি জুড়ে দিত। কেন কে জানে?

ওই রাজকুলজাত হংসবাহিনী ছিল আমার বাবার অতি স্নেহের। তাঁর ইচ্ছানুসারে পোষা এসব হাঁস বাড়িতে কখনো খাওয়া হতো না। যুদ্ধের অনিশ্চিত যাত্রায় যাওয়ার আগে তাদের দূরে ডেমরায় মিলের পুকুরে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিরাপদ ঠিকানায় স্থায়ী করে দিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধশেষে ঘর-দুয়ারসুদ্ধ পায়রা আর রাজহাঁসের দলকে আবার বাড়ি ফেরত আনা, অটল স্নেহের সিদ্ধান্ত ছিল। ‘সোয়ান লেক’ নামে একটা রেকর্ড ছিল বাড়িতে। সেই লং পেস্নর বিপুল রেঞ্জের বাদনে অপার্থিব একটা ব্যাপার ছিল। তখন গুগল ছিল না, কিন্তু বাবা ছিলেন। জাইকোভস্কির বিখ্যাত রচনার সঙ্গে পরিচয় করতে পুরো গল্পটা ‘বাদাম-খোসায়’ ঢুকিয়ে শুনিয়ে দিয়ে তারপর তার সাংগীতিক-সামাজিক বয়ান। সেসব তত্ত্ব-তথ্য কিছু ভুলেছি, কিছু তার এখনো ভুলিয়ে দেবে দুই চাহনির চোখের চাওয়া। কিন্তু এটা মনে আছে, তালিমোত্তর একাকী শ্রবণে ওই বাদন যে বোধের সঞ্চার করত – সে এখনো পরম মধুর-বেদন; শুনতে শুনতে ওই বাজনার চলন স্বভাব-চলনের সঙ্গে যে এক একাত্মতা তৈরি হয়ে রইল, যে এক বেদনাভরা গভীর রোদন, সেটা প্রাণের অতলে রয়েই গেল। তার এক ঝঙ্কারে এখনো টঙ্কার লাগে প্রাণে। বাড়ির চারদিকে ঘুরে বেড়ানো অতিচেনা রাজহাঁসেদের সঙ্গে তার মিল নেই, মিল নেই, তবু কিছু আছে কি কোথাও? এখন কোথায় হাঁসের দল,    কোথায় বাবা!

পুরনো চীনা কবিতা আমার বড় প্রিয়। চীনাদের হাজার তিনেক বছর আগের সাহিত্য ও ইতিহাস বেশ গোছানোভাবেই লেখা! ইংরেজি অনুবাদে তাতে একটা কবিতা পড়েছিলাম, যার সারকথা এই – জীবন পেরিয়ে গেলে হাজার হেমন্তের পরে এইসব সুখ-শোক-প্রেম আর গস্নানির কী মানে থাকে আর? অনেক হাজার হেমন্তের পরে সেটা পড়ে আমার বিশুদ্ধ বিভ্রম হচ্ছিল, মানে কি সত্যি নেই? সেই পাঠেরও কি কোনো মানে নেই? আমিই বা কেন লিখছি? কই যাব আমি আর এসব মানহীন-মানেহীন অজানার অলস লিপিলিখা? তবু চুয়াত্তর মনে হলেই আধো-সন্ধ্যায় লেকের জলে এক কচুরিপানার ভেলা, চুয়াত্তর মনে হলেই অল্পচেনা কিশোর রায়হানের তিরোধান সংবাদ – চুয়াত্তর মানে গ্রামের বাড়ির চাল বয়ে আনায় বাধা-নিষেধাজ্ঞা, চুয়াত্তর মানে হংস-কুক্কুট পরিবারের ডিম্বপ্রসর বিপর্যয়, চুয়াত্তর মানে রোদে পিঠ দিয়ে কাঠের পিঁড়িতে বসে গাছপাকা বরইয়ের দেশি স্বাদ-মাখামুখে গল্প-হাসির ফোয়ারা, নিক্কো-লুহিৎ সফর! চুয়াত্তর মানে আরো কত কী –

ওই বন্যার দিনেই দেবব্রতের মথিত আওয়াজে হঠাৎ গানের একটা লাইন মনে দাগ কেটেছিল – ‘বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে, দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে’ – সেদিনের গানে ওই পর্যন্তই মনোযোগ টিকে ছিল। প্রাপ্ত বয়সের ভিন্ন মেজাজি শ্রবণে মন গিয়েছে তারও পরে – ‘তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা!’ প্রৌঢ় দিনের অবসন্নতায় আজকাল ভাবি, কোনটি ভালোতর – আঘাত, না অবহেলা? চাইনি কোনোটিই। জীবনের ঘাটে ঘাটে স্তরে স্তরে বারেবারে পাইনি কি দুই-ই? থাক না। ‘তোমার কাছে শান্তি চাব না, থাক না আমার দুঃখ-ভাবনা।’ r