আদর্শলিপি

মনি হায়দার

কী হয়েছে তোমার?
বসার ঘরে গম্ভীরমুখে শাহাদাতকে বসে থাকতে দেখে অবাক জাহাঙ্গীর। কথা বলতে বলতে বসে পাশে। শাহাদাত হোসেন সরকারি বড় কর্মকর্তা। থাকে ঢাকায়। জাহাঙ্গীরের ছোট বোনকে বিয়ে করেছে কয়েক বছর আগে। বিয়ের আগে শাহাদাত আর জাহাঙ্গীর বন্ধু ছিল। দুজনে মাস্টার্স করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জাহাঙ্গীর মাস্টার্স করে চাকরি না খুঁজে ভা-ারিয়া উপজেলা শহরে ওষুধের বিরাট দোকান দিয়ে বসেছে। আরবান ফার্মেসি। প্রচুর বিক্রি হয় ওষুধ। বছরকয়েক আগে নিজের বাড়িতে বন্ধু শাহাদাতকে বেড়াতে এনেছিল জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরের ছোট বোন সূচনা তখন কলেজে বিএ পড়ে। সূচনার সঙ্গে শাহাদাতের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলে দুই পারিবারের মধ্যে কথা চালাচালির মাধ্যমে ওদের বিয়ে হয়। সেই সূত্রে শাহাদাত হোসেন হচ্ছে জাহাঙ্গীর হোসেনের ছোট বোনের স্বামী। ছোট বোনের স্বামী হলেও দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব আগের মতোই প্রগাঢ়। হাসিঠাট্টায় চমৎকার বন্ধুত্ব দুজনের।
শাহাদাত শ্বশুরবাড়ি এসেছে পূবালী লঞ্চে। লঞ্চ যখন কাউখালী পার হয়ে হুলারহাটের দিকে যাত্রা করে, তখন প্রায় দুপুর। কেবিনে একা একা ঝিমুচ্ছিল। হঠাৎ কানে আসে খুব পরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বর – ভাই, আদর্শলিপি লাগবে? আদর্শলিপি?
মানুষটা বলে যেতে থাকে, আপনার নাতি-নাতনি, ছেলেমেয়েদের আদর্শলিপি কিনে দেন। আদর্শলিপিতে কত সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে! – ইক্ষু রস অতি মিষ্ট, ঈশ্বরকে বন্দনা কর, ঊর্ধ্ব মুখে পথ চলিও না…।
নিমিষে ঝিমুনি ছুটে যায় শাহাদাতের। দ্রুত কেবিনের বাইরে আসে। ইতোমধ্যে আদর্শলিপির ফেরিঅলা দোতলা থেকে নিচের দিকে চলে গেছে। লঞ্চের রেলিং ধরে এক মুহূর্ত ভেবে দ্রুত ফেরিঅলাকে অনুসরণ করে নিচে নামে। সিঁড়ির আড়ালে দাঁড়ায়। ফেরিঅলা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত-বসা ক্লান্ত যাত্রীদের কাছে গিয়ে হাতের বই বাড়িয়ে ধরে – নেবেন ভাই আদর্শলিপি? বাড়িতে আপনার নাতি-নাতনি, ছেলেমেয়েদের হাতে আদর্শলিপি তুলে দিন। আদর্শলিপি পড়ে ওরা একদিন বড় আদর্শ নিয়ে বড় হবে। শুনুন, কত দামি কথা লেখা আছে আদর্শলিপিতে – ঊর্ধ্ব মুখে পথ চলিও না, ঈশ্বরকে বন্দনা কর…। দু-একজন যাত্রী বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে। একজন কেনে। ফেরিঅলা খুব খুশি হয়ে ভাংতি টাকা দিয়ে আবার ঘুরে অন্য যাত্রীদের দিকে যায়। কণ্ঠে সুরেলা আওয়াজ – নেবেন ভাই একটা আদর্শলিপি?
গোটা ঘটনা নিজের চোখে দেখে বিস্ময়-বিপন্ন শাহাদাত। কী করবে ভেবে পায় না কিছু। দেখে ফেরিঅলা ওর দিকেই আসছে। দ্রুত বিষণœ-মর্মাহত শাহাদাত হোসেন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। লঞ্চ যখন তেলিখালীতে ভেড়ে, ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসে শাহাদাত। চারদিকে তাকায় কিন্তু কোথাও আদর্শলিপির ফেরিঅলাকে দেখতে পায় না। কোথায় গেল?
জামাই মিয়া? আহমদ মাঝি শাহাদাতকে দেখেই কাদা ভেঙে তীরে এসে ব্যাগটা হাতে নেয়, আসেন। আমার নৌকায় আসেন। আহমদ মাঝি এলাকার মাঝি।
চলুন, জুতো জোড়া খুলে হাতে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে নৌকায় উঠে বসে শাহাদাত। নৌকা ছেড়ে দেয় আহমদ মাঝি। কচা নদীতে জোয়ারের কাল। তেলিখালী থেকে বোথলা গ্রামে যেতে ঘণ্টাখানেক লাগবে।
আহমদ প্রশ্ন করে, জামাই কি ঢাকা দিয়া আইচেন?
হ্যাঁ। টাপুরে নৌকার গলুইয়ে আসন গেড়ে বসেছে শাহাদাত।
চিঠি লেহেন নাই? বাড়ি দিয়া কেউ তো আমারে কিছু কইলো না। আপনে আওনের আগে পেরতেকবার তো আমারে কইয়া দেয় আপনের শ্বশুর…। তয় উনি আইজকাইল বাড়িতে বেশি থাহে না। হাটেবাজারে বই বেচে।
শাহাদাত উত্তরে কোনো কথা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। কচা নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে-যাওয়া কচুরিপানা, উড়ে যাওয়া বকদের সারি দেখে। বিকেলে বাড়িতে পৌঁছে খাওয়া সেরে বসার ঘরে বসে ট্রানজিস্টারে আবদুল লতিফের গান শুনছে ঢাকা কেন্দ্রের… ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়…।
এতদিন মানুষের মুখে শুনেছি… গম্ভীরভাবে বলে শাহাদাত, আজ নিজের চোখে দেখলাম –
কী দেখলে?
বাবা লঞ্চে বই বিক্রি করছে।
সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে যায় জাহাঙ্গীর – কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। আগে তো ভা-ারিয়া উপজেলায় গিয়ে বই বিক্রি করত। আমি ওষুধের দোকান দেওয়ার পর নিষেধ করেছি। কয়েকদিন বাড়ি থেকে বের হতে দিইনি…। আমাদের এত টাকা-পয়সা, মানসম্মান, আর আমার বাপ দোকানে দোকানে গিয়ে বই বিক্রি করে। কী বই? আদর্শলিপি। মানসম্মান আর রইল না।
তুমি ভাবো দৃশ্যটা, আমি লঞ্চের কেবিনে বসে আছি। আর আমার শ্বশুর যদি ঢুকে বলতেন, ভাই একটা বই কিনবেন? আমি কী করতাম? আমার মরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকত না।
কী করা যায় বাবাকে নিয়ে?
আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে –
জাহাঙ্গীর তাকায় শাহাদাতের দিকে, কী প্ল্যান?
বাবাকে কাছারিঘরের বড় রুমটার মধ্যে আটকে রাখলে কেমন হয়? আর বাড়িতে যত আদর্শলিপি আছে সব লুকিয়ে রাখব খাটের নিচে। কয়েকদিন বাড়ি থেকে বের হতে না পারলে বই বিক্রির ব্যাপারটা থেমে যেতে পারে। তুমি কী বলো? শাহাদাত তাকায় জাহাঙ্গীরের দিকে।
আইডিয়াটা ভালো; কিন্তু লোকে শুনলে বলবে কী?
লোকে কি এখন ভালো কিছু বলছে?
দ্বিধার করাতে কাটতে থাকে জাহাঙ্গীর, তা বলছে না; কিন্তু আটকে রাখাটা কি ঠিক হবে?
আমরা তো বাবাকে সম্মানের সঙ্গে রাখব। রুমে পর্যাপ্ত খাবার থাকবে। নরম গদিঅলা বিছানা থাকবে। মাঝে মাঝে আমরা গিয়ে গল্প করব। মোটের ওপর ওনার বই বিক্রির ব্যাপারটা ভুলিয়ে রাখা দরকার। কয়েক দিন বা মাসখানেক এভাবে রাখলে আমার ধারণা, বই বিক্রির ব্যাপারটা ভুলে যাবেন – জোর দিয়ে বলে শাহাদাত।
ঠিক আছে, কালকে থেকেই বাবাকে কাছারিঘরের বড় রুমটার মধ্যে রাখব। কিন্তু রাখলেই তো হবে না, তার সুবিধা-অসুবিধার দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে।
সেটা আমি রাখব, তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি তো সাত-আট দিন। অনন্ত এই কয়টি দিন আমি চোখে চোখে রাখতে পারব।
জামাতা এবং পুত্র নিজেদের মানসম্মান বাঁচাতে কফিলউদ্দিনকে কাছারিঘরে আটকে রাখে। প্রথমে ওরা ঘরটায় সুন্দর চেয়ার-টেবিল, বিছানাপত্র দিয়ে সাজিয়েছে। বাথরুমে যাওয়ার বদনা রেখেছে। খাবারের পানির কলস রেখেছে একটা। দুটি গ্লাস। সকালে উঠে কফিলউদ্দিন নাস্তা সেরে আদর্শলিপি কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগে ভরে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে মাত্র, জাহাঙ্গীর এসে সামনে দাঁড়ায়, বাবা কোথাও যাচ্ছেন?
হাসেন ষাটোর্ধ্ব কফিলউদ্দিন, যাবো না মানে? আমি তো এখনই বের হচ্ছি। কত জায়গায় যেতে হবে তুই জানিস? জানিস না। তুরাগপাড়া প্রাইমারি স্কুলে আজ আমার আদর্শলিপি বিতরণের দিন। ফুলের মতো ছেলেমেয়েরা আমার অপেক্ষা করছে। আমার কি দেরি করার সময় আছে?
যাওয়ার আগে একটু কাছারিঘরে আসবেন?
কাছারিঘরে কেন?
শাহাদাত তোমার সঙ্গে কী একটা জরুরি কথা বলবে –
ও শাহাদাত? চলো, ঢগঢগ করে পানি খেয়ে খালি গ্লাসটা রেখে ছাতাটা হাতে নিয়ে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ঢোকে কফিলউদ্দিন। শ্বশুরকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় শাহাদাত। শরীরের খোঁজখবর নিয়ে শাহাদাত আর জাহাঙ্গীর একসঙ্গে রুম থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়। হতভম্ব কফিলউদ্দিন জানালার সামনে এসে অবাক কণ্ঠে বলে – এসব কী হচ্ছে বাবারা?
বাবা, আপনার বয়স হয়েছে। আপনি রাস্তায় রাস্তায়, লঞ্চে-বাসে, স্কুলে স্কুলে গিয়ে বই বিক্রি করেন, আমরা চাই না – কথা বলতে বলতে জাহাঙ্গীর তাকায় শাহাদাতের দিকে।
জি বাবা, জাহাঙ্গীর ঠিকই বলেছে। সমর্থন করে বলে শাহাদাত – আপনার খাওয়া-পরার কি অভাব আছে? আপনি কেন বই বিক্রি করবেন? আজ থেকে আপনি এই ঘরে থাকবেন। খাবেন। সব আয়োজন থাকবে… আপনার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে ডাকবেন, আমি সব পৌঁছে দেব। প্রথম একটু খারাপ লাগবে আপনার, পরে ঠিক হয়ে যাবে…। বাবা, আমরা যা করছি, আপনার ভালোর জন্যই করছি…
কফিলউদ্দিন কয়েক মুহূর্ত নির্বাক তাকিয়ে থাকলেন পুত্র এবং জামাতার দিকে। গোটা ঘটনা করোটির ভেতরে নিয়ে যখন বুঝলেন তাকে বন্দি করা হয়েছে, তিনি বিবশ হয়ে গেলেন ভেতরে ভেতরে। পুত্র এবং জামাতা যে-ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল – চিৎকার-চেঁচামেচি করবে, লোক ডাকবে, দরজায় কশাঘাত বা লাত্থি মারবে, তার কিছুই না করে কফিলউদ্দিন রুমের ভেতরে খাটের ওপর বসলেন। মনটা অবশ। কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। বন্দি পরিস্থিতিতে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। একবার মনে হয়, চিৎকার করে কাছারিবাড়ির ঘর-দরজা ভেঙে বেরিয়ে সব গুঁড়িয়ে দিয়ে যেদিকে ইচ্ছা চলে যাবেন; কিন্তু নিজেকে নিজে থামালেন। পুত্র ও জামাতাকে একটি কথাও না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। জাহাঙ্গীর এবং শাহাদাত অবাক হলেও খুশি হয়েছে, যাক বাবা – কোনো ঝামেলা তৈরি করেনি। কয়েকটা দিন এভাবে থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বন্দি অবস্থা তিন দিন তিন রাত পার হয়েছে। কফিলউদ্দিন পুত্র বা জামাতার সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। নিয়মিত খাবার দেওয়া হচ্ছে, তিনি খাচ্ছেন। সময় কাটানোর জন্য ট্রানজিস্টার দেওয়া হয়েছে, কফিলউদ্দিন আগেও ট্রানজিস্টার শুনতেন। এখন বেশি সময় ধরে শুনছেন। তিন দিন পর এক সকালে, জাহাঙ্গীর আর শাহাদাত উপজেলা সদর ভা-ারিয়ায় চলে যায়। কফিল বিছানায় শুয়ে আছেন।
দাদু? এই দাদু? জাহাঙ্গীরের মেয়ে তৃণা জানালার ওপাশ থেকে ডাকছে। কফিল উঠে বসেন। চশমাটা চোখে দিয়ে দেখেন তৃণার সঙ্গে এসেছে শাহাদাতের ছেলে রজত। তৃণা পড়ে ফোরে। রজত পড়ে সিক্সে। দুজনার মধ্যে খুব ভাব। বিছানা থেকে নেমে কফিলউদ্দিন জানালার সামনে দাঁড়ান, কী দাদুরা? তোমরা কেমন আছো?
আমরা তো ভালো আছি। কিন্তু তোমাকে আটকে রেখেছে কেন নানাভাই? শাহাদাতের ছেলে রজত চটপট কথা বলে সবসময়।
গভীর বেদনামথিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কফিলউদ্দিন বলেন, আমি যে আদর্শলিপি বিক্রি করি –
আদর্শলিপি বিক্রি করলে কী হয়? পালটা প্রশ্ন করে তৃণা।
শোনো তোমরা, তোমাদের বলি। কারণ তোমাদের বাবা-মা জানে না। জানতেও চায় না। আমি যখন তোমাদের মতো স্কুলে পড়ি, ঠিক ক্লাস ফোরে আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা, তখন আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চাওয়া হয়েছিল।
কারা কেড়ে নিতে চেয়েছিল দাদু? জানতে চায় তৃণা।
পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকরা। শুরু হয় মায়ের ভাষা রক্ষার আন্দোলন। আমার বাবা শফিউদ্দিন ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। তখন ঢাকা থেকে পেপার আসত দুদিন পরপর। সেই পত্রিকা পড়ে এলাকাবাসীকে শোনাতেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনেক মানুষ এই অজপাড়াগাঁয়ে মিছিল করেছিল। সবার সামনে ছিল বাবা শফিউদ্দিন।
ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে তিনি ভাবলেন, দেশের ছেলেমেয়েদের কাছে বর্ণমালা পৌঁছে দেওয়া দরকার। তখন তো আর এত মানুষজন ছিল না, ছিল না যন্ত্রপাতি। বাবা ঢাকা থেকে হাজার হাজার কপি আদর্শলিপি কিনে এনে বিলাতে লাগলেন হাটে, মাঠে, স্কুলে আর স্কুলে। বিলাতেন আর বলতেন, আদর্শলিপির বর্ণ ও লেখাগুলো মুখস্থ করতে পারলে আমাদের সন্তানরা কখনো ভুলে যাবে না। আর ভুলে না গেলে ধ্বংস করাও সম্ভব হবে না। বাজারে দোকান দিলেন ‘ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি’। বাবা জানতেন, ভাষা বেঁচে থাকে বর্ণমালায়। সেই বর্ণমালা যদি একবার শেখা যায় কিংবা অসংখ্য শিশু-কিশোরকে শিখিয়ে দেওয়া যায় কেউ ধ্বংস করতে পারবে না বাংলাভাষা।
তারপর?
কফিলউদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, আমার বাবা মারা গেলে আমি ‘ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি’ চালাতে লাগলাম। লাইব্রেরির টাকায় তোদের মা-বাবাকে লেখাপড়া শিখালাম। বড় করলাম। আর এখন ওরা আমাকে বন্দি করে রাখে, চোখ ভিজে যায় জলে। আমি যদি আদর্শলিপি বিক্রি না করি কোথায় পাবে? আজকাল তো কেউ আদর্শলিপি পড়তে চায় না; কিন্তু আমি চাই এদেশের ঘরে ঘরে আদর্শলিপি পৌঁছে যাক…
দাদু?
ভেজা গলায় সাড়া দেন কফিলউদ্দিন, কী দাদাভাই?
তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমরা আসছি – তৃণা হাত ধরে রজতের। দুজনে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। কফিলউদ্দিন বিছানায় বসে ঝিমুতে শুরু করেন। অনেকদিন পর স্ত্রী সুফিয়াকে খুব মনে পড়ে। সুফিয়া তিন দিনে বাড়িতে ল-ভ- বানিয়ে দিত; যা ভালোবাসত কফিলউদ্দিনকে।
দরজা খুলে যায়। অবাক কফিলউদ্দিন, দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে তৃণা আর রজত। তৃণার হাতে তালা আর চাবি। রজতের হাতে আদর্শলিপির ব্যাগ।
দরজা খুললে কীভাবে?
বাবা চাবি রেখেছিলেন ড্রয়ারে, চুপিচুপি বলে তৃণা। সেখান থেকে নিয়ে এসেছি।
আর আদর্শলিপি লুকিয়ে রেখেছিল খাটের নিচে। সেখান থেকে নিয়ে এসেছি – বলতে বলতে রজত হাত ধরে নানার, চলো এখন।
কোথায় যাবো?
আমরা দুজন তোমার সঙ্গে ঘরে ঘরে আদর্শলিপি বিক্রি করব।
কফিলউদ্দিনের বুকের ভেতর হাজার হাজার বর্ণমালা নাচতে আরম্ভ করে, বাঁধভাঙা জোয়ারের উচ্ছ্বাস তার কণ্ঠে, সত্যি বলছ তোমরা?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। দেখি, আমাদের কে আটকায়? দাদার হাত ধরে তৃণা।
চলো।
তিনজনে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।
গ্রামের লোকেরা অবাক চোখে দেখছে, কফিলউদ্দিন হাতে আদর্শলিপি নিয়ে প্রায় দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, লাগবে আদর্শলিপি? মনে রাখুন আদর্শলিপির চিরন্তন উপদেশ – ঔদার্য্য অতি মহৎ গুণ, ঔষধি গাছ পাকিলে মরে যায়… অতি লোভে তাঁতি নষ্ট…
নানার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায় রজত, হাতে আদর্শলিপি। চিৎকার করে চারপাশের মানুষদের বলছে… আপনারা বর্ণমালা নেবেন? বর্ণমালা! রফিক-সফিক-জব্বারের বর্ণমালা!
দুজনের একটু পেছনে তৃণা হাঁটছে আর বাতাসে পতাকার মতো আদর্শলিপি দোলাতে দোলাতে বলছে, আমার কাছে আদর্শলিপি আছে, বর্ণমালা আছে… স্বরে অ আছে, স্বরে আ আছে… আপনারা কী নেবেন… আসুন আমার কাছে…
পথের মানুষ তাকিয়ে থাকে আদর্শলিপির ফেরিঅলাদের দিকে।