আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ

আতিয়া ইসলাম এ্যানি
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সার্ধশতজন্মবার্ষিকী পালিত হলো বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
এই মহামানবের বিচরণ ছিল সাহিত্যের সব শাখায়। ১৯১৬ সালে কবিগুরু একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন। তাই কবির সার্ধশতজনমবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনেও ছিল নানা আয়োজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো শান্তিনিকেতনে দুই দেশের শিল্পীদের অংশগ্রহণে আর্ট ক্যাম্প (১-৫ মে, ২০১২)। বাংলাদেশের শিল্পীরা ছিলেন – কাইয়ুম চৌধুরী, তাহেরা চৌধুরী, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, আবদুস শাকুর শাহ, ফরিদা জামান, সুবীর চৌধুরী, কাইয়ুম কে এম আবদুল, মো. মনিরুজ্জামান ও আতিয়া ইসলাম। ভারত থেকে অংশ নেন – পংকজ পানওয়ার, গৌতম দাস, দিলীপ মিত্র, প্রশান্ত সাহু ও অর্ঘ্যপ্রিয় মজুমদার।
ভারত যাত্রার প্রাক্কালে ১ মে মঙ্গলবার সকালে শিল্পীরা একত্রিত হলাম বেঙ্গল শিল্পালয়ের ক্যাফেতে। দেখা গেল সবার টিকিট-পাসপোর্ট গোছানো নিয়ে ব্যস্ত সুবীর চৌধুরী। সাংগঠনিক কাজে সুবীর চৌধুরীর দক্ষতা সেই শিল্পকলা একাডেমী থেকে দেখে আসছি। তাঁর ওপর সব ভার ছেড়ে আমরা নিশ্চিন্ত।
সকাল থেকেই মনের মধ্যে একধরনের মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। সেটা উত্তেজনা, নাকি নস্টালজিয়া, বুঝতে পারছিলাম না। যাঁদের সান্নিধ্যে একসঙ্গে কটা দিন ছবি অাঁকব, তাঁর মধ্যে আছেন আমার কৈশোরের প্রিয় ব্যক্তিত্ব কাইয়ুম চৌধুরী। এর সঙ্গে জড়িত গাজী ভাই ও সচিত্র সন্ধানীর স্মৃতি। আমার বিএফএর প্রিয় শিক্ষক রফিকুন নবী। আছেন মাহমুদুল হক, ১৯৭৭ সালে চারুকলায় ভর্তির পর আমার প্রথম শ্রেণিশিক্ষক। নানান স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মে দিবসের ছুটির কারণে রাস্তা ফাঁকা। চট করেই বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম।
সবাই একসঙ্গে ইমিগ্রেশন পার হয়ে যথাসময়ে বাংলাদেশ বিমানে। দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছে টের পেলাম – আমরা সরকারি অতিথি। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল অফিসার আমাদের গোলাপ ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। দুপুর প্রায় ৩টা। অপেক্ষমাণ গাড়িবহর আমাদের নিয়ে ছুটল বোলপুর, শান্তিনিকেতনের পথে।
সেই সকালে হালকা নাস্তা করে বাসা থেকে বেরিয়েছি। ইতিমধ্যে সবাই বেশ ক্ষুধার্ত। গাড়িতে আমরা তিনজন – সুবীর চৌধুরী, ফরিদা জামান ও আমি। সুবীরদা সঙ্গী থাকায় সুবিধা হলো, আমরা যে অভুক্ত এই বার্তা দ্রুত পৌঁছে গেল প্রটোকল অফিসারের ফোনে। কিন্তু যাত্রাপথে বহুদূর পর্যন্ত কোনো দোকান, হোটেল, ঘরবাড়ি কিছুই চোখে পড়ল না। বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়িবহর থামল যে-স্থানে, তার দুপাশে দোকানে বড় বড় করে লেখা ‘ল্যাংচা’। দোকানটি মূলত মিষ্টির। আর এখানকার মিষ্টির নামই ‘ল্যাংচা’। গরম শিঙাড়া, মিষ্টি, চা দিয়ে মধ্যাহ্নের আহার করলাম, বিকেল তখন প্রায় ৫টা। দিল্লি রোড ধরে আবার যাত্রা শুরু। গাড়িতে ঘুমিয়ে কিছুটা ক্লান্তি দূর হলো। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বহর সোজা এসে ঢুকল সৃজনীতে (পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র)। সন্ধ্যার আলো-অাঁধারিতে দেখলাম রঙিন নকশি কাগজ ও বাঁশ দিয়ে চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে প্রবেশদ্বার ও অনুষ্ঠানস্থল। মঞ্চও সুসজ্জিত। এখানেই আর্ট ক্যাম্পের উদ্বোধনী। ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পীদের উত্তরীয় পরিয়ে, ফুল ও উপহার দিয়ে মঞ্চে বরণ করা হলো।
দুই দেশের শিল্পীদের অংশগ্রহণে আর্ট ক্যাম্পের উদ্বোধন করলেন রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সৌমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
উদ্বোধনী ভাষণের পর সাদা ক্যানভাসে ছবি অাঁকলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও শিল্পী রফিকুন নবী। একে একে সব শিল্পী ক্যানভাসজুড়ে ছবি অাঁকলেন। এরপর ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী নাচ সবাইকে মুগ্ধ করে।
গেস্ট হাউসে ফিরে বসল আড্ডা। মজার মজার কৌতুক ও পানীয় সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিলো। প্রথমদিনের একটা ব্যাপার ছিল, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ, হরতাল ও পরিবারের খবর নেওয়া। সুবীরদা আর হক স্যারের ফোন সদা সচল। আমি ঢাকা থেকে সিম নিয়ে গেলেও সেটা ছিল অকার্যকর। এদিকে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে এই আনন্দযাত্রার কথা ভাগাভাগি করতে মন চাইছিল। হক স্যার বোধহয় ব্যাপারটা অাঁচ করতে পেরেছিলেন। মজা করে বললেন, মাত্র তিন টাকা মিনিটে আমার ফোন থেকে কথা বলা যায়। আমি ঝটপট সুযোগটা কাজে লাগালাম।
পরদিন সকালে প্রাতরাশে সবাইকে স্বাগত জানালেন ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের টেগর কনসালট্যান্ট মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘাঙ্গী, ফর্সা, হাসিখুশি মহিলা। মাহমুদুল হক স্যারের নানা রকম মজার কথায় নাস্তার টেবিল ছিল সরব। সবশেষে মধুছন্দাকে স্যার প্রশ্ন করলেন, খাওয়া-দাওয়া তো হলো, এবার বলেন আমাদের কী করতে হবে? হক স্যারের বলার ভঙ্গিতে মহিলা হেসে লুটোপুটি। বলেন কি! কী করতে হবে? ছবি অাঁকার এতো আয়োজন। স্যার আয়েশি ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা তাহলে ছবি অাঁকতে হবে – চলেন যাই।
গেস্ট হাউস থেকে সামান্য দূরত্বে সৃজনী। বৈশাখের উত্তাপে তপ্ত বাতাস। ঢাকার চেয়ে গরম অনেক বেশি। আশঙ্কা হচ্ছিল এই গরমে স্বস্তিতে ছবি অাঁকা যাবে তো? শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে এসে দেখা গেল ছবি অাঁকার আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের বিশাল ছাউনির পাশে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে। সামনে আড্ডার জন্য চেয়ার-টেবিল, চা-কফির ব্যবস্থা। তিন সাইজের ক্যানভাস, রং, তুলি ইত্যাদি নিয়ে প্রস্ত্তত অঞ্জনদা (বিভিন্ন আর্ট ক্যাম্পে তিনি এসব আয়োজনের দায়িত্ব পান), সঙ্গে তাঁর ছেলেও সাহায্য করল। শিল্পীরা যাঁর যাঁর মতো কাজ শুরু করলেন।
প্রথমে ক্যানভাসে টেক্সচার দিয়ে কাজ শুরু করলেন মাহমুদুল হক। কাইয়ুম চৌধুরী গ্রামীণ দৃশ্যের পটভূমিতে কবিগুরুর একটি প্রতিকৃতি অাঁকলেন। রফিকুন নবীর রবীন্দ্রনাথ দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে। নিচে চমৎকার হাতের লেখা –
ততক্ষণ ক্ষণে ক্ষণে
আসে যায় আপন মনে।
আবদুস শাকুর শাহ তাঁর নিজস্ব রীতিতে দুটো সুন্দর ছবি অাঁকলেন। এই ক্যাম্পে নতুন যে-বিষয়টি আমি আবিষ্কার করলাম তা হলো, চিত্রশিল্পী সুবীর চৌধুরী। সুবীরদাকে দেখছি তাও প্রায় বত্রিশ বছর হবে। আমি কোনোদিন তাঁর অাঁকা ছবি দেখিনি। ক্যাম্পে তিনি স্বয়ং ছবি অাঁকছেন। নবীস্যার অবশ্য আশঙ্কা (রসিকতা) প্রকাশ করলেন, সুবীর ছবি অাঁকা শুরু করলে কিন্তু আমাদের বিপদ। বিক্রির বাজার ওর দখলে চলে যাবে।
মধ্যাহ্নভোজের নির্দিষ্ট সময় মেনে সবাইকে গেস্ট হাউসে ফিরতে হলো। বিকেলে আবার ছবি অাঁকা। দুটো ক্যানভাসে প্রথমে ড্রইং করে নিয়ে আমি রং ভরছি। হঠাৎ চেনা কণ্ঠস্বর। দেখি শিল্পী নিসার হোসেন ঢাকা থেকে এসেছেন। কিছুক্ষণ হইচই, কথাবার্তা চলল। এর মধ্যে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। একটা মজার ঘটনা হলো, গেস্ট হাউসে নিয়মমতো বিকেলের নাস্তা তৈরি করা হতো। কিন্তু শিল্পীরা কেউ কাজ রেখে নাস্তা খেতে যেতেন না। অগত্যা নাস্তার আয়োজনসহ বাবুর্চিই ক্যাম্পের সামনে চলে এলেন।
শান্তিনিকেতনের পুরো এলাকাটা আমার কাছে মফস্বল শহর মনে হলো। আসা-যাওয়ার পথে এখানকার যে-জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগল, তা হলো সাইকেল। অধিকাংশ ছেলেমেয়ে সাইকেলে চলাফেরা করছে। শাড়ি পরেও কী অনায়াসে মেয়েরা সাইকেল চালাচ্ছে। সকালে স্কুলড্রেস-পরা একদল মেয়ে একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল – দৃশ্যটা এখনো চোখে লেগে আছে। এই এলাকায় রিকশা চোখেই পড়ে না, ভাড়াও ঢাকার তুলনায় অনেক বেশি।
৩ মে সকালে আমরা শান্তিনিকেতনের কলাভবন পরিদর্শনে গেলাম। সেইসব মাটির ঘর, রামকিংকরের ভাস্কর্য দেখে মনে পড়ে গেল প্রায় ২৮ বছর আগের কথা। ঢাকা চারুকলার ১৯৭৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিএফএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষে শিক্ষাসফরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলাম। শিল্পী হাশেম খানের নেতৃত্বে সেবার যখন শান্তিনিকেতনে পৌঁছলাম, তখন ছিল গ্রীষ্মের ছুটি। ফলে বাইরে ঘুরেফিরে চলে যেতে হয়েছিল।
কলাভবনে পৌঁছতেই দেখা মিলল বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সুমন ওয়াহিদ ও ঝোটনের। ওরা ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে এসেছে। প্রচন্ড গরমে ওরা সবাইকে পানি দিলো। ছাতিম গাছের নিচে কিছুক্ষণ স্যাররা বসলেন। এলেন শিল্পী সনৎ কর, দিলীপ মিত্র, অজিত শীল প্রমুখ। কলাভবনের আঙিনায় দৃষ্টি কাড়ে পরপর দুটো মাটির ঘর। চালা থেকে নিচ পর্যন্ত প্রখ্যাত শিল্পী ও শিক্ষক সুব্রহ্মণ্যনের দক্ষ ড্রইংনির্ভর ছবি অাঁকা। একটি মাটির রঙে সাদা ছবি, অন্যটি কালোর মধ্যে সাদা ছবি। চমৎকার এই ঘর দুটো দেখে আমরা গেলাম নন্দনে। সামনেই ছাত্রদের পরীক্ষা। সারাবছরের কাজ একসঙ্গে নিজের মতো করে ছাত্ররা ডিসপ্লে করছে নন্দনে। পরীক্ষকরা দেখে নম্বর দিচ্ছেন। এভাবে একজন ছাত্র একবেলা করে ডিসপ্লে করছে। ছাত্রদের সারাবছরের কাজ মূল্যায়নের এই পদ্ধতি আমার কাছে খুবই উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়েছে। কলাভবন থেকে রাস্তা পার হয়ে আমরা দেখে এলাম রবীন্দ্র জাদুঘর।
প্রয়াত শিল্পী সোমনাথ হোর থাকতেন কলাভবন থেকে কিছুটা দূরে। তাঁর মৃত্যুর পর তার কন্যা বাড়িটি কলাভবনকে দান করেছেন। আমরা সেটি দেখতে গেলাম। ছাপচিত্র বিভাগের প্রধান অজিত শীল আমাদের স্বাগত জানালেন। এখানে ছাপচিত্রের একটি গ্যালারি করা হয়েছে। তাছাড়া একটি মেশিন আছে, ছাপচিত্রে আগ্রহীরা কাজ করতে পারেন। আবাসিক থাকার ছোটখাটো বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
সন্ধ্যায় গেলাম সোনাঝুড়ি পল্লীর শান্তিনিকেতন সোসাইটি অব ভিজুয়াল আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন পরিদর্শনে। দেড় বিঘা জমির ওপর চমৎকার স্থাপত্য নকশার একটি প্রতিষ্ঠান। এতে রয়েছে গ্যালারি, পাঠাগার, আবাসিক ব্যবস্থা ইত্যাদি। বিশেষ করে শিক্ষাজীবন শেষ করার পর জায়গার অভাবে যাঁরা কাজ করতে পারেন না, তাঁরা ইচ্ছা করলে আবাসিক সুবিধা নিতে পারেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এই প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ শিল্পীদের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে। কোনো বিত্তবান বা করপোরেট সাহায্য নেওয়া হয়নি। নীতিগতভাবে এর উদ্যোক্তারা সেটি চান না। সোসাইটির সক্রিয় সদস্য দিলীপ মিত্র জানালেন, এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ১২ জন। বর্তমানে মোট সদস্য ৩০ জন। এর অর্থায়নের জন্য সর্বভারতীয় ১৫০ জন শিল্পীর কাছ থেকে ড্রইং আহবান করা হয়। সেই ড্রইং প্রিন্ট করে বিক্রয়লব্ধ প্রায় ৭০ লাখ টাকা দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। বিপিন গোস্বামী, যোগেন চৌধুরী প্রমুখ প্রথিতযশা শিল্পী এর সঙ্গে জড়িত আছেন। এখানে রবীন্দ্র-চিত্রকলার ওপর আলোচনার আয়োজন করা হয়। এই উপলক্ষে কলকাতা থেকে এসেছিলেন বিশিষ্ট শিল্প-সমালোচক ও লেখক প্রণবরঞ্জন রায়। এই অনুষ্ঠানের বড় প্রাপ্তি হলো, রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ শিবকুমারের দীর্ঘ বক্তৃতা। বাংলাদেশ থেকে আলোচনা করেন কাইয়ুম চৌধুরী ও রফিকুন নবী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন শিল্পী ঝনাকি ঝংকর।
৪ মে সারাদিন ছবি অাঁকা শেষে সবাই স্বাক্ষর করে সমাপ্তি টানতে লাগলেন। সন্ধ্যায় সবার ছবি ডিসপ্লে করা হলো। বিকেল থেকেই কিছু দর্শনার্থী আসছিলেন। মধুছন্দা জানালেন, ক্যাম্পে অাঁকা এসব ছবি দিল্লিতে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া তাঁর দায়িত্ব।
সন্ধ্যার পর সবাই মিলে কোপাই নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। যাওয়ার পথে দুজন শিল্পীর বাড়ি দর্শন করলাম যাঁরা কলকাতা থেকে এসে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে এখানে বসবাস করছেন। পরে কোপাই নদীর পাশে ছোট একটি চায়ের দোকানে বসলাম আমরা। কুপির আলোয় চা-বিক্রেতা মেয়েটির কালো কপালে লাল টিপ অপূর্ব এক দ্যোতনা সৃষ্টি করল। কেউ দুধ-চিনি ছাড়া লিকার, কেউ দুধ হবে চিনি নয়, কেউ চিনি কম ইত্যাদি কথাবার্তার মাঝে আমার মনের মধ্যে অভূতপূর্ব এক অনুভূতির জন্ম হলো। আমি ভাবছিলাম, কিছুদিন আগে আমরা কাইয়ুম স্যারের অশীতিতম জন্মদিন পালন করলাম। আজ এ-সন্ধ্যায় ছোট মাটির ঘরে আলো-অাঁধারিতে আমরা একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছি। চারদিকে অন্ধকার। এমন সন্ধ্যা জীবনে আর কখনো আসবে কি! কোপাই নদীর আশপাশের সবকিছু অন্ধকারে সাদা-কালো ছিল। শুধু এ-মুহূর্তের স্মৃতি আমার জীবনে রঙিন হয়ে থাকবে।
রাতে গেস্ট হাউসে ফেরার পথে আমি কলাভবনের গেটে নেমে গেলাম চারুকলার ছাত্র সুমন ওয়াহিদের স্টুডিও দেখতে। আগামীকাল সকালে আমরা কলকাতা রওনা হবো। ওর কাজ না দেখে গেলে আফসোস হবে। বড় বড় ক্যানভাসে কাজগুলো ভালো লাগল। বাস্তবধর্মী অনুশীলনে ওর দক্ষতা চমৎকারভাবে এই পর্বের ছবিতে কাজে লাগিয়েছে। আরো চারজন ছাত্রের কাজ দেখে আলোচনা করলাম। ওরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছে।
ফেরার পথে দেখলাম রাতের শান্তিনিকেতন। একেবারে নিরিবিলি। লোকজন, রিকশা কিছুই নেই। অনেকটা পথ হেঁটে একটা রিকশা পেলাম। ফলে গেস্ট হাউসে ফিরতে একটু দেরি হলো। ততক্ষণে রাতের আড্ডা জমে উঠেছে। আমি দেরি করে ঘরে ঢুকতেই নবী স্যার বললেন, তুমিও কি সুবীর হয়ে গেলে নাকি? সুবীর যেখানেই যায় কিছু কাজ সঙ্গে নিয়ে যায়। কথাটা সবাই বেশ উপভোগ করলেন।
সকালে আমাদের গাড়িবহর চলল সল্টলেকের দিকে। ওখানে আমাদের হোটেল। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা যাত্রা করে দুপুরে পৌঁছলাম। ঝটপট দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে সবাই মিলে ছুটলাম চেনা কলকাতার দিকে। ছুটলাম বলছি এজন্য যে, সন্ধ্যায় বাংলাদেশ দূতাবাসে শিল্পী প্রতিনিধিদলের সম্মানে অনুষ্ঠান। ফলে যাওয়া-আসার সময় বাদ দিলে হাতে এক ঘণ্টার মতো থাকবে নিজেদের মতো কাটাবার। তিনটি দলে ভাগ হয়ে গেলাম আমরা। আমি ও চট্টগ্রামের কাইয়ুম ভাই ভাবিসহ একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের ফিরতে একটু দেরি হচ্ছিল। সায়েন্স সিটির কাছাকাছি আসতেই সুবীরদার ফোন। কিছুটা রাগ, কিছুটা টেনশন। চটজলদি তৈরি হয়ে সময়মতোই সবাই পৌঁছে গেলাম পার্ক স্ট্রিটে। সবাইকে স্বাগত জানালেন কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম। খুব শান্ত ছিমছাম ভদ্রমহিলা। অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটা বিষয় হলো, দূতাবাসে আরো দুজন মহিলা কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা বয়সে নবীন। একজন জানালেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে যোগ্যতা থাকলে মেয়েদেরকেও দূতাবাসের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে হবে। আগে শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে দেশের বাইরে অনেক মেয়েই কাজ করার সুযোগ পাননি।
দূতাবাসের নৈশভোজে কলকাতার বিশিষ্ট প্রবীণ শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ফলে সুনীল দাস, শুভাপ্রসন্ন, যোগেন চৌধুরী, গণেশ হালুই, ঈশা মোহাম্মদ, ধীরাজ চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে দেখা হলো। চমৎকার আড্ডায় কাটল কিছুটা সময়।
পরদিন দুপুরে ঢাকায় ফেরার পালা। রাতেই যাওয়ার প্রস্ত্ততি শেষ। সময়মতো ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গাড়ি নিয়ে উপস্থিত।
দমদম থেকে মাত্র তিরিশ মিনিটে উড়ে এলাম ঢাকায়। সেই চেনা শহর, চেনা রাস্তা, কোলাহল, যানজট। 