আবুল হোসেন : আমাদের প্রথম আধুনিক কবি

আহমেদ মাওলা

আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪) আমাদের বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার যে-ধারা উত্তরকালের কবিদের হাতে বিকশিত হয়েছিল, আবুল হোসেন ছিলেন সে-ধারার সফল উত্তরাধিকারী। জীবনদৃষ্টি ও কাব্যভাষা দিয়ে তিনি আমাদের যুক্ত করেছিলেন আধুনিকতার সঙ্গে। তাঁর সমসাময়িক মুসলমান কবিরা হলেন আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, বেনজীর আহমদ, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, মহিউদ্দিন, হুমায়ুন কবির, কাজী কাদের নেওয়াজ, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের এই মুসলমান কবিরা, তাঁরা সেই সময়ে খুব পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আধুনিকতাটা তাঁরা বুঝলেনই না। তাঁরা লিখলেন পুরনো ধাঁচের কবিতা। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ছিলেন কবি আবদুল কাদির। তাঁর রুচি, রসবোধ ও পান্ডিত্য ছিল কিন্তু তিনিও হাঁটলেন পুরনো পথে। আধুনিকের পথে হাঁটলেন খুব স্বল্পসংখ্যক কবি – আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস এবং আবুল হোসেন। তাঁদের মধ্যে আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ (১৯৪৭), ফররুখ আহমদের সাতসাগরের মাঝি (১৯৪৪) এবং আবুল হোসেনের নববসন্ত প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র-সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধানতম মুখপত্র কবিতা পত্রিকায় গ্রন্থটির আলোচনা করেন নীহাররঞ্জন রায়, রূপায়ণে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, কৃষকে আবুল মনসুর আহমদ, সওগাতে গোলাম কুদ্দুস, চতুরঙ্গে শওকত ওসমান। একই সময়ে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের (১৯১৯-২০০৩) পদাতিকের (১৯৪০) প্রথম কবিতা ‘সকলের গানে’র পঙ্ক্তি – ‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?/ কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে’ এবং আবুল হোসেনের নববসন্ত গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘নবযুগে’র শেষ দুটি পঙ্ক্তি – ‘কান পেতে দ্বারে সারারাত জেগে রই/ আসে আসে সে যে শুয়ে শুয়ে শুনি।’

দুটি কবিতাতেই আসন্ন নতুন যুগের বার্তা ধ্বনিত হয়েছে। আবুল হোসেনের নববসন্তে স্পন্দিত হয়েছে মূলত বাঙালি মুসলমানের আধুনিক হয়ে ওঠার বার্তা। তিরিশের কবিদের প্রধান ছন্দ ছিল অক্ষরবৃত্ত আর আবুল হোসেনের নববসন্ত কাব্যগ্রন্থে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং মুক্তক অক্ষরবৃত্তের অমিল, সমিলের কবিতা আমরা দেখতে পাই। আধুনিক বাংলা কবিতা বলতে যা বোঝায়, তার জন্মই হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে বিরোধিতা করে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতাকে এত মিষ্টি করে ফেলেছিলেন যেন, এটা খুব একটা পেলব জিনিস, শুধু গীতিময়তা। গীতিময়তা থেকে দার্ঢ্য এনে দেওয়ার কাজটি করেছিলেন তিরিশের কবিরা সম্মিলিতভাবে। কাব্যভাষার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এলো গদ্যকবিতা। রবীন্দ্রনাথই প্রথম গদ্যকবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন, অবশ্য গদ্যকবিতায় তিনি একধরনের গল্প বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল, ছন্দমিলের  যে-কবিতা, সেটাতে সবকিছু লেখা যায় না। গদ্যকবিতার মধ্যে একটা প্রাত্যহিকতা আছে, তার ঊর্ধ্বে নয়। এটা যে সঠিক নয়, তা উত্তরকালে সমর সেন প্রমাণ করেছেন। সমর সেনই সাহসিকতার সঙ্গে বাংলা কবিতাকে গৎবাঁধা নিয়মের মধ্য থেকে বের করে গদ্যকবিতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। আবুল হোসেন আত্মমুক্তির পথ খুঁজে পেলেন সমর সেনের অনুসৃত পথেই। এক সাক্ষাৎকারে আবুল হোসেন বলেছেন – ‘আমার মনে হলো, আমি কবিতা শিখবো সেই ভাষায়, যে ভাষায় মানুষ কথা বলছে হাটবাজারে, ড্রয়িংরুমে। যে কারণে আমি সমর সেনকে বড় কবি বলি, সেটা হচ্ছে গদ্যকবিতা, এই গদ্যকবিতায় যে ছন্দরস থাকতে পারে, সেটা এনেছেন সমর সেন। আমি সমর সেনের কাছে এটা শিখেছি।’ (কালের খেয়া, ১৫০ সংখ্যা, ২৯ আগস্ট, ২০০৮)

আবুল হোসেন প্রথম লিখলেন সমিল গদ্যকবিতা –

আজকের দিনে রান্নাঘরের অন্ধকারের মাঝে

যে মেয়েরা বসে চীনে বাসন মাজে

মশলা পিষতে চোখ ভরে আসে জলে

তাদেরো অন্ধ জীবনের তলে

উঁকিঝুঁকি মারে রাজকুমার। পেঁয়াজ কাটার ফাঁকে

মনের গহনে রবিঠাকুরের একটি লাইন হয়তো চিত্র অাঁকে

হয়তো কখনো মনে তোলে দোলা

শেলির একটি কবিতা, আত্মভোলা

কীটসের অমর ওডগুলো

হয়তো পথের ধুলো

সংবাদ আনে রাজকুমারের আগমনের সুপ্ত মনের

আড়াল দেওয়া পর্দাটা যায় ফেঁসে

একটি নিমিষে।

(‘আমরা : বাংলার মেয়ে’, নববসন্ত)

আবুল হোসেনের নববসন্ত গ্রন্থে শব্দে, ছন্দে, উপমায় তিনি অবিরলভাবে প্রয়োগ করেছেন সে-যুগের কঠিন সমাজবাস্তবতা। কবিতায় মানুষের মুখের ভাষার অনুবর্তী কত সাধারণ হওয়া যায়, তার দিকেই অগ্রসর হয়েছেন তিনি। এটাই হচ্ছে আবুল হোসেনের স্বোউপার্জিত আধুনিকতা। আবুল হোসেন এভাবে তাঁর নিজস্ব জগতে প্রবেশ করেন এবং বাক্রীতি ও কাব্যভাষায় আত্মসাক্ষাৎ লাভ করেন।

আমাকে অমর করতে চায় মৃত্যু

ইতিহাসের পাতায়, যুগের ভাষায়, মানুষের কথায়

লক্ষ বুকের স্পন্দনে।

বাঁচিয়ে রাখতে চায় অনন্তকালের জন্য

তার জীয়নকাঠির স্পর্শ দিয়ে

কারণ মৃত্যুকে করেছি আমি জয়।

মৃত্যুতে কবিরা অমর হন। কবি ও ব্যক্তি এ দুয়ে মিলে হয়ে ওঠে শিল্পী ও শিল্প। প্রায় ৯২ বছর বয়স পেয়েছিলেন আবুল হোসেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত প্রকাশের পর তিনি নতুনধারার কবি হিসেবে বোদ্ধা পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য। ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ কবি, লেখক, সমালোচকের সঙ্গে। তাঁর কর্মজীবনও ছিল বৈচিত্র্যময়, শেষে যুগ্মসচিব থেকে অবসরে যান। কিন্তু যেখানে কাজ করেছেন, ছিলেন কবিতায় নিমগ্ন। প্রথম জীবনে প্রচুর লিখলেও পরে আবু সয়ীদ আইয়ুবের পরামর্শে লেখা কমিয়ে দিয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব বললেন, এত যে লিখছেন, এতে কি লেখার মান ধরে রাখা যায়? আবু সয়ীদ আইয়ুবের কথাটা আমার ভালো লাগলো, আমি গুরুত্ব দিলাম। উনি অনেক বড় মাপের সাহিত্য সমালোচক ছিলেন।’ আবুল হোসেনের সাহিত্য-রুচি গড়ে উঠেছে আইয়ুবের আদর্শে। উত্তরকালের আবুল হোসেন লেখালেখিতে বিরলপ্রজ, সংযত-রুচিশীল শিল্পবোধের পরিচায়ক হয়ে ওঠেন। নববসন্তের পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বিরস সংলাপ (১৯৬৯) প্রকাশিত হয় প্রায় ২০ বছর পর। তাঁর অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে – হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২), দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে (১৯৮৫), এখনও সময় আছে (১৯৯৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৭), আর কিসের অপেক্ষা (২০০০), রাজকাহিনী (২০০৪), অনুবাদ – ইকবালের কবিতা (১৯৫২), আমার জন্মভূমি (১৯৭৮), অন্য ক্ষেত্রের ফসল (১৯৯০), আবুল হোসেনের ব্যঙ্গ কবিতা (১৯৮২), আবুল হোসেনের প্রেমের কবিতা (২০০৮), স্মৃতিকথা – আমার এই ছোট ভুবন (২০০০), আর এক ভুবন (২০০৫)।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা। তাঁর ব্যঙ্গ কবিতার শিরোনাম হচ্ছে ‘জনগণের বাসর’, ‘ফতোয়াবাজি’, ‘দেশোদ্ধার’, ‘গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতিক’, ‘সন্ত্রাস’ ইত্যাদি। একটা কবিতা হচ্ছে –

তামাকও খান, ডুডুও খান

তীর্থে যান হিন্দুস্থান

এক সময় প্রাণের টানে

নুন খেয়েছেন পাকিস্তানে

কখনো রুশ কিংবা চীনি

কখনো খোদ মার্কিনি

যখন পানি যেদিকে গড়ায়

নেমে পড়েন সেদিকটায়।

এই কবিতা পড়লেই বোঝা যায়, আবুল হোসেন সমকালীন লুম্পেন সমাজকে কোন দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি দেখেছেন দুঃস্বপ্নের বর্তমান এবং জীবনের দুঃসহ বাস্তবকে। তাঁর গ্রন্থের শিরোনাম হয় তাই দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে। কোনো রূপকথার অতীত নয়, ভবিষ্যৎও যেন দুঃস্বপ্নমন্ডিত। দেশ, কাল, আত্মতা, স্বাভাবিকভাবেই ধরা পড়েছে তাঁর কবিতায় :

স্মৃতিচূর্ণ – যখন বয়স ছিলো দল বেঁধে তরুণ বন্ধুরা

আসতো মৌমাছির মতো, কখনও একাকী। সেই এক

ওড়ার সময়, মাটিতে পা পড়ে না। আর এখন

যে যার বাজারে গেছে। পাংশু অাঁশটে ঘরে বাতি জ্বেলে

বসে আছে যক্ষের মূর্তির মতো একা একজন

নিঃশব্দ বিনিদ্র পাহারায়। অথবা বুদ্ধের মূর্তি

সে, নির্বাণ প্রার্থনায়, ক্ষুধা-তৃষ্ণাহীন। শব্দ নেই

ঘরময় কালের যাত্রার স্মৃতি গমগম করে।

(‘সঙ্গ : নিঃসঙ্গতা’, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে)

যাপিত জীবনের প্রাত্যহিকতায় তিনি ক্লান্ত নন, তবে নিঃসঙ্গতা ও দুঃখের অনুভূতি এমন সূক্ষ্ম যে, তাকে পরিব্যক্ত করতে হয় জীবনেরই রূপকল্পে। কবিতার ভেতরে তিনি সঞ্চার করে দেন সময়ের বিচূর্ণ বাস্তবতা। বিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত আবুল হোসেন যাপন করে গেছেন সংহত এক শিল্পীর জীবন। তাঁর স্বাতন্ত্র্য, সততা ও সমাজ-সচেতনতা এবং আধুনিক জীবনদৃষ্টি সমকালীন কবিকর্মীকে পথচলায় প্রেরণা জোগাবে নিশ্চয়। আবুল হোসেন মুসলমান বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক কবি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।