আমাদের চার বন্ধুর গল্প

Amader Char Bandhuবোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ঢাকা, ২০১০-এর শেষদিক।

দুই

পাপেভরা ইউরোপ এবং জাঁকালো আমেরিকার মধ্যে আমার চলাফেরা। আবার জাঁকালো ভারত এবং পাপেভরা বাংলাদেশের মধ্যে আমার আনাগোনা। একসময় আমরা সাহিত্য ও সাংবাদিকতা নিয়ে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমরা : ঢাকার আমি, মুম্বাইয়ের গৌরী, প্যারিসের সুজান এবং আমেরিকার অ্যাবি। আমাদের সেইসব দিন ছিল উদ্দাম হাসির, ক্ষণিক প্রেমে পড়ার, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ঘুরে বেড়ানোর। এভাবেই আমরা আবিষ্কার করেছি পাপেভরা ইউরোপ এবং জাঁকালো আমেরিকার, আবিষ্কার করেছি জাঁকালো ভারত এবং পাপেভরা বাংলাদেশের। আমরা চার বন্ধু পাপ উদ্ভাবন করেছি এবং পুণ্য ছিটিয়ে দিয়েছি। আমরা চার বন্ধু অর্থাৎ চার তরুণী জীবনে পা ফেলে ফেলে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমরা ঠিক করেছি, একধরনের কথা দেওয়া, দুবছর পরপর যেখানেই থাকি, আমরা দেখা করব, পুরনো দিনের কথা বলব, বর্তমানের কথা বলব এবং ভবিষ্যতের প্ল্যান করব। আমরা জীবনের অন্য মানে খুঁজব। একটাই তো জীবন।

এর মধ্যে আমি বিয়ে করেছি। যাকে বিয়ে করেছি তার সঙ্গে থাকি এবং থাকিও না।

গৌরী চার বছর প্রেম করার পর, যাকে বিয়ে করেছে তার সঙ্গে বিয়ে ভেঙে গেছে। গৌরী অসুস্থ, ক্যান্সার, তাকে আমরা দেখতে যাচ্ছি, পৃথিবীর বিভিন্ন কোণ থেকে।

সুজান বহু বছর আমেরিকায় সাংবাদিকতা করে, প্যারিসে তার জন্মশহরে থিতু হয়েছে। সাংবাদিকতা করছে, একইসঙ্গে বৃদ্ধ বাবা-মার দেখভাল করছে।

আর অ্যাবি দাপটের সঙ্গে পৃথিবীময় ঘুরছে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করা তার পণ, এই পণ যেন সোনার হরিণ, আজ এই দেশে, কাল ওই দেশে।

তিন

আমি প্রথম মুম্বাই যাব। তারপর প্যারিস। তারপর নিউইয়র্ক।

যাবার আগে, কবে ফিরি ঠিক নেই। সেজন্য শাহজাদার সঙ্গে দেখা করতে আসা। বাবা-মা, কেন যে ওর নাম শাহজাদা রেখেছিল জানি না। শাহজাদার মতো চরিত্র, চলাফেরা, পৃথিবী দেখার ধরন। আমার সঙ্গে বনিবনা হয়নি, ছাড়াছাড়িও হয়নি।

যখন দেখা হয় একসঙ্গে চলাফেরা করি। যখন দেখা হয় না, পরস্পর ভুলে থাকি। আমাদের কোনো যন্ত্রণা হয় না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি : আমরা ভালোই আছি।

শাহজাদা তার নরম চেয়ার আমার কাছে নিয়ে আসে। তার মুখ আমার মুখের কাছে ভেসে আসে, ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে : ইমার্জেন্স, তার মতো। শাহজাদা আমার চুলে হাত বুলোয়। আমার কপালে হাত বুলোয়। ‘তুমি’, শাহজাদা বলে, তোমার মতো কেউ হয় না। সে হাসতে হাসতে বলে, এ-কথা আগেও বলেছি।

আমি একটু সরে বসি, আবারো একই কথা।

সে ফের হাসে, পুরনো কথা কি ভালো না।

আমি বলি, কে জানে।

তারপর আমার বলার কথা ফুরিয়ে যায়।

শাহজাদা কয়েক লহমা আমার দিকে চেয়ে থাকে। যেন কথার সমাপ্তি টানে।

আমার মন বিষণ্ণ হয়। তোমার মুখ এখনো আমাকে বিষণ্ণ করে। তোমাকে এখনো আমি ভালোবাসি। ফের শুরু করতে চাই না।

ওর চোখ কি ভিজে যায়। কিংবা আমার চোখ। আমি চোখ মুছি।

আমি বলি, তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।

শাহজাদা বলা শুরু করে, হয়তো আপন মনে, যখন আমি বুড়ো হব, বয়সের ভারে নুয়ে যাব, চেয়ারে বসে থাকব, তখন তুমি এসো, আমার হাত ধরে থেকো। ঠিক আছে? ভুলে যেও না।

আমি ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিই। চুমু খাই।

আমি বলি, আমার ভেতর থেকে কথাগুলি বেরিয়ে আসে, না, এসব বলে না। যখন তুমি বুড়ো হবে, কুঁজো হয়ে যাবে, আমি তখন কোথায় থাকব, কে জানে। আমি তোমার হাত এখন ধরে থাকতে চাই। তোমার যাতে মনে পড়ে। মনে থাকে।

 

চার

আমরা তিনজন একসঙ্গে হাসপাতালে আসি। আমাদের মনে হয় পৃথিবীটা আনজাস্ট, ইডিওটিক এবং স্টুপিড। আমরা কথাটা বলি না, কিন্তু কথাটা নিয়ে ভাবি।

কথাটা কার উদ্দেশে বলা?

কথাটা কার উদ্দেশে ভাবা?

ঈশ্বরের মতো আনজাস্ট, ইডিওটিক এবং স্টুপিড বিধাতা কোথাও নেই।

আমাদের বন্ধু গৌরী বিছানার সঙ্গে শরীর মিলিয়ে শুয়ে আছে। শরীরের সঙ্গে বিছানার কোনো তফাৎ নেই। শরীর তো নয়, একটা হাহাকার।

কেবিনের ভেতর একটা সুদর্শন ছেলে বসে আছে। বয়স কত হবে? দশ-এগারো। ছেলেটি গৌরীর হাত ধরে আছে।

গৌরী আস্তে বলে, বেটা, এরা তিনজন আমার বন্ধু।

গৌরী বিয়ে করেছে, জানতাম। এত বড়ো সুদর্শন ছেলে আছে, জানতাম না। গৌরী কখনো বলেনি। গৌরী বিয়ে করেছে ভিনজাতে, মুসলমানকে। সেই বিয়ে কবেই ভেঙে গেছে।

গৌরী ফের বলে, বেটা, হাত মিলাও, সালাম করো।

বেটা আকবর, এই হচ্ছে আমার বন্ধু সালমা।

বেটা আকবর, এই হচ্ছে আমার বন্ধু সুজান।

বেটা আকবর, এই হচ্ছে আমার বন্ধু অ্যাবি।

পাঁচজন মানুষকে কেবিনটা ধরে রাখতে পারছে না। আচমকা আমি বলি, এত সুন্দর ছেলে যদি আমার থাকত। আচমকা সুজান বলে, এত সুন্দর ছেলে যদি আমার থাকত। আচমকা অ্যাবি বলে, এত সুন্দর ছেলে যদি আমার থাকত।

আমাদের তিনজনের বুকের মধ্যে আকবর মিশে যায়। আকবর। আকবর। আকবর।

 

পাঁচ

 

মা।

কী রে বেটা।

আমি এখন যাই।

আরো খানিকক্ষণ থাক।

নানুর বাসায় যেতে হবে।

কেন রে।

নতুন একটা অষুধ কিনতে হবে।

বুঝেছি। টাকা লাগবে।

জি মা।

আকবর মাথা নিচু করে বসে থাকে। আমার সারাটা শরীর উথালপাতাল করে ওঠে। হায় রে জীবনের দাবি। আমার তো টাকার অভাব নেই। দিতে চাইলে আকবর কি নেবে। গৌরী কি নেবে। একটা হাহাকার বুকের ভিতর থেকে উঠে আমাদের সবাইকে ঘিরে ধরে। আমার ও আমার বন্ধুদের টাকার অভাব নেই। এই টাকা, এখন পরাস্ত। পরাজিত মুখ নিয়ে আমরা বসে থাকি।

মা।

কী রে।

আমি তো রোজই আসি। কাল আরো একটু আগে আসব।

আসবি তো।

রোজই আসি। তুমি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করো। আন্টিরা সবাই ভালো।

আমাদের সবার ঠোঁটে একটা হাসি ফোটে। শাদা নয়নতারার মতো। অথবা লাল নয়নতারার মতো।

আন্টিরা, আমি যাই। সালাম।

 

ছয়

গৌরী, এখন ডক্টর এবং মেডিসিনের মুঠোর মধ্যে, শুয়ে আছে। ডক্টররা তাকে এক মুহূর্তের আশার কথা শোনায়, আর যেটা শোনায় না তা হচ্ছে দীর্ঘ দীর্ঘ আশাহীনতার রাস্তা। আশা এবং আশাহীনতার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। আমরা, তিন বন্ধুরা, তা টের পাই, টের পেয়ে আমরা, তিন বন্ধুরা পরস্পরের হাত ধরে থাকি। এই ধরে থাকাটাই আমাদের সম্বল। গৌরী গৌরী, আমাদের দেবার কিছু নেই। শুধু চেয়ে থাকা ছাড়া আমাদের করার কিছু নেই। গৌরী এতক্ষণ চোখ বুজে ছিল। চোখ বুজে গৌরী বোধহয় কিছু ভাবছে, হয়তো আকবরের কথা ভাবছে, হয়তো আমাদের কথা ভাবছে, হয়তো কারো কথাই ভাবছে না। হয়তো চেনাজানা, যারা আগে চলে গেছে, তাদের কথা ভাবছে।

হঠাৎ চোখ খুলে গৌরী বলে ওঠে, এনাফ।

আমরা চমকে যাই।

গৌরী ফের বলে, নট এনাফ।

আমরা বুঝি, আমাদের যাবার সময় হয়েছে। আমরা এক একজন করে বিদায় নিই।

আমি বলি, গৌরী, এবার আসি।

গৌরী বলে, আবার এসো।

সুজান বলে, গৌরী, এবার আসি।

গৌরী বলে, আবার এসো।

অ্যাবি বলে, গৌরী, এবার আসি।

গৌরী বলে, আবার এসো।

আমরা হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়াই।

আমি বলি, জানো, মৃত্যু নামক অথরিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

সুজান বলে, মৃত্যু অথরিটি না।

আমি ফের বলি, কে জানে।

অ্যাবি বলে ওঠে, অথরিটির একটা ঘটনা শোনাই।

আমি তখন ফ্রাঙ্কফুর্টে পড়াশোনা করছি। সময়টা অ্যান্টিঅথরিটারিয়ান। ছাত্ররা বিদ্রোহ করছে টিচারদের বিরুদ্ধে। আমাদের টিচার আডর্নো, গ্লেট আডর্নো। আমরা ছাত্রীরা তাকে ঘিরে ধরেছি। আডর্নোকে এক্সপোজ করা দরকার। আমরা, ঝটপট, ব্লাউজ খুলে নগ্ন বুক তার চোখে তুলে ধরেছি। বদলে আমরা দাবি করেছি, আডর্নো গ্লেট আডর্নোকে, নগ্ন নুনু দেখাবার জন্য। বুর্জোয়াদের পোশাক আর না। অথরিটি থেকে সবাইকে নেংটো করা দরকার। তত্ত্ব দিয়ে আবরু সামলানো না। তাহলেই অথরিটি নেংটো হয়ে সবদিকে ছড়িয়ে যাবে। অথরিটির মধ্যে কোনো জোর থাকবে না। কোনো ভয় থাকবে না।

গৌরীকে দেখে আমরা ভয় পেয়েছি। এই ভয় থেকে আমাদের উদ্ধার পাওয়া দরকার।

মৃত্যুর থিওরি জীবনকে ঘিরে রাখে। এই ঘিরে থাকা থেকে মৃত্যুকে নেংটো করতে পারলে মৃত্যুর মধ্যে ভয় থাকবে না। তখন বিপ্লব হবে।

মনে রেখো, রাইটিস্ট ফ্যাসিজম যেমন আছে, তেমনি আছে লেফটিস্ট ফ্যাসিজম।

একটা সেমিনার যেন শেষ হলো। আমাদের যাবার সময় হয়েছে। আমাদের কারোই কিছু দেবার নেই। একটা শব্দ শুধু আমাদের বুকের মধ্যে : আকবর আকবর আকবর।

 

সাত

সুজানের সঙ্গে আমি প্যারিসে ফিরে আসি। পাপেভরা প্যারিস এবং জাঁকালো প্যারিস, আবার জাঁকালো প্যারিস এবং পাপেভরা প্যারিস, আমাকে পাগল করে দেয়। এই এক আশ্চর্য শহর, পৃথিবীতে এই শহরের মতো আর কোনো শহর নেই। আমি সুজানের সঙ্গে ঘুরি অথবা একা একা ঘুরি, এখানে খাস ফরাসিদের পাশাপাশি ঘুরছে নর্থ আফ্রিকান আর মিডল ইস্টার্ন লোকজন, জাপানিদের সঙ্গে ঘুরছে ভারতীয়রা। আমি কখনো কখনো বুলভা দু মপারনাসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে হাঁটি, রাস্তার ওপর কাফেতে বসে থাকি, জাঁ পল সাঁত ও সিমোন দ বুভেয়ার জীবনের একটা কি দুটো পাতা মনে মনে    উল্টাই, সার সার চেস্টনাট বৃক্ষগুলোকে বুকে চেপে ধরি, বৃক্ষগুলো থেকে ক্ষরিত উত্তাপ শাহজাদার বুকের উত্তাপের মতো মনে হয়, কিংবা মনে হয় জাঁ পল সাঁতের বুকের উত্তাপভরা বইগুলির মতো কিংবা মনে হয় সিমোন দ বুভেয়ারের একই সঙ্গে জাঁ পল সাঁত এবং আরো কয়েকজনকে ভালোবাসার মতো, ম্যান্ডারিন বইটিতে অসংকোচ দাপটে যেসব কথা তিনি লিখেছেন। আমি কফি খেতে খেতে ভাবি, আমার ওয়ালেটের ওজন কিছুতেই ভারহীন হয় না, তাহলে গৌরীকে কিছু দিয়ে ভার কমাতে পারতাম, জানি গৌরী কিছুতেই নেবে না, হায় রে আকবর, তুই যদি আমার ছেলে হতিস। তোকে বুকে জড়িয়ে আমি যদি ব্যাংকরাপ্ট হয়ে যেতে পারতাম।

 

আট

আমাদের চেনাজানা একটা বিস্ট্রোতে লাঞ্চ করার কথা। সুজানকে আমি খাওয়াব। ওর দেরি হচ্ছে, আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠি। শেষ পর্যন্ত সুজান আসে।

আমি বলি, তোমার এত দেরি।

সুজান একটু হেসে বলে, প্রেমিকের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া কঠিন।

বলোনি, তোমার লাঞ্চ অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

বলেছি তো। আমার এখন প্রেম করার সময় নেই। প্রেমের সময় আলাদা।

তারপরও ছাড়াছাড়ি নেই।

হায় রে প্রেম।

শুধু বলে একটা-দুটো কুইক আদর।

একটা-দুটোতে কি আদর শেষ হয়।

হয় না। জানি। তবু কুইকি।

বেশ আছো।

শেষ পর্যন্ত পাঁচটা চুমোর বিনিময়ে ছাড়া পাওয়া।

অপ্রতিরোধ্য হওয়া সত্যি নাইস।

তা ঠিক।

 

নয়

আমি সুজানকে বলি, কী খাবে ঠিক করো।

সুজান বলে, আমি ঠিক করে এসেছি। আমেরিকান স্টাইলে স্টেক। তুমি?

আমি বলি, ফরাসি স্টাইলে সালাদ, গোট চিজ আর ওয়ালনাট।

সুজান বলে, একটা জিনিস বাদ পড়েছে।

বলো।

দুজনের মাঝখানে এক বোতল ওয়াইন।

আমরা ওয়াইনে চুমুক দিতে থাকি, সালাদ খেতে থাকি, গোট চিজ খেতে থাকি, ওয়ালনাট টুকরো করতে থাকি আর স্টেক খেতে থাকি। দুপুরটা আমাদের মোহনীয় মনে হয়।

 

দশ

একটা কথা সুজানকে জিজ্ঞেস করব করব করি, কিন্তু করা হয় না। হয়তো আমার মনের ভিতরকার লজ্জা ও সংকোচ। আজ খেতে বসে লজ্জা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলি।

বলেই বসি, সুজি একটা কথা জিজ্ঞেস করি।

সুজান বলে, আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে কোনো গোপন নেই।

তাহলে বলি।

বলো।

একসময় তোমার বাবা-মা নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। এখন তোমার সঙ্গে। ভেতরের ব্যাপারটা বলো তো।

এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই।

বলো তাহলে।

জানো তো আমি এখন প্যারিসের একটা নামজাদা প্রকাশনার ইংরেজি এডিটর। আমার অ্যাপার্টমেন্ট, দেখেছো তো, অভিজাত এলাকায়। থাকার জায়গার অভাব নেই।

তা তো দেখছি।

বাবা-মা পেনশনের টাকায় আগে চলতেন। থাকতেন গরিব পাড়ায়। সাতু রুজ মেট্রো স্টেশনের কাছে। বাড়িটা লক্কড়ঝক্কড়। প্লাস্টার খুলে খুলে পড়ছে। মেইন গেইট ভাঙা। একদিন মার কাছ থেকে টেলিফোন পাই : তোর বাবা অসুস্থ, পারলে আসিস।

জানুয়ারির প্যারিস। ঠান্ডা ঠান্ডা, বাতাসে ঠান্ডার ধার। আমি ওদের ফ্ল্যাটে যাই। দরজায় নক করি। দেখি, দরজায় পাপা। লাল আন্ডারওয়ার পরা। পাতলা মোজা ঠান্ডা আটকাতে পারছে না। হাঁপানি পাপাকে কাবু করে রেখেছে।

পেছনে মামা। তার কাঁধে একটা কিচেন টাওয়াল। আঙুল মুছে চলেছেন। আলু ছিলে ছিলে ড্যাম্প লাগা। অনিয়নের গন্ধভরা কিচেন।

সবকিছু দেখে আমার কেন জানি সহ্য হলো না। আমি স্পষ্ট উচ্চারণে বললাম, মামা পাপা তোমরা এখন থেকে আমার সঙ্গে থাকবে।

গল্পটার শেষ এখানেই।

 

এগারো

নিউইয়র্কে আমি উড়ে আসি। অ্যাবি আমাকে তার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। বইপত্র ছড়ানো সর্বত্র। বসবার ঘরে বই, শোবার ঘরে বই, গেস্টরুমে বই, কিচেনে বই এবং বাথরুমে বই। বই ছাড়া অ্যাবির জীবন নেই আর অ্যাবির জীবন মানে বই। তার জীবন মানে বইয়ের বিস্ফোরণ। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অ্যাবি সর্বতো অর্থে ইনটেলেকচুয়াল।

অ্যাবির দুই চোখ বিশাল, মনে হয় ঈশ্বর দুই চোখে আগুন জ্বেলে রেখেছেন।

অ্যাবি দ্বিধাহীনভাবে বলে, রাষ্ট্র, কোনো রাষ্ট্র কেয়ারিং নয়, বেনিভলেন্ট নয়। সেজন্য রাষ্ট্র চুরমার করা দরকার।

আমি বলি, তোর পাগলামি গেল না।

অ্যাবি বলে ওঠে, জীবনের শেষ পর্যন্ত আমি লড়াই করতে চাই। বদলাতে চাই। নির্যাতনভরা পৃথিবী।

আমি আস্তে আস্তে বলি, পারবি তুই?

পারব রে পারব।

অ্যাবির হাসির তোড়ে ঘরের দেয়াল এবং ছাদ কেঁপে যায়। ছড়ানো-ছিটানো বইপত্র থরথর করে ওঠে।

অ্যাবি ফের বলে, আমার মতো অনেকেই ইতিহাসের  শুদ্ধিকরণে ব্যস্ত। বুর্জোয়াদের কাছ থেকে ইতিহাস কেড়ে নিতে হবে। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ইতিহাসের সঙ্গে মেলাতে হবে। তাহলেই আজ এবং আগামীকাল আমাদের পক্ষে আসবে।

বারো

অ্যাবির ঘর থেকে বহুদূর দেখা যায়। অনেকগুলো গাছ শক্তসমর্থ হয়ে দাঁড়িয়ে, দাঁড়ানোটা সুন্দর। অ্যাবির বেড়ালটা আমার পায়ের কাছে শুয়ে, যেন বলে আমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখো, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ফসলের একটা মাঠ হয়ে ওঠো। আমাকে আদর করো, সবার বাড়িঘর আদর করো, কেবল বাড়িঘর তাহলে অদ্ভুত মনে হবে না।

অ্যাবি বসার ঘরে কয়েকবার ঘুরপাক খায়। একটা চিন্তা তাকে অস্থির করছে।

আচমকা অ্যাবি বলে, তোমার কি সহসা দেশে ফিরতে হবে?

আমি বলি, তেমন কোনো তাড়া নেই।

অ্যাবি কয়েক লহমা চুপ থেকে বলে, আমার সঙ্গে ভেনিজুয়েলা চলো।

ভেনিজুয়েলা? সেখানে কী?

সেখানে গিয়ে বুঝতে চাই একটা ছোট দেশ একটা গরিব দেশ কী করে আমেরিকাকে ডিফাই করছে।

যাব, তোমার সঙ্গে যাব।

সালমা।

বলো।

আমাদের বন্ধুদের জীবন ছিন্নভিন্ন এখন।

তা অনেকটা ঠিক।

গৌরীর পক্ষে নড়াচড়া সম্ভব না। সুজানের পক্ষে মা-বাবাকে ছেড়ে দীর্ঘদিন কোথাও যাওয়া সম্ভব না।

তা ঠিক।

বাকি তুমি আর আমি।

আছি তো। শেষ পর্যন্ত আমরা বন্ধুরা সব অবস্থাতে থাকব।

অ্যাবি আস্তে আস্তে বলে, তাই বোধহয় সত্য।

হঠাৎ নিউইয়র্কের আবহাওয়া হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়। আকাশ থেকে সাদা ফুল ঝরা শুরু হয়। তুষারে ঢেকে যায় দূর এবং নিকট।

সালমা, কাম অন।

আমি বলি, তুষারের মধ্যে হাঁটতে ইচ্ছা করছে।

অ্যাবি হঠাৎ বলে ওঠে, আমার ইচ্ছা করছে আকবরের মতো একটা ছেলে পেতে।

তুষারের দিকে চোখ মেলে অ্যাবি ফের বলে, আমার লড়াইটা আকবরের হাতে দিয়ে যেতে।

আদিগন্ত তুষার। আদিগন্ত তুষারের মধ্যে মানুষ চলাফেরা করছে আর গন্তব্যে যাচ্ছে। গন্তব্যে মানুষ যাবেই। আমি অ্যাবির হাত ধরে তুষারপাত দেখতে থাকি।

 

তেরো

ঢাকা, ২০১১-এর প্রথমদিক। আমাদের আখ্যান।