আমাদের সাম্প্রতিক ছোটগল্পের গল্প

ফেরদৌস আরা আলীম

‘যে নিতে জানে তার জন্য ছড়িয়ে রয়েছে আপনিই হয়ে ওঠা গল্প। শুধু দরকার দেখবার চোখ, যেমন করে হীরাকে কেটে বার করতে হয়, তেমনি দরকার তাকে উদ্বুদ্ধ করার শক্তি।’ এ-শক্তি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে প্রথমবারের মতো যাঁর মধ্যে দেখেছিলেন বা আবিষ্কার করেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের সময়ে তাঁর অর্ধশতাব্দী পরে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সময়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, আপনিই হয়ে-ওঠা গল্প এই জনপদে ক্রমশ জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হয়তোবা। আর সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পথে-নামা ছোটগল্প আর ঘরে ফেরেনি। তবে বোঝা ফেলতে ফেলতে নতুন রং, নতুন আলো এবং নতুন সুবাস গায়ে মাখতে মাখতে, অমৃতে বিষ বা বিষে অমৃত মেশাতে মেশাতে এগিয়ে চলা ছোটগল্পের পথ আমাদের জন্য পৃথক হয়ে গেল ’৪৭-এ। নতুন দেশ পাওয়ার আনন্দে আমাদের যে-তরুণেরা সেদিন জ্বলে উঠেছিলেন তাঁদের মধ্য থেকেই আমরা পেয়ে গেছি আমাদের ছোটগল্পের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। সেদিনের দু-চারটি নাম এখনো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো আমাদের সাহিত্যের আকাশে দেদীপ্যমান। কিছু তারা নিভে গেছে। সময়ের নিয়মে কিছু নাম ঝরেও গেছে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের রক্তপাথার পেরিয়ে নতুন পতাকায় সেজেছে আমাদের দেশ। একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ভীষণভাবে বদলে দিয়েছে দেশকে, দেশের মানুষকে এবং সমাজ-পরিপার্শ্বকে। নতুন নতুন গল্প তৈরি হয়েছে। চারদিকে তখন গল্প। রোদের গল্প। ছায়ার গল্প। অন্ধকারের গল্প। গল্প আসে চারদিক থেকে। গল্প ওঠে নদী-সমুদ্র থেকে। গল্প গজায় ঘাসের জমিতে, বনে-জঙ্গলে। সেসব গল্প ধরবে বলে, ঝুলিতে ভরবে বলে গল্পকারেরও আকাল পড়েনি। অভাব হয়নি। তবে চাষবাস যতটা হয়েছে, শ্রম যত গেছে, চিন্তা-ভাবনা যত ব্যাপক যতটা অতলস্পর্শী হয়েছে সোনার ফসলে ডালা সেভাবে ভরেনি। গল্প যত হয়েছে শিল্পসিদ্ধি তত হয়নি, এ হচ্ছে মোটা দাগের কথা। যাঁদের হাতে সোনার ফসল ফলেছে, যাঁরা রয়েছেন শিরোমণি হয়ে, তাঁদের কথা আমরা কিন্তু এখানে বলছি না। আমরা বলছি আমাদের যোদ্ধা গল্পকারদের কথা, যাঁদের সব কথা বা সর্বৈব প্রস্তুতির কথা আমরা জানি না, তাঁদের সব অস্ত্রও আমাদের (আমার) দেখা হয়নি; কিন্তু তাঁদের প্রবল পদশব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি। কিছু গল্পকারের ‘হীরে কেটে বার করা’ গল্প অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখছি। কেউ হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো পাঠককে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের পিছু পিছু। এঁদের গল্প পাঠের পর স্তব্ধাহত বা বজ্রাহত হয়ে বেশ খানিকটা সময় বসে থাকার মতো গল্পও লিখছেন কেউ কেউ। কারো কারো গল্প পড়ে নেশার ঘোরে পড়ে যেতে হয় – এ-গল্পের ভাষা কোথায়, গল্পই বা কোথায়? কে কাকে লিখেছে? গল্প ভাষাকে, না ভাষা গল্পকে? এসব কথা আপাতত তুলে রেখে আমরা বরং গল্পের পথ ধরে খানিকটা হেঁটে আসি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দিয়েই শুরু করি। মুক্তিযুদ্ধ কেন, কারা করেছে, কীভাবে করেছে – এসব নিয়ে কম গল্প হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ কারা করেনি, কেন করেনি তাদের প্রাপ্তি বা পরিণতির গল্পও তো মুক্তিযুদ্ধেরই গল্প। কমিউনিস্ট আদর্শের রাজনীতি করা মানুষটির মস্তিষ্কে মুদ্রিত তার নেতার চিরকুটের বাণী তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। ‘সরকারি চাকরি, মধ্যবিত্তের নিশ্চিত, নিস্তরঙ্গ জীবন আপনার-আমার জন্য নয়। একজন আমলা হয়ে জীবনযাপন করার চেয়ে বিপ্লবীর মর্যাদায় মৃত্যুও শ্রেয়।’ এই মানুষটির বিশ্বাস ছিল ভোটে জেতা এক কথা, স্বাধীনতা অন্য কথা। পলাতক নেতা আনবেন স্বাধীনতা? প্রশ্নের উদ্যত সঙ্গিনই তার নিজের বুকেই তাক করা ছিল সর্বক্ষণ। তারই আত্মজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গোপনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। পিতা কমিউনিস্ট; ভাই মুক্তিযোদ্ধা। মেয়েটি খুব সহজে এ-যুদ্ধের বলি হয়। পুত্রের পাঠানো একটি গোপন চিরকুট সঙ্গে নিয়ে পিতা এরপর পালাতে থাকেন। সে-চিরকুটে পুত্রের ভাষ্য : ‘বাবা, এভাবে না এলে এতো মানুষের আত্মত্যাগ, এতো মা-বোনের অশ্র“জল আমার কাছেও কেবল দুই কুকুরের লড়াই বলে চিহ্নিত হতো। তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধার পিতা – এই গর্বিত পরিচয় থেকে বঞ্চিত হতে।…’ (‘চিরকুট’, রফিকুর রশীদ)
বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা মুক্তিযুদ্ধের একটি অমোঘ কিন্তু অসহায় স্মৃতির গল্প শোনাই। পিলখানায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ পিতার কোনো স্মৃতিই কিন্তু পুত্রটির ছিল না। মা ও ছোট ভাইটিকে বিলেতে থিতু হওয়ার পর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিন দশেক ধরে ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে সেন্ট অ্যালবার্নসের এক পাহাড়ি এলাকায় বিকল গাড়িসহ আসন্ন সন্ধ্যায় যে-ইংরেজ মহিলার সযতœ আশ্রয় ও আপ্যায়নে বেঁচে গেল তার স্বামীই যে পিলখানার প্রথম শহীদের ঘাতক সে তা কী করে জানবে? স্বয়ং পাকিস্তানি সে সৈনিকের মুখ থেকে পিতার নামটি যখন উচ্চারিত হয় তখন পাহাড়ের ঢালে তার গাড়িটি দ্রুতগতি পেয়ে গেছে। (‘দৈব সংযোগ’, ইফতেখার আমিন)
স্বাধীন দেশে শুদ্ধ রাজনীতিকে আমরা ধীরে ধীরে নীতিহীনতার হাঁ-মুখ অজগরের অন্ধকার গহ্বরে আশ্রয় নিতে দেখেছি। গডফাদাররা যখন সিংহাসনে, তখন তৃণমূল থেকে রাজনীতির প্রতিটি স্তরে ক্ষমতা এবং অর্থের দম্ভ ও দাপটে বিপন্ন জনজীবনের মর্মন্তুদ সব ছবি এসেছে আমাদের ছোটগল্পে। সৎ, শুদ্ধ বিবেকবান ভালো মানুষদের প্রতীক হয়ে এসেছেন বিশেষভাবে স্কুলশিক্ষকরা। তাঁদের অসহায় আত্মসমর্পণের গল্প লিখেছেন একাধিক গল্পকার।
দুহাতের থাবায় দুদিক থেকে ছাত্রকে মাথার ওপরে তুলে আছাড় দিয়ে বা তার ভয় দেখিয়ে বাপ-দাদাদের আমল থেকে ছাত্র মানুষ করা নেপাল স্যার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরিচ্যুত হন। ভিটেমাটি বিক্রি করে তহবিল-তছরুপের দায় এড়ান, তারপরও শেষরক্ষা হয় না। পেনশন-গ্র্যাচুইটির টাকা তুলতে গিয়ে মাস্তানদের বেষ্টনীতে উটপাখির মতো মুখ গুঁজে তাঁকে বসে থাকতে হয়। একদিন হারকিউলিস ছিলেন। আজ তাঁর মনে প্রার্থনা জাগে হারকিউলিসের দুটি ডানায় যদি উড়ে যেতে পারতেন! ফাইলপত্র নিয়ে কুকুরের মতো এভাবে অন্তত ঘুরতে হতো না। (‘হারকিউলিসের পাখা’, জয়দীপ দে)
আদর্শবাদিতার প্রতীক হিসেবে শিক্ষকের গল্প প্রতিষ্ঠিত গল্পকারদের হাতেও পেয়েছি আমরা। রতন স্যারের গল্প বলেছেন মইনুল আহসান সাবের। বিলেতে সফল গবেষক আদর্শবাদী, গুড অ্যাডভাইজার, মোটিভেটর রতন স্যারের গল্প বলে বলে স্ত্রীর মন গলাতে চান এ জন্যে যে, আসন্ন ছুটিতে বাড়ি যাবেন এবং রতন স্যারকে দেখে আসবেন দুজনে মিলে। স্ত্রীকে নিয়ে স্মৃতিতে ধরে রাখা ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে যে রতন স্যারকে পেলেন তিনিও স্যার বটে। তবে সে ভিটেবাড়িটি এখন বহুতল এবং থানার ওসি থেকে তাঁকে ঘিরে থাকা মাস্তানদের সবার তিনি স্যার। (‘স্যার’, মইনুল আহসান সাবের)।
জমিদার-জোতদার-তালুকদারদের ঘাট থেকে আমাদের গল্পের নৌকা এখন চেয়ারম্যানদের ঘাটে বাঁধা পড়েছে। গল্প ক্ষমতার, অর্থের, দম্ভের, সর্বোপরি চরিত্রহীনতার। পিতার চরিত্র পুত্রে বর্তায়। গুণধর এই পুত্রদের ও তাদের আজ্ঞাবহদের হাতে ক্রমাগত লাঞ্ছিত হতে থাকাটা দরিদ্র মেয়েদের নিয়তি। তারা স্কুলে পড়–ক বা ধানকলে কাজ করুক। চেয়ারম্যানপুত্রের প্রেমের প্রস্তাবের মানে একটাই। আর সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে মেয়েটির পরিণাম খবরের কাগজে বিষণœ কালির অক্ষরে লেখা হয়। এসব গল্প প্রচুর হয়েছে আমাদের। অন্যদিকে গল্পের লাগাম যে নির্যাতিত মেয়েটিও হাতে তুলে নিতে পারে সে-গল্পও হয়। চেয়ারম্যানের পুত্রটিকে রাতদুপুরে নিজের ঘরে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য মেয়েটি তাকে দিয়ে আগেভাগে ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থাটি করিয়ে নেয়।
যথাসময়ে ঝাঁপ ঠেলে ঘরে ঢুকে ষাট পাওয়ারের বাতির তলায় বকুলীর শয্যায় অপ্রস্তুত পিতাকে আবিষ্কার করে পুত্র পালিয়ে যায়। গল্প কিন্তু থাকে। চেয়ারম্যানের প্রশ্ন : তুই আমারে আমার পোলার সামনে খুন করলি? বকুলীর উত্তর : জানে তো মারতে পারি নাই। আপনে কিন্তু আমার নিরীহ স্বামীটারে এহেবারে মাইরা হের লাশটা কচাগাঙ্গে বাসাইয়া দেচেন। (‘বকুলীর মুখে এখন আর হাসি নাই’, মনি হায়দার)
নিষিদ্ধ পল্লী ও পতিতাদের গল্প তাদের ইতিহাসের মতোই পুরনো। এনজিওর কল্যাণে পতিতাদের জীবনের গল্প এখন নানা পথে হাঁটে, নানা সুরে গান গায়। এদের মৃতদেহ নিয়েও গল্প হয়। তারই একটি গল্প বলি। এ-পল্লীতে নতুন আসা মেয়েটার ভেজা ভেজা চোখ দুটো ছিল ঘন ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শান্ত ডোবার মতো। মুখে ছিল কষ্টের নীল চাঁদোয়া। সোনাসুইয়ে আঙুল ফুটিয়ে কপালে রক্তটিপ আঁকতো মেয়েটি। সেই মেয়েটি সরে গেল। ওর মতো ওর মৃত্যুও ছিল শান্ত, নিরীহ। মধ্যরাতে লাশবাহী দুজনের কাঁধে চড়ে মেয়েটি চলল। কিন্তু একা নয়। ওই পল্লীর দুটো মেয়ে সঙ্গে চলল। ওরা মেয়েটির হাত-পা পাথর-বাঁধা দড়িতে বেঁধে ওকে মাছের খাবার হতে দেবে না। নেশা লাগানো চাঁদের আলোতে, নদীতীরে নিত্যদিনের পেশায় লোক দুটোকে তৃপ্ত করে ওরা ওর জন্য একটু মাটি চেয়ে নেয়। (‘মাটি’, জাফর তালুকদার)
রীতিমতো অয়দিপাস পড়া মাঝবয়সী মানুষটা মেয়ের বয়সী কিশোরী কাজের মেয়েটিকে একা ঘরে পেয়ে ধর্ষণ করে। এবং ঘরের পেছনে পরিত্যক্ত ঘাস-মাটি খুঁড়ে মেয়েটিকে ওর খেলার মুখোশটিসহ কবরস্থ করে। এক বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে জেগে ওঠা মুখোশটি পরে তার অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটি তাকে চমকে দেয়। লোকটির কেন যেন মনে হলো যে কবর থেকে ওই মেয়েটি তার মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে এসেছে। নিজেই পুলিশ ডেকে মাটি খোঁড়ার আয়োজন করে লোকটি। (‘সান্ধ্য মুখোশ’, নাসরীন জাহান)
আসলে বিশ্বায়নের এই যুগে গল্পের যেমন সংখ্যা-শুমার নেই, সেসব গল্পের আসরও বসে যত্রতত্র। নইলে নিজকলমোহনার মতো গণ্ডগ্রামে কাশমতী বেওয়ার ঢেঁকিঘরে কি করে বসে গল্পের আসর, যেখানে আমেরিকার মেয়ে ক্লারা বসে থাকে ঢাকার দোভাষী মেহজাবিনকে নিয়ে। ক্লারা তো ক্লারা, খোদ মেহজাবিনই তো অবাক বিস্ময়ে শোনে কাশমতী বেওয়ার দুই হজের সওয়াব কামানোর গল্প। (১০১টি মানবশিশু প্রসবে ধাত্রীর এক হজের পুণ্য লাভ হয়।) তার প্রসববিদ্যার সকল গল্প, গোপন মন্ত্র, গীত-গান ইত্যাদির অনুবাদ করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খায় মেহজাবিন। ক্লারা কিন্তু তার গবেষণার রসদ ঠিকই পেয়ে যায়। শ্বেতাঙ্গ, বাদামি ও শ্যামবর্ণের মিথস্ক্রিয়ায় শিকড় শুদ্ধ তুলে আনা গল্পের এমন শাপলা-শালুক ফুলটি আগে কখনো দেখেছি আমরা? (‘নিজকলমোহনায় ক্লারা লিণ্ডল’, শাহাদুজ্জামান)
বিশ্বায়নের জোর হাওয়ায় দেশজুড়ে এখন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থায়নে টিভি চ্যানেলগুলো সংগীত বা সৌন্দর্য প্রতিভা খুঁজে বের করার আয়োজন করে। লালনের এলাকার মেয়েটি সাঁইজির গান গেয়ে ‘উই সিক ইউ’র আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসতে আসতে হাতবদলের খেলায় কোথায় যে উঠে যায় তার পিতাও আর সে-ঠিকানা খুঁজে পায় না। তবে হাতবদলের টাকা কিছু পিতার হাতে ঠিকই আসে – এইটুকু গল্পের ওজন কিন্তু ওইটুকু নয়। (‘হাতবদল’, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান) এই ধারার অন্য পিঠে মিস সুপারস্টার সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় পেছনকার সেশনের পর সেশন গ্র“পিং, কত কত ওয়ার্কশপ, কত কত ট্রিটমেন্ট, কতগুলো মেয়ের গা থেকে কীভাবে মাটির গন্ধ, দেশের গন্ধ, সংস্কৃতির গন্ধ এমনকি তার পরিবারের গন্ধটিও মুছে নেয় সে-গল্পও হয়েছে। এবং এ-কাজের সঙ্গে দিব্যি আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের রথী-মহারথীরাও কীভাবে জড়িয়ে থাকেন তাও আমরা দেখেছি। (‘ডানাকাটা প্রজাপতি ও কবি’, নুশেরা তাজরীন)
গল্প হয়তো দুটাকার। কিন্তু তার গায়ে কোটি টাকার সময়ের সিল-ছাপ্পড় মেরে দিচ্ছেন আমাদের গল্পকার। বিশেষ উপলক্ষে প্রচুর বাজার নিয়ে ঘরে ফেরা মানুষটি ভাংতি না থাকায় রিকশাওয়ালাকে দু-টাকা পাওনা থেকে বঞ্চিত করলেন। ঘরে ঢুকে খবরের কাগজ খুলতেই ১ জুন, ২০০৭-এর পাতায় কোটি কোটি টাকার গল্প। – বাবর ২০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছে। এস আলম গ্র“প দিয়েছে ৮০ কোটি টাকা। গাজীপুরে ফালুর ১৫২ কোটি টাকার জমি। বনের রাজার আরো ২ কোটি টাকার সন্ধান। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিলেন হুদা। খবরের কাগজ তাঁকে এত তুচ্ছ করলো। তিনি ১০ টাকার নোটটা দিতে পারলেন না। রিকশাওয়ালা তাঁকে ২ টাকা মাপ করে গেল। এ তো গল্প নিশ্চয়ই। অন্যদিকে এ-গল্পের মধ্যে গল্পকার যে শিকড়-বাকড়সহ সময়কে পুঁতে রাখলেন? সেও তো এক গল্প বটে। (‘দুই টাকার গল্প’, রেজাউর রহমান)
ইতিহাসের জমিন খুঁড়ে গল্প বের করছেন আমাদের প্রতœতাত্ত্বিক গল্পকারেরা। সব নেই হয়ে যাওয়ার গল্প। ভুবনেশ্বর নদ ছিল। নেই। মোদা মাঝির নাও ছিল। নেই। খেজুরের গাছ ছিল, গাছি ছিল। নেই। নমুরা ছিল একদিন। আজ নেই। ওদের খোঁজে মোমতাজ মিয়ার ছেলে বখতেয়ার গ্রাম ছেড়ে গেল কোথায়? (‘আমাদের গ্রামে মালোপাড়া নাই’, বদরুন নাহার।)
এভাবে তুলে আনা, তৈরি করা বা ‘কেটে বার করা’ গল্পগুলো তাদের মন-মেজাজ ও ভাষা-ভঙ্গিতে এক পোঁচ নতুন রং বা এক কলি নতুন সুর লাগিয়ে পৃথক অস্তিত্বে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। গল্পকারেরা যে-যার মতো শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। কালজয়ী গল্পের আশা এখন আর অস্বচ্ছ বা অস্পষ্ট নয়।
এবারে আমাদের সেই গল্পকারদের কথা বলবো যাঁরা কমলকুমার মজুমদার বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের মূল রসে মজেছেন বা এঁদের গল্পধারায় ভেসেছেন। নন্দন-ভাবনা বা শিল্পতাড়না এঁদের তাড়িয়ে বেড়ায় নিয়তির মতো। দিব্যি ঘোরলাগা, নেশা-জাগানিয়া এঁদের লেখায় বুঁদ হয়ে থাকা সম্ভব। তবে সন্বিত ফিরে পেয়ে হাতের মুঠোয় গল্পভাষাটি তুলে নেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ চেষ্টা হতেই পারে। সেসব গল্পকে গল্প-প্রবন্ধ, গল্প-কবিতা এমনকি গল্প-দর্শন নামাঙ্কিত করা যেতে পারে। এমন গল্প হচ্ছে। হবে নাই-বা কেন? চার অক্ষরের একটা নিরীহ শব্দ একটা আবেগী জাতিকে যে যোদ্ধার জাতিতে পরিণত করতে পারে ’৭১-এ সেটা আমরা দেখেছি। সে-জাতি যদি তার স্বপ্নকে, তার শপথকে কেবল ভেঙে যেতে, কেবল পদদলিত হতে দেখে তাহলে তার সৃজনশীল অংশের কেউ কেউ তাঁদের অভিধানে, শিক্ষায়-দীক্ষায়, মননে-মস্তিষ্কে পুঞ্জীভূত শব্দ নিয়ে, ভাবনা নিয়ে তাঁদের কাজটি তো করবেনই। যোদ্ধা গল্পকারেরা এভাবেই তৈরি হন। এঁদের সরাসরি বলার দুঃসাহস আছে, প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বলার ক্ষমতা আছে, আছে প্রচুর অধ্যয়ন, তীব্র তাড়না এবং আরো অনেক কিছু। সময়টাও এমন যখন খরার গল্প, মরুভূমির গল্প বা লু হাওয়ার গল্প এই সবুজ শ্যামল জলের দেশেই ফুলের মতো ফুটছে। গল্পকারের হাতে এ-সময়, স্বাভাবিক, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার গল্প হবে, পুকুর-ডোবা মানুষে পশুতে কর্দমাক্ত হওয়ার গল্প হবে, নদীতে প্রতিবেশী দেশ থেকে কিউসেক হিসেবে পানি আসার গল্প হবে। সেই সঙ্গে সবুজ নিধন, ব্যাঙ নিধনের সঙ্গে বাঁধা বিশ্ব পরিবেশকে হাতের মুঠোয় নিয়ে গল্পেরা সব উপন্যাসের বনসাইও হয়ে যেতে পারে।
মহাজনির দিন কি সত্যিই গেছে? শত পথে শত মহাজন এখন সুতো নিয়ে জাল নিয়ে ঋণ নিয়ে তাঁত নিয়ে এমনকি গুদাম নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে। মায়েরা গর্ভ ভাড়া দিচ্ছে আর নাটক-সিরিয়াল মেগা কি মহাব্যবসা করছে। গল্প নেই কোথায়? তবে গল্পের বিষয়কে যখন আর এক কেন্দ্রে পাওয়া মুশকিল হয়, বিষয় যখন প্রাণ-প্রবাহের মতো কেবল ছড়িয়ে যায়, সবকিছুকে ছুঁতে চায়, তখন গল্পবৃক্ষের ডালে-পাতায় সবুজ সাপের মতো জড়িয়ে থাকা গল্পের জন্য ভিন্নরকম আঙ্গিক তৈরি হয়। এসব গল্পের ভাষার গায়ে লেখক কেবল হাত বুলিয়ে যান ঘুম পাড়াতে কখনো, কখনো-বা ঘুম ভাঙাতে। শিল্পিত কৌশলে, মেধাবী মনস্কতায় ভাষা ও গল্পের এমন বিনুনি গল্পকার রচনা করেন যে, সময় নিয়ে সেটা খুলে না দেখলে গল্প বা ভাষা দুইয়েরই মন পাওয়া দূরের কথা নাগাল পাওয়াই ভার হয়। আমরা এমন গল্পকারদের মধ্যে এক নিঃশ্বাসে মনিরা কায়েস, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, খোকন কায়সার, অদিতি ফাল্গুনী, আহমাদ মোস্তফা কামাল প্রমুখের নাম নিতে পারি। ছোটগল্প নিয়ে অতএব আমাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ তো নেই-ই, বরং বলবো যে, পথ কেবলই খুলে যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত কী পেতে যাচ্ছি তার আভাসও আশা-জাগানিয়া।