আমার বাবা

আহমেদ নাজির

তখন আমি অনেক ছোট। কবুতর, মুরগি ইত্যাদি পশুপাখি পোষার প্রতি আমার দারুণ আগ্রহ ছিল। সর্বসাধারণ্যে শিল্পগুরু বলে খ্যাত আমার বাবা সফিউদ্দীন আহমেদ আমার এ-শখ পূরণের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। তিনি আমার জন্য নানান রকমের কবুতর আর মোরগ-মুরগি কিনে আনতেন। বাবার কাছ থেকেই জেনেছি, আমার দাদা শেখ মতিউদ্দীনেরও ছিল পশুপাখি পোষার বাতিক। দাদাকে দেখতে পাইনি আমি। দাদারা কয়েক পুরুষ ধরে কলকাতায় মানুষ হয়েছেন, এখনো আমার দাদার বাবার নামে কলকাতার ভবানীপুরে বেচু ডাক্তার লেন বলে একটি রাস্তা রয়েছে। আমার সৌভাগ্য যে, আমি ২০০৯ সালে আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত ওই লেনটিতে ঘুরে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভবানীপুরে একের পর এক বহুতল ভবন নির্মিত হলেও আমাদের বাড়িটি এখনো ঠিক আগের মতো রয়ে গেছে, যেমনটা ছিল আমার বাবার শৈশবে। আগের মতো বললে ঠিক বোঝানো হয় না, ওই বাড়িতে কালের চিহ্ন পড়েছে। ফলে বাড়িটি এখন জীর্ণশীর্ণ। বাবা তো ১৯৪৭ সালের পর আমাদের স্বামীবাগের বাড়ির সঙ্গে অদলবদল করে ওই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে অভিবাসিত এক হিন্দু পরিবারের কাছে। শুনেছি ওই পরিবারের মধ্যে উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কারণে মামলা হয়েছে বলে বাড়িটি এখনো আদি অবস্থায় রয়ে গেছে।
২০০৯ সালে কলকাতায় গিয়েছিলাম বাবার প্রদর্শনী উপলক্ষে। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস ও আইসিসিআর কেন্দ্র যৌথভাবে কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন্দ্রের নন্দলাল বসু ও যামিনী রায় গ্যালারিতে হয়েছিল ওই প্রদর্শনী। বাবার জন্মশহরে হয়ে যাওয়া ওই প্রদর্শনীকে সফিউদ্দীন আহমেদের তৃতীয় একক প্রদর্শনী বলা যায়। অবশ্য এটি তাঁর ২০০৮ সালে বেঙ্গল গ্যালারিতে হয়ে যাওয়া বাবার দ্বিতীয় প্রদর্শনীর সম্প্রসারিত একটি আয়োজন বলা চলে। ২৩ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রদর্শনী চলেছিল। প্রদর্শনী উদ্বোধনের সময় আমি যেতে পারিনি। অসুস্থতার কারণে বাবারও যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বাবার প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের পরিবারের পক্ষে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার স্ত্রী শিল্পী নাহিদা শারমিন উপস্থিত ছিল। শারমিন আমাদের কলকাতার বাড়ির ছবি তুলে এনেছে, এনেছে বেচু ডাক্তার এস্টেটের ছবিও। পরে প্রদর্শনীর সমাপনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমিও গিয়েছিলাম। গিয়েছিলেন বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসের পরিচালক শিল্পী সুবীর চৌধুরী। আমি নিজে যখন পূর্বপুরুষের নামে নামাঙ্কিত ওই রাস্তাটি ঘুরে দেখছিলাম তখন বাবার কাছ থেকে শোনা অনেক ছোট ছোট গল্পের কথা মনে পড়েছিল আমার। দেখেছিলাম ওই বাড়ির এক কোণে এখনো রয়েছে আমার দাদার কবর, যে-মানুষটি মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাইতেন, পশুপাখি পুষতেন, তিনি অনাদর আর অবহেলায় শুয়ে আছেন ওই কবরে।
পশুপাখির প্রতি দাদার আগ্রহের কথা বাবার কাছ থেকে জানলেও আমি নিজে বাবার মধ্যেও এ-বাতিকটি দেখেছি, তাঁর ছিল কুকুর পোষার শখ। আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পশুপাখি পোষার শখ নিয়ে কথা বলাটা আমার মূল উদ্দেশ্য নয়, আমি আসলে ছোটবেলায় বাবার রং চুরি করার একটা ঘটনার কথা বলতে চাইছি বলে এ-প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছি। আমার জন্য বাবা একবার সাদা রঙের মুরগি কিনে এনেছিলেন এবং আমার যত্নআত্তিতে বড় হয়ে ওই মুরগিটি গোটা দশেক বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল, যে-বাচ্চাগুলোর মধ্যে গোটা পাঁচেক টিকে গিয়েছিল, যেগুলোর সব কয়টিই ছিল ধবধবে সাদা।
হঠাৎ একদিন মনে হলো, বাবার স্টুডিও থেকে কিছু রং চুরি করে আনা গেলে আমার সাদা মুরগিগুলোকে রঙিন করে তোলা যেত। আমরা তখন থাকতাম স্বামীবাগের বাড়িতে। বাবার স্টুডিওটা সবসময়ই আমাকে টানত, মনে হতো রূপকথার অপরূপ সব রং লুকিয়ে আছে ওই ঘরে। রঙের প্রতি আমার ভালোবাসার জন্মও বোধহয় ওখান থেকেই। যাই হোক, সাদা মুরগিকে রঙিন করে তোলার গল্পটা আগে শেষ করি। প্রথম দিন বাবার স্টুডিও থেকে চুরি করে আনলাম এচিং করার রং। পানিতে যে ওই রং গোলানো যায় না, তা তখনো আমার জানা ছিল না। তাই আমার প্রথম দিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। এরপর আমি চুরি করলাম অ্যাগ টেম্পারার লাল, হলুদ ও সবুজ এবং আমার সাদা রঙের মুরগিগুলো চুরি করা রঙের সুবাদে বহুবর্ণিল রূপ পেল। মুরগিদের রং করা তো হয়ে গেল, রং করার কাজ শেষে কিন্তু আমি ভয় পেতে শুরু করলাম। মনে হলো, রঙিন মুরগিগুলোই তো আমার চুরিবিদ্যা জাহির করে দেবে। এসব রঙের দাম সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না আমার। বাবা ইংল্যান্ড থেকে ফেরার সময় এসব রং কিনে এনেছিলেন এবং বহুদিন পর কয়েক বছর আগে রংগুলোর বেশিরভাগ দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্রদের একজন শহিদ কবীরকে।
বাবা বাসায় ফিরে এসে রঙিন মুরগিগুলো দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার খোকন, তোমার মুরগিগুলো রঙিন হয়ে গেল কীভাবে?’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘একটু রং পেয়েছিলাম তো তাই মাখিয়ে দিয়েছি।’ আমি কিন্তু কোত্থেকে রং পেয়েছি তা বললাম না। বাবাও আর কিছু জানতে চাইলেন না। বাবা সবসময়ই এরকম ছিলেন, ধ্যানী, আত্মনিমগ্ন একজন মানুষ, তার মানে কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই আত্মকেন্দ্রিক বলা যাবে না। বরং সবার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াতেই ছিল তাঁর আনন্দ। তবে তাঁর ভালোবাসাও উচ্চকিত ছিল না। সবকিছু করতেন নীরবে-নিভৃতে। রাগের প্রকাশও ছিল অত্যন্ত মার্জিত।
টেম্পারা দিয়ে মুরগি রঙিন করার অপরাধে আমাকে তো আচ্ছা ধোলাই দেওয়া উচিত ছিল। আমার বাবা কিন্তু কিচ্ছুটি করলেন না, শুধু নীরবে তাঁর মূল্যবান সব রং রেখে দিলেন আমার নাগালের বাইরে। বাবা আমাদের মারধর করা তো দূরের কথা ধমক দিয়েছেন, এমন ঘটনাও খুব একটা নেই। একবারই তাঁর কাছ থেকে বড়মাপের ধমক খেয়েছিলাম, সেটা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঘটনা। অপারেশন সার্চলাইটের ওই রাতটি কিন্তু এখনো আমার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। ওই রাতে আমাদের স্বামীবাগের বাড়ি থেকে অদূরে ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হলো। সারারাত চলেছে গোলাগুলি ও বম্বিং। ভোররাতের দিকে বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি বাবা বেডরুম থেকে বারবার ড্রইংরুমে যাচ্ছেন এবং সেখান থেকে জানালার কাঠের খিড়কি ফাঁক করে উঁকি দিয়ে কী যেন দেখে ফিরে আসছেন এবং মাকে আস্তে আস্তে কিছু বলছেন। আমিও কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য খিড়কি খুলে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখলাম আকাশটা লাল আভায় ঢেকে গেছে। সত্যি বলতে কী ওই রাতের ধ্বংসযজ্ঞের কথা আমার পক্ষে তখন অনুমান করাটাই ছিল অসম্ভব। কখন বাবা ফিরে এসেছেন টের পাইনি। প্রচন্ড এক ধমক দিলেন আমাকে। এখন আমি বুঝতে পারি, আমার কিছু একটা হয়ে যেতে পারে বলে আতঙ্কে বাবা এমন ধমক দিয়েছিলেন, যুদ্ধের স্বরূপও হয়তো তাঁর মনে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছিল।
পরের দিন ২৬ মার্চ সকাল না হতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি ছেড়ে। ঘুরে দেখতে লাগলাম ধ্বংসযজ্ঞ, হয়তো ওই স্মৃতিই বহুকাল পরে আমাকে দিয়ে ‘ওয়ার’ সিরিজের কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। অবশ্য আমি তো এখন বিশ্বজুড়ে নানান যুদ্ধের ভয়াবহতাও দেখতে পাচ্ছি। আমার কাছে তো মনে হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসলে শুরু হয়ে গেছে। কোথাও তা প্রকৃত যুদ্ধের চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, কোথাও আবার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে রূপান্তরিত হয়েছে।
একাত্তরে আমার বয়স ছিল বছর সাতেক। প্রতিদিনই আমি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম বাইরে। আমাকে ঘরে আটকানোর জন্য বাবা বুদ্ধি করে বানিয়ে দিলেন মুরগির খাঁচা। একদিন দেখি বাবা তার দিয়ে বানানো জাল আর বাঁশ নিয়ে এলেন। আমাদের বাড়ির কাজের লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে একটা খাঁচা বানিয়ে ফেললেন। পরদিনই আনা হলো দশ-বারোটা মোরগ-মুরগি এবং আমাকে বলা হলো, তুমি এগুলোর যত্ন নেওয়ার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখো। বাড়ির কাজের লোকটাকে বলা হলো আমাকে এ-ব্যাপারে সহযোগিতা করতে। আসলে এখন বুঝতে পারি কাজের লোককে নিযুক্ত করা হয়েছিল আমাকে পাহারা দেওয়ার কাজে।
আমার শান্তসৌম্য বাবাকে জীবনে একবারই একটু অস্থিরচিত্ত হতে দেখেছি, সেও ওই ১৯৭১ সালে। তবে বাইরে থেকে যত শান্তই দেখাক না কেন, বাবার মধ্যেও আমি এক অস্থিরচিত্তের শিল্পীর সাক্ষাৎ পেয়েছি। ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ – সবকিছুই মূর্ত হয়েছে তাঁর শিল্পকর্মে। মুক্তিযুদ্ধ যে তাঁর মনে কী গভীর প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল তা বোঝা যায় ২০০২ সালে করা ‘মেমোরিজ অব ৭১’-এর কাজে। কপার এনগ্রেভিং মাধ্যমে কালো রেখায় এঁকেছেন ক্রন্দনরত মুখ, মুখের মাঝে অশ্রুসজল চোখের উপস্থিতি আমাদের একাত্তরের স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন এবং ১৯৫৪ সালের ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা তাঁকে আলোড়িত করেছে। বাবার কাছে শুনেছি, বন্যার কারণে জলবন্দি হয়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। খাটের ওপর বসে দেখেছেন বন্যার পানি, পানির ঢেউ এবং সেই পানিতে মাছের আনাগোনা। বন্যার অভিজ্ঞতা, বন্যার পানিতে মাছের ছোটাছুটি সবকিছু মিলে তাঁর কাজে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। তাঁর শিল্পকর্মে রাজনৈতিক উত্থান-পতন যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে কুমার থেকে ঘুড়ি-বিক্রেতা, শরবতওয়ালাসহ সমাজের নানা পেশার মানুষও। এঁকেছেন গ্রামের একটি সমৃদ্ধ পরিবার নগরে এসে কেমন উন্মূল হয়ে গেছে তা।
বাবার চারকোল ও ক্রেয়ন মাধ্যমে অাঁকা ‘কুমার’ ও ‘ঝড়’ শীর্ষক কাজ দুটি যখন আমি পাশাপাশি রেখে দেখি, তখন আমার মনে হয় উল্লিখিত কাজ দুটির প্রথমটির সমস্ত রেখায় আছে কুমারের হাপর টানার ছন্দ এবং দ্বিতীয়টিতে ঝড়ের ঘূর্ণাবর্ত। বাবার রেখায় যে দৃঢ়তা মূর্ত হতে দেখি, খুব বেশি শিল্পীর কাজে এমনটা দেখা যায় না, এমন দৃঢ়তা অর্জিত হয়ে যাওয়ার পরও এ-মানুষটিকে দিনের পর দিন কোনো একটি রেখাচিত্র এঁকে যেতে দেখেছি আমি। ফলে তাঁর সাধারণ রেখাচিত্রেও অনেক স্তরের দেখা মেলে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর ছবি একবার দেখে চলে যাওয়া যায় না এবং তা করা হলে দর্শক বুঝতে পারবেন না সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পের গভীরতা।
কেমন করে তিনি অর্জন করলেন এমন গভীরতর বোধ? বাবা নিজেই বলেছেন, ‘বাল্যকাল থেকেই একধরনের যুদ্ধ করতে হয়েছে জীবনের সঙ্গে।’ কলকাতার ভবানীপুরে ১৯২২ সালের ২৩ জুন তাঁর জন্ম হয়। জীবনের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ শুরু হলো মাত্র ছয় বছর বয়সে, তখন তিনি হারালেন তাঁর বাবাকে। শুনেছি কৈশোরেই নিজেদের বাড়ির অংশ নিয়ে তাঁকে চাচাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতে হয়েছে, ১৯৩৬ সালে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তাঁকে আর্ট স্কুলে পড়া নিয়ে আত্মীয়স্বজনের অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয়েছে। তাই শুরুর দিকে কাজই করতে পারছিলেন না। এ সময় তাঁর শিক্ষক আবদুল মঈন এগিয়ে এলেন। শিক্ষকের উৎসাহ ও সহযোগিতা পাওয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৪২ সালে শিক্ষাজীবন শেষ হয় এবং এর মাত্র এক বছর পর ১৯৪৪ সালে আর্ট স্কুলেই টিচারশিপ পড়ার জন্যে ভর্তি হন তিনি। তখন শিক্ষক হিসেবে পান রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে। শুনেছি ওই সময় ছুটি পেলেই বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতেন মধুপুর, দুমকা, গিরিডি, জেসিডি ও চাইবাসার সাঁওতাল এলাকায়। বিস্তৃত উঁচু-নিচু মাঠ, পাহাড়ি জনপদের গাছপালাশোভিত ছায়াসুনিবিড় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য তাঁকে আন্দোলিত করত। তাঁকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল ওইসব এলাকার প্রকৃতি ও মানুষ, যার জন্যে হয়তো সেই ছাত্রাবস্থা থেকে ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ পর্যন্ত বারবার তাঁকে ওইসব অঞ্চলে চলে যেতে দেখা যায়। এ সময়েই তিনি উড এনগ্রেভিং, এচিং ও ড্রাই পয়েন্ট – ছাপচিত্রের এ তিন মাধ্যমে সাঁওতালদের সহজ-সরল জীবন ও ছন্দোময় প্রকৃতিকে নিজের কাজে তুলে এনেছেন।
আবদুল মঈন ও রমেন্দ্রনাথের পাশাপাশি ইয়োরোপীয় শিল্পকলার শিক্ষায় শিক্ষিত এবং দীর্ঘদিন বিলেতে থাকা শিক্ষক ও অধ্যক্ষ মুকুল দে-সহ বসন্ত কুমার গাঙ্গুলী, অতুল বসু, প্রহ্লাদ কর্মকার প্রমুখ শিক্ষকের কথা বারবারই এসেছে বাবার স্মৃতিচারণায়। তাঁর মতে, মুকুল দে কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়ে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে একে সময়োপযোগী করে তুলেছিলেন।
শিল্পচর্চাকে একপ্রকার জীবনযুদ্ধের নামান্তর বলে মনে করতেন আমার বাবা শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ। ছবি অাঁকা তাঁর কাছে ছিল ধ্যানের মতো, নিজের ছবিকে তিনি নিজেরই সন্তানের মতো মনে করতেন। তাই ছবি কেনার জন্য পকেটভর্তি টাকা নিয়ে এসেও বহুজনকে ফিরে যেতে হয়েছে তাঁর ঘর থেকে। শুধু তাই নয়, নগদ টাকায় ছবি কিনতে আগ্রহী ওই লোকগুলোকে তিনি ছবি দেখতে পর্যন্ত দেননি। তাই বলে আবার অভদ্রের মতো তাড়িয়েও দেননি কাউকে। ছবি কিনতে আসা ওইসব লোককে অন্তত এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়িত করতেন।
এখানে আমি সফিউদ্দীন আহমেদকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সৈয়দ আজিজুল হকের লেখা থেকে একটু উদ্ধৃত করতে চাই, ‘এই শিল্পযোদ্ধার নীতিবোধও ছিল অসাধারণভাবে প্রখর। সেখানে শৈথিল্য বা নমনীয়তার কোনো স্পর্শ ছিল না। তাঁর এই শাণিত নীতিচেতনা শিল্প ও জীবন – উভয় ক্ষেত্রেই ছিল সমানভাবে সক্রিয়। ফলে শিল্পচর্চা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল সাধনার নামান্তর। তা সাধারণ জীবন-জীবিকার উপায় বলে গণ্য হয়নি কখনো। প্রকৃতই এ ছিল সুন্দরের সাধনা, যা সাধারণ বৈষয়িক প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন যথার্থই শিল্পের সাধক। তাই বলে শিল্পের জন্য শিল্প – এই তত্ত্বেও বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। নিজ শিল্পে তিনি স্থান দেননি বিষয়বিমুখতাকে। তাঁর শিল্পের বিষয় আহরণে বরাবরই ছিল দেশের মানুষ আর প্রকৃতির প্রাধান্য। ফলে তাঁর শিল্পের জমিনে দেশের আত্মার সংগীতই সব সময় মর্মরিত হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার জগতে এ কারণেই তিনি এতটা শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।’
বাংলাদেশের চারুকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পীদের মধ্যে সফিউদ্দীন আহমেদও একজন। ১৯৪৬ সাল বাবার জীবনের জন্য অত্যন্ত স্মরণীয় একটি বছর। ওই বছরই কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। জীবনের নতুন একটি ধাপে পা রাখলেন। এর আগের বছর ১৯৪৫-এ অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে করা ‘কবুতর’ ছবির জন্যে পেয়েছিলেন একাডেমী প্রেসিডেন্টের স্বর্ণপদক। একাডেমী অফ ফাইন আর্টস থেকে ১৯৪৬ সালে অ্যাকুয়াটিন্টের জন্যে আরো একটি পুরস্কার পান। ১৯৪৬ সালে বিহার শিল্পকলা পরিষদ-আয়োজিত প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। দ্বারভাঙ্গার মহারাজা এ-পুরস্কারটি প্রবর্তন করেছিলেন। মাত্র দু-বছরে এতগুলো পুরস্কার তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এ-অর্জনের কারণে তাঁকে ১৯৪৬-৪৭ সালে অল ইন্ডিয়া আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির কাউন্সিলর মনোনীত করা হয়। দিল্লিতে সোসাইটির মূলকেন্দ্র ছিল। ১৯৪৬ সালে আরো একটি বড় অর্জন তাঁর ঝুলিতে যুক্ত হয়েছিল, সেটি হলো প্যারিসের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে বিশ্বের ৪৪টি দেশের বাছাই করা শিল্পীদের কাজ নিয়ে ইউনেস্কো আয়োজিত প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া। পিকাসো, ব্রাক, মাতিস ও শাগালের মতো মাস্টার শিল্পীদের কাজের পাশাপাশি ওই প্রদর্শনীতে ভারতবর্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিংকর, যামিনী রায়, অমৃতা শেরগিল, জয়নুল আবেদিন ও সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে লন্ডনের রয়েল অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হলো খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের শিল্পকলার প্রদর্শনী। ওই প্রদর্শনীতে সফিউদ্দীন আহমেদের উড এনগ্রেভিং ‘সাঁওতাল রমণী’ দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় ‘সাঁওতাল রমণী’ ছবিটিকে ‘শুধু একটি রসপুষ্ট চিত্রই নয়, মহৎ শিল্পসম্পদের রূপবান নিদর্শন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা শুরুর আন্দোলনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাতে হাত রেখে এগিয়ে এসেছিলেন যাঁরা আমার বাবা সফিউদ্দীন আহমেদও তাঁদের একজন। তাঁদের নিরলস শিল্পসাধনায় গড়ে উঠেছে এদেশের সমৃদ্ধ শিল্পভুবন।
বাবার কাছ থেকে শুনেছি, দেশবিভাগের পর ঢাকায় চলে এসেছিলেন কলকাতা আর্ট স্কুলের আরো দুজন আনোয়ারুল হক ও হাবিবুর রহমান। আর্ট স্কুলের শিক্ষা শেষ করে কামরুল হাসান ও ড্রাফটসম্যান আলী আহসান চলে এলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সবার সহযোগিতায় ও উদ্যমে ১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হলো ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্ট’। এদেশে চিত্রকলা চর্চার আন্দোলনের শুরু হলো। সবাই ব্রত হিসেবে নিলেন শিক্ষকতাকে। সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্র বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন এবং ২০০৩ সালেও একাশি বছর বয়সে ছাপচিত্র বিভাগে নিবিষ্টমনে ছাত্রদের কাজ শিখিয়েছেন।
শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? এ-প্রশ্নের উত্তরে আমি বাবার ছাত্র ও সহকর্মী শিল্পী আবুল বারক আলভীকে উদ্ধৃত করতে চাই – ‘শিল্পী সফিউদ্দীন সার্থক চিত্রকর ও প্রিন্ট মেকার তো অবশ্যই, সেই সাথে অসাধারণ সংবেদনশীল একজন সার্থক শিক্ষকও। তাঁর সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি প্রত্যেক ছাত্রই ক্লাসে তাঁর কাছে ছিল সমান। ক্লাস বা পরীক্ষার নম্বর দেবার সময় জানতেও চাইতেন না এটা কার কাজ। একবার দেখেও তৃপ্ত হতেন না। পরের দিন আবার কাজগুলো বিছাতে হতো, আবার দেখতেন। তাঁর সবকিছুই নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা ছিল।’
আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলায় এই মহান শিল্পী তাঁর কাজকে যুক্ত করেন স্বকীয়তায়। অন্তর্মুখী ধ্যানী এই শিল্পীর তিরোধানে আমি হারিয়েছি আমার বাবাকে, কিন্তু আমাদের শিল্পের জগতে যে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি বাবাকে ধ্যানী শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করছি এজন্য যে, আমার জন্মের পর থেকে ২০০৮ সালে বাবা অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত এমন কোনো দিন দেখিনি যেদিন তিনি ছবি অাঁকার কাজ করেননি। নিরন্তর কাজ করে যাওয়াই ছিল তাঁর সহজাত প্রবণতা।
বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও পারতপক্ষে অন্যের ওপর নির্ভর করতে চাইতেন না। তখন আমি বাবার জন্য যতখানি করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে আমার স্ত্রী নাহিদা শারমিন। আমার ধারণা, শারমিন নিজে শিল্পী না হলে সফিউদ্দীন আহমেদের গুরুত্ব এতখানি বুঝতে পারত না। বাবাও নির্দ্বিধায় তাঁর ছেলের বউকে বলতেন তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে শিল্পযাত্রার আখ্যান। এখনো শারমিনকে জ্বালিয়ে মারছি আমি। আমাদের বেডরুমগুলো হয়ে গেছে বাবার ছবি সংরক্ষণের জায়গা। ছবিগুলো ভালো রাখার জন্য সারাক্ষণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালিয়ে রাখতে হয়। ডি-হিউমিডিটি ফায়ার চালু না রাখলে ময়েশ্চার থেকে ছবিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছবি অাঁকতে চাই।’ বাবার এমনটাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এ-ইচ্ছা তাঁর পূর্ণ হলো না, সর্বশেষ ছবি এঁকেছেন ২০০৮ সালে। কিন্তু ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি যে-ছবি এঁকেছেন, এটাই বিরাট ঘটনা। তবে আরেকটি ইচ্ছের পূর্ণতা ঘটেছে বাবার জীবনে। বাবা বলতেন, ‘যেদিন ছবিতে নতুন কিছু দিতে পারব না, সেদিন অাঁকা বন্ধ করব, সেদিন আমার শিল্পীজীবনের মৃত্যু ঘটবে।’ না, পুনরাবৃত্তিদোষে তাঁকে শিল্পচর্চা থেকে বিরত থাকতে হয়নি। তবে বাবা জানতেন শিল্পীকে একসময় থামতেও হয়। আমার বাবা শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ থামতে জানার সূত্রটা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। ২০০৮ সালে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি ছবি অাঁকা একেবারেই থামিয়ে দিলেন, অথচ তখন তাঁর ছবি নয়, সিগনেচারের বিশাল মূল্য দাঁড়িয়ে গেছে। আমি একবার তাঁকে বলেছিলাম, ‘বাবা তুমি অাঁকো না কেন?’ উত্তরে বাবা বলেছিলেন, ‘দেখো খোকন, আমি সারাজীবন অাঁকাঅাঁকি করে যে জায়গায় এসে পৌঁছেছি, সেটাও হয়তো চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করেনি, কিন্তু আমি তো আমার যা অাঁকার কথা তার চেয়ে খারাপ কিছু অাঁকতে পারি না।’
আমি এরপর আর কোনোদিনই তাঁকে অাঁকতে বলিনি। সবাই যাঁকে শিল্পগুরু বলে অভিহিত করছেন, তাঁর সন্তান হিসেবে আমি সত্যি গর্বিত হচ্ছি, কিন্তু তাঁর সন্তান বলে আমি জানি সফিউদ্দীন আহমেদ মনে করতেন, তিনি শিল্পকলার যে-জায়গায় পৌঁছাতে চান সেখানে পৌঁছাতে পারেননি।
বাবা সবসময় খুব সকালে ঘুম থেকে জাগতেন। যতদিন চারুকলায় শিক্ষকতার কাজ ছিল ততদিন কখনো দেরি করে ইনস্টিটিউটে যাননি। সারাদিন ছাত্রদের পড়াশোনা করিয়ে বিকেলবেলা এসে বসে যেতেন নিজের কাজ নিয়ে। রুটিনে বাঁধা ছিল তাঁর জীবন। ছুটির দিনগুলোতে সারাদিন কাজ করে যেতেন তিনি। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে ঢুকে যেতেন তাঁর ছবি অাঁকার ঘরে। আমাদের তিন ভাই-বোন কারোরই তাঁর ছবি অাঁকার সময় ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ ছিল।
আমি ছোটবেলায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নীরবে ঢুকে যেতাম বাবার স্টুডিওতে। এমন অনেকবার হয়েছে, আমি স্টুডিওতে ঢুকেছি। চুপচাপ বাবার কাজ করা দেখেছি এবং বেরিয়ে আসার সময় হয়তো কোনো কিছু একটা হাতে করে বেরিয়ে এসেছি। বাবা একটুও টের পাননি। তবে তাঁর কাজের সময় হঠাৎ করে কোনো শব্দ করলে ভীষণ বিরক্ত হতেন। শুধু বিরক্তি বললে কম বলা হবে, কাজের মাঝখানে কোনো শব্দ হলে চমকে উঠতেন। এ-রকম ঘটনায় তাঁকে অসুস্থ হয়ে যেতে দেখেছি। যে-কারণে আমরা তাঁর নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছিলাম। বাবার কাজের সময় স্টুডিওতে কেবল মা যেতে পারতেন। অবশ্য জরুরি প্রয়োজন না হলে মাও যেতেন না কখনো।
পরে আমি যখন একটু বড় হয়েছি, অাঁকাঅাঁকির প্রতি আমার আগ্রহ বাবা বুঝতে পারলেন, তখন অনেক সময় দুপুরের খাবারের পর আমাকে বলতেন, ‘খোকন আয় তো ছবিটা কেমন হয়েছে দেখে যা।’ আমি হয়তো দেখেটেখে বললাম, ‘কাজ তো পুরোপুরিই হয়ে গেছে।’ তখন তিনি নিজেই নিজের অাঁকার খুঁত ধরতে শুরু করতেন। আমাকে বলতেন, ‘দেখ তো ওই জায়গাটা বোধহয় ঠিক হলো না?’ আমার কিন্তু মনে হতো যা করেছেন, তাই পূর্ণাঙ্গ ছবি হয়ে গেছে। তবু বাবাকে খুশি করার জন্য বলতাম, ‘ইচ্ছে করলে ওখানে আরেকটু কাজ করতে পারো। তবে না করলেও কোনো অসুবিধা নেই।’ আমি জানতাম আমার এই বলায় সফিউদ্দীন আহমেদের কিছুই যায় আসে না, তিনি আবারও ওই ছবির পেছনে লেগে যাবেন। যথারীতি দেখা যেত তিনি রাতের ১০টা পর্যন্ত কাজ করলেন এবং কাজ শেষে আবারও আমাকে ডাকতেন। আমি বলতাম, ‘বাবা যা করেছ তা অসাধারণ হয়েছে। এবার সিগনেচার করে রেখে দাও।’ তিনি রেখে দিতেন কিন্তু সিগনেচার করতেন না। তারপর দেখা গেল দুই মাস আগে করা এরকমই কোনো একটা কাজ বের করে আনতেন, যাতে সিগনেচার করা নেই।
আবার শুরু হতো তাঁর পুরনো কাজকে নতুন করে বিনির্মাণের কান্ডকীর্তি। এভাবে একটা কাজ শেষ করতে বছর পাঁচেক পর্যন্ত লাগিয়ে দিয়েছেন। ছাপচিত্রের মতো কাজ, যে-কাজে তাঁর তুলনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, সে-কাজেও তিনি দিনরাত একাকার করে ফেলেছেন। এই যে দীর্ঘসূত্রতা, তা তিনি ছবিকে সন্তান জ্ঞান করেই করতেন। প্রদর্শনী করায় বাবার অনাগ্রহের কারণ যেটা অনুমান করি, তিনি মনে করতেন, প্রদর্শনী মানে তো নিজের সন্তানতুল্য শিল্পকর্মকে হাটে তোলা। তাই ২০০৮-এ বেঙ্গল গ্যালারির ওই একক প্রদর্শনী ছিল তাঁর শিল্পীজীবনের দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী। অথচ ১৯৪০ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি সাঁওতাল পল্লী, কলকাতার বাঁকুড়া অঞ্চলের মেলা, পার্বণ, কৃষক, নারী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বাস্তবধর্মী কাজ করেছেন। চল্লিশের দশকেই তিনি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। ছবি বিক্রি করতে চাইলে তখন থেকেই তিনি বিরাট বাজারমূল্য পেতে পারতেন।
২০০৮ সালে বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে দ্বিতীয় প্রদর্শনীর বহু আগে বিদেশে একটা প্রদর্শনী হয়েছিল তাঁর, সেটা ১৯৫৯ সালে। লন্ডনের নিউ ভিশন সেন্টার আর্ট গ্যালারিতে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হওয়া ছিল গৌরব করার মতো একটা বিষয়। বাবার আড়ালে থাকার এ-প্রবণতাকে কবি ও শিল্প-সমালোচক মাহমুদ আল জামান ব্যাখ্যা করেন এভাবে – ‘যাঁর সৃষ্টির ফসল অফুরন্ত, যাঁর চিত্রগুচ্ছে রয়েছে অসামান্য জীবন উপলব্ধির নতুন মাত্রা ও গহন-গভীর জিজ্ঞাসা, তিনি কেন এমনভাবে প্রচ্ছন্নেই রয়ে গেলেন। সে কি কেবল এই জন্য যে, তাঁর শিল্পিত স্বভাবে, রুচিস্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের মধ্যেই আছে এক ধরনের বিনয়। এই বিনয়ই সমাজজীবন থেকে আজ অপসৃত। অনুকরণীয় এই বিনয় নিয়েই তিনি কতভাবেই না অনুজ চিত্রীদের দীক্ষিত করতে চেয়েছেন। উত্তরকালের সৃজনধারায় তাঁর সৃজনী উৎকর্ষ ও আদর্শবাদিতা অনিঃশেষ প্রেরণা সঞ্চারিত করতে সমর্থ হলে এদেশের চিত্রকলা উচ্চতর পর্যায়ে উন্নত হবে সন্দেহ নেই।’
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ সব সময় আরো বেশি কিছু জানতে চাইতেন, জানতে চাওয়ার এ-তাড়নায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্যে ১৯৫৬ সালে প্রিন্ট মেকিং বিষয়ে পড়তে লন্ডনে গিয়েছিলেন। লন্ডনে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি মূলত উড এনগ্রেভিং করেছেন, লন্ডনে গিয়ে শুরু করলেন মেটাল এনগ্রেভিং। লন্ডনেও ছাপচিত্রের শিক্ষক মেরলিন ইভান্সের কাছে পেয়েছিলেন যথেষ্ট সহযোগিতা।
কাঠ খোদাইচিত্রে সাদা-কালো রঙে আলোছায়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থিতি তিনি নিশ্চিত করেছেন। সাদা-কালো ছাপাই ছবিতে তিনি আলোছায়ার উপস্থিতির সঙ্গে বিষয়ের বাস্তবানুগ অবয়ব উপস্থাপন নিশ্চিত করেন। তাঁর ১৯৪২ সালে করা কাঠ খোদাইচিত্র ‘সাঁওতাল রমণী ও শিশু’ ছবির বিষয় অতিচেনা। ফসলের ঝাঁকা মাথায় মাঠের ওপর অবস্থান করছে চারজন রমণী দুজনের অাঁচল টেনে আছে দুটি শিশু। দূরের ফর্সা আকাশের বুকে সূক্ষ্ম গতিশীল রেখা, মাঠের জমির ফসল বোঝাতে সূক্ষ্ম রেখা বারবার ব্যবহারে ছবির জমিনের বুকে মানবীয় অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। ১৯৪৩ পর্যন্ত আমরা তাঁর সাদা-কালো কাঠ খোদাইচিত্রে বিষয় হিসেবে পাই নিসর্গ, কৃষকের প্রতিকৃতি, দুমকা অঞ্চলের জনজীবনের চিত্র। ১৯৪৪ সালে ড্রাই পয়েন্টে করা ধাতব প্লেটের এচিংয়ে বাস্তবধর্মী বিষয় উঠে আসে। এ সময়ে ড্রাই পয়েন্ট কাজের মাঝে উডকাটে তাঁর সেরা কাজ ‘মেলার পথে যাত্রা’ বা ‘অন দ্য ওয়ে’ শিরোনামের সূক্ষ্ম রেখা আলোছায়ার উপস্থিতিকে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছে। লন্ডনের উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের পর এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, সফটগ্রাউন্ড, লিফটগ্রাউন্ড, ডিপএচসহ নানা মাধ্যমের মিশ্রণে কাজ করেছেন।
পরে লন্ডনে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণকালে রপ্ত করা আরেকটি নতুন মাধ্যম কপার এনগ্রেভিংয়ে (তাম্রতক্ষণ) কাজ শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কপার এনগ্রেভিংয়ে রঙের সমাবেশ করেন। বিষয়ে তিনি বাস্তবধর্মী আচরণ থেকে সরে এসে রেখা ও জ্যামিতিক ফর্মের আশ্রয় নেন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘ইয়োলো ফিশিং নেট’ বা মাছ ধরার হলুদ জাল শিরোনামের আড়াআড়ি কালো রঙের রেখার ছুটে চলা দর্শকদের কাছে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। ১৯৫৮ থেকে এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের কাজে বিষয়ে স্থূল রেখার ব্যবহার দেখা যায়। ১৯৮০ সালের দিকে এসে কাজের বিষয়ে যুক্ত করেন চিত্রতলের সরলীকরণ। ‘দ্য ক্রাই’ সিরিজে চোখের ফর্মের পৌনঃপুনিক ব্যবহারের পাশাপাশি দ্রুত রেখা উপস্থিত করেছেন। ছাপচিত্রের পাশাপাশি তিনি তেলরং, জলরং ও রেখাচিত্রে সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
চল্লিশের দশকে বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হলেও এরপর আর কখনই তিনি পুরস্কারের জন্য ছবি জমা দেননি। তাঁর চোখের সামনে দিয়ে কত পুরস্কার এলো গেল। আমি আমার বাবার মধ্যে এই ইঁদুর দৌড়ে শরিক হওয়ার কোনো মানসিকতা দেখিনি। তিনি একক প্রদর্শনী না করলেও যৌথ প্রদর্শনীতে ছবি জমা দিতেন। তবে সে-জন্য তাঁর কাছে এসে ঝুলোঝুলি করা লাগত। তাঁকে বোঝাতে হতো তিনি ছবি জমা দিলে ওই প্রদর্শনীর গৌরব বৃদ্ধি হয়। একইরকমভাবে কেউ যদি তাঁর ছবির প্রতি মমত্ব প্রকাশ করতেন, তাহলে দেখা যেত যে, ছবি বিক্রি করলে লাখ টাকা পেতে পারতেন, সেটা তিনি দান করে দিলেন।
ছাপচিত্র ছিল তাঁর মূল বিষয়। তাই তিনি ছাপচিত্রে প্রয়োগ করা রেখা ও বর্ণ অন্য মাধ্যমেও সমানভাবে ব্যবহার করেছেন। ১৯৬০ সালে পেনসিল ও ক্রেয়নে তিনি বেশ কিছু কাজ করেছেন। ছবিগুলোর বিষয় হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা মানব দেহভঙ্গির নানারূপ। জলরং চিত্রে দক্ষতা দেখিয়েছেন শিল্পী সফিউদ্দীন ১৯৩৯-৪০ সাল থেকেই। ১৯৪৪ সালের দিকে এসে তেলরঙে বাস্তবধর্মী নিসর্গচিত্র দুমকা অঞ্চলের জনজীবন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপ তুলে এনেছেন। ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬ সালে তেলরং চিত্রের বিষয়ে জ্যামিতির আশ্রয় নেন। বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন জ্যামিতিক আকৃতি, রেখায়; তাঁর ‘ফিশিং’ (১৯৫৪), ‘কার্পেন্টার’ (১৯৫৬) কাজ দুটি আধাবাস্তব ধাঁচে ক্যানভাসে এঁকেছেন। ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৮ সালে তেলরঙে তিনি বিষয়বস্ত্তকে ক্যানভাসে গড়ে তুলেছেন আধাবাস্তব রীতিতে নিজস্ব রঙের প্রয়োগে।
১৯৯৬ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত অাঁকা ছবিতে করণপদ্ধতির কোনো পরিবর্তন হয়নি; কিন্তু বিষয়ে পরিবর্তন এনেছেন। মানুষি দেহের সঙ্গে রং-রেখার সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শিল্পভুবন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত করা কাজগুলো বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
এ তো গেল মোটাদাগে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের মূল্যায়ন। এখানটায় আমার অবস্থানটা কোথায়। তাঁর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র আমিই শিল্পী। আমরা কে কী হতে চাই, এ নিয়ে তিনি কখনো কিছু চাপিয়ে দেননি। এমনকি আমি যখন চারুকলায় পড়তে যাই, তখনো বাবা আমাকে কখনো কাজ দেখিয়ে দেননি। আমি এখন বুঝি কেন তিনি এ-কাজটা করেছিলেন। তিনি সবসময়ই বলতেন, আমি প্রতিনিয়ত শিখছি, এটা যেমন বিশ্বাস করে বলতেন, তেমনি এও জানতেন যে, তিনি একজন বড় শিল্পী। তিনি চাননি তাঁর ছায়ায় আমি তাঁর মতো হওয়ার চেষ্টা করি। একদিন আমি বাবাকে আমার কিছু কাজ দেখাতে চাইলে এটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন। বাবা বললেন, ‘তুমি এমনিতে কাকে তোমার কাজ দেখাও?’ আমি বললাম, ‘কখনো কিবরিয়া স্যার, কখনো আবার আলভি স্যারের কাছেও যাই।’ বাবা বললেন, ‘তুমি এ-কাজগুলো কিবরিয়াকে দেখিয়ে আনো।’
বাবা কিন্তু আমাদের কখনো উপেক্ষা করেননি। দারুণ একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবার আমাদের। কাজেই মোহাম্মদ কিবরিয়াকে কাজ দেখাতে বলার মাধ্যমে বাবা আমার কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। আমি যখন তাঁর এ-বার্তাটা বুঝতে পারলাম, তখনই আবিষ্কার করলাম আমার রঙের ব্যবহারে কোথাও কোথাও এবং রেখায় পুরোপুরি বাবার প্রভাব রয়ে গেছে। এ-বার্তা বুঝতে পারার পর আমি তখন কিছুদিন কাজ করাই বন্ধ করে দিলাম। অথচ বাবার কাছে তখন তাঁর ছাত্ররা একের পর এক আসে যায়, কাজ দেখিয়ে নেয়, বাবা বারবার পরামর্শ দেন, কাজটা কেমন হতে পারত। এটা কিন্তু বাবার অসাধারণ এক গুণ, বাবা কখনো কাউকে বলেননি, তুমি যে-কাজটা করেছ তা হয়নি। তিনি বলতেন, আমি হলে এখানটায় এটা না করে ওইটা করতাম।
বাবা সর্বদাই ছিলেন সমকালীন। আমরা যখন ডিজিটাল প্রিন্ট বা ইনস্টলকে আত্মীকৃত করার চেষ্টা করছি, তখনো তাঁকে কখনো বলতে শুনিনি যে, এগুলো কিছু হচ্ছে না। আসলে বাবার কাছে শিল্পের কোনো মাধ্যম অবহেলিত হয়নি। তিনি বলতেন, ‘তুমি কোন মাধ্যমে কাজ করছ, সেটা বড় ব্যাপার না। বড় ব্যাপার হচ্ছে, কাজটা কেমন করছ।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, অগ্রজের কাজের প্রতি সম্মান দিতে হবে এবং অনুজের কাজ দেখতে হবে উদারতার সঙ্গে।
২০০৮ সালের পর বাবা তো পুরোপুরি ছবি অাঁকা ছেড়ে দিলেন, তখনো কিন্তু তিনি তাঁর ছাত্রের ছাত্রদের অকাতরে বুদ্ধিপরামর্শ দিয়ে গেছেন। এভাবে সফিউদ্দীন আহমেদ আমাদের ছোট্ট পরিবারের বাইরে বিশাল এক পরিবার তৈরি করে ফেলেছিলেন। আমার মা, আমরা ভাইবোনরাও তাঁর এই বিশাল পরিবারকে মেনে নিয়েছি সবসময়। আমাদের এই মেনে নেওয়াটা যে কত বড় কাজ করেছে তা বাবার মৃত্যুর পর অনুধাবন করেছি। একজন সফিউদ্দীন আহমেদের সন্তান শুধু আমরা তিনজন নই, অজস্র সন্তান রয়েছে।
আমি চাই, সফিউদ্দীন আহমেদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের তিন ভাইবোনের সঙ্গে তাঁর মানস সন্তানদের সম্পৃক্ততা। বাবা তাঁর ছবিগুলোর দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছেন। আমি তো জানি বাবা তাঁর শিল্পকর্ম বিক্রি করতে চাইতেন না। আমিও তাঁর কোনো শিল্পকর্ম বিক্রি না করার অনড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাবার সঙ্গে তাঁর কাজগুলো নিয়ে যখন কথা হয়েছে, তখন তিনি আমাকে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। আমি চাই, জাতীয় চিত্রশালায় সফিউদ্দীন আহমেদের নামে একটি আলাদা গ্যালারি করা হোক, যে-গ্যালারিতে আমি তাঁর প্রায় সব কাজ দান করে দিতে পারব। প্রায় সব কাজ বলছি এজন্য যে, আমি কিছু রেখে দেব সফিউদ্দীন আহমেদের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি গ্যালারির জন্য। এখানে চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা এসে সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ দেখতে পারবে, তাঁকে নিয়ে গবেষণা করতে পারবে।
যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের হাতে শিল্পকর্মগুলো তুলে দিতে পারছি না, ততদিন এ-গ্যালারিতে রাখা হবে বাবার শিল্পকর্ম, এখানে একটি স্টাডিরুম গড়ারও পরিকল্পনা আছে আমার। সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পকর্ম নিয়ে যারা গবেষণা করবে তাদের জন্য কোনো বৃত্তি প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা তাও আমি ভেবে দেখছি। এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল আমি আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকেই ব্যবস্থা করতে চাই, তবে এ-কাজে আমি সফিউদ্দীন আহমেদের ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ীদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করব। এসব কিছু আমি এখনো একাই ভাবছি, অচিরেই সবার সঙ্গে এ নিয়ে ভাববিনিময়ের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেষ্টা করব। 