‘আপনার গল্প লেখার গল্প শুনতে চাই’ আবদারটি জানাতেই বড় অসহায় মনে হলো শওকত আলীকে। ‘আমার যে কিছুই মনে নেই।’ বললাম, ‘দেখুন না মনে করে।’ তিনি বললেন, ‘লাভ হবে না। কিছুই মনে থাকে না আমার।’ বলেই স্বাভাবিক হয়ে গেলেন; কিন্তু আমি আর মাহবুব রেজা আমরা দুজন বড় অসহায় বোধ করি। বাংলাদেশের সাহিত্যের অন্যতম এক সেরা গল্পকারের গল্প লেখার প্রেক্ষাপট, তিনি কীভাবে এলেন এই গল্প লেখার জগতে, কীভাবে গল্পের চরিত্রগুলো পেলেন, বিষয়বস্ত্তকে কীভাবে টেনে বের করে আনলেন শিল্পের পারদে, নিজের গল্পগুলো সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মূল্যায়নই বা কী অথবা বাংলাদেশের ছোটগল্পচর্চাকে তিনি কীভাবে দেখেন – এসব বিষয় অজানাই থেকে যাবে! তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা কোনো বিশ্লেষণই পাবো না!

হয়তো কেউ-কেউ এসব বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন, বেরও করে নিয়েছেন নানা তথ্য-উপাত্ত, কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম তাঁর ছোটগল্পকার-সত্তা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ সবিস্তার সাক্ষাৎকার! সেটা যে আর সম্ভব হবে না, তা শওকত আলীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয় না। ইদানীং তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। এই সেদিনও কাটিয়ে এলেন হাসপাতালে। যত না শরীর খারাপ, তার চেয়ে খারাপ স্মৃতিশক্তির অবস্থা। মনে তো থাকেই না কিছু, বলতে চাইলেও নির্দিষ্ট বিষয়কে ছুঁতে পারেন না। অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা হয়। আমরা তাই বারবার একই চক্করে ঘুরপাক খেতে থাকি। আর তাঁর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ বোধ করি এই ভেবে যে, একদিন কী প্রবল প্রাণশক্তি নিয়েই না আমাদের কথাসাহিত্যের জগতে বিচরণ করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন গল্প-উপন্যাসের জগৎ!

বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর আগমন ঘটেছিল ষাটের দশকে। যে-দশকের মতো গল্পের এতো সমৃদ্ধ দশক এখন পর্যন্ত এদেশে আসেনি বলা যায়। আক্ষরিক অর্থেই সে-সময়টা ছিল বাংলাদেশের গল্পসাহিত্যের যৌবনকাল – হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, রিজিয়া রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রাহাত খান, শহীদ আখন্দ, সেলিনা হোসেন, হাসনাত আবদুল হাই, আবদুশ শাকুর, রশীদ হায়দার, সুব্রত বড়ুয়া, আল মাহমুদ, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ূন আহমেদ, কায়েস আহমেদ, মাহমুদুল হক, আহমদ ছফা, বুলবুল চৌধুরীসহ একসঙ্গে একঝাঁক প্রতিভাবান শক্তিশালী ছোটগল্পকারের আবির্ভাব ঘটেছিল।

তাঁরা ছোটগল্পের আঙ্গিক, প্রকরণ ও বিষয়বস্ত্ত নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি তাঁদের গল্পে ক্রমবিকশিত নগরজীবনের ক্লেদ, জটিলতা, জীবন-জিজ্ঞাসা আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষিত হয়েছে। সেইসঙ্গে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র যে বৈষম্যের শিকার হয়ে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে তার সাংকেতিকতাও গল্পে সূচিত হয়েছে। ষাটের দশকের এসব প্রতিভাবান ছোটগল্পকার অবশ্য ছোটগল্পচর্চার দৃঢ় একটি ভিত্তি পেয়েছিলেন, যা নির্মাণ করেছিলেন পঞ্চাশের দশকের শিল্পীরা – যাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান প্রমুখ। পঞ্চাশের দশকের ছোটগল্পের অন্য নিপুণ কারিগররা ছিলেন – সরদার জয়েনউদ্দীন, আবু রুশ্দ, রশীদ করীম, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শাহেদ আলী, আবু ইসহাক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মিরজা আবদুল হাই, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, মুর্তজা বশীর, জহির রায়হান, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ।

বলার অপেক্ষা রাখে না, পঞ্চাশের দশকের ছোটগল্পকাররা বাংলাদেশের সাহিত্যে আধুনিকতার যে-বীজ বপন করেছিলেন, ষাটের দশকের ছোটগল্পকারদের হাতেই তা পরম উৎকর্ষ পেয়েছে এবং নতুন জীবন-জিজ্ঞাসা আর যুগযন্ত্রণাকে ধরে বাংলাদেশের গল্পের বাঁকও বদলে দিয়েছে অনেকখানি। এক্ষেত্রে শওকত আলীও রেখেছেন নিজস্ব শক্তির পরিচয়।

খুব বেশি ছোটগল্প লিখেননি শওকত আলী। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যার তুলনায় তা অল্পই। তাঁর ছোটগল্পের বইয়ের সংখ্যা চারটি – উন্মুল বাসনা (১৯৬৮), লেলিহান সাধ (১৯৭৭), শুন হে লখিন্দর (১৯৮৬) এবং বাবা আপনে যান (১৯৯৪)। এ-চারটি গল্পগ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি নিজের কণ্ঠস্বরকে ভিড়ের ভেতরও উচ্চকিত রাখতে পেরেছেন।

শওকত আলীর ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যটি হলো, তাঁর গল্পে আগাগোড়াই সমাজের অতিসাধারণ নিচুতলার মানুষের জীবন ঠাঁই পেয়েছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক জীবনধারা প্রায়শই উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। প্রথমদিকের গল্পে তিনি যে শুধু এদের জীবনসংগ্রামকেই তুলে ধরেছেন, তা নয়, শরীর এবং মনের চাহিদাগুলো নিয়েও আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নতুনভাবে আলোকপাত করেছেন। এই শ্রেণির মানুষের লিবিডো-তাড়না তাঁর গল্পে নতুনভাবে উন্মোচিত হয়েছে। এরপর ক্রমশই তাঁর গল্পে নির্যাতিত মানুষের জীবন এসেছে, যুক্ত হয়েছে সেখানে শ্রেণিচেতনা, তবে কোনোরকম রাজনৈতিক দর্শন আরোপিত হয়নি। এখানেই তাঁর সার্থকতা। অথচ এই পদস্খলন তাঁর হতেই পারত। কেননা, তিনি কলেজে পড়ার সময় থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কমিউনিজম চেতনার তখন আগ্রাসী প্রভাব ঘটছে, বিশেষ করে শিল্পী-সাহিত্যিকরা এ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের মধ্যে একটি সাম্যময় সমাজের স্বপ্ন দেখছেন। শওকত আলীও সে-চেতনায় উজ্জীবিত, অথচ তাঁর গল্প এবং সাহিত্যকে শিল্পচ্যুত হতে দেননি, এটা কম শক্তির পরিচায়ক নয়।

তিনি প্রথম গল্পগ্রন্থ উন্মুল বাসনায় সমাজের নিচুতলার শ্রেণির মানুষ যেমন – চোর বা চোরের সহধর্মিণী, ট্রাকড্রাইভার, মুদিদোকানদার, সীমান্তের চোরাকারবারি কিংবা সার্কাস খেলোয়াড়ের মতো মানুষের লিবিডো-তাড়িত আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। লেলিহান সাধে এ-প্রবণতা বজায় থাকলেও বিষয় হিসেবে এসেছে মহাজন শ্রেণির নিপীড়ন। ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না। শুন হে লখিন্দরে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। ধনিকশ্রেণির কাছে গরিবশ্রেণির শোষিত হওয়ার প্রেক্ষাপটকে তিনি যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হৃদয়ের আর্তিকেও পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের মনে। সর্বশেষ বই বাবা আপনে যানে এসেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। লক্ষণীয় যে, শেষ গল্পগ্রন্থে শওকত আলী নিজের উত্তরণকে ঠিক ধরে রাখতে পারেননি। সম্ভবত ক্রমেই গল্প লেখায় তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলেন, ব্যস্ত হয়ে উঠছিলেন উপন্যাস রচনা নিয়ে।

যতই স্মৃতিবিভ্রমে তিনি ঘুরপাক খান, হাটখোলা রোডে তাঁর বাড়ির পাশেই ছোট ছেলের ফ্ল্যাটবাড়িতে, আমরা চেষ্টা করতে থাকি ছোটগল্পকার হিসেবে তাঁর সত্তাকে পুনরাবিষ্কারের। যদিও তিনি ক্ষণে ক্ষণেই এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছিলেন খুব দ্রুত, থেমে-থেমে শুরু হয় আমাদের কথোপকথন।

কালি ও কলম :  আপনার লেখালেখি কি গল্প দিয়ে শুরু হয়েছিল, না উপন্যাস দিয়ে?

শওকত আলী : লেখালেখির শুরু তো একেবারে বাল্যকালে। প্রথম জীবনে আমি আবেগাক্রান্ত হয়ে বহু ছড়া-কবিতা লিখেছি। গল্প-টল্প লেখা ধরেছি তার অনেক পরে। স্কুলে আর আট-দশজনের মতো আমার ভেতরেও ‘ভাবে’র উদয় হতো। এই ‘ভাব’ উদয় হওয়ার ফলাফল ছিল ছড়া-কবিতা। যখন স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম, তখন কলেজবার্ষিকীতে আমি অন্যদের দেখাদেখি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। অধ্যাপক জিসি দেব ছিলেন আমাদের প্রিন্সিপাল। শুনেছো তো নামটা? নজরুল ইসলামের ওপর আমার প্রবন্ধটার বেশ প্রশংসা করেছিলেন তিনি।

কালি ও কলম : এটা কত সালের ঘটনা হবে?

শওকত আলী : ১৯৫১ সালের। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের আগে।

কালি ও কলম : এটা তো প্রবন্ধের কথা বললেন, স্যার আমরা আপনার প্রথম গল্প লেখার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাচ্ছি।

শওকত আলী : স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক মনে করতে পারি না। জীবনের কত ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে গল্প লিখেছি। সেসব গল্পের কথা কী বলবো? আমি আমার লেখা গল্পই এখন পুরো মনে করতে পারি না। এই যে ধরো, তোমরা এখন আমার যে-গল্প নিয়ে কথা বলছো, আমি কিন্তু এ-মুহূর্তে তার কিছু বলতে পারব না – তোমরা যখন গল্পের ব্যাপারে কথা বলছো, আমি শুনে যাচ্ছি। হয়তো দেখা যাবে অনেক রাতে ঘুমানোর আগে কিংবা ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমার মনে হবে – আরে! ওই গল্পটা তো এরকম ছিল। কয়েক বছর ধরেই আমার স্মৃতিশক্তি আমার সঙ্গে এ-ধরনের লুকোচুরি খেলছে।

তবে ভাসা-ভাসা যেটা বলতে পারবো, কলেজে থাকতেই আমি গল্প লিখতে শুরু করলাম। তখন আমি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমি যখন গল্প লেখা শুরু করলাম, তখন আমার বাবা ব্যাপারটা জানতেন। তিনি এ-ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেননি। মূলত বাবার নীরব সমর্থন আমাকে লেখালেখির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে।

কালি ও কলম : প্রথম গল্পের কথা মনে পড়ছে না, ঠিক আছে। তাহলে গল্প লেখার প্রথম দিকের দিনগুলির গল্প শুনতে চাই।

শওকত আলী : বিএ পাশ করি আমি দিনাজপুরেই। ঢাকায় এলাম ’৫৪ সালে। এমএ ক্লাসে ভর্তি হলাম; বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে আমার একটা মজার গল্প আছে। যেহেতু রেজাল্ট খারাপ তাই প্রথম দিন বাংলা বিভাগ আমাকে নিল না। মন খারাপ করে বেরিয়ে আসছিলাম। কলা ভবনের সামনে জিসি দেব আর মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। মুনীর চৌধুরী জিগ্যেস করলেন, মন খারাপ কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি, মন কি আর ভালো থাকে? মুনীর স্যারকে জানালাম। মুনীর চৌধুরী তখন জিসি দেবকে বললেন, ও হচ্ছে শওকত আলী, ভালো গল্প লিখে। তখন জিসি দেব বললেন, ওকে তো আমি কলেজ থেকেই চিনি। তারপর জিসি দেব আর মুনীর চৌধুরী আমাকে নিয়ে গেলেন বাংলা বিভাগে। তারপরে, ভর্তি হয়ে গেলাম।

কালি ও কলম : তার মানে, আপনার গল্পকার-পরিচিতি আপনাকে বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে সহায়তা করেছিল?

শওকত আলী : নিশ্চয়ই। তবে ভর্তি হয়েও আমি আবার দিনাজপুর ফিরে গিয়েছিলাম।

কালি ও কলম : কেন?

শওকত আলী : হলে থাকার জায়গা নেই, ঢাকায় থাকার জায়গা নেই। কী করবো? কিন্তু বাবা আমাকে আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। ব্যস, ফিরে এলাম ঢাকায়। এরপর লেখালেখিটা বেড়ে গেল। তখন গল্পই লিখতাম বেশি। সমকাল পত্রিকা বেরিয়ে গেছে। তার মধ্যে লেখালেখি করছি। কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তিনি আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। তিনি একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটার নাম মনে পড়ছে না। আহসান হাবীব আর সিকান্দার আবু জাফর দুজনই আমাকে স্নেহ করেছেন, জায়গা দিয়েছেন, লেখা ছাপিয়েছেন। তখন সাহিত্য মহলে আমার নামটি মোটামুটি জানাজানি হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটিতেও আমার নামটা সবাই জানতো আর কি! এভাবে আমার লেখক-জীবনের শুরু।

কালি ও কলম : স্যার, আপনার প্রথম গল্পের বইয়ের কথা জানতে চাই।

শওকত আলী : কিছুই বলতে পারবো না। তবে আমার প্রথম গল্পের বই উন্মুল বাসনা… এটা বেরিয়েছিল কত সালে…? (চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগলেন)

কালি ও কলম : ১৯৬৮ সালে।

শওকত আলী : হ্যাঁ। হ্যাঁ। ’৬৮ সালেই হবে।

কালি ও কলম : স্যার, এটাই কি আপনার প্রথম প্রকাশিত বই?

শওকত আলী : আমার প্রথম বই ছিল উপন্যাস। সম্ভবত পিঙ্গল আকাশ।

কালি ও কলম : আপনার প্রথম গল্পের বইটি কোথা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল?

(শওকত আলী অসহায় হাসি হাসলেন)

কালি ও কলম : আচ্ছা, ঠিক আছে, আমরা গল্পের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি যখন গল্প লেখা শুরু করলেন, তখন কাদের গল্প আপনাকে প্রভাবিত করেছিল?

শওকত আলী : বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমার আউট বই পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেল সাংঘাতিক। সে-সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের তিনজনের লেখা আমার ভীষণ ভালো লাগত। ওঁদের গল্প যখন আমি পড়তাম, তখন আমার ভালো লাগত, এ-কথা যেমন ঠিক, কিন্তু আমার মনে হতো, – নাহ্, আমি ওঁদের মতো লিখব না। আমি লিখব আমার নিজের মতো করে। আমি আমার মতো গল্প লেখার চেষ্টা করেছি, কতটুকু পেরেছি তা জানি না।

কালি ও কলম : এই যে আপনি বললেন, ‘আমি আমার মতো গল্প লেখার চেষ্টা করেছি, কতটুকু পেরেছি তা জানি না’ – এ-কথাটা আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন।

শওকত আলী : (হাসতে হাসতে) তাও জানি না…

কালি ও কলম : শওকত আলীর সাহিত্য পাঠ যাদের আছে, প্রায়শই তাদের আক্ষেপ শোনা যায়, যেভাবে আপনার গল্পের মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল, তা এদেশে হয়নি। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?

শওকত আলী : কথাটা সত্যি। পৃথিবীর অনেক দেশেই সমালোচনার বিষয়টি সাহিত্যের মর্যাদায়ই চলে গেছে। আমাদের এখানে আমি মনে করি, সমালোচনা সেরকম জায়গায় যায়নি। সামনে যে যাবে সে-সম্ভাবনাও আমি দেখি না। আমি আমার নিজের লেখা গল্প নিয়েই বলতে পারি, আমার এমন অনেক গল্প আছে, যেগুলো নিয়ে সমালোচকরা কোনো কাজই করেননি। আমার এখন মনে হচ্ছে এসব গল্প নিয়ে আলোচনা হলে গল্পগুলো পাঠকদের মধ্যে আরো বেশি আলোড়ন তুলতো।

কালি ও কলম : গল্পকার কায়েস আহমেদ আপনার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘শওকত আলীর গল্পের মূল্যায়নে সবচেয়ে বড় বাধা তিনি নিজেই।’ কায়েস আহমেদের এ-কথাকে আপনি কীভাবে নেবেন?

শওকত আলী : (শিশুর সরল হাসিতে বললেন) কায়েস তো আমার ছাত্র ছিল। লিখতও ভালো। আমার গল্প নিয়ে খারাপ বলেনি। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রথম চাকরি সবই শুরু হয়েছে আধা মফস্বল, আধা গ্রামে, যে-কারণে আমি একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি, আমার গল্পে সবসময় মানুষের কথা এসেছে। বিচিত্র পেশার বিচিত্র শ্রেণির মানুষের কথা এসেছে, যে-কারণে আমার গল্পে হয়তো বহুমাত্রিক দ্যোতনা রয়েছে। তবে সবশেষে ঘুরেফিরে ওই মানুষের কাছে ফিরে যাওয়াই সার হয়েছে।

কালি ও কলম : হ্যাঁ, সত্যি আপনার প্রায় গল্পেই দেখা যায় ঘুরেফিরে এসেছে সেই নিম্নবর্ণের মানুষই। এরা কীভাবে আপনার গল্পের চরিত্র হয়ে উঠে এলো?

শওকত আলী : আগেও আমি তোমাদেরকে বলেছি, ছাত্রজীবনে আমি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। চোখের সামনে অনেক স্বপ্ন ছিল। ওই সময়ে যেরকম থাকে আর কি! ছাত্ররাজনীতি করার কারণে অল্পবয়সে জেলও খেটেছি। তবে, হ্যাঁ, জেলজীবনে আমার অনেক প্রাপ্তিযোগের মধ্যে একটি হলো বিখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের সঙ্গে জেল খাটা। বন্দি সাঁওতালদের সঙ্গে তাদের জীবনাচার, কৃষ্টি, গঞ্জনা-বঞ্চনার কথাও শুনেছি অনেক। আর জেলের লাইব্রেরির সব বই প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। কী বিচিত্র বিষয়ের সেসব বই! আরেকটা কথা বলি, ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে আমার একটা স্বভাব ছিল, আমি সবসময় শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে থাকতাম। তাদের সঙ্গে চলাফেরা করে আমি জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। পরে এই সমস্ত মানুষ আমার গল্পে উঠে এসেছে নানা রূপে, নানা মাত্রায়।

কালি ও কলম : এছাড়া আপনার গল্পে মানব-মানবীর লিবিডো তাড়নার ব্যাপারটা ঘুরেফিরে আসতে দেখা গেছে – এ-ব্যাপারে আপনার মতামত…

শওকত আলী : এ-ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে আগেও হতে হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমি আমার মতো করে জীবনের জলছবি তুলে ধরার যৎসামান্য চেষ্টা করেছি। মানব-মানবীর মধ্যে যে বিচিত্ররকম সম্পর্ক থাকে আমি তা নির্মাণ করি মাত্র।

কালি ও কলম : আপনার গল্পের অনেক চরিত্রই পরবর্তীকালে আপনার উপন্যাসে জায়গা করে নিয়েছে। এ-ব্যাপারে আপনার নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে কি?

শওকত আলী : কথাটা একদম ঠিক। আমার ছোটগল্পের অনেক চরিত্রই পরবর্তীকালে আমার উপন্যাসে চলে এসেছে আমার জ্ঞাতসারেই। কারণ ছোটগল্পে আমি অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও চরিত্রের ডালপালা আমার মতো করে ছড়াতে পারিনি কিংবা এটাও হতে পারে, অসন্তুষ্টি আমার মধ্যে কাজ করেছে যার কারণে ঘটনা কিংবা চরিত্ররা পরবর্তীকালে উপন্যাসে বিস্তৃত হয়েছে।

কালি ও কলম : একটা পর্যায়ে মনে হয়েছে আপনি উপন্যাস লেখাটাই বেশি উপভোগ করেছেন… গল্পে মনোযোগ কমে গেছে।

শওকত আলী : এটার কারণ কি জানো, ঈদসংখ্যাগুলো যখন বের হতে থাকে, ধরো, বিচিত্রার শাহাদত চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে – ঈদ এলেই চেপে ধরতো, ঈদসংখ্যার জন্য উপন্যাস দিতে হবে। এরকম অনুরোধ অন্যান্য জায়গা থেকেও আসতো। তাই উপন্যাস লেখাটাই বেশি হতে লাগলো। গল্প যে লিখিনি তা নয়, গল্পও লেখা হয়েছে, তবে প্রাধান্য পেয়েছে উপন্যাস। আমি তো লেখালেখি শুরুই করেছিলাম গল্প দিয়ে। তিন-চার বছর পর লিখতে শুরু করি উপন্যাস।