আমি শুধু একটা চাকরি চেয়েছিলাম

মাহবুব তালুকদার

 বিএ পরীক্ষায় ফেল করার পর আমার মনে ধারণা জন্মাল, লেখাপড়া আমার জন্য নয়। শিক্ষকের সন্তান হয়েও শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে না পারায় পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার অনুভূতি আমাকে চরম হতাশার মধ্যে ঠেলে দিলো। আমার চেয়েও খারাপ অবস্থা এখন আমার স্ত্রী রোজিনার। ওর মুখের দিকে আর তাকানো যায় না। পাশ না করার দুঃখ ও বেদনা আমার চেয়ে তারই বেশি। আমাদের প্রেমের ব্যাপারে ওদের পরিবারের সায় ছিল না, বিয়ের ব্যাপারে তো নয়ই। বিয়ের আগে রোজিনা তার বাবা-মাকে বুঝিয়েছিল, বিএ পাশ করলে আমি রকেটের মতো সাঁই করে ওপরে উঠে যাবে। কিন্তু আমি যে ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে নিচে নামব, এমন কথা তার মনে আসেনি। এখন আমাকে রোজিনার সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে দিনরাত তাকেই আমার সান্ত্বনা দিতে হচ্ছে।

আমার নাম ছিল জোবায়ের আলম মেহেদি। এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় ফরম পূরণ করতে গিয়ে ভুলক্রমে জোবায়ের নাম বাদ পড়ে যায়। সবাই আমাকে মেহেদি নামে ডাকতেন বলে শিক্ষকরাও এ-ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেটে আমার নাম আলম মেহেদি। এজন্য আমার শিক্ষক-পিতার আফসোসের অন্ত নেই। তিনি অবশ্য শিক্ষকতার চাইতে শিক্ষক সমিতির নেতা হিসেবে বেশি আত্মনিবেদিত। পিতা হওয়ার চেয়ে নেতা হওয়ার বিষয়েই তার মনোযোগ বেশি ছিল। ফলে আমার নামের তিন ভাগের এক ভাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নামের প্রসঙ্গ এখানে টানার আরেকটা কারণ আছে। আমার নাম-দুর্যোগের খবর শুনে আমার একমাত্র মামা হাসরত তাজপুরী আমার হাতখানা টেনে নিয়ে বললেন, কুছ পরোয়া নেই। আগে হাতের রেখার সঙ্গে তোমার নামের বানান মিলিয়ে দেখে নিই। তারপর সব ঠিক করে দিচ্ছি।

মামা পেশাদার হস্তরেখাবিদ। তার হাতের কাছে সবসময় একটা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস থাকে। তিনি সেটা দিয়ে আমার হাতের ওপর উবু হয়ে দেখলেন। কাগজ-কলম টেনে নিয়ে আমার নামের বানান লিখলেন। তারপর বলেন, তুমি নামটাকে পালটে দাও। আলম মেহেদির বদলে মেহেদি আলম লেখ। আলম বানানে দুটো ‘এ’ লিখে এল এ এম লিখবে। এভাবে নাম লিখলে জীবনে কখনো তুমি ফেল করবে না, সর্বদাই কৃতকার্য হবে।

মামার পরামর্শে আমি নাম পালটে মেহেদি আলম হয়েছি। ভেবেছিলাম নামের জোরেই এবার পরীক্ষায় পাশ করে যাব। কিন্তু ফেল করার পর মামা কিংবা তার হস্তরেখাবিদ্যার ব্যাপারে আমার আর কোনো আস্থা নেই।

ফেল করার খবরটা মামাকে জানিয়ে বললাম, আপনি তো বলেছিলেন জীবনে কখনো আমি ফেল করব না।

বলেছিলাম নাকি! মামা এক মিনিট চুপ থেকে চিন্তার জাবর কাটলেন। বললেন, আমি তোমার জীবনযুদ্ধের কথা বলেছি। পরীক্ষার কথা বলিনি। জীবনে তুমি জয়যুক্ত হবেই।

কবে হবো?

যখন সময় আসবে তখন। মামা সামনের কাগজ টেনে নিয়ে একটি চক্র আঁকলেন। ওটার ওপর খানিকটা আঁকিবুকি করে বললেন, তোমার ঘাবড়ানোর কোনো ব্যাপারই নেই। তুমি সামনে এগিয়ে যাও।

আমার ফেল করা নিয়ে খুবই নাজুক অবস্থায় পড়েছে রোজিনা। তার বাবা পৌরসভায় কাজ করেন। পৌরসভার মেয়রের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। সেই সুবাদে তিনি মেয়েকে আশ্বাস দিয়েছিলেন বিএ পাশ করার পর তিনি মেয়রকে ধরে জামাইয়ের চাকরির একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। রোজিনাও এ-বিষয়ে খুব আশাবাদী ছিল। কিন্তু ভাগ্যটা যে এমন ঘোলাপানিতে ডুবে যাবে, তা সে কখনো ভাবতে পারেনি।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের বাসায় একটা পারিবারিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। এর বিষয়বস্ত্ত বা আলোচ্য বিষয় আমার ভবিষ্যৎ। বাবা বললেন, ওর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই উচিত। আগামীবার আবার পরীক্ষায় বসা দরকার। একবার না পারিলে – বলতে গিয়ে তিনি থেমে গেলেন।

আমার শ্বশুর বললেন, বেয়াই সাহেব! ওকে কিছু টাকা দিয়ে দিন। সময় নষ্ট না করে ব্যবসায় নেমে পড়ুক। ব্যবসার পথঘাট আমি চিনিয়ে দিতে পারব।

টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার কোথায়? ব্যবসার টাকা দিতে পারলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলব কেন?

তাহলে সে কী করবে? আমার দিকে তাকিয়ে শ্বশুর সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, বলো! তুমি কী করতে চাও?

আমি চাকরি করব!

চাকরি! বাবা বললেন, বিএ ফেল করে কী চাকরি করবে শুনি! আজকাল বিএ-এমএ পাশ করে অনেকে পিয়নের চাকরি করছে।

মামা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন, সবই ভাগ্যের ব্যাপার। আমার জানা একজন ম্যাট্রিক পাশ লোক সরকারের সচিব পর্যন্ত হয়েছে।

এ পর্যায়ে আমাকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠকের কার্যক্রম সিদ্ধান্তহীনভাবে শেষ হলো। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম। চাকরি আমাকে করতেই হবে। আজ ক-মাস ধরে বিয়ে করেছি। বিয়ের পরে স্ত্রীসহ বাবার বাড়িতে পড়ে থাকার মতো বিব্রতকর আর কিছু হতে পারে না। রোজিনা প্রায়ই মনে করিয়ে দেয়, উপার্জনহীন স্বামীসহ এ-সংসারে থাকতে তার ভালো লাগছে না। এরপর পেটে সন্তান এলে তারই বা কী দশা হবে? এমতাবস্থায় অতি শিগগির আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আমি নিজেও এমন প্রয়োজনের বিষয় উপলব্ধি করতে পারি। মফস্বল শহরে চাকরির পরিসর খুবই সীমিত। তবু প্রতিদিন পত্রিকার পাতা দেখে দেখে চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠাই। মেধায় না হোক, কোটার ভিত্তিতে কোনো চাকরি জুটে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু দুমাস পেরিয়ে গেলেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

অবশেষে নিতান্ত আকস্মিকভাবে ঘটল ব্যাপারটা। আমার বড় বোনের স্বামী খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মোবাইল কলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, চাকরি করবে নাকি মিয়াসাহেব?

করতে তো চাই। পাই কোথায়?

চাকরি একেবারে হাতের মুঠোয় আছে। ঢাকায় এলে সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে।

কী চাকরি, কেমন চাকরি, কোথায় চাকরি, বাড়ির সবাই এসব কথা জানতে চাইবে।

কাউকে কোনো কথা জানাবার দরকারটা কী? তুমি বলে আসতে পারো, ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছ। তারপর চাকরিতে জয়েন করে আস্তেধীরে সবাইকে সব খবর জানাতে পারবে।

কিন্তু রোজিনাকে তো কিছু একটা বলে আসতে হবে। তাকে কোনো মিথ্যা কথা বলে আসা যাবে না।

তাই তো মিয়াসাহেব! রোজিনাকে বলে এসো তুমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকা যাচ্ছ। কথাটা মিথ্যা নয়। যেখানে চাকরি করবে, সেখানে তোমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে।

তবে যে বললেন, চাকরি আপনার হাতের মুঠোয়! শেষে যদি না হয়!

এসব ভেবে টেনশন বাড়াবার কোনো মানে হয় না। চাকরির ব্যাপারে আমি তোমাকে শতভাগ গ্যারান্টি দিতে পারি। ইন্টারভিউ দেওয়া একটা ফর্মালিটি মাত্র। নাও, তোমার বোনের সঙ্গে কথা বলো।

দুলাভাই বোনের হাতে টেলিফোন তুলে দিতে বড় আপা উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, মেহেদি! তুমি কালই ঢাকায় চলে এসো। বেতন যা-ই হোক, চাকরিটা মন্দ না। চাকরিতে বিনাভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা আছে। ঢাকা শহরে একটা থাকার জায়গা পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। তুমি চলে এসো।

রাতে বিছানায় শুয়ে রোজিনাকে চুপিচুপি বললাম, আমি ঢাকায় যাচ্ছি।

ঢাকায়! কেন?

একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে।

কী চাকরি বলো না।

তা জানি না। তবে চাকরিতে বাসস্থানের ব্যবস্থা আছে।

সত্যি! তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আমাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবে।

আগে চাকরি হোক। তারপর তো থাকার ব্যবস্থা।

রাতে ঘুমাবার আগে প্রতিদিনের মতো প্রার্থনা করলাম, হে পরওয়ার দেগার! তুমি আমার দিকে মুখ তুলে তাকাও। আমাকে তুমি একটা চাকরি জুটিয়ে দাও। আমি শুধু একটা চাকরি চাই।

দুই

খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নামের মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে বলে আমার ধারণা। যারা তাকে চেনেন তারা অবশ্য বলবেন যে, তার মন-মেজাজ ও আচার-আচরণের মধ্যে একধরনের আভিজাত্য বিদ্যমান। পোশাক-আশাকেও তার অভিনবত্ব আছে। তিনি সর্বদা মাথায় একটি গান্ধীটুপি এবং শার্ট বা পাঞ্জাবির ওপর মুজিবকোট পরে থাকেন। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, তার গান্ধী টুপি পরা ঐতিহ্যগত। ব্রিটিশ আমলে তার দাদা এবং পাকিস্তানি আমলে তার বাবা গান্ধীটুপি পরতেন বলে ঐতিহ্যের সেই ধারা তিনি অব্যাহত রেখেছেন। তবে মুজিবকোটটি তার পরিচ্ছদে বাংলাদেশ আমলের সংযোজন। বড় আপা অবশ্য এহেন পোশাক মোটেই পছন্দ করেন না। বিয়ের পর প্রথমদিকে আপত্তি তুললেও এখন আর কিছু বলেন না। ঢাকায় আসার পথে মনে মনে তাদের দুজনের কথা ভাবছিলাম আমি।

এর আগেও ঢাকায় বেশ কয়েকবার এসেছি। তবে আপা-দুলাভাইয়ের এ-বাসায় আগে কখনো আসিনি। ঢাকায় তার চাকরি বা ব্যবসা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। শুনেছিলাম তিনি ইস্কাটনে শাইনপুকুর আবাসিক এলাকায় ম্যানেজার। এছাড়া মগবাজারে তার একটি কম্পিউটারের দোকান আছে। তাতে একটি ছেলে কম্পিউটারে টাইপ করে, আরেকজন কম্পিউটার মেরামত করে।

শাইনপুকুরের বাসায় পৌঁছাতে বড় আপা ও দুলাভাই একসঙ্গে দুধরনের প্রশ্ন করলেন। আপা জানতে চাইলেন, পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা! আর দুলাভাই বললেন, একেবারে তৈরি হয়ে এসেছো তো? লাগেজপত্র কোথায় তোমার? আর কিন্তু ফিরে যেতে পারবে না। কালই জয়েন করতে হবে।

চাকরিটা কী, তাই তো বুঝলাম না। আমি বললাম।

চাকরি আর কী! খাবে ঘুমাবে আর আরাম-আয়েশ করবে।

এমন হেঁয়ালিপনা কথায় আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আসলে আমাকে কী করতে হবে?

ওই যে বললাম –

বড় আপা এ-সময়ে কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন, তোমার দুলাভাই এখানে যে-চাকরিটা করছেন, একই চাকরি। আমাদের পাশের বহুতল বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার দরকার। ওখানকার সমিতির মেম্বাররা তোমার দুলাভাইকে ধরেছেন একজন লোক ঠিক করে দিতে।

দুলাভাই জানালেন, আমারও পদবি আগে কেয়ারটেকারই ছিল।

আমাদের সমিতিকে বলে আমি ওটা ম্যানেজার করিয়ে নিয়েছি। তুমিও সেটা করিয়ে নিতে পারবে। পদ যা-ই হোক, একটা সম্মানজনক পদবি তো দরকার।

বেতন কত দেবে?

আপাতত পাঁচ হাজার। পরে বাড়তে পারে।

মাত্র পাঁচ হাজারে চলবে কী করে?

ঘরে বসে থাকলে পাঁচ হাজার টাকাই বা তোমাকে দিচ্ছে কে? তাছাড়া তোমার থাকার জন্য ওখানে একটা ঘর পাচ্ছ। পাশে বাথরুম আছে। ঢাকা শহরে এমন অভিজাত এলাকায় বিনাভাড়ায় বাসস্থান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাছাড়া, খাওয়া-দাওয়াও ফ্রি।

খাওয়া ফ্রি মানে? ওরা খাওয়াবে নাকি?

আমাদের আলাপ শুনে বড় আপা বললেন, ওদের খাওয়াতে হবে কেন? পাশাপাশি বাড়িতে তুমি আমাদের এখানেই খাবে।

না, না। সেটা ঠিক হবে না। চাকরি করে নিজের থাকা-খাওয়ার সংস্থান যদি না করা যায়, তাহলে সে-চাকরিতে লাভ কী?

আমার একমাত্র ভাই তুমি। খাওয়া-পরার ব্যাপার বড় করে দেখার দরকার নেই। আপাতত চাকরিতে জয়েন করো। আপা বললেন।

দুলাভাই হাত ধরে টানলেন, চলো আগে খেয়ে নিই। পরে চাকরির বিষয়ে আলাপ করা যাবে। ঢাকা শহরে একবার পা ফেলতে পারলে কোথায় কখন কোন দরজা খুলে যাবে, তা কে বলতে পারে!

চাকরিটা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল। এসব বহুতল বাড়িতে নিরাপত্তা, লিফট, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা সদাসর্বদা চালু রাখার জন্য বাসিন্দাদের সমবায়ে একটি করে সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে। ইমারতের যাবতীয় দায়িত্ব কেয়ারটেকারের ওপর ন্যস্ত। নিরাপত্তা পাহারাদাররা ঠিকমতো ডিউটি করছে কিনা তদারক করা, লিফটের সার্ভিসিং ও প্রয়োজনে মেরামতের ব্যবস্থা, যৌথ ব্যবস্থাপনার পানির বিল পরিশোধ, বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ফোনের বিল  ব্যাংকে জমা দেওয়া – এসব দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। সমিতির সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে দুলাভাই সবকিছু পটিপটি করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনিই আমাকে নিয়ে সমিতির সভাপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে সভাপতি একবার আমার জীবনবৃত্তান্ত ও পরে আমার মুখের ওপর দৃষ্টি রেখে বললেন, শুধু বায়োডাটা দিলে হবে না। আমার বরাবরে তোমাকে চাকরি চেয়ে দরখাস্ত দিতে হবে।

সেটা আজই লিখে দিতে পারবে। বললেন দুলাভাই।

ঠিক আছে। ওটা আমাকে দিয়ে মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে কাজে লেগে যাক। আমার দিকে ফিরে বললেন, তুমি অফিসের কাগজপত্র সবকিছু বুঝে নাও।

জ্বি স্যার!

এখানে আমাদের দশটা ফ্ল্যাট আছে। সবাই মিলে সমিতি করেছি। সমবায় অধিদফতরে কয়েক বছর আগে তা নিবন্ধিত হয়েছে। আমাদের দশজনের মধ্যে একজন হলো ব্ল্যাক শিপ। ব্ল্যাক শিপ অর্থ বোঝ?

জি স্যার।

আসলে কিছুই বোঝো না। শুধু এটুকু জেনে রাখো ও লোকটা হলো খতরনাক। আমরা ন-জন একদিকে আর সে একা একদিকে। বুঝলে?

জি স্যার।

লোকটা একসময়ে সরকারি চাকরি করত, এখন রিটায়ার্ড। কিন্তু সে তার আগের দাপটের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। আমাদের সমিতির বিরুদ্ধে সমবায় অধিদফতরে নালিশ করেছে। কী বিষয়ে নালিশ করেছে আল্লাহই মালুম। বুঝেছ কিছু?

জি স্যার!

অথচ দ্যাখো, লোকটা কিন্তু আমাদের এই ইমারতের মালিক নয়। ঘুষ খেয়ে ফ্ল্যাট কিনেছে তো! তাই স্ত্রীর নামে কিনেছে। তার স্ত্রীকে দিয়ে সই করিয়ে সমবায় অফিসে অভিযোগপত্র পাঠিয়েছে। আগামী পরশু সমবায়ের অফিসার তদন্ত করতে আসবে। যে-আসবে সে নাকি জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র। আমি ডক্টরেট করার পর ওখানে পড়াতাম। বুঝলে?

জি স্যার!

লোকটার ব্যাপারে তুমি খুব সাবধান থাকবে। আস্তে আস্তে অবশ্য সবই বুঝতে পারবে।

সভাপতি অফিসকক্ষ থেকে চলে যাওয়ার পূর্বে আমাকে অফিসের চাবি ও আমার থাকার ঘরের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। থাকার ঘরটি দেখে আমার মন ভরে গেল। ঘরের দক্ষিণ দিক খোলা। আয়তনে ছোট হলেও দক্ষিণপাশের জানালার ওদিকে একটি পার্ক আছে বলে উন্মুক্ত আকাশ দেখা যায়। এই ইমারতের নামটি অভিনব – ‘জুয়েলারি হাউস’। যিনি এই জমিটির আদি মালিক ছিলেন ‘জুয়েলারি হাউস’ নামে তার একটি সোনার দোকান ছিল। দোকানটি মোটামুটি সুপরিচিত হওয়ায় নিজের বাড়রি নামও দিয়েছিলেন ‘জুয়েলারি হাউস’। ডেভেলপার তার কাছ থেকে বাড়িটি কিনে নতুনভাবে বারোতলা বাড়ি তৈরি করে একই নাম দেয়। কাগজপত্র পড়ে দেখতে পেলাম, সমিতির নাম ‘জুয়েলারি হাউস ফ্ল্যাট মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেড’। সমিতির সভাপতির নাম ডক্টর গাজী জামালউদ্দীন। যার সম্পর্কে তিনি আমাকে সচেতন থাকতে বলেছেন এবং যাকে তিনি খতরনাক বলে আখ্যা দিয়েছেন, তার নাম কাজী কামালউদ্দীন। অর্থাৎ নামের যতই মিল থাকুক না কেন, দুজনের মধ্যে চরম শত্রুতা চলছে, চিঠিপত্র পড়ে তা বোঝা যায়। আমার কাছে নামের এরকম মিল বিস্ময়কর। পৃথিবীতে কাকতালীয়ভাবে কত বিস্ময়কর ঘটনাই না ঘটে।

এই ইমারতে যারা বসবাস করেন, তারা সকলেই সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদের মধ্যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর ব্যাংকার – বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। একজন পুলিশ অফিসার, ব্যবসায়ী ও একজন শিল্পপতিও আছেন এখানে। এসব তথ্য জানা গেল নামাজঘরের ইমামের কাছে। কেয়ারটেকারের অবর্তমানে গত দুমাস তিনি কাজ চালিয়ে আসছিলেন। এখানকার বাসিন্দাদের সম্পর্কে তিনি আমাকে মোটামুটি ধারণা দিলেন। তার কাছে আরো জানা গেল, সমিতির সভাপতি গাজী জামালের সঙ্গে প্রাক্তন আমলা কাজী কামালের চরম রেষারেষি চলছে এখানে। এর উৎস হচ্ছে একটা রেক্সিনের পর্দা। কাজী কামালের গ্যারেজের পেছনদিকটায় গ্রিল দেওয়া বিধায় পাশের নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে সিমেন্ট ও বালি এসে গাড়ির ওপর পড়ে। তা থেকে রক্ষা পেতে গ্যারেজের পেছনে তিনি একটি পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এতে সভাপতি নাখোশ হয়েছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে কাজী কামালকে সাতদিনের মধ্যে পর্দা সরিয়ে নিতে হবে, নইলে সমিতিই নিজ দায়িত্বে পর্দা উচ্ছেদ করবে। সমিতির এহেন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজী কামালের স্ত্রী নূরবানু কামাল জেলা সমবায় অফিসে চিঠি লিখে পর্দাটি যথাস্থানে রাখার নির্দেশ চান। সমবায় অফিসের একজন পরিদর্শক বিষয়টি তদন্ত করার পর জেলা সমবায় অফিস থেকে নির্দেশ আসে, ‘পাশের নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পর্দাটি যথাস্থানে রাখার আবশ্যকতা আছে।’ এরপরও সমিতির সভাপতি পর্দাটি নিরাপত্তা বিঘ্নকারী বলে ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিটি সভার সিদ্ধান্তে পর্দা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে কাজী কামাল নিজেই চিঠি লিখে সমবায় অফিসকে জানিয়েছেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি অবৈধভাবে কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এই কমিটি বাতিল করা উচিত। এ-বিষয়ে তদন্ত করতে জেলা সমবায় অফিসের একজন পরিদর্শক আসবেন।

ব্যাপারটি বিশদভাবে জানার পর আমার মনে হলো, কত ছোট ছোট বিষয়ে বড় বড় মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে। কিন্তু ছোট মুখে বড় কথা বলতে নেই বলে এ-বিষয়ে আমার কিছু করণীয় নেই। আমি অবশ্য বিভিন্ন ফ্ল্যাটে গিয়ে নতুন কেয়ারটেকার হিসেবে সবার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। হরতালের দিন ছিল বলে সেটা সুবিধাজনকই হলো। ফ্ল্যাট মালিকদের প্রায় সবাই বাসায় ছিলেন। কেউ কেউ দরজায় দাঁড়িয়ে দু-এক কথা বলে আমাকে বিদায় করে দিলেন। আবার অনেকে বাসার ভেতরে ডেকে আপ্যায়ন করলেন। একমাত্র পুলিশ অফিসার ‘ফোন না করে বাসায় এসেছ কেন’ ধমক দিয়ে ‘তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই’ বলে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কাজী কামালের বাসায় যাওয়া ঠিক হবে কি না, দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত তার দরজায় বেল টিপলাম। কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো এবং পরিচয় পেয়ে সে ড্রইংরুমে বসতে বলল। কাজী কামাল প্রশাসন ক্যাডারের অফিসার ছিলেন এবং সরকারের যুগ্মসচিব হিসেবে অবসর নিয়েছেন। তার সঙ্গে আলোচনায় তাকে তেমন খতরনাক বলে মনে হলো না।

রাতে নতুন ঘরে বিছানায় শুয়ে মনে হলো, আমার প্রথম চাকরি জীবনের প্রথম দিনটা কাটল। একা একা অনেক আকাশ-পাতাল ভাবলাম। সবচেয়ে বেশি মনে হলো রোজিনার কথা। সেও নিশ্চয়ই বিছানায় শুয়ে এখন আমার কথা ভাবছে। ওর একটা মোবাইল ফোন থাকলে কথা বলতে পারতাম। বেতন পেয়ে সেটাই প্রথমে কিনতে হবে। কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা বেতনে মোবাইল কিনব, না সংসার চালাব!

একসময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

 

তিন

এমন যে ঘটনা ঘটবে, তা কখনো কল্পনাও করিনি আমি। অকুস্থলে নিজে উপস্থিত না থাকলে ঘটনাটাকে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতাম আমি। কিন্তু নিজের চোখ-কানকে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। তবে যা-কিছু ঘটতে দেখেছি, তা এখনো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সমাজের ওপরতলার লোকদের আচার-আচরণ এমন হতে পারে, সে-কথা অন্যদের বিশ্বাস করানো কঠিন হবে।

সমবায় অফিস থেকে তদন্ত করতে এসেছিলেন পরিদর্শক আখতার হোসাইন। তিনি সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ছাড়াও কাজী কামালউদ্দীনকে অফিসকক্ষে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন। কাজী কামাল ও তার স্ত্রী নূরবানু কামাল ওখানে উপস্থিত হওয়ার আগেই সভাপতিসহ সেখানে হাজির ছিলেন পুলিশ অফিসার আল্লাহ বখশ ও প্রকৌশলী আলী আসগর। কাজী কামাল সস্ত্রীক কক্ষে ঢোকামাত্রই গাজী জামাল সমবায় অফিসারকে বললেন, এই লোকটা এখানে কেন?

আখতার হোসাইন বললেন, উনি ব্যবস্থাপনা কমিটির ব্যাপারে আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগ করার সে কে? সে তো ফ্ল্যাটের কোনো মালিক নয়।

অভিযোগ যে কেউ করতে পারেন। তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলে তা আমলে নেওয়া হবে না।

আমাদের সমিতি সম্পর্কে বাইরের লোকের কথা বলার কোনো এখতিয়ারই নেই।

কাজী কামাল এতক্ষণ চুপ ছিলেন। এবার বললেন, লোকটা মানে কী! ভদ্রভাবে ওকে কথা বলতে বলুন।

তোর সঙ্গে আবার ভদ্রতা কী? তুই একটা হারামখোর!

আমি হারামখোর হলে তুই কী? তুই একটা –

কাজী কামাল কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার স্ত্রী তার মুখ চেপে ধরলেন।

গাজী কামাল অকস্মাৎ একটা চেয়ার তুললেন মাথার ওপরে, তুই পেয়েছিস কী? তোকে আজ শায়েস্তা করে ছাড়ব।

নূরবানু কামাল স্বামীকে বাঁচাতে তার মাথা দুহাতে টেনে নিয়ে স্বামীর ওপরে ঢাল হয়ে রইলেন।

ইত্যবসরে প্রকৌশলী আলী আসগর গাজী জামালের হাত থেকে টেনে নামালেন চেয়ারটাকে। অতঃপর গাজী জামাল কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে অফিসকক্ষ ত্যাগ করলেন। অন্য দুজন অনুসরণ করলেন তাকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। মনে হলো আমার সেখানে উপস্থিত না থাকাই ভালো ছিল; কিন্তু সমবায় অফিসার আমাকে সংশ্লিষ্ট ফাইলপত্র হাজির করতে বলায় আমার সেখানে উপস্থিতি। তিনি অবশ্য কাজী কামালের একপ্রস্থ বক্তব্য লিপিবদ্ধ করলেন। সমবায় অফিসার আমার কাছে বিগত নির্বাচনের কাগজপত্র এবং আয়-ব্যয়ের হিসাবপত্র চেয়ে নিলেন। কাজী কামাল সস্ত্রীক চলে যাওয়ার পরও আখতার হোসাইন দীর্ঘ সময় ধরে ফাইল থেকে নোট করলেন। কোনো কোনো কাগজের ফটোকপি করে আনতে বললেন আমাকে।

পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। সমবায় অফিস থেকে জেলা সমবায় অফিসার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানো হলো, পূর্ববর্তী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে নিয়মনীতি পালিত না হওয়ায় এবং অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করায় সমবায় বিধি অনুযায়ী বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির বদলে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হলো। নতুনভাবে নির্বাচন করাই এই কমিটির মূল দায়িত্ব। অন্যদিকে কাজী কামাল সিএমএম আদালতে গিয়ে গাজী জামালের বিরুদ্ধে চেয়ার তুলে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করলেন। মামলার আর্জির সঙ্গে ওইদিন থানায় দায়ের করা জিডির অনুলিপি সংযোজিত করে দিলেন। সাক্ষী করলেন আখতার হোসাইন, নূরবানু কামাল ও আমাকে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে গাজী জামালের বিরুদ্ধে সমন জারি করলেন।

কয়েকদিনে বুঝতে পারলাম, এই ইমারতের পরিবেশ বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। একদিকে গাজী জামালের নেতৃত্বে ফ্ল্যাটের মালিকদের প্রায় সবাই। অন্যদিকে কাজী কামালের পক্ষে সমবায় অধিদফতর। আমি যে কোনদিকে যাব, তা বুঝতে পারলাম না। গাজী জামাল আমাকে ডেকে বললেন, তুমি সমবায় অফিসকে কোনো পাত্তাই দেবে না। বুঝলে?

জ্বি স্যার!

পুলিশ অফিসার আল্লাহ বখশ বললেন, আমরা নিজের টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছি। আমাদের ওপর খবরদারি করার সমবায় কে?

জ্বি স্যার!

প্রকৌশলী আলী আসগর বললেন, এবার থেকে সাভির্স চার্জের টাকা তোমার কাছে জমা রাখবে। সমবায়কে কোনো রকম টাকা-পয়সা ও কাগজপত্র দেবে না। আমরা ওদের কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করব না।

জ্বি স্যার!

অতঃপর সবাই মিলে যে সভা করা হলো, তাতে অবশ্য কৌশলগত কারণে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। সবাই একবাক্যে সায় দিলেন যে, যেহেতু সমবায় নিয়োজিত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির একমাত্র কাজ হচ্ছে নির্বাচন করা, সেহেতু নতুনভাবে নির্বাচিত হয়ে এলে অবৈধতার আর অবকাশ থাকে না। ফলে পূর্বের বাতিল কমিটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে দায়িত্বভার অর্পণ করল। শুরু হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া।

কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ঘটল আরেক অভিনব ঘটনা। সভাপতি পদে ডক্টর গাজী জামালউদ্দীনের পাশাপাশি কাজী কামালের স্ত্রী নূরবানু কামালও মনোনয়নপত্র পেশ করলেন। এতে প্রায় সবাই মুখ বাঁকা করে হাসলেন এজন্য যে, নূরবানু কামালের ভোট মাত্র একটি এবং সেটি তার নিজের। গাজী জামাল আমাকে ডেকে বললেন, নির্বাচনের পর আমি সবাইকে খাসি জবাই করে খাওয়াব। তুমি আমাকে একটা খাসি কিনে দিও।

মনোনয়নপত্র যথারীতি বাছাইয়ের সময় দেখা গেল সবার মনোনয়নপত্র সঠিক থাকলেও গাজী জামালের মনোনয়নপত্রে কাটাকাটি রয়েছে। তিনি নামের আগে ডক্টর লিখে নামের শেষে পিএইচ-ডি লিখেছেন। পরে ডক্টর শব্দটি কেটে শুধু পিএইচ-ডি কথাটি রাখলেন। এহেন কাটাকাটির কারণে নির্বাচন কমিশন বিধি অনুযায়ী তার মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করল। শেষে সভাপতি পদের অপর প্রার্থী নূরবানু কামালকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচন করা হলো। ফলে অন্যরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেন।

গাজী জামালের এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিতে সবাই মিলে পুনরায় নির্বাচন চাইলেন। পুনরায় নির্বাচন অবশ্য হতেই পারে। তবে ইতোমধ্যে নির্বাচিত সভাপতির পদটি বাদ দিয়ে অন্যান্য পদে নির্বাচন হতে হবে; কিন্তু তাতে কেউই রাজি হলেন না। গাজী জামাল সভাপতি না হলে আর নির্বাচন করে লাভ কী? আগের ব্যবস্থাপনা কমিটি পুরোপুরি বহাল হতে পারলে তবেই না নির্বাচন!

পূর্বতন কমিটির সদস্যদের আবার সভা হলো। সভায় ঠিক হলো সমিতির প্রয়োজন মেটানোর জন্য সবাই মিলে উন্নয়ন ফি বাবদ দশ হাজার টাকা করে দেবেন। এই টাকা ও সার্ভিস চার্জের টাকা আমার নামে ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে জমা রাখতে হবে, যাতে সমবায়ের লোকজন তাতে হাত দিতে না পারে। এর হিসাবপত্র ব্যক্তিগতভাবে আমি সংরক্ষণ করব। আগের সমিতির ফাইলের সঙ্গে তা মেশানো চলবে না।

গাজী জামাল তার বাড়িতে ডাকলেন আমাকে। এই প্রথম তিনি বাড়িতে আমাকে আপ্যায়ন করলেন। বললেন, তোমার তো দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল।

জি স্যার।

একটা কথা মন দিয়ে শোনো। সেদিনের ঘটনার মামলায় আমি আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসেছি। উকিল বলেছে, এ-মামলায় আমার কিছুই হবে না। মানে এটা কোনো মামলাই নয়। বুঝলে?

জি স্যার!

খতরনাক লোকটা তোমাকে সাক্ষী মেনেছে। তুমি অবশ্যই সাক্ষ্য দিতে যাবে। বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে তুমি বলবে, সেদিন ওখানে চেয়ার তুলে মারার মতো কিছুই ঘটেনি। হত্যা-প্রচেষ্টার অভিযোগ নিতান্ত বানোয়াট ও হাস্যকর। স্যারের মতো, মানে আমার মতো একজন ডক্টরেট মানুষ কি কারো গায়ে হাত তুলতে পারেন? আদালতে কী কী বলতে হবে, তা আমি তোমাকে লিখে দেব। তুমি বারবার পড়ে তা মুখস্থ করে নিও।

কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ বেরোলো না।

গাজী জামাল বললেন, কী ব্যাপার! তুমি চুপ করে আছ কেন? কথায় কথায় তো জি স্যার জি স্যার বলো। এখন কথা বলছ না কেন? আমি কী বলেছি বুঝতে পেরেছ তো?

জি স্যার!

গুড। তুমি আদালতে বুঝিয়ে বলবে সেদিন ওখানে কোনো গন্ডগোলই হয়নি, এমনকি কথাকাটাকাটিও নয়। সমবায়ের লোকটাকে আশা করি ম্যানেজ করতে পারব। তাকে দিয়ে বলাতে হবে কাজী কামাল ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমার মতো একজন সম্মানিত ডক্টরেট সম্পর্কে মিথ্যা মামলা রুজু করেছেন।

জি স্যার!

শোনো! তোমার জন্য একটা সুখবর আছে। আমার এক বন্ধু বেসরকারি ব্যাংকের এমডি। আমি তাকে বলে তোমার চাকরির ব্যবস্থা করেছি। মামলার ঝামেলাটা মিটে গেলে আমি তোমাকে নিয়ে এমডি সাহেবের কাছে যাব।

আমি এতক্ষণে মুখ খুললাম। বললাম, স্যার! আমি শুধু একটা চাকরি চাই।

চার

সমবায় অফিসের সঙ্গে এখানকার ইমরাতের বাসিন্দাদের রেষারেষি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির তিন মাস কার্যকালের মধ্যে কেবল নূরবানু কামালকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচন করা ছাড়া আর কোনো অর্জনই নেই তাদের; কিন্তু এতে পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল হয়েছে। এখানকার বাসিন্দারা সমবায়ের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে প্রথম থেকেই। এখন তারা ঘোষণা দিয়েছে সমবায়ের অফিসাররা এখানে এলে তাদের প্রতিরোধ করা হবে। আমাকে আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমি যেন তাদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না করি। তারা অবশ্য মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করে এখানকার পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন। তবে সেসব কথা আমি কাউকে জানাই না।

ইতোমধ্যে প্রথম অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে জেলা সমবায় অফিসার আরেকটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের নির্দেশ জারি করলেন। মূলত সমবায় কর্মকর্তাদের সমবায়ে এই কমিটি গঠিত হলেও বিধি অনুযায়ী নূরবানু কামালকে নতুন কমিটির একজন সদস্য মনোনীত করা হলো। ফলে ধিকিধিকি আগুন তাতে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সবাই সভা করে স্থির করলেন, এই কমিটি সভাপতিবিহীন অন্যান্য পদে নির্বাচন করতে চাইলে, কেউই প্রার্থী হবেন না। যেহেতু সমবায় সমিতির নির্বাচনকালীন সময়ে আইন অনুযায়ী আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায় না, সেহেতু নির্বাচনের সময় উত্তীর্ণ হলে তারা উচ্চ আদালতে রিট করবেন।

আমি এর মধ্যে সিএমএম আদালত থেকে কাজী কামালের মামলায় সাক্ষ্য প্রদানের জন্য সমন পেয়েছি। সেটি পাওয়ার পরপরই গাজী জামাল তার বাসায় ডাকলেন আমাকে। প্রচুর আপ্যায়নের পর একটা টাইপ করা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। তাতে লেখা আছে, সেদিনের ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম। কিন্তু সেখানে মারামারি, চেয়ার তোলা কিংবা কথাকাটাকাটির কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসবই একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারীর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণতার কারণে বানোয়াট ও ভুয়া অভিযোগ। গাজী জামালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি বললেন, কাগজটা তুমি একেবারে মুখস্থ করে ফেলবে। বানোয়াট কথাটা বলতে ভুলো না। ওটা হচ্ছে আইনের ভাষা।

আমার বাসস্থানে ফিরে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতো টেনশন আর আমার সহ্য হয় না। সমবায় কার্যালয়ের এখানকার বাসিন্দাদের রেষারেষির এক ধরনের টেনশন তো আছেই। এখন আরো বড় টেনশন হচেছ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া। একবার মনে হয়েছিল, রোজিনার সঙ্গে এসব বিষয় শেয়ার করলে টেনশন কিছুটা কমবে। পরে মনে হলো, ওকে এসব বিষয় জানিয়ে ওর টেনশন বাড়িয়ে লাভ নেই। অবশেষে বাবাকে ফোন করলাম আমি।

সমবায়ের সঙ্গে বাসিন্দাদের দ্বন্দ্বের ব্যাপারে তিনি বললেন, সমবায় হচ্ছে সরকারের অংশ। অন্যদিকে বাসিন্দারা দলে ভারী। আইন অনুযায়ী সমবায় দায়িত্ব পালন করলেও বাস্তবক্ষেত্রে বাসিন্দারা ওখানে ক্ষমতাবান। এক্ষেত্রে তোমার নিরপেক্ষভাবে গা বাঁচিয়ে চলা উচিত।

সেটাই চেষ্টা করছি। কিন্তু মামলার ব্যাপারে আমাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলা হচ্ছে। আমি যা দেখেছি, যা শুনেছি তা বলতে মানা করা হচ্ছে।

বাবা বললেন, এ-বিষয়ে আমার চিন্তা খুব পরিষ্কার। আদালতে শপথ করে তুমি কখনো মিথ্যা কথা বলতে পার না। তাতে তোমার চাকরি যদি চলে যায়, যাক।

আমিও সেরকমই ভাবছি।

একজন শিক্ষকের ছেলে হয়ে তুমি অমন জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা বলবে কী করে?

আগামীকাল মামলার তারিখ। আগের সভাপতি গাড়ি করে আমাকে আদালতে নিয়ে যাবেন বলেছেন।

সেটা ঠিক হবে না। যিনি তোমাকে সাক্ষী মেনেছেন, তিনি তোমাকে কিছু বলেননি?

না। তুমি তোমার বোনের বাসায় চলে যাও। ওখানে রাত কাটিয়ে ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে যেও। প্রয়োজনে বাসে চড়ে আদালতে যাবে। কারো সঙ্গে গাড়িতে চড়ে নয়।

বাবার কথা অনুযায়ী আমি পরদিন বাসে চড়েই সিএমএম আদালতে পৌঁছালাম। গাজী জামাল ও কাজী কামাল, উভয়ের কাছ থেকেই লুকিয়ে থাকার অবস্থা আমার। এই লুকোচুরি মোটেই ভালো লাগল না। আমি সাধারণভাবে চাকরি করতে ঢাকায় এসেছিলাম। এসব ঝুটঝামেলা পোহানোর জন্য চাকরি করতে আসিনি। মনে মনে নিজেকে সাহস দিলাম। আমি তো কোনো অপরাধ করিনি যে আমাকে সংকোচ করে চলতে হবে।

এড়াতে চাইলেও অবশেষে গাজী জামালের সামনাসামনি পড়ে গেলাম। সম্ভবত তিনি আমাকে খুঁজছিলেন। বললেন, কাগজটা মুখস্থ করেছ তো?

কোন কাগজ?

ওই যে আমি তোমাকে টাইপ করে দিয়েছিলাম। ঘটনাটা যে বানোয়াট এ-কথাটা জোর দিয়ে বলবে তুমি। বানোয়াট শব্দটা ভুলে যেও না। এটা হচ্ছে আইনের ভাষা।

এরপরের ঘটনা নিতান্ত সংক্ষিপ্ত। আমি কখন কীভাবে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম, আদালতে সেদিনের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিলাম, বারবার পিতার মুখখানা স্মরণ করে ঘটনার সত্যপ্রকাশ থেকে একচুলও বিচ্যুত হলাম না, আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী শতরকম জেরা করেও আমাকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারলেন না – এবং নির্ভীকচিত্তে কীভাবে আদালতকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম, সমস্তটাই একটা ঘোরের ভেতর ঘটে গেছে বলে মনে হলো। ওখান থেকে ফিরে ‘জুয়েলারি হাউসে’ যেতে আর ইচ্ছে করল না। বোনের বাসায় চলে এলাম আমি। শরীর ভালো নয় বলে রাতেও সেখানে থেকে গেলাম।

পরদিন সকালে তিনজন পুলিশ এলো বোনের বাসায়। দুলাভাই রীতিমতো অবাক হলেন। বললেন, কী ব্যাপার! আমার বাসায় পুলিশ কেন?

পুলিশ কেন, তা আপনি ভালোই জানেন।

আমি কী করে জানব?

একটা চরম অপরাধীকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন, আর আপনি কিছুই জানেন না?

কে চরম অপরাধী?

এই যে আলম মেহেদী! নাম বদল করে মেহেদী আলম হয়েছে। নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সমিতির টাকা আত্মসাৎ করেছে। কাল থেকে সে তার বাসস্থানে যায়নি। পালিয়ে আছে। আমাদের বস আল্লাহ বখশ সাহেব হদিস না জানালে আমরা তাকে খুঁজেই পেতাম না।

আপনাদের কাছে ওয়ারেন্ট আছে? আমার বোন জানতে চাইলেন।

সবই আছে। থানায় গেলেই বুঝতে পারবেন।

আমি বলতে চেষ্টা কলাম, দেখুন! আমার বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগ ভুয়া। গতকাল আমি ‘জুয়েলারি হাউসে’র গাজী জামাল সাহেবের মামলায় তার পক্ষে সাক্ষ্য দিইনি বলে আমার বিরুদ্ধে আল্লাহ বখশ সাহেবের প্ররোচনায় এই মামলা দেওয়া হয়েছে।

এই চোপ! আমার বসের বিরুদ্ধে কথা! সাতদিনের রিমান্ডে নিলেই সব তেজ বেরিয়ে যাবে।

বিশ্বাস করুন, আমি যা বলেছি সব সত্য।

আর আমরা বুঝি সব মিথ্যাবাদী? রিমান্ডে নিয়ে পিটানি দিলেই বোঝা যাবে আর কোথায় কোথায় এমন জোচ্চুরি করেছিস!

না, না। আমার ভাইটাকে রিমান্ডে নেবেন না। বড় আপা কেঁদে ফেললেন।

দুলাভাই পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা পুলিশের দলনেতার হাতে দিলেন।

দলনেতা পকেটে টাকাগুলো চালান করতে করতে বললেন, আমাদের বসের কেস! দেখা যাক কী করতে পারি?

আমাকে প্রথমে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। দুলাভাইও সঙ্গে এলেন। থানার ওসির সঙ্গে কথা বললেন। একটা টাকার বান্ডিল তার হাতে তুলে দিলেন তিনি। অফিসার সেটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, টাকা নিয়ে এসেছেন, ভালো কথা। দিয়ে যান। অভিযোগ খুবই গুরুতর। আফটার অল আমাদের বসের কেস।

আপনি একটু দেখবেন স্যার।

নিশ্চয় দেখব। থানায় তাকে কোনো মারধর করা হবে না। এটুকু কনসিডার আমি করতে পারি। তাছাড়া, এবারই তো প্রথম।

থানাহাজত থেকে বিকালে আমাকে আদালতে চালান করা হলো। গতকালও এখানকার আদালতে এসেছিলাম আমি। কিন্তু সবকিছুর কত পার্থক্য। গতকাল আমার মধ্যে যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস ছিল, তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই এখন। থাকবে কী করে? মামলাটি বিচারের অপেক্ষায় থাকলেও সবার চোখে এখন আমি অপরাধী। বিচারক আমাকে জামিন দেবেন কিনা কে জানে! দুলাভাই অবশ্য জামিনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছেন।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হলো, আমি যেন একটা নাটকের দৃশ্যে অভিনয় করছি। আমার বিরুদ্ধে আদালতে যা কিছু বলা হলো, তার কিছুই আমার কানে ঢুকল না।

অকস্মাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বিচারক আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, আমার কিছু বলার আছে কি না!

আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। কাতরকণ্ঠে বিচারকের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার বিরুদ্ধে এই মামলা নিতান্ত বানোয়াট। আমি শুধু একটা চাকরি চেয়েছিলাম।