আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

জর্জ প্লিম্পটন

ভূমিকা ও অনুবাদ : ফখরুজ্জামান চৌধুরী

বিশ শতকের মার্কিন সাহিত্যে অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য কিন্তু ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান আত্মহননের মাধ্যমে। মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে ট্রিগার টিপে রোগক্লিষ্ট জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে তিনি কেন তাঁর জন্মস্থান ইলিনয়ের ওক পার্ক কিংবা পরবর্তী জীবনে বসবাসের জন্য নির্বাচিত মায়ামির কি-ওয়েস্ট, প্রিয় দেশ কিউবার পরিবর্তে জেম স্টেট হিসেবে খ্যাত আইডাহোকে বেছে নিলেন, তা এক রহস্য বটে। তাঁর এমন রহস্যময় মৃত্যুর কারণ হতে পারে দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক বৈকল্য, যার ফলে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্য তিনি ১৯৫৪ সালে সশরীরে সুইডেনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এজন্য তাঁর মনে অনেক খেদ ছিল।

হেমিংওয়ের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়েছে ১৯৯১ সালে। এরপর প্রায় দেড় যুগ কেটে গেছে। এখনো হেমিংয়ের প্রভাব সাহিত্যে দৃশ্যমান।

জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে হেমিংওয়েকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে তাঁর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেন জর্জ প্লিম্পটন (জন্ম ১৮ মার্চ ১৯২৭ – মৃত্যু ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৩)।

লেখক, সাংবাদিক, শৌখিন ক্রীড়াবিদ ও অভিনেতা জর্জ প্লিম্পটন লেখক হিসেবে তেমন কৃতিত্বের অধিকারী না হলেও মার্কিন সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর একটি বিশিষ্ট আসন আছে। বিখ্যাত সাহিত্য-সাময়িকী ত্রৈমাসিক প্যারিস রিভিউয়ের (প্রতিষ্ঠা ১৯৫৩) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর সঙ্গে এই মহতী প্রয়াসে যুক্ত ছিলেন হ্যারল্ড হোমস ও পিটার ম্যাথিসেন, কিন্তু প্লিম্পটন ছিলেন সাময়িকীটির প্রাণপুরুষ।

প্যারিস রিভিউয়েতে বিখ্যাত লেখকদের অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকার ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-সংরক্ষণের প্রয়াস হিসেবে এইসব সাক্ষাৎকার আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। হেমিংওয়ের সাক্ষাৎকারটি অত্যন্ত আন্তরিক ও খোলামেলা। এতই খোলামেলা যে, মাঝে মাঝে মনে হতে পারে এটি অত্যন্ত আটপৌরে, বিদ্বিষ্ট চিত্তপ্রসূত কোনো সাক্ষাৎকার, ব্যক্তিগত সখ্যের কারণে জজ প্লিম্পটনকে এড়াতে না পেরে হেমিংওয়ে যেন বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছেন সাক্ষাৎকার প্রদানে।

সাক্ষাৎকারটি সাহিত্যের কলকব্জা সম্পর্কে বেশকিছু ধারণা দেবে, বলা বাহুল্য। – অনুবাদক

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই ইলিনয়ের ওক পার্কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখকজীবনের শুরু আঠারো বছর বয়সে কানসাস সিটি স্টার পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। ১৯২১ সালে তিনি টরন্টো স্টার উইকলির ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সেই বছরের ডিসেম্বরে তিনি ইউরোপে পাড়ি দেন এবং গ্রিক-তুরস্ক যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে লুজান শান্তি বৈঠক সম্পর্কে রিপোর্ট প্রেরণ করেন। এই সময়কালে তাঁর লেখা সমুদয় কবিতা ও গল্পসমেত তাঁর একটি স্যুটকেস ট্রেন ভ্রমণকালে হারিয়ে যায়। একমাত্র বেঁচে যায় ‘মাই ওল্ডম্যান’ গল্পটি। আবার সবকিছু তাঁকে নতুন করে শুরু করতে হয়।

১৯২৩ সালে হেমিংওয়ের প্রথম বই থ্রি স্টোরিজ অ্যান্ড টেন পোয়েমস প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত পুস্তকের সংখ্যা ছিল তিনশো। পরবর্তী বই গল্প-সংকলন ইন আওয়ার টাইম প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। প্রহসনগ্রন্থ টরেন্টস অফ স্প্রিং প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। সেই বছরের শরৎকালে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস দি সান অলসো রাইজেস। আর একটি গল্প-সংকলন মেন উইদাউট উইমেন প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালের অক্টোবরে। এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘দি কিলারস’ এবং ‘দি আনডিফিটেড’ নামক দুটি গল্প, যা আধুনিক ছোটগল্পের উদাহরণ হিসেবে সর্বস্বীকৃত।

১৯২৯ সালে এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের সময়ের একজন প্রথম কাতারের লেখক হিসেবে পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি। হেমিংওয়ের ছোটগল্পের সংকলন দি ফাস্ট ফরটিনাইন প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে।

১৯৪০ সালে তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধভিত্তিক দীর্ঘ উপন্যাস ফর হুম দি বেল টোল্স সমাপ্ত করেন। দশ বছর পর প্রকাশিত হয় অ্যাক্রস দি রিভার অ্যান্ড ইনটু দি ট্রিজ। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দি সি। ১৯৫৪ সালে ষষ্ঠ মার্কিন লেখক হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পুরস্কার প্রদানকালে সম্মাননাপত্রে বলা হয় : ‘তার শক্তিশালী এবং শৈলীসৃষ্টিকারী শিল্পকর্মের জন্য…’

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বহু বছর কিউবায় বাস করেন। তাঁর শেষদিনগুলো কাটে আইডাহোর কেচামে, যেখানে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৬১ সালের ২ জুলাই।

জর্জ প্লিম্পটন : আপনি কি ঘোড়দৌড়ে যান?

হেমিংওয়ে : হ্যাঁ, মাঝে মাঝে।

জর্জ প্লিম্পটন : তাহলে আপনাকে ‘রেসিং ফর্ম’ পড়তে হবে।

ওখানেই আছে সত্যিকারের উপন্যাসের শিল্পরূপ।

মাদ্রিদ কাফেতে কথোপকথন, মে ১৯৫৪।

হাভানার শহর সান ফ্রান্সিসকো দ্য পৌলান বাসভবনের শোবারঘরে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লেখালেখি করেন। যদিও বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় চৌকোনো এক অলিন্দে একটি কামরা তাঁর লেখালেখির জন্য নির্ধারণ করা আছে, তিনি শোবারঘরেই লেখালেখি করতে পছন্দ করেন। অবশ্য মাঝে মাঝে তিনি তাঁর সৃষ্ট ‘চরিত্র’ দ্বারা ধাবিত হয়ে অলিন্দের কামরাটিতে উঠে যান।

শোবারঘরটি নিচতলায় এবং বাড়ির প্রধান কামরার সঙ্গে সংযুক্ত। দুটি কামরার মাঝখানের দরজাটি দি ওয়ার্ল্ড’স এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনস্ নামের একটি বিশাল বই দ্বারা ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। শোবার কামরাটি বড় এবং সূর্যালোকিত। পূর্ব ও দক্ষিণমুখী জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে আছড়ে পড়ে সাদা দেয়াল আর হলদে আভার টাইল-আচ্ছাদিত মেঝেতে।

কামরাটি বুক সমান উঁচু এক জোড়া বুক কেস দ্বারা দুভাগে বিভক্ত। এক অংশে বিশালাকার একটি ডাবল খাট, যার নিচে সুন্দরভাবে বড় আকারের চটি জুতো, স্যান্ডেল সাজানো। শয্যাপাশের দুটি টেবিল বইপত্রে ঠাসা। কামরার অন্য অংশে একটি বিরাটাকার ফ্ল্যাট-টপ ডেস্ক, দুপাশে দুটি চেয়ার। টেবিলের ওপর কাগজপত্র ও স্মারকচিহ্ন রাখা। কামরার শেষ প্রান্তে দেয়ালে একটি চিতাবাঘের চামড়া ঝুলিয়ে রাখা আছে। অন্য দেয়ালগুলোতে সাদা রঙের বুক কেস। বুক কেস থেকে বই মেঝের ওপরেও উপচে পড়ছে। বইয়ের পাশে রয়েছে পুরনো খবরের কাগজ, ষাঁড়ের লড়াই-সংক্রান্ত সাময়িকী আর রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ চিঠি।

এমনি একটি বুক কেস, যা পূর্বদিকের জানালার কাছে, বিছানা থেকে তিন ফুট দূরে, সেটাকেই হেমিংওয়ে লেখার টেবিল হিসেবে ব্যবহার করেন। পায়ের কাছে এক বর্গফুট পরিমাণ জায়গা বইপত্র আর খবরের কাগজের বান্ডিলে ঠাসা। আরো আছে পান্ডুলিপি আর প্রচারপত্র। একটি টাইপরাইটার রাখার মতো খালি জায়গা আছে টেবিলে। পাশে পাঁচ-ছটা পেনসিল আর পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহৃত এক টুকরো তামার পাত। পূর্বের জানালা দিয়ে আসা বাতাস যেন কাগজ উড়িয়ে না নেয় তার জন্য এই তামার পাত ব্যবহার করা হয়।

শুরু থেকেই তাঁর একটা নিজস্ব কার্যপ্রণালি রয়েছে। যখন লেখেন, তখন হেমিংওয়ে দাঁড়িয়ে যান। তিনি বিশালাকার চটি পায়ে দাঁড়ান আর তাঁর টাইপরাইটারটি থাকে বুকসমান উচ্চতায়।

হেমিংওয়ে যখন কোনো কাজে হাত দেন, তখন তিনি পেনসিল দিয়ে পেঁয়াজ রঙের কাগজে অাঁকাজোঁকা করেন। একগুচ্ছ কাগজ তিনি টাইপরাইটারের বাঁদিকে রাখেন। একটা একটা করে তিনি কাগজ বের করে লেখেন। পড়ার টেবিলের ওপর তিনি কাগজগুলো রাখেন আড়াআড়িভাবে, বাঁহাতের ওপর ভর দিয়ে কাগজগুলো সাজান, আর হস্তাক্ষরে কাগজগুলো পুরো করেন, যা প্রতিনিয়ত বালসুলভ হচ্ছে। অক্ষরগুলো বড় হচ্ছে, যতি-প্রকরণ অনিয়মিত এবং খুব কমই বড় হাতের অক্ষর ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃষ্ঠা লেখা পূর্ণ হলে তিনি তা উলটে ক্লিপ দিয়ে আটকে টাইপরাইটারের ডানপাশে রাখেন। লেখা যখন দ্রুত এগোতে থাকে অথবা যখন লেখা সহজ প্রক্রিয়ায়, যেমন সংলাপে উপনীত হয়, তখন হেমিংওয়ে টাইপরাইটারের আশ্রয় নেন। তিনি দৈনন্দিন কাজের অগ্রগতির হিসেব রাখেন দেয়ালে ঝোলানো হরিণের মাথার নিচে টাঙানো একটি বোর্ডে। দৈনিক কত শব্দ লিখলেন তার হিসেব থাকে সেখানে। এই সংখ্যা হতে পারে ৪৫০, ৫৭৫, ৪৬২, ১২৫০ কিংবা ৫১২। উপসাগরীয় স্রোতে যদি পরের দিন মাছ ধরতে যান, তাহলে হেমিংওয়ে অতিরিক্ত কাজ করে নেন। নিয়মিত অভ্যাসে অভ্যস্ত হেমিংওয়ে কামরার অন্য অংশে যথোপযুক্ত টেবিলটি ব্যবহার করেন না, যদিও টেবিলটি লেখার জন্য যথেষ্ট বড়। তবে এর ওপর রাখা আছে বিবিধ বস্ত্তসামগ্রী – চিঠির স্তূপ, খেলনা সিংহ, এক ঝুড়ি মাংসাশী প্রাণীর দাঁত, শটগানের গুলির খোল, শু-হর্ন, কাঠে খোদাই করা সিংহ, জলহস্তী, দুটি জেব্রা, আফ্রিকার শূকর। এগুলো এক সারিতে ঝোলানো আছে সুবিন্যস্তভাবে। অবশ্য টেবিলের পাশে বইয়ের সারি অবিন্যস্তভাবে স্তূপ করে রাখা আছে। বইয়ের নামগুলো তাদের বিষয়বৈচিত্র্যের পরিচায়ক। শেলফের বিপরীত দিকে দাঁড়ানো অবস্থায় হেমিংওয়ের হাঁটুর উচ্চতায় রয়েছে ভার্জিনিয়া উলফের দি কমন রিডার, বেন আমেস উইলিয়ামের হাউস ডিভাইডেড, দি পার্টিজান রিডার, চার্লস এ বেয়ার্ডের দি রিপাবলিক, টার্লের নেপোলিয়ন’স ইনভেশন অফ রাশিয়া, পেগি উডের হাউ ইয়ং ইউ লুক, এলডেন ব্রুকসের উইল শেক্সপিয়র অ্যান্ড দি ডায়ার’স হ্যান্ড, বল্ডইনের আফ্রিকান হান্টিং, টি এস এলিয়টের কালেকটেড পোয়েম্স এবং টু বুকস অন জেনারেল কাস্টার্স ফল অ্যাট দি ব্যাটল অফ দি লিটল বিগ হর্ন।

প্রথম দৃষ্টিতে কামরাটিকে অগোছালো মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তার মালিককে মূলত পরিচ্ছন্ন মনেরই মনে হবে। তবে তিনি কোনো জিনিস ফেলে দিতে পারেন না, বিশেষ করে সেই বস্ত্তটির সঙ্গে কোনো আবেগ জড়িত থাকলে তো নয়ই। একটি বুকশেলফের ওপর অনেকগুলো স্মারকচিহ্ন : কাঠের তৈরি জিরাফ, ঢালাই করে লোহার তৈরি কচ্ছপ, ইঞ্জিনের ছোটখাটো মডেল, দুটি জিপ, ভেনিসের গন্ডোলা, পিঠে চাবি লাগানো খেলনা ভল্লুক, করতাল হাতে বাঁদর, খুদেকায় গিটার, টিনের তৈরি ইউএস নেভি বাইপ্লেন (যার একটি চাকা খোয়া গেছে), প্লেনটিকে খড়ের ওপর কোনোমতে ঠ্যাকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর এসব সঞ্চয় অনেকটা জুতোর বাক্সে ছোট বালকের খেলনাসামগ্রীর মতো মনে হয়। মনে হয় জিনিসগুলোর আলাদা মূল্য আছে। যেমন আছে তিনটি মহিষের শিঙের। শয়নকক্ষে হেমিংওয়ে শিংগুলো রেখেছেন তাদের মূল্যের জন্য নয়, বরং সংগ্রহ করার সময়ে দুঃসময় শেষ পর্যন্ত সুসময়ে পরিণত হওয়ার কারণে।

হেমিংওয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হতে পারেন, তবে তা নিয়ে তিনি আলোচনা করতে নারাজ। লেখার ব্যাপারেও তাঁর একই ধারণা। এই সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, লেখার কোনো একটি অংশ খুব ভালো হলে তার কথা বারবার বলার কোনো যুক্তি নেই। কোনো অংশ দুর্বল হতেও পারে। এসব নিয়ে আলোচনা করলে লেখার কাঠামো ভেঙে পড়বে না।

চমৎকার আমুদে মানুষ হেমিংওয়ের বিবিধ বিষয়ে জ্ঞান অপরিসীম। তবে তিনি লেখাপড়ার ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলতে অনাগ্রহী। এর কারণ এই নয় যে, এ বিষয়ে তাঁর কোনোকিছু বলার নেই। বরং তিনি চান এ-বিষয়ে সবকিছু অনুক্ত থাকুক। লেখার ব্যাপারে তাঁকে কোনো প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রায় নির্বাক হয়ে যান। এই সাক্ষাৎকারে অনেক প্রশ্নের জবাব তিনি তাঁর পড়ার টেবিলের ওপর দিতে পছন্দ করেন। তাঁর নিরুচ্চার কণ্ঠস্বর বোঝাতে চায় যে, লেখার কাজ একান্তই ব্যক্তিগত, চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহণ না করা পর্যন্ত যা নির্জনে সাক্ষীবিহীন পরিবেশে সাধিত হয়।

শিল্পের প্রতি তাঁর নিবেদিতচিত্ততার সঙ্গে যেন তাঁর খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের সংঘাত আছে। বাস্তবতা হলো এই যে, হেমিংওয়ে জীবনকে যেমন উপভোগ করেন, তেমনি অন্য কাজও করেন একাগ্রচিত্তে। এ ব্যাপারে তাঁর নেই কোনো রকমের সমঝোতা।

হলদে রঙের বেডরুমে তিনি সবচেয়ে বেশি নিবেদিতচিত্তে থাকেন। প্রতিদিন সকালে তিনি ধ্যানমগ্নভাবে দাঁড়ান রিডিং বোর্ডের সামনে। কাজ যখন সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলে, আনন্দিত বালকের মতো জোরে জোরে শ্বাস নেন। আর এর উলটোটা হলে তিনি স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধে ফেলেন। এভাবে দুপুর পর্যন্ত কাটিয়ে বেড়ানোর ছড়ি নিয়ে সুইমিংপুলের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হন। রোজ তিনি আধমাইল সাঁতার কাটেন।

জর্জ প্লিম্পটন : লেখার মূল সময় হিসেবে এই সময়গুলো কি যথার্থ?

হেমিংওয়ে : খুবই।

প্লিম্পটন : এই প্রক্রিয়া সম্বন্ধে কিছু বলবেন? কখন লেখালেখি করেন? লেখার ব্যাপারে কঠোর কোনো নিয়মরীতি পালন করেন কি?

হেমিংওয়ে : যখন কোনো উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প লিখি, সকালের প্রথম আলো ফোটার পরপরই লিখতে বসে যাই। তখন আপনাকে বিরক্ত করার জন্য কেউ থাকে না। আপনি হিমশীতল অবস্থায় লিখতে শুরু করেন, আর লিখতে লিখতে শরীর তেতে ওঠে। যা লিখেছেন তা আপনি পড়ে দেখেন, আপনি পরবর্তীকালে কী লিখছেন তা ভেবে দেখার জন্য লেখার কাজে বিরতি দিতে পারেন। লেখার নির্যাস যতক্ষণ বজায় থাকে, ততক্ষণ আপনি লিখে যেতে পারেন; আগামীকাল কোথা থেকে শুরু করবেন, তা ঠিক করে লেখার কাজ বন্ধ করতে পারেন। ধরুন, সকাল ছটায় লিখতে বসলেন। দুপুর কি তার পূর্ব পর্যন্ত লিখে যেতে পারেন। লেখা শেষ যখন করেন, তখন আপনি শূন্যতাবোধ করতে পারেন। আবার নাও পারেন। কারণ আপনি ভালোবাসা দিয়েছেন এমন একজনকে, যাকে আপনি ভালোবাসেন। কোনোকিছুই আপনাকে আহত করতে পারে না। কিছুই ঘটতে পারে না, মানে আগামীকাল আবার আপনি লেখার কাজ শুরু করার আগে কিছুই ঘটবে না। আগামীকালের জন্য প্রতীক্ষাটা খুব কষ্টকর।

প্লিম্পটন : টাইপরাইটার ছেড়ে আসার পর কী লিখছিলেন তা কি মন থেকে ঝেড়েমুছে ফেলতে পারেন?

হেমিংওয়ে : অবশ্যই। তবে তা করার জন্য এক ধরনের শৃঙ্খলা অর্জন করতে হয়।

প্লিম্পটন : আগের দিন যা লিখেছেন তা কি পরের দিন পড়ে নতুন করে আবার লেখেন? তবে কি লেখাটা পুরোপুরি শেষ করে এ-কাজটা করেন?

হেমিংওয়ে : প্রতিদিন যা লিখি পরের দিন তা আবার নতুন করে লিখি। লেখা শেষ হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই আপনি চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। আপনি সংশোধনের সুযোগ পান, অন্য কেউ টাইপের কাজ করলে আপনি নিজে সুন্দরভাবে আবার তা টাইপ করে নিতে পারেন। শেষ সুযোগটা আসে প্রুফ সংশোধনের সময়। এই বিভিন্ন ধরনের সুযোগের কারণে আপনি কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন।

প্লিম্পটন : কী পরিমাণ লেখালেখি করেন?

হেমিংওয়ে : সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ফেয়ারওয়েল টু আর্মসের শেষ পৃষ্ঠাটা আমি ঊনচল্লিশবার পুনর্লিখন করে তবে সন্তুষ্ট হয়েছিলাম।

প্লিম্পটন : সেখানে কি কোনো কৌশলগত সমস্যা ছিল? কী কারণে আপনি আটকে গিয়েছিলেন?

হেমিংওয়ে : জুতসই শব্দ খুঁজে পাওয়ার জন্য।

প্লিম্পটন : পড়ে পড়ে কি লেখার নির্যাস খুঁজে পান?

হেমিংওয়ে : বারবার পড়লে আপনি আসল জায়গাটায় পৌঁছে যেতে পারেন। যথাযথ জায়গায় আপনি নির্যাসটা পাবেন।

প্লিম্পটন : এমন কোনো সময় আছে যখন কোনো ধরনের অনুপ্রেরণা থাকে না?

হেমিংওয়ে : স্বাভাবিকভাবেই। তবে যদি কোথাও বিরতি দেওয়ার সময়ে বুঝতে পারেন সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তাহলে এগিয়ে যেতে পারেন। শুরু যদি করতে পারেন, তাহলে ঠিকই আছে। নির্যাসটা ধরা দেবে।

প্লিম্পটন : থর্নটন ওয়াইল্ডার দৈনন্দিন লেখার ব্যাপারে বস্ত্তগত প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন। আপনি তাঁকে নাকি বলেছিলেন, প্রতিদিন আপনি বিশটি পেনসিল কেটে নেন।

হেমিংওয়ে : একসময়ে বিশটি পেনসিলের মালিক ছিলাম এমন তো মনে হয় না। দিনে দুটি সাত নম্বর পেনসিলই যথেষ্ট বলে মনে করি।

প্লিম্পটন : কোন কোন জায়গায় লেখালেখি করতে আনন্দবোধ করছেন? আপনার বইয়ের সংখ্যা বিবেচনা করলে এমব্রোস মুনডোস হোটেলকে তেমন একটি জায়গা বলে মনে হয়। অথবা পরিবেশের কি লেখার ওপর কোনো প্রভাব আছে?

হেমিংওয়ে : হাভানার এমব্রোস মুনডোস চমৎকার একটি জায়গা। ফিনকাও একটি চমৎকার জায়গা কিংবা চমৎকার জায়গা ছিল। সবখানেই আমি ভালোভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত। টেলিফোন আর অতিথিরা হলো কাজের আসল বাধা।

প্লিম্পটন : আবেগের স্থিতি কি ভালো লেখার জন্য জরুরি? একবার আপনি বলেছিলেন, যখন আমি প্রেমে পড়ি, তখনই শুধু লিখতে পারি। এ-বিষয়ে কি আরেকটু আলোকপাত করতে পারেন?

হেমিংওয়ে : কী এক প্রশ্ন! তবে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য পূর্ণ নম্বর পাবেন। আপনি যখন একা থাকেন, তখন যে-কোনো সময়েই লিখতে পারেন। অথবা যদি নির্মম হন তাহলেও লিখতে পারেন। তবে লেখার প্রকৃষ্ট সময় হলো প্রেমে পড়ার সময়ে। সবসময়েই যদি আপনার একরকম মনে হয় তাহলে আর এ-ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না।

প্লিম্পটন : অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যাপারে কী বলবেন? ভালো লেখার পথে তা কি কোনোরকম অন্তরায়?

হেমিংওয়ে : যদি তা আগেভাগেই এসে যায় আর আপনি তাকে ভালোবেসে ফেলেন, তাহলে প্রলোভন সামলাতে কঠিন চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। একবার যদি লেখা আপনার সেরা পাপ আর শ্রেষ্ঠ আনন্দ হয়ে যায়, তাহলে একমাত্র মৃত্যুই তাতে যতিরেখা টানতে পারে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিরাট সাহায্য বটে, কারণ তাতে আপনার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটে। দুশ্চিন্তা লেখার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। দুর্বল শরীরও তুলনামূলকভাবে খারাপ হতে পারে। কারণ এতে অবচেতন মনে আপনার দুশ্চিন্তা হতে পারে এবং আপনার সঞ্চিত জীবনশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে।

প্লিম্পটন : এমন কোনো মুহূর্তের কথা মনে করতে পারেন, যখন লেখক হতে মনস্থ করেন?

হেমিংওয়ে : না, সবসময়েই আমি লেখকই হতে চেয়েছি।

প্লিম্পটন : আপনার সম্পর্কিত বইয়ে ফিলিপ ইয়ং ইঙ্গিত করেন যে, ১৯১৮ সালে গোলার আঘাতে আহত হওয়ার ঘটনা লেখক হিসেবে আপনাকে প্রভাবিত করে। মনে আছে, মাদ্রিদে এ-বিষয়ে আপনি সংক্ষেপে কিছু বলেছিলেন। বলেছিলেন, লেখকের সরঞ্জাম হলো তার অর্জিত চরিত্র নয়, বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত চরিত্র।

হেমিংওয়ে : দৃশ্যত, সেই সময়ে মাদ্রিদে আমার মনমানসিকতা খুব সুস্থির ছিল বলা যায় না। মি. ইয়ংয়ের গ্রন্থ এবং তাঁর আঘাতজনিত থিয়োরি সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু বলেছিলাম। হয়তো দুটি আঘাত এবং মাথার খুলিতে ফ্র্যাকচারের জন্য আমার বক্তব্য দায়িত্বহীন ছিল। মনে পড়ে, আমি আপনাকে বলেছিলাম যে, আমার বিশ্বাস, কল্পনাশক্তি বংশপরম্পরায় গোষ্ঠীগতভাবে প্রাপ্ত। আঘাত-পরবর্তী আনন্দময় মুহূর্তে কথাগুলো ভালোই শোনায়। কিন্তু আমি মনে করি, কমবেশি তা ঠিক। তাহলে পরবর্তী আঘাত-মুক্তি পর্যন্ত বিষয়টা এখানে ক্ষান্ত রাখা যেতে পারে। আপনি এতে রাজি তো? তবে আমার যেসব আত্মীয়স্বজনকে আমি অভিযুক্ত করেছি তাদের নাম উল্লেখ না করায় আপনাকে ধন্যবাদ। কথা বলার মজাই হলো অনুসন্ধান করা, তবে যা দায়িত্বজ্ঞানহীন তা লেখায় উল্লেখ না করাই বিধেয়। একবার লেখা হয়ে গেলে তা অস্বীকার করার জো নেই। বিশ্বাস করেন কি করেন না তা পরীক্ষা করার জন্যও আপনি কিছু বলতে পারেন। আপনি যে প্রশ্ন তুলেছেন, আঘাতের প্রভাবে তাতে হেরফের ঘটে। সামান্য আঘাতে যাতে হাড়গোড় ভাঙে না, তা খুব সামান্য। কখনো-সখনো তা আস্থা এনে দেয়। যেসব আঘাতে হাড় এবং স্নায়ুর ব্যাপক ক্ষতি হয় তা যেমন লেখকের জন্য শুভ নয়, তেমনি শুভ নয় অন্য কারো জন্য।

প্লিম্পটন : হবু লেখকের জন্য বুদ্ধিভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ আপনি জরুরি মনে করেন?

হেমিংওয়ে : তাহলে বলা যেতে পারে যেহেতু ভালো লেখা অসম্ভবরকম কষ্টকর, গলায় রশি লাগিয়ে যেন ঝুলে পড়তে পারে, নির্মমভাবে তাকে টুকরো করে ফেলা যেতে পারে। বাকি জীবন কী করে ভালো করে লেখা সম্ভব, সে-চেষ্টা তাকেই করতে হবে। নিদেনপক্ষে গলায় রশি দেওয়ার গল্পটা দিয়ে তো সে শুরু করতে পারে।

প্লিম্পটন : যেসব ব্যক্তি অ্যাকাডেমিক জীবিকা বেছে নিয়েছেন তাঁদের সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী? আপনি কি মনে করেন যেসব লেখক শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত তাঁরা তাঁদের সাহিত্যজীবন নিয়ে আপস করেছেন?

হেমিংওয়ে : সেটা নির্ভর করছে, আপস বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন। মহিলার আপস? অথবা রাজনীতিকের আপস? অথবা আপনার মুদি কিংবা দর্জির সঙ্গে এই মর্মে আপস করা যে, আপনি তাকে বেশি দেবেন তবে টাকাটা একটু দেরিতে দেবেন? একজন লেখক যিনি লেখা এবং শিক্ষকতা দুটোই করতে পারেন, দুটোই করতে সমর্থ হবেন। অনেক যথার্থ লেখক তা প্রমাণও করেছেন। আমি অবশ্য পারিনি। যাঁরা পারেন, তাঁদের প্রশংসা করি। আমি অবশ্য মনে করি অ্যাকাডেমিক জীবন বাইরের অভিজ্ঞতা দ্বারা বৈশ্বিক জ্ঞানের পরিধি সীমিত করে দিতে পারে। জ্ঞান লেখককে আরো দায়িত্ববান করে এবং লেখার কাজকে আরো কঠিন করে দেয়। স্থায়ী মূল্যের কোনো কিছু লেখার কাজ হলো পূর্ণকালীন কাজ, যদিও দিনে সামান্য কয়েক ঘণ্টা আসল লেখার কাজে খরচ হয়। একজন লেখককে কুয়োর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অনেক রকম কুয়ো আছে, যেমন আছেন লেখক। জরুরি বিষয় হলো কুয়ো থেকে ভালো পানি সংগ্রহ করা, কুয়োকে সম্পূর্ণ শুকিয়ে ফেলে আবার ভর্তি করার চেয়ে অনেক ভালো। প্রশ্নটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি দেখছি। তবে প্রশ্নটা খুব চমকপ্রদ মনে হয়নি।

প্লিম্পটন : তরুণ লেখকদের জন্য সংবাদপত্রে কাজ কি আপনি অনুমোদন করেন? ‘কানসাস সিটি স্টারে’ প্রশিক্ষণ কতটা সহায়ক হয়েছে?

হেমিংওয়ে : স্টারে আপনি বর্ণনামূলক বাক্য লিখতে বাধ্য হয়েছেন। এটা যে-কোনো ব্যক্তির জন্য উপযোগী। সংবাদপত্রে কাজ করলে তরুণ লেখকের কোনো ক্ষতি হবে না, যদি তিনি সময়মতো তা থেকে বের হয়ে যেতে পারেন। এটা একটা ধূলিধূসরিত গৎবাঁধা কথা এবং এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। পুরনো ক্লান্তিকর প্রশ্ন করলে পুরনো ক্লান্তিকর জবাবই পাবেন।

প্লিম্পটন : একবার ট্রান্স-আটলান্টিক রিভিউতে আপনি লিখেছিলেন, সাংবাদিকতা করার একমাত্র কারণ হলো ভালো টাকা পাওয়া। আপনি বলেছিলেন, ‘ভালো জিনিস যখন লিখে নিঃশেষ করেন, তখন তো ভালো টাকা আপনার পাওয়া দরকার।’ আপনি কি লেখাকে এক ধরনের আত্মবিনাশ বলে মনে করেন?

হেমিংওয়ে : কখনো এমন কিছু লিখেছি বলে তো মনে করতে পারছি না। কথাটা আমার কাছে হাস্যকর ও ভয়ংকর মনে হচ্ছে। দাঁত দিয়ে নখ কাটা এড়াতে হলে এমন কথা বলা যায়। অবশ্যই লেখাকে আমি কখনোই এক ধরনের আত্মবিনাশী কাজ বলে মনে করি না। যদিও একটা পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর সাংবাদিকতা একজন সৃজনশীল লেখকের জন্য দৈনন্দিন আত্মবিনাশী হতে পারে।

প্লিম্পটন : আপনি কি মনে করেন অন্য লেখকদের সাহচর্য থেকে বুদ্ধিভিত্তিক বলবৃদ্ধি একজন লেখকের জন্য মূল্যবান?

হেমিংওয়ে : অবশ্যই।

প্লিম্পটন : বিশের প্যারিসে অন্যান্য  লেখক-শিল্পীর সঙ্গে আপনি কি ‘গোষ্ঠীভাব’ অনুভব করেছেন?

হেমিংওয়ে : না। কোনো গোষ্ঠীভাব ছিল না। আমাদের ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বহু চিত্রশিল্পীকে আমি শ্রদ্ধা করতাম, এঁদের কেউ কেউ ছিলেন আমার সমবয়সী, কেউ কেউ বড় – গ্রিস, পিকাসো, ব্রাক, মনে, যিনি তখনো জীবিত ছিলেন এবং কয়েকজন লেখক জয়েস, এজরা, স্টেইন।

প্লিম্পটন : যখন লেখেন তখন যা পড়েন, তার দ্বারা কি প্রভাবিত হন?

হেমিংওয়ে : জয়েস ইউলিসিস লেখার পর তেমন হয়নি। তাঁর প্রভাব প্রত্যক্ষ ছিল না। কিন্তু তখনকার দিনে যখন আমরা জানতাম কিছু শব্দ আমাদের কাছে নিষিদ্ধ, একটি একক শব্দের জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। জয়েসের লেখার প্রভাব সব বদলে দিয়েছে এবং আমাদের পক্ষে আগল ভাঙা সম্ভব হয়েছে।

প্লিম্পটন : লেখকদের কাছ থেকে লেখা সম্বন্ধে কিছু শিখতে পেরেছেন? কালকেই আপনি বলছিলেন, উদাহরণস্বরূপ, জয়েস লেখালেখি নিয়ে কথাবার্তা সহ্য করতে পারতেন না।

হেমিংওয়ে : নিজের পেশার লোকদের মাঝে সাধারণভাবে আপনি অন্য লেখকদের বই নিয়ে কথা বলেন। লেখক যত ভালো, ততই তিনি নিজের লেখা সম্বন্ধে কম কথা বলবেন। জয়েস অনেক বড় লেখক ছিলেন, তিনি শুধু বলতেন ঝাঁকুনি দিতে কী করেন। অন্য যেসব লেখককে তিনি শ্রদ্ধা করতেন, তাঁদের জানার কথা ওঁদের বই পড়ে তিনি কী করেন।

প্লিম্পটন : বিগত বছরগুলোতে আপনি লেখকদের সাহচর্য এড়িয়ে চলেছেন। কেন?

হেমিংওয়ে : ওটা খুব জটিল ব্যাপার। লেখায় যত বেশি নিমগ্ন হবেন, ততই আপনি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবেন। আমাদের সেরা এবং বয়স্কতম লেখকরা মারা গেছেন।  অন্যরা সরে গেছেন। কালেভদ্রে তাঁদের সঙ্গে আপনার দেখা হয়। যদি আপনি লিখে যান, তাঁদের সঙ্গে আপনার সংযোগটি থেকে যাবে। মনে হবে যেন পুরনো দিনের মতো কাফেতে আছেন। আপনি কৌতুক বিনিময় করেন, কখনো কখনো অশ্লীল, দায়িত্বহীন পত্রাবলি। সরাসরি কথা বলার মতোই ব্যাপার তো! তবে আপনি নিঃসঙ্গ, কেননা, আপনাকে লিখতে হবে এবং লেখার জন্য নির্ধারিত সময় এমনিতেই কম। সেই স্বল্প সময় যদি অপচয় করেন, তাহলে আপনি এমন এক ধরনের পাপ করেন যার কোনো ক্ষমা নেই।

প্লিম্পটন : আপনার সমকালীন কয়েকজনের প্রভাব আপনার লেখার ওপর কেমন ছিল? গার্ট্রুড স্টেইনের কোনো প্রভাব ছিল? অথবা এজরা পাউন্ডের? অথবা ম্যাক্স পার্কিনসের?

হেমিংওয়ে : দুঃখিত, এ-জাতীয় ময়নাতদন্তে আমি খুব একটা পটু নই। এ-জাতীয় বিষয়াদি বিশ্লেষণ করার জন্য সাহিত্য কিংবা অসাহিত্যবিষয়ক করোনার রয়েছেন। মিজ স্টেইন আমার লেখার ওপর তাঁর লেখার প্রভাব সম্পর্কে বেশ লম্বা-চওড়া লেখালেখি করেছেন। এটা তাঁর জন্য জরুরি ছিল। কারণ তিনি দি সান অলসো রাইজেস নামক বই থেকে সংলাপ লেখা শেখেন। আমি তাঁকে খুব পছন্দ করতাম এবং তিনি যে সংলাপ লিখতে শেখেন তার জন্য আমি আনন্দিত হই। জীবিত কিংবা মৃত কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে শেখা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। তবে বুঝতে পারি এর ফলে গাট্রুর্ড প্রচন্ডভাবে নাড়া খাবেন। অন্যভাবে তিনি কিন্তু বেশ ভালোই লিখছিলেন। নিজের জানা বিষয়ে এজরা খুবই জ্ঞানবান ছিলেন।  এ-জাতীয় কথা কি আপনাকে ক্লান্ত করে না? পঁয়ত্রিশ বছরের নোংরা কাপড় পরিষ্কার করার সাহিত্য-সম্পর্কিত এসব আলোচনা আমার কাছে রুচিহীন মনে হয়। কেউ যদি পুরোপুরি সত্য কথা বলতেন, তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। তার একটা আলাদা মূল্য হতো। গাট্রুর্ডকে ধন্যবাদ জানাই কারণ তাঁর কাছ থেকে আমি শব্দের বিমূর্ত সম্পর্কের বিষয়ে অবহিত হই। বলুন, আমি তাঁর প্রতি কী পরিমাণ অনুরক্ত, বড় কবি এবং অনুগত ভক্ত হিসেবে এজরা পাউন্ডের প্রতি আমার বিশ্বস্ততা পুনরায় ব্যক্ত করুন এবং বলুন ম্যাক্স পার্কিনসের জন্য আমি এত কাতর ছিলাম যে, তাঁর মৃত্যুর কথা বিশ্বাসই করতে পারিনি। তিনি কখনো আমার কোনো লেখা অদল-বদল করতে বলেননি – শুধু সে সময়ে প্রকাশের অযোগ্য কিছু শব্দ বাদ দেওয়া ছাড়া। সেসব শব্দের জায়গা শূন্য রাখা হতো, যাঁরা শব্দগুলো সম্বন্ধে জানেন, তাঁরা বুঝতেন শূন্যস্থানে কী ছিল। আমার জন্য তিনি সম্পাদক ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিজ্ঞ বন্ধু এবং চমৎকার একজন সঙ্গী। তাঁর হ্যাট পরার এবং ঠোঁট নাড়ার বিচিত্র ঢং আমার খুব ভালো লাগত।

প্লিম্পটন : আপনার পূর্বসূরি কারা ছিলেন, যাঁদের কাছ থেকে আপনি বেশি শিখেছেন?

হেমিংওয়ে : মার্ক টোয়েন, ফ্লবেয়র, স্তাঁদাল, বাখ, তুর্গেনেভ, টলস্টয়, দস্টয়ভস্কি, শেখভ, অ্যান্ড্রু মার্ভেল, জন ডান, মপাসাঁ, কিপলিং, থোরো, ক্যাপ্টেন ম্যারিয়েট, শেক্সপিয়র, মোৎজার্ট, কুইভেডো, দান্তে, ভার্জিন, টিনটোরেটো, হেয়ারোনিমাস, বশ, ব্রুয়েগেল, পাতিনির, গয়া, গিয়োট্টো, সেজান, ভ্যানগঘ, গগাঁ, সান জুয়ান দ্য লা ক্রুজ, গংগোরা – সবারই কথা স্মরণ করতে একদিন লেগে যাবে। আর মনে হতে পারে যে, পান্ডিত্য আমার নেই তবে দাবিদার আমি এবং আমাকে প্রভাবিত করেছে এমন নামের বিশাল ফিরিস্তি দিচ্ছি। প্রশ্নটা পুরনো এবং ভোঁতা নয়। সুন্দর প্রশ্ন তবে এর জবাব দিতে বিবেকের পরীক্ষা নিতে হবে। আমি চিত্রশিল্পীর নাম করেছি। কারণ এক লেখকের কাছ থেকে যেমন, একজন চিত্রশিল্পীর কাছ থেকেও তেমনি শিখেছি। প্রশ্ন করতে পারেন, কেমন করে তা হলো। আরেকদিন এর ব্যাখ্যা দেবো। আমি মনে করি, সংগীতকার ও ঐকতান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

প্লিম্পটন : আপনি কখনো কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন?

হেমিংওয়ে : চেলো বাজাতাম। সংগীত শিক্ষার জন্য আমার মা আমাকে পুরো এক বছর স্কুল থেকে বাইরে রেখেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, সংগীত শেখা আমার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু আদপেই আমার কোনো প্রতিভা ছিল না। আমরা সম্মিলিতভাবে বাদ্যযন্ত্র বাজাতাম, কেউ একজন এসে বেহালা বাজাতেন, আমার বোন বাজাতেন ভায়োলা এবং মা পিয়ানো। আর পৃথিবীতে নিকৃষ্টতম চেলোবাদক ছিলাম আমি। অবশ্য সে-বছর আরো অনেক কাজ করেছি আমি।

প্লিম্পটন : আপনি কি আপনার তালিকাভুক্ত লেখকদের লেখা পুনরায় পড়েন? যেমন ধরুন, টোয়েন?

হেমিংওয়ে : টোয়েন দুই-তিন বছর পরে আবার পড়তে হয়। তাঁর লেখা আপনার খুব মনে থাকবে। শেক্সপিয়রের কোনো কোনো লেখা প্রতিবছর পড়ি। লিয়ার সবসময়। এটা পড়লে আপনি উৎফুল্ল হবেন।

প্লিম্পটন : তাহলে পড়াশোনা হলো নিত্যদিনের কাজ এবং আনন্দ।

হেমিংওয়ে : সবসময়ে আমি বই পড়ি। বই এমনভাবে পড়ি, যেন সরবরাহে ঘাটতি না পড়ে।

প্লিম্পটন : কখনো পান্ডুলিপি পড়েছেন?

হেমিংওয়ে : লেখককে যদি ব্যক্তিগতভাবে না জানেন, তাহলে আপনি ঝামেলায় পড়তে পারেন। বছর কয়েক আগে এক ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন। আমি নাকি তাঁর অপ্রকাশিত চিত্রনাট্য থেকে চুরি করে ফর হুম দি বেল টোলস লিখেছি। হলিউডের কোনো পার্টিতে তিনি চিত্রনাট্য পড়ে শুনিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, আমি সেখানে ছিলাম। নিদেনপক্ষে ‘আর্নি’ নামে একজন পার্টিতে ছিলেন। এক মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার জন্য তিনি ছিলেন যথেষ্ট। একই সঙ্গে তিনি নর্থ ওয়েস্ট মাউন্টেড পুলিশ এবং সিসকো কিডস নামক দুটি চলচ্চিত্রের প্রযোজকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অভিযোগ, তাঁর অপ্রকাশিত চিত্রনাট্য থেকে ছবি দুটির কাহিনি চুরি করা হয়েছে। কোর্টে আমরা গেলাম এবং মামলায় জিতলাম। লোকটা কপর্দকশূন্য হয়ে পড়লেন।

প্লিম্পটন : তালিকাভুক্ত একজন চিত্রশিল্পী হেয়ারোনিমাস বশ সম্বন্ধে আলোচনা করা যায়? তাঁর বিমূর্ত চিত্রকলা তো দুঃস্বপ্নস্বরূপ। আপনার লেখা তো তাঁর চিত্রকর্ম থেকে অনেক দূরে।

হেমিংওয়ে : আমারও দুঃস্বপ্ন আছে, অন্যের দুঃস্বপ্ন সম্পর্কে আপনি অবহিত থাকেন। তবে সেসব লেখার প্রয়োজন নেই। আপনার জানা আছে এমন কিছু লেখা থেকে আপনি বাদ দিতে পারেন। যখন একজন লেখক তাঁর অজানা কিছু লেখা থেকে বাদ দেন, তখন বাদ দেওয়া জিনিসগুলো লেখার মধ্যে খাদের মতো লাগে।

প্লিম্পটন : তার অর্থ এই যে, যাঁদের লেখা সম্বন্ধে আপনার ধারণা আছে, তাঁদের সম্বন্ধে ধারণা থেকে কিছুক্ষণ আগে কথিত আপনার ‘খাদ’ ভরাট করতে পারেন? অথবা তা কি লেখার           শৈলী-উন্নয়নে ছিল এক প্রবহমান সহায়তা?

হেমিংওয়ে : দেখতে, শুনতে, চিন্তা করতে, অনুভব করতে, না করতে এবং লিখতে একটা প্রক্রিয়া ছিল। খাদটা ছিল যেখানে আপনার ‘নির্যাস’ জমা হয়েছে। কেউ জানে না, এটা কিসের তৈরি? নিদেনপক্ষে আপনার। আপনি জানবেন, যদি আপনি এর জন্য অপেক্ষা করেন অথবা তার আগমনের অপেক্ষায় থাকেন।

প্লিম্পটন : আপনার উপন্যাসে প্রতীকীবাদের কথা কি আপনি স্বীকার করেন?

হেমিংওয়ে : সমালোচকরা যখন ক্রমাগত প্রতীক খুঁজে পেয়েছেন, ধারণা করি, প্রতীকের অস্তিত্ব আছে। কিছু যদি মনে না করেন, এ নিয়ে কথা বলতে, বা এ-সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হতে               আমার আপত্তি আছে। বই অথবা গল্প লেখা দুরূহ ব্যাপার, অবশ্য এ-সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য না হলে। লেখার ব্যাখ্যাদাতাকেও তা বঞ্চিত করে। পাঁচ-ছজন ভালো ব্যাখ্যাকারী যদি একসঙ্গে বলতে থাকেন, তাহলে আমি কেন তাঁদের কথার প্রতিবাদ করি? পড়ার আনন্দে পড়ুন, আমি যা লিখেছি। এর অতিরিক্ত কিছু যদি পান সেটা আপনার কৃতিত্ব।

প্লিম্পটন : এই ধারায় একটি প্রশ্নের ধারাবাহিকতায় বলছি : একজন উপদেষ্টা সম্পাদক বলেছেন, তিনি দি সান অলসো রাইজেস উপন্যাসে ষাঁড়-লড়িয়ে রিংয়ের চরিত্র আর উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, উপন্যাসের প্রথম বাক্যই আমাদের জানান দেয় যে, রবার্ট কন একজন মুক্তিযোদ্ধা; পরবর্তীকালে দেখা যায়, ষাঁড়টি তার শিং ব্যবহার করছে মুষ্টিযোদ্ধার মতো। ষাঁড়কে যেমন তার প্রশিক্ষক শান্ত করে, কনকে তেমনি শান্ত করে জেক। মাইককে সে দেখে বল্লমধারী অশ্বারোহী হিসেবে, যে ক্রমাগত কনকে উৎসাহ দিয়ে যায়। সম্পাদকের অভিসন্দর্ভ এগিয়ে যায়, তবে তাঁর সন্দেহ হয় আপনি উপন্যাসে ষাঁড়ের লড়াইয়ের বিয়োগান্ত দিক দেখতে চেয়েছেন কি না।

হেমিংওয়ে : মনে হয় উপদেষ্টা-সম্পাদক কিছুটা বিভ্রান্ত। কে বলে জেক আহত হয়েছে, ষাঁড়-লড়িয়ের মতো? বস্ত্তত সে আহত হয়েছে অন্যভাবে। তার অন্ডকোষ অক্ষত ছিল। তাই স্ত্রীর প্রতি সে একজন পুরুষের অনুভূতির অধিকারী ছিল, যদিও অনুভূতিকে কাজে লাগাতে সে ছিল অসমর্থ। জরুরি ব্যাপার হলো যে, সে আহত হয়েছিল শারীরিকভাবে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে নয় এবং সে পৌরুষত্ব হারায়নি।

প্লিম্পটন : লেখার শৈলী নিয়ে উচ্চারিত প্রশ্নগুলো খুবই বিরক্তিকর।

হেমিংওয়ে : যুক্তিসংগত প্রশ্ন না আনন্দদায়ক, না বিরক্তিকর। আমি এখনো বিশ্বাস করি, লেখক কী করে লেখেন সে-সম্বন্ধে বলাটা অরুচিকর। তিনি লেখেন চক্ষুগ্রাহ্য পঠনের জন্য, কোনো ব্যাখ্যা বা গবেষণা এ-ব্যাপারে নিষ্প্রয়োজন। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, কোনো লেখক প্রথমবার পড়ার পরও কিছু বাকি থেকে যায় এবং যা বাকি থেকে যায় সে-সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দেওয়া কিংবা তাঁর লেখার দুর্বোধ্য অংশ সম্বন্ধে অবহিত করা লেখকের দায়দায়িত্ব হতে পারে না।

প্লিম্পটন : এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি, আপনি বলেছিলেন, রচনাধীন কোনো লেখক সম্পর্কে কিছু বলা বিপজ্জনক কিন্তু কেন তা হবে? আমি প্রশ্ন করি, কয়েকজন লেখক – টোয়েন, থারবার, স্টেফেনস – শ্রোতার প্রতিক্রিয়া দেখে লেখা ঝালাই করে নিতেন।

হেমিংওয়ে : টোয়েন হাকলবেরি ফিন শ্রোতাদের ওপর ‘যাচাই’ করেছিলেন, এমনটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না। যদি করেই থাকেন, তাহলে তাঁরা হয়তো তাঁকে দিয়ে ভালো অংশ বাদ দিয়ে বাজে অংশ গ্রহণ করিয়েছেন। ওয়াইল্ডকে যাঁরা চিনতেন তাঁরা তাঁকে লেখকের চেয়ে কথক হিসেবেই ভালো মনে করতেন। স্টেফেনস লেখার চেয়ে ভালো বলতে পারতেন। তাঁর লেখা এবং কথা কখনো কখনো অবিশ্বাস্য মনে হতো, শুনেছি তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক গল্পের রূপ পালটে গেছে। বারবার যদি লেখার মতো বলতে পারতেন, তাহলে তিনি হতে পারতেন মহত্তম এবং কম বিরক্তিকর কথক। আমার জানামতে, যে-ব্যক্তিটি তাঁর পেশা সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো বলতে পারেন তাঁর জবান যেমন মধুরতম, তেমনি বদখৎও। তিনি হলেন ম্যাটাডর হুয়ান বেলমেন্ট।

প্লিম্পটন : আপনার লেখার সুনির্দিষ্ট শৈলী তৈরির কাজে কী পরিমাণ চিন্তাভাবনা জড়িত সে-সম্বন্ধে কিছু বলবেন?

হেমিংওয়ে : এ এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর প্রশ্ন, যার জবাব দিতে দিনদুয়েক লাগবে।  ফলে লেখার কাজ শিকেয় উঠবে। এটুকু বলতে পারি, নবিশরা যাকে বলে শৈলী আসলে তা হলো প্রথম লেখার সময়কার অনিবার্য আড়ষ্টতা। কোনো নতুন ক্লাসিকসই পুরনো কোনো ক্লাসিকসের অনুবর্তন নয়। প্রথমে মানুষ দেখে আড়ষ্টতা। পরে তা ধরা যায় না। এই আড়ষ্টতাকেই শৈলী মনে করে লোকজন অনুকরণ করতে শুরু করে দেয়। এটা বেদনাদায়ক।

প্লিম্পটন : একদা আপনি আমাকে লিখেছিলেন, সহজ পরিবেশে লেখা বিভিন্ন শিক্ষামূলক হতে পারে। কথাটা কি দি কিলারসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? অথবা আপনি যে বলেছিলেন টেন ইন্ডিয়ানস এবং টুডে ইজ ফ্রাইডে একদিনেই লিখেছিলেন, সে ক্ষেত্রে এবং উপন্যাস দি সান অলসো রাইজেসের ক্ষেত্রে?

হেমিংওয়ে : দেখা যাক। দি সান অলসো রাইজেস লেখা শুরু করি ভেলেনশিয়ায় আমার জন্মদিনে, চবিবশে জুলাইয়ে। আমার স্ত্রী হেডলে আর আমি গিয়েছিলাম ভেলেনশিয়ায় ফেরিয়া উৎসবের দুটি ভালো টিকিট পাওয়ার জন্য। উৎসবটি শুরু হয় চবিবশে জুলাই। আমার বয়সী সবাই একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছেন, আর আমি একটি প্যারাগ্রাফ লিখতেই হিমশিম খাই। তাই আমার জন্মদিনেই লেখা শুরু করে দিলাম, সকালে বিছানায় বসে বসে ফেরিয়া উৎসবের মধ্যেই লিখে চললাম। মাদ্রিদে গেলাম। সেখানেও লেখার কাজ চালিয়ে গেলাম। ওখানে ছিল না কোনো ফেরিয়া উৎসব। আমাদের জন্য ছিল টেবিলসহ একটি কামরা। পাসায়ে আলভারেৎ এলাকায় হোটেলে শীতল পরিবেশে লিখে চললাম। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে যাওয়ায় চলে গেলাম হেনডায়ে। ওখানে চমৎকার দীর্ঘ সৈকতে ছিল সস্তা দামের একটি হোটেল। লেখার কাজ খুব চলল। গেলাম প্যারিসে। ১১৩ র্যু নতরে-দেম-দে-শ্যাম্পে উপন্যাসের প্রথম খসড়া লিখে শেষ করলাম শুরু করার ছয় সপ্তাহ পরে। ঔপন্যাসিক ন্যাথান আসচকে প্রথম খসড়া দেখালাম। তিনি ভারিক্কি চালে বললেন, ‘উপন্যাস লিখেছি বলতে কী বোঝাতে চাইছ হে? হুঁ! উপন্যাস। কঠিন ঘোড়সওয়ার হয়েছ তুমি, হুম।’ ন্যাথানের কথায় নিরুৎসাহিত না হয়ে ওটা পুনর্লিখন করলাম। ভ্রমণের (যা ছিল মাছ ধরার জন্য প্যামপ্লোনায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা) বর্ণনাও রেখে দিলাম।

যে গল্পদুটির উল্লেখ করেছেন, তা লিখেছি মাদ্রিদে, একদিনে, ষোলোই মে তারিখে। যেদিন বরফপাতের জন্য সান ইসিড্রোর ষাঁড় লড়াই বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে লিখলাম দি কিলারস, যা আমি আগেও লিখতে গিয়ে বিফল হয়েছি। তারপর মধ্যাহ্ন ভোজনের পর শরীরটা একটু তাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিছানায় গিয়ে লিখলাম টুডে ইজ ফ্রাইডে। আমার মনে এত রস সঞ্চারিত হয়েছিল যে, পাগল হওয়ার উপক্রম। আরো ছটা গল্প মাথায় কিলবিল করছিল। সেইজন্য পোশাক-আশাক পরে বুল ফাইটারদের পুরনো কাফে ফরনোসে গেলাম, কফি খেলাম। তারপর ফিরে এসে লিখলাম টেন ইন্ডিয়ানস। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তাই ব্রান্ডি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। খাওয়ার কথা ভুলে গেলাম। একজন বেয়ারা কিছু বাকালাও, এক টুকরো স্টেক, আলু ভাজা আর এক বোতল ভলদেপেনাস এনে দিলো। সরাইখানার মালিক ভদ্রমহিলা আমার স্বল্পাহারে উদ্বিগ্ন হয়ে বেয়ারা পাঠিয়েছিলেন। বিছানায় বসে খেতে খেতে ভলদেপেনাস পান করার কথা মনে পড়ে। বেয়ারা বলল, সে আর এক বোতল নিয়ে আসছে। সে বলল, ভদ্রমহিলা জানতে চেয়েছেন সারারাত আমি লিখব কিনা। বললাম, না, ভাবছি শুয়ে পড়ব। আরেকটা গল্প লেখার চেষ্টা করছেন না কেন? বেয়ারা জিজ্ঞেস করল। বললাম, একটা গল্পই আমার লেখার কথা। বেয়ারা বলল, বাজে কথা। আপনি ছটা গল্প লিখতে পারেন। আগামীকাল চেষ্টা করে দেখব, বললাম। আজ রাতেই চেষ্টা করুন, সে বলল। বুড়ো মহিলা কি খামোকা আপনার জন্য আহার-পানীয় পাঠিয়েছেন?

বললাম, আমি আজ খুব ক্লান্ত।

সে বলল, ননসেন্স (শব্দটা কিন্তু ননসেন্স মনে হয়নি)। তিনটা ফালতু গল্প লিখে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? একটা আমাকে অনুবাদ করে শোনান।

আমাকে একটু একা থাকতে দাও, বললাম। আমাকে একাকী থাকতে যদি না দাও, তাহলে লিখব কী করে? বিছানায় বসে ভলদেপেনাস পান করলাম। ভাবলাম, প্রথম গল্পটাই যদি আশানুরূপ ভালো হয়, তাহলে দারুণ এক লেখক তো আমি।

প্লিম্পটন : আপনার নিজের মনের ভেতর একটি গল্পের ধারণা কতটা পূর্ণ থাকে? লিখতে লিখতে কি গল্পের বক্তব্য, প্লট অথবা চরিত্ররা বদলে যায়?

হেমিংওয়ে : কখনো গল্পটা আপনার জানা থাকে। কখনো লিখতে লিখতে আপনি এগিয়ে যান। এটাই হলো গল্পের গতি। কখনো এই গতিবেগ এত শ্লথ হয় যে মনে হবে গল্প এগোতেই চাইছে না। তবে পরিবর্তন এবং গতিবেগ সবসময়েই থাকবে।

প্লিম্পটন : উপন্যাসের বেলায়ও কি তাই? আপনি কি লেখা শুরু করে অনড় মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যান?

হেমিংওয়ে : ফর হুম দি বেল টোলসের সমস্যা ছিল। প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে গেছি। ঘটনা কীভাবে এগোবে জানতাম, তবে তা প্রতিদিন বুঝতে হতো।

প্লিম্পটন : দি গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকা, টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট এবং অ্যাক্রস দি রিভার অ্যান্ড ইনটু দি ট্রিজ – এসব উপন্যাসের শুরু কি গল্প হিসেবে হয়েছিল? তাহলে প্রশ্ন – সাহিত্যের এই দুটি শাখায় কি এতই মিল যে, লেখক ইচ্ছা করলেই একটির আদল বদলে অন্যটি লিখতে পারেন?

হেমিংওয়ে : না, এটা ঠিক নয়। দি গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকা উপন্যাস নয়। চেষ্টা করেছিলাম দেখতে যে, একটি দেশের অবয়ব এবং একটি মাসের ঘটনাবলির যথাযথ প্রকাশ কাল্পনিক কাহিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে কিনা। এটা লেখার পর দুটি ছোটগল্প লিখি, ‘দি স্নোজস অফ কিলিমানজেরো’ এবং ‘দি শর্ট হ্যাপি লাইফ অফ ফ্রান্সিস ম্যাকোম্বার’। এক মাসের শিকারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত ধারণা নিয়ে গল্পদুটি লিখি। এই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি দি গ্রিন হিলস, টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট এবং অ্যাক্রস দি রিভার অ্যান্ড ইনটু দি ট্রিজে। দুটিরই শুরু কিন্তু গল্প হিসেবে।

প্লিম্পটন : আপনি কি একটি সাহিত্য প্রকল্প থেকে অন্যটিতে যেতে স্বস্তিবোধ করেন অথবা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করে যান?

হেমিংওয়ে : বাস্তব সত্য হলো এই যে, এসব নির্বোধ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শিকেয় তুলে রেখেছি তার জন্য আমার কঠোর দন্ড হওয়া উচিত। দন্ডিত হবোও আমি। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না।

প্লিম্পটন : আপনি কি নিজেকে অন্য লেখকের প্রতিযোগী মনে করেন?

হেমিংওয়ে : কখনো না। যেসব মৃত লেখকের লেখার মূল্যমান সম্পর্কে আমি নিশ্চিত, তাদের চেয়ে উন্নত লেখা লিখতে চেষ্টা করেছি। দীর্ঘ সময় ধরে আমি চেয়েছি আমার সেরা লেখাটি লিখতে। ভাগ্য কখনো সুপ্রসন্ন হলে আমার ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভালো লেখা লিখব।

প্লিম্পটন : আপনি কি মনে করেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন লেখকের ক্ষমতা কমে যায়? দি গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকাতে আপনি বলেছেন যে, একটা বয়সকালে মার্কিন লেখকরা ঠাকুরমায় রূপান্তরিত হয়।

হেমিংওয়ে : সে-ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। যদি একজন জানে সে কী করছে, তাহলে তার কৃতকর্ম, অন্তত তার মাথাটি যতদিন জীবন্ত আছে ততদিন, বেঁচে থাকবে। যদি খেয়াল করেন, যে-বইয়ের উল্লেখ আপনি করলেন, সেখানে আমি একজন রসকষহীন অস্ট্রেলিয়ানের সঙ্গে বাধ্য হয়ে আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি, অথচ তখন চেয়েছিলাম অন্য কিছু করতে। আমাদের কথোপকথনের হুবহু বর্ণনা দিয়েছি আমি। মৃত্যুহীন ঘোষণা দিতে চাইনি। আমার বক্তব্যের বড় একটা অংশই ছিল যথার্থ।

প্লিম্পটন : চরিত্রাবলি নিয়ে তো আলোচনা করা হলো না। আপনার সাহিত্যকর্মের চরিত্রাবলি কি ব্যতিক্রমহীনভাবে, বাস্তব জীবন থেকে গৃহীত?

হেমিংওয়ে : অবশ্যই না। কিছু হয়তো বাস্তব জীবন থেকে এসেছে। মানুষ সম্পর্কে আপনার অর্জিত জ্ঞান, ধারণা ও অভিজ্ঞতা থেকে আপনি চরিত্রচিত্রণ করেন।

প্লিম্পটন : বাস্তব একটি চরিত্রকে উপন্যাসের চরিত্রে রূপান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?

হেমিংওয়ে : যদি তা বলতে চাই তাহলে মানহানির মামলার আইনজীবীর জন্য ছোটখাটো একটি বই হয়ে যাবে।

প্লিম্পটন : আপনি কি, ই এম ফরস্টার যেমন করেন, তেমনি ‘ফ্ল্যাট’ ও ‘গোলাকৃতি’ চরিত্রের জন্য কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?

হেমিংওয়ে : যদি মনে করেন কোনো চরিত্র আলোকচিত্রের মতো ‘ফ্ল্যাট’ তাহলে সেটা আমার ব্যর্থতা। যদি তাকে আপনার চেনা থাকে, তাহলে তার থাকবে বহুমাত্রিকতা।

প্লিম্পটন : আপনার কোন কোন চরিত্রকে আপনি বিশেষ আনুগত্য দিয়ে বিবেচনা করেন?

হেমিংওয়ে : সেটা অনেক লম্বা তালিকা হবে।

প্লিম্পটন : তাহলে তো আপনি আপনার বইগুলো বারবার পড়েন, একবারও ভাবেন না যে, কোথাও কোনো পরিবর্তন প্রয়োজনীয় ছিল?

হেমিংওয়ে : যখন লেখার কাজটি কঠিন মনে হয়, তখন নিজেকে উল্লসিত করার জন্য কখনো পড়ি এবং তখন ভাবি কাজটা কী কঠিনই না ছিল এবং কখনো কখনো ছিল প্রায় অসম্ভব।

প্লিম্পটন : আপনার চরিত্রাবলির নামকরণ করেন কীভাবে?

হেমিংওয়ে : আমার সেরা সাধ্যমতে।

প্লিম্পটন : গল্প লেখা যখন প্রক্রিয়াধীন থাকে তখন কি গল্পের নাম আসে?

হেমিংওয়ে : গল্প বা বইটি শেষ করে আমি নামের একটা তালিকা করি। কখনো কখনো শ’খানেক নামের তালিকা। তারপর বাদ দিতে শুরু করি। কখনো কখনো পুরো তালিকাই বাদ দিয়ে দিই।

প্লিম্পটন : যেসব নামকরণ গল্পের ভেতর থেকে আসে, তাদের বেলায় কী করেন? যেমন ধরুন, হিলস লাইক হোয়াইট এলিফ্যান্টস।

হেমিংওয়ে : হ্যাঁ, নাম আসে পরে। প্রুনিয়ারে গিয়েছিলাম মধ্যাহ্নভোজের আগে ঝিনুকের খাবার খেতে। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো। আমি জানতাম, তার একবার গর্ভপাত হয়েছিল। তার সঙ্গে কথা বললাম, কিন্তু ওই বিষয়টি বাদ দিয়ে। দুপুরের খাওয়া বাদ গেল। বাড়ি ফেরার পথে গল্পটি নিয়ে ভাবলাম। বিকেলটা কেটে গেল গল্প লিখতে লিখতে।

প্লিম্পটন : তাহলে যখন আপনি লেখালেখি করেন না, তখন ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করে যান, লেখার খোরাক খুঁজে বেড়ান।

হেমিংওয়ে : নিশ্চয়ই। একজন লেখকের পর্যবেক্ষণক্ষমতা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন লেখক হিসেবে তিনি নিঃশেষিত। তবে তাকে সচেতনভাবে দেখতে হবে এবং দেখাটাকে কাজে লাগাতে হবে এমন কথা নেই। শুরুর দিকে তেমন একটা চিন্তা হতে পারে। পরে সবকিছুই তার দেখা ও জানা সঞ্চয়ের ভান্ডারে জমা হতে থাকে। যদি বলা বাহুল্য না হয়, তাহলে বলি, আমি সবসময়ে জানি, বরফের চাঁইয়ের দৃশ্যমান অংশের আট ভাগের সাত ভাগ পানির নিচে ডোবা থাকে। আপনি যা জানেন, তাকে পরিহার করতে পারেন। এতে বরফের চাঁইটা শক্ত-সুঠাম হবে। মূল্যবান হলো অদৃশ্য অংশটুকু। জানেন না বলে লেখক যদি কিছু বাদ দেন তাহলে গল্পে একটা ফাঁক থেকে যায়।

দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি হাজারখানেক পৃষ্ঠার করা যেত। গ্রামের প্রতিটি চরিত্র এতে আনা যেত, তারা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করে, লেখাপড়া শেখে, শিশুর জন্ম দেয়, এ-সবকিছুর বর্ণনাই দেওয়া যেত। এ-কাজটি সুচারুভাবে অন্য লেখকরা সম্পাদন করেছেন। অন্যরা আগে যা সুচারুভাবে করেছেন, সে-ব্যাপারে আপনার সীমাবদ্ধতা আছে। তাই আমি চেয়েছি অন্য কিছু করতে। আমি চেয়েছি অপ্রয়োজনীয় সবকিছু বাদ দিতে। একজন পাঠক কিংবা পাঠিকা আমার লেখা পড়ার পর যেন বলেন এ-অভিজ্ঞতার তিনি অংশীদার হবেন এবং এটা হওয়াও সম্ভব এমনটাই আমি চেয়েছি। কাজটা খুব কঠিন এবং কঠোর পরিশ্রমও করেছি।

যাকগে, কীভাবে এটা আমি করেছি সে-প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বলি, এসবে আমার ভাগ্য ছিল অবিশ্বাস্যভাবে অনুকূলে এবং পরিপূর্ণভাবে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছি, এমনভাবে দিয়েছি, যা আগে কেউ পারেননি। ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন ছিল, আমি পেয়েছিলাম একটি ভালো মানুষ এবং একটি ভালো বালক। এখন লেখকরা হয়তো ভুলে গেছেন, এমন মানুষ এখনো আছেন। তারপর রয়েছে সাগর, যার সম্বন্ধে লেখা খুব গৌরবের ব্যাপার। ভাগ্যটা আমার ওখানেই ভালো ছিল। আমি মার্লিনমেট মাছ সম্বন্ধে জানি। তাই তাদের কথা বাদ দিলাম। পঞ্চাশ বা তারও বেশি তিমি আমি একসঙ্গে দেখেছিলাম। এদের মধ্যে ষাট ফুট লম্বা একটাকে হারপুন দিয়ে গেঁথেও ধরে রাখতে পারিনি। ওদের কথাও বাদ দিলাম। জেলেপল্লির যেসব গল্প আমি জানতাম সেগুলো বাদ দিয়েছি। বরফের চাঁইয়ের নিচের অংশটুকুই হলো জ্ঞান।

প্লিম্পটন : আর্চিবন্ড ম্যাকলেইশ পাঠকের কাছে অভিজ্ঞতা সঞ্চারণের একটি প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন, যা আপনি নাকি অর্জন করেন কানসাস সিটি স্টার পত্রিকার জন্য বেসবল খেলার প্রতিবেদন লেখার দিনগুলোতে। তা ছিল এই যে, অভিজ্ঞতা সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে সহজভাবে জানাতে হবে, এমন নিবিড়ভাবে বলতে হবে যে, পাঠক মনে করবেন, তিনি যে-বিষয়ে অচেতন ছিলেন, সে-সম্পর্কে সচেতন হলেন।

হেমিংওয়ে : উপাখ্যানটি সন্দেহজনক। স্টারের জন্য আমি কখনো বেসবল লিখিনি। আর্চি যা স্মরণ করতে চেষ্টা করছিল তা হলো ১৯২০ সালে শিকাগোতে আমি তখন খুঁজছিলাম এমনসব নজর কাড়তে ব্যর্থ দৃশ্য, যা মানুষের মনে আবেগের জন্ম দেয়। যেমন ধরুন, একজন আউটফিল্ডার তার গ্লাভস ছুড়ে মারল কিন্তু সেটা কোথায় গিয়ে পড়ল তা খেয়ালও করল না, রেসিন ক্যানভাসের ওপর মুষ্টিযোদ্ধার জিমনেশিয়াম জুতোর কিচমিচ শব্দ, অথবা সদ্য খেলা থেকে ফিরে আসা জ্যাক ব্ল্যাকবার্নের চামড়ার ধূসর রং। এসব জিনিস আমি লক্ষ করেছি একজন অঙ্কনশিল্পীর মতো করে। ব্ল্যাকবার্নের অদ্ভুত গাত্রবর্ণ আপনি চেনেন, তাঁর গালে ক্ষুরের দাগকে চেনেন এবং মানুষকে চরকির মতো ঘুরানোর ইতিহাস জানেন। গল্প জানার আগে এসব ঘটনা আপনাকে নাড়া দেয়।

প্লিম্পটন : ব্যক্তিগতভাবে জানেন না, এমন কোনো ঘটনার বর্ণনা কি আপনি দিয়েছেন?

হেমিংওয়ে : এটা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন। ব্যক্তিগত বলতে কি শারীরিক অভিজ্ঞতার কথা বললেন? তাহলে উত্তর হবে হ্যাঁ-বাচক। একজন লেখক, যদি তিনি ভালো লেখক হন, বর্ণনা দেন না। তিনি ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান থেকে অর্জিত বিষয় সৃজন করেন, কখনো তিনি গোত্রীয় বা পারিবারিক অভিজ্ঞতা থেকে অনির্ণীত ঘটনার কথা বলেন। পায়রাকে উড়তে শেখায় কে? যোদ্ধা ষাঁড় কোথা থেকে তার সাহস পায়, অথবা শিকারি কুকুর তার ঘ্রাণের শক্তি? এসব জিনিস নিয়ে তখন আমরা মাদ্রিদে আলাপ করতাম। তখন আমার মস্তিষ্ককে আমি বিশ্বাস করতাম না।

প্লিম্পটন : কোনো অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখতে গেলে তা থেকে আপনাকে কতটা বিষুক্ত হতে হবে? যেমন ধরুন, আফ্রিকান বিমান-দুর্ঘটনার ব্যাপারটি, যার কবলে আপনি পড়েছিলেন?

হেমিংওয়ে : সেটা নির্ভর করে অভিজ্ঞতার ওপর। এক অংশের সঙ্গে শুরু থেকেই আপনি সম্পূর্ণভাবে বিযুক্ত থাকেন, অন্য অংশের সঙ্গে জড়িত থাকেন। একটা বিষয় নিয়ে কত তাড়াতাড়ি আপনি লিখতে পারেন, এ-ব্যাপারে কোনো নিয়ম আছে ভাবি না। একজন কত দ্রুত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তার ওপর এটা নির্ভর করে। এবং কত তাড়াতাড়ি তিনি ধাতস্থ হতে পারেন, তার ওপরও। একজন প্রশিক্ষিত লেখকের জন্য দুর্ঘটনায় পতিত জ্বলন্ত বিমানে থাকতে পারাটা একটা অভিজ্ঞতাও বটে। অভিজ্ঞতাটা তার কাজে লাগবে কি না তা নির্ভর করবে তার বেঁচে থাকার ওপর। বেঁচে থাকা, এই সম্মানজনক অথচ পুরনো শব্দটি খুবই মূল্যবান এবং তা লেখকের কাছেও। যাঁরা দীর্ঘায়ু হন না, তাঁদের সবাই ভালোবাসে। কারণ বেশিদিন তো তাঁদের সহ্য করতে হয় না। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে লেনদেন হয় কম। যাঁরা স্বল্পায়ু হন এবং যাঁরা সহজে সরে যান, তাঁদের পছন্দ করা হয়, কারণ তাঁরা বোধগম্য এবং মানবিক। ব্যর্থতা এবং সুকৌশলে লুকিয়ে রাখা কাপুরুষতা অনেক মানবিক ও আদরণীয়।

প্লিম্পটন : জিজ্ঞেস করতে পারি, একজন লেখক তাঁর সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সঙ্গে কতটা সম্পৃক্ত হবেন?

হেমিংওয়ে : প্রত্যেকেরই নিজস্ব বিবেক আছে এবং বিবেক কীভাবে কাজ করবে সে-ব্যাপারে কোনো নিয়ম নেই। রাজনীতিমনস্ক লেখকের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন যে, যদি তাঁর লেখা টিকে যায়, তাহলে লেখা পড়ার সময়ে আপনি রাজনৈতিক অংশটুকু বাদ দিয়ে দিতে পারেন। তথাকথিত রাজনৈতিক লেখকদের অনেকে অতিদ্রুত তাঁদের রাজনীতি বদলান। তাঁদের কাছে কাজটা খুব উত্তেজক। কখনো কখনো তাঁরা তাঁদের মতবাদ পর্যালোচনা করেন এবং করেন দ্রুততার সঙ্গে। হয়তো সুখ অন্বেষার প্রক্রিয়া হিসেবে একে পছন্দ করা যেতে পারে।

প্লিম্পটন : বিচ্ছিন্নতাবাদী কাসপারের ওপর এজরা পাউন্ডের প্রভাবের কারণেই কি আপনি বিশ্বাস করেন যে, কবিকে সেন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া উচিত?*

হেমিংওয়ে : না। বিলকুল না। আমি মনে করি, এজরা পাউন্ডকে মুক্তি দিয়ে ইতালিতে কবিতা লিখতে দেওয়া উচিত, তবে তাঁকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন। কাসপারকে দ্রুত জেলে দেখতে পেলে আমি আনন্দিত হবো। বড় কবিদের গার্ল গাইড কিংবা স্কাউটমাস্টার হতে হবে এমন কথা নেই। তারুণ্যের ওপর সুমহান প্রভাবও তাদেরকে বিস্তার করতে হবে মনে করি না। স্থানীয় কাসপাররা ভেরলেইন, র্যাঁবো, শেলি, বায়রন, বোদলেয়ার, প্রুস্ত, জিদ প্রমুখকে তাঁদের চিন্তাচেতনা নৈতিকতার বিস্তার ঘটাতে বাধা দেবেন, এ হয় না। আমার তো মনে হয়, এই কাসপারকে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য দশ বছর পরে এই অংশের সঙ্গে পাদটীকা যুক্ত করতে হবে।

প্লিম্পটন : আপনার সাহিত্যকর্মে কোনো শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য আছে কি?

হেমিংওয়ে : শিক্ষামূলক শব্দটির অপব্যবহার করা হয়েছে। ডেথ ইন দি আফটারনুন একটি অনুশাসনমূলক বই।

প্লিম্পটন : বলা হয়ে থাকে, একজন লেখক একটি বইয়ে একটি কিংবা দুটি আইডিয়া নিয়ে কাজ করেন। আপনার লেখায় কি তাই করেছেন?

হেমিংওয়ে : কথাটা কে বলেছে? খুব সরল শোনাচ্ছে। যে লোকটা বলেছে তার বোধহয় মাত্র দু-একটা আইডিয়াই ছিল।

প্লিম্পটন : তাহলে বোধহয় কথাটা এভাবে বলা যায়। গ্রাহাম গ্রিন বলেছেন, আইডিয়ার অভিন্নতা শেলফের বইতে সাযুজ্য আনে। আমার বিশ্বাস, আপনি বলেছিলেন যে মহৎ লেখার সৃষ্টি অবিচারবোধ থেকে। আপনি কি মনে করেন একজন ঔপন্যাসিকের এভাবে কোনো বাধ্যবাধকতার আয়ত্তাধীন থাকা উচিত?

হেমিংওয়ে : মি. গ্রিনের বাণী দেওয়ার গুণ আছে, যা আমার নেই। বই নিয়ে এমন সরল উক্তি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। যেমন সম্ভব নয় পাখি এবং হাঁসের ঝাঁক সম্বন্ধে বলা। তবু আমি সাধারণীকরণের চেষ্টা করব। বিচার-অবিচারের বোধশক্তিহীন একজন লেখকের উচিত হবে উপন্যাস লেখা থেকে বিরত থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীর জন্য স্কুলের ইয়ারবুক সম্পাদন করা। আর একটা সাধারণীকরণ উক্তি। যখন কোনো কিছু দৃশ্যগ্রাহ্য তখন তা কঠিন হয় না। একজন লেখকের এটাই বড় হাতিয়ার। এটা হলো একজন লেখকের রাডার এবং বড় লেখকদের তা আছে।

প্লিম্পটন : সবশেষে একটি মৌলিক প্রশ্ন : যেমন, একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবে আপনার শিল্পকর্মের কাজ কী বলে মনে করেন? কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা, নয় কেন শুধু ঘটনা?

হেমিংওয়ে : এতে কেন এত বিমূঢ় হচ্ছেন? যা ঘটে গেছে এবং যা বিদ্যমান এবং আপনি যা জানেন এবং যা জানেন না, সব মিলিয়ে আপনি এমন কিছু একটা তৈরি করেন, যা কোনো বিশেষ কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে না বরং সম্পূর্ণ নতুন একটা কিছু সৃষ্টি হয়, যা সত্য এবং প্রচলিত কিছুর চেয়েও নতুন। আপনি তাতে প্রাণের সঞ্চার করেন এবং যদি সুন্দরভাবে তা আপনি সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে তা অমরত্ব পাবে। এজন্যই আপনি লেখেন এবং আপনার জানা আর কোনো কারণের জন্য নয়। তবে কী হবে সেসব কারণের যার সম্বন্ধে কেউ জানে না?

* ১৯৫৮ সালে ওয়াশিংটন ডিসির একটি ফেডারেল কোর্ট এজরা পাউন্ডের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে সেন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে তাঁর মুক্তির পথ প্রশস্ত করে দেয়।