আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে সমর মজুমদারের একক প্রদর্শনী মাটির মায়ায়

বসন্ত রায়চৌধুরী

সমর মজুমদারের আঁকা বইয়ের প্রচ্ছদের কথা আমাদের সবার কমবেশি জানা আছে। তাঁর আঁকা শিল্পকর্ম সম্পর্কে আমরা কিছু ধারণা পেয়ে যাই প্রথম একক প্রদর্শনীতে। এবারের প্রদর্শনীটি দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী। ‘মৃত্তিকা মায়া’ নামে এ-প্রদর্শনীর ৩৮টি কাজের মধ্যে ১০টি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা। বাকি কাজগুলো, হ্যান্ডমেইড কাগজে অ্যাক্রিলিক রং দিয়ে করা।

সমর মজুমদার দৃশ্যশিল্পে লোকজ ধারার গল্প বলার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। যেটি আমাদের পটচিত্রে-ছবির সঙ্গে শিল্পী সুরে সুরে গল্প বলে ছবি বুঝিয়ে দেন। সমর মজুমদার ঐতিহ্যসন্ধানী। তাঁর ক্যানভাসের বিষয়গুলোতে বাংলার চিরচেনা জীবনপ্রকৃতি দেখা যায়। বিষয় নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন এভাবে – ‘আমার ছবির বিষয় বাঙালির অতিচেনা। যেমন – মাছ-বিক্রেতা, মাছ ধরা, জলকে চল, সাঁকো, দক্ষিণের ঘাট, হাটুরে, মা। অতিচেনা এসব বিষয়কে নতুন করে বলে দিতে হয় না। আমার ছবিই দর্শককে গল্প বলে স্মৃতিকাতর করে তোলে।

গ্রামীণ জনজীবনের রোজকার চেনা বিষয়গুলো এই নগরের দেয়ালে এসে যখন হাজির হয়, তখন দর্শক তাঁর শৈশবে ফিরে যান। কোনো কোনো সময়ে দেখা এ-জীবনপ্রণালি দর্শককে ভাবায়। ‘মৃত্তিকা মায়া’য় সমর মজুমদার বসবাস করেন। প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় সাজিয়ে তোলার মাধ্যমে তিনি স্মৃতিকে জীবন্ত করে দেখান। তৃণমূল মানুষের দৈনন্দিন সহজ জীবন আমাদের অভিভূত করে তোলে। সমর মজুমদার সহজ ফর্মে বিষয়গুলো বর্ণনা করেন।

আমাদের জয়নুল, কামরুল, সুলতান, কিবরিয়া, সফিউদ্দীনের মতো বিষয় নির্বাচনে দর্শকের কাছাকাছি গিয়েছেন সমর মজুমদার। একেবারে বাস্তব নয় আবার মানুষ ও অন্য প্রাণীগুলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। এবারের প্রদর্শনী নিয়ে সমর মজুমদার বলেন এভাবে – একটি ছবির সঙ্গে আরেকটি ছবির সম্পর্ক আছে এমন ছবিগুলোই এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। প্রায় ৫০০টি ছবি থেকে বাছাই করে ৩৮টি শিল্পকর্ম প্রদর্শন করা হয়েছে এ-প্রদর্শনীতে।

লোকজ ও আধুনিকতার মিশেলে সমর মজুমদার ছবির জমিন তৈরি করেন। রং প্রলেপ দেওয়ার সময় তিনি মৌলিক রং ব্যবহার করেছেন। রঙের প্রয়োগে অতি নাটকীয়তা তিনি রাখেননি। কোনো কৌশল ছাড়াই একটি বিষয়কে ভাগ করে নিয়ে আলো আর ছায়ার বিন্যাস দেখিয়েছেন। সবল বর্ণলেপন বা সহজ ভঙ্গিতে আধাবিমূর্ত বিষয়ে রঙের ব্যবহারেও সরলীকরণ দেখা যায়। যৌগিক বা মিশ্র রং ব্যবহারের প্রবণতা সমর মজুমদারের কাজে খুব কম দেখা যায়। এরকমভাবে রং ব্যবহার তাঁর ক্যানভাসকে সরল করে তুলেছে। লোকজ শিল্পের রং ব্যবহারের পদ্ধতি অনুসরণের ছাপ এতে স্পষ্ট। সমর মজুমদারের শিল্পকর্ম দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে এভাবেই।

এবারে ছবির কিছু বিষয় নিয়ে বলা যায় – ‘অবলম্বন’ ছবির মূল ভাবনা একমাত্র গাভিটি কৃষক জড়িয়ে ধরে আছেন। এর চিত্রতলে যে বান্ট সিয়েনা রঙের ব্যবহার হয়েছে, তার সঙ্গে গরুটির রং মিলে গেলেও কৃষকের সাদা লুঙ্গির উজ্জ্বলতা ছবিটিকে আলাদা আলো দিয়েছে। এতে ছবির বিষয়ের সঙ্গে রঙের ঐক্য তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে ‘মা’-১ ছবিটিতে দেখা যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে হারিকেন উঁচিয়ে দেখছেন তার প্রিয় মানুষটি আসছে কিনা। অপেক্ষার আনন্দের রেশ ক্যানভাসের মানুষটির মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। এ দুটি ছবির বিষয় ভিন্ন; কিন্তু দুটি ছবির মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়েছে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে গাঢ় রং ব্যবহারের জন্য। আরো দুটি ছবির কথা এখানে বলা যায়। একটি হলো ‘নৌকা ভ্রমণ’। ছবিটিতে দূর আকাশ মিলেমিশে যায়, নীল-সাদা রঙের আকাশ অনেক দূরে মিলিয়ে যায়।

নৌকার গলুই আর মাঝির অবস্থান ক্যানভাসকে কৌণিকভাবে ভাগ করে দিয়েছে। এতে ছবিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। ছবির সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগ তৈরি হয়। ‘হাটুরে’ ছবিটিও আমাদের জানান দেয় মানুষের আকৃতি-প্রকৃতিতে দ্রম্নত মিলিয়ে যায়। গ্রামের মেঠোপথে হাটের দিকে যাত্রা করার এ-গতি নির্মাণ করেছেন সমর মজুমদার। এটি দর্শকদের এক ছন্দের সন্ধান দিয়েছে। বিশ্বায়নের এ-যুগে পুঁজির দুনিয়ায় সময় মজুমদার স্মৃতি হাতড়ান, নগরে থেকে গ্রামকে মনে করেন। আর শহরের দর্শকদের গ্রামের জীবনের কথা উস্কে দেন। এখানে তিনি সফল একজন শিল্পী। গত ১৩ অক্টোবর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে এ-প্রদর্শনীটি শুরু হয় এবং প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ২৬ অক্টোবর।  r