আলী আনোয়ারের চলে যাওয়া

আব্দুল হান্নান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আলী আনোয়ার ৩ মার্চ নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ৭৯ বছর বয়সে মারা গেছেন। ওর সঙ্গে আমার পরিচয়, অন্তরঙ্গ সখ্য, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময়ের। সে ছিল আমার সহপাঠী। স্বভাবতই আমার মন ভারাক্রান্ত। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আলী আনোয়ার নেই।

আজ অতীতের টুকরো টুকরো স্মৃতি আমায় আচ্ছন্ন করে দেয়। মনে পড়ে সেই কবে, ১৯৫৩ সালের আগস্টে আমরা ১৮ জন ছেলে ও একমাত্র মেয়ে দিলারা, পরবর্তীকালে দিলারা হাশেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। আলী আনোয়ার ছিল গুরুগম্ভীর রাশভারী ব্যক্তিত্ব, কিন্তু দারুণ আড্ডাপ্রিয়। জানি না কী মন্ত্রবলে অনতিবিলম্বে অজ্ঞাতসারে আমি, ওয়াসেক আল আজাদ, আনসারী ও দীর্ঘদিন বিলেতে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত আমির আলী প্রথম দেখায় আলী আনোয়ারের ভক্ত হয়ে গেলাম।

সেই থেকে ক্লাসে একসঙ্গে বসা, বাইরে আমতলায়, মধুর রেস্টুরেন্টে চার আনায় শিঙাড়া খাওয়া, সদরঘাটে রূপমহল সিনেমার পাশে রিভারভিউ রেস্টুরেন্টে ও নবাবপুরে ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টে চার আনার চপ খাওয়া, চানখাঁরপুলে ছোট রেস্টুরেন্টে চার আনার বুন্দে খাওয়া, দৈবক্রমে পকেটে এক টাকার বেশি থাকলে মুকুল সিনেমার পাশে ওকে রেস্টুরেন্টে কাটলেট কিংবা জিন্নাহ এভিনিউতে রেকস রেস্টুরেন্টে কাবাব-পরোটা কিংবা নারায়ণগঞ্জে বোস কেবিনে এক টাকায় খাঁটি ঘিয়ে ভাজা লুচি ও মুরগির মাংস খাওয়া। আরো ছিল গুলিস্তানে এক টাকা চার আনায় রিয়ার স্টলে বসে সিনেমা দেখা। মনে হয় প্রাচীনকালের কিংবদন্তির কথা বলছি।

এছাড়া বিকেলে প্রায়ই রমনা রেসকোর্সে এবং আলী আনোয়ারের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় – সবুজে শ্যামলিমায় ঘেরা কাকলি নিকেতনে – নির্দিষ্ট আড্ডার স্থান তো ছিলই। ফ্রকপরা ছোট বোন ছবিকে অসময়ে, বেলা ৪টায় কিংবা রাত ১০টায়, আনোয়ারের হুকুম – ‘যাও, টেবিলে চারজনের খানা লাগাও।’ মৃদু আপত্তি জানালে বলত, ‘চিন্তা করো না। কাকলি নিকেতনে উনুনের বিশ্রাম নেই।’ কিন্তু খালাম্মা? তাঁর নির্বিকার জবাব, অত্যাচারটা সয়ে গেছে। এমনই ছিল বেপরোয়া বন্ধুবৎসল আলী আনোয়ার।

আড্ডার বিষয়বস্ত্ত ছিল বিবিধ ও বিস্তারিত। কখনো পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ নিম্নবিত্ত শ্রেণীর ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সামরিক, বণিক ও সামন্ত শ্রেণীর শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা। মার্কস-এঙ্গেলসের সমাজতন্ত্র ও রুশ বিপ্লব। আবার কখনো পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর আধিপত্য ও প্রভাববিস্তারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আবার কখনো কান্ট, হেগেল, শোপেনহাওয়ার, কিয়েরকিগ্যার্ড, বার্নার্ড শ, নিটসে এবং সাম্প্রতিককালের জ্যাকস ডেরিডা প্রমুখের দার্শনিক চিন্তা। আলবেয়ার কামু, জ্যঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ এবং অতি-আলোচিত নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ, Second Sex-রচয়িতা সিমোন দ্য বোভোয়ারও বাদ পড়তেন না আমাদের আড্ডায়। এছাড়া চিত্রশিল্প-আন্দোলনে Impressionism, Cubism, Surrealism প্রভৃতির আবির্ভাব। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোজগতে বিচরণ, পশ্চিমা সাহিত্যে আদ্রেঁ জিদ, মোপাসাঁ, জেমস ফ্রেজারের গোল্ডেন বাউ, রুশ সাহিত্যে তলস্তয়, তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কি, ম্যাক্সিম গোর্কি, বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এপিক উপন্যাস পথের পাঁচালী ও পদ্মানদীর মাঝি; এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ইয়েটস ও বোদলেয়ার এবং বাংলা কবিতায় বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ ও সুধীন দত্তের আধুনিকতা আলোচনায় বাদ পড়তো না। তৎকালীন পশ্চাৎপদ ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আসা আমার বিদ্যার দৌড় ছিল বড়জোর মোহন সিরিজ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ কিংবা Treasure Island, Gulliver’s TravelsOliver Twist। তাই আমার মতো অর্বাচীন আলী আনোয়ারের জ্ঞানগর্ভ  আলোচনা, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা বিপুল বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে শুনে অভিভূত হতাম।

আমাদের আড্ডা অনিবার্যভাবে শেষ হতো নিউমার্কেটে মহিউদ্দিন সন্সের বইয়ের দোকানে। বলতে দ্বিধা নেই, আলী আনোয়ারের কাছ থেকেই বই কেনা ও পড়ার অভ্যাসটা আমার হয়েছিল। তার সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থেই এই অভ্যাসের চর্চাটা আজো অব্যাহত রেখেছি। পাছে শুনতে হয় তার অতিপরিচিত তিরস্কার – ‘ওই বইটা পড়োনি, তুমি মূর্খ, নরাধম, ফিলিস্তিন, তোমার পৌনঃপুনিক অধঃপতন – শিক্ষকতা ছেড়ে সাংবাদিকতা, সাংবাদিকতা ছেড়ে পাতি কূটনীতিক।’ বিদ্রূপ-শাণিত হলেও ভালোবাসা ও সমবেদনার অন্ত ছিল না তার। আমি যে আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে অন্য পেশা নিয়েছিলাম এটা সে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। আলী আনোয়ার সিমোন দ্য বোভোয়ারের একটা উক্তি প্রায়ই বলত – ‘One’s life has value so long as one attributes value to the life of others, by means of love, friendship, indignation and compassion.’ ওর প্রেরণায় একদিন আমি লেখকে উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম Obstinate Hopes বইটি লিখে। বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছিলাম, ‘I owe the inspiration of bringing out this book to Professor Ali Anwar of the Department of English, Rajshahi University, whose friendship I deeply cherish and whose breadth of reading and profundity of learning I admire and envy.’

পরবর্তীকালে জীবিকার অন্বেষণে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লেও আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন কখনোই ছিন্ন হয়নি। মনে পড়ে, কিছুদিন আগে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম নিউইয়র্কে তার মেয়ে সুস্মিতার বাসায়। তাকে দেখে অাঁতকে উঠেছিলাম। রোগে জর্জরিত হয়ে তার চেহারায় সেই উজ্জ্বলতা, উচ্ছলতা ছিল না। চোখে-মুখে ছিল বিষণ্ণতা ও বিপন্ন হাহাকার। আলী আনোয়ার আমায় বলল, ‘জানো হান্নান, জীবনসায়াহ্নে আমার কোনো আক্ষেপ, ক্ষোভ বা অতৃপ্তি নেই। ভাগ্যবিড়ম্বিত আমাদের দেশে আমি অপেক্ষাকৃত সাফল্য অর্জন করেছি। সুখ্যাতির সঙ্গেই আমি শিক্ষকতার জীবন অতিবাহিত করেছি। আমার সবকটি ছেলেমেয়েই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত; আমি স্ত্রীভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলাম। তুমি জানো না, লাবু কী অপরিসীম সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে দিন-রাত আমায় সেবা-শুশ্রূষা করেছে। আমার দুঃখ, ওর প্রতি আমি কখনোই যথেষ্ট মনোযোগ দিইনি। বই আর বন্ধুদের সময় দিয়েছি। একটা খেদ রয়ে গেল, বেয়াড়া ব্যাধিটা আমার অবসরজীবনে তোমাদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিতে দিলো না। আরেকটা অস্বস্তি আছে, অতি যত্নে সংগৃহীত ও বহু কষ্টে অর্জিত আমার ২০ হাজারের বেশি বইয়ের কী হবে?’ আমি বললাম, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে দান করলে কেমন হয়?’ একটু ভেবে আলী আনোয়ার বলল, ‘তা যে ভাবিনি, তা নয়। তবে তুমি তো জানো বইগুলো আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ওগুলো দিয়ে দিলে আমার মৃত্যুর আগেই মরণ হবে।’ তার স্ত্রী, হোসনে আরা ভাবি, ঠিকই বলেছিলেন, ‘বইবিহীন কবরে আলী আনোয়ার কীভাবে আছে যদি জানতে পারতাম।’ আলী আনোয়ার আমায় আরো বলেছিল, ‘মৃত্যুকে আমার ভয় হয়। মৃত্যুর পর আমি কি অন্ধকারের অতল গহবরে তলিয়ে যাব, নাকি ওই নীলাকাশে নক্ষত্র ও মেঘের সঙ্গে ভেসে বেড়াব।’ আমি মাথা নিচু করে বসেছিলাম। এ কি আসন্ন মহাপ্রস্থানের পথে অকপট নির্ভার জীবনালেখ্য, অন্তিম দীর্ঘশ্বাস?

আলী আনোয়ার ছিল অপরিমিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বৈদগ্ধ্যে পরিশীলিত। সমস্ত সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উন্মুখ; প্রগতিশীল মনন ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন আপাদমস্তক সংস্কৃতিমনস্ক একজন বড়মাপের মানুষ। তার অগাধ পান্ডিত্যের তুলনায় তার রচিত বইয়ের সংখ্যা দীর্ঘ নয়। সৃষ্টিশীল লেখায় উঁচুমানের সন্ধানে আপস না করায় তার কাছে সংখ্যা মুখ্য ছিল না। তবুও তার লেখা বিদ্যাসাগর, ইবসেন, পাবলো নেরুদা এবং বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত সাহিত্য-সংস্কৃতি নানা ভাবনা আমাদের সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। শেষোক্ত গ্রন্থটিতে তার মননের প্রাখর্য, প্রজ্ঞা, বিশ্লেষণশক্তির যে-প্রমাণ সে রেখে গেছে তেমন তুল্য গ্রন্থ সত্যিকার অর্থেই বিরল। এ-গ্রন্থটিতে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা ভাবনার প্রকাশ আছে। আলী আনোয়ার ছিল মূলত প্রবন্ধকার। তার রচনা সমাজনির্মাণের কারিগর, রাষ্ট্রপরিচালনার কুশীলব, বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদদের চিন্তায় নাড়া দেবে এবং সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের সচেতন করবে।

আমাদের ব্যর্থতা, জীবিতকালে তার সঠিক মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। বাংলা একাডেমি তাকে অবশ্য পুরস্কৃত করেছিল। আরো জাতীয় সম্মান ও স্বীকৃতি তার অবশ্যপ্রাপ্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় উদ্বাস্ত্ত থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমতসৃষ্টিতে আলী আনোয়ারের ভূমিকা সুবিদিত। প্রচারবিমুখ আলী আনোয়ার অবশ্য কখনোই সম্মাননার কাঙাল ছিল না। আলী আনোয়াররা ওরকমই হয়। ওরা জনপ্রিয়তা চায় না। স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র মাধুর্যে ওরা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আলী আনোয়ারের মতো মানুষের বন্ধুত্ব দুর্লভ।