আহবাব এবং ইসমায়েল

হাসনাত আবদুল হাই

গাড়িটা একেবারে গেটের সামনে থামালো ড্রাইভার ইসমায়েল, সেখানে সে প্রতিবারই থামে, খুব ভিড় না থাকলে। লোকজন বেশি হলে গেটের ঠিক সামনে না, একটু দূরেই গাড়ি থামাতে হয় বাধ্য হয়ে। ইঞ্জিন চালু রেখেই সে পেছনের দিকে তাকিয়ে বলে, অপেক্ষা করুন স্যার? ভিড়টা পাতলা হইয়া যাক। তখন গেটের কাছে যাওন যাইবো। বলে সে উত্তরের অপেক্ষা করে।
আহবাব কিছু বলার আগে তার স্ত্রী মরিয়ম বলে, তাই করো ইসমায়েল।
অতদূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে কষ্ট হবে সাহেবের।
শুনে আহবাব জেদ করে বলে, এখান থেকেও যেতে পারবো। কষ্ট হবে কেন? অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। বলে সে মরিয়ম কিছু বলার আগেই গাড়ির দরজা খুলে ক্রাচটা নিচে খোয়াওঠা, এবড়োখেবড়ো রাস্তার ওপর নামিয়ে দেয়। খট্ করে একটা শব্দ হয়, যেন কেউ ঢিল ছুড়লো।
গেটের সামনে ফকিরের ভিড়, তারা ঝাঁকে ঝাঁকে দৌড়ে আসে। কয়েকজন ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে। দুজন বগলে ক্রাচ রেখে তার ওপর ভর দিয়ে। তারা আহবাবের দিকে প্রসন্ন মুখে তাকায়, সহানুভূতি পাওয়ার আশায়। তাদের দেখে আহবাব নিজের ক্রাচটা জোর করে বগলের নিচে চেপে ধরে, সমস্ত শরীরের ভর দিয়ে। তার ভেতর দয়ামায়া না, বেশ একটা আক্রোশ, প্রতিবাদ জেগে ওঠে। সে ফুঁসে উঠতে চায়, কার বিরুদ্ধে নিজেই জানে না। নিজের বিরুদ্ধে কি? সে কি এখনো নিজেকেই দায়ী করে চলেছে, দুর্ঘটনার জন্য? নাকি সেই গাড়িটাকে, যার রং সাদা, ওপরটা উঁচু, সেই পাজেরোকে? আহবাব দ্রুত হাঁটতে থাকে, ক্রাচের নিচে খটখট শব্দ হয়। গোরস্তানের তদারককারীদের একজন তাকে দেখে এগিয়ে আসে, হাত বাড়িয়ে দেয় সাহায্য করার জন্য। আহবাব বিরক্তির সঙ্গে তার দিকে তাকায়। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যায় গেটের ভেতর দিয়ে। দুদিকে বাঁধানো কবরগুলো। মার্বেল ফলকে নাম লেখা, জন্মতারিখ, মৃত্যুর দিন-তারিখ। কিছু কথা লেখা, শিলালিপিতে যেমন হয়। কোথাও কোথাও কবিতার পঙ্ক্তি যেমন, এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ। অথবা তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ – এই সব।
কবরটার সামনে বসে আছে আহবাব। বাঁধানো, মার্বেল ফলকও আছে, সেখানে শুধু লেখা আহবাব চৌধুরী, জন্ম ১৯৭৯, জানুয়ারি ২৫। মৃত্যুর তারিখ নেই, জায়গাটা ফাঁকা রাখা, একটা শূন্যতা, কোনো কবিতার পঙ্ক্তি লেখা হয়নি। ভেতরে মাটি ঢিবির মতো উঁচু করা না, সমান। সবুজ ঘাসে মোড়া। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ ভিজে আসে। সে বিড়বিড় করে বলে, আমাকে ফেলে চলে গেলে। একসঙ্গে থেকেছি, সেই জন্মের পর থেকে। কত জায়গায় গিয়েছি। তুমিই নিয়ে গিয়েছো, অথবা আমি তোমাকে। কোনটি সত্য, তা মনে করতে পারছি না। দিনে-রাতে, দেশে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, বিদেশে বরফের ভেতর। মনে পড়ে তোমার? কত দৃশ্য, কত ধরনের মানুষ দেখেছি একসঙ্গে? কত ঘরে থেকেছি দুজন। বাড়িতে, হোটেলে। জাহাজে, লঞ্চে, উড়োজাহাজে, বাসে, গাড়িতে করে ঘুরেছি। অ্যাকসিডেন্টের পর বিদেশে একবারই গিয়েছি তোমাকে নিয়ে, তুমি সুস্থ ছিলে না। তোমাকে দেখাতেই বিদেশ যাওয়া। সেই বিদেশ যাওয়া আগের মতো ছিল না, বিমর্ষ হয়ে ছিলাম সারাক্ষণ, যতদিন থাকতে হয়েছে। তুমিও স্বাভাবিক ছিলে না। ডাক্তারের রায় শুনে চলে এলাম, বুকের ভেতর খুব কষ্ট নিয়ে।
পেছনে মরিয়ম দাঁড়িয়ে থাকে। গোরস্তানের গোরখোদক একজন কাছে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে কোদাল, গায়ে কাদামাটি। এইমাত্র কবর খুঁড়ে এলো বলে মনে হয়। সে বলে, এখন ঘাস হইছে স্যার। আমি রোজ পানি দিই আইসা।
আহবাব লোকটাকে দেখে। হ্যাঁ, এই গোরখোদকই কবরটা খুঁড়েছিল, তার কথামতো। অগভীর করে। তাকে বলা হয়েছিল দেখাশোনার জন্য। সে ফাঁকি দিচ্ছে না। দেখাশোনা করছে। কবরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পাশাপাশি ফুলগাছও লাগিয়েছে, গাদা ফুল। হলুদ হয়ে আছে, যেন একঝলক সূর্যের আলো। গোরখোদক বলে, অনেকেই এইখানে আইসা খাড়ায়। শুনে আহবাব বলে, কেন দাঁড়ায়?
গোরখোদক বলে, এমুন কবর তো আর নাই এহানে। হের লাইগা। লোকে আইসা দেখে, জিগায় আমারে, কার কবর এইটা। মারা যাওয়ার তারিখ নাই ক্যান?
আহবাব শুনে বিরক্ত হয়ে বলে, তুমি কী উত্তর দাও তাদের?
গোরখোদক বলে, আমি কিছু কই না। কই, জানি না।
মরিয়ম বললো, চলো যাই এবার। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তোমার কষ্ট হচ্ছে।
মরিয়মের কথায় আহবাবের তন্ময়তা ভাঙলো, সে সচেতন হলো। আশপাশে তাকিয়ে দেখলো। কেউ কেউ তার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে। দুটো বাচ্চা ছেলে ছেঁড়া শার্ট গায়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একবার কবরটা দেখছে, একবার আহবাবকে। আহবাব মরিয়মের উদ্দেশে বললো, না, কষ্ট হচ্ছে না। কষ্ট হবে কেন? বেশ জোরের সঙ্গেই কথাগুলো বললো সে। কষ্টের কথা শুনলেই তার রাগ হয়। মনে হয়, তাকে অপমান করা হচ্ছে, করুণা দেখাচ্ছে। শুধু তাকে না, সেই সঙ্গে আরেকজনকেও। সে ক্রাচটা জোরের সঙ্গে ধরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, না। কোনো কষ্ট নেই। কিছু তো ঘাড়ের ওপর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি না। বলে সে হাঁটতে থাকে। সিমেন্টবাঁধা সরু পথে ক্রাচের শব্দ হয় খটাখট, খটাখট।
ফোনের ওপাশে যে কথা বলছে, তাকে বেশ নির্লিপ্ত মনে হলো। বেশ কয়েকবার বললো, কে বলছেন? আহবাব না দেখেও বুঝতে পারলো লোকটা হাই তুলছে। আবসাদ? উদাসীনতা? আহবাব নিজের নাম বললো না। লোকটা ওপাশ থেকে বললো, কেইসটা কী? এ্যা, মোটর অ্যাকসিডেন্ট? কোথায় হলো? রাস্তার নাম?
আহবাব বললো, আজকে হয়নি। দুমাস আগে। লোকটা এবার স্পষ্ট করে শোনা যায় এমনভাবে হাই তুলে বললো, দুমাস আগে! তা এখন কী করার আছে? ফোন করেছেন কেন? আপনি কে?
আহবাব রেগে গিয়ে বলে, আপনি মনে হয় সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না।
লোকটা বলে, রোজ এত অ্যাকসিডেন্ট হয়। কত লোক মারা যায়। সিরিয়াসলি নিতে নিতে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি। বুঝলেন। এখন এসব রুটিন কাজ। তা বলেন দেখি, দুমাস আগের অ্যাকসিডেন্ট নিয়ে ফোন করেছেন কেন? আপনি অ্যাকসিডেন্ট করেছেন বলে মনে হচ্ছে না।
না। আমি করিনি। আমি ভিকটিম।
বলুন ভিকটিম স্যার। কী করতে পারি। লোকটার স্বরে শ্লেষ এবং কৌতুক। তার পাশে বসে কেউ যেন হেসে ওঠে মজা পেয়ে।
আহবাব অধৈর্য হয়ে, রেগে গিয়ে বলে, ঠাট্টা করবেন না। আই অ্যাম এ ট্যাক্সপেয়ার। আমাদের সেবা করার জন্য আপনারা আছেন। এভাবে কথা বলতে পারেন না।
লোকটা বলে, তাহলে কীভাবে বলবো বলেন দেখি। তারপর একটু থেমে বলে, ট্যাক্সপেয়ার স্যার। আবার তার পাশে খুকখুক হাসি শোনা যায়।
আহবাব এবার আরো রেগে গিয়ে বলে, ঠাট্টা, ফাজলামি রাখুন। কাগজে খবর ছাপাবো। বুঝলেন? আর কিছু না হোক, ক্লোজড হবেন। ফর নেগলিজেন্স অফ ডিউটি।
ক্লোজড? তাহলে তো খুবই ভালো হয়। বিনা বেতনে ছুটি কাটানো যাবে। লোকটা হেসে বলে।
আহবাব বলে, হাইকোর্ট থেকে রিট অর্ডারের জন্য উকিলকে বলবো। মানবাধিকার কমিশনে কমপ্লেন করতে যাবো। ফাজলামো করবেন না।
লোকটা বললো, আপনি দেখছি বেশ মেজাজি লোক। ভীষণ চটে আছেন। ব্যাপার কী বলেন তো? একটা মোটর অ্যাকসিডেন্ট নিয়ে এত হইচই কেন?
আহবাব বললো, যে-গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে, আপনারা তার ড্রাইভারকে ধরতে পেরেছেন কিনা জানতে চাই। তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছেন কিনা শুনতে চাই।
শুনে লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলে, খুনের আসামিই ধরা যাচ্ছে না আজকাল। অ্যাকসিডেন্টের আসামি ধরার সময় কোথায় বলেন?
আহবাব বলে, তার মানে ধরতে চেষ্টা করছেন না?
লোকটা বলে, না, তা বলিনি। নিশ্চয়ই চেষ্টা করা হচ্ছে। আমার জানা নেই। খাতাপত্র দেখতে হবে। সব কেইস কি মনে থাকে? বললাম না, হাজার হাজার এ-ধরনের কেইস। বলেন দেখি জিডি নম্বর, তারিখ, সময়। আমি খুঁজে দেখি। তারপর জানাবো।
আহবাব বলে, কতবার বলতে হবে?
কতবার? লোকটা অবাক হয়। তারপর বলে, আমাকে বলেননি। এই প্রথম আপনার কথা শুনছি।
আহবাব বলে, আপনি না শুনলেও অন্যেরা শুনেছে। তারাও বলেছে জানাবে। এখনো জানালো না।
লোকটা বললো, সময় নিচ্ছে। বোঝেনই তো, ড্রাইভার পালালে তাকে খোঁজা খুব কঠিন। আচ্ছা, আপনি কি গাড়ির নম্বর দিয়েছিলেন? রেজিস্ট্রেশন নম্বর?
দিয়েছিলাম।
আচ্ছা। আবার বলেন দেখি, কবে জিডি করেছেন। তারিখ?
মরিয়ম চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলে, রাস্তায় তোমার অমন করা ঠিক হচ্ছে না।
আহবাব তার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বলে, কী করা ঠিক হচ্ছে না?
মরিয়ম বলে, এই যে সাদা পাজেরো গাড়ি দেখলেই তার পেছনে গাড়ি ছোটাও। কখন আবার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। অত ভিড়ের মধ্যে কি গাড়ির পিছু নেওয়া যায়?
আহবাব তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলে, পিছু নেওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা তুমি তা বুঝতে পারবে না।
মরিয়ম বলে, কেন পারবো না? এভাবেই তো অ্যাকসিডেন্ট হয়। একবার হয়েছে।
আহবাব বলে, তুমি আমার ব্যাপারে মাথা ঢোকাতে যেয়ো না। আমি জানি, আমি কী করছি। বুঝেশুনেই করছি।
মরিয়ম বললো, পুলিশকেও বলেছো, তারাই ব্যবস্থা নেবে। তোমার এত কষ্ট করার কী দরকার?
আহবাব উত্তেজিত হয়ে বলে, কষ্ট? সাদা পাজেরোর পিছু নেওয়ার কষ্টটাই তুমি দেখছো। আর কিছু দেখতে পাচ্ছো না। সেই জন্য এসব কথা বলছো।
মরিয়ম বললো, আর কী কষ্ট? তোমার পায়ের? সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমাকে বলতে হবে কেন?
আহবাব মুখ ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি বুঝতে পারবে না। চুপ করে থাকো।
মরিয়ম বললো, ইসমায়েল খুব ভয় পায় ওইভাবে তোমার কথা শুনে ভিড়ের মধ্যে জোরে গাড়ি চালিয়ে নিতে। বেশ নার্ভাস হয়ে যায়।
আহবাব অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকায়। তারপর বলে, তোমাকে বলেছে নাকি এ কথা?
মরিয়ম বলে, হ্যাঁ, বলেছে। খুব ভয়ে ভয়ে বলেছে যেন তোমাকে না বলি। একটু চুপ করে থেকে সে আবার বলে, ইসমায়েলের ধারণা, তুমি একটা ভয়ঙ্কর জেদ নিয়ে ওই সাদা পাজেরো খুঁজে বেড়াচ্ছো সারা শহরে আর দেখা পেলেই ধাওয়া করছো তার পেছনে। ইসমায়েল তোমার কথা শুনে আপত্তি করতে পারে না, কিছু বলতেও পারে না বেচারা। আমাকে বললো, তার খুব ভয় লাগে ওইভাবে পিছু নিয়ে গাড়ি চালাতে। তার ভয়, খুব বিপজ্জনক কিছু হয়ে যেতে পারে।
আহবাব বলে, বেশ। ও যদি ভয় পায় আর আমার কথা অনুযায়ী গাড়ি চালাতে না পারে, আমি চালাবো গাড়ি।
মরিয়ম অবাক হয়ে বলে, তুমি? এই অবস্থায়? বলে সে তার ক্রাচের দিকে তাকায়।
আহবাব এবার রেগে গিয়ে বলে, মানুষের মনে জেদ থাকলে অনেক কিছু করতে পারে। তুমি সেটা বুঝতে পারবে না। কেউই পারবে না। ভাববে পাগল। বলে সে হাসে।
আহবাব ঘরের মেঝেতে উত্তেজিত হয়ে হাঁটছে। ক্রাচটা কার্পেটের ওপর শব্দ করছে। অল্প অল্প ধুলো উড়ছে। খটখট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘরের একপাশ থেকে অন্যপাশে গিয়ে ঘুরে এসে উত্তেজিত হয়ে হাঁটছে, আবার যাচ্ছে। সাদা উঁচু পাজেরোটাকে খুঁজে পেতেই হবে। কোথায় সে লুকিয়ে আছে? বিশাল জনসমুদ্রে যেখানেই থাক, খুঁজে বার করবে সে। পুলিশ না করুক, সে করবে। ভাবতে ভাবতে তার উত্তেজনা বাড়ে। খটখট শব্দ আরো জোরে হয়। মরিয়ম ঘরে ঢুকে তাকে কিছুক্ষণ দেখলো। তারপর বললো, এমন অস্থিরভাবে হাঁটছো কেন? বিছানায় শুয়ে থাকো।
আহবাব রুষ্ট স্বরে বললো, কেন? শুয়ে থাকবো কেন? আমার কি অসুখ হয়েছে? জ্বর?
মরিয়ম বললো, তুমি এভাবে হেঁটে শরীরকে কষ্ট দিচ্ছো।
আহবাব হাঁটা বন্ধ করে বললো, শরীর? শরীরের কষ্টটাই দেখতে পাচ্ছো? সেই কষ্টটাই বড়? যাও, আমাকে বিরক্ত করো না। আমার শরীর ঠিকই আছে।

মহিলা প্রোসথেটিক পাটা হাঁটুর ওপর লাগিয়ে বললো, চমৎকার ফিট করে গিয়েছে। হেঁটে দেখুন। বুঝতেই পারবেন না যে আর্টিফিশিয়াল পা। প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগতে পারে, অভ্যাস হয়ে গেলে টেরই পাবেন না। অন্যেরাও টের পাবে না হাঁটতে দেখে। প্যান্ট-পাজামা পরা থাকবে ওপরে। একেবারে নরমাল দেখাবে।
আহবাব প্রোসথেটিক লেগটা দেখে। প্লাস্টিক, রংটা গোলাপি, সাহেবদের গায়ের রং যেমন হয়। কয়েকটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। বেশ স্বাস্থ্যবান মনে হয়। দেখতে দেখতে তার ভেতর একটা তীব্র আলোড়ন আসে। ক্রোধ, বিস্ময়, হতাশা আর সেইসঙ্গে প্রতিবাদ।
মহিলা বলেন, হাঁটুন। দেখেন কেমন লাগছে।
আহবাব পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, হাঁটবো। এখন না। যখন দরকার হবে হাঁটবো।
মহিলা মরিয়মের দিকে তাকায়। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়। তারপর আহবাবের দিকে তাকিয়ে বলেন, কিন্তু আমার তো জানা দরকার কেমন হলো, কেমন লাগছে আপনার?
আহবাব চোখ তুলে তাকালো মহিলার দিকে। তারপর উঠে দাঁড়ালো। একটু সময় নিলো শরীরের ওজন দুপায়ের ওপর ছড়িয়ে দিতে। তারপর হেঁটে গেল আস্তে আস্তে। ক্রাচ ছাড়া। ক্রাচটা পড়ে থাকলো চেয়ারে হেলান দিয়ে। জুতো জোড়াসুদ্ধ প্রোসথেটিক লেগ নিয়ে আহবাব হেঁটে গেল। প্রথমে অদ্ভুত এক অনুভূতি এলো, সেই সঙ্গে কিছু অস্বস্তি আর ব্যথাও। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে আবার হেঁটে এলো মহিলা আর মরিয়মের দিকে। তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ঠিকই আছে। একটু অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন খুলে পড়ে যাবে।
মহিলা হেসে বললেন, প্রথমে এমন মনে হবে। কিন্তু খুলে পড়বে না। টাইট করে লাগানো। আপনি কয়েকবার হাঁটুন। দেখবেন, স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
আহবাব নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। প্রোসথেটিক লেগটা ঝলসে উঠছে ঘরের ভেতর ইলেকট্রিক আলোয়। এটা নিয়েই এখন তাকে হাঁটতে হবে। আমৃত্যু? ভাবতে ভাবতে তার ভেতর হতাশা, ক্রোধ, আক্রোশ জেগে উঠলো। সাদা উঁচু পাজেরোটার ছবি ভেসে উঠলো সামনে। তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো, যেন কাউকে আঘাত করতে চায়। পুলিশ কিছু করুক আর না-ই করুক, সে ছেড়ে দেবে না।
ডাক্তার বললেন, আমরা লোকাল অ্যানাসথেশিয়া দেবো। অপারেশনের সময় কিছু টের পাবেন না। পরে ব্যথা হবে। পেইন কিলার খেলে খুব একটা অনুভব করবেন না।
আহবাব ব্যান্ডেজ বাঁধা পায়ের দিকে তাকালো। তারপর বললো, ওটা কী করবেন? অপারেশনের পর?
ডাক্তার তাকালেন তার পায়ের দিকে। তারপর বললেন, ফেলে দেওয়া হবে। সবার ক্ষেত্রে যা করা হয়।
না। প্রায় চিৎকার করে বললো আহবাব। শুনে ডাক্তার হকচকিয়ে গেলেন। তিনি কিছু বলার আগেই আহবাব বললো, ওটা আমাকে দেবেন।
ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন, আপনি নিয়ে কী করবেন? ওটা দিয়ে তো আর কোনো কাজ হবে না। পচে যাবে। এখনই পচন ধরেছে। ওটা পুঁতে ফেলতে হবে।
আহবাব গম্ভীর স্বরে বললো, আমাকে দেবেন। কোথাও ফেলবেন না। যা করার আমিই করবো।

টেলিভিশনের সামনে বসে ডিভিডি দেখছে আহবাব। পাশে মরিয়ম। ফ্যান্টম অফ দ্য অপেরা। লোকচক্ষুর আড়ালে ফ্যান্টম গান গাইছে, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। গানের সুর বেশ করুণ। গভীর দুঃখে কাতর, বেদনার ভারে অবনত। আহবাব দেখতে দেখতে একসময় বলে, বন্ধ করে দাও।
মরিয়ম বলে, ভালো লাগছে না? অনেক অস্কার পেয়েছে।
আহবাব বলে, রোবোকপ-টু দেখাও। রোবোকপ-টু।
মরিয়ম তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে গিয়ে ডিভিডির শেলফ থেকে রোবোকপ-টু বার করে এনে প্লেয়ারে দিয়ে চালিয়ে দিলো। ছবি দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পর আহবাবের মুখের পেশি শক্ত হয়ে আসে।

ডাক্তার বলেন, গ্যাংগ্রিন হয়ে যাচ্ছে। পা-টা হাঁটু থেকে কেটে ফেলতে হবে।
শুনে আহবাবের বিশ্বাস হয় না। ডাক্তার এমন স্বাভাবিক স্বরে বললো যেন মনে হলো, তার নাক থেকে সর্দি ফেলে দিতে বলছে। খুব ভাবলেশহীন আর নির্বিকার। সে চোখ বিস্ফারিত করে বললো, কী বলছেন? কী কাটতে হবে?
ডাক্তার বলেন, যেখানে পায়ের জখম হয়েছে, সেখান থেকে সবটা। শুকোচ্ছে না। গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছে। হলুদ দাগ দেখা যাচ্ছে। কেটে ফেলা ছাড়া উপায় নেই।
না। কখ্খনো না। পা কাটতে দেবো না। আহবাব চিৎকার করে ওঠে। তারপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলে, ভালো করে চিকিৎসা করুন। ঘা শুকোবে। আপনি মনোযোগ দিচ্ছেন না। বলে সে বেশ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকায়। তারপর ব্যান্ডেজ বাঁধা পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, দরকার হলে আমি বিদেশে যাবো। সেখানে দেখাবো। তারা সুচিকিৎসা করবে। তারা আপনাদের মতো…। আপনাদের মতো…। উত্তেজনায় তার কথা শেষ হয় না।
ডাক্তার হেসে বলে, বেশ তো যান না। স্যাটিসফায়েড হয়ে আসুন। অনেকেই তাই করে। যাদের সামর্থ্য আছে।
আহবাব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, আগামীকালই ব্যাংককের টিকিট করো। ই-মেইলে ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নাও। তারপর মুখ বিকৃত করে বলে, এদেশে সবকিছুর স্ট্যান্ডার্ড নিচে নেমে গিয়েছে। বলে কিনা পা কেটে ফেলতে হবে। যেন মানুষের পা না, গরু-ছাগলের।
মরিয়ম তার কাছে এসে শান্তস্বরে বলে, বেশ তো যাওয়া যাবে। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে রাগ করে লাভ কী? তিনি তার মতো করে যা ভালো বুঝেছেন, তা-ই বলেছেন।
ডাক্তার ঘর ছেড়ে যেতে যেতে বললো, ব্যাংককে যাওয়ার সময় সবকিছু নিয়ে যাবেন। এক্স-রে, মেডিক্যাল রিপোর্ট। তারা সব দেখতে চাইবে।
মানিক মিয়া এভিনিউতে গাড়িটা স্পিডব্রেকারের জন্য গতি কমিয়েছে, এই সময় চোখে পড়লো আহবাবের। গাড়ির ভিড়ে সামনে সাদা পাজেরোটা উঁচু হয়ে আছে। সে উত্তেজিত হয়ে ড্রাইভার ইসমায়েলকে বললো, ওই যে সাদা পাজেরো। ওকে ধরো। ধরো। তাড়াতাড়ি চালাও।
ইসমায়েল চমকে উঠে স্পিড বাড়ায়। স্পিডব্রেকারে লেগে গাড়ি লাফিয়ে ওঠে। তারপর কিছুদূর দ্রুত সামনে ছুটে যায়। সাদা পাজেরো তাদের সামনে সাত-আটটা গাড়ির পর। সেটা ছুটছে, এঁকেবেঁকে যেন পালাতে চাইছে। সামনে, দুদিকে গাড়ির সমুদ্র, চলতে শুরু করলেই ঢেউ উঠছে যেন। আহবাব দাঁত কিড়মিড় করে বললো, তাড়াতাড়ি চালাও। ধরো ওইটাকে। যেতে দিয়ো না।
ইসমায়েল জোরে গাড়ি চালায়, কিন্তু সামনে গাড়ির ভিড়ে আটকে যায়, স্পিড বাড়াতে পারে না। সাদা পাজেরো এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো দেখা যাচ্ছে, কখনো হারিয়ে যাচ্ছে। আহবাব চিৎকার করে ওঠে, ইসমায়েল পালাতে দিয়ো না। ওকে পালাতে দিয়ো না। ধরতেই হবে।
ইসমায়েল ফার্মগেটের মাথায় চলে আসে, পাজেরোর সঙ্গে তাদের গাড়ির দূরত্ব কমে এসেছে। প্রায় ধরে ফেলবে এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালো ট্রাফিক পুলিশ। হাতের লাঠি তুলে পেছনে সব গাড়িকে থামতে বললো। ইসমায়েল ব্রেক কষলো জোরে, ঘ্যাস্স করে শব্দ হলো। ভেতরে বসে আহবাব লাফিয়ে উঠলো। সাদা পাজেরো ডান দিকে ঘুরে ভিআইপি রোড দিয়ে চলে যাচ্ছে, গাড়ির ভিড়ে মিশে গেল একসময়। ভিআইপি রোড তখন গাড়ির সমুদ্র। আহবাব প্রায় গর্জে উঠে বললো, থামলে কেন? চালাও। পাজেরো ভেগে যাচ্ছে।
ইসমায়েল সামনের দিকে হাত তুলে বললো, পুলিশ। ট্রাফিক পুলিশ। এখন যাওয়া যাইবো না।
আহবাব অস্থির হয়ে বললো, তাকে ডাকো। বলো, আমাদের জরুরি কাজ আছে। এখনই যেতে হবে।
ইসমায়েল গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে পুলিশকে ডাকলো কয়েকবার। ট্রাফিকের গর্জনে তার স্বর গিয়ে পৌঁছালো না। ইসমায়েল ক্রাচটা হাতে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো, দরজা খোলো। আমি নামবো। পুলিশকে বলবো যেতে দিতে।
ইসমায়েল পাশের দিকে তাকিয়ে বলে, দরজা খোলার জায়গা নাই। গাড়ির জাম।
আহবাব গর্জে উঠে বলে, এভাবে গাড়ি রেখেছো কেন? স্টুপিড কোথাকার। তার কথা শেষ হতে না হতে পুলিশ সরে গিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়ালো। পেছন থেকে থেমে থাকা গাড়ি আবার বাঁধভাঙা স্রোতের মতো যেতে থাকলো। ইসমায়েল ডানদিকে মোড় নিলো ভিআইপি রোডে যাওয়ার জন্য, যেদিকে সাদা পাজেরো গিয়েছে। উত্তেজিত স্বরে আহবাব বললো, জোরে চালাও। খুব জোরে। খুঁজে বার করতেই হবে। কতদূর গিয়েছে আর। এই ভিড়ে বেশিদূর যেতে পারে না। তার স্বরে জেদ।
ইসমায়েল সামনে তাকিয়ে বলে, অনেক গাড়ি। জোরে চালানোর উপায় নাই।
আহবাব রেগে গিয়ে বলে, পাজেরোটা যদি জোরে যেতে পারে, আমাদের গাড়ি কেন পারবে না? জোরে চালাও।
ইসমায়েল বলে, পাজেরো আমাদের অনেক আগে চইলা গ্যাছে। অনেক টাইম পাইছে সামনে যাবার লাগি। মনে হয়, অনেক দূর গ্যাছে গিয়া।
আহবাব সামনে ঝুঁকে অসহিষ্ণু স্বরে বলে, ধরতেই হবে। তুমি যত জোরে পারো চালাও।

কবরস্থানের গোরখোদক তাকে দেখে অবাক। মুখের হাঁ বন্ধ করে বলে, স্যার, আপনারে চেনা যায় না।
আহবাব বলে, কেন? চেনা যায় না কেন? আমার চেহারা বদলে যায়নি। একই রকম দেখায়।
গোরখোদক বলে, না স্যার। চেহারা ঠিকই আছে। বগলের নিচে লাঠিটা…। বলে সে ট্রাউজার পরা পা দুটোর দিকে তাকায়। একই রকম দেখাচ্ছে। তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না। আহবাব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহবাব সিমেন্টে বাঁধানো সরু পথ দিয়ে কবরটার কাছে যেতে যেতে বলে, ক্রাচটা লাগে না এখন। এমনিতেই হাঁটতে পারি।
কবরটার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। পেছনে গোরখোদক। সে পেছন থেকেই বলে, তাজ্জব ব্যাপার। দেইখা বোঝাই যায় না যে…। তার কথা শেষ হয় না।
আহবাব কবরটার দিকে তাকায়। মার্বেলে লেখা : আহবাব চৌধুরী, জন্ম ১৯৭৯ জানুয়ারি ২৫। মৃত্যু…। কোনো সন-তারিখ লেখা নেই শেষে। গোরখোদক বলে, এহন কি এর ভিতর থাইক্যা ওইটা….। সে কথা শেষ করে না। আহবাব তার কথায় কান না দিয়ে বলে, ঘাসে রোজ পানি দেবে। সবুজ করে রাখবে।
গোরখোদক একবার তার পা আর একবার কবরের দিকে তাকিয়ে বলে, দিতাছি স্যার। রোজই দিতাছি। দেখেন না কেমুন চকচক করতাছে ঘাস।

গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় আহবাবের। বুকটা ঢিবঢিব করছে। সে মরিয়মের পিঠে হাত রাখে। একটু করে ঠেলা দেয়। মরিয়মের ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে শুয়ে বলে, কী হলো? কিছু চাও?
আহবাব বললো, হাঁটুর নিচে ব্যথা করছে।
মরিয়ম বললো, না। ব্যথা করছে না।
আহবাব একটু রেগে গিয়ে বললো, করছে। আমার পা আমি বুঝবো না ব্যথা করছে কিনা?
মরিয়ম তার মাথায় হাত রেখে ঘুম জড়ানো স্বরে বললো, না ব্যথা করছে না। ব্যথা করতে পারে না। তুমি অন্য কিছু ভাবো।
আহবাব বিরক্ত হয়ে বলে, অন্য কথা ভাববো কেমন করে? কী আশ্চর্যের কথা। হাঁটুর নিচে ব্যথা করছে এমন সময় অন্য কিছু ভাবা যায়?
মরিয়ম এবার শান্ত স্বরে বললো, হাঁটুর নিচে ব্যথা করছে না। তোমার কল্পনা।
আহবাব ক্রুদ্ধস্বরে বলে, আমার কল্পনা? আমাকে কী মনে করছো তুমি? আমার হুঁশ নেই, ছেলেমানুষি করছি? তারপর সে শ্লেষের সঙ্গে বলে, তুমি কি ডাক্তার, কী করে জানো যে আমার ব্যথা করছে না? ব্যথা করতে পারে না?
মরিয়ম বললো, এটা জানতে ডাক্তার হতে হয় না। এমনিতেই বোঝা যায়। তুমিও বুঝবে কিছুদিন পর।
আমিও বুঝবো? কিছুদিন পর? কী করে জানলে? আহবাব অবাক হয়ে বলে।
মরিয়ম বলে, অভ্যাস হয়ে যাওয়ার পর। অভ্যস্ত হয়ে গেলে নিজেই বুঝতে পারবে।
ডাক্তার শুনে বললেন, হু। এমন হবে কিছুদিন। তিনি মনে করবেন, হাঁটুর নিচে তার পা আগের মতোই আছে। চুলকোতে ইচ্ছে করবে মাঝেমধ্যে। ব্যথা অনুভব করবেন। এভাবে কিছুদিন চলবে তার মানসিক বিভ্রান্তি। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। পায়ের ব্যথা ফিল করবেন না আপনার হাসব্যান্ড। চুলকোতেও যাবেন না ওই হাঁটুর নিচে। তিনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। ঠিক যেভাবে আপনি বলেছেন তাকে।
ওভারব্রিজে উঠেই একটু দূরে চোখে পড়লো সাদা পাজেরোটা, আশপাশের অন্য গাড়ির ওপরে উঁচু হয়ে রয়েছে তার ছাদ। রোদ পড়ে ঝলসাচ্ছে। আহবাবেরই প্রথম চোখে পড়ে। কেননা, সে রাস্তায় এলে চারদিক তাকিয়ে শুধু সাদা পাজেরোই খোঁজে। সে সামনে ঝুঁকে উত্তেজিত হয়ে বললো, ইসমায়েল ওই যে। সামনে সাদা পাজেরো। ধরো ওটাকে। এবার যেন পালিয়ে যেতে না পারে।
ইসমায়েল স্পিড বাড়ায়। হঠাৎ সামনে একটা বাস এসে পড়ে। সাদা পাজেরো ঢাকা পড়ে যায়। বাসটাকে পাশ কাটিয়েও যাওয়া যাচ্ছে না। আহবাব হতাশায়, দুঃখে, রাগে ওপরে হাত ছুড়ে বলে, ওহ্ শিট!
ইসমায়েল কিছু পর রাস্তা ফাঁকা পেয়ে সামনে গাড়ি চালায়। পাজেরোটা এঁকেবেঁকে গাড়ির ফাঁক দিয়ে রাস্তা বার করে চলে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় যেন টের পেয়েছে। পালাচ্ছে। ইসমায়েলকে বলতে হয় না, সে নিজেই যত দ্রুত পারে গাড়ি চালিয়ে যায়। পাজেরো ওভারব্রিজ ছাড়িয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে থাকে দ্রুতগতিতে। ইসমায়েল তার পিছুপিছু আসে। তখন রাস্তার দুপাশে সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠেছে। গাড়ির হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। চোখে এসে ঝলসে দিচ্ছে হলুদ আলো। পাজেরো একসময় এয়ারপোর্ট পার হয়ে উত্তরায় ঢুকলো। তারপর সেখান থেকে টঙ্গীর দিকে যেতে থাকলো। টঙ্গীর কাছে এসে হঠাৎ বাঁদিকে মোড় নিয়ে আশুলিয়ায় যেতে থাকলো পাজেরো। রাস্তায় গাড়ি কম, কিন্তু পাজেরো হঠাৎ গতি কমিয়ে দিলো। ইসমায়েল বেশ অবাক হলো দেখে। পেছনের সিটে বসে উত্তেজিত স্বরে আহবাব বললো, ধরো ওটাকে। তার সামনে গিয়ে পথ আটকে দাও।
ইসমায়েল ঘাবড়ে গেল, বেশ ভয়ও পেল। একটু পর সে তার গাড়ি জোরে চালিয়ে সাদা পাজেরোর সামনে গিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে দিলো। পাজেরো ব্রেক কষে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের গাড়িকে ঠেলে রাস্তার একপাশে নিয়ে এলো। ইসমায়েল দেখলো, রাস্তা নিচে ঢালু হয়ে নদীতে মিশেছে। পাজেরো প্রচন্ড শক্তিতে তাদের গাড়িকে ঠেলতে ঠেলতে পানিতে ফেলে দিলো। পেছনে তখনো আহবাব চিৎকার করছে, তাকে নির্দেশ দিচ্ছে। পানিতে পড়ার পর ইসমায়েলের আর কোনো কথা মনে এলো না। সে মরিয়া হয়ে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলো। ভয়ে তার বুকের ভেতরটা লাফাচ্ছে। গাড়ি পানির নিচে চলে যাওয়ার পর সে প্রাণপণে চেষ্টা করলো দরজা খুলতে, কিন্তু পানির চাপে দরজা খোলা বেশ কষ্টকর হলো। তারপর তার কোনো বোধশক্তি থাকলো না, সে বুঝতে পারলো না কী করছে, কী হচ্ছে তার আশপাশে।

কবরটার সামনে এসে মরিয়ম দাঁড়িয়েছে। পেছনে গোরখোদক আর ইসমায়েল। কবরের মার্বেলে লেখা : আহবাব চৌধুরী, জন্ম ১৯৭৯ জানুয়ারি ২৫। মৃত্যু ২০১১ জানুয়ারি ২৫।
ইসমায়েলের সবাইকে সেদিনের ঘটনা বলতে হয়। ঘটনার পরদিন থেকে প্রত্যেক দিনই বলতে হয়। বলতে গিয়ে তার গলা একটু কেঁপে ওঠে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, কীভাবে বাঁইচা গেছি কইতে পারি না। তারপর একটু থেমে নিয়ে বলে, হুনেন কই। তার স্বরে আতঙ্ক জড়ানো।